You dont have javascript enabled! Please enable it! 1972.03.14 | এবারের সংগ্রাম শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার সংগ্রাম- বঙ্গবন্ধু | দৈনিক আজাদ - সংগ্রামের নোটবুক

এবারের সংগ্রাম শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার সংগ্রাম- বঙ্গবন্ধু

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন, এবারের সংগ্রাম একটি শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার সংগ্রাম। প্রধানমন্ত্রী মঙ্গলবার সকালে শহীদ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে (রেসকোর্স) অনুষ্ঠিত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভাষণদানকালে এই ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু বাংলার জনগণের সামনে এবারের সংগ্রাম শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার সংগ্রাম ও দেশ পুনর্গঠনের মাধ্যমে নতুন দেশ গঠনের সংগ্রাম এই দুটি নতুন স্লোগান তুলে ধরেন। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, স্বাধীনতা অর্জনের চাইতে স্বাধীনতা রক্ষা করা অনেক বেশি কঠিন। তিনি বলেন যে, মানবতার সেবাই সবচেয়ে বড় সেবা। তিনি সেবার মনোবৃত্তি নিয়ে গঠনমূলক কাজে এগিয়ে যাওয়ার জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতি আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু বলেন, প্রধানমন্ত্রিত্ব আমি চাই না। আমি চাই একটি শোষণমুক্ত সমাজব্যবস্থা । আমি দেখতে চাই বাংলার মানুষ আবার হাসছে, বাংলার মাঝি আবার মনের সুখে গান গাইছে, বাংলার নিরন্ন বুভুক্ষু মানুষ পেট ভরে দুটো খেতে পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার জনগণকে ভালবাসে। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে না পারলে প্রয়োজন হলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেবো, কিন্তু বাংলার জনগণের অকৃত্রিম ভালবাসাকে হারাতে পারবো না। আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান জনাব আবদুর রাজ্জাকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা শহর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের মধ্যে স্বাধীনতা পদক বিতরণ করেন। মগবাজার ইউনিয়নের পক্ষে ঢাকা নগর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর উপপ্রধান জনাব ফজলুর রহমান ও সূত্রাপুর ইউনিয়নের পক্ষে ইউনিট প্রধান জনাব আবদুর রশীদ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করেন। ঢাকা শহরের ৭টি ইউনিট প্রধান জনাব আবদুর রশীদ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে স্বাধীনতা পদক গ্রহণ করেন। ঢাকা শহরের ৭টি ইউনিয়নের স্বেচ্ছাসেবকরা বঙ্গবন্ধুকে অভিবাদন জানান। অভিবাদন গ্রহণ অনুষ্ঠানে শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনসহ মন্ত্রী পরিষদের অন্যান্য সদস্য ও এম সি এ গণ উপস্থিত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণের শুরুতেই বিগত স্বাধীনতা আন্দোলনে ঢাকা শহরের দু’শত স্বেচ্ছাসেবকের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। স্বেচ্ছাসেবক ভাইদের আন্তরিক ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে বঙ্গবন্ধু বলেন, মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচন ও যে বিশেষ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য হাজার হাজার নাম না জানা শহীদ রক্তদান করেছেন সেই রক্ত যেন বৃথা না যায় এটা আমার নির্দেশ। বঙ্গবন্ধু বলেন, বিগত ঐতিহাসিক ৭ মার্চে যে নির্দেশ আমি দিয়েছিলাম, আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। বাংলার মানুষ সেই নির্দেশ পালনের জন্য অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেবে। বাংলাদেশ স্বাধীন করবে। লক্ষ লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে। সেই স্বাধীনতার স্বার্থক রূপায়ণের জন্য লক্ষ লক্ষ পুত্রহারা বাপ-মা গৃহহারা মানুষ নির্যাতিত মা-বোন আপনার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আরও যে কোন ত্যাগের বিনিময়ে তাদের মুখে আমরা হাসি ফুটিয়ে তুলবোই।
স্বার্থান্বেষী মহলের প্রতিঃ স্বার্থান্বেষী মহলের বিরুদ্ধে হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বঙ্গবন্ধু বলেন যে, ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা যেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীদের পেছনে ঘোরাঘুরি না করেন। তিনি বলেন যে, বাংলার মানুষ যখন পাকিস্তান হানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে পেরেছে তখন তারা দুষ্কৃতকারীদের বিরুদ্ধেও সংগ্রাম করতে পারবে।
চোরাচালানীর বিরুদ্ধে: বঙ্গবন্ধু চোরাচালানী মুনাফাখোর ও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী ও জনসাধারণের প্রতি আহবান জানান। তিনি বলেন যে, গুণ্ডা- পাণ্ডা ও দুষ্কৃতকারীদের জন্য বাংলাদেশ স্বাধীন হয় নাই। বঙ্গবন্ধু ১৬ ডিসেম্বরের পর যারা মুক্তিবাহিনী সেজেছেন সেই সব ভূয়া মুক্তিবাহিনীকে খুঁজে বের করে কঠোর শাস্তি দানের জন্যে স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতি নির্দেশ দেন। এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু স্মরণ করিয়ে দেন যে, স্বেচ্ছাসেবক ভাইরা যেন এমন কোনো কাজ না করেন যাতে জনগণ তাদের বদনাম করতে পারে। বঙ্গবন্ধু বলেন যে, যারা আমাকে মানে না, যারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে না তারাই কেবল এখনও অস্ত্র জমা দেয় নাই। তিনি এইসব দুষ্কৃতকারীদের সমূলে উৎখাত করার জন্য স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী ও জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। একটি শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তিনি গ্রামে গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সংগ্রাম শেষ হয়নি: বঙ্গবন্ধু বলেন যে, সংগ্রাম আমাদের শেষ হয়নি। বাংলার মানুষকে বাঁচাবার নতুন সংগ্রাম শুরু হয়েছে। তিনি স্বেচ্ছাসেবক ভাইদের ও জনগণকে আরও তিন বছর দেশ গড়ার সংগ্রামে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানান। তিনি দলের কর্মীদের স্মরণ করিয়ে দেন যে, বাংলাদেশ সরকার শুধু আওয়ামী লীগের সরকার নয়, এটা জনগণের সরকার।
চার স্তম্ভ: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা- সরকারের এই চার স্তম্ভ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু পুনরায় বলেন যে, এই চারস্তম্ভের বিরুদ্ধে যারা কথা বলবে বাংলার মানুষ তাদের ক্ষমা করবে না। যারা তলে তলে এই চারস্তরের বিরোধীতা করছে জনগণ তাদের কঠোর শাস্তি দেবে।
রিলিফের কাজে যোগ দিন: বঙ্গবন্ধু বেকারদের ঢাকা শহরে চাকুরির জন্য ধর্ণা না দিয়ে গ্রামে গিয়ে টেস্ট রিলিফের কাজে যোগদান করার আহ্বান জানান। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান জনাব আবদুর রাজ্জাক এম সি এ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের জবাবে আরও যে কোনো ত্যাগের বিনিময়ে অক্ষরে অক্ষরে তার নির্দেশ পালন করার আশ্বাস দান করেন। তিনি বলেন যে, অতীতের মতো বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আমরা প্রাণ দিতে প্রস্তুত।

রেফারেন্স: ১৪ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ