You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.18 | রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে পূর্ব কোণ - সংগ্রামের নোটবুক

রক্তে রক্তে লাল হয়ে ওঠে পূর্ব কোণ

(পূর্ব রণাঙ্গণ থেকে জাহাঙ্গীর আলম কর্তৃক প্রেরিত) বড় বাড়ী। দালাল মাকসুদ আলীর বাড়ী। পশ্চিম পাকিস্তান জল্লাদ-বাহিনীর একটি ইউনিট আস্তানা  গেড়েছে এ-বাড়ীতে। মাত্র কিছুক্ষণ হলাে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা গ্রেনেড ফাটিয়েছে এখানে। সাতজন পাকসেনা জায়গায় খতম। আহত দালাল মাকসুদ আলী কাতর বেদনায় মৃত্যুর প্রহর গুণছে। খবর পেয়ে এগিয়ে আসে শতাধিক পাকসেনা। বেপরােয়া গুলি চালাতে থাকে গ্রামের নিরীহ মানুষের উপর। পুড়িয়ে দেয় গ্রামের ছােট ছােট নীড়গুলাে।  তখন রাত হয়ে গেছে। নিকষ কালাে রাত। বিস্তীর্ণ ধূসর আকাশে লক্ষ তারার মিছিল। ততক্ষণে খবর চলে গেছে মুক্তিবাহিনীর গােপন ছাউনিতে। একটা দমকা হাওয়ার মতাে চঞ্চলতা ১৮জন মুক্তিসেনার মধ্যে। ওরা বেড়িয়ে পড়ে ছাউনি ছেড়ে । অদম্য এদের এ অভিযান আর নীরব সাক্ষীর মতাে বােবা চোখ নিয়ে দেখে যাচ্ছে কালের ইতিহাস। দেখে যাচ্ছে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের এ অভিযান। মেঠো পথ ধরে এগুচ্ছে ওরা। জোনাকিরা পথ দেখাচ্ছে। কানে বাজছে ঝি ঝি পোকার একটানা ছন্দময় সুর। কখনাে দ্রুত কখনাে বা মন্থর গতিতে এগুচ্ছে ওরা। জল্লাদ সেনারা তখন গ্রামের অসহায় যুবতীদের উপর জোর করে তাদের পাশবিক ক্ষুধা মেটাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরাও ততক্ষণে পৌছে গেছে। তিন তিন করে দুটি ভাগে ভাগ হয়ে ঘিরে ফেলেছে ময়মনসিংহের ছুতিয়াখালি গ্রামটি। বুকের মধ্যে একটা অদ্ভুত চঞ্চলতা। সমস্ত শরীরে তাদের আশ্চর্য শিহরণ । হয় মুক্তি, নয় মৃত্যু শপথে উজ্জীবিত ওরা। সামনেই মানবতার শত্রু। শক্তহাতে ধরা মুক্তিবাহিনীর জোয়ানদের হালকা মেশিনগানের রেঞ্জের মধ্যেই শত্রুরা। রাতের নিস্তব্ধতাকে খান খান করে ভেঙ্গে দিয়ে হঠাৎ গর্জন করে উঠলাে মুক্তি সেনাদের ৯টি হালকা মেশিনগান। ঝড় ঝড় কড় কড়, কান ফাটানাে আওয়াজ। সাড়া পড়ে গেছে পাক সেনাদের মধ্যে। না কোন পাল্টা আক্রমণের জো নেই। আতঙ্কে বিহ্বল হয়ে শুধু ছুটাছুটি করছে ওরা। ছত্রভঙ্গ হয়ে পেছনদিক থেকে পালাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কোথায় যাবে? চারিদিকেই যে তাদের মৃত্যুফাদ । মুক্তিসেনাদের অবিরাম অব্যর্থ গুলি। পালাবার পথ রুদ্ধ। তাই আহত পাক সেনাদের কেবল ভয়ার্ত আর্তনাদ।

প্রায় একঘণ্টা চলল মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ। এবারে শেষ হয়েছে মুক্তিযােদ্ধাদের হালকা মেশিনগানের আওয়াজ। বজ্র কঠিন কণ্ঠে ঘােষিত হলাে “হ্যান্ডস আপ!” নিরস্ত্র অবস্থায় মাথার উপর হাত উঁচু করে আত্মসমর্পণ করলাে ২৬ জন পাকসেনা। তাদের অপর ৩৫ জন সঙ্গীর মৃতদেহ পড়ে রইল এখানে সেখানে। পড়ে রইলাে হানাদার বাহিনীর মর্টার ও মেশিনগান। এগুলাে কুড়িয়ে নিয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা। রেখে দিয়েছে আগামী দিনের জন্যে। হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে। এমনি করেই আজ লড়ে যাচ্ছে বাংলার মুক্তি সংগ্রামীরা। হানাদার দস্যুগুলােকে খতম করছে। শত্রুদের মাঝে এখন ত্রাহি ত্রাহি রব। ভয়াল মৃত্যু ওদের গ্রাস করেছে। সংখ্যা ওদের কমে আসছে। চারিদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে মুক্তিসেনারা। হানছে আঘাতের পর আঘাত। তীব্র আঘাত। আরাে ক্রমে তীব্রতর হবে এ আঘাত। সম্বল হানাদার শত্রুদের নিকট থেকেই ছিনিয়ে আনা মারণাস্ত্র ।

সাপ্তাহিক বাংলা ॥ ১: ৫ 

১৮ নভেম্বর ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড  ০৯