মস্কোতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
মস্কো। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবর রহমান ক্রেমলিনে তাঁর সম্মানার্থে আয়োজিত ভোজসভায় যে ভাষণ দেন তার পূর্ণ বিবরণ নিচে দেয়া হলঃ
বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেন- ‘আজ আপনাদের সাথে মিলিত হতে পেরে আমি বাস্তবিক নিজেকে খুবই সম্মানিত বোধ করছি। আমি বিশেষভাবে আনন্দিত বোধ করছি এই কারণে যে, আজকের এই অনুষ্ঠানে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির জেনারেল সেক্রেটারি মি ব্রেজনেভ এবং সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেয়ামের চেয়ারম্যান মি কোসিগিনও উপস্থিত আছেন। “এইবারই সর্বপ্রথম স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের একজন প্রতিনিধি আপনাদের দেশ সফরে আসলেন। এই বাংলাদেশ স্বাধীনতা, সামাজিক ন্যায় বিচার এবং অধিকতর সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য মানব জাতির সংগ্রামে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমাদের ইতিহাসে এটা একটা বিরাট ঘটনা। ‘সারাবিশ্বে শান্তি স্থাপনের উপযোগি পরিবেশ সৃষ্টির জন্য মহান সোভিয়েত জাতি যে বিরোচিত ভূমিকা পালন করে আমরা তার প্রশংসা করি। এই ভূমিকা আপনাদের বৈপ্লবিক ঐতিহ্যেরই উপযুক্ত এবং ঐতিহ্য অনুসারেই সোভিয়েত সরকার ও সোভিয়েত জাতি শুরু হতেই আমাদের ন্যায়নীতি ও স্বাধীনতা সংগ্রামে পাশে দাঁড়িয়েছিল।” “আপনারা জানেন, পুনর্বাসনের জন্য আমরা আমাদের নিজেদের কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। ধর্মীয় কুসংস্কারের বশবর্তী হয়ে কিভাবে ধ্বংসকার্য সাধন করা হয় ও জনগণের অশেষ দুঃখ-দুর্গতি ঘটানো হয় তা আমরা দেশের জনগণ দেখেছে। জাতি ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল বাঙালিই স্বাধীন নাগরিক হিসেবে সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা ও অধিকার ভোগ করবে। আমাদের রাষ্ট্রের দ্বিতীয় মূল নীতি হলো একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির ভিত্তি স্থাপন করা। আমরা সম্পূর্ণ সচেতন আছি যে, বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র যেখানে ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ অত্যন্ত বেশি তার অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলো সামাজিক নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে উন্নতি করতে পারে না। আমরা বহুমূল্যে রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু তা রক্ষা করতে হলে দারিদ্র রোগব্যাধী ও অনাহারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়লাভ করতে হবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস আছে, আমরা যে অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করেছি তা শুধু আমাদের অর্থনীতির পথই সুনিশ্চিত করবে না, অধিকন্তু এর ফল যাতে সমভাবে সকলে ভোগ করতে পারে, তার সুষ্ঠু বন্টনের ব্যবস্থাও সুনিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের দেশ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিজ্ঞাবন্ধ। গণতান্ত্রিক নীতিসমূহ হবে আমাদের দেশের ভিত্তি। এখন হতে আপনাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা হবে যেসব নীতি ও সংস্থার দ্বারা সবরকম গণতান্ত্রিক অধিকার পূর্ণ মাত্রায় ভোগ করার সুযোগ এনে দেবে সেগুলোর বিকাশ ও উন্নতি সাধন করা। একমাত্র গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোই মানুষকে ব্যক্তিগত ও জাতীয় জীবনে মর্যাদা ও সম্মান দেয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্য হলো সকল জাতির জন্য গণতন্ত্র ও সমঅধিকার অর্জন করা। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ও তার দেশবাসী যে সাহায্য করেছেন এখানে আমি তা উল্লেখ না করে পারছি না। আমাদের পৃথিবী নানাবিধ বিরোধে পূর্ণ। সমগ্র বিশ্বে শান্তি স্থাপনের উপযুক্ত অবস্থা সৃষ্টির পথে মহান সোভিয়েত জাতি যে বিরোচিত ভূমিকা পালন করেছে আমরা তার প্রশংসা করি। বিশ্বে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সুখ-সমৃদ্ধি আনয়নের প্রচেষ্টা আমরাও যে নিজেদেরকে যুক্ত করতে পেরেছি তজ্জন্য একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে আমরাও আজ গর্ব বোধ করছি। “এখানে আমি ভিয়েতনামে যে দীর্ঘদিন যাবত মর্মান্তিক যুদ্ধ চলছে তাও উল্লেখ করছি। আমার সরকার দৃড়ভাবে বিশ্বাস করে, এই দুঃখজনক যুদ্ধের অবশ্যই অবসান ঘটাতে হবে। কারণ, এই অঞ্চলের মানুষ কী ভীষণ দুঃখকষ্ট ভোগ করছে তা আমরা আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা হতে বুঝতে পারছি। ভিয়েতনামিগণকে নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই ঠিক করার সুযোগ দিয়ে সকল বৈদেশিক সৈন্য অপসারণই হলো সেখানে শান্তি ও স্থিতি স্থাপনের একমাত্র পথ। শুধু দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতেই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বে শান্তি সুপ্রতিষ্ঠিত করার মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি সম্পর্কেও আমার সরকার ও দেশবাসী উদ্বিগ্ন। কারণ এই অঞ্চলের সহিত আমাদের দীর্ঘ দিনের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক রয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি জাতিসংঘ সনদ মোতাবেক শান্তিপূর্ণ উপায়ে মধ্যপ্রাচ্য সমস্যার অবশ্যই সমাধান করতে হবে এবং এই উদ্দেশ্যে আমার সরকার সকল প্রচেষ্টা সমর্থন করবে। আপনারা জানেন আন্তর্জাতিক ব্যাপারে আমার সরকার জোট নিরপেক্ষতার নীতিতে ওয়াদাবদ্ধ। নীতির অর্থ কোনো নিষ্ক্রিয় নীতি নয়। বিশ্ব শান্তি ও নিরাপত্তা বিধানের জন্য আমরা জাতি-গোষ্ঠীর সহিত সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করব। নিয়ন্ত্রীকরণ ও আনবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে এবং মানব জাতির স্বার্থের ব্যাপারে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এইসব গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানের পথ উদ্ভাবনের প্রচেষ্টায় আমরা কখনও পিছপা হয়ে থাকব না। “বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা প্রশ্নের সাথে আমি উন্নয়নশীল জাতিগুলির সমস্যাবলি এবং দারিদ্র্য, ব্যাধি ও নিরক্ষরতার বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের কথাও উল্লেখ করতে চাই। মনে হয়,খুব কম জাতিই এই সমস্যাগুলির গুরুত্ব ও আশু সমাধানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে । এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের একটা খুবই বিশাল অংশের এই বিরাট সমস্যার প্রতি বিশ্বের জাতিগোষ্ঠি কীভাবে সাড়া দেয় তার ওপরই বিশ্বের মানব গোষ্ঠীর ভবিষ্যত নির্ভর করে। চলাচল ও যোগাযোগ ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নতি বিভিন্ন জাতিকে আজ পরস্পরের খুবই কাছাকাছি এনেছে। পর্বত ও সাগর এখন আর কোনো বাধা নয়। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার সমস্যাসহ উন্নয়নশীল দেশগুলির সমস্যা এবং দারিদ্র রোগ ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের উল্লেখ করতে চাই। সামান্য কিছু সংখ্যক লোকই মাত্র সমস্যার ব্যাপকতা ও জরুরিত্ব উপলব্ধি করতে পেরেছে বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিরাট সংখ্যক মানুষের এই বিশাল সমস্যার প্রতি বিশ্ব সমাজ কিভাবে সাড়া দেয় এখনও তার ওপর মানবজাতির ভবিষ্যত নির্ভর করছে। পরিবহন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার বিপ্লবী পরিবর্তনের ফলে মানুষ একে অপরের নিকটতর হয়েছে। অতীতের ন্যায় এখন আর পর্বতমালা বা সমুদ্ররাজি প্রতিবন্ধক সৃষ্টি করতে পারে না। এই যোগাযোগের ফলে সমগ্র বিশ্বে একটা উন্নততর জীবন ব্যবস্থার আশা প্রদীপ্ত হয়ে উঠেছে। ধনী দেশগুলির উপলব্ধি করতে হবে যে, বিশ্বের এসব প্রাচীন সমাজকে সম্পূর্ণরূপে আধুনিক সমাজে উন্নীত করার উদ্দেশ্যে আত্মনির্ভরশীলতার সাথে ধনিক দেশগুলি হতে উন্মুক্ত সাহায্য দান করা নাহলে এই প্রদীপ্ত আকাক্ষা একটা ব্যাপক উত্তেজনা এবং তার পরে বিশ্বের বিভিন্ন এলাকায় অস্থিতিশীলতার সৃষ্টি করবে। সোভিয়েত সরকার ও জনগণ উন্নয়নশীল দেশগুলিকে সাহায্যের ব্যাপারে যে তার ভূমিকা পালন করেছে আমার সরকার সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন রয়েছে। আমি এব্যাপারে নিশ্চিত যে, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের দারিদ্র রোগ ও অশিক্ষার বিরুদ্ধে সংগ্রামে জাতিসংঘ এবং তার বিশেষজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বা বহু পাক্ষিক সম্পদ সমবেত করার জন্য তার নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করে যাবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বত্র আমি যে আন্তরিক আতিথ্য পেয়েছি, সেজন্য আমি সোভিয়েত সরকার ও জনগণের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। আমার এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, বাংলাদেশের জন্য আপনার দেশের শুভেচ্ছার ভাণ্ডার যে কত গভীর তারই প্রতিফলন ঘটেছে এর মধ্যে। আমি নিশ্চিত যে, সোভিয়েত জন প্রতি বাংলাদেশের জনগণেরও শুভেচ্ছা রয়েছে। বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের এই শুভক্ষণে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং এই মহান দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মহান জনগণের শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করছি।
রেফারেন্স: ১ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ