বাংলাদেশ সোভিয়েত সম্পর্ক এশিয়ায় রাজনৈতিক ভারসাম্য পালটে দিতে পারে
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মস্কো সফর নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বঙ্গবন্ধু সফরে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বলেছেন, বাংলাদেশের জনগণের শুভেচ্ছা নিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এশিয়ার এ অঞ্চলে সাম্প্রতিক তৎপরতার প্রেক্ষিতে এ সফর শুভেচ্ছাগন্ডী পার হয়ে পারষ্পরিক মৈত্রী সহযোগিতার ক্ষেত্র প্রশস্ততর করবে এ বিষয়ে সন্দেহ নাই। সোভিয়েত পত্রপত্রিকা বঙ্গবন্ধুর সফর উপলক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অতীত পাতাগুলো উলটে তাদের ভূমিকা এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে চীন মার্কিন অশুভ আঁতাত সম্পর্কে মন্তব্য করছে। এটা সর্বশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। নিক্সন সম্প্রতি চীন সফর শেষ করেছেন। এখন বাংলাদেশ তাঁর হৃত মর্যাদা উদ্ধারের জন্য কিভাবে টোপ ফেলবে তা নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নানা ধরনের কৌশলের আশ্রয় করবে। এমতাবস্থায় রাশিয়া নিজের ভূমিকা ও নিক্সন সরকারের ভূমিকার তুলনামূলক বিচারকে বঙ্গবন্ধুর সফরকালে পুনরায় তুলে ধরছে তা নিছক রাজনৈতিক প্রচারণা নয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গেলেন। তিনি সেখানে চারদিন অবস্থান করে প্রধানমন্ত্রী আলেকজাই কোসিগিন প্রেসিডেন্ট পোদগর্নি ও পার্টি প্রধান ব্রেজনেভ সহ বিশিষ্ট সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সরকারিভাবে বাংলাদেশ-সোভিয়েত সহযোগিতার ভিত মজবুত করার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের এই সফরের সুদূরপ্রসারী গুরুত্ব রয়েছে। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য ও সহযোগিতা দান করেছেন সেজন্য প্রধানমন্ত্রী মুজিব এই সফরের সুযোগে সোভিয়েত ইউনিয়নের শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করবেন। এছাড়া তাঁর এই সফরের ফলে মহান বন্ধু রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্ব স্থিতিশীল ও সুদৃঢ় হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বঙ্গবন্ধুর সোভিয়েত সফরের অপরিসীম রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্বশান্তি ও জোট নিরপেক্ষ নীতিতে বিশ্বাসী। বাংলাদেশ শুধু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীই নয় ঔপনিবেশিক শাসন শোষণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়েই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে। সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতির মুক্তি সংগ্রামে মহান সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন বরাবর দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিয়ে আসছেন। বিশ্বশান্তিরও মহান প্রহরী সোভিয়েত ইউনিয়ন। কাজেই এশিয়াকে সাম্রাজ্যবাদী শোষণজাল এবং যুদ্ধের পায়তারা থেকে মুক্ত করার ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নীতির মাঝে ঘনিষ্ঠ সংযোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়া দরকার। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পিকিং সফরের ফলে মার্কিন চীন সহযোগিতার যে নতুন ক্ষেত্র তৈরি হলো তাতে করে এশিয়ার নীতিগত জাতিগুলোর ওপর চীন মার্কিন খবরদারী এবং সাম্রাজ্যবাদী রূপপায়তারা নতুন কৌশলে পরিচালিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। চীন এবং মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ যদি এশিয়াকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করার কোন গোপন ফন্দি এটে থাকে তা হলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোর জন্য তা অত্যন্ত আশঙ্কার কথা। তাদের এরকম দুরভিসন্ধির খপ্পর থেকে এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশগুলোর আত্মরক্ষার প্রধান ভরসা হচ্ছে সোভিয়েত ইউনিয়ন।
চীন ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামের শুধু বিরোধিতাই করেনি স্বাধীনতা বানচাল করার জন্য নানাভাবে চক্রান্তও করেছে। সে চক্রান্ত আজও চলছে এবং ভবিষ্যতেও যে চলবে না তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কাজেই বহু ত্যাগ এবং অনেক রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করতে হলে আন্তর্জাতিক শক্তিবর্গের চক্রান্ত থেকে আত্মরক্ষার যুক্তিসিদ্ধ পন্থা বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে হবে। এ ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্ধুত্ব এবং সাহায্য সহযোগিতা হবে সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। এই পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর বর্তমান সোভিয়েত সফরের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতাঃ সোভিয়েত ইউনিয়ন শুধু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সাম্রাজ্যতন্ত্রী দেশই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের পরেই পৃথিবীর সর্বোশ্রেষ্ঠ শিল্পোন্নত রাষ্ট্র। বাংলাদেশের বিধ্বস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য জরুরী চাহিদা পূরণ এবং ভবিষ্যৎ দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন প্রকল্পে কারিগরী ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা লাভের ব্যাপারে সোভিয়েত ইউনিয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে পারে। বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বাস্তবায়নে ওয়াদাবদ্ধ। কাজেই অনুন্নত অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক পরিকল্পনার ভিত্তিতে কীভাবে দ্রুত উন্নত করা সম্ভব সে বিষয়েও সোভিয়েত ইউনিয়নের অভিজ্ঞতা এবং সাহায্য সহযোগিতা বাংলাদেশের পক্ষে অত্যন্ত উপকারী হবে। সোভিয়েত ইউনিয়নের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা এবং সাহায্য সহযোগিতার পূর্ণ সদ্ব্যবহারের ব্যাপারেও বঙ্গবন্ধুর এ সফর তাই বিশেষ সহায়ক হবে।১
রেফারেন্স: ১ মার্চ ১৯৭২, দৈনিক আজাদ
দিনলিপি বঙ্গবন্ধুর শাসন সময় ১৯৭২, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ