নির্যাতনের কষাঘাতই দেশবাসীকে সাফল্যের স্বর্ণদ্বারে পৌঁছাইয়া দিবে
সংগ্রামী শপথদীপ্ত বগুড়াবাসীর প্রতিক শেখ মুজিবের আশ্বাস
(ইত্তেফাকের বিশেষ প্রতিনিধি)
বগুড়া, ৯ই এপ্রিল।-পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবর। রহমান গতকাল এই ছােট্ট শহরের বুকে অর্ধলক্ষাধিক লােকের এক সভায় ঘােষণা করেন যে, বহু ত্যাগ ও সংগ্রামের মাধ্যমে এই দেশের জনগণ তাহাদের স্বাধীনতা অর্জন করিয়াছে। সুতরাং জনগণকেই ইহার ফল ভােগ করিতে দিতে হইবে। স্বার্থন্বেষী মহল কিংবা তাঁহাদের ক্রীড়নকদের রাজত্বের জন্য দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয় নাই।
স্থানীয় এডওয়ার্ড পার্কে গতকাল আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আয়ােজিত এই জনসভায় শ্রোতমণ্ডলীর বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে শেখ সাহেব উপরােক্ত ঘােষণা করেন। তিনি বলেন যে, শােষণ ও বিশ্বাসঘাতকতার চির অবসান ঘটাইবার জন্য আওয়ামী লীগ শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালাইয়া যাইবে। শ্রমিক-কৃষক-বুদ্ধিজীবী তথা সকল শ্রেণীর, নাগরিকের এই সভা শ্রোতমণ্ডলীর পীড়াপীড়িতে রাত্র ১০টা পর্যন্ত অব্যাহত রাখিতে হয়। এই মহতি জনসভার মাধ্যমে অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রদেশের এই ছােট্ট শহরের মানুষের চোখেমুখে দৃপ্ত শপথের যে অভিব্যক্তি ঘটে, তাহা লক্ষ্য করিলেই বুঝা যাইবে দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাহারা কতখানি উদ্বিগ্ন ও আগ্রহী। তাঁহারা জানেন, তাঁহাদের অভীষ্ট লক্ষ্য একদিন অর্জিত হইবেই—অবসান ঘটিবে বর্তমান অমানিশার। সেই দিন আর দূরে নয়। সভার প্রধান বক্তা পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবর রহমান তুমুল। হর্ষধ্বনির মধ্যে বক্তৃতা করিতে উঠিয়া ঘােষণা করেন যে, শােষণের যাঁতাকল। হইতে দেশবাসীকে মুক্ত করাই আওয়ামী লীগের নীতি। ৬-দফা কর্মসূচী একাধারে পাকিস্তানের জনগণের মুক্তিসনদ, এই অভিমত প্রকাশ করিয়া শেখ সাহেব তাঁহার দীর্ঘ বক্তৃতায় এক এক করিয়া ৬-দফার ব্যাখ্যাদান করেন। তিনি বলেন যে, ইহা কোন দলের প্রয়ােজনে প্রণীত রাজনৈতিক কর্মসূচী নয়—পাকিস্তানকে সত্যিকারভাবে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই এই কর্মসূচী গ্রহণ করা হইয়াছে। প্রকৃত রাজনৈতিক মনােভাব লইয়াই ইহার বিচার করিতে হইবে। জনগণকে কোন। পথে লইয়া যাওয়া হইতেছে, তাহা ভাবিয়া দেখার জন্য তিনি জনসাধারণের নিকট আহ্বান জানান।
শেখ সাহেব ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাস করে বলিয়া ভারতকে পাকিস্তানের ভূমি দখল করিতে দিবে একথা কেবল তাঁহারই বলিতে পারেন যাঁহারা দেশ ও দশের স্বার্থে বিশ্বাস করেন না, কেবল ব্যক্তিস্বার্থই চিনেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের কোন নাগরিক ভারতের নিকট পাকিস্তানকে বিকাইয়া দিতে পারেন, একথা কেবল তাহারাই বলিতে পারেন, যাঁহারা দেশ ও দশের স্বার্থ পদদলিত করিয়া কেবল স্বীয় ভাগ্য গড়িতেই অভ্যস্ত।
হয় মানুষের মত বাঁচার না হয় মানুষের মত মরার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবহেলিত অবস্থা যদি আরও ১০ বৎসর অব্যাহত থাকে। তাহা হইলে এখানকার মানুষের আর কাপড় পরারও সঙ্গতি থাকবে না। পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানরা হিন্দুদের সামনে জুতা পরিতে পারিত না বলিয়া প্রেসিডেন্ট আউয়ুব যে মন্তব্য করিয়াছেন, শেখ মুজিব তাহাকে পারিতাপজনক বলিয়া অভিহিত করেন।
শেখ সাহেব বলেন যে, এই মন্তব্য দ্বারা প্রেসিডেন্ট আইয়ুব আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানীদের অপমান করিয়াছেন। রাষ্ট্রপ্রধানের পক্ষে অনুরূপ মন্তব্য অশােভনীয় বলিয়া শেখ মুজিবর রহমান অভিমত প্রকাশ করেন।
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রেসিডেন্ট আইযুবকে রাজনৈতিক ইস্যুসমূহের বিচার-বিবেচনার সময় যুক্তিবাদী মনােভাব গ্রহণের অনুরােধ করেন। শেখ মুজিব বলেন যে, ছয়-দফা রাজনৈতিক দরকষাকষির কোন ব্যাপার নহে, ইহার সহিত জড়িত রহিয়াছে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের জীবন-মরণ প্রশ্ন। এমতাবস্থায় ৬-দফার প্রশ্নটিকে হালকাভাবে গ্রহণ না করার জন্য তিনি সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আবেদন জানান।
ছয়-দফা পরিত্যাগ করিব, যদি-
আওয়ামী লীগ সভাপতি তাহার বক্তৃতায় আরও বলেন যে, প্রেসিডেন্ট আইয়ুব যদি শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় রাজধানী পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তরে রাজী হন তাহা হইলে তিনি নিজের ছয়-দফা প্রত্যাহার করিতে প্রস্তুত আছেন। জনসভায় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজুদ্দিন আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী এম, এন, এ খােন্দকার মােস্তাক আহমদ এডভােকেট, মনসুর আলী এবং শাহ মােয়াজ্জেম হােসেনও বক্তৃতা করেন।
দৈনিক ইত্তেফাক, ৯ এপ্রিল ১৯৬৬