You dont have javascript enabled! Please enable it! ধর্মীয় নেতা ও রাজনীতিবিদ মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী - সংগ্রামের নোটবুক

আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা (১৮৮০-১৯৭৬)

আব্দুল হামিদ খান একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতা। সবার কাছে মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত। তিনি কৃষক, শ্রমিক তথা সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে সোচ্চার ছিলেন। আসামের ভাসানচরে বাঙালী কৃষকদের বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি বাঁধ নির্মাণ করেন। ঐ এলাকার লোক তাঁকে ‘ভাসানী সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। পরবর্তীতে তিনি মওলানা ভাসানী নামেও সমধিক পরিচিতি লাভ করেন।
সিরাজগঞ্জ জেলার ধনপাড়া গ্রামে ১৮৮০ সালে ভাসানী জন্মগ্রহন করেন। পিতা হাজী শরাফত আলী খান। স্থানীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় অধ্যয়ন করেন। তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত ব্যক্তি।
টাঙ্গাইলের কাগমারিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর তিনি ময়মনসিংহের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।
১৯১৯ সালে কংগ্রেসে যোগদানের মধ্যে দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। তিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন এবং তাঁর আহবানে বেশকিছু কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৩৭ সালে তিনি মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং আসাম শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।
‘৪৭- পরবর্তী সময়ে তিনি পূর্ববাংলায় আসেন। ১৯৪৯ সালের ২৩-২৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লীগ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হন মওলানা ভাসানী।
ভাসানীর নেতৃত্বে এ প্রদেশের দুর্ভিক্ষাবস্থার প্রতিবাদে একটি শোভাযাত্রা সচিবালয় অভিমুখে অগ্রসর হলে ভাসানীসহ অনেক নেতা গ্রেফতার হন। ভাসানী কারাগারের অভ্যন্তরে এর প্রতিবাদে অনশন শুরু করেন। অবস্থা সংকটাপন্ন হলে ১৯৫০ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি সরকারের তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠন করেন। যুক্তফ্রন্টের তিনি ছিলেন অন্যতম নেতা। পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন ও বৈদেশিক নীতির ব্যাপারে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৭ সালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ নামে একটি নতুন দল গঠন করেন এবং সভাপতি হন। আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন নেতৃত্বের প্রশ্নে চীনপন্থী ও সোভিয়েতপন্থী এ দুই শিবিরে বিভক্ত হলে পূর্ব পাকিস্তানও দ্বিখন্ডিত হয়। ভাসানী চীনপন্থী অংশের নেতৃত্ব গ্রহন করেন।
তিনি ১৯৬৯ এর আইয়ুব বিরোধী গণ-আন্দোলনে অগ্রনী ভূমিকা পালন করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও মুজিবের মুক্তির দাবি জানান। ‘৭০ নভেম্বরে প্রলয়ঙ্গরী ঘুর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য নির্বাচন বয়কট করেন। পাকিস্তানী শাসকচক্রের কেউই ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্য করার জন্য না এলে তিনি বলেছিলেন সেই বিখ্যাত উক্তি ‘ওরা আসেনি’ অর্থাৎ তিনি এর মাধ্যমে শাসকচক্রের কাছে এদেশের মানুষের গুরুত্ব কেমন তা বোঝাতে চেয়েছেন। ঢাকায় পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি ‘স্বাধিন পূর্ব পাকিস্তান দাবী’ উত্থাপন করেন। এ জনসভায় তিনি পাক শাসকচক্রকে বলেছিলেন ‘ওয়ালাইকুমসালাম’। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন মেনে না নিলে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সকল সম্পর্ক ছেদ সম্পর্কে এ উক্তি বলেন। তাঁর এ দুটো উক্তিই সেসময় সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের বীজ বপনে সহায়তা করে। তিনি শেখ মুজিবের অসহযোগ আন্দোলনকে (৩-২৫ মার্চ) সমর্থন করেন। তিনি মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ভারতে গমন করেন এবং ২২ জানুয়ারী ১৯৭২ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি ‘ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী’ চুক্তিওর বিরোধীতা করেন। ফারাক্কা চুক্তিকে তিনি বাংলাদেশের পরিপন্থী বলে মনে করেন এবং ১৫ মে ১৯৭৬ রাজশাহী থেকে ফারাক্কা অভিমুখে এক মিছিলের নেতৃত্ব দেন। তিনি আজীবন নিপীড়িত ও নির্যাতিত মানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর মৃত্যুবরণ করেন, তাকে সন্তোষে সমাহিত করা হয়।

[৭৩]             মোহাম্মদ সেলিম

রেফারেন্স: মুক্তিযুদ্ধ কোষ (প্রথম খণ্ড) – মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত