আমাদের বাঁচার দাবি ছয়-দফা কর্মসূচী
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ছয়-দফা কর্মসূচী দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালােচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনদের এই চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশব্যাপী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও নায্য দাবি যখনই উঠিয়াছে, তখনই এই দালালরা এমনিভাবে হৈ হৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব-পাক জনগণের মুক্তিসনদ একুশ দফাদাবি, যুক্ত-নির্বাচন প্রথার দাবি, ছাত্র তরুণদের সহজ ও স্বল্প ব্যয়ে শিক্ষা লাভের দাবি, বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি ইত্যাদি সকল প্রকার দাবির মধ্যেই এই শােষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।
আমার প্রস্তাবিত ছয়-দফা দাবিতেও এরা তেমনিভাবে পাকিস্তান দুই টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরােপ করিতেছেন। আমার প্রস্তাবিত ছয়-দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে পাঁচ কোটি শােষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে, তাহাতে আমার কোনও সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায় সংবাদে ও সভাসমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণীর সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গােটা দেশবাসীর উৎসাহ-উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি। তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ছয়-দফা দাবি অনুমােদন করিয়াছে। ফলে ছয়-দফা দাবি আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবিতে পরিণত হইয়াছে। এ অবস্থায় কায়েমী স্বার্থ শােষকদের প্ররােচনায় জনগণ বিভ্রান্ত হইবে না সে বিশ্বাস আমার আছে।
কিন্তু এ-ও আমি জানি জনগনের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম, তাঁহাদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এঁদের অফুরন্ত, মুখ এঁদের দশটা, গলার সুর এঁদের শতাধিক, এঁরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারি দলে; আবার ইসলাম ও গণতন্ত্রের দোহাই দিয়া এঁরা আছেন অপজিশন দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনীর বেলায় এরা সকলে একজোট। এরা নানা ছলাকলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এঁরা ইতিমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার-সচেতন দেশবাসী বিভ্রান্ত হইবেন না, তাতে আমার কোন সন্দেহ নাই। তথাপি ছয়-দফা দাবির তাৎপর্য ও উহার অপরিহার্যতা, জনগণের মধ্যে প্রচার করা সমস্ত গনতন্ত্রী, বিশষত আওয়ামী লীগ কর্মীদের অবশ্য কর্তব্য। আশা করি, তাঁরা সকলে অবিলম্বে ছয়-দফার ব্যাখ্যায় দেশময় ছড়াইয়া পড়িবেন। কর্মীভাইদের সুবিধার জন্য ও দেশবাসী জনসাধারণের কাছে সহজবােধ্য করার উদ্দ্যেশে আমি ছয়-দফার প্রতিটি দফার দফাওয়ার সহজ সরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এই পুস্তিকা প্রচার করিলাম। আওয়ামী লীগের তরফ হইতেও এ বিষয়ে আরও পুস্তিকা ও প্রচার-পত্র প্রকাশ করা হইবে। আশা করি, সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী, বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের কর্মীগণ ছাড়াও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানিমাত্রেই এই সব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করিবেন।
দৈনিক ইত্তেফাক, ১৯ মার্চ ১৯৬৬