আওয়ামী লীগের প্রবাসী নেতৃত্ব
নয়াদিল্লী থেকে সচিত্র প্রতিবেদনঃ মাহফুজউল্লাহ
ঢাকা থেকে প্রতিবেদনঃ আহমেদ নূরে আলম | শেহাব আহমেদ | জগলুল আলম
(বেগম হাসিনা ওয়াজেদ এর সাক্ষাৎকার এই আর্টিকেলের নীচে দেখুন।)
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/sheikh-hasina.pdf” title=”sheikh hasina”]
পান্ডেরা রোডের ডি-টু কলোনীর ১৪ নম্বর ফ্ল্যাট।
দিল্লীর পালাম বিমান বন্দর থেকে ট্যাক্সিতে প্রায় ৩০ মিনিটের পথ। হঠাৎ করেই বাড়িটা এখন মর্যাদা পেয়েছে। বাড়ির লোকজনের নিরাপত্তার জন্য প্রহরা বসেছে। ভারতের গোয়েন্দা পুলিশের খাতায় নাম না লিখে কারো ভেতরে ঢোকার জো নেই।
পান্ডেরা রোডের এই বাড়িটি দিল্লীর অভিজাত এলাকায়। রাস্তার এক দিকে থাকেন বিদেশী কুটনৈতিকরা। অন্য দিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের যুগ্ম সচিবের পদমর্যাদার অফিসাররা। দ্বিতল ফ্ল্যাটগুলো নগরীর কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন। কিন্তু নাগরিক সুযোগ সুবিধা সীমিত নয়।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের পর থেকে বাড়ির লোকজনের জীবনে তেমন কোন বৈচিত্র্য ছিল না। সব কিছুই চলছিল স্বাভাবিক নিয়ম মাফিক।
বাঙলাদেশের রাজধানী ঢাকায় গৃহীত ৮১ সালের ফেব্রুয়ারীর একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছে গোটা বাড়ির চেহারা। সাংবাদিকরা আসছেন খবরের আশায়। ফুলের তোড়া নিয়ে স্বাগত জানাতে এসেছেন বাঙলাদেশ থেকে, রাজনৈতিক নেতারা। এসেছেন কংগ্রেস ও যুব কংগ্রেস নেতারা। প্রিয়রঞ্জন দাশ মুনসী, সৌগত বন্দ্যোপাধ্যায় সহ অনেকে। এসেছেন ভারত প্রবাসী কাদের সিদ্দিকী, ডঃ মযহারুল ইসলাম প্রমুখ। কাদের সিদ্দিকীই একমাত্র ব্যক্তি যাকে গোয়েন্দা খাতায় নাম লেখাতে হয় না। তার গাড়ির নম্বরটাই অতি পরিচিত।
১৬ ফেব্রুয়ারী অনুপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সভানেত্রী বেগম হাসিনা ওয়াজেদ (৩৩) স্বামী – পুত্র – কন্যাসহ এই বাড়িতেই থাকেন। প্রথম যখন রাজনৈতিক আশ্রয় মিলেছিল তখন উঠেছিলেন অন্যত্র। পরবর্তীতে পেয়েছেন এই বাড়িটি।
গত পাঁচ বছরে আদৌ দেশে ফিরবেন কিনা, ফিরলেই বা কবে ফিরবেন, রাজনীতি করবেন কিনা এসব প্রশ্ন ছিল অভাবনীয়।
ছাত্রজীবনে, ১৯৬৭ সালে শেখ মুজিবের কন্যা হিসেবে ইডেন গার্লস কলেজের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়া ছাড়া রাজনীতির সঙ্গে পরিবার কাঠামোর বাইরে কোন যোগাযোগ ছিল না। দীর্ঘ ১৩ বছর পর বেগম হাসিনা ওয়াজেদ এখন জাতীয় সংসদে বৃহত্তম বিরোধী দল আওয়ামী লীগের সভানেত্রী।
ভরত যেমনি সিংহাসনে রামের জুতা রেখে দেশ শাসন করেছিলেন, আওয়ামী লীগের তেমনি প্রয়োজন ছিল ‘ঐক্যের’ কারণে মুজিবের উত্তরাধিকারীকে সভানেত্রী নির্বাচনের। কিন্তু ফেব্রুয়ারী সিদ্ধান্তের আগেও হাসিনা ছিলেন মালেক উকিলের ভাষায় ‘এ্যাবাভ কন্ট্রোভার্সি’ অথবা রাজ্জাকের ভাষায় ‘হাসিনা – রেহানার স্থান সবকিছুর উর্ধ্বে ‘। (বিচিত্রা, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮১)
কিন্তু হাসিনা এখন আর সব কিছুর উর্ধ্বে নন। কেননা হাসিনাকে কেন্দ্র করেই ভারত এখন স্বপ্ন দেখে, অকৃতজ্ঞ বাংলাদেশকে শিক্ষা দেবার, বাংলাদেশের সঙ্গে কঠোর ব্যবহারের। কেননা এই জাতি ভারতের অবদান ও বন্ধুত্বকে ভুলে গেছে। (সম্পাদকীয়, আনন্দ বাজার পত্রিকা, ৪ ঠা মার্চ, ১৯৮১)
১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগস্টের ঘটনার পর শেখ হাসিনা তার পিতার যে বন্ধুদের দায়ী করেছিলেন আজ আবার তিনিই তাদের সহযাত্রী৷ সেই দিনগুলোতে তাকে যখন এককভাবে সব সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়েছে তখন এরা কেউ তার পাশে ছিলেন না। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ও তার মিলেছে ‘মুজিব তনয়া’ হিসেবে, আওয়ামী লীগ কর্মী বা নেত্রী হিসেবে নয়।
রাজনৈতিক আশ্রয়ের নেপথ্য কাহিনী
১৯৭৫ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ইউরোপে তখন শীত নামতে শুরু করেছে। একটি গাড়ি এসে ঢুকল পশ্চিম জার্মানীতে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত মিঃ রহমানের বাড়িতে।
গাড়ির আরোহী গাড়ি থেকে নামতেই এগিয়ে এলেন রাষ্ট্রদূত। মনোভাব ব্যক্ত করতেই রাষ্ট্রদূত বললেন, লিখিতভাবে আবেদন জানাতে।
আবেদনকারীর কাছে কোন কলম নেই। উত্তেজনায় তার শরীর কাঁপছে। রাষ্ট্রদূতের সহকারী লিখে দিলেন আবেদন পত্র – ‘খাঁটি ও নির্ভেজাল রাজনৈতিক আশ্রয়ের ‘।
গাড়িটি ফিরে গেল ফ্রাংকফুর্ট বিমান বন্দরে। দিল্লী এসে নামলেন ভারতের রাজনৈতিক আশ্রয় লাভকারী পারমাণবিক পদার্থ বিজ্ঞানী ডঃ ওয়াজেদ, স্রী হাসিনা ওয়াজেদ এবং তাদের দু সন্তান।
প্রথম অবস্থায় দিন কেটেছে অনিশ্চয়তায়। ধীরে ধীরে অবস্থার উন্নতি ঘটেছে। বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদন ছাড়াই বাংলাদেশের কোটা থেকে ডঃ ওয়াজেদকে দেয়া হয়েছে পোস্ট – ডক্টরাল ফেলোশীপ। অন্যান্য সুযোগ সুবিধে ছাড়া মাসিক ভাতা ভারতীয় মুদ্রায় ২২০০ টাকা৷
কাজ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজ মিলেছে বই লেখার। ইতোমধ্যে একটি বইয়ের পান্ডুলিপিও শেষ করে ফেলেছেন ডঃ ওয়াজেদ। বই ছাপা ও ফেলোশিপের মেয়াদের কারণেই সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের আগে ভারতের বাইরে যেতে পারবেন না ডঃ ওয়াজেদ।
কিন্তু স্ত্রীর নতুন পরিচয় তার জন্য সুখবর নয়। যেমন করেই হোক তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়াতে চান না। ফিরেও আসতে চান না দেশে। কেননা, যোগ্যতার মাপকাঠিতে ‘চাকুরী একটা মিলবে অন্য কোথাও।’ তার দুঃখ অন্যত্র। এক সময় সবাই বলত, ‘বঙ্গবন্ধুর জামাই’, আর এখন বলবে ‘হাসিনার স্বামী ‘।
বেগম হাসিনা ওয়াজেদ ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহন করলেও, দিল্লীস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনারের ভাষায় ‘তার পাসপোর্ট আমরা নবায়ন করেছি।’ এবং তা ডঃ ওয়াজেদ ও শেখ হাসিনা ওয়াজেদের আবেদনক্রমেই করা হয়েছে।
ভারতীয় মুদ্রায় ৩১ টাকা ৯০ পয়সা ফি দিয়ে হাসিনা তার পাসপোর্ট (নম্বর বি ০৯৬২৩১, তারিখ ১৮-৪-৭৫) নবায়িত করেছেন ২৬ ডিসেম্বর ৭৯। কিন্তু তার পাসপোর্টে কোন ভারতীয় ভিসা নেই। ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহন নিয়ে কেন প্রশ্ন উঠবে তার কারণ হাসিনা খুঁজে পান না। (সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য)
স্বামী ও নিজের কথা চিন্তা করেই হাসিনা প্রথমে সভানেত্রীর পদ গ্রহণ করতে রাজি হন নি। কেননা প্রতিবারই ঢাকা থেকে যখনই ফোন এসেছে, স্বামী বাসায় ছিলেন বলে মত দিতে পারেন নি। যখন মত দিয়েছেন তখন স্বামী বাসায় ছিলেন না। ডঃ ওয়াজেদের কাছে এখন আর এটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি সিদ্ধান্তের সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে চাইছেন কেননা ‘ওটা তার ব্যাপার! ‘
দেশে ফেরার ব্যাপারে ডঃ ওয়াজেদ অনিশ্চিত। আণবিক শক্তি কমিশনের চাকুরী স্থল থেকে ছুটির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় যখন তিনি ছুটি চেয়ে দরখাস্ত দিয়েছিলেন, তখন ভারতে জনতা সরকার ক্ষমতাসীন। তাকে ছুটি না দিয়ে বলা হয়েছিল ‘কারণ দর্শাতে কেন অনির্ধারিত ছুটির জন্য তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে না? ‘ ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় আসার পর তার দরখাস্তের জবাবে বলা হয়েছে, ‘আমরা আপনার প্রত্যাবর্তন আশা করছি।’
ভারতীয় পত্র-পত্রিকার উল্লাস
বেগম হাসিনা ওয়াজেদ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হওয়ার সংবাদ দিল্লী পৌছুতে না পৌছুতেই সেখানকার পত্র পত্রিকা উল্লাসে ফেটে পড়ে। বিভ্রান্তিকর খবর ও মন্তব্য সহ প্রকাশিত হচ্ছে দীর্ঘ প্রতিবেদন।
‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ ১৯ ফেব্রুয়ারী মন্তব্য করেছে ‘তার নির্বাচনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে তাৎক্ষণিক। খবর ছড়িয়ে পড়তেই ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় মিষ্টি বিতরণ করা হয় এবং লোকজন আনন্দে নাচতে থাকে৷ আপাততঃ তার নির্বাচন ছিল প্রয়োজনীয়তা। মতবিরোধে আক্রান্ত আওয়ামী লীগ অন্য কোন নামে রাজী হতে পারেনি।
ভারতের মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির দৈনিক পত্রিকা ‘প্যাট্রিয়ট’ ২৮ ফেব্রুয়ারী মন্তব্য করেছে ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সমন্বয়ে গঠিত বাকশালের আদর্শ ও উদ্দেশ্যই এখন আওয়ামী লীগ গুরুত্ব দিচ্ছে। ‘
২ রা মার্চের প্যাট্রিয়ট প্রথম পৃষ্ঠায় তার তিন কলাম ব্যাপী ছবি ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে বলেছে, ‘তাে নির্বাচন বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের মনে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছে।’
একই সাক্ষাৎকারে মিসেস ওয়াজেদ ভারতের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন তাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ আশ্রয় ও নিরাপত্তা দেয়ার জন্য। ‘
ভারতীয় বার্তা সংস্থা ইউ এন আই’ র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বেগম হাসিনা ওয়াজেদ মন্তব্য করেছেন ‘ভারত ৭১ সালে আমার দেশকে সাহায্য করেছে এবং আমি আশা করি প্রয়োজনে আবার সাহায্য করবে। ‘
কিন্তু এ সাক্ষাৎকারে তার সোভিয়েত ইউনিয়ন সম্পর্কে নীরবতা লক্ষণীয়।
একই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, চট্টগ্রামের চাষীরা আমার প্রত্যাবর্তনকে স্বাগত জানানোর জন্য ঢাকা আসছে।’
ভারতীয় পত্র-পত্রিকা তার সমস্ত সাক্ষাৎকারকে চিত্রিত করেছে ১৫ ই আগস্টের ঘটনার নায়কদের বিচারের উজ্জ্বল সম্ভাবনা হিসেবে। এবং বাংলাদেশের নয় কোটি মানুষের প্রাণের উল্লাস হিসেবে। রাজনৈতিক ভাবে হাসিনার দাবীও একটিই।
ভারতীয় দৈনিক ‘হিন্দু’ ১৯ ফেব্রুয়ারী সম্পাদকীয় কলামে মন্তব্য করেছে ‘প্রেসিডেন্ট জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলে ব্যাপক কর্মীদের যোগদানের ফলে আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী সমর্থন হারানোর সংকটের সম্মুখীন হয়েছিল। একই সঙ্গে দলে মস্কোপন্থীদের অনুপ্রবেশ ঘটে।’
আওয়ামী নেতাদের দিল্লী সফর
প্রবাসী নেতৃত্বকে নির্বাচিত করে, সংগঠনকে জোড়াতালি দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ছুটে যান দিল্লী, ২৪ ফেব্রুয়ারী। দিল্লী বিমান বন্দরে অন্যান্য বাংলাদেশীদের মত এসব নেতাকে কোন ঝামেলা পোহাতে হয়নি। যেতে হয়নি শুল্ক অনুসন্ধানের কড়াকড়ির ভেতর৷ আওয়ামী নেতাদের বহনকারী বিমান পালাম বিমান বন্দরে পৌছুতেই একটি সাদা মাইক্রোবাস তুলে নেয় নেতাদের৷ ছুটে বেরিয়ে যায় গন্তব্য স্থলের দিকে। যে কারণে বিমান বন্দরে ভারতীয় সাংবাদিকরা তাদের সঙ্গে কোন আলাপ করতে পারেননি।
আওয়ামী নেতারা চিরাচরিতভাবেই কোন হোটেলে ওঠেন নি। বিশেষ ব্যবস্থাধীনে তারা ওঠেন নয়া দিল্লীর ডিফেন্স কলোনীতে অবস্থিত ভারতীয় ইস্পাত কর্পোরেশনের অতিথিশালায়। যা দিল্লীতে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এর বাড়ী হিসেবে চিহ্নিত।
মহিলা নেত্রীরা উঠেছিলেন বেগম হাসিনা ওয়াজেদের বাড়িতে। কিন্তু হাসিনা বিমান বন্দরে যান নি, তাদের স্বাগত জানাতে। তারাই ছুটে যান ফুলের মালা নিয়ে তার বাড়িতে। প্রথমেই মাল্য দান করেন প্রাক্তন সভাপতি আবদুল মালেক উকিল। নেতৃত্ব সম্পর্কে সম্ভাব্য বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য।
দিল্লীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, নেতৃবৃন্দের দিল্লী সফর হাসিনা খুশী মনে গ্রহণ করেন নি। ওখানকার পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ এমনভাবে প্রেসিডিয়ামকে উপস্থাপিত করেন যা একটা অস্থায়ী প্রবাসী সরকারের মত।
আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকেই এবার দিল্লীতে মন্তব্য প্রকাশে ছিলেন অত্যন্ত সতর্ক। দিল্লীর সাংবাদিকদের পীড়াপীড়িতেও তারা সরকারের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। পুরো দায়িত্বটা কৌশলে চাপিয়ে দেন হাসিনার উপর। অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে বিমানের সীট রিজার্ভেশন থেকে শুরু করে বেশ কিছু সুবিধে নেয়ার কারণে আওয়ামী নেতৃবৃন্দ মুখ খুলতে পারেন নি।
যেটুকু করার দরকার তা তারা করেছেন গোপনে। দিল্লী মসনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একজন সাংবাদিকের মতে, ডঃ কামাল হোসেন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন সাতাশে ফেব্রুয়ারী। অন্যরা এটা মানতে রাজী নন। তাদের মতে, ডঃ কামাল হোসেন শুধু মিসেস গান্ধীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরুণ সেন গুপ্ত পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন। আর সাবেক সভাপতি আবদুল মালেক উকিল দেখা করতে পেরেছেন বিজয় ধরের সঙ্গে। বিজয় ধর প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর ঘনিষ্ঠ সহচর স্বর্গীয় ডি, পি, ধরের পুত্র এবং রাজীব গান্ধীর অন্যতম উপদেষ্টা।
এর বাইরে নেতৃবৃন্দ ভারতীয় আর কার কার সঙ্গে দেখা করেছেন, তা একেবারেই গোপনীয়। তবে তারা দেখা করেছেন তিন মাস ধরে দিল্লী প্রবাসী কাদের সিদ্দিকী, ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহনকারী চিত্তরঞ্জন সূতারের সঙ্গে।
হাসিনার প্রত্যাবর্তন
হাসিনার দেশে ফেরা নিয়ে ইতোমধ্যে বহু কথা হয়েছে। বিভিন্ন কাগজ বিভিন্ন ভাবে তার ফেরার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু ১৭ মার্চ তার ফেরা হচ্ছে না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তায়ও সম্ভব হয় কিনা সন্দেহ। কেননা তার বাচ্চাদের (ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুল) পরীক্ষা এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে। ছেলে মেয়েদের একলা রেখে হাসিনার কোথাও যাওয়া সম্ভব নয়। কেননা তার কথাতেই ‘বাচ্চারা আমাকে ছেড়ে এক মিনিটও থাকে না।’ এজন্যই প্রতিদিন তাকে বাচ্চাদের স্কুল থেকে আনতে যেতে হয়।
কিন্তু এগুলো বড় যুক্তি নয়। সবটাই নির্ভর করবে দিল্লীর সঙ্গে ব্যবস্থার ওপর। কিন্তু দিল্লীর পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে যখন পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক উন্নত হচ্ছে এবং মিসেস গান্ধী অভ্যন্তরীণ ভাবে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন তখন তিনি নতুন রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতে রাজী নন। এছাড়াও, মিসেস গান্ধী নাকি মনে করেন, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব সমর্থন পাবার মত ‘সঠিক’ অবস্থানে নেই।
প্রথম দিল্লী সফর
অক্টোবর, ১৯৮০। ঢাকা থেকে দিল্লী। লন্ডন থেকে দিল্লী। সাজেদা চৌধুরী আর জিল্লুর রহমান ঢাকা থেকে এসেছেন। অনেকটা গোপনে। ডঃ কামাল হোসেন লন্ডন থেকে এসেছেন।
মিশনের লক্ষ্যঃ ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিলে শেখ হাসিনার সভানেত্রী নির্বাচন নিশ্চিত করণ। এ ভাবেই শেখ মুজিবর রহমানের যাদুর পরশে দিল্লী ঘেষা ও অনুপ্রবেশকারীদের হাতে কোণঠাসা অবস্থা থেকে উন্নত করা৷
২৮ অক্টোবর, খুলনা জেল খানার ঘটনার প্রেক্ষিতে, নিজেদের অবস্থা আরো গুছিয়ে নেবার অভিপ্রায়ে, ৩ নভেম্বর কাউন্সিল দশ-দলীয় ঐক্য জোটের ‘সর্বাত্মক আন্দোলন ‘ এর আড়ালে পিছিয়ে দেয়া হয়।
অবস্থা আরো ভাল করার জন্য কূটনীতি বিশারদ ডঃ কামাল হোসেন ফিরে আসেন ঢাকায় এ সময়। সবার অলক্ষ্যে যেমন তিনি ১৯৭৯ সালে দেশ ত্যাগ করেছিলেন তেমনি ফিরে আসেন আবার৷ ১০ নভেম্বর আবির্ভূত হলেন তিনি বায়তুল মোকাররমে দশ দলের জনসভায়।
ধীরে ধীরে তারা নিজেদের শক্তি সংহত করতে থাকেন; প্রথম দিল্লী মিশন রয়ে যায় গোপনে। হাতে গোণা কয়েক জন ছাড়া কেউ জানতেন না। এমনকি আবদুর রাজ্জাক, মালেক উকিল কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারেন নি এ মিশনের তাৎপর্য।
দ্বিতীয় দিল্লী মিশন
১৬ ফেব্রুয়ারী, ১৯৮১। প্রচন্ড উত্তেজনা বিস্ফোরণাণ্মুখ পরিস্থিতিতে ইডেন হোটেল এর সামনের রাস্তায় দু দলের সমর্থকরা যার যার অবস্থান নিয়ে প্রস্তুত। দু সপ্তাহ ধরে সভাপতি কে হবেন মূলতঃ এ প্রশ্নে দড়ি টানাটানি চলছে। তারও আগে কয়েক দফা মারপিটের মাধ্যমে বৃদ্ধি পেয়েছে নেতৃত্বের সংকট। ধুমায়িত হয়েছে অসন্তোষ অনুপ্রবেশকারীদের বিরুদ্ধে। ‘মার্ক্সিস্ট তাত্ত্বিক ‘ শিক্ষা এ সংস্কৃতি সম্পাদক এস এম ইউসুফকে দলের কার্যালয়ে পেটানোর মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটে এ অসন্তোষের।
১৬ ফেব্রুয়ারী বেলা একটার দিকে কানাঘুষার মাধ্যমে দলের কর্মীদের ইঙ্গিত দেয়া হয় সভাপতি পদে শেখ হাসিনার নাম। বেলা দুটোর সময় অপেক্ষমান সাংবাদিকদের সভাপতি কে হচ্ছেন এ প্রশ্নের উত্তরে নাটকীয় ভাবে ডঃ কামাল হোসেন ভাবলেশহীন মুখে বললেনঃ ইউ উইল গেট সাম সারপ্রাইজ বিলাইয়িং অল এক্সপেকটেশন। (সব ধারণা ভ্রান্ত করে আপনারা আকষ্মিক কিছু পাবেন)
এরপর রাতের দিকে নিজের নাম প্রত্যাহার করে জোহরা তাজউদ্দীনের নাম প্রস্তাব করেন ডঃ কামাল। তারপর নাছোড়বান্দা মালেক উকিল ও আবদুর রাজ্জাককে শেখ হাসিনার নাম প্রস্তাব করে ‘সারপ্রাইজ’ দিয়ে দেন ডঃ কামাল হোসেন। যা পছন্দ না করলেও প্রত্যাখান করার সাহস দুজনের কারোই ছিল না। এর আগের দিন শেখ হাসিনা ও ডঃ কামালকে প্রথম ও দ্বিতীয় কাউন্সিলর হিসেবে কো-অপ্ট করা হয় আরো ৪৮ জনের সঙ্গে।
২৪ ফেব্রুয়ারী প্রেসিডিয়াম ও সেক্রেটারীয়েট এর এক প্রতিনিধি দল দিল্লীতে অবস্থানরত সভানেত্রীর সঙ্গে প্রথম বৈঠকের জন্য ঢাকা ত্যাগ করেন।
তাদের আগে সবার অগোচরে দলের এককালীন দফতর সম্পাদক আনোয়ার চৌধুরী ও আরো দুজন নেতা দিল্লী যান৷ আনোয়ার চৌধুরী ৭৫ থেকে ৭৮ সাল অবধি ভারতে ছিলেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে দেশে ফিরে আসেন।
২৭ ফেব্রুয়ারী প্রথম ফিরে আসেন ডঃ কামাল হোসেন। দিল্লীতে রয়ে যান মালেক উকিল, আবদুল মান্নান, জোহরা তাজউদ্দিন, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদ, সাজেদা চৌধুরী ও আইভি রহমান। ডঃ কামাল ফিরে এসে বললেন, ‘আমাদের দিল্লী মিশন সফল হয়েছে। শেখ হাসিনা শীগগীরই দেশে ফিরে আসছেন। আমরা তাকে কাউন্সিলের সব সিদ্ধান্ত অবহিত করেছি, তিনি সভানেত্রীর পদ গ্রহণ করেছেন।’
‘মিশন’ কি শুধু এতেই সীমাবদ্ধ ছিল? যাবার আগে ও ফিরে আসার পর সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যেয়ে দলের নেতারা এ প্রশ্নকে আরো ঘনীভূত করেছেন। কাদের সিদ্দিকী, চিত্ত সুতারদের সঙ্গে, সরকারী ও কংগ্রেসী নেতা কিংবা অন্য কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে কিনা অস্বীকার করেছেন।
দশাননের রাবণ
তিনদিনের কাউন্সিল অধিবেশনের পরও আওয়ামী লীগের এক দেহ দুই মনের রাজনৈতিক অস্তিত্ব অব্যাহত রয়েছে। সমাধানের বদলে সংকট আরো জটিল হয়েছে৷ একজন সভাপতির বদলে ১১ জন সভাপতি হয়েছেন। সভাপতি মন্ডলীর প্রধান সুদূর – দূরের শেখ হাসিনাকে ‘রাজনৈতিক শিখন্ডী’ হিসেবে দাড় করানোর অপপ্রয়াস চলছে। দশজন সভাপতি দলের ‘দশানন’ রাবণের মত দশ দিকে তাকাচ্ছেন। সাধারণ সম্পাদক তার অবস্থান মজবুত রাখতে মস্কোপন্থীদের স্মরণাপন্ন হয়েছেন প্রবলভাবে। দিল্লী ও পাশ্চাত্যমুখী লবীর নেতা তোফায়েল আহমেদ দলের নতুন প্রভাবশালী নেতা ডঃ কামালের সহায়তায় দলের ভেতর প্রভাববলয় আরো প্রসারিত করেছেন। পদে সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও তোফায়েল আহমেদ এখন সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ‘অঘোষিত সাধারণ সম্পাদকের’ মর্যাদা ভোগ করছেন। আর সে সঙ্গে হাসিনাকে সামনে রেখে শুরু হয়েছে দল ভাঙনের নতুন প্রক্রিয়া। মিজান চৌধুরীর পরিণতি এগাতে চান বিচ্ছিন্নতাকামী বা একে অপরকে বহিষ্কার উদ্যোগী দুই টি গ্রুপই৷ হাসিনা যে অংশে থাকবেন, সেটাই হবে আওয়ামী লীগের ‘উত্তরাধিকারী’ দল। তবে হাসিনা কবে ফিরে আসবেন তা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় নি।
হাসিনা ফিরে এলেও তিনি যে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেবেন সে আওয়ামী লীগ কি ঐক্যবদ্ধ সংগঠন হিসেবে তার পেছনে দাগাবে না তাকে দাবার ছক ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করবে, তা এখন স্পষ্ট। দলের সংহতির প্রতীক হিসেবে হাসিনা আবার আওয়ামী লীগকে একক ব্যক্তির সংগঠনে পরিণত করতে পারবেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। ইতিমধ্যে দলের নেতৃত্বের কোন্দল এবং পরে দলের নেতাদের দিল্লী সফর ইত্যাদি দলের জনপ্রিয়তাকে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। দলের ভাবমূর্তি বিপন্ন এখন। হয়তো তার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে ৭ ই মার্চ শহীদ মিনারে দলের সমাবেশে। সেদিনের ক্ষুদ্র সমাবেশে বাইরের লোকদের যতো বিস্মিত হয়েছেন কয়েক জন নেতা।
এ সমাবেশে মালেক উকিল বলেছেন, বাংলাদেশের স্বার্থের ভিত্তিতেই আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে আগ্রহী। হয়তো নেতৃবৃন্দ আঁচ করতে পেরেছেন জনসমর্থনে বিরাট ধ্বসের। পরদিনই দলের প্রেসিডিয়াম একটি বিবৃতি দিয়েছেন। তাতে তারা সম্প্রতি নিখিল বঙ্গ নাগরিক সংঘ কর্তৃক কোলকাতায় বাংলাদেশের ২০ হাজার বর্গমাইল ভূ-খন্ড দাবী করে বাংলাদেশ হাই-কমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও স্মারকলিপি প্রদানের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ঘটনাকে ‘ন্যাক্কারজনক’ বলে অভিহিত করে বলেছেন, তা বাংলাদেশের ‘স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী’। কিন্তু তাতেও সমর্থকদের মনের দ্বিধা -সন্দেহ যাবে কি?
কাউন্সিল, নতুন সমস্যা সৃষ্টি করেছে
১৪ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন দলের সমস্যার সমাধান করতে ব্যর্থ হয়েছে। পার্টির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, কোন্দল ও সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কাউন্সিল একটি গণতান্ত্রিক ফোরাম হবে বলে দলের যারা আশা করেছিলেন তারা নিদারণভাবে হতাশ হয়েছেন। এ কাউন্সিল পুরোনো অসমাধিত সমস্যার সঙ্গে যোগ করেছে নতুন কিছু সমস্যা – যা ভবিষ্যতে দলের আভ্যন্তরীণ সংকটকে আরো তীব্র ও ভয়ংকর করবে, যার পরিণতিতে আওয়ামী লীগ দূর্বল থেকে দূর্বলতর হতে থাকবে এবং দেশের রাজনীতিতে দলটির কার্যকরী ভূমিকা ও প্রভাব কমে যেতে থাকবে।
বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে এক বছর বিলম্বিত কাউন্সিল শুরু হয় সভাপতি আবদুল মালেক উকিলের এ কথা দিয়ে – ‘সকল জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়, শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।’
কাউন্সিলর-ডেলিগেটরা যার যা মনের কথা, চিন্তা ভাবনা, ধ্যান ধারণা প্রকাশ করার পুরো সুযোগ পাবেন, মালেক উকিল উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ প্রতিশ্রুতি দিলেও পরবর্তী দু দিনে তা রক্ষা করা হয় নি। কাউন্সিল যোগদানকারী প্রায় চার হাজার কাউন্সিলর – ডেলিগেট তিন দিনই প্রদর্শন করেছেন দলের প্রতি অপরিসীম মমতা, আস্থা ও আনুগত্য এবং সর্বোপরি পরিচয় দিয়েছেন, অধিবেশনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত, অভূতপূর্ব শৃঙ্খলা ও ধৈর্যের। তা সত্ত্বেও তারা যা চেয়েছিলেন তা কি অর্জিত হয়েছে? কাউন্সিল কি দলের সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে? এ প্রশ্ন রেখেছিলাম আমরা অনেককে।
কাউন্সিল নির্বাচনের পর একজন কাউন্সিলর স্বস্তির আনন্দে বললেন, ‘আমাদের দল এক দলই থাকলো, ভাঙলো না। কিন্তু পনেরো দিন পরে আবার সে কাউন্সিলরই হতাশার সঙ্গে বললেন, ‘আমরা কি অর্জন করলাম? দ্বন্দ্ব বিভেদের যেখানে ছিলাম আমরা তার আরো এক ধাপ এগিয়ে গেছি এখন। ‘
দলের নেতৃবৃন্দ কাউন্সিল অধিবেশনে শান্তিপূর্ণ সফল ও স্বার্থক হয়েছে – এ কথা সগর্বে বলেন। কিন্তু কাউন্সিল অধিবেশনের মাধ্যমে দলকে আরো শক্তিশালী, ব্যপক ও প্রভাবশালী সংগঠনে পরিণত করার যে সুবর্ণ সুযোগ এসেছিল, তার বিন্দুমাত্রও গ্রহণ করা হয় নি। কাউন্সিল দলের সর্বোচ্চ সংস্থা, সেখানে ‘মিটিং অব মাইন্ডস’ হওয়ার কথা। সফলতা, ব্যর্থতা, করণীয়, কৌশল, কর্মসূচী ইত্যাদির স্পষ্ট বিশ্লেষণ সমালোচনা বলতে যা বোঝায়, তার কিছুই করা হয় নি। বরং কাউন্সিলর – ডেলিগেটরা প্রভাবান্বিত হয়েছেন নেতৃত্বের দ্বারা – যে দ্বিধা বিভক্ত নেতৃত্ব তিনটি দিনই প্রায় প্রকাশ্যে নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের সংঘাতে লিপ্ত রয়েছিলেন। সমস্যাগুলো তারা কাউন্সিলরের সামনে তুলে ধরেন নি। বরং কায়দা করে দল এক রাখার নামে কাউন্সিলের অধিকার কাউন্সিলের কাছে থেকেই তারা ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সমস্যা গুলো – যে সমস্যার সমাধান তারা গত তিন বছরে করতে পারেন নি। যার ফলে দলের নেতৃত্ব দলের ভেতর থেকেই নির্ধারিত হলো না, সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত হলেন রাজনীতি থেকে দূরে এবং স্বদেশ থেকে প্রায় হাজার মাইল দূরে ভিনদেশে ঘর সংসার নিয়ে ব্যস্ত শেখ হাসিনা। আর দলের সদ্য সাবেক সভাপতি মালেক উকিল কাউন্সিল অধিবেশন সমাপ্তি ঘোষণা করলেন এই বলেঃ ‘অনেক যোগ্য ব্যক্তি দলে থাকা সত্ত্বেও দলের ঐক্য অটুট রাখতে আপনাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। আপনারা যাকে মেনে নিয়েছেন, তার গায়ে বঙ্গবন্ধুর গন্ধ আছে।’
কাউন্সিল দলের আদর্শ, সামগ্রিক সাংগঠনিক পরিস্থিতি, ভবিষ্যৎ কর্মসূচী সম্পর্কে আলোচনা বা নিদেনপক্ষে সাধারণ সম্পাদকের রিপোর্টের পর্যালোচনা হতে পারেনি, নেতা কে হবেন এ মিমাংসা না হওয়ায়। সাংগঠনিক জেলা কমিটিগুলোর রিপোর্ট পেশ ছাড়া উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটেনি। এ সম্পর্কে দলের একটি সূত্র জানান, ভেতরে ভেতরে কাউন্সিলর – ডেলিগেটদের মনোভাব এতো বিস্ফোরণোন্মুখ ছিলো যে, প্রধান ইস্যুগুলো বাদ দিয়ে বঙ্গবন্ধু পরিষদ কেন মনি সিংয়ের লোকদের দখলে চলে গেছে – এই ছোট্ট ইস্যুই যথেষ্ট কারণ হতো হাঙ্গামা – হৈ – চৈয়ের। কিন্তু যারা অধিবেশনের পর্যবেক্ষক ছিলেন তারা কিছুতেইএ যুক্তিকে গ্রহন করবেন না। পার্টির ঐক্য অটুট রাখতে কাউন্সিলর – ডেলিগেটরা এবার যে মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন তা আওয়ামী লীগের ইতিহাসে আর কখনো ঘটেনি।
যৌথ নেতৃত্ব, সমস্যা দূর করেছে কি?
সমস্যা সমাধানের নাম করে দলের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে যৌথ নেতৃত্ব চালু করা হয়েছে। কাউন্সিল অধিবেশনে নেতৃবৃন্দ এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি করলেন, যাতে এই ধারণা হলো যে, একের বদলে অনেক অর্থাৎ যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করলে নেতৃত্বের মধ্যে বিরাজমান সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। গঠনতন্ত্র সংশোধনের প্রস্তাব তাই কাউন্সিলে উপস্থাপিত হলে তা বিনা আলোচনায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। সংশোধনের পর নেতৃত্বের লড়াই আরো স্পষ্ট ও নগ্ন হয়ে ওঠে। সাবজেক্ট কমিটি নেতা নির্বাচনে পৌছুতে বারবার ব্যর্থ হয়। শেষ পর্যন্ত কমিটি সাতজন নেতাকে সভাপতিমণ্ডলীর সভাপতি ঠিক করার দায়িত্ব দেন। এরপরও অচলাবস্থা থেকেই যায়৷ শেখ হাসিনা নির্বাচিত হওয়ার পর দলে নতুন সমস্যা দেখা দেয়। প্রশ্ন ওঠে সভানেত্রী দেশে ফিরে না আসা পর্যন্ত কে দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করবেন? কাউন্সিলের সমাপ্তি ভাষণে মালেক উকিল ‘অস্থায়ী সভাপতি ‘ হিসেবে দায়িত্ব পালনের ‘রায়’ প্রার্থনা করেন এ বলে,, ‘আপনারা এ পদে আমাকে না রাখলে আমি দলের দু আনার সদস্য পদে ফিরে যাবো।’ দলের সদ্য সাবেক সভাপতি হিসেবে জনাব মালেক উকিলের রায় প্রার্থনার দরকার ছিল না। তা সত্ত্বেও কাউন্সিলর রায় পরবর্তী কালে সম্মানিত হয়নি। দলের তরফ থেকে এ পর্যন্ত তাকে ‘অস্থায়ী বা কার্যকরী সভাপতি ‘ হিসেবে স্বীকার করা হয় নি৷ সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক দিল্লী যাত্রার সময় বিমান বন্দরে সাংবাদিক দের যদিও বলেছেন, ‘জনাব উকিলই দলের কার্যকরী সভাপতি। ‘ বরং ফিরে আসার পর ৮ মার্চ দলের প্রেসিডিয়ামের যে বৈঠক বসে তাতে কে সভাপতিত্ব করেছেন, তাও উল্লেখ করা হয় নি। জানা গেছে, এ সভায় সভাপতিত্ব করেন কোরবান আলী৷ দলের অভ্যন্তরে নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দলের অবসান হয় নি।
দলের গঠনতন্ত্র সংশোধনে আরো কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ২৭ সদস্যের ওয়ার্কিং কমিটি গঠিত হবে মনোনয়নের মাধ্যমে। ‘মনোনীত ‘ এ কমিটির হাতেই ‘নির্বাচিত’ প্রেসিডিয়াম ও সেক্রেটারীয়েট নিয়ন্ত্রিত হবেন। এ অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দলের অভ্যন্তরের কোন্দলকে আরো তীব্র করবে৷
অনুপ্রবেশকারীদের অবস্থান
শেখ হাসিনাকে সভানেত্রী করে সংকট এ যাত্রা এড়ালেও আরো গভীর সংকটের জন্ম দিয়েছে তার নির্বাচন। কারণ দলের দু পক্ষের মূল দ্বন্দ্বের নিরসন হয়নি এতে৷
আবদুর রাজ্জাক ও মস্কোপন্থী নেতা ও কর্মীরা তাদের অবস্থান আরো সংহত করার জন্য জোর প্রচেষ্টা শুরু করেছেন।
একজন ক্যাডারের ভাষায়ঃ দলের প্রতিক্রিয়াশীলরা শেখ মুজিবের কন্যাকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করে প্রগতিশীলদের আপাততঃ ঠেকিয়ে রাখতে চাইছে। অবশ্য তারা পারবে না কারণ তাদের সঙ্গে আমাদের গুণগত পার্থক্য রয়েছে। আমরা এবার কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেব যাতে করে তারা এদের প্রতিহত করতে পারে। সত্যিকার অর্থে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তারাই হবে ভবিষ্যতের সুশিক্ষিত ক্যাডার। এদের সঙ্গে দলের প্রতিক্রিয়াশীলরা নীচ থেকে উপরে সর্বক্ষেত্রে পাল্লা দিতে পারবে না।’
কাউন্সিলে এ উদ্দেশ্যে শাসনতন্ত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী পাশ হয়েছে। দলের প্রাথমিক সদস্যদের দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে। সদস্য পদপ্রার্থীরা কমপক্ষে এক বছর পর পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ লাভ করবেন।
আপাততঃএ স্ট্র্যাটেজি রেখেই নিজেদের অবস্থান আরো ব্যাপক ও সুসংহত করার নীতি নিয়েছেন মস্কোপন্থীরা। তারা বুঝতে পেরেছেন কর্মীদের মাঝে আদর্শগত প্রভাব খাটাতে না পারলে তাদের সব পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে।
কারণ কাউন্সিলে আবদুর রাজ্জাকের সমর্থকরা ওয়ার্কিং কমিটিতে গৃহীত একটি সংশোধনী পাশ করাতে ব্যর্থ হন। এটি ছিল দলের বর্তমান শাসনতান্ত্রিক একটি ধারা যাতে বলা হয়েছে, যে প্রাথমিক সদস্য দু-বছর মেয়াদ উত্তীর্ণ হননি, তিনি কোন কার্যকরী পদ কিংবা কমিটির সদস্য হতে পারবেন না।
এর ফলে ১৯৭৯ এর ১০ ডিসেম্বর দলে আনুষ্ঠানিক ভাবে ‘অনুপ্রবেশকারী’ মতিয়া চৌধুরী ও তার সাথীরা বঞ্চিত হয়েছেন আপাততঃ দলের নেতৃত্ব কাঠামোয় থাকতে৷
হেরে গেলেও ভেঙ্গে যাবার পাত্র নন তারা। সুতরাং এবারের আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব থাকবে ক্যাডার সৃষ্টি করে আপাততঃ নীচু তলায় অবস্থান করে এগিয়ে আসার রাজনীতি বনাম ‘খাঁটি’ নির্ভেজালল আওয়ামী লীগগ তারর স্বকীয়তা নিয়ে থাকারর লড়াই।
আরো সংকট – এর ফলে তৈরী হতে যাচ্ছে দলের ভিতর। সম্ভবত এর নিরসনে এ বছরেই আরো একটি বিশেষ কাউন্সিল ডাকা হবে দলের নীতি নির্ধারণ কল্পে এবং নেতৃত্বের সংকট নিরসনে।
হাসিনার নির্বাচন বিস্ময়!
কাউন্সিল অধিবেশনে শেষ মুহূর্তের ঐক্য হিসেবে আপোষ নেতৃত্বের ফর্মূলায় শেখ হাসিনার নাম ঘোষণার প্রথম পর্যায় থেকেই একাধারে বিস্ময় ও মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। বিচিত্রার সঙ্গে কাউন্সিল অধিবেশনের আগে দেয়া সাক্ষাৎকার গুলোতে প্রথম পর্যায়ের কয়েকজন নেতাই হাসিনার নাম স্মরণ করেছেন গভীর শ্রদ্ধা ভরে, কিন্তু দলের প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে তাকে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িয়ে ফেলার প্রশ্নটি সবাই যথাসম্ভব এড়িয়ে গেছেন। কাউন্সিলের শেষ দিনে নেতা নির্বাচনের সময় দুপুর পর্যন্ত অধিবেশন চত্বর ছিলো গুজবে মুখরিত। মূল নেতৃত্ব নির্বাচনেকেউই কোন আপোষ মীমাংসায় পৌছতে পারছিলেন না। কিন্তু তাই বলে দলকে নাটকীয় ভাবে এমন পরিণতিতে ফেলা হবে তা বোধহয় অনেক নেতা পর্যন্ত কল্পনা করতে পারেন নি। অপরাহ্নে সাত নেতার রুদ্ধদ্বার কক্ষে আলোচনায় ডঃ কামাল হোসেন মারফত হাসিনার নাম প্রস্তাব ও অনুমোদন এবং শেষ মুহূর্তে তার ফলশ্রুতি হিসেবে বিকেলের দিকে বেগম সাজেদা চৌধুরীর মঞ্চে আরোহন ও সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার নাম ঘোষণা সবই ছিল আকষ্মিকতায় ভরপুর।
এ কথা সত্য যে, সাধারণ আওয়ামী লীগ কর্মী এবং কাউন্সিলরদের খুব কমই শেখ হাসিনাকে তাদের মধ্যে আশা করেছিলেন। যৌথ নেতৃত্বের যে খসড়া ডঃ কামাল হোসেন প্রণয়ন করেছেন, তাতে দলের অন্যতম নেতা হিসেবে হাসিনার নাম থাকবে এ ভাবনাও অনেকে প্রশ্রয় দেননি। কিন্তু সভানেত্রী হিসেবে হাসিনাকে দলের অনেক সুযোগ্য নেতাও কল্পনা করতে পারেন নি। সহসা শেখ হাসিনাকে বেনজির ভুট্টোর মতো প্রথম সারির নেতৃত্বে নিয়ে আসা এবং তাকে দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সাময়িক ভাবে মস্কো পন্থী রাজ্জাক সমর্থিত মোর্চাকে কোণঠাসা করে ফেলে।
‘বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরী ‘ হিসেবে শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব তুলে ধরে পক্ষান্তরে বঙ্গবন্ধুর অন্ধ অনুসারীদের সমর্থন আদায় করতে সুপারিশকারী কামাল হোসেন চমকপ্রদভাবেই সফলতা অর্জন করেছেন এ কথা নির্দ্বিধায় বলা চলে। এরপর থেকে বাকশালের ধ্বজাধারী তোফায়েলও ক্ষমতার দড়ি টানাটানিতে রাজ্জাককে হারিয়ে দিয়ে হাসিনার আরো কাছাকাছি চলে এসেছেন। এভাবে তোফায়েল এবং হাসিনাকে অতি দ্রুত সামনে ঠেলে দিয়ে ডঃ কামাল একদিকে নেতৃত্বের নীতি নির্ধারণী শক্তিকে রেখেছেন হাতের মুঠোয়, অন্যদিকে দল থেকে সিপিবি প্রাধান্যকে হটিয়ে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন তার আকাঙ্ক্ষিত দিল্লী – পাশ্চাত্যপন্থী নেতৃত্বের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা। শেখ হাসিনার ভাবমূর্তি ও তার সঙ্গে নিজের নৈকট্যকে সম্বল করে বিসমার্কের কায়দায় কামাল হোসেন ভবিষ্যতে আরো সামনে চলে আসতে পারবেন এ কথা এখনই বলে দেয়া যায়।
প্রথম দিকে প্রেসিডিয়ামের সভানেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনার নাম কর্মীদের বিস্মিত করলেও পরে তাদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। অধিবেশনের পর কর্মীরা শেখ হাসিনাকে তাদের মধ্যে আশা করেছিলেন। তড়িঘড়ি নেতাদের দিল্লী গমন তাদের আগ্রহের মধ্যে নতুন অনুপ্রেরণাও সঞ্চারিত করেছিলো। কিন্তু একে একে সব কয়জন নেতাই দিল্লী থেকে ফিরে এলেন। কিন্তু হাসিনার প্রত্যাবর্তন সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না।
দলের ক্ষমতা কার হাতে?
১৬ ফেব্রুয়ারী কাউন্সিল অধিবেশন আরম্ভ হবার এক মাস আগে থেকেই ‘প্রাসাদ রাজনীতিবিদ’ হিসেবে খ্যাত ডঃ কামাল হোসেন হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। আওয়ামী লীগের প্রতিটি দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে পিছিয়ে থাকা দলের ভেতরে বাইরে সর্বত্র তুমুলভাবে সমালোচিত ডঃ কামালই হয়ে উঠলেন অতঃপর দলের মূল ব্যক্তি। দিল্লী ঘেষা পাশ্চাত্য লবীর মোর্চা স্বাভাবিকভাবেই হলো আরো জোরদার। এর পর থেকে দলের অবশ্যম্ভাবী ভাঙনের মুখে আপোষ-ফয়সালায় কামাল হোসেন হয়ে উঠলেন একজন মধ্যমণি।
কাউন্সিল অধিবেশনে সুচতুর কৌশলে রাজ্জাক-মালেক জুটিকে পেছনে ঠেলে দিয়ে আকষ্মিকভাবে শেখ হাসিনার নাম ঘোষণায় ডঃ কামালই সবচাইতে বড় ভূমিকা গ্রহন করেছিলেন। এমনকি কাউন্সিলরও শেষ মুহূর্তে জোর করে ভেতরে ঢুকে যাওয়া সাধারণ কর্মীদের কাছ থেকে হাসিনার পক্ষে সমর্থন আদায়েও তিনি কম প্রচেষ্টা চালান নি। অদূর ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগে যে যৌথ নেতৃত্বের পটভূমি বিস্তৃত হতে যাচ্ছিলো তাতে অন্যতম কর্ণধার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে গিয়ে রাজ্জাক-তোফায়েল-জোহরা তাজউদ্দীন -মালেক-সামাদের সঙ্গে জনপ্রিয়তা ইত্যাদিতে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না বলেই হয়তো তিনি দলের কাউকে দিয়ে আপোষ-নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চান নি।
অন্য দিকে বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হয়েও শেখ হাসিনার কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব পেশের জন্য দিল্লী যাওয়াতে ডঃ কামাল ছিলেন সবচাইতে বেশী তৎপর। প্রত্যক্ষ ভাবে প্রেসিডিয়াম সদস্য হিসেবে দলে প্রভাব বিস্তার এবং পরোক্ষভাবে হাসিনার আস্থাভাজন হওয়া এই দুই ক্ষেত্রেই তিনি সমান সাফল্য অর্জন করার পক্ষপাতী ছিলেন।
আপাতঃ দৃষ্টিতে কামাল হোসেনের সুচতুর রাজনৈতিক কলাকৌশলের হাতে রাজ্জাক গং রা চরম মার খেয়েছেন। কিন্তু তাতে দলের কতটুকু লাভ হয়েছে সে ব্যাপারে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ থেকে যায়। রাজনীতির প্রথম পর্যায় থেকেই কামাল হোসেন একজন বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাসাদ রাজনীতিবিদ হিসেবে সুপরিচিত। দেশে বিদেশে রাজনীতির চাইতে আইন ব্যবসায় তার প্রসিদ্ধি অপেক্ষাকৃত বেশী। বিপ্লবের জন্য মাঠে না গিয়ে সুক্ষ্ম ও জটিল মারপ্যাঁচ এবং টেবিল আলোচনাতেই সমস্যা সমাধানে তিনি পারদর্শী। দলের সাধারণ কর্মীদের সঙ্গে তার যোগাযোগ সব সময়ই ক্ষীণ। এর ফলে তোফায়েলের মতো মঞ্চ নায়কও যে ধীরে ধীরে কামাল হোসেনের যুক্তিজালে প্রভাবিত হয়ে মাঠের চাইতে ঘরের দিকে চোখ ফেরাবেন, সে আশংকা করা যায় প্রতি মুহূর্তে।
শেষ কথা
শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের ভগ্নতরী ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ কাউন্সিল সমুদ্র জোড়াতালি দিয়ে পার হতে পেরেছে, পেরেছে ভাঙনকে সাময়িক ভাবে ঠেকিয়ে রাখতে। কিন্তু অসমস্বত্ব মিশ্রণের এই ঐক্য কতদিন টিকবে সে সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করা কঠিন। প্রেসিডিয়ামের সব কয়জন সদস্যই রয়ে গেছেন কেবল মাত্র নিজের শক্তি ও ক্ষমতার শ্রেষ্ঠত্বের দাবীদার। ফলে প্রত্যেকেই এখন দলকে নিজ নিজ প্রভাব বলয়ে নিয়ে আসতে ব্যস্ত৷ কাউন্সিলের পর কোন রকমে একটা কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু কোন প্রক্রিয়ায় তা বাস্তবায়িত হবে তার কোন রূপরেখা প্রণয়ন করা হয় নি। কাউন্সিল পরবর্তী দিনগুলোতে প্রতিটি কর্ম তৎপরতা ও বক্তব্যে নেতাদের পরস্পরের প্রতি দেখা যাচ্ছে সন্দেহ ও অবিশ্বাস। আওয়ামী লীগের ডাকে সাড়া দিতে দলের সমর্থক কর্মীরাই এখন দ্বিধাগ্রস্ত। তাদের এই নির্লিপ্ততা নেতাদের এই প্রথম হতাশা পীড়িত করে তুলছে। কাজেই আগামীর দিন গুলোতে ঘটনাজাল আবার কোন দিকে মোড় নেবে তা হয়ে উঠেছে এক রকম অনিশ্চিত।
***
বেগম হাসিনা ওয়াজেদ এর সাক্ষাৎকার
“ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছি”
– বেগম হাসিনা ওয়াজেদ, সভানেত্রী, আওয়ামী লীগ
প্রশ্নঃ দীর্ঘদিন সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার পর আপনি আবার রাজনীতিতে ফিরে এসেছেন। আপনি এই ফিরে আসাকে কিভাবে দেখছেন?
উত্তরঃ ছাত্রজীবনে আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। পরবর্তীতে রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম এটা ঠিক নয়৷ আমার পুরো জীবনটাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। রাজনীতির সঙ্গে জীবন ওতোপ্রোতো ভাবে জড়িত। রাজনীতির জন্যই মা-বাবা, ভাই-বোন, আত্মীয় – স্বজন হারিয়েছি।
আমি রাজনীতির সঙ্গেই আছি। নতুন করে রাজনীতিতে এসেছি, বলতে পারেন না। নতুন করে রাজনীতিতে প্রবেশের প্রশ্ন ওঠে না।
আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছি, ঠিকই। তবু বলবো আমি একজন সাধারণ মেয়ে, এমন কোন গুণ নেই যে সভানেত্রী হতে পারি। আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী।
একটি বড় রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বাংলার মানুষের মত প্রকাশ করে। সে দলের সভানেত্রী নির্বাচিত করে তারা বাবার প্রতি সম্মান দেখিয়েছে – বাবার প্রতি আস্থা প্রকাশ করেছে। এখানে আমার বিশেষ কি করণীয় আছে?
প্রশ্নঃ আপনার ভারতে অবস্থান সম্পর্কে বিভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। এ ব্যাপারে সত্যিকার অবস্থা টা কি?
উত্তরঃ আমি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছি। বহুলোক ১৫ আগস্টের পর বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহন করেছে। দেশ থেকে বেরিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমার ভারতে অবস্থান নিয়ে কোন কথা হওয়ার কোন কারণ নেই।
প্রশ্নঃ রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য ভারতকেই বেছে নিলেন কেন?
উত্তরঃ এর পেছনে বিশেষ কোন কারণ নেই। ১৫ আগস্টের ঘটনার সময় আমরা জার্মানীতে ছিলাম। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর নানা ধরণের কথা শুনেছি। প্রথম খবর পেলাম মা ও রাসেল বেঁচে আছে। কিন্তু সঠিক অবস্থা জানতাম না। সঠিক অবস্থা জানার জন্য ভারতে ছুটে আসি। এতে দেশের কাছাকাছি আসা যায়।
ভারতে আসার পর খবর পাই কেউই বেঁচে নেই। পরবর্তীতে ভারত আমার স্বামীকে একটা চাকরী দেয়। সেই থেকে এখানে আছি। এখানে জীবন যাত্রাও সহজ। ঘরে কাজের লোক পাওয়া যায়। সবচে বড় কথা দেশীয় পরিবেশ পাওয়া যায়।
প্রশ্নঃ সভানেত্রী নির্বাচনের পেছনে কি কারণ আছে? আপনার জন্য সিদ্ধান্ত টা কি আকস্মিক নয়?
উত্তরঃ সভানেত্রী বানানোর পেছনে একটাই কারণ। তা হচ্ছে বাবার প্রতি আওয়ামী লীগ কর্মীদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তবে সিদ্ধান্তটা, বলতে পারেন, হঠাৎই এসেছে। আমি সবসময় চিন্তা করতাম কর্মী হিসেবেই কাজ করব। কর্মী হিসেবে কাজ করতে পারলেই খুশী হতাম। তবু দায়িত্ব যখন দেয়া হয়েছে কর্তব্য করতেই হবে।
প্রশ্নঃ ফেব্রুয়ারী কাউন্সিলের আগে আওয়ামী লীগের বিরোধ প্রকাশ্য রূপ নেয়। এ সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তরঃ একটি পরিবারে পরিবার প্রধান মারা গেলে গোলমাল বা বিরোধ দেখা দেয়। আওয়ামী লীগের মত একটা পার্টিতে এ ধরণের ঘটনা স্বাভাবিক৷ এটা ভাঙন হতে পারে না। আওয়ামী লীগের কোন কাগজ নেই – তাই সাংবাদিকরা যা খুশী লেখে। সত্যিকার ভাবেই আওয়ামী লীগে তেমন কোন বিরোধ নেই। আওয়ামী লীগে কোন গ্রুপ নেই। একটাই গ্রুপ – তা হলো বঙ্গবন্ধুর গ্রুপ।
প্রশ্নঃ দেশে ফিরে যাওয়ার পর ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে আপনার ভূমিকা কি হবে?
উত্তরঃ ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের ঘটনা সম্পর্কে বাংলার মানুষের কাছে, বিশ্ব মানবতার কাছে, বিশ্ব রাজনীতিবিদদের কাছে আমার একটাই আবেদন – হত্যার তদন্ত হওয়া উচিৎ। হত্যাকারীর বিচার হওয়া উচিৎ। একটা সাধারণ হত্যারও বিচার হয়। তাই সে হত্যার কেন বিচার হবে না? একটা মেয়ে পিতৃ হত্যার, বোন হিসেবে ভাতৃ হত্যার বিচার চাই৷ আওয়ামী লীগ কর্মী হিসেবে নেতার হত্যার বিচার চাই। আমি মনে করি, সব রাজনৈতিক হত্যার বিচার হওয়া উচিৎ। আমি যে কোন রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের বিরোধিতা করি। হত্যা একটা জঘন্য প্রক্রিয়া। কেন অন্যায় ভাবে হত্যা করা হবে?
প্রশ্নঃ অন্য বিরোধী দল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে রাজনৈতিক হত্যার জন্য দায়ী করে। এ অভিযোগের কি জবাব দেবেন?
উত্তরঃ অন্য বিরোধী দলের এ অভিযোগ সঠিক নয়। বরং আওয়ামী লীগ আমলেই আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী দের হত্যা করা হয়েছে। বিরোধী দলীয় লোকজন আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মী দের হত্যা করে আওয়ামী লীগের ওপরই দোষ দিয়েছে।
প্রশ্নঃ ১৫ আগস্টের ঘটনার জন্য আওয়ামী লীগ চীন – মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যোগসাজশ কে দায়ী করে। আপনি কাকে দায়ী করেন?
উত্তরঃ আমি বলব, যারা হত্যা করেছে, তারাই বলে বেড়াচ্ছে, এ সম্পর্কে জনগণই বলতে পারবেন। এ ধরণের যে কোন মন্তব্য তদন্ত সাপেক্ষ। পুরো তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত কোন মন্তব্য করবোই না। শুধু বলবো, সত্য কখনোই চাপা থাকে না – সত্য একদিন উদঘাটিত হবেই।
প্রশ্নঃ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে কি আবার ‘বাকশাল’ বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ নেবে?
উত্তরঃ সেটা সময় মত জানতে পারবেন। তবু বলবো বাকশাল একটা নতুন ব্যবস্থা। মানুষের কল্যাণের জন্যই এটা করা হয়েছে। এতে কারো সঙ্গে বিরোধ আছে বলে আমি মনে করি না। তবে রাজনীতি তে সময় বুঝেই পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। সময় এবং পরিবেশের ওপরই নির্ভর করবে কখন কি হবে? বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই বাকশাল গঠিত হয়েছিল। ভবিষ্যতে বাংলার মানুষের জন্য যা কল্যাণকর তা ই করা হবে।
প্রশ্নঃ দেশে ফিরে যাওয়ার পর কি নির্বাচনের দাবী তুলবেন?
উত্তরঃ এসব ব্যাপারে পার্টির সিদ্ধান্ত ছাড়া কিছু বলতে পারি না। তা ছাড়া নির্বাচন করে কি হবে? নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হলে বোঝা যেত কারা ক্ষমতায় থাকে, কারা বিরোধী দলে থাকে? আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে বিশ্বাস করে। কিন্তু কেউ যদি আপনার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তা হলে কি করবেন?
প্রশ্নঃ আপনি একটি ভারতীয় সংস্থার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, প্রয়োজনে আবার ‘৭১ এর মত ভারতের সাহায্য চাইবেন। এ বক্তব্য দিয়ে কি বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তরঃ আমি এভাবে বলিনি। আমি বলেছি ‘৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন বন্ধু দেশ থেকে নৈতিক সমর্থন পেয়েছি। ভবিষ্যতেও আমাদের আন্দোলনে আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে এ সকল বন্ধুদের নৈতিক সমর্থন আশা করি।
প্রশ্নঃ এটা কি বিশেষভাবে ভারত – রাশিয়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য?
উত্তরঃ এটা সকল বন্ধু দেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।
প্রশ্নঃ আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ ভারতে বসে বাংলাদেশ বিরোধী প্রচারণা করছেন। এর কি জবাব দেবেন?
উত্তরঃ না, আমি কোন সরকার বিরোধী প্রচার করছি না। এখানে যা বলেছি, লন্ডনেও তা ই বলেছি। কিন্তু ভারতে বসে কি করলাম, সেটা কেন নজরে এল?
প্রশ্নঃ দেশে ফিরে এলে কি ৩২ নম্বরের পৈত্রিক বাড়িতেই উঠবেন?
উত্তরঃ দেখি কি হয়? সরকার বলেছে, টুঙ্গীপাড়ার বাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। অথচ যতদূর জানি, সেটা এখনো তালা বদ্ধ। ১৫ আগস্টের পর সম্পত্তির ব্যাপারে খুব একটা খোঁজ খবর নেই নি। ৩২ নম্বরের বাড়ি এখনো তালাবদ্ধ। ঐ বাড়ি সম্পর্কে কাগজ থেকেই যা জানতে পেরেছি, সরকার কিছু বলেন নি।
প্রশ্নঃ দেশে ফিরবেন কবে? সরাসরি কি ঢাকা ফিরবেন?
উত্তরঃ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হয়, ফিরবো। সরাসরিই ঢাকা যাওয়ার ইচ্ছা আছে। তবে পরিকল্পনা এখনো বলতে পারছি না। সেটা উনি (স্বামী ডঃ ওয়াজেদ) বলতে পারবেন।
প্রশ্নঃ বর্তমানে আপনার পরিচয় কি? রাজনীতিবিদ না গৃহিণী?
উত্তরঃ আমি সবই। তবে প্রথমে আমি – দুটো সন্তানের জননী। এছাড়া বঙ্গবন্ধুর মেয়ে।
– ইউনিকোডেড বাই সংগ্রামের নোটবুক
***
মূল পত্রিকা অরিজিনাল কপি
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1981.03.13-bichitra.pdf” title=”1981.03.13 bichitra”]