শহীদ আবুল বরকত
রফিকুল ইসলাম | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮
বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারী থেকে যে নামটি এদেশে ঘরে ঘরে বেদনা ও শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে, যে নাম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শহীদদের তালিকায় প্রথম আসে, যে নাম বাংলাদেশে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে, সেই আবুল বরকত সম্পর্কে সম্প্রতি কিছু বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশিত হওয়ায় শহীদ আবুল বরকতের পরিচয় জানার এবং জানানোর জন্য আগ্রহী হয়ে উঠি। এ প্রসঙ্গে প্রথমেই আমার মনে পড়ে বরকতে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু নাসির ওয়াহিদকে। বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী, বর্তমানে আইনজীবী এবং ঢাকা সিটি ল’ কলেজের সহ – অধ্যক্ষ। নাসির সাহেবকে তিপ্পান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ বরকতের কবরে বরকতের মাতাকে নিয়ে যেতে দেখেছিলাম, আরো দেখেছিলাম, ছেলের কবরে এসে অচৈতন্য হয়ে পড়লে বরকতের মাতাকে পুত্রের মতো সেবা করতে। আমার অনুরোধে আবু নাসির ওয়াহিদ সাগ্রহে এগিয়ে এলেন বরকতের জীবন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে সাহায্য করতে।
তার সাহায্যেই আমি বরকতের আপন মামা আবদুল মালেক সাহেবের সন্ধান পাই। মালেক সাহেব ওয়াপদার অবসরপ্রাপ্ত ডাইরেক্টর অব একাউন্টস, বর্তমানে ওয়ান বি আউটার সার্কুলার রোড, মগবাজারের বাসিন্দা। আবুল বরকত ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আসার পর থেকে ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারী মৃত্যুর দিন পর্যন্ত মালেক সাহেবের বাসাতেই ছিলেন। আমার অনুরোধে মালেক সাহেব আবুল বরকত সম্পর্কে যে তথ্য দেন তার ভিত্তিতে আবুল বরকতের জীবনী সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
আবুল বরকত ১৯২৮ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্থানীয় তালিবপুর হাইস্কুল থেকে তিনি ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিক এবং বহরমপুর কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেন। ১৯৪৮ সালে বরকত পূর্ব বাংলায় চলে আসেন এবং ঢাকায় মামা মালেক সাহেবের বাসায় পুরানা পল্টন লাইনের ‘বিষ্ণুপ্রিয়া ভবন’ এ এসে ওঠেন। বরকত ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম বর্ষ অনার্স ক্লাসে ভর্তি হন। আবুল বরকত অত্যন্ত মনোযোগী ছাত্র ও ভদ্র, নম্র, বিনয়ী ও চরিত্রবান ছিলেন। বরকত বেশ লম্বা ছিলেন এবং পুরানা পল্টন লাইন থেকে সাইকেলে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাতায়াত করতেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে বরকত বিকেল বেলা পুরানা পল্টন মাঠে বেড়াতেন এবং সন্ধা হলেই ঘরে ফিরে পড়তে বসতেন। ১৯৫১ সালে বরকত দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান অধিকার করে অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরীক্ষার ফল খুব খারাপ না হলেও বরকত তাতে খুশী হননি এবং এম এ তে আরো ভালো করার সংকল্প করেছিলেন।
১৯৫২ সালে বরকত রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এম, এ শেষ পর্বের ছাত্র ছিলেন। একুশে ফেব্রুয়ারীতে তিনি সকাল সকাল গোসল করে খেয়ে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। মামা আবদুল মালেক গুলীর খবর পান বিকেল পাঁচটায়, দুইজন ছাত্র এসে তাকে খবর দেয় যে বরকত গুলীবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত অবস্থায় মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পড়ে আছে। মালেক সাহেব তখন তার পরিচিত স্বাস্থ্য দফতরের ডেপুটি সেক্রেটারী ডাঃ কাসেমকে নিয়ে হাসপাতালে যান। হাসপাতালে গিয়ে তিনি দেখেন তারই পরিচিত ডাক্তার কর্ণেল গিয়াসুদ্দীন বরকতকে অপারেশন করছেন। কর্ণেল গিয়াসুদ্দীন মালেক সাহেবকে দেখেই চিৎকার করে বলে ওঠেন, ‘বড়োই দুঃখের বিষয় ওকে বাঁচাতে পারলাম না।’ তিনি বরকতের হাতের ঘড়ি এবং আংটি তাকে ফেরত দেন। কর্নেল গিয়াসুদ্দীন তাকে আরো বলেন, ‘ মরার আগে বরকত আপনার নাম করায় আমি তাকে চিনতে পারি।’
পুলিশ বরকতে লাশ দাফনের জন্য বাড়ীতে আনতে দেয়নি, তবে মালেক সাহেবকে আজিমপুর গোরস্থানে যেতে দিয়েছিল। সেখানে তার সঙ্গে ছিলেন কাসেম সাহেব ছাড়াও মেডিক্যাল কলেজের প্রফেসর ডাঃ হাবীবউদ্দীন। শহীদদের লাশের দায়িত্বে ছিলেন ওবায়দুল্লাহ নামক একজন পুলিশ অফিসার। একুশে ফেব্রুয়ারী রাত দশটার দিকে শহীদ বরকতের লাশ হাসপাতাল থেকে কড়া প্রহরায় বের করে আজিমপুর গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। বরকতের মামা মালেক সাহেব পরিবারের পক্ষ থেকে কবরের জায়গা কেনার টাকা এবং কাফনের খরচ দেন। পরবর্তী কালে বরকতের পরিবার থেকেই কবর পাকা করে দেয়া হয়েছিল। সেদিন বরকতের দাফনের আগে প্রহরারত জনৈক তরুণ অবাঙালী সামরিক অফিসার বরকতের মৃতদেহ দেখে তার মামাকে বলেছিলেন, ‘দুধকা বাচ্চাকো মরাকে এ লোগ রাজ রাখেগা’! শহীদ বরকতকে কবর দিয়ে মালেক সাহেব, ডাঃ কাসেম, ডাঃ হাবীবউদ্দীন ও আত্মীয় স্বজন যখন বাড়ী ফেরেন তখন ভোর হয়ে এসেছে।
মালেক সাহেবকে আমি প্রশ্ন করি, সাপ্তাহিক ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার বিজয় দিবস ‘৭৭ সংখ্যায় জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক শামসুল হক নামে কোন এক পুলিশ অফিসারকে উদ্ধৃত করে যে বলেছেন, বরকত পুলিশের লোক ছিল সে সম্পর্কে তার বক্তব্য কি? এ প্রশ্নের উত্তরে আবদুল মালেক সাহেব বলেন, ‘বরকত সম্পর্কে ঐ তথ্য সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। বরকত ঢাকায় আসার পর থেকে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত আমার বাড়ীতে থেকেই লেখাপড়া করছিল। সে ঢাকায় তার বোন নূরজাহানের বাড়ী যেত, বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বন্ধু ছিল আবু নাসির ওয়াহিদ, ইকবাল হলে তার কাছেও যেত। এ ছাড়া তার আর কোথাও যাতায়াত ছিল না, সে অত্যন্ত পড়ুয়া ছিল। পুলিশের সঙ্গে তার কোন প্রকার সম্পর্কের প্রশ্নই ওঠে না। ‘বিচিত্রা’ র বিজয় দিবস সাতাত্তর সংখ্যায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের উদ্ধৃতি দিয়ে সরদার ফজলুল করীম বরকত সম্পর্কে যে তথ্য পরিবেশন করেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ‘
আবদুল মালেক সাহেবের কাছে আমি শেষ প্রশ্ন রাখি শহীদ বরকতের বৃদ্ধা মাতা কি এ পর্যন্ত কোন সরকারী সাহায্য বা ক্ষতি পূরণ পেয়েছেন? মালেক সাহেব তার উত্তরে জানালেন, ‘বরকতের মা পূর্ববর্তী কোন সরকারের কাছ থেকে কোন প্রকার ক্ষতিপূরণ পায়নি, তবে গতবার একুশে ফেব্রুয়ারীর সময় যখন তিনি ঢাকায় এসেছিলেন তখন বর্তমান সরকারের কাছে থেকে তিন হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য পান। জয়দেবপুরে একটি জমির প্রতিশ্রুতিও তিনি পেয়েছেন। তবে এ বছর অসুস্থতার জন্য তিনি একুশের সময়ে আসতে পারছেন না।’ প্রসংগক্রমে উল্লেখযোগ্য যে, বরকতের মা এখনও মুর্শিদাবাদের গ্রামেই আছেন যদিও তার স্বামী, অপর পুত্র সকলেই পরলোকগত। তার খুব ইচ্ছা ছেলের কবর যেখানে, সেখানে এসে থাকেন। জানি না তার সে ইচ্ছা পূরণ হবে কি না।
মালেক সাহেবের পর আমি বরকতের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বন্ধু ঢাকা সিটি ল’ কলেজের সহ অধ্যক্ষ আবু নাসির মোঃ ওয়াহিদকে আবুল বরকত সম্পর্কে বলতে অনুরোধ জানাই। তিনি জানান যে, ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত বরকত এবং তিনি একত্রে পড়াশুনা করেছেন। তারা ১৯৪৮ সালে একই সঙ্গে পড়াশুনা করে ১৯৫১ সালে অনার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন এবং ১৯৫২ সালে তারা একই সঙ্গে এম এ শেষ পর্ব পড়ছিলেন। নাসির সাহেব ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন ফলে পড়াশুনায় খুব একটা নিয়মিত ছিলেন না। প্রধানতঃ বরকতের উৎসাহেই তিনি পড়াশুনা করেন এবং অনার্স পরীক্ষা পাস করেন। বরকত পরানা পল্টন লাইনে বিষ্ণুপ্রিয়া ভবনে মামার বাড়ীতে থাকতেন। নাসির সাহেব থাকতেন ইকবাল হলের ব্যারাকে। নাসির সাহেব নিয়মিত বরকতের বাড়ীতে এবং বরকত ইকবাল হলে নাসির সাহেবের ঘরে আসতেন, তারা একত্রে পড়াশুনা করতেন। বরকত খুব নিয়মিত ছাত্র ছিলেন এবং অনার্সে হাই সেকেন্ড ক্লাস পান। বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বন্ধুদের মধ্যে আরো ছিলেন একই বিভাগের ছাত্র কে, জি মোস্তফা। (বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট কর্মী ও ইরাকে বাংলাদেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত)
বিচিত্রা বিজয় দিবস সংখ্যায় বরকত সম্পর্কিত অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক পরিবেশিত তথ্যের কথা উল্লেখ করতেই নাসির সাহেব বললেন, ‘বিচিত্রার বিজয় দিবস সংখ্যায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের হাওলা দিয়ে সরদার ফজলুল করীম যে তথ্য পরিবেশন করেছেন তা পাঠ করে আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ, বিস্মিত ও মর্মাহত হয়েছি। আবুল বরকত সম্পর্কে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ও অধ্যাপক সরদার ফজলুল করিম কিভাবে এই রূপ দায়িত্বজ্ঞানহীন তথ্য পরিবেশন করতে পারলেন তা আমি ভেবে পাই না। আমি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিতে চাই যে, আবুল বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন নিষ্ঠাবান ছাত্র ছিলেন। প্রত্যক্ষ রাজনীতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক না থাকলেও তিনি সচেতন এবং প্রগতিশীল মনোভাবাপন্ন ছিলেন। বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে আমরা একত্রেই আমতলার ঐতিহাসিক সভায় যোগদান করি। সভার পর অতিরিক্ত কাঁদুনে গ্যাস প্রয়োগের কারণে বড় রাস্তায় বের হতে না পেরে বরকত আরো অনেকের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পুরাতন কলা ভবন প্রাঙ্গণ ছেড়ে পাঁচিল টপকে মেডিক্যাল কলেজের ব্যারাক হোস্টেলে আশ্রয় নেয়। সেখানেই এক নম্বর শেডের বারান্দায় পুলিশের গুলীতে আহত হন, তার উরুতে গুলী লেগেছিল, ছাত্ররা তাকে ধরাধরি করে ইমারজেনসিতে নিয়ে যায়, সেখানে অপারেশন সত্ত্বেও অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে তার মৃত্যু হয়। বরকতকে আমি খুবই ঘনিষ্ঠ ভাবে জানতাম, তার ঢাকার চার বছর জীবনের অধিকাংশ সময়ই আমার সঙ্গে কেটেছে। আমি জোরের সঙ্গে বলতে পারি যে বরকতের সঙ্গে পুলিশের কোন প্রকার সম্পর্কই ছিল না। আমি আমার বন্ধু শহীদ আবুল বরকত সম্পর্কে উদ্দেশ্যমূলক, বিভ্রান্তিকর ও ভ্রান্ত তথ্য প্রচারের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা করছি। ‘