বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন | কাজী জাফর আহমদ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭
১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ক্রমধারায় বাষট্টির রক্তঝরা ছাত্র অভ্যুত্থানের জন্ম। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পূর্ববাংলার জনগণের হয়ে অংকুরিত হয়েছিল জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের বীজ। ধীরে ধীরে পূর্ব বাংলার জনগণের মনে সাম্রাজ্যবাদের সহযোগী পশ্চিম পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত বৃহৎ বুর্জোয়ার বিজাতীয় শোষণ ও শাসনের চরিত্র সম্পর্কে মোটামুটি স্পষ্ট একটা ধারণা গড়ে উঠছিল। পূর্ববাংলার জনগণের মধ্যে তখনও জাতীয়তাবাদী যে চিন্তাভাবনার উন্মেষ ঘটছিল, মূলতঃ তাকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যকে সম্মুখে রেখেই ১৯৫৮ সালের সামরিক শাসন জারী হয়েছিল। যদিও সারা পাকিস্তান জুড়েই বিদেশী সাম্রাজ্যবাদ, দেশীয় মুনাফা শিকারী এক চেটিয়া পুঁজিপাতি ও সামন্ত প্রভূদের হাতের ক্রীড়নক হিসেবে আয়ুবের সামরিক জান্তা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে দেশ থেকে গণতন্ত্রের চিহ্নকে উৎখাত করে দিয়ে স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্ব গড়ে তুলেছিল, কিন্তু পূর্ববাংলায় জনগণের উপরই নেমে এসেছিল সর্বাপেক্ষা নিষ্ঠুর শোষণ, জাতিগত নিপীড়ন ও ফ্যাসিবাদী আক্রমণ। তাই, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের উত্তরসুরী ছাত্র-সমাজ প্রথম থেকেই সামরিক শাসনকে মেনে নিতে পারেনি। যতটুকু মনে পড়ছে, সামরিক শাসন জারী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ময়মনসিংহে প্রগতিশীল ছাত্রনেতা কাজী আবদুল বারী প্রমুখের নেতৃত্বে সামরিক শাসন বিরোধী মিছিল বেরিয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে কাজী বারী গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে সামরিক বিচারে দশটি বেত্ৰদণ্ড প্রদান করা হয়। ফলে কাজী বারী বধির হয়ে যান। আইয়ুবের সামরিক জান্তার স্বৈরাচারের অক্টোপাস ছাত্রসমাজের জীবনকেও করে তুলেছিল দুর্বিসহ। সামরিক শাসন জারী হওয়ার পর পূর্ব-বাংলার অধিকাংশ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিয়নগুলোকে বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। পরের দিকে যে সমস্ত ইউনিয়ন গঠন করতে দেয়া হয়েছিল, তা কর্তৃপক্ষের কড়া প্রহরার নীচে অগণতান্ত্রিক পন্থায় ঘোষিত সংবিধান অনুযায়ী। এইভাবে ছাত্র সমাজকে শক্তিহীন করে শাসকশ্রেণী স্কুল-কলেজের বেতন বৃদ্ধির চেষ্টা করেছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ ঘোষণা করেছে, অনেক শিক্ষককে মিথ্যা রাজনৈতিক অজুহাতে বিতাড়িত করা হয়েছে। আর সবশেষে চাপিয়ে দেয়া হয়েছিল আইয়ুবী শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট! তাই, প্রথম থেকেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের মনে বিক্ষোভ ধুমায়িত হয়ে উঠছিল। এর পেছনে মূলতঃ তিনটি কারণ ছিল : (১) গণতন্ত্র হত্যার বিরুদ্ধে নিজেদের কণ্ঠকে সোচ্চার করে গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবী করা, (২) গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও (৩) সর্বোপরি জাতিগত নিপীড়নের বিরুদ্ধে নতুন জাতীয় চেতনার উন্মেষ। .
বাষট্টি সালের ঐতিহাসিক ছাত্র-অভ্যুথানের আর্ন্তজাতিক প্রেক্ষাপটও বিশেষভাবে উল্লেখের দাবী রাখে। পাকিস্তানের বুকে যখন সামরিক শাসনের অন্ধকার যুগে পেচার রাজত্ব কায়েম হয়েছে, তখন এশিয়া, আফ্রিকার দেশে দেশে গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সংগ্রাম জোরদার হয়ে উঠেছে। কালো আফ্রিকার হৃদয় তখন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশ বাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তির আকাংখায় উদ্বেল। কঙ্গোর অগ্নিপুরুষ প্যাট্রিস লুমুম্বা নবতর জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ বাংলাদেশের ছাত্রসমাজের কাছে নতুন সূর্য হয়ে দেখা দিয়েছেন। দেখা দিয়েছে আলজেরিয়ার মুক্তি সেনানীর আত্মত্যাগ আমাদের ভবিষ্যত পথের দিশারী হিসেবে কোরিয়া, জাপান হতে শুরু করে ইরান তুরঙ্ক পর্যন্ত ছাত্রদের যে আন্দোলন গড়ে উঠিছিল সাম্রাজ্যবাদ ও প্রতিক্রিয়াশীল দ্বৈতান্ত্রিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে, সে আন্দোলনের জোয়ার-ভাঁটার টানে আমাদেয় হৃদয়ও আন্দোলিত হচ্ছিল।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই, বাষট্টির আনুষ্ঠানিক আন্দোলন শুরু হওয়ার বহু পূর্ব থেকেই এর পটভূমি প্রস্তুত হচ্ছিল। আমি আগেই বলেছি যে, এই আন্দোলনের মধ্যে গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের আকাংখার সঙ্গে নবতর জাতীয় চেতনার সংমিশ্রণ ঘটেছিল।
জাতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার একটি অস্পষ্ট ও কিছুটা কুয়াসাচ্ছন্ন আকাঙ্খা গোটা আন্দোলনের প্রস্তুতিপর্বে সঞ্জিবনী শক্তির কাজ করছিল। তবে এখানে এই কথাটাও উল্লেখ করতে হবে যে, প্রধানতঃ বাংলাদেশে ছাত্রসমাজের প্রগতিশীল অংশের (যার প্রতিনিধিত্ব করতো তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান দূত ইউনিয়ন) মধ্যেই প্রগতিশীল জাতীয় চেতনায় উম্মেষ ঘটেছিল। কারণ, পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা তাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অনুযায়ী স্বৈরতন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে একত্রে গ্রথিত করে দেখতেই অভ্যস্থ ছিল। বস্তুতঃপক্ষে সারা দুনিয়া জুড়ে তখন যে দুর্বার ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠছিল, তার মধ্যে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী গণতান্ত্রিক এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ‘জাতীয় মুক্তির আকাংখা’—এই উভয় স্রোতধারাই বিদ্যমান ছিল। এখানে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে যে, তাহলে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্রলীগের কি ভূমিকা ছিল ? ছাত্রলীগ প্রধানতঃ সামরিক শাসনের পরিবর্তে সারা পাকিস্তান ব্যাপী একটি পার্লামেন্টারী গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করার কথাই চিন্তা করতেন। তাঁদের অধিকাংশই আইয়ুব খানের পরিবর্তে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে দেখতে চাইতেন। তবে ইতিহাসের রেকর্ডকে নির্ভুল করে রাখার জন্য আমাকে এই কথা বলতে হবে যে, ছাত্রলীগের মধ্যে অভ্যস্ত মুষ্টিমেয় হলেও কিছু কর্মী এবং কোন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়, এমন কিছু সচেতন ছাত্রের মনের মধ্যেও জাতীয় চেতনা বেশ সক্রিয় ছিল।
মোট কথা, যে কথাটি সঠিকভাবে আমি বলতে চাই, তা হচ্ছে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন আপাততঃ দৃষ্টিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার কিংবা আইয়ুবের শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও এর মধ্যে জাতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাটিই প্রবল ছিল। বিশেষ করে এর উদ্যোক্তা এবং নেতৃত্বের মধ্যে আমি ইতিপূর্বে বলেছি যে, বাষট্টির ছাত্র-অভ্যুত্থানের মূল স্রষ্টা ও উদ্যোক্তা ছিল বামপন্থী ও প্রগতিশীল চিন্তার অনুসারী পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন। অবশ্য, আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক ও পরবর্তী পর্বে ছাত্রলীগ কিভাবে এবং কতটুকু অংশগ্রহণ করেছে, সেটুকু আমি বাষট্টির ছাত্র অভ্যুত্থানের বিভিন্ন পর্যায়ের আনুপুর্বিক ইতিহাস বর্ণনার মধ্যে উল্লেখ করবো। কিন্তু বাষট্টির ছাত্র-অভ্যুত্থান শুরু হওয়ার প্রস্তুতি পর্বে (এই পর্বের সময়সীমা আমি ১৯৫৯ সাল থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত নির্ধারণ করতে চাই) আমাদের মাঝে জাতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা কতটুকু প্রবল ছিল, তা প্রমাণিত করার জন্য দু একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতে চাই। আমরা তথন সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র। আমার যতটুকু মনে পড়ে, আমরা কয়েকজন মিলে BLA (Bengal Liberation Association) নামে একটি ছোট্ট সংগঠন দাড় করিয়েছিলাম। ১১ থেকে ১৩ জন এর সদস্য ছিলেন এবং এর মধ্যে অধিকাংশই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য ছিলেন। তবে ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়াও কোন ছাত্র সংগঠনের সাথে জড়িত নন, এমন কিছু ছাত্রও ছিলেন। শুধু সলিমুল্লাহ হলেই নয়, পরবর্তীকালে আমরা শুনেছি যে, বিভিন্ন হলেও এ ধরনের ছোট ছোট সংগঠন গড়ে উঠেছিল। তবে এই সমস্ত সংগঠনের মধ্যে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক চেতনার চাইতে একটা অনাস্বাদিত আকাঙ্ক্ষা ও অনুভুতিই প্রবল ছিল। আর একটি ঘটনা। খুব সম্ভবতঃ ‘৬১ সালের কোন এক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইয়ুবী মন্ত্রীসভায় তৎকালীন সদস্য লেঃ জেনারেল কে এম শেখ ও জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করতে এসে ছিলেন। ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা তাদেরকে পূর্ব-বাংলার উপর আঞ্চলিক বৈষম্যের ব্যাপারে প্রশ্নবানে জর্জিত করে ফেলেন। এই সময়ের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রহমান সোবহান, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ Two economy Theory-এর প্রবক্তা ছিলেন। তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী জিয়াউদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ ছাত্র ইউনিয়ন নেতা দুই অর্থনীতি প্রচলনের সপক্ষে বক্তব্য পেশ করেন এবং এ সম্পর্কে আইয়ুবের মন্ত্রীদের মতামত প্রদানের আহ্বান জানান। দৃশ্যত এটা বোঝা যাচ্ছিল যে, দুই মন্ত্রী হতভম্ব হয়ে যান এবং তারা পূর্ববাংলার ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবী সমাজের ভাবনা কোন লক্ষ্যপানে অগ্রসর হচ্ছে, সে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করতে সক্ষম হন। ছাত্রদের প্রশ্নের কোন সদুত্তর দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি এবং তাঁদের প্রচুর লাঞ্ছনা ও গঞ্জনা সহ্য করে ফিরে যেতেই তৃতীয় যে ঘটনাটি আমি উল্লেখ করছি, তা ঐতিহাসিক মানদণ্ডে গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। তবে এ সম্পর্কে অনিবার্য কারনে এই মুহূর্তে সমস্ত তথ্য উদঘাটিত করা সমীচিন হবে না বলে আমি মনে করি। আমি পূর্বেই বলেছি, সামরিক শাসনামলে ছাত্রলীগের কিংবা আওয়ামী লীগের মধ্যে আইয়ুবের পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতালাভের চিন্তা ছাড়া অন্য কোন চিন্তুা সংগঠণগত ভাবে ছিল না। তবে ব্যতিক্রম হিসেবে দু’ একজনের মধ্যে জাতীয় স্বাধিকারের আকাংখা একেবারে ছিল না, এমনটি আমি বলতে চাই না। কিন্তু সেটা সার্বিক কোন ব্যাপার ছিল না। তাকে ব্যতিক্রম হিসেবেই ধরতে হবে। কিন্তু ‘৬১ সালের শেষ দিকে ‘ইত্তেফাক’ সম্পাদক জনাব হোফজল হোসেন মানিক মিয়ার মধ্যস্থতায় তৎকালীন অবিভক্ত বামপন্থী মহল ও আওয়ামী লীগের মধ্যে এই সম্পর্কে কিছু আলোচনা হয়। এই আলোচনার মধ্যে পূর্ববাংলার স্বাধিকারের প্রশ্নটি সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের সাথে সম্পত করে আলোচিত হয়। এই ব্যাপারে তৎকালীন দৈনিক ইত্তেফাকের ‘মিঠে কড়া’ কলামের লেখক ‘ভীমরুল’ অর্থাৎ জনাব আহমেদর রহমান বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। আওয়ামী লীগের ও বামপন্থীদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে বাষট্টি সালের প্রথম দিকে একটি জঙ্গী আন্দোলন গড়ে তোলার রুপরেখা প্রণীত হয়েছিল। এই রূপরেখা অনুযায়ী কথা ছিল যে, আইয়ুবের শাসনতন্ত্র জারী হওয়ার সাথে সাথে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে প্রথম আন্দোলনের সূত্রপাত হবে এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ ও বামপন্থীরা সম্মিলিতভাবে সেই আন্দোলনের বহ্নিশিখা ব্যাপক জনগণের মধ্যে প্রজ্জলিত করবেন। এই ব্যাপারে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক জনাব শেখ মুজিবর রহমানের উপর বিশেষ দায়িত্ব অর্পিত হয়েছিল। কথ্য ছিল, প্রয়োজনবোধে আন্দোলনের বৃহত্তর স্বার্থে শেখ মুজিব আত্মগোপন করবেন এবং বামপন্থীদের সাথে মিলিতভাবে এই আন্দোলনের জঙ্গী রূপান্তর ঘটাবেন। কিন্তু সমস্ত ঘটনা এখানে উল্লেখ না করলেও এটুকু বলা যায় যে, শেখ মুজিব তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে আন্দোলনের সূচনা লগ্নেই কারা বরণ করে নেন। শেখ মুজিবের গ্রেপ্তারের সংবাদে, মরহুম মানিক মিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে পড়েন এবং আমার স্পষ্ট মনে আছে, তিনি এই ক্ষোভ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় প্রকাশ করতে ছাড়েননি। তিনি একটকু পর্যন্ত বলেছিলেন যে, “মুজিব তার ওয়াদা ভঙ্গ করেছে। ও পুলিশের কাছে ধরা দিয়েছে।” অবশ্য, কয়েকদিন পরে মানিক মিয়াও গ্রেপ্তার হয়ে যান এবং স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব পরিকল্পিত বাষট্টির আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পক্ষে তেমন কোন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সম্ভব হয়নি। এবার তৃতীয় ঘটনার কথা উল্লেখ করছি। এই ঘটনায় উল্লেখের মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে যে, পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর ক্ষুদ্রতম অংশ বাঙ্গালী সামরিক অফিসারদের মধ্যেও কিভাবে প্রখর জাতীয় চেতনা দানা বেধে উঠছিল। কিন্তু এই ঘটনার বর্ণনা করতে গেলে আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কিছু, অধ্যাপক বিশেষ করে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মাজেদ খানের কথা উল্লেখ করতে হবে। সম্প্রতি ইউরোপে অধ্যাপক মাজেদ খান মারা গিয়েছেন। আমি এই নিবন্ধে বাংলাদেশের প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে তাঁর অৰদানের কথা উল্লেখ করে তাঁর স্মৃতির প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করতে চাই। অধ্যাপক মাজেদ খানের সাথে আমাদের যোগাযোগ গড়ে উঠেছিল উক্ত ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র তৎকালীন ছাত্রনেতা মহিউদ্দিন আহমদ, জামাল হোসেন ভূইয়া প্রমুখের মাধ্যমে। তিনি কোন রকম মারপ্যাচের ধার ধারতেন না। তাঁর সরাসরি বক্তব্য ছিল “পূর্ব-বাংলাকে স্বাধীন করতে হবে। আমরা কেন্দ্রের গোলাম হিসেবে থাকতে চাই না।” তিনি এই আলোচনা সাধারণত ছাত্র ইউনিয়ন কর্মীদের সাথেই করতেন। তবে কিছু কিছু ছাত্রলীগ কর্মীয় সাথেও তাঁর যোগাযোগ ছিল। তবে তাঁদের সম্পর্কে তাঁর ধারণা খুব একটা ভালো ছিল না। আমরা প্রায়ই রাত একটা বাজলে তাঁর বাসায় যেতাম এবং আন্দোলনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে তার সাথে আলোচনা করতাম। আন্দোলন তখন শুরু হয়ে গেছে। একদিন তিনি আমাদের বললেন : “রাত্রে তোমরা কয়েকজন এসো। বাঙ্গালী সামরিক অফিসারদের প্রতিনিধি তোমাদের সাথে সাক্ষাত করবেন।” তখনকার অবস্থায় এ ধরনের ঘটনা কি ধরনের মানসিক চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পারে, আজকে তা উপলদ্ধি করা যাবে না। যাই হোক, যথানির্দিষ্ট সময়ে আমরা কয়েকজন-আমি, মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুল হালিম, হায়দার আকবর খান রনো এবং রাশেদ খান মেনন প্রমুখ স্যারের বাড়ীতে উপস্থিত হলাম। দেখলাম, একজন ফর্সা ও পাতলা গড়নের বেসামরিক পোষাক পরিহিত ভদ্রলোক উপস্থিত হয়েছেন। স্যার পরিচয় করিয়ে দিলেন, “ইনি হচ্ছেন বেলুচ রেজিমেন্টের বাঙ্গালী অফিসার ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী।” সেদিনকার আলোচনার সবটুকু বিষয়বস্তু এখন মনে করতে পারছি না। তবে যেটুকু মনে আছে, তা এখানে উল্লেখ করছি। ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরী বললেন, “তোমাদের আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য যদি পূর্ব-বাংলাকে স্বাধীন করা হয়, তাহলে আমরা বাঙ্গালী অফিসারেরা রাইফেল তোমাদের পক্ষ হয়ে ওদের দিকে ধরিয়ে দেবো। কিন্তু তোমরা কি সেজন্য মানসিকভাবে ও সাংগঠনিক ভাবে প্রস্তুত আছো।”
মিলিটারী মানুষ এবং মিলিটারী কায়দায় সরাসরিই কথাটা তিনি বলে ফেললেন। আমরা প্রথমটা একটু হতচকিত হয়ে পড়লাম। কারণ,আমাদের হৃদয়ের মনিকোঠায়ও আমরা এই কথাটি অত্যন্ত সযতনে লালন করে রেখেছি। কিন্তু এমন বাস্তব সত্যের মুখোমুখি তখনও আমরা দাঁড়াতে চাইনি। কারণ আমরা জানতাম যে, আন্দোলনের নেতৃত্বের একটি অংশের মধ্যে এমনি ধরনের একটি অপট অনুভূতি ছিল। কিন্তু ছাত্র আন্দোলনের ব্যাপক কর্মী ও অংশগ্রহণকারীদের চিন্তাভাবনা আরও অস্বচ্ছ ও কোন কোন ক্ষেত্রে পশ্চাদপদ ছিল। তাছাড়া নেতৃত্বের একাংশের মনের মধ্যে যে কথাটাই থাক না কেন, আমরা আন্দোলনকে গড়ে তুলছিলাম সামরিক শাসন বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবেই। তাই, আমরা সেদিন ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরীকে উত্তর দিয়েছিলাম : “আপনি যে কথা তুলেছেন, তা আমরা মুষ্টিমেয় কয়েকজন চিন্তা করলেও এখনও তার সময় আসেনি। এরজন্য আন্দোলনের কোন সাংগঠনিক প্রস্তুতি পরের কুথা মানসিক প্রস্তুতি পর্যন্ত নেই। পূর্ব-বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠতে অন্তত আরও দশ বছর সময় লাগবে।” আমাদের ভবিষ্যদ্বানী ইতিহাস সত্য বলে প্রমাণিত করেছে।
যাই হোক, উপরের ঘটনাগুলো এই কথা নিঃসন্দেহে প্রমাণ করেছে যে, বাষট্টির ছাত্র অভ্যুত্থান আমাদের দৃষ্টিতে আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্র ও শিক্ষানীতি বিরোধী বলে প্রতিভাত হলেও জাতীয় স্বাধিকারের চেতনা ও আকাঙ্ক্ষা আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রেরণার উৎস ছিল। তবে এখান থেকে এই ধারনা করা কিংবা এই অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সঠিক হবে না যে, নেতৃত্বের প্রত্যেকের মধ্যেই একই উপলদ্ধি ছিল কিংবা স্বাধিকারের প্রশ্নকে সম্মুখে রেখে বাষট্টির ছাত্র আন্দোলনকে আনুষ্ঠানিকভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল। সেখানে স্বাভাবিকভাবেই আন্দোলনের ভিন্নতৱ কৌশল ছিল। মূলতঃ স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার ও গণমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার দাবীতেই আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। আমি এখন বাষট্টির সেই ছাত্র অভ্যুত্থানের আনুষ্ঠানিক পর্বের আনুপর্বিক ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস পাচ্ছি।
আনুপর্বিক ইতিহাস
সামরিক শাসন জারী হওয়ার পর প্রতি বছর একুশে ফেব্রুয়ারীতে শহীদ দিবস উদযাপনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে আমরা আন্দোলন গড়ে তোলার নতুন নতুন কৌশল আয়ত্ত করতে শুরু করেছিলাম। পূর্বেই বলেছি, ‘৬১ সাল শেষ হওয়ার আগেই আমরা তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলাম যে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আমাদের মুখে দাঁড়াতেই হবে। আমাদের দৃঢ় সংকল্প ছিল, বিশ্ববাসীর কাছে আমরা তুলে ধরবোই যে, আমরা সামরিক শাসনকে ঘৃণা করি। তাই, একদিকে পর্দার অন্তরালে আওয়ামী লীগের সাথে বামপন্থী মহলের যেমন গোপন সমঝোতা হয়েছিল। ঠিক তেমনি ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে এই সময়ে আমাদের একটা সমঝোতা সষ্টি হয়েছিল যে, দেশের নতুন শাসনতন্ত্র, ছাত্রজীবনের সংকট বা সামরিক শাসনের অবসান প্রশ্নে আমরা যৌথভাবে আন্দোলন গড়ে তুলবো। এই সময়ে প্রকাশ্যে আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠার একটা ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়েছিল। ১৯৬১ সালে শেষের দিকে জনসাধারণ ও ছাত্র-সমাজের সামরিক সরকার বিরোধী অসন্তােষ তীব্র আকার ধারন করতে শুরু করে। বিশেষত শাসনতন্ত্র সম্পর্কে যে সকল প্রচার বা বস্তুত সরকার পক্ষ হতে করা হয়েছিল, জনগণকে উত্তেজিত করার পক্ষে তা ছিল যথেষ্ট। এই পটভূমিকায় ‘৬২ সালের ৩০শে ফেব্রুয়ারী জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর গ্রেপ্তার ছিল আমাদের কাছে একটা সূত্ৰ মাত্র। ৩১শে জানুয়ারী সারাদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে চাপা উত্তেজনা বিরাজ করতে থাকে। সোহরাওয়ার্দীর গ্রেপ্তারের খবর ছাত্রলীগের মধ্যেও আন্দোলনের জন্য আগ্রহ সৃষ্টি করলো। তবে তাঁরা আন্দোলনকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির দাবীতেই সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী ছিলেন।
যা হোক ৩১শে জানুয়ারী সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় মধুর কেন্টিনে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ, ছাত্রশক্তি ও এন, এস, এফ-এই চারটি ছাত্র সংগঠনের মধ্যে এক যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। এখানে দুই এক কথায় এন, এস, এফ ও ছাত্রশক্তির পরিচয় তুলে না ধরলে এই দুইটি ছাত্রসংগঠনের রাজনৈতিক পরিচয় ও ভূমিকা পাঠকদের সম্মুখ তুলে ধরা সম্ভব হবে না। এন, এস, এফ ছিল তৎকালীন আইয়ুব সরকারের পোটোয়া একটি ছাত্রসংগঠন। এই সংগঠন পরবর্তীকালে কিভাবে এই দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপর মোনায়েম খানের ঘৃণ্য লাঠিয়াল হিসেবে ঝাপিয়ে পড়েছিল এবং কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাজীবনকে কলুষিত বিষাক্ত করে তুলেছিল, সেই কলংকজনক ইতিহাস সবারই জানা প্রয়োজন। তবে বাষট্টির গোড়ার দিকে তখনও এন, এস, এফ এমনি ধরনের প্রকাশ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়নি। রাত্রের বেলায় সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চললেও দিনের বেলায় ছাত্র-সমাজ এবং দলীয় সাধারণ অনুসারীদের চাপে তাঁদের আন্দোলনের হাঁকডাক চালিয়ে যেতে হতো। অন্যদিকে, ছাত্রশক্তির সঙ্গে সরকারের কোন যোগাযোগ না থাকলেও তাদের রাজনীতি ছিল দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল। তবে বাষট্টির আন্দোলনে তাঁরা কোন কোন সময় দ্বিধা-দ্বন্দ এবং আপোষকামীতায় পরিচয় দিলেও আন্দোলনের বিরোধী ভূমিকায় কখনও অবতীর্ণ হননি। এখন পূর্বের কথায় ফিরে আসা যাক। ৪টি ছাত্র সংগঠনের সভায় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হলো যে, আগামীকাল অর্থাৎ ১লা ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘটের আহ্বান দেয়া হোক। ছাত্রলীগ আন্দোলনকে সীমিত রাখার শর্তে এই প্রস্তাবের প্রতি সম্মতি জানালো। কিন্তু এন, এস, এফ তীব্রভাবে ছাত্র ধর্মঘটের বিরোধিতা করতে থাকে। ছাত্রশক্তিও দোদুল্যমানতার পরিচয় দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত কৌশলগত কারণে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগ ১লা ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় সরকারের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের প্রতিবাদে সাধারণ সভা করার কর্মসূচীর মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাতে রাজী হয়। অন্য দুইটি সংগঠন বিশেষ করে এন, এস, এফ অত্যন্ত খুশী হয়ে চলে যায়। তারা চলে যাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে গভীৱ রাতে মধুর ক্যান্টিনে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের মধ্যে এক গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সভায় ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে জনাব মোহাম্মদ ফরহাদ, জনাব মহিউদ্দিন আহমদ, জনাব হায়দার আকবর খান রনো, জনাব রাশেদ খান মেনন, জনাব রেজা আলী প্রমুখ এবং ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে শেখ ফজলুল হক মনি উক্ত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। উক্ত বৈঠকে এই যৌথ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, পরদিন অর্থাৎ ১লা ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ধর্মঘট করা হবে। । তারপরই ছাত্র নেতৃবন্দ বসে গেলেন পোষ্টার লিখতে। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের দেওয়ালে পোস্টার দেখা গেল। পোস্টারে ধর্মঘটের আহান রয়েছে। ১লা ফেব্রুয়ারী পূর্ণ ছাত্র ধর্মঘট পালিত হলো। আইয়ুবী সামরিক শাসনের সাড়ে তিন বছরের নীরবতার পর এই প্রথম প্রতিবাদ। ১লা ফেব্রুয়ারী পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত আমতলায় ছোট একটা সভা হলো। সেখানে প্রথম আইয়ুবী সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখলেন হায়দার আকবর খান রনো ও আনিসুর রহমান। ২রা ফেব্রুয়ারী ছাত্র ধর্মঘটের কোন খবরই কাগজে ছাপা হলো না। ছাত্ররা এই খবর না ছাপার জন্য প্রতিবাদ জানালো। ৫০/৬০ জন ছাত্রের একটি দল প্রেসক্লাবের সামনে উপস্থিত হয়ে খবরের কাগজ পোড়ালো। প্রকাশ্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করলেন আবদুর রহিম আজাদ। এই প্রথম প্রকাশ্যে রাস্তায় আইয়ুবের সামরিক শাসন বিরোধী শ্লোগান উচ্চারিত হলো। পরদিন ৩রা ফেব্রুয়ারী পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী পাকিস্তানের তদানীন্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব মঞ্জুর কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন বক্তৃতা করতে। ছাত্ররা তখন উত্তেজনা ও আক্রোশে ভিতরে ভিতরে কসছে। পুরানো আর্টস বিল্ডিং-এর ১০৪ নং রুমে সভার আয়োজন করা হয়েছে। ছাত্ররা জমা হয়েছে। ভাইস চ্যান্সেলরের সঙ্গে ঢাকলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। কিন্তু বক্তৃতা শুরু করার আগেই ছাত্ররা প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নেই কেন, পূর্ব-বাংলার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ কেন ? মঞ্জুর কাদের মাইকের কাছে উঠে এসে দাড়ালেন। ঠিক এমন সময় ছাত্ররা মঞ্জুর কাদেরের কলার চেপে ধরলেন, তাকে পাশে সরিয়ে দিয়ে ছাত্রদের মধ্য থেকেই বক্তৃতা শুরু হলো। মঞ্জুর কাদেরের গায়ে থু থু পর্যন্ত নিক্ষিপ্ত হলো। পরে পুলিশ এগিয়ে এসে তাঁকে নিরাপদে সরিয়ে নিল। কিন্তু মঞ্জুর কাদিরের গাড়ীটি অক্ষত ছিল না। ৪ঠা ও ৫ই ফেব্রুয়ারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে উত্তেজনা ছিল, কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাসের বাইরে বের হয়নি। তবে গভীর রাত্রে ঢাকার বিভিন্ন রাজপথের পাশের দেওয়ালে স্লোগান লিখেছে, “ডাউন উইথ মার্শাল ল” অর্থাৎ “সামরিক আইন ধংস হোক।” ৫ই ফেব্রুয়ারী রাতে হঠাৎ করে ঘোষিত হলো, বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। পরদিন ৬ই ফেব্রুয়ারী তারই প্রতিবাদে কয়েক হাজার ছাত্র কার্জন হল প্রাঙ্গণে জমা হলো। তারা মিছিল করে বেরোবে। সামনে পুলিশের ব্যারিকেড। প্রথমে ব্যারিকেড ভাঙ্গার চেষ্টা করলে গ্রেপ্তার হলো দুইজন ছাত্র আবু তালেব ও দিলিপ দত্ত। কার্জন হল ও হাইকোর্টের সামনের রাস্তাটি ছাত্র পুলিশের খণ্ড লড়াইয়ের ক্ষেত্র। ছাত্ররা একটা পুলিশের বাসে আগুন ধরিয়ে দিল। পুলিশ পাঁচ রাউণ্ড গুলি চালায়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর তদানীস্তন জি, ও, সি এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ঐ গাড়ীতে ঢিল ছুড়লে গাড়ীর ড্রাইভার আহত হন এবং জি, ও, সি’র গাড়ীর সঙ্গে আরেকটি গাড়ী উল্টে যায়। ঐদিন মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে মিছিলটি এগিয়ে গেলে দুই পাশের জনতা স্বতস্ফুর্তভাবে হাততালি দিতে থাকে। নবাবপুর রোডের উপর মিলিটারী মিছিলকে বাঁধা দেয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। পরদিন ৭ই ফেব্রুয়ারী পুনরায় মিছিল বের হয়। আবার হামলা চলে। আবার বেশ কিছু ছাত্রকর্মী গ্রেপ্তার হন। কয়েকদিনের জন্য আন্দোলন একটু খিজিয়ে আসে। কিন্তু মার্চ মাসের প্রথম দিকে আবার আন্দোলন শুরু হলো। এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে মিছিল করার সময় বেশ কিছু ছাত্র গ্রেপ্তার হন। এই সমস্ত গ্রেপ্তারকৃত ছাত্রদের ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়। এদের মধ্যে হায়দার আকবর খান রনো, তৎকালীন ডাকসু সহ-সভাপতি রফিকুল হক প্রমুখ ছিলেন। পরে তাঁদেরকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এই আন্দোলনকেও আর বেশী দিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কারণ, ইতিমধ্যে আন্দোলনের প্রথম সারির কর্মীদের অনেকেই গ্রেপ্তার হয়ে গিয়েছেন। এই ভাবেই বাষট্টির ছাত্র অভ্যুথনার প্রথম পর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে চাই যে, বাষট্টির আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা লগ্নে আমি ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত ছিলাম না। তার কারন হচ্ছে : ‘৬১ সালে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ পরীক্ষার্থী ছিলাম। সুতরাং ‘৬১ সালেই আমার শিক্ষাজীবন শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আমি এম, এ পরীক্ষার ৪টি পেপারের মধ্যে একটি পেপারের পরীক্ষা ড্রপ করি। সুতরাং বাষট্টি সালে অনিয়মিত ছাত্র হিসেবে এম, এ, পরীক্ষা দেয়া ছাড়া আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রজীবনের সমাপ্তি সেখানেই ঘটে। তাই বাষট্টির আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক সূচনা পর্বের সঙ্গে আমি জড়িত ছিলাম না। তবে আগেই আমি উল্লেখ করেছি যে, বাষট্টির ছাত্র অভ্যুথানের বিস্ফোরণ আকষ্মিক কোন ঘটনা ছিল না—এটা ছিল সুদীর্ঘকালের প্রস্তুতি ও পরিকল্পনার ফসল। এই প্রস্তুতির প্রথম থেকেই আমি জড়িত ছিলাম। তা ছাড়া আন্দোলন শুরু করার যে রুপরেখা পর্বে প্রণয়ন করা হয়েছিল, সে অনুসারে ১লা ফেব্রুয়ারীতেই আন্দোলন করার কথা ছিল না। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আকস্মিক গ্রেপ্তার আন্দোলনের সুচনাকে ত্বরান্বিত করে দেয়। তাই, বাষট্টির আন্দোলনের প্রথম পর্বে আমার পক্ষে যোগদান করা সম্ভব হয়নি।
আন্দোলনে দ্বিতীয় পর্ব:
আমি বাষট্টির ছাত্র অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্বে এসে যোগদান করি। যদিও তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত ছাত্র ছিলাম না, তবুও আন্দোলনের স্বার্থে বামপন্থী মহলের নির্দেশে আমি তাতে যোগদান করি। এখানে কিছুটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ এসে গিয়েছে কিন্তু এই প্রসঙ্গ আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বলেই তার কথা উল্লেখ করা হলো। আমি বাষট্টির মার্চ মাসের শেষের দিকে যখন আবার আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কিত হই, তখন আন্দোলনে ভাঁটারটান চলছে। কিছু ছাত্রকর্মী জেলে এবং অন্যান্যরা তখন অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন এবং তাদের মধ্যে বেশ কিছুটা হতাশাও দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রলীগের কর্মীরাই আন্দোলনের ভবিষ্যত সপকে বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। ছাত্র ইউনিয়নের বেশ কিছু কমী তখনও। বাইরে সক্রিয় ছিল। কিন্তু অতঃপর কোন পথে অগ্রসর হওয়া যাবে, সে সম্পর্কে তারা সঠিক সিদ্ধান্তে আসতে পারছিলেন না। ছাত্র ইউনিয়নের যারা তখনও বাইরে থেকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ, আবদুল হালিম, ওয়ালিউল ইসলাম, জামাল হোসেন ভূঁইয়া, আইয়ুব রেজা চৌধুরী প্রমুখ। মোহাম্মদ ফরহাদ তখন আত্মগোপন করেছিলেন। ছাত্রলীগের মধ্যে আমি একমাত্র সিরাজুল আলম খান ছাড়া আর কাউকেই তখন দেখতে পাইনি। এমনি এক অবস্থায় আমার উপর আন্দোলনের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা এবং নতুন করে আন্দোলন শুরু করার মূল দায়িত্ব একজন পুরাতন কর্মী হিসেবে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়ে। আমাদের তখন প্রথম কাজই হয়ে পড়ে আন্দোলনের কর্মীদের নতুনভাবে সংগঠিত করা এবং সাধারণ ছাত্রসমাজের মধ্যে আশাবাদ ও আত্মপ্রত্যয় সঞ্চার করা। আমরা সেজন্য খুব সম্ভবতঃ এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি “শপথ দিবস” পালন করার একটি কর্মসূচী গ্রহণ করি। বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর রেস্তােরা এবং বিভিন্ন হলে ছাত্র সভার মধ্যে দিয়ে এই দিবসের কর্মসূচী পালন কৱা হয়। দেশের কয়েকটি স্থানেও এই কর্মসূচী পালিত হয়। এই কর্মসূচী অত্যন্ত সাফল্য মণ্ডিত হয় এবং এর সর্বাপেক্ষা বড় সাফল্য হচ্ছে : ছাত্র সমাজে ও ছাত্র কর্মীদের সম্মুখে আন্দোলনের ভবিষ্যত সম্পর্কে “শপথ দিবস” পুনরায় আশার আলোক বর্তিকা নিয়ে উপস্থিত হতে সমর্থ হয়। ইতিমধ্যে আমাদের সামনে আন্দোলন শুর করার একটি নতুন ক্ষেত্রও প্রস্তুত হয়। আন্দোলনের প্রথম পর্বের সমাপ্তির পর আইয়ব যে নতুন শাসনতন্ত্র জারী করে তার আলোকে মৌলিক গণতন্ত্রীদের দ্বারা তথাকথিত ‘জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার ব্যবস্থা করে। যতদূর মনে পড়ে ২৭শে এপ্রিল উপরোক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে উক্ত নির্বাচনকে বয়কট করতে হবে। অবশ্য এই সিদ্ধান্ত আমাদের একক সিদ্ধান্ত ছিল না। বামপন্থী মহলের উর্ধতন কর্তৃপক্ষের তরফ থেকেই আমাদের উপর এই সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়া হয়। আমরা যারা তখন ছাত্র আন্দোলনকে নতুন করে গড়ে তুলছিলাম, তারা উপরোক্ত সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত ছিলাম না। তবুও উক্ত সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার জন্য আমরা সমস্ত ঝুকি নিয়ে কর্মসূচী গ্রহণ করি। নির্বাচনের পূর্বদিন আমরা জনগণের নিকট নির্বাচন বয়কট করার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রচারপত্র বিলি করি। সামরিক শাসনের মধ্যেই আমরা ঢাকা শহরে স্কুটার যোগে উক্ত প্রচারপত্র ত্বরিৎগতিতে বিলি করার ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতেও দ্বিধাবোধ করিনি। কিন্তু বলা বাহুল্য, নির্বাচনে জনগণ ভোটার ছিল না, ভোটার ছিল মৌলিক গণতন্ত্রীরা। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এই ব্যাপারে জনগণের প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা ছিল না। নির্বাচনের দিন আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, নওয়াবপত্র গভর্নমেন্ট স্কুলের নির্বাচনী কেন্দ্রে আমরা প্রত্যক্ষভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করবো। আমরা যখন এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী করার প্রস্তুতি গ্রহণ করছি, তখনই খবর আসে যে, শেরে বাংলা এ, কে, ফজলুল হক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের উদ্যমে যথেষ্ট শৈথিল্য আসে। তবুও আমরা কয়েক মিনিটের জন্য গেরিলা কায়দায় বিক্ষোভ না প্রদর্শন করে কর্মীদের সরে পড়ার নির্দেশ দেই। মাত্র ২০/২৫ জন কর্মীকে উক্ত কর্মসূচী কার্যকর করার জন্য পাঠানো হয়। যে সমস্ত কর্মীরা সেদিন জীবনের ঝুকি নিয়ে উপরোক্ত কর্মসূচীকে কার্যকরী করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন, আমি তাঁদের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জানাই। তাঁরা উক্ত স্থান ত্যাগ করার সাথে সাথেই মিলিটারী বাহিনীর একটি দল সেখানে উপস্থিত হয় কিন্তু ততক্ষণে আমাদের কর্মীরা শেরে বাংলার জানাজায় অংশ গ্রহণ করার জন্য হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে নিজেদের আত্মগোপন করে ফেলতে সক্ষম হয়। আমরা শুধু একটি নির্বাচনী কেন্দ্রে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে ক্ষান্ত হইনি। আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবক্ষের নিকটও ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে নির্বাচন বয়কট করার জন্য জোরালো বক্তব্য উপস্থিত করি। ঠিক সুনির্দিষ্ট তারিখ আমার মনে নেই, তবে যতদূর মনে পড়ছে, এই সময়েই রাজনৈতিক নেতৃবন্দ আইয়ুবী শাসনতন্ত্রের অগণতান্ত্রিক দিকসমূহ উল্লেখ করে তাকে প্রতিহত করার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। ছাত্র আন্দোলনের কর্মীদের চাপের ফলেই রাজনৈতিক নেতারা উক্ত বিবৃতি প্রদানে সম্মত হন। উপরোক্ত বিবৃতিই ৯ নেতার বিবৃতি হিসেবে ইতিহাসে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণভাবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। যা হোক আইয়ুবের শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে ‘৬২ সালের মৌলিক গণতন্ত্রীদের ভোটে যে জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে দলীয়ভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ও কর্মীরা অংশ গ্রহণ না করলেও ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক দলের কিছু কিছু নেতা তাতে অংশ গ্রহণ করেন এবং জয়লাভ করেন। এদের মধ্যে মুসলিম লীগের আবদুল মোনায়েম খান, আবদুস সবুর খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান চৌধুরী, ভাসানী ন্যাপের মশিউর রহমান (যাদু মিয়া) প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। মুসলিম লীগের এককালীন নেতা পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীও (যিনি প্রধান মন্ত্রীত্ব হারিয়ে রাষ্ট্রদূতের চাকুরি নিয়ে দেশত্যাগ করেছিলেন) পুনরায় রাষ্ট্রদূতের চাকুরী ত্যাগ করে বগুড়ার একটি নির্বাচনী কেন্দ্র থেকে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্র-সমাজ ও রাজনৈতিক দলের ম্যান্ডেট ভঙ্গ করে উপরোক্ত রাজনৈতিক নেতারা জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হলেও আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি যে, তাঁদের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাঁদেরকে দিয়ে জাতীয় পরিষদের মধ্যেই আইয়ুবের স্বৈরতান্ত্রিক একনায়কত্বের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে।
উক্ত সিধান্তের ভিত্তিতে আমরা জাতীয় পরিষদের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাত করা এবং তাঁদের নিকট ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে একটি স্মারকলিপি প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। উক্ত স্মারকলিপির মূল কথা ছিল : পূর্ব বাংলা থেকে জাতীয় পরিষদের যে সমস্ত সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁদেরকে আইয়ুবের স্বৈরতন্ত্র, রাজবন্দীদের মুক্তি এবং পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার সম্পর্কে বক্তব্য উথাপন করতে হবে। ছাত্র আন্দোলনের নেতা ও কর্মীরা ছোট ছোট গ্রপে বিভক্ত হয়ে আমাদের উপরোক্ত স্মারকলিপি জাতীয় পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের কাছে পৌছিয়ে দিতে সক্ষম হন। কারণ বাষট্টির ছাত্র অভ্যুথানের প্রাথমিক পর্বের পরিসমাপ্তির পর আন্দোলনে যে ভাটার টান এসেছিল, আমরা আন্দোলন ও সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণের মধ্য দিয়ে অত্যন্ত সফল্যজনকভাবে শুধু তাকে প্রতিহতই করিনি, আন্দোলনের মধ্যে আবার পূর্ণ জোয়ার সৃষ্টি করতেও সক্ষম হই। এই সময় আন্দোলনের প্রাথমিক পর্বে যারা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তারাও মুক্তিলাভ করে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন। মুক্তি প্রাপ্তদের মধ্যে ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, জিয়াউদ্দিন মাহমদ, রফিকুল হক, ইদানল রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো প্রমুখ। ছাত্র কর্মীদের মুক্তির কিছু পূর্বে ও পরে রাজনৈতিক নেতাও মুক্তিলাভ করেছিলেন। এখন আবার পূর্বের প্রসঙ্গে ফিরে আসছি। আমরা তথাকথিত জাতীয় পরিষদের সদস্যদের কাছে শুধু স্মারকলিপি প্রেরণ করেই ক্ষান্ত হইনি, যে সমস্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ম্যান্ডেট ভঙ্গ করে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সাক্ষাতেরও ব্যবস্থা করি। এই সাক্ষাতকার গুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ বলে আমি এখানে দুই একটি সাক্ষাতকারের কথা সবিস্তারে উল্লেখ করতে চাই। আমরা প্রথমেই বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর সাথে দেখা করি। আমি নিজেও উক্ত সাক্ষাৎকারে উপস্থিত থাকি। ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে আমিই প্রথম আলোচনা শুরু করি। তাঁকে বলা হয়, আপনি ছাত্র-জনতার ম্যান্ডেট ভঙ্গ করে আইয়ুবী শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। এই জন্য আমরা অত্যন্ত বিক্ষুদ্ধ। তবুও আমরা আপনাকে ক্ষমা করে দিতে চাই একটি শর্তে। উক্ত শর্ত হচ্ছে : আপনারা জাতীয় পরিষদে গিয়ে পর্ব-বাংলায় ছাত্র-জনতার পক্ষ থেকে গণতান্ত্রিক অধিকার রাজবন্দীদের মুক্তি এবং পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের সপক্ষে নিজেদের কণ্ঠকে সোচ্চার করবেন। আর একটি কথা। আপনাৱা আইয়ব সকাল্পের সঙ্গে কোন সহযোগিতা করতে পারবেন না। মন্ত্রী হতে পারবেন না। যদি আপনানা তা করেন, পর্ববাংলার মাটিতে আপনারা ফিরে আসতে পারবেন না।” আমি অত্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে এবং কঠোর ভাষায় উপরোক্ত বক্তব্য উপস্থাপিত করলেও মোহাম্মদ আলী সাহেব তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভাষায় আলোচনার মধ্যে হালকা রস সঞ্চার করতে শুরু করেন। তিনি বলেন আপনারা ছাত্ররাই আমাদের নেতা ।
আমরা আপনাদের নির্দেশ ভঙ্গ করেছি, আপনাদের সাহায্য করার জন্যই। আপনারা ময়দান থেকে আইয়ুবকে খতম করতে চান, আর আমরা জাতীয় পরিষদের ভিতর থেকে আইয়ুবের শাসনের ইমারত ভেঙ্গে ফেলতে চাই। আমরা তো আপনারই লাঠিয়াল।” এই বলে তিনি হাসতে থাকেন। কিন্তু উপস্থিত ছাত্রনেতারা তাঁর এই হাস্যরসের মধ্যে অংশ গ্রহণ না করে তাঁর সাথে আরও কঠোর ভাষায় আলোচনা শুরু করেন। তিনি ছাত্রদের কড়া মেজাজ বুঝতে পেরে বলেন, আমি আপনাদের শর্ত মেনে নিচ্ছি। আমি ওয়াদা করছি, ছাত্রদের রায় আমি অমান্য করবো না।” চট করে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “যদি আপনি আপনার ওয়াদা ভঙ্গ করেন ?” উত্তরে মোহাম্মদ আলী সাহেব তার গলার চারদিকে হাত ঘুরিয়ে ইঙ্গিতে জবাব দিলেন, আমাকে আপনারা কোতল করে দিবেন। আমি যদি আপনাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করি, তা হলে আমি আর পূর্ব বাংলার মাটিতে ফিরে আসবো না” আমরা এরপর সেখান থেকে চলে আসি। বলা বাহুল্য, আমাদের প্রতি প্রদত্ত ওয়াদা ভঙ্গ করে কেমন করে কয়েকদিনের পরেই মোহাম্মদ আলী সাহেব আইয়ুবের মন্ত্রী সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ও জাতীয় পরিষদের সরকারী দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন, সে কথা সবারই জানা আছে। তবে এটা ঠিক যে, মোহাম্মদ আলী সাহেব তাঁর একটি ওয়াদা রক্ষা করেছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলার মাটিতে আর ফিরে আসেননি। অন্ততঃ জীবিত অবস্থায়। আইয়ুবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকা অবস্থাতেই তিনি আকস্মিকভাবে হ্রদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। এবার যে রাজনৈতিক নেতার সাথে সাক্ষাতকারের কথা উল্লেখ করবো, তিনি এখনও জীবিত আছেন এবং পূর্ব ঐতিহ্য অনুসারেই জনগণ, গণতন্ত্র ও ইসলামের খেদমত করে যাচ্ছেন। তিনি হচ্ছেন মুসলিম লীগ নেতা আবদুস সবুর খান। তাঁর সাথে তাঁর বকশীবাজারের বাসায় ছাত্র প্রতিনিধিদল সাক্ষাত করতে গেলেই তিনি অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে বলে উঠলেন : “তোমরা আমার কাছে কেন এসেছো ? আমি জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছি বলে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য। আমি আইয়ুবকে দেখে নেবো। তোমারা কি জান না, আইয়ুবের মার্শাল ল জারী হওয়ার পর আমাকে ৪টি ক্ষেদণ্ড দেওয়া হয়েছে ?’ প্রসঙ্গতঃ উলেখযোগ্য, ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ জারী হওয়ার সাথে সাথে আবদুস সবুর খান (তিনি তখনও খান, এ সবুর হননি) গ্রেপ্তার হন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তিনি আগরওয়ালা নামক জৈনক মাড়ােয়ারীর জুট বেলিং প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডাইরেক্টর ছিলেন এবং সামরিক আইন জারী হওয়ার সাথে সাথে উপরোক্ত কোম্পানী বোধগম্যকারণে তাদের সমস্ত কাগজপত্র নষ্ট করে ফেলার জন্য বস্তাবন্দী করে নদীতে ফেলে দেয়। শুনেছি যে, কাগজপত্রের ঐ বস্তা দু একদিন পরে নদীতে ভেসে ওঠে এবং তা পুলিশের মাধ্যমে সামরিক বাহিনীর হাতে পড়ে যায়। মোট কথা, মাড়োয়ারীর জুট বেলিং কোম্পানীয় ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে ব্যবসায়িক নীতির অভিযোগে জনাব সবুর গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে বেত্রদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। যা হোক, ছাত্র প্রতিনিধি দলকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই জনাব সবুর বলে উঠলেন : “আমার কাছে তোমরা কেন এসেছো? তোমরা কি মনে কর যে, আমি আইয়ুবের সাথে সহযোগিতা করব। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন একবার বসতে দাও, তারপর আইয়ুব খান বুঝবে ‘কত ধানে কত চাল’। তোমরা আমার কাছে না এসে বরং মোহাম্মদ আলী, মোনায়েম খান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, ওয়াহিদুজ্জামান—এদের কাছে যাও। ওরা মন্ত্রী হওয়ার জন্য পাগল হয়েই গেছে। তোমরা কি পাগল হয়েছে যে, আইয়ুবের মন্ত্রীসভায় ভূট্টা, বকরীদের সাথে আমি মন্ত্রী হবো?” প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং লেঃ জেনারেল বারকা তখন আইয়ুবের প্রথম মন্ত্রীসভার সদস্য। সবুর সাহেব যেভাবে নিজেই সবকিছু উজার করে বলে ফেললেন, তাতে দু’ প্রতিনিধিদল বেশ কিছুটা মুগ্ধ ও সন্মোহিত হয়ে সেদিন এলেন। কিন্তু সেদিন কি তাঁরা ঘুনাক্ষরে একথা বঝতে পেরেছিলেন যে, এই ভদ্রলোক এই সাক্ষাতকারের ৮/১০ দিন পরই আইয়ুবের মন্ত্রীসভায় যোগাযোগ মন্ত্রীর আসন অলংকৃত করবেন। তারপর ? তার পরের ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষের অজানা থাকার কথা নয়।
সবুর সাহেবের সাথে সাক্ষাতকারের পর আমরা আরও কিছু জাতীয় পরিষদের সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত করি। কিন্তু ঐ সমস্ত সাক্ষাতকারগুলোর তেমন কোন তাৎপর্য নেই বলে আমি এখানে সেগুলোর উল্লেখ করছি না। তবে আমি বিশেষভাবে এখানে ‘স্বনামধন্য মোনায়েম খানের সাথে আমাদের সাক্ষাতের প্রচেষ্টা এবং পরবর্তীকালে ঢাকা বিমান বন্দরে তার সাথে আমাদের মোলাকাতের প্রসঙ্গটি এখানে একটু বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করতে চাই।
মোনায়েম খান তখন মুসলিম লীগের তেমন কোন নামজাদা নেতা। হলেও ছাত্র সমাজের কাছে তিনি একটি কারণে ‘বিখ্যাত হয়ে পড়েছিলেন। ময়মনসিংহ থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েই মোনায়েম খান সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। উক্ত বিবৃতিতে তিনি রাজবন্দীদের দেশদ্রোহী হিসেবে আখ্যায়িত করে তাঁদের যাতে মুক্তি প্রদান করা না হয়, তার জন্য সরকারের কাছে আবেদন জানান। স্বাভাবিকভাবেই আইয়ুবের কারাগারে বন্দী প্রায় তিন হাজার রাজবন্দীর বিরুদ্ধে এই ধরণের বিষোদগার করায় ছাত্রসমাজ অত্যন্ত বিক্ষুদ্ধ হয়ে পড়ে। আমরা মোনায়েম খানের সঙ্গে দেখা করার জন্য আরমানীটোলার ময়দানের কাছে তাঁর বেয়াই ইসলামিয়া লাইব্রেরীর মালিক শরফুদ্দিন সাহেবের বাড়ীতে গেলাম। তিনি সে বাড়ীতেই উঠেছিলেন এবং বহুকষ্টে আমরা তার ঠিকানা সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। কিন্তু রাত প্রায় একটা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও আমরা তার সাথে দেখা করতে পারলাম না। আমাদের উপস্থিতির কথা জানতে পেরে তিনি নরল আমীন সাহেবের বাসাতেই রাত কাটালেন। তার পরদিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত’ সমস্ত জাতীয় পরিষদ সদস্যের পিণ্ডি চলে যাওয়ার কথা। সুতরাং সিধান্ত গ্রহণ করলাম যে, আমরা গেরিলা কায়দায় আচমকা তেজগাঁ বিমানবন্দরে উপস্থিত হবে এবং জাতীয় পরিষদের সকল সদস্য বিশেষ করে মোনায়েম খানকে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে “চরমপত্র’ দিয়ে আসবো। তারিখ আমার মনে পড়ছে না, তবে সকাল ৯টা বাজার আগেই আমরা ৫০/৬০ জন কর্মী সহ বিমান বন্দরে হাজির হলাম। সেখানে ভি, আই, পি লাউঞ্জে সমবেত জাতীয় পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশ্য করে ছাত্রসমাজের পক্ষ থেকে আমি বক্তব্য পেশ করলাম। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পক্ষ থেকে জনাব মশিউর রহমান এবং সৈয়দ আবদুস সুলতান প্রতিশ্রুতি প্রদান করলেন যে, তাঁরা ছাত্র সমাজের ম্যাণ্ডেট অনুসারে জাতীয় পরিষদের অভ্যন্তরে গণতন্ত্র, রাজবন্দীর মুক্তি এবং পূর্ব বাংলার জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের পক্ষে জোরালো আওয়াজ তুলবেন। কিন্তু তখনও মোনায়েম খান বিমানবন্দরে আসেননি। আমি অন্যান্য জাতীয় পরিষদ সদস্যদের সাথে কথা বলছি, এমন সময়ে কে যেন আমাকে খবর দিল, “মোনায়েম খান এসেছে। ভি, আই, পি লাউঞ্জ থেকে দৌড় দিলাম বিমান বন্দরের মূল হল ঘরে। যেয়ে দেখি, মোনায়েম খানকে চারিদিক থেকে ছাত্রকর্মীরা ঘেরাও করে ফেলেছে। বিমান বন্দরে সমবেত জনতাও তাদের সাথে হাত মিলিয়েছে এবং ইতিমধ্যেই কিছু ‘ধেলাই-পর্ব’ সমাধা হয়েছে। আমি তাড়াতাড়ি কর্মীদের নির্দেশ দিলাম : “তোমরা মোনায়েম খানকে ঘিরে বৃত্তাকারে হাত ধরাধরি করে ব্যারিকেড রচনা কর। আমরা তাকে দৈহিকভাবে নয়, রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে চাই। এই কথা বলে আমি এগিয়ে গেলাম মোনায়েম খানের দিকে। তারপর প্রথমে হাত, পরে তার শেরোয়ানায় কলার চেপে ধরে তাকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতার ভঙ্গীতে বললামঃ কুখ্যাত মোনায়েম খান। তোমাকে আমরা চিনি। তুমি একদিন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছিলে, এখন তুমি রাজবন্দীদের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেওয়ার মতো ঔদ্ধ্যত্ব দেখিয়েছ ! সুতরাং তোমার কঠিন শাস্তি হওয়াই উচিত। পূর্ব-বাংলার মাটি থেকে তেমাকে পশ্চিমপাকিস্তানেই আমরা যেতে দিতাম না। কিন্তু পাপীকে যেমন অনেক সময় ক্ষমা করে তাকে সংশোধন করার সুযোগ দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি তোমাকেও আমরা তোমার চরিত্র সংশোধন করার সুযোগ দিতে চাই। জাতীয় পরিষদে তোমাকেই প্রথম রাজবন্দীদের মুক্তির দাবীতে মূলতবী প্রস্তাব উত্থাপন করতে হবে। যদি তুমি এই শর্তে রাজী হও, তাহলে তোমাকে আমরা ক্ষমা করে দিতে পারি।” আজও আমায় স্পষ্ট মনে আছে, মোনায়েম খান যে উত্তর দিয়েছিল। মোনায়েম বললেন : “ছাএ বন্ধুরা, আমি আজীবন পাকিস্তানের খেদমত করেছি, আজীবন আর খেদমত করে যাবো। তবে আমি তোমাদের দাবী মেনে নিচ্ছি।” স্পষ্টতই তার কথার মধ্যে ফাঁক ছিল–আর তাই ছাত্র-সমাজ উত্তেজিত হয়ে উঠলো এবং যা অনিবার্য তাই ঘটতে থাকলো। এক পর্যয়ে মাথা থেকে তার টুপী পড়ে গেলো এবং সাংবাদিকরা ক্যামেরায় উক্ত দৃশ্যের ছবিও তুলে ফেললো। আমি তাড়াতাড়ি টুপটি উঠিয়ে ভার হাতে দিয়ে দিলাম। এই সময় বিমান থেকে আওয়াজ ভেসে এলো : “জনাব আবদুল মোনায়েম খান, আপনি তাড়াতাড়ি বিমানে আরোহন করুন। সবাই বিমানে উঠে গেছেন।” কিন্তু ছাত্র-জনতা এত উত্তেজিত যে, তাকে বিমানে উঠতেই দেবে না। ইতিমধ্যে দৌড়ে এলেন ইত্তেফাক সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) এবং সংবাদ সম্পাদক জনাব জহুর হোসেন চৌধুরী। এসেই তাঁরা বললেন : “জাফর, কি করছো ? মোনায়েম খানকে বিমানে উঠতে দাও। তা না হলে এই ঘটনার বিরুপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে।” তাঁদের পরামর্শে বহু কষ্টে তাঁকে উদ্ধার করে বিমানে উঠিয়ে দেয়া হলো। এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন পর বগুড়ার মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে যারা আইয়ুবের মন্ত্রীসভায় যোগদান করেন, তাদের মধ্যে আবদুল মোনায়েম খান ছিলেন অন্যতম এবং তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদে নিযুক্ত হন। দুই এক মাস পর আইয়ুব খান তাকে পূর্ব-পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন। পরে শুনেছি, মোনায়েম খান তেজঁগা বিমান বন্দরে ছাত্রদের হাতে যে লাঞ্ছনা ভোগ করেন, সেটাকেই পূজি করে তিনি আইয়ুবের কৃপা দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। পূর্ব বাংলার জনগণের উপর শোষণ, বঞ্চনা ও নির্যাতনের স্টীম রোলার চালাবার জন্য মোনায়েম খান যে একজন বিশ্বস্ত, অনুগত ও প্রভূভম্ভ হবে, এই সত্য উপলব্ধি করতে আইয়ুবের কোন অসুবিধা হয়নি। বিমানবন্দরের ঘটনা আইয়ুবের এই উপলদ্ধি আনয়নে যথেষ্ট সাহায্য করে। অবশ্য, মোনায়েমও প্রভুর প্রতি কোন দিন বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। তেজঁগা বিমান বন্দরে আমাদের বক্তব্যের জবাবে তিনি আজীবন খেদমত করার জন্য যে কথা দিয়েছিলেন, জীবন দিয়েও তিনি তা রক্ষা করেছেন।
বাষট্টির ছাত্র অভ্যুত্থান তৃতীয় পর্ব
বাষট্টির ছাত্র অভ্যুথানের তৃতীয় পর্ব হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। শিক্ষা কমিশন রিপোর্টকে কেন্দ্র করে যে ছাত্র আন্দোলনের সৃষ্টি হয় এবং যা পরে স্বৈরতন্ত্র বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দেলন এবং স্বাধিকারের চেতনার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে দেশে দাবানলের সৃষ্টি ফরে, সেটাই এদেশে সবচেয়ে সফল ছাত্র আন্দোলন। সমস্ত ছাত্র সমাজই এতে অংশগ্রহণ করেছিল তাদের নিজ নিজ সংকটাপন্ন সমস্যা-জঞ্জরিত অবস্থান থেকে। অবশ্য, বায়ান্নেতে এবং ‘৬৮-৬৯ সালেও ছাত্রদেয় জঙ্গী আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু শুধুমাএ ছাত্রদের সমস্যাভিত্তিক এমন ব্যাপক ও বিশাল আন্দোলন আর হয়নি বললেই চলে। অবশ্য শিক্ষা মিশন রিপোর্ট বিরেধী আন্দোলনের পরিধি সংকীর্ণ ছিল এবং তার আবেদন মূলত ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই আন্দোলন ছাত্রসমাজের পশ্চাদপদ, অংশকেও টেনে আনতে সক্ষম হয়েছিল এবং স্কুলের ছাত্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এতে বাঁধভাঙ্গা স্রোতের মতন নেমে এসেছিল। অন্যদিকে, পরবর্তীকালে এই আন্দোলন স্বৈরতন্ত্র বিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনে স্রোতধারার সাথে সম্পৃক্ত হয়ে তার সংকীর্ণ গণ্ডীর পরিধিকে অতিক্রম করতে পেরেছিল। আর এই জন্য ছাত্র আন্দোলনের তৎকালীন নেতারা কৃতিত্বের দাবী করতে পারেন। এখানে এ কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বিরোধী আন্দোলন প্রথম আমরা শুরু করিনি—এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে কলেজের ছাত্ররাই শক্ত করেছিলেন। এই সম্পর্কিত তথ্য এখানে লিপিবদ্ধ করার আগে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের মর্মবস্তু সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। আইয়ুবের নির্দেশে বিচাৱপতি হামুদুর রহমান (বাঙ্গালী হয়েও তিনি তখনও পাকিস্তানে অবস্থান করছেন।) উপরোক্ত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়ন করেন। হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট নামে কুখ্যাত উক্ত রিপোর্টের নিম্নোক্ত বিষয়বস্তু সমূহ ছাত্রদের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও উত্তেজনার সৃষ্টি করেঃ
(১) ৩ বছরের বি, এ, পাস কোর্স পদ্ধতি চালু করা হয়। এর আগে দুই বছরের ডিগ্রী কোর্স ছিল।
(২) রিপোর্টে শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রবণতা অত্যন্ত নগ্নভাবে ফুটে উঠে। স্কুল-কলেজের সংখ্যা কমানো এবং ছাত্র বেতন বদ্ধির সুপারিশ উক্ত রিপোর্টে করা হয়।
(৩) শিক্ষা ধনিক শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার অপপ্রয়াস গ্রহণ করা হয়। রিপোর্টে বলা হয় যে, শিক্ষা শুধু মাত্র মেধাবী ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে। রিপোর্টে এমন কথাও বলা হয় যে, শিক্ষা ব্যয়ের ব্যয়ের শতকরা ৮০ ভাগ অভিভাবকদের বহন করতে হবে, বাকী অংশ সরকার বহন করবে। স্বভাবতঃই এর ফলশ্রুতিস্বরুপ হচ্ছে এক ধরনের Investment বা বিনিয়োগ। রিপোর্টে সুপারিশে শিক্ষা ধনীদের হাতে সীমাবদ্ধ হওয়ার আশংকা দেখা দেয়।
এ সরকারের উপরোক্ত শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের মধ্যে বিক্ষোভের স্বতঃস্ফুত বহিপ্রকাশ প্রথম ঘটে কলেজের ছাত্রদের মধ্যে। যতদুর মনে পড়ে, প্রথম ঢাকা কলেজে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে “ডিগ্রী স্টুডন্টস ফোরাম” গঠিত হয়। এই ফোরাম গঠিত হয় ঢাকা কলেজ কাফেটেরিয়ায়। সভাপতিত্ব কৱেন ঢাকা কলেজ ছাত্রসংসদের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক কাজী ফারুক আহমদ। পরবর্তী পর্যায়ে “ডিগ্রী ফোরাম” নেতৃবৃন্দ জগনাথ কলেজ, কায়েদে আজম কলেজ ও ইডেন কলেজে পরস্পর কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত করে। সভা অনুষ্ঠান ও বিবৃতি প্রদানের প্রক্রিয়ায় মধ্যদিয়ে “ডিগ্রী স্টুডেন্টস ফোরাম” ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম যুগান্তরিত হয়। এই সভা অনুষ্ঠিত হয় ইউনিভার্সিটির কাফেটেরিয়ায়। এতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি মিলিতভাবে যোগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের পক্ষ থেকে এনায়েতুর রহমান, জামাল আনোয়ার বাসু, ঢাকা কলেজের সাধারণ সম্পাদক কাজী ফারুক, জগন্নাথ কলেজে ভি, পি, আবদুলাহু ওয়ারেস ইমাম, ইডেন কলেজ ছাত্রসংসদে মতিয়া চৌধুরী, নাজমা বেগম, কায়েদে আজম, কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি নুরুল আরেফীন খান, নারায়ণগঞ্জ তোলারাম কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক আবদুল আজিজ বাগমার প্রমুখ উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন।
কাজী ফারুক আহমদ এবং আবদুল্লাহ ওম্রারেস ইমামকে ধন্য আছায় নির্বাচিত করে ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদ গঠিত হয়। এই ফোরামের নেতৃত্বেই প্রথমে কলেজ ছাত্রদের মধ্যে এই আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করে। এই ফোরামের মধ্যে প্রথম থেকেই দুইটি ধারা চলে আসছিল। সাধারণ ছাত্রদের একটা অংশ চাচ্ছিল এই আন্দোলন ৩ বছরের ডিগ্রী কোর্স বাতিলের আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে। ছাত্রলীগ প্রভাবিত অংশ মূলত এই চিন্তা ভাবনার অনুসারী ছিলেন। ছাত্র ইউনিয়ন প্রভাবিত অংশ এটা হয় আন্দোলন পটভূমিকা সৃষ্টি করার মাধ্যম হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। যদিও প্রথম অবস্থায় এই আন্দোলন আমাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণে ছিল না, কিন্তু প্রথম থেকেই এর গতিধারার দিকে আমরা সুতীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে যাচ্ছিলাম। সংগ্রাম ফোরামের অন্যতম আহবায়ক কাজী ফারুক আহমদ ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আবদুল্লাহ ওয়ারেস ইমাম ছিলেন ছাত্রলীগের সমর্থক, আর ফোরামের অধিকাংশ সদস্যই ছিল আমাদের ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী ও সমর্থক।
এইভাবে শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলন যখন দানা বেধে উঠতে শুরু করে, তখনই আমরা তাকে আন্দোলনের সাধারণ গতিধারার সাথে সামিল করার উদ্যোগ গ্রহণ করি।’ আন্দোলনের কেন্দ্র এতদিন পর্যন্ত ছিল বিভিন্ন কলেজ, কিন্তু আমরা তাকে এবার নিয়ে আসি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন ভবনের ঐতিহাসিক আমতলা থেকে সূচিত হয়েছিল ফেব্রুয়ারী অভ্যুথানের প্রথম বিস্ফোরণ, সেটাই হয়ে দাঁড়ালো এই আন্দোলনের মূল কেন্দ্র। মুলত কলেজের ছাত্রদের নিয়ে যে ফোরাম গঠিত হয়েছিল, তাকে সম্প্রসারিত করে বিভিন্ন ছাত্র প্রতিষ্ঠানের ও স্কুল-কলেজের ছাত্রদের সমবায়ে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। এর নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের উপর বর্তায়। কারণ, ঢাকা শহরের অধিকাংশ স্কুল-কলেজে ছাত্র ইউনিয়নের শক্তিশালী সংগঠন আমরা গড়ে তুলতে পেরেছিলাম। অবশ্য ছাত্রলীগের ভূমিকাকেও খাটো করে দেখা যাবে না। তারাও এতে অংশগ্রহণ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় এক বিরাট ছাত্র সমাবেশের মধ্য দিয়ে বাষট্রিয় ছাত্র অভ্যুথানের তৃতীয় পর্বের দূর্বার যাত্রা শুরু হয়। উক্ত সভায় মুল বক্তা হিসেবে ছিলাম আমি ও শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। আমি অত্যন্ত জোরালো ও উত্তেজনাপণে বক্তব্য পেশ করি। বক্তব্যের বিষয়বস্তু আজ স্মরণ নেই। তবে আমাদের অগ্নিক্ষরা বক্তৃতা ছাত্রদের মধ্যে এমন এক প্রাণচাঞ্চল্য ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে যে, সাধারণ ছাত্ররাই স্বতঃস্ফুতভাবে মিছিল সহকারে বেরিয়ে পড়ে। সে এক অন্তহীন মিছিল। রাজধানী ঢাকা শহরে আর বেরিয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। প্রায় পঁচিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রী উক্ত মিছিলে অংশগ্রহণ করে। মিছিলের বিশালতা দেখে সর্বপ্রকার আয়োজন থাকা সত্ত্বেও সামরিক কর্তৃপক্ষ মিছিলে বাঁধা দিতে সাহস পায়নি। এর পর আমরা অবিরাম ছাত্র ধর্মঘটের আহান জানাই। অত্যন্ত স্বতঃক্ষত সাফল্যজনকভাবে এই অবিরাম ধর্মঘট পালিত হয়। দুই একদিন পর পরই বেরতে থাকে ঢাকা শহরে ছাত্রদের মিছিল। নয় দশ বছরের স্কুলের ছাত্র থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা পর্যন্ত উক্ত মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। এমনকি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষককেও উক্ত মিছিলে অংশগ্রহণ করতে আমি দেখেছি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শত শত ছাত্রীরা উক্ত মিছিলে অংশগ্রহণ করেছেন। মিছিলগুলো সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় ছাত্র সমাবেশের পর বেরিয়ে কার্জন হল ও হাইকোর্টের পাশ দিয়ে আবদুল গনি রোড হয়ে লাটভবন (সে সময়ে গভর্নর হাউজের মুল গেইট ছিল আজকে যেখানে গুলিস্তান বাস টারমিনাল হয়েছে সেখানে) ও নওয়াবপুর রেল ক্রসিং অতিক্রম করে এগিয়ে যেতো পুরাতন ঢাকার দিকে। তারপর সদরঘাট, ইসলামপুর, মিটফোর্ড আরমানীটোলা, নাজিমুদ্দিন রোডের কেন্দ্রীয় কারাগারের সম্মুখভাগ দিয়ে মিছিলের গতি থামতে শহীদ মিনারে। মিছিল কত বিশাল ও সুদীর্ঘ হতো, তার একটি বর্ণনা দিচ্ছি। মিছিলের এক প্রান্ত যখন নওয়াবপুরে রেল ক্রসিংয়ে থাকত, তখন আর এক প্রান্ত হয়তো মিটফোর্ড অতিক্রম করে গেছে। কিন্তু মিছিল হতো অত্যন্ত সংগঠিত ও সুশৃংমঙ্খল। এইভাবে ছাত্রদের এই আন্দোলন গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আন্দোলনের সাথে সম্পন্ত হয়ে যখন ব্যাপক জনতার সমর্থন অর্জন করতে সক্ষম হয়, তখন আমরা ১৭ই সেপ্টেম্বর ছাত্র ধর্মঘট ও সাধারণ হরতালের আহ্বান দেই। এই ভাবেই রচিত হয় রক্তাক্ত ১৭ই সেপ্টেম্বরের ঐতিহাসিক পটভুমিকা। ১৭ই সেপ্টেম্বর এই দেশের ছাত্র আন্দোলনের একটি অবিস্মরণীয় দিন। বাষট্রিয় ছাত্র অভ্যুথানের এটি ছিল সর্বাপেক্ষা রক্ত ঝরানো দিন। দিনে ছাত্র-জনতা কিভাবে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ইতিহাস সৃষ্টি করেছে, কিভাবে অফাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। কিভাবে অকুতোভয়ে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, আর একজন সাক্ষী হিসেবে আমি আজও বেচে রয়েছি। শুধু আমি নই আমার মতো অনেকেই যে বেচে আছেন, এটা একটা আশ্চর্য ঘটনা বলতে হবে। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি ঘটনার সাথে আমি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলাম বলে আমি এই দিনটির ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে একটা বিশদভাবে বর্ণনা দেব। তবে তার আগে ১৬ই ডিসেম্বর সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও এই দিনটির তাৎপর্য অস্বীকার করা যাবে না। এই নিবদ্ধে পূর্বেই আমি উল্লখ করেছি যে ৩১শে জানুয়ারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। খুব সম্ভবত ১০ই সেপ্টেম্বর তিনি করাচীতে মুক্তি লাভ করেন এবং ১৬ই সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন। আমাদের হরতালের ঠিক আগের দিন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ঢাকা আগমন সাধারণ ছাত্রসমাজের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এমনিতেই একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, সরকারের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতেই শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব মুক্তিলাভ করেছেন। নিয়মতান্ত্রিকতার, পূজারী শহীদ সোহরাওয়াদ সাহেবকে আইয়ুব সরকার আন্দোলনের গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ব্যবহার করতে চেয়েছিল কিনা সুনিশ্চিতভাবে এ কথা বলার ঝুকি আমি নিতে চাই না। তবে আমরা এই ব্যাপারে যে বেশ কিছুটা সন্দেহপ্রবণ ছিলাম, এই কথা অস্বীকার করতে চাই না। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে বিমান বন্দরে বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়। আমরাও তাতে অংশগ্রহণ করি। আমার স্পষ্ট মনে পড়ছে শহীদ সাহেবেক যে গাড়ীতে করে মিছিল সহকারে ঢাকা বিমান বন্দরে নিয়ে আসা হয়েছিল, ঠিক তার পেছনে একটা স্কুটারে মাইক লাগিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকজন আমরা বক্তৃতা করছিলাম। বক্তৃিতার ভাষা মূলত শহীদ সাহেবের প্রতি অভিনন্দনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও মাঝে মাঝে বক্তৃতার মধ্যে কিছু কিছু সতর্কবাণীও উচ্চারিত হচ্ছিল। সতর্কবাণীর ভাষা ছিল : “আন্দোলনের প্রশ্নে আমরা আপোষহীন। আগামীকাল ১৭ই সেপ্টেম্বর হরতাল আমরা করবোই। যদি কেউ আন্দোলনের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে কিংবা সরকারের সাথে সমঝোতার চেষ্টা করে তাকে আমরা ক্ষমা করবো না। তিনি যত বড় নেতাই হন না কেন। আমাদের উপরোক্ত বক্তব্যের সর উপলদ্ধি করতে কারো , এমনকি শহীদ সাহেবেরও কষ্ট হয়নি। মনে আছে, শহীদ সাহেব যখন শেরেবাংলার মাজার জিয়ারত করতে গেলেন, (হাঁফ সাহেব জেলে থাকা অবস্থাতেই শেরেবাংলা মত্যু বরণ করেন) তখন শেখ মুজিবর রহমান এবং জনাব মানিক মিয়া আমাকে বক্তৃতার ভাষা সংযত করার জন্য সতর্ক করে দেন। ছাত্রলীগের বন্ধুরাও তাঁদের অবিসংবাদিত নেতার প্রতি ও ধরনের কটাক্ষ সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না। ফলে বেশ কিছুটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। যা হোক, কথা ছিল শহীদ সাহেবের সম্বর্ধনা পর আমরা ‘ডাকসু’ অফিসে বসে ১৭ই সেপ্টেম্বরের ছাত্র ধর্মঘট ও হরতালের কর্মসূচী সম্পর্কে চূড়ান্ত সিধান্ত গ্রহণ করবো। ছাত্র লীগের বন্ধুদের উক্ত সভায় আসতে যথেষ্ট বিলম্ব হয়। বিলম্বের কারণ হিসেবে তাঁরা যা বলেন তার মমার্ধ হচ্ছে, “নেতা তাঁর সম্বর্ধনা মিছিলকে হরতালের প্রস্তুতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা পছন্দ করেননি। তাছাড়া তাঁর প্রতি কটাক্ষ করায়, তিনি যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই একটু, গরু-গম্ভীর পরিবেশে আমাদের আলোচনা শুরু হয়। উক্ত সভায় ১৭ই সেপ্টেম্বরের হরতালের কর্মসূচীকে সফল করার জন্য কতিপয় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ডাকসু অফিসে ও জগন্নাথ কলেজে দুইটি কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। জগন্নাথ কলেজে স্থাপিত কেন্দ্রের দায়িত্ব ছাত্রলীগ সম্পাদক শেখ ফজলুক হক মনির উপর অর্পণ করা হয় এবং উক্ত কেন্দ্র থেকে পুরাতন ঢাকার হরতাল পরিকল্পনা করার সিদ্বান্ত গ্রহণ করা হয়। ডাকসু কেন্দ্রের দায়িত্ব কার উপর অর্পিত হয়েছিল, সেটা আমার অরুণ নেই। তবে আমার উপর দই কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পড়ে। উক্ত বৈঠকে আরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, ছাত্র ধর্মঘট ও হরতালের জন্য প্রয়োজনবোধে পিকেটিং করতে হবে এবং সকাল বেলায় পিকেটিং-এর কাজ সমাধার পর সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সকাল ৯টায় জমায়েত হবে এবং আমতলায় ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হবে। সকাল দশটায় ঐতিহাসিক আমতলা থেকে মিছিল বের করা হবে। গভীর রাতে উক্ত সিধান্ত করার পর যে যার দায়িত্ব সম্পাদন করার জন্য চলে যান। ছাত্রলীগের বন্ধুৱা বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের নেতবৃন্দের সাথে আলোচনা করার জন্য গেলেন বলে মনে হলো। আওয়ামী লীগ তখন আন্দোলনের বর্তমান গতিধারাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিয়মতান্ত্রিক খাতে প্রবাহিত করার কথা চিন্তা করছিলেন বলেই আমাদের ধারণা সৃষ্টি হয়। এই জন্যই ছাত্রলীগের নেতৃত্বের মধ্যে ১৭ই সেপ্টেম্বরের হরতাল সম্পর্কে কিছুটা দ্বিধা ও দ্বন্দ পরিলক্ষিত হয়। এই জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রের কাজ তদারক করে ভোর চারটার সময় আমি আমাদের কয়েকজন সহকর্মী সহ জগন্নাথ কলেজ কেন্দ্রের দিকে যাই। সেখানে যেয়ে দেখি, পূর্ব সিদ্ধান্ত মোতাবেক আমাদের কাজ খুব সুশৃংঙ্খলভাবে সমাধা না হলেও ছাত্র কর্মীরা বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে ভোর পাঁচটা থেকেই রাস্তায় নেমে পড়েছে। আমিও তাদের সঙ্গী হলাম। রাস্তায় নেমে দেখি, প্রচুর পুলিশ রাস্তার মোড়ে মোড়ে মোতায়েন হয়েছে। সার্জেন্ট হাফিজের নেতৃত্বে একটি পুলিশ দল নওয়াবপুর রেলওয়ে ক্রসিং থেকে সদরঘাট পর্যন্ত টহল দিচ্ছে। যেখানেই তারা আমাদের কর্মীদের দেখতে পাচ্ছে, সেখানেই ঝাপিয়ে পড়ছে, লাঠি চার্জ করছে, কোথাও কর্মীদের গ্রেপ্তার করছে। আমার চোখের সামনেই এমনি বেশ কয়েকটি দৃশ্য আমার নজরে পড়লো। আমি জগন্নাথ কলেজ থেকে কাপ্তান বাজারের কাছে পৌছতে পৌছতে আমাদের প্রায় ১০/১১ জন কর্মী গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন এবং কয়েক দফা লাঠি চার্জও হয়ে গেছে। আমার সাথে জগন্নাথ কলেজ থেকে যাত্রার সময় শেখ মনিও ছিল, কিন্তু কাপ্তান বাজার পর্যন্ত আসতে আসতে আমাদেরকে পুলিশের লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তারকে এড়িয়ে আসতে হচ্ছিল। নওয়াবপুর রেলওয়ে ক্রসিং ও মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটের মধ্যবর্তী জায়গায় আমি বেশ কিছু গণ্ডাকে লোহার বড় লাঠি ও বড় বড় রামদা নিয়ে ঘোরাফিরা করতেও দেখতে পেলাম। প্রচার সতর্কতা অবলম্বন করে অন্যান্য সহকর্মীদের সাহায্য ও সহযোগিতায় আমি নওয়াবপুর রেলওয়ে ক্রসিং পার হলাম। নওয়াবপুর রেলওয়ে ক্রসিং পার হওয়ার সাথে সাথে আমি সম্পূর্ণ এক ভিন্ন দৃশ্য দেখতে পেলাম। দেখলাম, রাস্তায় প্রচুর মানুষ নেমে পড়েছে। পুলিশ ভাড়া করছে, লাঠি চার্জ করছে, কিন্তু তারা খেয়েও পিছু, হটে আবার তাঁরা ফিরে আসছে। আমাদের মনোবল আবার ফিরে এলো। আমি গুলিস্তানের সামনে ট্রাফিক স্ট্যাণ্ড ও কামানের উপর দাঁড়িয়ে জনগণের উদ্দেশ্যে। দুই তিনবার বক্তৃতাও করলাম। বক্তৃতার মধ্য দিয়ে পুলিশের নির্যাতনের কথা তুলে ধরলাম এবং জনগণকে তা মোকাবিলা করার জন্য আহ্বান জানালাম। আমার বক্তৃতার ভাষার মধ্যে আবেগজনিত উত্তেজনা ও নির্যাতনের বিবরনে যে কিছুটা বাড়াবাড়ি ছিল, তা অস্বীকার করা যাবে না। কিন্তু আমাদের বক্তৃতায় জনগণের কাছ থেকে যে সাড়া পাওয়া গেল, তা ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়। অত্যন্ত উৎসাহিত হয়ে আমি ও অন্যান্য সাথীরা পল্টন ময়দানের দেয়াল থেকে শুরু করে উচু জায়গা যেখানেই পাওয়া গেছে, সেখানে আমরা বক্তৃতা করতে শুরু করলাম। আমার মনে আছে, সেদিন আমি একাই এ ধরণের ৫১টি ই সভায় বক্তৃতা করেছিলাম। আমার সাথে আরও যারা বক্তৃতা করেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন রহিম, আজাদ প্রমুখ। ফল দাঁড়ালো এই যে, আমরা যখন প্রেস ক্লাবের সামনে উপস্থিত হয়েছি, তখন আমাদের সাথে কমপক্ষে পাঁচ ছয় হাজার মানুষ শামিল হয়েছে। প্রেস ক্লাবের সম্মুখে এসে আমরা শুনতে পেলাম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা স্থানীয় কর্মী আবদুল হালিমকে একটু আগেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তার উপর দৈহিক নির্যাতন করা হয়েছে। এই সংবাদ আমাদের মনে আগুন ধরিয়ে দিল, কারণ হালিম দলমত নির্বিশেষে সবারই কাছে অত্যন্ত প্রিয় ছিল। আমরা সেখানে অপেক্ষা না করে বিদ্যালয় আমতলায়, উপস্থিত হলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যাওয়ার সময় বিপরীত দিক থেকে কয়েক হাজার মানুষের একটি মিছিলের সাথে আমাদের মুখোমুখী দেখা হলো। উক্ত মিছিলে মহিউদ্দিন, রেজা আলী হায়দার আকবর খান রনো রাশেদ খান মেনন, সিরাজুল আলম খান প্রমুখ ছিল। দুইটি মিছিলকে নিয়েই আমরা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় হাজির হলাম। সময় তখন খুব সম্ভবতঃ ৮-৪৫ মিঃ। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে লোকারণ্য। কমপক্ষে দশ হাজার ছাত্র জনতা সেখানে সমবেত হয়েছে। এমন সময়ে খবর এলো যে, নওয়াবপুর রোডে গুলি হয়েছে এবং কয়েকজন শহীদ হয়েছে। আর যায় কোথায়, উপস্থিত ছাত্র-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। পূর্ব নির্ধারিত সময়সূচী রক্ষা করা সম্ভব হলো না তখনি আমাদের সভা শুরু করে দিতে হলো। সুশংঙ্খল সভা করা তখন সম্ভব ছিল না। খুব সম্ভবতঃ আমি একাই বক্তৃতা করি এবং আমার বক্তৃতা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণ থকে মিছিল বেরিয়ে গেলো। মিছিলের পূর্বভাগে থাকলেন সিরাজুল আলম খান, মহিউদ্দিন, রনো, মেনন, রেজা আলী, আবদুল রহিম আজাদ, আইয়ুব রেজা চৌধুরী প্রমুখ। মিছিল যখন কার্জন হলের সামনে দিয়ে হাইকোর্ট পার হয়ে আবদুল গুলি রোডের দিকে অগ্রসর হয়েছে, তখন মিছিলের পিছন দিকে গুলীর আওয়াজ আমরা শুনলাম। এখানেই বাবুল ও ওয়াজিউলাহ সাহাদত বরণ করেন। মিছিল একটু থমকে দাঁড়ালো। আমি দেখলাম, সিরাজুল আলম খান সহ কয়েকজন ছাত্রকর্মী আহত ও নিহতদের নিয়ে মেডিক্যাল কলেজের দিকে যাচ্ছেন। আমরা মিছিলকে না ভেঙ্গে সামনের দিকে অগ্রসর হলাম। আমাদের গন্তব্যহল জগনাথ কলেজের কেন্দ্র। কারণ সেখান থেকে পূর্ব নির্ধারিত কর্মসূচী অনুযায়ী বিরাট মিছিল বের হওয়ার কথা ছিল। আমরা মিছিল নিয়ে যখন নওয়াবপুর রেলওয়ে ক্রসিং পর্যন্ত গিয়েছি, তখন আবার গুলী বষর্ণ করা হলো। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছাত্র আবদুল হামিদ আহত হলেন। আহত হলেন আরও অনেকে। তবুও মিছিল নিয়ে আমরা অগ্রসর হলাম। রথখোলার মোড়ে যখন আমরা উপস্থিত হলাম, তখন দেখলাম অন্তত হাজার খানেক পুলিশ ও মিলিটারী ব্যারিকেড রচনা করে আমাদের পথ রোধ করে দাঁড়িয়েছে। ব্যারিকেডের অপর পার্শ্বে দেখতে পেলাম জগন্নাথ কলেজ কেন্দ্র থেকে আগত কয়েক হাজার ছাত্র-জনতার আর একটি মিছিল দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশ ও মিলিটারী বাহিনী দুইটি মিছিল, যাতে এক সাথে শামিল হতে না পারে সেজন্যই ব্যারিকেড রচনা করেছে। এই ব্যারিকেড ভাঙ্গার জন্য মিছিলের দুইদিক থেকে আমাদের পক্ষ থেকে শিলাবৃষ্টির মত ইষ্টক বর্ষণ শুরু হলো। পুলিশ-মিলিটারীর দল প্রথম অবস্থায় হটে যেতে বাধ্য হলো এবং কোট প্রাঙ্গণে আশ্রয় নিয়ে এলোপাথাড়ি গুলী ও টিয়ারগ্যাস ছাড়তে শুরু করলো আক্রমণের এই তীব্রতার সামনে মিছিল আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়লাম। পুরাতন ঢাকার গলিতে গলিতে আমরা ঢুকে পড়ে আত্মরক্ষা করলাম। তারপর বিচ্ছিন্ন ও বিক্ষিপ্তভাবে আমরা চারিদিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পিছনের দিক থেকে দেয়াল টপকে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাঙ্গণে হাজির হলাম। ততক্ষণে অংশ সারা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা পুলিশ-মিলিটারী ঘেরাও করে ফেলেছে। আমরা তবুও এই ঘেরাও এর মধ্যেই ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের একটি যৌথ বৈঠক করতে সক্ষম হলাম। এন, এস, এফ ও ছাত্র শক্তির কাউকে দেখা গেলো না। ছাত্রলীগের নেতৃত্বের সাথে আমাদের কিছু, ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি হলো। মিছল পূর্ব নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বের করার জন্য তারা আমাদের দায়ী করলেন। কেউ কেউ উত্তেজনা যশে এমন কথাও বললেন যে, গুলীবর্ষণের ঘটনার জন্য আমরাই দায়ী। যা হোক, আমরা তাদের নিকট কি পরিস্থিতিতে মিছিল পূর্ব নির্ধারিত সময়ের পরে বের করতে হয়েছে, তা ব্যাখ্যা করলাম। উত্তেজনা কিছুটা প্রশমিত হলেও ভুল বোঝাবুঝি দূর হলো না। এরপর আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল কলেজের মধ্যবর্তী রেলিং টপকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যেয়ে ঢুকলাম। হাসপাতালে আহতদের অবস্থা দেখে আমরা হতভম্ব হয়ে গেলাম। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। চারিদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত আর আহতদের করুণ আর্তনাদ। এত বেশী মানুষ আহত হয়েছে যে, তাদের রাখার জায়গা পর্যন্ত নেই। কাউকে কাউকে বারান্দায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। অবশ্য, ডাক্তার ও মেডিক্যাল কলেজের ছাত্ররা চিকিৎসা করার ত্রুটি করছে না। তারপর গেলাম অমরা মর্গে। সেখানে বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহর লাশ পূর্বেই রাখা হয়েছে শহীদের আত্বীয়স্বজনেরা লাশ নিতে যাচ্ছে দাফন করার জন্য কিন্তু একটি মিলিটারী ভ্যান তাদের লাশ ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছে। এই খবর শুনে চতুর্দিক থেকে কয়েকশত ছাত্র-জনতা সেখানে জমায়েত হয়ে গেলো। আমাদপর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, আমরা কিছুতে লাশ নিতে দিব না। মর্গ থেকে লাশ আমরা মর্গের পাশ্ববর্তী হল রুমে নিয়ে এলাম। তারপর লাশকে সম্মুখে রেখে আমরা প্রতিজ্ঞা করলাম, কিছুতেই লাশ নিতে আমরা দেবো না। আমার মনে আছে, লাশকে সামনে রেখে মর্মস্পর্শী বক্তিৃতা করেছিলাম। বস্তুত করতে করতে কান্নায় যেমন আমি ভেঙ্গে পড়েছিলাম। ঠিক তেমনি উপস্থিত শ্রোতারাও তাদের অস্রু ধারণ করতে পারেননি। মেয়েদের মধ্যে কেউ কেউ ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকলো। অবস্থা এমন পর্যায়ে উপনীত হলো যে, মিলিটারী ভ্যান, সরে পড়লো! সঙ্গীদের আত্মীয়র লাশ দাফন করার সুযোগ পেলে। শহীদের আত্মীয়রা ঘন দাফন করার জন্য লাশ নিয়ে গেলেন, তখন বিকেল গড়িয়ে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমরা রাতের অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে উপস্থিত হলাম জনাব আতাউর রহমান খানের বাড়ীতে। সেখানে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবর রহমান, নুরুল আমীন, মাহমুদ আলী, জনাব আতাউর রহমান, খান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। আমরা ছাত্র সমাজের পক্ষ থেকে তাঁদের কাছে ছাত্র-জনতার হত্যার প্রতিবাদে আগামীকাল অর্থাৎ ১৭ই সেপ্টেম্বর হরতাল ডাকার জন্য আহ্বান জানালাম। কিন্তু শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব বললেন যে, “তোমরা ছাত্ররা বাড়াবাড়ি করেছ এবং বাড়াবাড়ি করেই এই ধরণের ঘটনা সৃষ্টি করেছো। তাই আমরা হরতালের ডাক দিয়ে পরিস্থিতিকে অনিয়মতান্ত্রিকতার পথে নিয়ে যেতে দিতে পারি না।’ তিনি আরও বললেন, আমার সাথে গভর্নর গোলাম ফারুকের কথা হয়েছে। একটা সমঝোতা করা যাবে। তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছ যারা সমঝোতা না করে গণ্ডগোল বাধিয়ে দিতে চাও। এবং আমাদের নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করে দিতে চাও। আমি তোমাদের কোন কথা শুনতে চাই না। আন্দোলন এখানেই শেষ করতে হবে। একেতো সারাদিন রক্তের খেলা দেখেছি, সমস্ত স্নায়ুতে স্নায়ুতে উত্তেজনা শহীদ সাহবের কথা আর সহ্য করতে পারলাম না। বিশেষ করে তাঁর কথায় ছাত্র ইউনিয়নের প্রতি কটাক্ষ করা হয়েছিল। আমি টেবিলে সজোরে আঘাত করে তাঁর কথার প্রতিবাদ জানালাম তিনিও রেগে ফেটে পড়লেন। সংঘাত চরমে পৌছিলো। শেখ সাহেব আমাকে এক পাশে টেনে নিয়ে গেলেন। আমরা অত্র ইউনিয়নের যারা উপস্থিত ছিলাম, আমি, মহিউদ্দিন, রেজা আলী, রহিম আজাদ, রুনো, মেনন (মুহম্মদ ফরহাদ সেদিন উপস্থিত ছিলেন কিনা আমার স্মরণ নেই) প্রমুখ সবাই সেখান থেকে এ রাগ করে উঠে চলে এলাম। আসার সময় বলে এলাম ; “দেখা যাবে নেতাদের আমরা নেতা বানিয়েছি, প্রয়োজন হলে আমতলায় আবার কবর দিব।” কিন্তু এই ঘটনার পর ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে এমন ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হলো যে, আন্দোলনকে আর অগ্রসর করে নেওয়া সম্ভব হলো না। সৃষ্টি হলো আন্দোলনে বিভ্রান্তি। এর মধ্যে আবার ২৩শে সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের সরকার হাটের স্কুলছাত্ররা যখন ধর্মঘট করে। তখন পুলিশ গুলি বর্ষণ করে এবং সেখানে একজন ছাত্র শহীদ হন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবার সম্ভব হলো না। আমরা খুব সম্ভবত ২৪শে সেপ্টেম্বর পল্টন ময়দানে এক ছাত্র জনসভা অনুষ্ঠিত করলাম এবং সরকারকে চরমপত্র দিলাম শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবী সহ অন্যান্য দাবী মেনে নেওয়ার জন্য। প্রকৃতপক্ষে আমরা আন্দোলন আপাততঃ থামিয়ে দিলাম। সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো, আবার প্রস্তুতি নিয়ে ও সংগঠিত হয়ে আন্দোলন শুরু করা হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাহেব গভর্নর গোলাম ফারুকের সাথে আলোচনা শুরু করলেন একটা সমঝোতা করার জন্য। শহীদ সাহেবের বক্তব্য হলো ; “এভাবে আন্দোলন করে লাভ হবে না। আগে সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করাতে হবে, অন্দোলনকে নিয়মতান্ত্রিক গণ্ডীর মধ্যে আনতে হবে। তিনি আইয়ুবী শাসনতন্ত্র বাতিলের দাবীরও বিরোধিতা করলেন। তিনি বললেন, শাসনতন্ত্রকে গণতন্ত্রায়ণ করে প্রয়োজনবোধে এই শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতেই নির্বাচন করতে হবে। সে প্রসঙ্গ ভিন্ন প্রসঙ্গ তাই এখানে সে আলোচনা করবে না। মোট কথা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের দোদুল্যমানতা ও আপোষকামীতার কারণে ‘৬২-এর ছাত্র অভ্যুত্থানের পরিসমাপ্তি সেখানেই ঘটে। তবে কিছুদিন পর সরকার তিন বছরের ডিগ্রী কোর্সের সিদ্ধান্ত প্রভ্যাহার করে নেয়। এবং আন্দোলনের আংশিক সাফল্য অর্জিত হয়, কিন্তু শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল করা হয়নি। তবুও এই আন্দোলন ব্যর্থ হয়েছে এই কথা বলা যায় না-কারণ এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ছাত্র জনতার যে ব্যাপকতম ঐক্য গড়ে উঠেছিল, সেই ঐক্যই পরবর্তীকালে ৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক উবর্র ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল। পরবর্তীকালের ইতিহাস তারই নির্ভুল স্বাক্ষর।
উপসংহার
বাষট্টির ছাত্র অভ্যুথানের তত্বগত পর্যালোচনায় আমি ইচ্ছতভাবেই যাইনি। আমি এর হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করার জন্যই এর ধারাবাহিক ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ‘৫২ সালের ভাষা অন্দোলনের ইতিহাস মোটামটি লিখিত হয়েছে। কিন্তু বাষট্টির ইতিহাস এখনও লিখিত হয়নি। সম্পূর্ণ স্মৃতিশন্তির উপর নির্ভর করেই এটা লিখতে হয়েছে। কোন দলিলপত্র কিংবা কোন। তথ্যসম্বলিত প্রবন্ধও আমার হাতের কাছে ছিল না। ‘৬৩ সালে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক “ডাক দিয়ে যাই” নামক একটি। সংকলন প্রকাশিত হয়েছিল এবং উক্ত সংকলনে “ এক নজরে ১৭ সেপ্টেম্বর” শীর্ষক আমার লিখিত একটি প্রামাণ্য তথ্য সমৰ্থ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ বহু চেষ্টা করেও তার হদিশ মিলেনি। তাছাড়া, এই নিবন্ধটি এমন এক অস্বাভাবিক তাড়াহুড়াের মধ্যে আমাকে লিখতে হয়েছে যে, আমি স্তির নিশ্চিত যে, বাষট্টির ছাত্র অভ্যুথানের ইতিহাসের প্রতি এবং আমার নিজের প্রতিও আমি এখানে সবিচার করতে পারিনি। আমার ৬ই সেপ্টেম্বর উত্তর কোরিয়া সফরে যাওয়ার কথা। একদিকে এই লেখাটি লেখার জন্য “বিচিত্রা” সহকারী সম্পাদক মাহফুজউল্লাহর তাগাদা, অন্যদিকে বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি, এই টানাপোড়েনেই আমি একে ইতিহাসের চাহিদা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করতে পারলাম না। আমার এই সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য সহৃদয় পাঠকবর্গের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।আমি ক্ষমা
আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি তাদের কাছে যারা এই ইতিহাসের নায়ক–অথচ যাৱা এর মধ্যে হয়তো তাদের আকাক্ষিত মর্মবস্তু খুজে পাবে না। তব, বাষট্টির ছাত্র অভ্যুত্থান সম্পর্কে আমার নিজস্ব মূল্যায়ন দুই-চার কথায় না বললে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমি বলতে চাই যে, বাষট্টির ছাত্র অভ্যুত্থান ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন তথা পূর্ব-বাংলার জনগণের স্বাধিকার আন্দোলনেরই আরেক অপেক্ষাকৃত বিকশিত ও পরিণত রপ। এই অভ্যুত্থানের বাহ্যিক চেহারা যাই থাক না কেন, এর মূল সুর ছিল, পশ্চিম-পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত একচেটিয়া পুজিপতিদের প্রতিভূ বিজাতীয় আইয়ুব শাহীর স্বৈরতাত্রিক ও জাতিগত নিপীড়ণের শৃংখল থেকে বেরিয়ে এসে জাতীয় স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা। এই স্বাধিকারের আকাঙক্ষাই ‘৬৮-৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সিড়ি বেয়ে ‘৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এই প্রসঙ্গে এই আন্দোলনের একটি দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে এই নিবন্ধ শেষ করতে চাই। ‘৬২ সালের ছাত্র অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জাতীয় চেতনার ফরুণ ঘটেছিল ঠিকই কিন্তু তা মেহনতী জনগণের শ্রেণী সংগ্রামের সাথে স্পষ্ট করা হয়নি। যদিও ‘৬২ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর টঙ্গী শিল্প এলাকায় শ্রমিক ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে পুলিশের গুলীতে সুন্দর আলী নামক জনৈক শ্রমিক শাহাদাত বরণ করেছিলেন এবং সেখানে শ্রমিক আন্দোলন যথেষ্ট সঙ্গীরুপ ধারন করেছিল কিন্তু আমরা তাকে আমাদের আন্দোলনের গতিপ্রবাহের সঙ্গে যুক্ত করতে পারিনি। শ্রমিকদের ক্ষেত্রে যেটা সম্ভব হয়নি। কৃষকদের ক্ষেত্রে তো সে প্রশ্ন উঠেই না। তাই ৬২-এর ছাত্র অভূত্থানে জাতীয় চেতনার স্ফুরণ ঘটলেও তার শ্রেণীগতভিত্তি শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে না থাকার কারণে পরবর্তীকালে এই দুর্বলতা কাটিয়ে তোলা যায়নি এবং স্বাভাবিকভাবেই স্বাধিকার তথা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব সাম্রাজ্যবাদের প্রতি মোহগ্রস্ত ও সামন্তবাদের সাথে সম্পর্কিত বলচিত্ত ও আপোষকামী ধনিকশ্রেণীর হাতে চলে যাওয়ার জন্য এটা ছিল অন্যতম কারণ।
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.09.09-6.pdf” title=”1977.09.09″]