You dont have javascript enabled! Please enable it! সাক্ষাৎকার | মণি সিংহ - সংগ্রামের নোটবুক

মণি সিংহ

নির্বাচন অনুষ্ঠানের পর থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত আমি কারাগার বন্দী ছিলাম। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থেকে কাজ করার পর ১৯৬৭ সালে আমি গ্রেপ্তার হই এবং ১৯৬৯ সালের মহান গণঅভ্যুত্থানের সময় জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আমার এবং রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি দেশের আনাচে-কানাচে ধ্বনিত করে তোলে, সেই পটভূমিতে ফেব্রুয়ারী মাসে আমরা মুক্তি পাই।

কিন্তু সামরিক শাসন জারি ও ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় আসার পর ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে আমাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের পর বন্দীরা রাজশাহী জেল ভেঙ্গে আমাকে বের করে নেয়ার আগ পর্যন্ত আমি আটক ছিলাম। কাজেই উল্লিখিত সময়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে পার্টি ও জনগনের রাজনৈতিক সংগ্রামে সরাসরি যোগ দিতে পারিনি। তবে আমাদের পার্টির তখনকার ভূমিকা আমার জানা আছে, সেটা সংক্ষেপে বলছি।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্লেষণ ও পরিস্থিতির মূল্যায়ন আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে বের করা হয়। আমরা নির্বাচনের ফলাফলকে পূর্ব বাংলার জনগণের ঐক্যবদ্ধ অভ্যুত্থান এবং একটি আকাঙ্খার বহিঃপ্রকাশরুপে দেখি। আমাদের বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল যে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ৬-দফার পক্ষে রায়ের মধ্য দিয়ে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা আরও বিকাশ লাভ করেছে এবং বাঙালি জাতির আত্ননিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠানকে নায্য মনে করে এবং প্রকৃতপক্ষে আমাদের পার্টিই প্রথম বাংলাদেশের জনগণের পূর্ণ আত্ননিয়ন্ত্রণের দাবি ধ্বনিত করে।

নির্বাচনের ফলাফল মূল্যায়ন করে আমরা আরও দেখছিলাম যে আওয়ামীলীগ কেবল “পূর্ব পাকিস্তানের ” জনগণেরই সর্বাত্নক সমর্থন পায় নি, তৎকালীন পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে গোটা পাকিস্তানের সরকার গঠনের অধিকারও লাভ করেছে। কিন্তু আমরা মূল্যায়নে বলেছিলাম যে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি এবং এই শাসকদের মদদকারী সাম্রাজ্যবাদ কিছুতেই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নেবে না এবং তা বানচাল করার জন্য ষড়যন্ত্র করবে। বিশেষত ৬-দফার সঙ্গে ছাত্র সমাজের ১১-দফাও তখন জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল এবং বিজয়ী দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১১-দফাকে সমর্থন দিয়েছিলেন। ১১-দফায় সাম্রাজ্যবাদ ও একচেটিয়া পূঁজির স্বার্থের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলা হয়েছিল, ফলে তাঁর ঐ নির্বাচনের দাবি কিছুতেই মানতে পারে না। এ-কারনে পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ছিল অনিশ্চিত এবং এমতাবস্থায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকেই অগ্রসর হবে এবং সে সংগ্রামের জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা দরকার।

১৯৭০ সালের নির্বাচন সম্পর্কে আমাদের পার্টর এই বিশ্লেষণ পরবর্তী ঘটনাবলী সঠিক বলেই প্রমাণিত হয়। ‘৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাস নাগাদ নির্বাচনের ফলাফল বানচালের জন্য পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এবং ভুট্টো প্রমুখের ষড়যন্ত্র পরিষ্কার হয়ে উঠে এবং জাতীয় সংসদের যে অধিবেশন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষনা অনুযায়ী ৩রা মার্চ হওয়ার কথা ছিল তা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ঐ সময় ২৫ শে ফেব্রুয়ারী আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি এক প্রস্তাবে রাজনৈতিক দাবী হিসেবে ঘোষনা মোতাবেক জাতীয় সংসদের অধিবেশন, সেখানে জাতিসমূহের আত্ননিয়ন্ত্রণের অধিকারের স্বীকৃতিসম্বলিত শাসনতন্ত্র প্রনয়ন এবং প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ঐ শাসনতন্ত্র অনুমোদন ও ক্ষমতা হস্তান্তর করার দাবী উত্থাপন করে। সে সঙ্গে ঐ প্রস্তাবে বলা হয় যে, নির্বাচনের রায়কে কার্যকরী করতে না দেয়া হলে বাংলাদেশের জনগনের আন্দোলন একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দিকে যেতে পারে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের কর্তব্য হবে বাঙালিদের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রনের নীটি অনুসারে ঐ সংগ্রামে শরিক থাকা এবং ঐ নিতি অনুসারে সমস্ত গনতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে এই সংগ্রামকে সঠিক পথে চালিত করতে চেষ্টা করা।

১লা মার্চ ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় সংসদের অধিবেশন হবে না – এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে আমরা শাসকগোষ্ঠীর ষড়যন্ত্র কার্যকর হতে দেখলাম। ঐ দিন জনগন স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে স্বাধীনতার আওয়াজ তুলল। পরিস্থিতি সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়ন ছিল যে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বাঙালী জাতির এই অভ্যুত্থান দমন করার জন্য সর্বাত্নক শক্তি প্রয়োগ করবে এবং স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন হবে। সে জন্য জনগণকে প্রস্তুত করা দরকার।

আমাদের পার্টি বেআইনী এবং আত্নগোপনে ছিল। ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক প্রভৃতি গণসংগঠনের মাধ্যমে এবং অন্যান্য গনতান্ত্রিক শক্তির সঙ্গে আমাদের যতটুকু যোগাযোগ এবং সম্পর্ক ছিল তা কাজে লাগিয়ে আমরা আমাদের মূল্যায়নের ভিত্তিতে প্রচারকার্য চালিয়েছি। পার্টির নামোল্লেখ না করে আমরা ‘ একতা ‘ নামে যে সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সুযোগ গ্রহণ করেছিলাম তার মাধ্যমেও আমরা দেশপ্রেমিক শক্তি ও জনগণকে প্রস্তুত করার জন্য প্রচার চালিয়েছি। প্রকৃতপক্ষে উল্লিখিত সময়ের মধ্যে আমরা সম্ভাব্য স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাধ্যমতো আমাদের পার্টি ও জনগণকে প্রস্তুত করে তুলেছিলাম।

১লা মার্চের পর ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স এর জনসমাবেশ থেকে “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম ” বলে ঘোষণা দিয়ে যে অসহযোগ আন্দোলনের সূচনা করেন, আমরা তার পুরোপুরি সমর্থক ছিলাম। ইয়াহিয়া খান যখন ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় বসেন, তখন আলোচনার বিরোধীতা করাকে আমরা যুক্তিসংগত মনে করি নি, কিন্তু আমাদের পার্টির মূল্যায়ন ছিল যে ঐ আলোচনায় কোন অপসরফা হবে না কেননা জনগণ স্বাধীনতার আকাঙ্খা ব্যক্ত করেছে এবং পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী এবং সাম্রাজ্যবাদীরা এটা মেনে নিতে পারে না। আমাদের পার্টি তখন জনগণের সচেতনতা জাগরূক রাখার জন্য এবং আসন্ন যেকোন ধরনের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে ঢাকাসহ সম্ভব মতো দেশের সব জায়গায় স্বেছাসেবক বাহিনী গঠন, তাদের কুচকাওয়াজ ও ট্রেনিং ইত্যাদির ব্যবস্থা করি। তখন ছাত্রসমাজের শক্তিশালী প্রগতিশীল সংগঠন ” পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন “-এ আমাদের পার্টির প্রভাব থাকায় তাদের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ’ইউ ও টি সি’র- সহায়তায় তরুণ-তরুণীদের রাইফেল ট্রেনিং এবং কুচকাওয়াজের আয়োজন করা হয়েছিল। ডেমরা এলাকার কিছুসংখ্যক শ্রমিককেও আমরা স্বেচ্ছাসেবক করে এ-ধরনের ট্রেনিং-এ যুক্ত করেছিলাম। এ-সব কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ছিল জনগণকে দেখিয়ে উদ্ধুদ্ধ ও তাদের মনোবল বৃদ্ধি করা এবং সশস্ত্র সংগ্রাম সম্পর্কে মানসিকভাবে সচেতন ও প্রস্তুত করে তোলা। এক কথায় ঐ সময়টাতে আমাদের পার্টির ভূমিকা ছিল অবশ্যম্ভাবী স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাধ্যমতো সকল দেশপ্রেমিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ, জনগণকে সচেতন ও প্রস্তুত করে তোলা। এক কথায়, ঐ সময়টাতে আমাদের পার্টির ভূমিকা ছিল অবশ্যম্ভাবী স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সাধ্যমতো সকল দেশপ্রেমিক শিক্তিকে ঐক্যবদ্ধ, জনগণকে সচেতন ও প্রস্তুত করে তোলা।

আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ২৫শে মার্চের আগেই বুঝতে পেরেছিল যে অবস্থা ক্রমেই সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়ে যাচ্ছে। উল্লেখ করা যায় যে, ৯ই মার্চ ঢাকায় উপস্থিত কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের এক বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সশস্ত্র সংগ্রামের যথাসম্ভব প্রস্তুতির জন্য একটি সার্কুলার প্রচার করা হয়েছিল। তবে তখনকার পরিস্থিতিতে কোনো কোনো জেলায় সার্কুলারটি বিলম্বে পৌঁছে এবং পার্টির তখনকার শক্তিসামর্থ্য সশস্ত্র সংগ্রামের ব্যাপক প্রস্তুতির উপযুক্ত ও ছিল না। সে পরিস্থিতিতে ২৫ শে মার্চ জনগণের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ শুরু হয়।

সামগ্রিক অবস্থা সম্পর্কে আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ছিল এই যে, জনগণ জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছে এবং বিশেষত সমগ্র পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন, পশ্চিম-পাকিস্তানে ভুট্টোর দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং বাঙালিদের জাতীয় অধিকারের দাবির সঙ্গে ১১-দফায় সাম্রাজ্যবাদ-সামন্তবাদ-একচেটিয়া পুঁজিবিরোধী আকাঙ্ক্ষা ব্যক্তি হওয়ায় পাকিস্তানে একটা সরকার গঠন এবং বাঙালিদের দ্বারা শাসিত হওয়ার অবস্থা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ও সাম্রাজ্যবাদ কিছুতেই মেনে নেবে না। কাজেই বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনিবার্য এবং তা সশস্ত্র সংগ্রামের পথে যাবে। সে জন্য জনগণকে ঐক্যবদ্ধ ও প্রস্তুত করাই মুখ্য কাজ এবং তা খুব দ্রুত করতে হবে।

সামগ্রিক অবস্থা মূল্যায়নের আরও একটা দিক আমাদের পার্টির ছিল। তা হচ্ছেঃ আমরা সচেতন ছিলাম যে আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের কতগুলি দুর্বলতা থাকবে। মধ্যস্তরের জনগণের যে দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐ স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল তাঁদের মধ্যে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের চরিত্র ও তার বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে চেতনার ঘাটতি ছিল এবং শ্রমিক-কৃষক মেহনতী মানুষের সংগঠন শক্তি ছিল দুর্বল। বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আওয়ামী লীগের সমর্থনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল আমরা অনিবার্য ঘটনা-ধারায় পিছনে না থেকে সর্বশক্তি দিয়ে সংগ্রামে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সংগ্রামের গতিধারায় অন্যান্য দেশপ্রেমিক শক্তি ও জনগণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তাদের সচেতন হয়ে উঠার প্রক্রিয়ায় ঐ দুর্বলতাগুলো কাটানো প্রয়োজন বলেই তখন সিদ্ধান্ত করেছিলাম। তাছাড়া স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভের জন্য জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় মুক্তির সমর্থক আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের সমর্থন সংগঠিত করার প্রয়োজনীয়তাও আমরা উপলব্ধি করেছিলাম। উল্লেখ্য যে, ২৫ শে মার্চের আগেই ঢাকায় উপস্থিত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়ে বিভিন্ন দেশে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পত্র পাঠায়।

স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করাও প্রচার চালানোর মাধ্যমে প্রতিরোধের শক্তিগুলোকে প্রস্তুত করার চেষ্টার কথা আগেই বলেছি। ২৫ শে মার্চ পাকবাহিনীর সশস্ত্র আক্রমন শুরু হলে আমাদের পার্টির ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-স্বেচ্ছাসেবকরা যেখানে যতটুকু সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ প্রভৃতি দেশপ্রেমিক শক্তির সঙ্গে মিলিতভাবে প্রতিরোধরত বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর বাহিনীর সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে।

এপ্রিলের মাঝামাঝি নাগাদ এই প্রাথমিক প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়লে প্রথমে শহর থেকে গ্রামে এবং পরে বাধ্য হয়ে আমাদের কর্মীরা ভারতে চলে যায়। তাঁরা আমাদের পার্টি ও গণসংগঠনের সমর্থক ও ইচ্ছুক তরুণদেরও সংগঠিত করে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং -এর জন্য ভারত যেতে থাকেন। অনেক বিপন্ন পরিবারও ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

সীমান্ত অতিক্রম করার প্রাক্কালে আমি রাজশাহী জেলে বন্দী ছিলাম। বাইরে সমগ্র জাতি যে মুক্তির জন্য উদ্বেল হয়ে উঠেছে তা বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারতাম সামনে অপেক্ষা করছে এক নিদারুণ রক্তাক্ত সংগ্রাম। রাজশাহী শহরেই ইপিআর এর ক্যাম্প ছিল। পাকবাহিনীর ক্যাম্প ও ছিল। ২৫ শে মার্চ পাক বাহিনী ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করে। ই পি আর প্রতিরোধ করে। আমি গোলাগুলির আওয়াজ শুনি এবং কিছু কিছু গোলাগুলি জেলখানার কাছে এসে পড়তে থাকে। ফলে বন্দীদের মধ্যে উত্তেজনা দেখা দেয়। গোলাগুলির মাঝে পড়ে বন্দী অবস্থায় মৃত্যু ঘটতে পারে। অন্য সকল এসে আমাকে বলে যে আপনি ডি আই জি -কে বলুন জেলের গেয় খুলে সকলকে মুক্তি দিতে। ডি আই জি বললাম, কিন্তু তিনি রাজি হন না। তখন বন্দীরা সিদ্ধান্ত নেয় জেল ভেঙ্গে বের হবে। বাইরে জনতাও জেল ভাঙ্গা সমর্থন করে। বন্দী ও জনতা মিলে জেলের ময়লা ফেলার দরজা ভেঙ্গে ফেলে। আমরা বের হয়ে আসি। আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন রাজনৈতিক বন্দী ছিলেন। জনতাই আমাদের পদ্মা নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে নৌকায় উঠিয়ে দেয় এবং বলে যে, শহরে থাকা আপনাদের জন্য নিরাপদ নয়, আপনারা নদীর ওপারে চলে যান। নৌকাযোগে নদী পার হয়ে বুঝতে পারি যে, আমরা ভারতের মাটিতে পা দিয়েছি। কারন পদ্মার ওপারেই ভারত।

এই সময়ে জেলের ভেতরের বিচিত্র কোনো অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু মার্চ মাসের একটি অসাধারন ঘটনা ছিল। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলে ডাক দেয়ার পরে ঐ ভাষণ ও ঘোষণার জন্য আমি বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন ও সমর্থন জানিয়ে রাজশাহী জেল থেকে একটি টেলিগ্রাম করতে চাই। জেল কর্তৃপক্ষ বলেন যে, “আপনি তো টেলিগ্রাম করতে পারবেন না, কারন আপনি ডেটিনিউ। আপনার টেলিগ্রাম পাঠাতে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের অনুমোদন লাগবে। ” আমি বললাম, ” তবে অনুমোদন নিয়ে আসুন।” তাঁরা বলল যে, ” এখন অনুমোদন আনা যাবে না, কারন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ অফিসে কেউ কাজ করছে না, তারা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। ” পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগও অসহযোগ আন্দোলনে শরীক হয়েছে এমন অভিজ্ঞতা আমার রাজনৈতিক জীবনে ইতিপূর্বে আর ছিল না। তখন জেলের ভেতর থেকে আমি বুঝতে পারি যে সমগ্র জাতি স্বাধীনতার জন্য কতখানি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে।

প্রতিরোধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দলের সঙ্গে আমাদের আত্নগোপনরত পার্টির সম্পর্ক ছিল। বিশেষত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (মোজাফফর) আমাদের পার্টির ঐতিহ্যগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ন্যাপের অসাম্প্রদায়িক, সাম্রাজ্যবাদী বিরোধী এবং সমাজতন্ত্রের সমর্থক ভূমিকার জন্য আমাদের পার্টির সঙ্গে তাদের রাজনৈতিক ও নীতিগত মিল ছিল বেশী। অসহযোগ আন্দোলন, প্রতিরোধ ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে এই দুই পার্টি ঘনিষ্ঠ সহযোগীতায় কাজ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপের (এবং ছাত্র ইউনিয়নের) সঙ্গে মিলিতভাবে আমাদের পার্টি গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলে। অনেক স্থানে একত্রে ক্যাম্প করা হয়।

আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৯৬০-৬১ সাল অর্থাৎ আইয়ূব-বিরোধী আন্দোলনের সূচনা থেকেই আমাদের পার্টির সহযোগীতামূলক সম্পর্ক ছিল। আমাদের পার্টি আত্মগোপনে থাকতে বাধ্য হলেও ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব সময়টাতে আওমী লীগের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ে আমাদের মতবিনিময় ও পরামর্শ হয়েছে। ১৯৭০-এর নির্বাচনের ফলাফল পাকিস্তানী শাসকরা যে মেনে নেবে না এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনিবার্য এবং তা সশস্ত্র সংগ্রাম হতে পারে এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের পার্টি ঐক্যমত্যে পৌঁছেছিল। বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন যে সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য যোগাযোগের ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগীতা তাঁর জন্য মূল্যবান হবে, কেননা আওয়ামী লীগের এক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা ও যোগাযোগের অভাব রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু আজ বেঁচে নেই। তিনি ঘাতকদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। তাঁর স্মৃতিতে স্মরণ করে আমি বলতে চাই যে কমিউনিস্ট পার্টি সম্পর্কে তিনি যে মূল্যায়ন ও প্রত্যাশা করেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে আমরা তা পূরণ করতে পেরেছি।

১৯৭১ সালের এপ্রিলে আওয়ামী লীগ প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার গঠন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষনা করার পরই দেশের ভেতর আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও সম্পাদকমন্ডলীর উপস্থিত সদস্যরা এক বৈঠকে বসে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বাগত জানায় এবং প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগীতার কথা ঘোষনা করে। আমাদের পার্টির ঐ প্রথম প্রকাশ্য বিবৃতি বিদেশে সংবাদপত্র ও বেতারে প্রচারিত হয়েছিল। এর ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামে পার্টির ভূমিকা দেশ-বিদেশে জনগণ জানতে পারে। আমাদের পার্টির বহু সদস্য সমর্থক বাংলাদেশ সরকারের অধীনে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং গঠন করে। তবে এক্ষেত্রে সরকার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমাদের পার্টির কিছু কিছু দ্বিমত ও সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল ।

অন্যান্য দলের মধ্যে কাজী জাফর আহমদ ও রাশেদ খান মেননদের দলের সঙ্গেও আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হয়। এরা মাওবাদী নীতি অনুসরন করলেও ২৫ মার্চের পর সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে যায়। এরা স্বাধীনতার প্রতি সমর্থন দিলেও আওয়ামী লীগের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি, স্বাধীনতার শক্তিগুলোর ঐক্য এবং স্বাধীনতার আন্তর্জাতিক শত্রু-মিত্র সম্পর্কে এঁদের নীতির সঙ্গে আমাদের প্রভুত পার্থক্য ছিল। মুক্তিযুদ্ধকালে এঁরাসহ কিছু মাওবাদী শক্তি আওয়ামীলীগ কে বাদ দিয়ে একটি ‘বামপন্থী ফ্রন্ট’ গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছিল তাকে আমরা বিভেদাত্নক ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল করার প্রয়াসী বলে ভ্রান্ত মনে করে প্রত্যাখান করি এবং আওয়ামী লীগসহ জাতীয় ঐক্য গঠনের নীতি অনুসরণ করি। স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী দলগুলোকে আমরা শত্রু বলে চিহ্নিত করি।

২৫ মার্চের পড়ে জেল ভেঙে মুক্ত হওয়ার পর কয়েকজন সহকর্মীসহ আমার নিরাপত্তা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রয়োজন উপলব্ধি করে জনতাই আমাদের ঠেলে নিয়ে পদ্মা পার করিয়ে দেয় একথা আগেই বলেছি। কাজেই দেশের ভিতরে আমাদের পার্টির সংগঠিত হওয়ার ব্যাপারে আমি ব্যক্তিগতভাবে জড়িত থাকতে পারি নি।

আমাদের পার্টির অন্য নেতারা ২৫ মার্চের পর সঙ্গে সঙ্গেই দেশত্যাগ করেন নি। তাঁরা পরিস্থিতি অনুযায়ী ভেতর থেকে প্রতিরোধ সংগঠিত করার কাজ শুরু করেন। অচিরেই ঢাকায় থাকা অসম্ভব এবং সকলের থাকা অপ্রয়োজনীয় মনে হলে আমাদের পার্টির নেতৃবৃন্দ তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারন সম্পাদক আবদুস সালাম, খোকা রায়, মোহাম্মদ ফরহাদ, জ্ঞান চক্রবর্তী সাইফউদ্দিন মানিক, মনজুরুল আহসান খান প্রমুখ ঢাকা জেলার বেলাতো থানার রায়পুরায় ঘাঁটি করে অবস্থা করেন। কিছু কমরেডকে অধিকৃত রাজধানীতে রেখে যাওয়া হয়। রায়পুরা এলাকা পাকবাহিনীর পদানত হলে আমাদের নেতৃবৃন্দ ভৈরবের দিকে আশুগঞ্জ সরে গিয়ে অবস্থান নেন। নেতৃবৃন্দ দেশ থেকে পার্টির বিভিন্ন পর্যায়ে সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ পুনঃস্থাপন এবং পুনর্গঠিত হয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধ ভূমিকা পালনের চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। আশুগঞ্জে বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়লে এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে নেতৃবৃন্দের থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে এবং প্রকৃতপক্ষে এলাকার জনগণ তাঁদেরকে ক্রমে সীমান্তের দিকে নিয়ে যায়। সীমান্ত অতিক্রম করার আগেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বিভিন্ন জেলা সংগঠনের জন্য নির্দেশ দিয়ে ক্যাডার পাঠাতে সক্ষম হন।

পাকবাহিনীর আক্রমন, নির্বিচার গনহত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ প্রভৃতির মুখে সীমান্ত এলাকার হাজার হাজার মানুষ ভারতে চলে যায়। আমাদের পার্টির বহু কর্মী সমর্থক ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়। অন্যান্য দলের কর্মীরাও চলে যায়। আমাদের হিসেব অনুযায়ী আমাদের পার্টির নেতা, সমর্থক, কর্মীগন ও তাদের পরিবারবর্গ মিলিয়ে ৬ হাজার নরনারী ভারতের পশ্চিমবংগ, মেঘালয় ও ত্রিপুরা এই তিনটি রাজ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময়ে গোটা পার্টি সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন জেলায় দেশের মাঝে আমাদের কিছু কমরেড থেকে গিয়েছিলেন। প্রবাসে সকলের জন্যে আশ্রয়, খাদ্য প্রভৃতির ব্যবস্থা করা, ভেতরে বাহিরে সকল পার্টির সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করা, সংগঠন গুছিয়া নেয়া, এবং সর্বোপরি কালবিলম্ব না করে গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা সহ অত্যন্ত দুরুহ কাজ পার্টির সামনে ছিল। আমরা নেতা-কর্মীদের সবকিছু হাসিমুখের সাথে সহ্য করা, অসম সাহসিক প্রয়াস এবং ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি সহ অন্যান্য দেশপ্রেমিক শক্তির সাহায্যের ফলে অতি অল্প সময়ে আমরা কাজগুলো গুছিয়ে তুলি। এ পর্যায়ে আমাদের সংগঠিত হওয়ার ধারাগুলো ছিল নিম্নরূপঃ

ক) কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ক্যাম্প স্থাপন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও অন্যান্য দেশপ্রেমিকের সহায়তায় ভারতের তিনটি রাজ্যে তাদের আহার-বাসস্থানের ব্যবস্থা।

খ) দু ধরনের ক্যাম্প ছিল- পার্টির বয়স্ক সদস্যদের পরিবারবর্গের আশ্রয়ের জন্যে এবং তরুনদের যাদের লড়াইয়ের উপযুক্ত মনে করা হবে ও ট্রেনিং দিয়ে পাঠানো হবে।

(গ) ক্রমশ স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সহায়তা গ্রহন এবং আমাদের ক্যাম্পে সংগঠিত তরুনদের সরকারের মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং এ প্রেরণ।

(ঘ) আমাদের পার্টি, ন্যাপ, ও ছাত্র ইউনিয়নের মিলিত একটি নিজস্ব গেরিলা বাহিনী গঠন। এতে প্রথমে ট্রেনিং প্রদানে প্রভূত ‘টেকনিক্যাল’ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। পরে ভারত সরকারের অনুমতি নিয়ে তা গঠন সম্ভব হয়।

(ঙ) আগরতলায় এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে কলকাতায় কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যালয় গঠন করে কাজ করা।

(চ) আমাদের নিজস্ব গেরিলা বাহিনীকে বাংলাদেশ সরকারের সাথে যোগাযোগ রেখে দেশের ভেতরে যুদ্ধে পাঠানো।

(ছ) দেশের ভেতরে কমরেডদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন ও গেরিলাদের সহায়তা প্রদান।

(জ) আমাদের ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা।

(ঝ) কেন্দ্রীয় কমিটী কতৃক ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে তা সকল ক্যাম্পে, শরনার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে ও দেশের ভেতর প্রচারের ব্যবস্থা করা।

আমাদের পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনীতে ৫ হাজার তরুনকে ট্রেনিং দিয়ে পাঠানো হয়। এছাড়া আমাদের প্রচেষ্টায় আমরা আরো ১২ হাজার তরুনকে সংগ্রহ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনীতে পাঠাই। অর্থাৎ আমরা মোট ১৭ হাজার তরুন মুক্তিযোদ্ধাকে যুদ্ধের জন্যে সংগঠিত করি। তবে যুদ্ধের পরে এদের অনেকেই লেখাপড়া, চাকরি, কৃষিকাজ ও ব্যবসা প্রভৃতি নিজ নিজ পেশায় ফিরে যায় এবং রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত ছিল না।

ভারতে যাওয়ার পরই ১৯৭১ সালের মে মাসে কেন্দ্রীয় কমিটি মিলিত হয়ে প্রথমে স্বাধীনতা সংগ্রামের মৌলিক চরিত্র, সংগ্রামের শক্তি, ও শত্রু-মিত্র সম্পর্কে একটি দলিল গ্রহন করেছিল। ঐ দলিলে পাকিস্তানের ঐপনিবেশিক শাসন-শোষনের স্বরুপ নির্দেশ করে আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামকে জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম বলে মূল্যায়ন করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে স্বাধীনতার জন্যে জনগনের দৃঢ় একতা এবং মুক্তিবাহিনীর বীরত্ব ও ত্যাগ আমাদের প্রধান শক্তি। এবং প্রতিবেশী ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবির, বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন ও স্বাধীনতা, গনতন্ত্র ও প্রগতিকামী শক্তি আমাদের বন্ধু ও অন্যদিকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, মাওবাদী চীন ও দুনিয়ার অন্যান্য প্রতিক্রিয়াশীলেরা পাকিস্তানের সমর্থক ও আমাদের স্বাধীনতার শত্রু বলে মূল্যায়ন করেছিল। এই মূল্যায়ন সঠিক বলেই প্রমানিত হয়েছে।

মে মাসের পরেও মাঝে মাঝে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা করা সম্ভব হয়েছে। যদিও আমাদের কমরেডরা ভারতের তিনটি রাজ্যে ও দেশের মাঝে ছড়িয়ে থাকায় তা কষ্টসাধ্য ছিল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয় তিনটি রাজ্যেই সীমান্তবর্তী শহরে আমাদের পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের যৌথ ক্যাম্প ছিল। দু ধরনের ক্যাম্প ছিল। পার্টির বয়স্ক সসস্যদের পরিবারবর্গসহ এবং যুদ্ধে পাঠানোর জন্যে তরুনদের ‘ইয়ুথ ক্লাব’।

দেশ থেকে যাওয়ার সময়ে আমাদের কমরেডদের সাথে যে সামান্য অর্থসম্পদ ছিল,তাই ছিল আমাদের প্রাথমিক সহায়। পরে ভারতীয় নাগরিকদের দ্বারা গঠিত সহায়ক কমিটি থেকে আমরা অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য পেয়েছিলাম। আমাদের প্রতিষ্ঠিত কিছু ক্যাম্প আমরা বাংলাদেশ সরকারের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মিলিয়ে দিয়েছিলাম। পরে অল্প সংখ্যক ক্যাম্পই আমাদের নিয়ন্ত্রনে ছিল।

এছাড়া ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় প্রবাসী আমাদের পার্টির সমর্থকেরা অর্থ সাহায্য সংগ্রহ করে পাঠাতেন। বাংলাদেশে পাক বাহিনীর নৃসংসতা ও বাংগালীদের সাহসিক যুদ্ধের খবর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে ছাপা হওয়ার পর সারা দুনিয়াময় আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। এ পটভূমিতে মুক্তিযুদ্ধের শেষের মাসগুলোতে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে সাহায্য সংগ্রহের কাজটা আমাদের কমরেডরা সমন্বিত করে পাঠাতেন।

আমাদের ক্যাম্পে সংগঠিত তরুনদের অধিকাংশকেই যেহেতু মুক্তিবাহিনীতে পাঠিয়ে দেয়া হত, তাই খরচের বোঝা আমাদের বহন করতে হয়নি। আর আমাদের নিজস্ব গেরিলা বাহিনীর ছেলেরা দেশের ভেতরে এসে জনগনের সহায়তায় আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করত।

আওয়ামীলীগের সাথে আমাদের কিছু সম্পর্কের কথা আগেই বলেছি। সবিচেয়ে বড় ঐকমত্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে, সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তা অর্জনের প্রশ্নে আমরা একমত ছিলাম।

আমরা আওয়ামী লীগ সহ স্বাধীনতার পক্ষের সকল শক্তির বৃহত্তম ঐক্য গড়ে তুলতে সচেষ্ট ছিলাম। এই প্রচেষ্টা তেমন সফল হয় নি। শেষের দিকে বাংলাদেশ সরকারের ‘পরামর্শদাতা কমিটি’ গঠিত হয় এবং তাতে আমাদের পার্টির প্রতিনিধি হিশেবে আমি ছিলাম। সশস্ত্র সংগ্রামের অগ্রগতির পর্যায়ে আমাদের উভয় দলের দৃষ্টিভংগিগত কিছু পার্থক্য ছিল। আমরা মুক্ত এলাকা গড়ে তুলে সেখানে প্রগতিশীল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক নীতি গ্রহন ও কার্যকরের মাধ্যমে ভবিষ্যত বাংলাদেশের মডেল জনগনের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতাম ও ঐ রকম রণকৌশলের কথা বলতাম। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেবল সাধারন জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতাম না। মেহনতি মানুষ শোষণ ও নির্যাতনমুক্ত সুখী জীবন গড়ার আকাং্খা থেকে স্বাধীনতা চাইত। আমরা স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক কৃষক মেহনতি মানুষের দৃঢ় ও শক্তিশালী রুপে সংগঠিত হওয়ার লক্ষ সামনে রেখেছিলাম। মুক্তাঞ্চল গড়ে তুলে প্রগতিশীল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে পারলে সারা দেশের মেহনতি মানুষ আরও উতসাহ ও অনুপ্রেরণা নিয়ে এগিয়ে আসত। আমরা জাতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজস্ব শক্তির উপর নির্ভর করার উপর জোর দিতাম। এই সকল বিষয়ে আওয়ামীলীগের স্পষ্ট ধারণা ছিল না।

আওয়ামীলীগের একাংশের তরুনদের দ্বারা ‘মুজিব বাহিনী’ নামে পৃথক একটি বাহিনী হবার পর তাদের সংগে এবং বিশেষ করে আমাদের সমর্থক গেরিলাদের দেশের ভেতরে প্রেরণের প্রশ্নে সরকারের সংগে আমাদের কিছু অসুবিধা দেখা দিত। এসব সমস্যা সমাধানের জন্যে পরে একটি কোওর্ডিনেশন কমিটি গঠিত হয়েছিল।

তবে সার্বিকভাবে আওয়ামীলীগের সাথে আমাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। কমিউনিস্টরা সবসময় তাদের আন্তর্জাতিক কর্তব্য হিশেবেই যে কোন জাতির ন্যায্য সংগ্রাম- জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রামকে সমর্থন করে। এই নীতি থেকে বস্তুত আমাদের প্রচেষ্টা ছাড়াই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আমাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে এবং বাংলাদেশের পক্ষে ভারতে জনমত গঠনে প্রভূত সহায়তা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, বিশেষত পাক বাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতন ও গনহত্যা এবং প্রায় এককোটি ছিন্নমূল নারী ও শিশুর ভারতে আশ্রয় গ্রহন ইত্যাদি ভারতের জনগনের মাঝে বাংলাদেশের পক্ষে গভীর আবেগ সৃষ্টি করেছিল। তারা, বিশেষত সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোতে বাংলাদেশের শরনার্থী ও উদ্বাস্তুদের আশ্রয় দিতে যে অসুবিধার সম্মূখীন হয়েছিলেন তা হাসিমুখে আওহ্য করেছিলেন। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই জনমতকে আরও বিস্তৃত ও সংহত করার জন্যে অবদান রেখেছে। ভারতের বিরোধী দক্ষিনপন্থী রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে বাংলাদেশ এর স্বাধীনতার প্রশ্নে কিছু কিছু বিভ্রান্তি ও বিরুদ্ধ মত ছিল। কোন কোন প্রশ্নে কংগ্রেস এরও দোদুল্যমানতা ছিল। এক্ষেত্রে ভারতের অভ্যন্তরে একটি রাজনৈতিক লড়াই ছিল। এই লড়াইয়ে বাংলাদেশ এর পক্ষে সিপিআই এর ভূমিকা দ্বারা আমাদের সংগ্রাম লাভবান হয়েছে।

আগেই বলেছি ২৫শে আগেই আমরা ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলোর কাছে আমাদের সম্ভাব্য স্বাধীনতা সংগ্রামের সহায়তায় জন্যে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে চিঠি পাঠাই। এরপর ভারতে যাবার পর মে মাসে আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্য ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাথে বৈঠকে বসে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তৃত আলোচনা করেছিলেন। সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের কোচিনে অনুষ্ঠিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসে আমাদের পার্টির একটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছিল এবং সেখানে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বিস্তৃত জানানোর সুযোগ গ্রহন করা হয়েছিল। তবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি আগে থেকেই আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রচারের উদ্যোগ নিয়েছিল।

সকলেই জানেন যে রণক্ষেত্র থেকে জাতিসংঘে নিরাপত্তা পরিষদের টেবিল পর্যন্ত প্রতিবেশী ভারত ব্যাতীত সোভিয়েত ইউনিয়নসহ বিশ্ব সমাজতান্ত্রিক শিবির এবং আন্তর্জাতিক প্রগতি ও শান্তির শক্তিসমূহের সক্রিয় সমর্থন বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়্ব্র একটি অন্যতম প্রধান উপাদান। আমাদের পার্টিই এপ্রিল মাসে উদ্যোগি হয়ে বিশ্ব শান্তি পরিষদের সাধারন সম্পাদক রমেশ চন্দ্রেএও সাথে যোগাযোগ করে তার সহায়তায় তিন সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বিদেশ পাঠায়। এই দলের সদস্য ছিলেন আওয়ামীলীগের আবদুস সামাদ আজাদ, ন্যাপের দেওয়ান মাহবুব আলী (ফেরার পথে দিল্লীতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন), এবং কমিউনিস্ট পার্টির ডা: সারোয়ার আলী। এই শান্তি প্রতিনিধিদল ইউরোপের বিভিন্ন রাজধানী সফর করে প্রগতিশীল শক্তিসমূহের কাছে ইয়াহিয়া বাহিনীর ভয়াবহ গনহত্যা এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয় তুলে ধরেন। তখন পর্যন্ত কোলকাতা ছাড়া বিদেশের কোথাও বাংলাদেশ সরকারের মিশন গঠিত হয় নি।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে বিদেশে এমনকি প্রগতিশীল মহলেও নানারকম প্রশ্ন বিদ্যমান ছিল। বিদেশে পাকিস্তানীদের মিথ্যা প্রচার খন্ডন করার বিশেষ প্রয়োজন ছিল। ১৯৭০ এর নির্বাচনে জনগনের রায়ের প্রকৃত তাৎপর্য এবং আমাদের সংগ্রাম যে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী তরপরতা’ নয় ও জনগনের ব্যপক সমর্থনপুষ্ট ন্যায্য সংগ্রাম এই কথাও বিদেশে প্রচাররের প্রয়োজন ছিল। অন্য দেশের মুসলমানদের মধ্যে বাংলাদেশ এর স্বাধীনতা সংগ্রামকে “মুসলিম দেশ পাকিস্তান ভাংগার জন্যে অন্য দেশের ষড়যন্ত্র” বলেও বিভ্রান্তি ছিল। আমরা চিঠিপত্র ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে এইসব ভ্রান্তি মোচনের চেষ্টা করেছি। সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হবার কিছুকাল আগে থেকেই আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে, আন্তর্জাতিক প্রগতিশীল শক্তিসমূহ, বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমর্থন ও সাহায্য ব্যাতীত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও চীনের মাওবাদী নেতৃত্ব এর সমর্থনপুষ্ট বর্বর ইয়াহিয়া চক্রকে পরাভূত করা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে জয়লাভ করা সম্ভব হবে না। তাই আমাদের পার্টি স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন ও সাহায্যের আবেদন জানিয়ে দুনিয়ার ভ্রাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট পার্টির কাছে বিশদ চিঠি পাঠানোর এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষে দুনিয়ার সকল প্রগতিশীল জনমত সমবেত করার জন্যে ও অন্য সকল সম্ভাব্য পন্থার জন্যে চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এই সিদ্ধান্ত মতে প্রথমে পাক বাহিনীর গনহত্যা শুরু হবার আগে ১৪ই মার্চ এবং সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হবার পরে মে মাসে কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ হতে সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টি সহ দুনিয়ার প্রায় সকল কমিউনিস্ট পার্টির নিকট চিঠি পাঠানো হয়েছিল। আমাদের পার্টির সে চিঠি হতেই বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন ও দুনিয়ার বিভিন্ন কমিউনিস্ট পার্টি এবং তাদের মাধ্যমে জাতিসমূহের স্বাধীনতা ও মুক্তি সমর্থনকারী শান্তি ও প্রগতির শক্তিসমূহ এবং গনতান্ত্রিক জনগন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে সঠিক ধারনা পেয়েছিল। এটি বিশ্ব জনমত গড়ে ওঠায় ও আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বের গনমাধ্যপমে প্রচারে সহায়ক হয়েছিল।

কোচিনে অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে কংগ্রেসের কথা আগে বলেছি সেখানে আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় প্রতিনিধিদল ২২টি ভ্রাতৃপ্রতিম কমিউনিস্ট পার্টির সাথে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। তাছাড়া শান্তি আন্দোলন ও অন্যান্য প্রগতিশীল আন্দোলন এর সাথে যোগাযোগ করে তাদের সমর্থন পাবার চেষ্টা আমাদের পার্টি করেছে।আমরা বলতে পারি যে, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম এর পক্ষে দুনিয়ার সমাজতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিসমূহকে সমবেত করার ক্ষেত্রে আমাদের পার্টি যথোচিত উদ্যোগ গ্রহন করেছিল, এবং এই গুরুত্বপূর্ণ কাজে যথাসাধ্য অবদান রেখেছে। বিশ্ব জনমত গঠনের ক্ষেত্রে এবং তার কার্যকর ভূমিকা সুসংহত করতে আমাদের পার্টির অবদানই সবচেয়ে বেশি।

স্বাধীনতা যুদ্ধে শত্রুর বিরুদ্ধে জয়লাভের জন্যে একটি অপরিহার্য শর্ত ছিল সমগ্র জাতির একতা এবং আরো সুনির্দিষ্টভাবে স্বাধীনতার সকল শক্তি বিশেষত আওয়ামীলীগ, ন্যাপ ও কমিউনিস্ট পার্টির ঐক্যবদ্ধ কর্মতৎপরতার প্রয়োজন ছিল। আমাদের পার্টি স্পষ্টভাবে এইসব রাজনৈতিক দল সমবায়ে জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের আওয়াজ তুলেছিল এবং সে ফ্রন্ট গঠনে অবিরাম প্রচেষ্টা নিয়েছিল। বিশ্ব জনমত ও ভারতের জনমত ও বাংলাদেশের নিকট এরুপ জাতীয় ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ দেখতে চাচ্ছিল। আওয়ামীলীগ এ ধরনের জাতীয় ঐক্য গঠনের গুরুত্ব বিলম্বে উপলব্ধি করে। পাশাপাশি কয়েকটি মাওবাদী উপদল আওয়ামীলীগকে বাদ দিয়ে তথাকথিত ‘বামপন্থী ফ্রন্ট’ এর নামে বিভেদাত্মক আওয়াজ তুলেছিল। এই দুই মনোভাবের বিরুদ্ধেই আমাদের পার্টির ঐক্যের নীতি তথা জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট গঠনের নীতি স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথমদিকে কার্যকর হয় নি। যুদ্ধ শুরু হবার কিছুকাল পরে আওয়ামীলীগ,ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ কংগ্রেস এর প্রতিনিধি ও ব্যাক্তিগতভাবে মাওলানা ভাসানীকে নিয়ে তদানীন্তন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের একটি ‘পরামর্শদাতা’ কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই কমিড়িতে আমাদের পার্টির প্রতিনিধি ছিলাম আমি।

এই পরামর্শদাতা কমিটি গঠনের গুরুত্ব ছিল এই যে স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এবং কমিউনিস্ট পার্টি সহ দেশপ্রেমিক শক্তি যে একতাবদ্ধ সেটা প্রত্যক্ষভাবে দুনিয়ার সামনে প্রকাশ করা গিয়েছিল। বিভিন্ন দলের সমন্বয় নিয়ে ঐ কমিটি দেশের ভেতরে জনগন ও মুক্তিযোদ্ধাদের মনে নতুন উতসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল। আমাদের পার্টি ‘ পরামর্শদাতা কমিটি’ গঠনকে স্বাগত জানিয়েছিল। তবে ঐ কমিটি তেমন কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে নি এবং ঐ ঐক্যের উচ্চতর কোন বিকাশও ঘটেনি। এ বিষয়ে প্রধানত গুরুত্ব উপলব্ধি তে আওয়ামীলীগ এর দুর্বলতা ও অনুতসাহ ছিল।

কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের সম্মিলিত একটি পৃথক গেরিলা বাহিনী গড়ে উঠেছিল। এই বাহিনী গঠন, ব্যবস্থাপনা, ভারত সরকারের সাথে এই বিষয়ে যোগাযোগ প্রভৃতির সামগ্রিক দায়িত্ব ছিল আমাদের পার্টির বর্তমান সাধারন সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ এর উপর। আমাদের গেরিলা টিম সকল জেলায় পাঠানো হয়েছিল। ঢাকার খোদ রাজধানী, রায়পুরা, কুমিল্লা নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, রংপুর সহ উত্তরবঙ্গ এর কতেকটি স্থানে আমাদের গেরিলা টিম একশন করেছে এবং আমাদের কমরেডরা প্রাণ দিয়েছেন। যারা ভারতে যাননি, সেই কমরেডরা দেশের ভেতরে থেকে যুদ্ধের সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন এবং এরাই ভারত থেকে আগত গেরিলাদের একশনে সাহায্য করেছিলেন। এখন বয়সের কারনে কোন সময়ে কোথায় কোথায় আমাদের টিম কিরুপ একশন বা লড়াই করেছিল তা স্মৃতি থেকে আমার পক্ষে বিশদ বলা সম্ভব নয়। আমরা নিজেরা এবং বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সহায়তায় সাধ্যমত সারাদেশে যুদ্ধরত ছিলাম। যুদ্ধ ছাড়া সংবাদ বহন, রেকি করা প্রভৃতি যুদ্ধের সহায়ক ঝুকিপূর্ণ কাজ আমাদের কমরেডরা করেছেন। কেবল নিচুপর্যায়ে নয়, উচু পর্যায়েও যুদ্ধের সংগঠনে আমাদের ভূমিকা ছিল। ছোটখাটো গেরিলা একশন ছাড়া আমাদের গেরিলারা চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানী জাহাজ ডুবিয়েছিল। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম এলাকায় ঢাকা- চট্টগ্রাম সড়কে বেতিয়ারা নামক স্থানে আমাদের কমরেড আজাদ, মুনির প্রমুখ আমাদের গেরিলা বাহিনীর ৯ জন সদস্য পাকবাহিনীর সাথে লড়াইয়ে নভেম্বর মাসের ১১ তারিখে নিহত হন।

মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শহীদুল্লাহ কায়সার ঢাকায় আলবদর বাহিনীর হাতে নিহত হন।

-মনি সিংহ
(বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি
মার্চ, ১৯’৮৪