স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
রেডিও পাকিস্তানের বাঙালি অফিসাররা ভারতে পালিয়ে আসার সময় ৫ কিলোওয়াট এর একটি একটি ট্রান্সমিটার নিয়ে এসেছিল। আগরতলায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র কাজ শুরু করে। প্রফেসর মোহা. খালেদ, এমএনএ কে প্রচারনার কাজের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। যেহেতু পুরা বাংলাদেশে প্রচারনার জন্য ট্রান্সমিটারটি যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল না, তাই আমরা ভারত সরকারকে আরো শক্তিশালী একটি ট্রান্সমিটার ধার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করলাম। তাই একটি ৫০ কিলোওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সমিটারের ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু এটা স্থাপন করা হল কলকাতায়। তাই রেডিও স্টেশন আগরতলা থেকে কলকাতায় স্থানান্তর করা হলো।
মন্ত্রীসভা গঠন করার পরে আমি কলকাতায় গিয়েছিলাম। কিন্তু দেখলাম কাজগুলো যথেষ্ট পরিমাণে গুছানো হচ্ছে না। আমি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এবং খন্দকার মোস্তাক আহমেদকে পরামর্শ দিলাম যে তাদের উচিত প্রতিনিয়ত সরকারিভাবে অফিসের কাজ পরিচালনা করা। তাঁরা আমাকে জানাল যে তাঁরা এমন কাউকে পাচ্ছে না যে তাদের সাহায্য করবে। আমি আগরতলা থেকে অফিসার দিয়ে তাদের সাহায্য করার কথা প্রতিশ্রুতি দিলাম। ডেপুটি হাই কমিশনের ২য় তলায় পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বসানো হল এবং মাহাবুব আলমকে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হল। আমি তৌফিক ইমাম কে মন্ত্রীসভার সচিব হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদ এর কাছে পাঠিয়েছিলাম এবং আসাদুজ্জামানকে অর্থসচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হল।
আমাকে পূর্ব জোন এর “ইনচার্জ” হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হল এবং কর্তৃপক্ষ আমাকে সকল ব্যাংক একাউন্ট এবং অন্যান্য ফান্ড পরিচালনার জন্য ” গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ” লেখা একটি সীলমোহর দিলেন। চাষী সাহেব পাকিস্তান এম্বাসিতে নিয়োজিত সকল বাঙালিদের সাথে যোগাযোগ করলেন এবং তাদেরকে বেরিয়ে এসে নির্বাসিত সরকারের সাথে কাজ করার জন্য বললেন। তাৎক্ষণিক একটা ফলাফল পেলাম এবং ওয়াশিংটন এ নিযুক্ত সকল বাঙালি অফিসাররা প্রবাসী মিশন ‘ডিফেক্ট’ করার জন্য প্রস্তুত হলেন। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুরোধে আমি আমেরিকা এবং কানাডাতে নির্বাসিত সরকারের প্রথম এম্বাসেডর হিসেবে প্রেরিত হলাম।
১৯৭১ সালের জুলাই মাসে আমেরিকাতে যাই। আমরা কানেকটিকাট এভিনিউর অফিস ব্লক এ একটি ফ্লোর নিই যেটি ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম দূতাবাস। যেহেতু বাংলাদেশকে তখনও অ্যামেরিকা স্বীকৃতি দেয় নাই, সেহেতু আমিও একজন ‘দূতাবাসের কর্মকর্তা’ হিসেবে স্বীকৃতি পাই নাই। কিন্তু আমি একটি ‘মিশনের প্রধান’ হিসেবে নিবন্ধন করার অনুমতি পেলাম যার ফলে আমি বৈধভাবে রাজনৈতিক তদবির চালিয়ে গেলাম। যদিও পাকিস্তান সরকারের সাথে আমেরিকার সরকারের বন্ধুত্ব সম্পর্ক ছিল তবুও আমেরিকার সংবাদ মাধ্যম, সভা, পরিষদ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং সাধারন জনগন আমাদের ব্যাপকভাবে সমর্থন দিয়েছিল কারন আমাদের দাবী সঠিক ছিল এবং বিশ্ববাসী পাকিস্তানের গণহত্যার বিষয়টি জেনেছিল। কিছু আমেরিকান, যারা বাংলাদেশে ছিল তারা নিজেদের মধ্যে একটি দল বানায় এবং ওয়াশিংটনে “বাংলাদেশ তথ্য কেন্দ্র” স্থাপন করে। এটা অবশ্যই উল্লেখ করা উচিত যে এদের মধ্যে ড. গ্রিনাফ, ড. ডেভিড নালিন, টম ডিনি, আন্না টেইলর উল্লেখযোগ্য। রাজনীতিবিদদের মধ্যে সিনেটর চার্চ, সিনেটর কেনেডি, সিনেটর পারসেই, সিনেটর সাক্সবি, কংগ্রেসম্যান গাল্লাহার তারা আমাদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং আমাদের কাছে যুদ্ধের কারণগুলো শুনে তারা এটাকে গুরুত্বের সাথে নিয়েছিলেন। তাঁদের অফিসটা আমাদের ‘ক্যাম্পেইন সেন্টার’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছিলো। সেই সাক্সবে-চার্চ সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সাহায্য বন্ধ করা হয়েছিল।
আমেরিকার প্রত্যেক শহরে অবস্থিত বাঙালিরা নিজেদের মধ্যে সংস্থা গড়ে তুলে এবং তহবিল গঠন করা সহ যতভাবে সাহায্য করা যায়, তা করেছিল। এফ.আর. খান, বিখ্যাত স্থপতি, তিনি শিকাগোর ‘বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন’-এর প্রধান হিসেবে কাজ করেছিলেন, তাঁর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। দূতাবাসের জন্য সকল প্রকার রাজনৈতিক বাধা দূর করার লক্ষে মন্ত্রী এনায়েত করিম, কাউন্সিলর কিবরিয়া, অর্থনৈতিক কাউন্সিলর মুহিত, প্রেস কাউন্সিলর আবু রুশদি মতিন উদ্দিন এবং সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী সকল অফিশিয়াল প্রোটকল ভেঙে নির্বাচনী প্রচারণার মতো করে ব্যাপক লবিং করেন।
১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ আসলো। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী আত্নসমর্পন করলো। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হল। আমরা শেখ মুজিবকে নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় ছিলাম। অবশেষে তিনি আমাকে ১৯৭২ সালের ১লা জানুয়ারী টেলিফোন করলেন। আমি উনার সাথে ফিরতে পারি নি। কয়েকদিন পর ফিরেছিলাম। মুক্তির সুবাতাস বইছিলো। এ যেন এক নতুন জীবনের অনুভূতি।
এরপর বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হওয়াটা একটা স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে। উনি আমাকে উনার উষ্ণ আলিঙ্গনে টেনে নিয়েছিলেন। পরে তিনি আমাকে তাঁর মন্ত্রীসভার বাণিজ্য এবং বৈদেশিক বানিজ্য মন্ত্রী হিসেবে যোগদান করতে অনুরোধ করেছিলেন।
-এম. আর. সিদ্দিকী
মার্চ, ১৯৮৪