You dont have javascript enabled! Please enable it! 1977.01.01 | "রাজনৈতিক দলবিধি ১৯৭৬" ও তৎকালীন রাজনৈতিক দলসমূহের অবস্থান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা - সংগ্রামের নোটবুক

1977.01.01 | “রাজনৈতিক দলবিধি ১৯৭৬” ও তৎকালীন রাজনৈতিক দলসমূহের অবস্থান | সাপ্তাহিক বিচিত্রা

রাজনৈতিক দলবিধি,’৭৬ঃ-
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বুধবার রাজনৈতিক দল বিধি, ১৯৭৬-এর ২২ নং সামরিক আইন বিধি জারী করেন ২৮শে জুলাই, ১৯৭৬। নিম্নে বিধির পূর্ণ বিবরণ দেয়া হলঃ
“যেহেতু, অতঃপর বর্ণিত উদ্দেশ্য সাধনে একটি সামরিক আইন প্রণয়ন করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
অতএব, এক্ষণে ১৯৭৫ সনের ২০শে আগস্ট ও ১৯৭৫ সানের ৮ই নবেম্বরের ঘোষণানুসারে এবং ঐ পক্ষ থেকে প্রদত্ত সমূদয় ক্ষমতা বলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিম্মােক্ত বিধি প্রণয়ন করছেন ।
১। সংক্ষিপ্ত শিরনাম ও শুরু: এই বিধিকে রাজনৈতিক দল বিধি ১১৭৬ নামে অভিহিত করা যেতে পারে।
২। সংজ্ঞা : বিষয় বা বিষয়বস্তুর কোন কিছুর পরিপন্থী না হলে এই বিধি অনুসারে (ক) ‘প্রার্থী’ বলতে সংসদসহ যে কোন নির্বাচনী সংস্থার নির্বাচনে প্রার্থী হওয়াকে বুঝাবে।
(খ) ‘নির্বাচন কমিশন’ অর্থ সংবিধানে বর্ণিত অর্থানুসারে নির্বাচন কমিশন।
(গ) ‘বিদেশী সাহায্যপূষ্ট দল’ অর্থ এমন একটি রাজনৈকি দল, যা –
(১) বিদেশী কোন সরকার বা রাজনৈতিক দলের যোগসাজশে গঠিত বা সংগঠিত হয়েছে ; অথবা
(২) বিদেশী কোন সরকায় বা রাজনৈতিক দলের অনুমোদিত অথবা সংশ্লিষ্ট অথবা
(৩) কোন বিদেশী সরকার অথবা রাজনৈতিক দল অথবা বিদেশী কোন নাগরিকের নিকট থেকে এর তহবিল অথবা যে কোন ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা চালানোর জন্য আর্থিক অথবা অন্য যে-কোন উপায়ে সাহায্য গ্রহণ করে থাকে।
(ঘ) ‘রাজনৈতিক দল’ অর্থ যে-কোন সমিতি বা জনসংস্থা যা কোন রাজনৈতিক মতের প্রচারণাসহ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে যেকোন তৎপরতা চালায় অথবা নিয়োজিত থাকে এবং হার ছাত্র, শ্রমিক, সাংস্কৃতিক, কৃষক এবং যুব সংগঠন , অথবা এ ধরনের সমিতি বা সংস্থা অনুমোদিত অথবা সংলিষ্ট রয়েছে।
(ঙ) ‘আপত্তিকর তৎপরতা’ অর্থ যে-ফোন তৎপরতা, যার উদ্দেশ্য–
(১) বাংলাদেশের প্রতিরক্ষার ক্ষতি করা ; (২) জননিরাপত্তা অথবা জন-শৃংঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত অথবা বিপন্ন করা ;
(৩) বিভিন্ন সম্প্রদায়, শ্রেণী অথবা অংশের জনগণের মধ্যে শত্রুতা অথবা ঘৃণার মনোভাব সৃষ্টি অথবা জাগ্রত করা ;
(৪) প্রশাসন এবং আইন-শৃংঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে হস্তক্ষেপ্ত করা অথবা হস্তক্ষেপে উৎসাহিত করা ;
(৫) সমাজের জন্য অত্যাবশ্যকীয় সরবরাহ ও জরুরী সার্ভিস বজায় রাখার ব্যাপারে ক্ষতিগ্রস্ত করা ;
(৬) জনগণ অথবা জনগণের কোন অংশে ভয় অথবা ভীতি প্রদর্শন করা ;
(৭) শিল্পে শান্তি বজায় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে হস্তক্ষেপ করা অথবা রাষ্ট্রের অর্থ ও আর্থিক সুবিধার ব্যাপারে ক্ষতি সাধন করা ;
(৮) শিক্ষার পরিবেশ কলুষিত করা অথবা শিক্ষা, প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু কার্যক্রমে বিঘ্ন সৃষ্টি করা অথবা ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক তৎপরতা উৎসাহিত করা অথবা উচ্ছৃংখলতা সৃষ্টি করা ;
(৯) প্রতিরক্ষা সার্ভিস অথবা বাংলাদেশ রাইফেলস অথবা পুলিশ অথবা আনসার বাহিনীর কোন অফিসার অথবা অন্য কোন সদস্যকে তার কর্তব্য অথবা সরকারের প্রতি তার আনুগত্য থেকে বিপথে পরিচালিত করার প্ররোচনা দেয়া।
৩। কতিপয় রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধঃ-
(১) বিদেশী সাহায্যপুষ্ট হয়ে কোন দল গঠন, সংগঠন প্রতিষ্ঠা বা আহবান করা যাবে না অথবা কোন ব্যক্তি কোন বিদেশী সাহায্যপুষ্ট দলের সদস্য হতে পারবে না অথবা তার সাথে জড়িত থাকতে পারবে না।
(২) কোন অনিষ্টকর তৎপরতা অথবা কোন মতের প্রচারণাসহ কোন অনিষ্টকর তৎপরতা চালানোর উদ্দেশ্যে এমন কোন রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না যা বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, সংহতি অথবা নিরাপত্তার ক্ষেত্রে ক্ষতিকর হতে পারে।
৪। রাজনৈতিক তৎপরতা শুরুঃ
(১) রাজনৈতিক দল চালু অথবা রাজনৈতিক তৎপরতা শুরুর আগে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে সরকারের কাছে পেশ করতে হবে—
ক) একটি দলীয় গঠনতন্ত্র যাতে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, সর্বস্তরের সাংগঠনিক কাঠামো, কর্মকর্তা নিবাচন পদ্ধতি, অর্থ সংস্থানের উৎস, দলীয় কার্যক্রমে অর্থ ব্যয়ের পদ্ধতি, এর আয়-ব্যয়ের হিসাবের বার্ষিক অডিটের পদ্ধতি এবং অডিট রিপোের্ট প্রকাশনা ইত্যাদি বর্ণিত থাকবে।
(খ) এর অনুমোদিত, সংশ্লিষ্ট অথবা ফ্রন্ট সংগঠনগুলোর নামের তালিকা, যাতে ঐসব সংগঠনের প্রত্যেকটির নাম ও কর্ম তৎপরতার সুনির্দিষ্ট বর্ণনা থাকবে।
(গ) জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে পরিকল্পনা সংবলিত দলের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচী এবং আইন, নির্বাহী ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে এর প্রস্তাব আইনগত উপায়ে এই কর্ম-সূচী বাস্তবায়িত হলে জনগণের কতটুকু কল্যাণ সাধিত হতে পারে সে সম্পর্কে আশাবাদেরও তাতে প্রকাশ থাকতে হবে।
(২) উপ-অনুচ্ছেদ (১)-এর অধীনে পেশকৃত কোন রাজ-নৈতিক দলের গঠনতন্ত্র, তালিকা ও ঘোষণাপত্র এবং কর্মসূচী পাওয়ার পর থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই সরকার রাজনৈতিক দল হিসেবে এই দলটি বিধি অনুসারে চালু হতে পারে কিনা, তা লিখিতভাবে জানাবেন।
(৩) উপ-অনুচ্ছেদ (২)-এর অধীনে এই বিধির প্রয়োজনীয় সব কিছুই এদের রয়েছে এই মর্মে কোন নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত কোন রাজনৈতিক দল চালু অথবা তার তৎপরতা শুরু করতে পারবে না।
৫। গোপন কার্যকলাপ এবং সশস্ত্র কর্মীদল (ক্যাডার) নিষিদ্ধকরণঃ
(১) কোন রাজনৈতিক দল—
(ক) কোন গোপন সংগঠন, গ্রপ অথবা সংস্থা রাখতে পারবে না অথবা কোন কার্যকলাপে লিপ্ত থাকতে পারবে না। অথবা,
(খ) যে নামেই হোক না কেন কোন শৃংঙ্খলাবদ্ধ বাহিনীর মত পরিচালনযোগ্য, কোন সশস্র কর্মীদল (ক্যাডার), স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী অথবা অন্য কোন সংস্থা পরিচালনা করতে বা বজায় রাখতে পারবে না।
(২) যখন একটি রাজনৈতিক দল উপ-অনুচ্ছেদ (১)-এর ব্যবস্থা লংঘন করবে তখন তা অনুচ্ছেদ (১০)-এর অধীনে বিচারযোগ্য হবে।
৬। অর্থাদি গ্রহণের শর্ত (১) কোন দল কতৃক অর্থ গ্রহণের কতৃর্ত্বপ্রাপ্ত দলের কোন কর্মকতার স্বাক্ষরিত, মুদ্রিত ও ক্রমানুযায়ী সাজানো রসিদ দান ব্যতীত সংশ্লিষ্ট দল কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা দান বা অন্য কোন হিসেবে অর্থ গ্রহণ করতে পারবে না । কোন ব্যক্তিও এ ধরনের রসিদ ছাড়া কোন দলকে কোন ক্রমেই চাঁদা দান বা অন্য কোনভাবে কোন অর্থ দিতে পারবে না।
(২) উপ-অনুচ্ছেদ (১) লংঘন করে কোন রাজনৈতিক দল কোন অর্থ গ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে অনুচ্ছেদ (১০) অধীনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
(৩) উপ-অনুচেছদ (১)-এর যারা লংঘনকারী কোন অর্থ কোন রাজনৈতিক দলের পক্ষে কোন ব্যক্তি গ্রহণ করলে বা কোন ব্যক্তি কর্তৃক কোন রাজনৈতিক দলকে দেয়া হলে তার ৩ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড, জরিমানা বা উভয় প্রকার দন্ড হতে পারে।
৭। ব্যাঙ্ক একাউন্টের মাধ্যমে তহবিল পরিচালনা করতে হবে—
(১) কোন রাজনৈতিক দলের সমগ্র তহবিল কোন তফসিলী ব্যাঙ্কের মাধ্যমে সংরক্ষণ এবং পরিচালনা করতে হবে।
(২) কোন রাজনৈতিক দল উপ-অনুচ্ছেদ (১) লংঘন করে কোন তহবিল সংরক্ষণ বা পরিচালনা করলে তার বিরুদ্ধে অনুচ্ছেদ(১০) অধীনে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
৮। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতার শর্তাবলীঃ
নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে পূর্বেই নিম্নে বর্ণিত বিষয়সমূহ পেশ না করে কোন রাজনৈতিক দল সংসদসহ কোন সংস্থার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিত করতে পারবে না বা কোন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে বা কোন প্রার্থীকে নিজ দলের মনোনীত বলে গ্রহণ করতে পারবে নাঃ-
(ক) দলের কর্মসূচী বাস্তবায়নের আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাবলীর সুপারিশ এবং এ সকল ব্যবস্থার সম্ভাব্যতা ও কার্যকারিতার ব্যাখ্যা সম্বলিত নির্বাচনী ঘোষণাপত্র প্রকাশ করতে হবে–
(খ) নির্বাচনে উক্ত দল যে সকল প্রার্থী মনোনীত করতে ইচ্ছুক তাদের সংখ্যা নির্বাচনী প্রচার অভিযানের জন্য সম্ভাব্য ব্যয়ের অংক এবং এসব কাজে ব্যয়ের জন্য গঠিত তহবিলের সূত্র উল্লেখ করে বিবৃতি প্রকাশ করতে হবে।
৯। কতিপয় কাজের উপর নিষেধাজ্ঞাঃ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতাকারী কোন রাজনৈতিক দল নীচে বর্ণিত কাজ করতে পারবে নাঃ—
(ক) অন্য কোন রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ প্রতিফলিত বা সেই দলের কোন প্রার্থীর ব্যক্তিগত চরিত্রের প্রতি কটাক্ষ করে যা সেই দল বা প্রার্থীর প্রতি ঘৃণার সৃষ্টি করতে পারে এমন কোন পোস্টার প্রচারপত্র বা বিবৃতি প্রকাশ করতে পারবে না। তবে অপর দল বা প্রার্থীর লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী সম্পর্কে ঘৃণার উদ্রেক করে না এমন ধরনের বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করা যেতে পারে।
(খ) কোন রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী আয়োজিত সভা, সমাবেশ ও শোভা যাত্রায় কোন ব্যক্তি কর্তৃক (ক) উপ-অনুচ্ছেদে উল্লিখিত প্রকতির কোন বক্তৃতা, বিবৃতি দেয়া।
(গ) অপর রাজনৈতিক দল বা প্রাথী আয়োজিত সভা অনুষ্ঠানে বাধা বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে কোন সমাবেশ বা শোভা যাত্রা অনুষ্ঠান বা অনুষ্ঠানে উৎসাহিত করা।
(ঘ) কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর পক্ষে ভোটদাতাদের সমর্থন আদায় বা অপর দলের প্রার্থীর পক্ষ সমর্থনে ভোটদাতাদের বিরত রাখার জন্য বলপ্রয়োগ অথবা হামলা চালানো বা তার হুমকি দেয়া।
১০। বিধি লংঘনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাঃ
(১) কোন রাজনৈতিক দল এই বিধির ৩, ৪, ৫, ৬ এবং ৭ নং অনুচ্ছেদ বা ১১ নং অনুচ্ছেদবলে প্রদও নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত কোন আদেশ লংঘন করেছে বলে যদি সরকারের বিশ্বাস করা কারণ ঘটে তবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য তা সুপ্রীম কোর্টের আপীল বিভাগের জজ সমবায়ে গঠিত ট্রাইব্যুনালের কাছে পেশ করা যাবে। উক্ত জজ সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি কর্তৃক মনোনীত হবেন। ট্রাইব্যুনালে উক্ত বিষয় পেশ করার পর সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত না হওয়া পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কার্যকলাপ বন্ধ থাকবে।
(২) ট্রাইব্যুনাল (১) নং উপ-অনুচ্ছেদবলে পেশকৃত কোন বিষয়ের প্রেক্ষিতে সরকার কর্তৃক উপস্থাপিত সকল সাক্ষ্যপ্রমাণ বিবেচনা এবং সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের বক্তব্য পেশের সুযোগ দেয়ার পর তার সিধান্ত জানাবেন। উক্ত বিষয় পেশের এক মাসের মধ্যে ট্রাইব্যুনাল এই সিদ্ধান্ত দেবেন।
(৩) কোন রাজনৈতিক দল বিধির ৩, ৪, ৫, ৬ ও ৭ নং অনুচ্ছেদ অথবা ১১ নং অনুচ্ছেদবলে প্রদত্ত নির্বাচন কমিশনের কোন আদেশ লংঘন করেছে বলে ট্রাইব্যুনাল সিদ্ধান্ত দিলে উক্ত সিধান্ত সরকারী গেজেটে প্রকাশিত হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত এবং তার সকল সম্পত্তি ও তহবিল বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।
১১। ৮ ও ৯ নং অনুচ্ছেদ লংঘনের দন্ড।
(১) যদি কোন রাজনৈতিক দল ৮ নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তাবলী পূরণ না করে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করে বা প্রার্থী মনোনয়নদান করে অথবা উক্ত অনুচ্ছেদ অনুসারে পেশকৃত বিবৃতিতে উল্লিখিত অঙ্কের বেশ অর্থ নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করে অথবা ৯ নং অনুচ্ছেদের পরিপন্থী কোন কাজ করে তবে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট দলকে বক্তব্য পেশের সুযোগ দেয়ার পর এক আদেশবলে উক্ত দলের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশ দিতে পারেন, তবে এর মেয়াদ দু’বছরের বেশী হবে না। এই নির্দেশের পর উক্ত দল উল্লিখিত সময়ের জন্য তার তৎপরতা বন্ধ রাখবে।
(২) কোম রাজনৈতিক দল ১ নং উপ-অনুচ্ছেদবলে প্রদত্ত আদেশ লংঘন করে তার তৎপরতা অব্যাহত রাখলে বিষয়টি ১০ নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত ট্রাইব্যুনালে পেশ করার পর তা যদি সত্য প্রমাণিত হয় তাহলে সংশ্লিষ্ট দলটি বিলুপ্ত হবে এবং তার সময় সম্পত্তি ও তহবিল বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে।
(৩) যদি কোন রাজনৈতিক দলের কোন কর্মকর্তা তার দলের হয়ে এমন কোন কাজ করে যাতে করে সংশ্লিষ্ট দল ১ নং উপ-অনুচ্ছেদের অধীনে দায়ী হয় তাহলে সেই দলটিই এ কাজ করেছে বলে গণ্য করা হবে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট দলের পক্ষে সিধান্ত গ্রহণের উপযুক্ত কর্মকর্তাদের বা তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের অগোচরেই ঐ কাজ করা হয়েছে কিংবা তারা এ ধরনের কাজে বাধাদানের জন্য আগে থেকেই প্রয়োজনীয় সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন বলে প্রমাণিত হলে সে ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে না।
১২। কতিপয় ক্ষেত্রে প্রার্থীর জন্য দন্ড। এসব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য অপর যে কোন আইনের প্রয়োগ ক্ষম হওয়া ছাড়াই সংসদ নির্বাচনের ৭ ক্ষেত্রে কোন প্রার্থী ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্টের ১৫৫ নং আদেশ) -এর সংজ্ঞানুযায়ী দোষী সাব্যস্ত হবেন এবং অন্য কোন নির্বাচনী সংস্থায় নির্বাচনের ক্ষেত্রে, প্রার্থীকে অযোগ্য করে দেয় এমন কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত হবেন, যদি তিনি (ক) কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থী না হয়ে নিজেকে সেই দলের প্রার্থী কিংবা সেই দল কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি বলে পরিচয় দেন;
(খ) কোন রাজনৈতিই দল ১০ নং অনুচ্ছেদবলে বিলুপ্ত বা ১১ নং অনুচ্ছেদবলে সাসপেন্ড হবার পর নিজেকে সেই দলের প্রার্থী বলে বা সেই দল কর্তৃক মনোনীত ব্যক্তি বলে পরিচয় দেন। অথবা
(গ) নিজের নির্বাচনের উদ্দেশ্যে কিংবা নিজ নির্বাচনী প্রচার চলাকালে ১ নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত এমন কোন কাজ করেন যার ফলে সেও কাজের দায়দায়িত্ব ১১ নং অনুচ্ছেদের ১ নং উপ-অনুচ্ছেদের অধীনে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের ওপর বর্তায়।
১৩। নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার শর্তবিলী। (১) ১৯৭২ সালের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (১৯৭২ সালের প্রেসিডেন্টের ১৫৫ নং আদেশ কিংবা কোন নির্বাচনী সংস্থার নির্বাচন সংক্রান্ত ব্যাপারে আপাতত বলবৎ অন্য কোন আইনে উল্লিখিত ব্যবস্থা সত্ত্বেও কোন প্রার্থী (ক) সংসদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, অখন্ডতা ও নিরাপত্তা রক্ষার প্রতিশ্রতি এবং জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে নিজ প্রস্তাব সম্বলিত নির্বাচনী ইস্তেহার নির্বাচন কমিশনের কাছে পেশ না করলে ;
(খ) অন্য কোন নির্বাচনী সংস্থার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ ধরনের নির্বাচনী সংস্থা সম্পর্কে ক ধারায় বর্ণিত প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ করে একটি স্মারক নির্বাচন পরিচালনাকারী না করলে কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ না করলে—
নির্বাচন চাইতে পারবেন না অথবা সংসদসহ কোন নির্বাচনী সংস্থায় নির্বাচনের জন্য প্রস্তাব বা মনোনয়নপত্র পেশ করতে পারবেন কিংবা তা পেশ করার ব্যাপারে সম্মতি দিতে পারবেন না।
(২) কোন প্রার্থী ১ নং উপ-অনুচ্ছেদে বর্ণিত শর্তাদি পরিপ করে নির্বাচনে দাঁড়ালে তিনি সংসদের নির্বাচনের ক্ষেত্রে ১৯৭২ সনের জনপ্রতিনিধিত্ব আদেশের (প্রেসিডেন্টের ১৯৭২ সালের ১৫৫ নং আদেশ) সংজ্ঞা অনুযায়ী দনীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হবেন। এবং অন্য কোন নির্বাচনী সংস্থার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ ধরনের সংস্থার নির্বাচনে প্রার্থীকে অযোগ্য করে দেয় এমন কাজের জন্য দোষী সাব্যস্ত হবেন।
১৪। রাজনৈতিক তৎপরতা বিধি।
(১) সরকার সময় সময় আদেশ জারি করে তার বিবেচনামত পন্থায় যে কোন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী প্রচারসহ অন্যান্য তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
(২) কোন রাজনৈতিক দল ১ নং উপ-অনুচ্ছেদবলে প্রদত্ত আদেশ লংঘন করলে তার ১১ নং অনুচ্ছেদের বিধানগুলিও লংঘন করেছে বলে গণ্য হবে এবং সেই অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট দলটিকে সাসপেন্ড করা হবে।
১৫। বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা। সরকার সরকারী গেজেটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এই বিধির উদ্দেশ্য সাধনে প্রয়োজনীয় বিধি প্রণয়ন করতে পারবেন এবং এ ধরনের বিধিতে অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে কোন রাজনৈতিক দলের আয়ের উৎস সম্পর্কে তদন্ত করার এবং এ ধরনের দলের যে কোন কর্মকর্তা বা এজেন্সীর একাউন্ট পরীক্ষা করার ব্যবস্থা থাকবে।
১৬। অন্যান্য আইনের সঙ্গে এই বিধির সংঘাতের ক্ষেত্রেঃ
আপাতত বলবৎ অন্য যে কোন আইনে যাই উল্লেখ থাকুক না কেন, এই বিধিই কার্যকর বলে গণ্য হবে।
১৭। বাতিল। ১৯৬২ সালের রাজনৈতিক দল আইন (১৯৬২ সালের ৩ নং) এবং ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক দল (নিষেধাজ্ঞা) অধ্যাদেশ (১৯৭৫ সালের ৪৬ নং) এতদ্বারা বাতিল করা হল।
পরে ১৯৭৬ সালের ৪ঠা আগষ্ট এবং ২৪শে অক্টোবর এই রাজনৈতিক বিধিমালার দু’টো সংশোধনী প্রকাশ করা হয়। সংশোধনী দু’টো নীচে দেয়া গেলঃ-
১ম সংশোধনীঃ-
১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির (১৯৭৬ সালের সামরিক আইন বিধি নং ২২) সংশোধন করে ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দল (সংশোধনী) বিধি জারি করেন ৪ঠা আগষ্ট, ১৯৭৬। এই বিপির পূর্ণ বিবরণ নিম্নরূপঃ-
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক গতকাল ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দল (সংশোধনী) বিধি জারি করেছেন।
এই বিধির পর্ণ বিবরণ নিম্নরূপ :
যেহেতু নিম্নলিখিত কারণে ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দল বিধির (১৯৭৬ সালের সামরিক আইন বিধি নং ২২) সংশোধন জরুরী, এক্ষণে, অতএব ১৯৭৫ সালের ২০শে আগষ্ট ও ১৯৭৫ সালের ৮ই নবেম্বরের ঘোষণায় তাঁকে প্রদত্ত সকল ক্ষমতাবলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিম্নলিখিত সামরিক আইনবিধি জারি করেছেনঃ
(১) এই বিধি ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দল (সংশোধনী) বিধি বলে অভিহিত হতে পারে।
(২) ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধিতে (১৯৭৬ সালের সামরিক আইন বিধি নং ২২)।
(১) ৯ নম্বর আইটেমের ই ধারায় দ্বিতীয় অনুচ্ছেদের শেষে পূর্নচ্ছেদের বদলে একটি সেমিকোলন বসবে এবং তারপর থেকে নিম্নলিখিত নতুন আইটেম যুক্ত হবে, যথাঃ
(১০) জীবিত অথবা মত কোনো ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি পূজা সৃষ্টি অথবা উৎসাহ দেয়া এবং
(২) সি ধারায় ৪ নম্বর অনুচ্ছেদে ১ নম্বর উপ-অনুচ্ছেদের শেষে পূর্ণচ্ছেদের বদলে একটি কোলন বসবে এবং তারপর থেকে। নিম্নলিখিত ব্যাখ্যা বসবে, যথা
শর্ত হচ্ছে, দলের ইশতেহারে কর্মসূচীতে এমন কিছু অন্তভুক্ত করা যাবে না যা জনগণের সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নয়নমুখী নয় অথবা দলের ইশতেহার ও কর্মসূচীতে জনগণের সামাজিক- অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো প্রতিফলন থাকবে না।
দ্বিতীয় সংশোধনী :
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধি (১৯৭৬ সামরিক আইনবিধি নং ২২) সংশোধন করে পুনরায় একটি সামরিক আইনবিধি জারি করেন ২৪শে অক্টোবর,১৯৭৬। ১৯৭৬ সালের (দ্বিতীয় সংশোধনী) রাজনৈতিক দলবিধি ১৯৭৬ সালের ৩০ নং সামরিক আইনবিধি বলে আখ্যায়িত হয়। উক্ত বিধির পূর্ণ বিবরণ নিম্নে দেয়া হল :
যেহেতু নিম্নে বর্ণিত উদ্দেশ্যে ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধি (১৯৭৬ সালের সামরিক আইন বিধি নং ২২) আরো সংশোধন করা জরুরী হয়ে পড়েছে,
এখন তাই, ১৯৭৫ সালের ২০শে আগষ্ট ও ১৯৭৫ সালের ৮ই নভেম্বরের ঘোষণা অনুযায়ী সেভাবে তাঁকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিম্নলিখিত সামরিক আইনবিধি প্রণয়ন করেছেনঃ
১। সংক্ষিপ্ত শিরোনাম : এ বিধি ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক আইনবিধি (দ্বিতীয় সংশোধনী) বলে অভিহিত হবে।
২। ১৯৭৬ সালের ২২ নং সামরিক আইন বিধির সংশোধনঃ
১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক আইন বিধির (১৯৭৬ সালের ২২ নং সামরিক আইনবিধি) ৪ অনুচ্ছেদে—
(১) উপ-অনুচ্ছেদ (২)-এ যেখানে ‘রাজনৈতিক দল’ শব্দসমূহ শেষ হয়েছে তারপর একটা সেমিকোলন এবং ‘কোন রাজনৈতিক দল এ বিধির শর্ত পূরণ করেছে কিনা সে সম্পর্কে সরকারী সিধান্তই চূড়ান্ত হবে এবং কোন আদালতে বা অপর কোন কর্তৃপক্ষের নিকট এ সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না শব্দসমূহ সংযুক্ত হয়েছে বলে ধরতে হবে; এবং (২) উপ-অনুচ্ছেদ (৩) -এর পরে নিম্নলিখিত নতুন অনুচ্ছেদ সংযুক্ত হবে, যথা :
(৩) সরকারী গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সরকার ঘোষণা করতে পারে যে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত কোন সময়কালেই উপ-অনুচ্ছেদ (১)-এ উল্লিখিত এ ধরনের কোন দলিলপত্রই সরকার কর্তৃক গৃহীত বা গ্রাহ্য হবে না।
(৪) বিচারাধীন মামলা ইত্যাদি রদবদল : ১৯৭৬ সালের রাজনৈতিক দলবিধির (১৯৭৬ সালের ২২ নং সামরিক আইনবিধি) 8 অনুচ্ছেদের উপ-অনুচ্ছেদ (২) -এর অধীনে জানানো সরকারী সিদ্ধান্তের যথার্থতা বা বৈধতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে কোন আদালতে বা অপর কোন কর্তৃপক্ষের নিকট এ আইনবিধি জারির পূর্বে অথবা এ ধরনের ঘোষণার অনতিপূর্বে দায়ের করা, গঠিত বা শুরু হওয়া বা বিচারাধীন সকল মামলা আবেদন ও অপর কার্যধারা রদ হবে এবং এ ব্যাপারে আর কিছু করা যাবে না।
রাজনৈতিক দল
উপরোক্ত রাজনৈতিক বিধিমালার প্রেক্ষিতে সরকারের নিকট ৫৬টি প্রস্তাবিত রাজনৈতিক দল বৈধ দল হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্য কাগজপত্র দাখিল করে। এদের মধ্যে মোট ১৯টি রাজনৈতিক দল বৈধ দল হিসেবে সরকারের স্বীকৃতি পায়। দলগুলোর সংক্ষিত, পরিচিতি নিম্নরূপ :-
ইউনাইটেড পিপলস পার্টি :
সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দল বিধিমালার অধীনে স্বীকৃত অপর একটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে ইউনাইটেড পিপলস পার্টি (ইউপিপি)। দলের নেতা হচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদ। ৩রা নভেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে কাজী জাফর আহমদ দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী ব্যক্ত করেন।
দলের ঘোষিত আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে তিনটি মূলনীতি রয়েছে। এগুলো হচ্ছে স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক মুক্তি। জনগণের সার্বিক শোষণমুক্তি তথা সমাজতন্ত্র দলটির চূড়ান্ত লক্ষ্য। অন্যান্য কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গণ থেকে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করে স্বনির্ভর বলিষ্ঠ জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তোলা ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা।
নির্বাচনী বিতর্কের প্রসঙ্গে তিনি নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে মত দেন। কিন্তু নির্বাচনী তৎপরতা চালানোর কিছু সময়ের জন্য নির্বাচনী তারিখ পিছিয়ে দেয়ার পক্ষে মত দেন।
জাতীয় জনতা পার্টি :
সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় শর্তমুক্ত প্রক্রিয়া শেষে জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে জাতীয় জনতা পার্টি নামে নতুন দলের স্বীকৃতি লাভ ঘটে। দলের প্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ওসমানী গত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এবং এর পরেও কিছুকাল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। পরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন এবং মন্ত্রীও হন। বাকশাল গঠনের পর তিনি তৎকালীন সংসদ সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
জাতীয় জনতা পার্টির ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচীতে বলা হয়ঃ দলের উদ্দেশ্য হচ্ছে শোষণের হাত থেকে জনগণকে মুক্ত করে ন্যায়সঙ্গতভাবে সম্পদের যথাসম্ভব সমবন্টন করা। পার্টির সমাজতন্ত্রের প্রতি যথেষ্ট আস্থা রয়েছে। তবে তাঁরা সংসদীয় এবং নিয়মতান্ত্রিক পথে সমাজতন্ত্র গড়ে তোলায় বিশ্বাসী।
বৈধ দল হিসেবে সরকারী অনুমোদন লাভের পর পার্টি প্রধান জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) ওসমানী এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন : “স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্রের কথা বলে সমাজতন্ত্র বিরোধী কাজ করা হয়েছে।” অথচ সে সময়ে তিনি ক্ষমতাসীন দলের সদস্য এবং মন্ত্রী ছিলেন। তিনি বলেন । তিনি সংবিধান পরিবর্তনের পক্ষপাতি নন। দেশরক্ষার ব্যাপারে তিনি যুগোস্লাভিয়া এবং ইসরায়েলের কাছ থেকে শিক্ষা নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেন : আওয়ামী লীগাররাই তাকে হত্যা করেছে।
বাংলাদেশ পিপলস লীগ
ডঃ আলীম আল রাজীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ পিপলস লীগ নামে একটি নতুন দল রাজনৈতিক দলবিধির শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সরকারী অনুমোদন লাভ করেছে ১৯৭৬-এ। দলের নেতা ডঃ আলীম আল রাজী পেশায় আইনজীবি। পাকিস্তান আমলে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এম, এন, এ নির্বাচিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরবর্তীকালে তিনি ভাসানী ন্যাপে যোগ দিয়েছিলেন।
সরকারের কাছে পেশকৃত দলের ঘোষণা ও কর্মসূচীতে বলা হয়ঃ তাঁর দল পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তে সমাজতন্ত্র ও শোষণমুক্ত সমাজ কায়েমের পক্ষপাতি। তাঁর দল সংসদীয় গণতন্ত্রেও বিশ্বাস করে।
বাংলাদেশ পিপলস লীগের কর্মসূচী, আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রসঙ্গে ডঃ আলীম আল রাজী সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন : তাঁর দল নির্বাচিত হলে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করবে এবং বর্তমান তিনশ’ জনের পরিবর্তে পার্লামেন্টে চারশ’ সদস্যের বিধান রাখবে।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী)
রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় শর্তযুক্ত প্রক্রিয়া শেষ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বৈধ দল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ২০শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬। সে সময়ে দলের প্রধান হিসেবে এ দেশের বয়োবৃদ্ধ নেতা মওলানা ভাসানীই আসীন ছিলেন। মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর দলের সাংগঠনিক প্রধান হিসেবে কেউ দায়িত্বপ্রাপ্ত হননি। এ দলের প্রধান প্রধান নেতা হলেন গাজী শহীদুল্লাহ, মশিউর রহমান (যাদু মিয়া), আবু নাসের খান ভাসানী প্রমুখ।
সরকারের কাছে পেশকৃত ন্যাপের ঘোষণাপত্র এবং কর্মসূচীতে বিধৃত বক্তব্যে বলা হয় : পার্টির মূলনীতি থাকবে দু’টি-জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্র। পাটি রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ও পরিচালনায় মূল ভারী ও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী। কিন্তু অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্যক্তিগত বিনিয়োগ ও প্রচেষ্টাকে রাষ্ট্র সর্বপ্রকার সুযোগ প্রদান করবে। পার্টি জাতীয় স্বাধীনতা ও রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব এবং রাষ্ট্রীয় অখন্ডতা রক্ষা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে মূল ভিত্তি করে বৈদেশিক নীতি প্রণয়ন করিবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে অসাম্প্রদায়িক নীতিতে অবিচল থাকবে। পার্টি নেতৃত্বে কোরান ও সুন্নাহ পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করা হবে না এবং অন্য কোন ধর্ম বিরোধী আইন প্রণয়ন করা হবে না।
বাংলাদেশ জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন –
সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক বিধিমালার অধীনে অপর একটি রাজনৈতিক দল হচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয় গণমুক্তি ইউনিয়ন (জাগমুই)। দলের নেতা হচ্ছেন দলের সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল হোসেন খান। সিরাজুল হোসেন খান এদেশের শ্রমিক আন্দোলনের একজন প্রথম সারির নেতা।
২৭শে নভেম্বর এক সাংবাদিক সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচী ব্যাখ্যা করেন। দলের পঞ্চশালা নীতিভিত্তিক কর্মসূচীতে রয়েছে -(১) জনগণের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন, (২) সকল বিদেশী শোষক আধিপত্যের অবসান ঘটিয়ে জাতীয় মুক্তি অর্জন ও স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণ। সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম চালানো, (৩) আন্তর্জাতিক পুজি ও জোতদারী মহাজন ইত্যাদির শোষণ অবসান করে গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা ও জাতীয় অর্থনীতি এবং জনগণের সামাজিক উন্নয়ন ও বিকাশ সাধন করা, (৪) সকল প্রকার সাম্প্রদায়িকতা, আঞ্চলিকতা ও বিভেদমূলক রাজনীতি এবং ফ্যাসিবাদী তৎপরতাকে প্রতিহত করা এবং (৫) সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সকল নিপীড়িতের আন্তর্জাতিকতাবাদকে জোরদার করা।
বাংলাদেশের সাম্যবাদী জল –
সরকার ঘোষিত বিধিমালা অনুযায়ী আরো একটি দল অনুমতি পেয়েছে। দলটির নাম বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল। দলের প্রধান হলেন মোহাম্মদ তোয়াহা। সাম্যবাদী দল ‘৭৬-এর নির্বাচনী বিতর্কে নির্বাচনের বিরোধিতা করে।
দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা এক সময় তৎকালীন পাকিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ভাসানী) কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ১৯৭২ সালে তিনি মুজিব সরকারের হলিয়ার প্রেক্ষিতে গোপন সংগঠন করেন এবং সকল কার্যক্রম গোপনে চালান। অতীতে তাঁর রাজনীতির প্রধান লাইন ছিল ‘শ্রেণী শত্রু খতম। ” অবশ্য মুজিবের মৃত্যুর পর প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে এসে তিনি ঘোষণা করেন, “গলা কাটার রাজনীতি করে ভুল করেছি’। সাম্যবাদী দলের নেতা মোহাম্মদ তোয়াহা অনুমতি লাভের পর পরই এক সাক্ষাতকারে বলেন, তাঁদের দলের নীতি ও কর্মসূচীর সঙ্গে বর্তমান সরকারের নীতির সামঞ্জস্য রয়েছে বলে তারা বর্তমান সরকারকে সমর্থন করেন।
বাংলাদেশ জাতীয় লীগ
আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ “জাতীয় লীগ” সরকারের রাজনৈতিক দল বিধিমালার শর্ত পূরণ করে বৈধ দল হিসেবে ছাড়পত্র পায় ২৩শে সেপ্টেম্বর, ১৯৭৬। দলের প্রধান আতাউর রহমান একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং পেশায় আইনজীবী। পাকিস্তান আমলের প্রথম ভাগে তিনি পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রায় দু’বছর। পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে তিনি “পাকিস্তান জাতীয় লীগ” নামে একটি রাজনৈতিক দলও গঠন করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব একদল ‘বাকশাল’ গঠন করলে তিনি বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে যোগ দেন।
বাংলাদেশ জাতীয় লীগের ঘোষণাপত্র ও কর্মসচীতে বলা হয়ঃ জাতীয় লীগ প্রশাসন যন্ত্রের উপর প্রভাব বিস্তার করতে পারে এমন সমস্ত মূল বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ সরকারী নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত করবে। অন্যসব শিল্প প্রতিষ্ঠান বেসরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন থাকবে। বাংলাদেশ জাতীয় লীগের মূলনীতিসমূহ হচ্ছেঃ ধর্ম মানব জীবনের ভিত্তি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব তাদের পবিত্র আমানত। রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে সংসদীয় গণতন্ত্রই তাদের আদর্শ। শোষণমুক্ত সমাজ ব্যবস্থা তথা কল্যাণমূলক রাষ্ট্র কায়েম করাই হচ্ছে জাতীয় লীগের লক্ষ্য। নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও মুসলিম বিশ্বের সহযোগিতা আমাদের কাম্য।
বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক লীগ
সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় খোন্দকার মুশতাক আহমদের নেতৃত্বে নতুন একটি রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ ডেমোক্র্যাটিক লীগ’ সরকারী অনুমোদন পায় ১৯৭৬-এ। দলের নেতা ১৯৪৯ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন । স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় দলের নেতা খোন্দকার মুশতাক আহমদ অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন। ১৯৭৫ সনে গঠিত শেখ মুজিবের বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রভাবশালী সদস্য ছিলেন। ১৫ই আগষ্ট শেখ মুজিব নিহত হলে তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন।
ডেমোক্র্যাটিক লীগের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচীতে সমাজতন্ত্রকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। দলের ঘোষণাপত্র ও কর্মসূচীতে বলা হয় : গণতন্ত্রই পার্টির মূলতন্ত্র। তবে তাঁরা, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। বরঞ্চ ফ্রি ইকনমিই তাদের পছন্দ।
দলের কর্মসূচী, আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন : “গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্যই অগণতান্ত্রিক উপায়ে ১৫ই আগষ্ট আমাকে ক্ষমতা হাতে নিতে হয়েছিল”। আওয়ামী লীগ ছেড়ে ডেমোক্র্যাটিক লীগ গঠন প্রসঙ্গে বলেন : আওয়ামী লীগ যতদিন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিল ততদিন ছিলাম। যেহেতু বর্তমানে আওয়ামী লীগে থেকে কাজ করা সম্ভব নয় এবং সমীচীনও নয় তাই এ নতুন দলের গোড়াপত্তন।
জাতীয় দল –
সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় নতুন আর একটি রাজনৈতিক দলের স্বীকৃতি ঘটে এবার। দলটির নাম জাতীয় দল। দলের নেত্রী মিসেস আমেনা বেগম।
মিসেস আমেনা বেগম এক সময় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সদস্যা এবং নেতৃস্থানীয়দের একজন ছিলেন। এক সময় আওয়ামী লীগের দুর্দিনে পাটির হালও ধরেছিলেন। ৬-দফার জন্য প্রচুর প্রচারণাও চালিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতার পূর্বেই পাটির আভ্যন্তরীণ ক্ষমতার কোন্দলে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে এসে আতাউর রহমানের জাতীয় লীগে যোগ দিয়েছিলেন। সম্প্রতি তিনি নতুন দলটি গঠন করেন। ঘরোয়া রাজনীতির শুরুতে আতাউর রহমানের সঙ্গে দল গঠন (অস্পষ্ট)- বসলেও পরে তিনি নিজেই নতুন দল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন।
এখানেও ক্ষমতার স্বত্বই হয়তো প্রধান। পার্টির মূলনীতি এবং ঘোষণাপত্র আতাউর রহমানের পার্টির মতই!
রাজনৈতিক দিক দিয়ে জনগণের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়ে খসড়া ঘোষণাপত্রে এ দল গণতন্ত্রকে মূলনীতি হিসেবে মেনে নিয়েছে। ঘোষণায় অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তেমন কোন নির্দিষ্ট রূপরেখা দেয়া হয়নি। তবে ঘোষণায় তাঁর জনগণের সুযোগের সাম্যের পক্ষপাতী। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের প্রতি তাদের সমর্থন রেখে তাঁরা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনকারী সকল রাষ্ট্রকে বন্ধু এবং হুমকি কটাক্ষকারীদের। শত্রু বলে খসড়া ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেছেন।
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মোজাফফর) –
সরকারের রাজনৈতিক দলবিধির আওতায় বৈধদল হিসেবে রাজনীতি করার ছাড়পত্র পেয়েছে বাংলাদেশ ন্যাপ (মো)। দলের প্রধান হলেন অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ নিজেই।
এদেশে বামপন্থী আন্দোলনের প্রথম বিভক্তিকালে তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মস্কোপন্থী অংশের নেতা হিসেবে পরিচিত হন। শেখ মুজিব বাকশাল গঠন করার পর তিনি তাঁর নিজে বাকশালে যোগদান করেন এবং নিজ দলের বিলোপ সাধন করেন।
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ নতুন করে তাঁর দলের ছাড়পত্র লাভের সময় পাটির বর্তমান আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মুখবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা পরকালের মুক্তির জন্য চাই শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থা।’ আর এ দুইয়ের মধ্যে তারা কোন বিরোধও লক্ষ্য করেন না।
পাটির বর্তমান আদর্শ ও উদ্দেশ্যের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভৌগলিক অখন্ডতা রক্ষা করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করে দেশী বিদেশী প্রতিক্রিয়াশীলদের মোকাবেলা করবে বলেও পার্টির কর্মসূচীতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (মনি সিং)
সাবেক বাকশাল নেতা মনি সিং-এর নেতত্বে গঠিত হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি। এ দল সরকারী অনুমোদন লাভে সমথর্ হয় ২২শে অক্টোবর।
দলের নেতা মনি সিং এ দেশের একজন প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা। পাকিস্তান আমলে অধিকাংশ সময় তিনি আত্মগোপন জীবন অতিবাহিত করেন। ষাটের দশকে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভক্তির সময়ে তিনি মস্কোপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি তাঁর দল নিয়ে প্রকাশ্য রাজনীতিতে ফিরে আসেন।
শেখ মুজিবের আমলে তার দল প্রথমে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের (মোজাফফর) সঙ্গে ত্রিদলীয় ঐক্যজোট করেন এবং পরে শেখ মুজিবের বাকশালে যোগ দিয়ে তাঁর দলের বিলোপ সাধন করেন। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর দীর্ঘদিন মস্কোয় অবস্থান করে দলের অনুমোদন লাভের কিছুদিন আগে দেশে ফিরে বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পাটিকে সংগঠিত করেন।
বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল :
এম, এ, আউয়ালের নেতৃত্বাধীন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল সরকারের অনুমোদন পেয়েছে ১২ই অক্টোবর। সাবেক জাসদের কিছু কিছু নেতা ও কর্মী এই দলের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছেন। আদমজী জুট মিলের প্রাক্তন প্রশাসক এম, এ, আউয়াল শেখ মুজিবের সরকার কর্তৃক মিলের প্রশাসকের পদ থেকে অপসারিত হওয়ার পর তৎকালীন ‘জাসদে’ যোগ দেন। পরে তিনি পার্টির প্রথম সারির নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক দল হিসেবে অনুমোদন লাভের পর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের নেতা এম, এ, আউয়াল সাংবাদিক সম্মেলনে দলের ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন। দলের ঘোষণাপত্রে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রকেই’ জাসদের মূলমন্ত্র বলে ঘোষণা করা হয়েছে। আরো বলা হয়েছে জনগণই রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক। জনগণের সাবভৌমত্ব প্রতিষ্ঠাই দলের মূল লক্ষ্য। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জনশক্তিকে সম্পদে রূপান্তরের পথকেই মুক্তির পথ বলে ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্কাটিক লীগ :
সাবেক নেজামে ইসলামের মওলানা ছিদ্দিক আহমদ ও জামাতে ইসলামের মওলানা আবদুর রহিম গঠন করেছেন বাংলাদেশ ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ। এই দল সরকারী অনুমোদন পেয়েছে ১২ অক্টোবর। অনুমোদন লাভের মওলানা ছিদ্দিক এক সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁর দলের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন।
মওলানা ছিদ্দিক আহমদ এবং মওলানা আবদুর রহিম উভয়ের পূর্বতন দল দুটি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরোধী ছিল। এমন কি হানাদার বাহিনীর সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ছিল বলেও অনেকে অভিযোগ করেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিদেশী উস্কানীর ফল, ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবী হত্যার জন্য দায়ী কারা তা ভেবে দেখতে হবে।তবে আল-বদর আল-শামস রাজাকাররা তার জন্য দায়ী না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি—কেননা তখন তারা পলায়নে অধিক মনোযোগী ছিল।
মওলানা ভাসানী সম্পর্কে মওলানা ছিদ্দিক আহমদ বলেন, তিনি কোরান ও সুন্নাহ মোতাবেক ইসলামী হুকুমত কায়েম করতে পারলে তা হলে তার নেতৃত্ব মানব। কিন্তু উনার কথা সব কিছু আল্লাহর একথা মানতে পারি না। কারণ আমার বউ, বিবি, বাল-বাচ্চা এসব কিছু আল্লাহর এটা মানতে পারি না।
দলের কর্মসূচীতে দেশে ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের জন্য সবকিছু করার দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ :
সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দল বিধি ৭৬-এর শর্ত পূরণ করে বৈধ-রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ। স্বাধীনতার পর থেকে ২১শে সেপ্টেম্বর অর্থাৎ বৈধ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পূর্ব পর্যন্ত এই দল ছিল নিষিদ্ধ। দলের নেতা হচ্ছেন অবদসে সবুর খান।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগের সঙ্গে পুরনো মুসলিম লীমের সম্পর্ক প্রসঙ্গে দলের নেতা আবদুস সবুর খান বলেন, “সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী বর্তমান মুসলিম লীগ একটি নতুন রাজনৈতিক দল। কিন্তু ১৯০৬ সনে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম লীগের আদর্শ ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে এর সাদৃশ্য রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময়ে আবদুস সবুর খানের ভূমিকা ছিল স্বাধীনতা বিরোধী। ষাট দশকের প্রথম দিকে আয়ুব খানের বিরোধীতা করলেও পরবর্তীতে তিনি দীর্ঘদিন আয়ুব মন্ত্রীসভা সদস্য ছিলেন।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগ সরকারী অনুমোদন লাভের পর পরই ২৯শে সেপ্টেম্বর সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করে। সম্মেলনে আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যেই চার নীতিসহ বাংলাদেশের সংবিধানকে গ্রহণ করেছি। এর বাতিলের পক্ষপাতিও আমরা নই। এর অধীনেই আমরা নির্বাচনে অংশ নিতে রাজী। অন্যান্য উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীর মধ্যে রয়েছে, বাংলাদেশী মালিকদের জাতীয়করণকৃত পাট ও বস্ত্রকারখানা পুরাতন মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া, ভবিষ্যতে যে কোন ধরনের জাতীয়করণের সম্পূর্ণ বিরোধীতা করা, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদে দৃঢ় আস্থা প্রকাশ এবং চিরকালের জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি অনুগত থাকা।
গণমুক্তি পার্টিঃ-
গণমুক্তি পার্টি নামে নতুন আরো একটি দলের অভ্যুদয় ঘটেছে। রাজনৈতিক দল বিধি অনুসারে এ দলটিও সরকারের অনুমোদন লাভ করেছে। দলের প্রধান হিসেবে রয়েছেন আবদুল হামিদ। অধ্যক্ষ আবদুল হামিদ তৎকালীন পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন।
অধ্যক্ষ হামিদ দলের আদর্শ উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচী প্রসঙ্গে এক সাংবাদিক সম্মেলন আহবান করেন ৫ই নভেম্বর। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শ্রমতাত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের মাধ্যমে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনই বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টির মূল লক্ষ্য।
কর্মসূচীতে নির্ভুল শ্রমনীতি প্রবর্তন ও এ ভিত্তিতে শোষণমুক্ত সমাজ গঠনকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। শোষণমুক্ত সমাজ গঠনের এ মতবাদকেই তিনি শ্রমবাদ বলেছেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, তার দল মনে করে পুঁজিবাদ, সমাজবাদ ও সাম্যবাদ শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ জন্যই তিনি আল্লাহর অস্তিত্ব ও একত্ব বিশ্বাস করে নিয়ে পবিত্র কোরান ভিত্তিক শ্রমবাদ প্রবর্তনের প্রস্তাব করেছেন। নির্বাচন প্রশ্নে তিনি কমপক্ষে এক বছর নির্বাচন পিছানোর মত প্রকাশ করেছিলেন।
বাংলাদেশ লেবার পাটি
রাজনৈতিক বিধিমালার অধীনে নতুন আর একটি স্বীকৃত দল হচ্ছে বাংলাদেশ লেবার পার্টি। দলের প্রধান হলেন মওলানা মতিন। তিনি একসময়ে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
মওলানা মতিন ‘৭৬-এর নির্বাচনী বিতর্কে নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কমপক্ষে নির্বাচন দুই বছর পিছিয়ে দেয়া উচিত।
পার্টির মূলনীতিতে কোরান ও সুন্নাহ অনুযায়ী ইসলামী আদর্শ ও মূলনীতির উপর জোর দেয়া হবে বলে বলা হয়েছে। এছাড়াও এ দল স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদকে মূল লক্ষ্য। হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছে বলে মেনিফেষ্টোতে ঘোষণা করা হয়েছে। আদর্শের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে ধর্মহীনতা নয় ধর্মপরায়নতাই অন্যতম আদর্শ। দলে কর্মসূচীতে জাতীয় সংহতি ও রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বিধানকেই প্রাধান্য দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ কনভেনশন মুসলিমলীগ :
বাংলাদেশ কনভেনশন মুসলিম লীগ নামে আরো একটি রাজনৈতিক দল সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক বিধিমালার আওতায় স্বীকৃতি লাভ করেছে। দলের প্রধান পাবনার আবদুল মতিন। বাংলাদেশ মুসলিম লীগের নেতা সবুর খানের সঙ্গে প্রথমে তিনি আলোচনা চালালেও নেতৃত্বের প্রশ্নে এই দল গঠন করেন। মতীন, সবুর খানের মত বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধান ঠিক রাখার পক্ষে নন। পাকিস্তান আমলে মতীন মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিলেন। এ দলের আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচী সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি।
তফসিলী ফেডারেশন :
রাজনৈতিক দলবিধি ‘৭৬-এর আওতায় নতুন আর একটি রাজনৈতিক দল স্বীকৃতি পেয়েছে। দলটির নাম তফসিলী ফেডারেশন। দলের নেতা হিসেবে রয়েছেন মিঃ রসরাজ মন্ডল।মিঃ মন্ডল পাকিস্তান আমলে তৎকালীন শাসকবর্গের সঙ্গেও তাল মিলিয়ে চলতেন। খোন্দকার মোশতাক যখন প্রেসিডেন্ট তখন তিনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ‘৭৬-এ রাজনৈতিক দলবিধি দল বিধি ঘোষণার পর তিনি তফসিলী জাতিদের সমন্বয়ে এ দল গঠন করেন।
দলের ঘোষণাপত্রে তফশীল জাতির উন্নয়নে আস্থাভাজন তফশীল সদস্যদের নিয়ে একটি স্থায়ী স্বায়ত্বশাসিত কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। নির্বাচন প্রসঙ্গে দলের নেতা রসরাজ মন্ডল নির্বাচন পিছিয়ে দেয়ার পক্ষেই মত দেন।
আওয়ামী লীগ :
সরকার ঘোষিত রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় আওয়ামী লীগ বৈধ রাজনৈতিক দল হিসেবে স্বীকৃতি পায় ৪ঠা নভেম্বর। এ দলের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে রয়েছেন আবদুল মালেক উকিল, বেগম সাজেদা চৌধুরী, মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ।
আওয়ামী লীগের আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং কর্মসূচী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়নি।
কুটনীতি
১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান ও ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক উপরি কাঠামোতে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে তার সামগ্রিক প্রতিফলন ঘটেছে ৭৬ সালের পররাষ্ট্রনীতিতে। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের আওয়ামী-বাকশালী শাসনের আমলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের নিয়ন্ত্রণ ছিলো খুবই স্পষ্ট এবং প্রত্যক্ষ। ভারত ও রাশিয়ার এই নিয়ন্ত্রণ স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রতিফলিত হয়েছে। ১৫ই আগস্টের সামরিক অভ্যুত্থান ও ৭ই নভেম্বরের পরিবর্তনের মাধ্যমে এই নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়, যা ভারত ও রাশিয়া কারোই মনঃপূত ছিলো না। এই সময়ে ভারত ও রাশিয়ার বিভিন্ন সরকার মুখপাত্র ও তাদের পরিচালিত সংবাদপত্র ও প্রচার মাধ্যমসহ বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ জ্ঞাপন করে ও বিভিন্নভাবে অপপ্রচার চালায়। বাংলাদেশের নতুন সরকার তাঁদের ঘোষিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি তানুযায়ী ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে বরাবর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ অব্যাহত রাখতে আগ্রহী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে ৮ই ডিসেম্বরে নয়াদিল্লীতে বাংলাদেশের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদলের সফরের পর যুক্ত ঘোষণায় বলা হয় সার্বভৌমত্ব, সমতা ও পারস্পরিক কল্যাণের ভিত্তিতে দুদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা গড়ে তোলার জন্য ভারত সব কিছু, করবে। এতদঞ্চলের দেশসমূহের মধ্যে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সহযোগিতা এসব দেশের জনগণের কল্যাণ ও অগ্রগতির জন্য একান্ত জরুরী বলে উভয়পক্ষ জোর মত প্রকাশ করেন। এর কিছু দিন পর প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত পররাষ্ট্র সচিব তবারক হোসেনের দুদিনব্যাপী মস্কো সফর শেষে ১৮ই ডিসেম্বর ঢাকা ও মস্কো থেকে যুক্ত বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ এবং এই অঞ্চলের সকল দেশের মধ্যে তথা সারা বিশ্বে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা জোরদার করে তোলার প্রতি প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। এই বিবৃতিতে উভয়পক্ষের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা ও অপরের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি প্রতি শ্রদ্ধাসহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির ভিত্তিতে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে এবং জোরদার করতে উভয়পক্ষ আগ্রহ প্রকাশ করে। বাংলাদেশের সকল আগ্রহ ও আন্তরিকতার পরও ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের বিশেষ কোন উন্নতি ‘৭৬ সালে পরিলক্ষিত হয়নি। বরং ভারতের বৈরী মনোভাবের থেকে বাংলাদেশ যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ আগ্রাসন ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছে এ দেশের জাতীয় অর্থনীতিতে তার প্রতিক্রিয়া হয়েছে মারাত্মক।
ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ক্রমাবনতি ঘটা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ১৯৭৫ সালের পরিবর্তনের পর পররাষ্ট্রনীতির ৫ ক্ষেত্রে বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর বাংলাদেশ গণচীন ও সৌদী আরবের স্বীকৃতি লাভ করেছে। একই সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক আরো ঘনিষ্টতর হয়েছে। ১৯৭৬ সালের আগষ্টে কলম্বোয় অনুষ্ঠিত জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। এই সম্মেলনে ভারত ছাড়া সকল দেশ (মোট ৮৫) বাংলাদেশের বক্তব্য সমর্থন করে। এই সম্মেলনের ঘোষণা প্রণয়নের ব্যাপারে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে গণচীন ও সৌদি আরবের সঙ্গে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে সম্পর্ক স্থাপিত হয়। সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন ছিলো খুবই দরকারী।
‘৭৬-এর মে মাসে ইসলামী পররাষ্ট্র মন্ত্রী সম্মেলনে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ‘বাধহীন গঙ্গা নদীর পানিতে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যার দাবী উত্থাপন করেন এবং এই সম্মেলনে ভারতের ফারাক্কা নীতির কঠোর সমালোচনা করা হয়।
১৯৭৬-এ জাতিসংঘের বিশের রাজনৈতিক কমিটিতে ফারাক্কা বিতর্কে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব করেন উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক রিয়ার এডমিরাল এম, এইচ, খান। ফারাক্কা প্রশ্নে জাতিসংঘের অপরাপর দেশসমূহ বাংলাদেশের বক্তব্য সমর্থন করে, যদিও ভারত এ ব্যাপারে তার একগুয়ে নীতি অব্যাহত রাখে। জাতিসংঘে বাংলাদেশ একদিকে যেমন ফারাক্কা প্রশ্নে ভারতের আগ্রাসী নীতির সমালোচনা করেছে তেমনি প্যালেস্টাইন প্রশ্নে ইসরাইলী ইহুদীবাদের এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ও রোডেশিয়ার বর্ণবাদী শেতাঙ্গ সরকারের নিন্দা করেছে সুস্পষ্ট ভাষায়। প্যালেস্টাইন রোডেশিয়াসহ তৃতীয় বিশ্বের অপরাপর দেশসমূহের সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী সংগ্রামে বাংলাদেশ এই সারে জাতিসংঘসহ সকল আন্তর্জাতিক ফোরামে দৃঢ় সমর্থন প্রদান করেছে এবং বাংলাদেশও তার আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদ বিরোধী ন্যায্য সংগ্রামে তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন লাভ করেছে।
১৯৭৬ সালে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যবৃন্দ এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতির চিত্র তুলে ধরেছেন এবং ভারতের আগ্রাসী তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করেছেন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির কথা ঘোষণা করলেও প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের রুশ-ভারত বলয়ে অবস্থানের কারণে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রকৃত মর্যাদা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ‘৭৫-এর ৭ই নভেম্বরের পর সরকার জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতির কথা বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন এবং স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে (অস্পষ্ট) করার জন্য বিদেশী শক্তিবর্গের আগ্রাসী তৎপরতাকে প্রতিহত করার কথাও বলেন। ১৯৭৬-এ বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিবর্গের ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের বক্তব্যের ভেতর দিয়ে জোটনিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টি প্রতিটি দেশ অনুধাবণ করতে সক্ষম হয়েছে এবং বাংলাদেশ নিজেকে বিশ্বের দরবারে সম্মানজনক আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। ‘৭৬ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ৭৭ জাতি গ্রুপের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছে। ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে একচেটিয়া বৈদেশিক বাণিজ্য হ্রাস পেয়েছে এবং ইইসি ভুক্ত দেশসমূহ এবং গণচীনসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের সঙ্গে বাণিজ্যিক লেনদেন বৃদ্ধি পেয়েছে।
১৯৭৬ সালের বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন সাধিত হয়েছে অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তার প্রভাব পড়েছে। এই সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানসহ পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশ প্রচুর আর্থিক সাহায্য লাভ করেছে। যার ফলে এই বছর দ্রব্যমূল্য পীর্বের তুলনায় হ্রাস পেয়েছে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে কিছুটা স্থিতিশীলতা পরিলক্ষিত হয়েছে।
গণচীনের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বাভাবিক সম্পর্ক ও পারস্পরিক সহযোগিতার নীতি বাংলাদেশকে তার আর্থিক ও রাজনৈতিক সংকট দূর করতে যথেষ্ট সহায় হয়েছে। ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের পর স্বীকৃতি এবং ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানকে স্বাগত জানানোর মাধ্যমে গণচীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপর্ণ সম্পর্কের উত্তরোত্তর উন্নতি ঘটেছে। উভয় দেশ কয়েক দফায় বাণিজ্য প্রতিনিধিদল বিনিময় করেছে। ঢাকায় সিনহুয়া বার্তা সংস্থা এবং পিকিং-এ বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সময়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সমিতির একটি দল মৈত্রী সফরে চীন গমন করেন। এর পর বাংলাদেশের একটি সাংবাদিক প্রতিনিধিদলও চীন সফর করেন। এই প্রতিনিধিদলের নেতা এনায়েতুল্লাহ খান ঢাকায় এসে একজন প্রভাবশালী চীনা নেতার বরাত দিয়ে বলেন, ‘দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের প্রতি চেয়ারম্যান মাও গভীর মনোযোগ দিয়েছেন।’ বিশ্বের সর্বহারা নিপীড়িত জনগণের মহান নেতা চেয়ারম্যান মাও-সে-তুং ১ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর সম্মানে বাংলাদেশে একদিন সকল অফিস-আদালত, শিক্ষা ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে এবং সাত দিন জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়। প্রেসিডেন্ট সায়েম তাঁর শোকবার্তায় বলেন, ‘এ দেশের জনমনে চেয়ারম্যান মাও ভক্তির স্থায়ী আসনে সমাসীন।’ প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়া বলেন, ‘চেয়ারম্যান মাও শুধু মহান চীনের জনগণেরই প্রিয় নেতা ছিলেন না, উপরন্তু তিনি ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মহান ব্যক্তি।’ চেয়ারম্যান মাওয়ের মৃত্যুর পর চেয়ারম্যান হওয়া কুয়ো ফেং-এর নেতৃত্বে পরিচালিত গণচীন সরকার ফারাক্কা প্রশ্নে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের বক্তব্য দৃঢ়ভাবে সমর্থন করেন। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারীতে ভারত যখন বাংলাদেশের সীমান্তে প্রথম হামলা চালায় তখন পিকিং বেতারসহ চীনের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মন্তব্যসহ ভারতের এই আগ্রাহী হামলার চিত্র বিষদভাবে তুলে ধরেছে।
বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সুসম্পর্ক বজায় থাকা একাধিক কারণে প্রয়োজন। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভারত একটি সম্প্রসারণবাদী উপ-বৃহৎ শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার ফলে এই অঞ্চলের দুর্বল ও ক্ষুদ্র দেশগুলোর স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। দুর্বল প্রতিবেশী সিকিমকে ভারত ইতিমধ্যে গ্রাস করেছে এবং নেপাল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান প্রতি দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্মকে খর্ব করার জন্য বিভিন্নভাবে আগ্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছে। সকল প্রকার সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদের বিরোধিতার ক্ষেত্রে চীন যে ভূমিকা পালন করছে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের স্বাধীনতা ও জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে তা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বাংলাদেশ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে এই ধরনের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র দেশসমূহের ঐক্যবদ্ধ দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছে।
১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের যে অঙ্গীকার ঘোষিত হয়েছে, তৃতীয় বিশ্বের শতাধিক দেশ তা সমর্থন করেছে। এই সংগ্রামে বাংলাদেশ যে বন্ধুহীন নয়, এটা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে একাধিকবার পরিলক্ষিত হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশসূমহের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্ব বিশেষ করে গণচীনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের যে পদক্ষেপসহ ‘৭৬ সালে নেয়া হয়েছে ‘৭৭-এ সেটা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশ সম্প্রসারণবাদ ও আধিপত্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে জয়যুক্ত হবে এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যা অর্থনৈতিক অগ্রগতির ক্ষেত্রেও প্রভূত সাফল্য এনে দিতে পারে।
পঞ্চম জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন
যে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সূত্রপাত, তাতে সঙ্গত কারণেই ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী, অবনতি ঘটে এশীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির। জাপানী অবরোধের মুখে জাতীয়তাবাদের বিকাশ ঘটে এশীয় দেশগুলোতে। কিন্তু জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ধসে পড়ে যুদ্ধপূর্ব উপনিবেশিকতার কাঠামো। মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে এক বিপুল সাম্রাজ্যের অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় বৃটেন, অবশেষে থাকে রাজকীয় শুভেচ্ছার। যুদ্ধের অংশীদারিত্ব থেকে বঞ্চিত ফ্রান্সও বিতাড়িত হয় উপনিবেশগুলো থেকে। ১৯৪৫-এর সানফ্রান্সিসকো সম্মেলন থেকে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোর কাছে ‘পশ্চিমী আদর্শের’ সম্মান লাভ করে, তাকেও মোকাবেলা করতে হয় নতুন সমস্যার সঙ্গে। এশিয়ায় একচ্ছত্র বৃটিশ বাণিজ্যের বিরোধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এমন এক এশীয় পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, যেখানে বাণিজ্য করার মতো কোন কাঠামো ছিল না। সঙ্গত কারণেই উপনিবেশিক শক্তির সমর্থনে এগিয়ে আসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যে সমর্থন ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো আশা করেনি। শুধু সমর্থনই নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করল, ঔপনিবেশিক কাঠামো তার টিকিয়ে রাখা উচিত। এ কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সামন্ততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং এমনকি সামরিক সমর্থনের যোগান দেয়। এসবের কোন কিছুই এশীয় দেশগুলোতে জাতীয়তাবাদের বিকাশ কিংবা সরকারের কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনকে ঠেকাতে পারেনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চোখে এসব ছিল ‘কমিউনিস্টদের প্রভাব’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে এশিয়ায় পরাজয় মেনে নিতে হয় পশ্চিম দুনিয়াকে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন উল্লেখিত কারণে এশিয়ায় পশ্চিমের পরাজয়। কেননা যে জনগণ একসময় ছিল পশ্চিম গোলার্ধের শাসনাধীন, তারা তখন সে নিয়ন্ত্রণ বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এশীয় দেশগুলোর নিরপেক্ষতা, সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহের সঙ্গে বন্ধুত্ব, ‘এশীয় সমাজতন্ত্র’—সবকিছু মিলিয়ে এমন এক অবস্থার সূত্ৰপাত ঘটে যার ফলে শুরু হয় পশ্চিমের বিরুদ্ধে এশিয়ার প্রতিশোধ গ্রহণের পালা। পশ্চিমের নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রাখার জন্য শুরু হয় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পি-এল-৪৮০ কর্মসূচী এবং বিভিন্ন সামরিক জোট সেই প্রচেষ্টার বহিঃপ্রকাশ।
জাপান দখলের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আশা করেছিল, পূর্বের মতই সে এশিয়ায় বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারবে। আর সমাজতান্ত্রিক শিবির ভেবেছিল, এশীয় দেশগুলো হবে সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মিত্র। কিন্তু বাস্তবে এর কোনটাই হয়নি।
ঔপনিবেশিক শোষণ ও নির্যাতনের বিরদ্ধে এশীয় জাতীয়তাবাদ সোচ্চার হলেও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা করেছিল পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে। স্বাধীনতার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাই সিনেটর থাকাকালীন সময়ে প্রেসিডেন্ট কেনেডী মন্তব্য করেছিলেন, “স্বাধীন ও মুক্ত হবার আকাঙ্খার সঙ্গে সোভিয়েটের সঙ্গে বন্ধুত্বপর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার কোন যোগসূত্র নেই।”
জোটনিরেপক্ষ আন্দোলন সম্পর্কে প্রাথমিক পর্যায়ে শুধু পশ্চিম জগতেই নয়, পূর্ব গোলার্ধেও ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ ছিল। ১৯৬২ সালে এক ভাষণে অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন— “এ বিশ্বাস করতে আমার কষ্ট হচ্ছে যে, বর্তমান সময়ে এমন কেউ আছেন, যিনি আমাদের সভ্যতাগ্রাসী রাজনৈতিক সঙ্কটে নিরপেক্ষ ভূমিকা গ্রহণ করতে পারেন।”
জোটনিরপেক্ষতা সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝির মূল কারণ পূর্বপশ্চিমের সংঘাত সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলো এই সংঘাতকে ভালো-মন্দের সংঘাত বলে মনে করেনি, তাদের দাবী ছিল শান্তি সম্পর্কে সিদ্ধান্তের মালিক শুধু বৃহৎ শক্তিগুলো নয়। তাদের বক্তব্য, শান্তি তখনই সম্ভব, যখন এই শক্তিগুলো যুদ্ধের সিদ্ধান্ত ত্যাগ করবে। আর পশ্চিমা মহলের দাবী ছিল জোটনিরপেক্ষতা শুধু এক পক্ষকেই সাহায্য করে। এবং জোটনিরপেক্ষতার সুযোগে ‘আগ্রাসী তৎপরতা চালাবে কমিউনিস্ট মতাদর্শ, যার চরিত্র এমনিতেই আগ্রাসী।
১৯৬১ সালে বেলগ্রেডে অনুষ্ঠিত প্রথম জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক রুপ নেয় জোটনিরপেক্ষতার আন্দোলন। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রগুলোর সদস্যপদের ভিত্তি ছিল : “তারা কমিউনিস্ট অথবা পশ্চিমা সামরিক জোটের সদস্য নয়, তারা কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ নয়, তাঁদের মাটিতে কোন বিদেশী ঘাঁটি নেই, তারা নিজের মাটিতে বিদেশী ঘাঁটি প্রতিষ্ঠার বিরোধী, তারা মুক্তি ও স্বাধীনতার আন্দোলনের সমর্থ এবং তারা পররাষ্ট্রনীতিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে বিশ্বাসী।”
তবে সদস্যপদ দানের ব্যাপারে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর আভ্যন্তরীণ রাজনীতি সম্পর্কে কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক, কমিউনিস্ট কিংবা ডিক্টেটর শাসনাধীন যে কোন দেশ আন্দোলনের নীতিমালা মেনে নিয়ে সদস্য হতে পারে। জোটনিরপেক্ষ দেশগুলোর প্রথম সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রের সংখ্যা ছিল ২৪।
এই সম্মেলন থেকে একটি ঐক্যবদ্ধ ঘোষণা তৈরী হয়। তার বিষয়বস্তু ছিলঃ এসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানরা পুরনো ব্যবস্থা থেকে নতুন ব্যবস্থায় উত্তরজনিত সংঘাতের সঙ্কটকে বিবেচনা করবে? সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সংঘাত অবশ্যম্ভাবী একথা স্বীকার করবে ; শান্তি সে বিশ্বেই সম্ভব যেখানে উপনিবেশবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও নয়া উপনিবেশবাদ নেই—একথা স্বীকার করবে ; এরা এও স্বীকার করে যে, এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে। এছাড়াও এরা আরও ঘোষণা করেন যে, নিজেদের অবস্থা ও পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রতিটি রাষ্ট্রের নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করা উচিত। কোন দেশের উপর অন্য রাষ্ট্রের নীতি চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা বিশ্বশান্তিকে বিঘিত করার নামান্তর বলেই তারা মনে করেন।
বেলগ্রেড সম্মেলনে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো দ্বিমুখী সঙ্কট এড়াতে সক্ষম হয়। প্রথমত সম্মেলন গৃহীত নীতিমালা সম্পর্কে বাধ্যবাধকতা আরোপ না করা এবং ঐক্যমতে পৌছা যে জোটনিরপেক্ষতা শুধু বৃহৎ শক্তির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য নয়, অন্যান্য জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। দ্বিতীয়তঃ এমন কোন ঘোষণা গৃহীত হয়নি যার ফলে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলো এশিয়া ও আফ্রিকার জোটভুক্ত রাষ্ট্র গুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে পারে।
বেলগ্রেড সম্মেলনের পূর্ব পর্যন্ত, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন ছিল একটি উন্মুক্ত ক্লাব। ১৯৫৫ সালে বান্দুং-এ অনুষ্ঠিত সম্মেলনে এ আন্দোলন একটি কাঠামো লাভ করে। বেলগ্রেড সম্মেলনের পূর্ব পর্যন্ত এ আন্দোলনের অন্যতম ব্যক্তি নেহেরু ছিলেন, জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর কোন সম্মেলনের বিরোধী। তাঁর বক্তব্য ছিল—“এর ফলে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর কোন সম্মেলনের বিরোধী। তিনি এ সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও দৃষ্টিভঙ্গীর পক্ষপাতি ছিলেন। নেহেরুর উদ্যোগেই বেলগ্রেড সম্মেলনে মার্কিন জোটের অংশীদার বলিভিয়া, ইকুয়েডর, ব্রাজিল এবং মেক্সিকো প্রতিনিধি পাঠায়। কারণ এরা জোটের সদস্য হলেও জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা করার পক্ষপাতি।
জোটনিরপেক্ষতা নিরপেক্ষতা নয়। প্রথমে একে অনেকেই নিরপেক্ষতা বলে ভুল করেছিলেন। মূলতঃ নিরপেক্ষতা হচ্ছে, সংঘর্ষ থেকে কোন রাষ্ট্রের অনুপস্থিতি এবং পরোক্ষে যুদ্ধবাদীদের প্রতি সহানুভূতির মনোভাব। জোটনিরপেক্ষতা আবার কৌশলগত নিরপেক্ষতাও নয়। কারণ এমন ধরনের নিরপেক্ষতা তেমন সুবিধের নয়।
১৯৬১ সালের পর থেকে বিভিন্ন প্রতিকুলতা সত্তেও শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে, জোটনিরপেক্ষতার আন্দোলন। বিগত ১৫ বছরে এই আন্দোলনের সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি এই আন্দোলনের বিস্তৃতিকে সাহায্য করেছে। ১৯৬৪ সালে কায়রো, ১৯৭০-এ লুসাকা এবং ১৯৭৩-এ আলজিয়ার্সের সম্মেলনে ক্রমান্বয়ে সদস্যসংখ্যা বেড়েছে। বেলগ্রেডে যেখানে সদস্যসংখ্যা ছিল মাত্র ২৪, সেখানে কায়রোয় ৪৬, লুসাকায় ৬২ এবং আলজিয়ার্সে ৭৬ জাতি সমাবেশ ঘটে।
১৯৫৫ সালে অনুষ্ঠিত আফ্রো-এশীয় জাতিসমূহের বান্দুং সম্মেলনে ভিত্তি রচিত হয়েছিল জোটনিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির। সে সম্মেলনের পঞ্চশীলা নীতিই পরবর্তীকালে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর পররাষ্ট্র নীতিকে নির্ধারণ করে। জাতিসংঘের চত্বরে জোটনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর ভূমিকা তাই আলোচনার দাবী রাখে।
জাতীয় স্বার্থ থেকেই শক্তি সঞ্চয় করেছে জোটনিরপেক্ষতার নীতিমালা। এবং এই নীতিমালা থেকেই বিচার্য জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন।
কলম্বাে সম্মেলন
৮৫টি রাষ্ট্রের সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানের উপস্থিতিতে শ্রীলংকার রাজধানী কলম্বােয় অনুষ্ঠিত হয়েছে এবারের জোটনিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলন। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্যরাষ্ট্র চীনের সাহায্যে নির্মিত ‘বন্দরনায়েক স্মৃতি হল’ শ্রীলংকার মহিলা প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করেন শীর্ষ সম্মেলনের।
এবারে সম্মেলনে একমাত্র ভারত বাদ দিয়ে যোগদানকারী প্রতিটি রাষ্ট্রই ছিল বৈদেশিক আগ্রাসন এবং আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার। অপরদিকে তৃতীয় বিশ্বের মধ্যে বেড়েছে সহযোগিতার মনোভাব।
আলজিয়ার্সের সম্মলনে নতুন ধরনের আধিপত্যের বিরুদ্ধে বক্তব্য উত্থাপিত হলেও, এবার মত শক্তি সঞ্চয় করেনি। এবারের সম্মেলনের প্রতিনিধিরা ছিলেন পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ জনগণের প্রতিনিধি এবং পৃথিবীর অর্ধেক সম্পদের মালিক। তাই জাতিসংঘের মহাসচিব কুট ওয়াল্ডহেইম, এসেছিলেন সম্মেলনকে শুভেচ্ছা জানাতে।
কলম্বাে সম্মেলনের উদ্বোধনী দিন থেকেই অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ সোচ্চার দাবী উত্থাপন করেছে আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে। উদ্বোধনী ভাষণে মিসেস বন্দরনায়েক বলেছেন-“কোন রাষ্ট্রকর্তৃক পর রাষ্ট্রের সৌভাগ্যের উপর খবরদারী বা নিয়ন্ত্রণের যে কোন রকম ধারণাই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গণতন্ত্রায়ণের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন। জোটনিরপেক্ষ দেশসমূহ সর্বত্র এই গণতান্ত্রায়ণের জন্য সংগ্রাম করে এসেছে।” তিনি আরো বলেন, সাম্রাজ্রবাদ ও উপনিবেশবাদ পিছু হটতে থাকা সত্ত্বেও নতুন চেহারা নিয়ে দেখা দিচ্ছে যা আরও মারাত্মক। এই ধরনের হুশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের একমাত্র জীবিত প্রতিষ্ঠাতা সদস্য যুগোস্লাভিয়ার ৮৪ বছর বয়স্ক প্রেসিডেন্ট টিটো।
এবারের সম্মেলনের আরো উল্লেখযোগ্য দিক হলো, জোটনিরপেক্ষ অর্থনীতি গড়ে তোলার উদ্যোগ। এ সমস্যা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে নাইরোবীতে অনুষ্ঠিত (অস্পষ্ট) সম্মেলনে। এর আগে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত ৭৭ জাতি সম্মেলনে (অস্পষ্ট) প্রস্তাব নেয়া হয়েছিল তাই পেশ করা হয় নাইরোবীর সম্মেলনে কিন্তু মতপার্থক্যের দরুণ যখন সম্মেলন পণ্ড হবার যোগাড় তখন জোড়াতালি দিয়েই সম্মেলনের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়। এই প্রেক্ষাপটেই জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনকে নেয়া হয় তৃতীয় বিশ্বের জন্য ব্যাংক ও মুদ্রা চালুর প্রস্তাব। কিন্তু আলোচনার পরে এ ব্যাপারে কোন ঘোষণা দেয়া হয়নি।
বাংলাদেশের ভূমিকা
১৯৭১ সালে পৃথীবির মানচিত্রে যে নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে সেই বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে প্রথম জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগ দেয়। কিন্তু সেবারের চেয়ে ১৯৭৬ সালে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সাড়া তুলতে সক্ষম হয়। সম্মেলনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতা ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সায়েম। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করণের প্রশ্নে সম্মেলনে দেয়া জেনারেল জিয়ার ভাষণকে বিদেশী সংবাদদাতারা তুলনা করেছেন ‘স্নাইপার এ্যাটাক’ বলে। তিনি তাঁর ভাষণে যেসব ক্ষুদ্র দেশ আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে বড় দেশের শিকারে পরিণত হয়েছে, তাদের রক্ষা করার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, জোটনিরপেক্ষতা আন্দোলনের শক্তি হলো তার নমনীয়তা এবং যখন কতিপয় বৃহৎ রাষ্ট্র ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রকে তার পদানত রাখতে চেষ্টা করছে, যখন একটি রাষ্ট্র অন্যান্য রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার হস্তক্ষেপের চেষ্টা করছে, যখন কতিপয় রাষ্ট্র ক্ষুদ্রতর রাষ্ট্রের ওপর তার প্রাধান্য বিস্তারের চেষ্টা করছে, তখন বর্তমানের জটিল সমস্যার আলোকে তাদের আন্দোলনকে অবলোকন করতে হবে। তিনি আরো বলেন, এ অবস্থায় যখন তাদের মূললক্ষ্যই হলো এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা, তখন তার বিভিন্ন রাষ্ট্র, পর্যবেক্ষক ও অতিথিদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে কোন অনমনীয়তা রাখতে পারে না।
সত্যের স্বীকৃতি হিসেবেই জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের রাজনৈতিক ঘোষণায় সংশোধনী এনে বাংলাদেশ প্রকত স্বাধীনতার পক্ষে অঙ্গীকার এবং যে কোন সূত্রের চাপ ও হুমকির বিরোধিতা দাবী করে। একমাত্র ভারত বাদ দিয়ে, বাংলাদেশের এই দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে সব ক’টি দেশ।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে উত্থাপিত সংশোধনীতে বলা হয় হস্তক্ষেপ বিভিন্ন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক রুপ নিতে পারে। প্রচার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত আক্রমণ, সীমান্তে উস্কানি, অস্ত্র সরবরাহ, আঞ্চলিক বিরোধ সৃষ্টি এবং আভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সৃষ্টিসহ সরকার অস্থিতিশীল করার গোপন প্রচেষ্টাই সবচাইতে বিপজ্জনক। যেসব জোটনিরপেক্ষ দেশ এ ধরনের চাপের শিকার হয়েছে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ তার খসড়া প্রস্তাবে সম্মেলনের প্রতি আহ্বান জানায়।
অপরদিকে শীর্ষ সম্মেলনে ভাষণ দানকালে প্রেসিডেন্ট সায়েম প্রতিষ্ঠিত সরকারের স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করা, অন্তর্ঘাতী প্রচেষ্টা চালানো, আভ্যন্তরীণ অসন্তোষ সৃষ্টি ও সীমান্ত লংঘনের মাধ্যমে নিরাপত্তার অভাববোধ সৃষ্টি করে নতুন ধরনের উপনিবেশবাদ ও আধিপত্য বিস্তারের অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন—“জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। তিনি আরো বলেন, বহু শতাব্দী ধরে আমরা শোষণে যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েছি। আমরা আমাদের প্রকৃত স্বাধীনতা রক্ষায় সংগ্রাম চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর।
শুধু বাংলাদেশই নয়, এবারকার জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিন্দা ও আশঙ্কা ধ্বনিত হয়েছে বড় দেশের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে। বাইরের চাপ, হুমকি ও হস্তক্ষেপ যে ক্ষুদ্র দেশগুলোর স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে প্রধান বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে সেকথা স্পষ্টভাবেই উচ্চারিত হয়েছে জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনের মঞ্চে ও অঙ্গনে। নেপালের রাজা বীরেন্দ্র বিক্রম ও আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ছোট দেশগুলোর সার্বভৌম অধিকারের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন।
সম্মেলনের ঘোষণা
কলম্বো সম্মেলনের ঘোষণায়, একে অপরের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে একই সাধারণ লক্ষ্যের বাস্তবায়নের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাবার পুনঃসংকল্পের কথা বলা হয়েছে। সদস্যরাষ্ট্রসমূহের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করা সম্পর্কে ভারত।

[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1977.01.01-zia-rules.pdf” title=”1977.01.01 zia rules”]