You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.06 | সোভিয়েত প্রতিনিধি জনাব জ্যাকব মালিকের বিবৃতি | জাতিসংঘ ডকুমেন্টস - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
সোভিয়েত প্রতিনিধি জনাব জ্যাকব মালিকের বিবৃতি জাতিসংঘ ডকুমেন্টস ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

নিরাপত্তা পরিষদের সামনে রয়েছে পাঁচ জাতি কর্তৃক উত্থাপিত একটি খসড়া প্রস্তাব, যা এস/১০৪২৫ দলিলে বর্ণীত। সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের এই খসড়া প্রস্তাব উত্থাপনকারীদের সদিচ্ছা, আন্তরিকতা এবং উত্থাপিত সমস্যা সমাধানের তাদের ইচ্ছার ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু, এই খসড়া প্রস্তাবে, আরও নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত আরও অনেক খসড়া প্রস্তাবের মতই, একটি উল্লেখযোগ্য ত্রুটি আছে। সেটি হল, পূর্ব পাকিস্তানে যে বিশাল সংকটের উদ্ভব হয়েছে এবং সেটির আন্তর্জাতিক ফলশ্রুতিতে হিন্দুস্তান উপদ্বীপে যে জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার শুধুমাত্র একটি দিকই বিবেচনা করা, যেটি হল পাকিস্তান কর্তৃক প্রতিবেশী ভারতের উপর চালানো সামরিক আগ্রাসন বন্ধ করা।

দুইদিন ব্যাপী নিবিড় এবং বিশদ আলোচনার পরে, সাথে নিরাপত্তা পরিষদে উত্থাপিত দলিলের ভিত্তিতে থাকা তথ্যাদি এবং প্রমাণের পর কারো মনে এই ব্যাপারে সন্দেহ থাকা উচিত নয় যে, হিন্দুস্তান উপদ্বীপের সামরিক সংঘাতের মূল কারণ হল পাকিস্তান সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আইনগত অধিকার এবং দাবিকে দমনের চেষ্টা করা।

এই অঞ্চলের সামরিক সংঘাত হচ্ছে গত কয়েক মাস ধরে চলা উৎপীড়ন, নিপীড়ন এবং সহিংসতা, যেটাতে আধুনিক সমরাস্ত্র ব্যবহার করে সাড়ে সাত কোটি পূর্ব পাকিস্তানীর ইচ্ছাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা চালানো হচ্ছে, সেটির ফলাফল। পূর্ব পাকিস্তানী জনগণ এর ফলশ্রুতিতে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিক উপায়ে সমাধানে ব্যর্থ হয়ে, এবং সহিংসতার মাধ্যমে সেই রাজনৈতিক আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয়ে, পাকিস্তান সরকার প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেছে, যেটা সামরিক সংঘাতের জন্ম দিয়েছে এবং পরিস্থিতিকে আর খারাপ করে তুলেছে।

এই কাজের উদ্দেশ্য সকলের কাছেই পরিষ্কার। এর মধ্যে রয়েছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাজকর্মের দায়ভার প্রতিবেশী দেশের উপর চাপানো, এবং যে বিশাল পরিসরে সন্ত্রাস এবং নিপীড়ন চালানো হয়েছে সেটিকে ন্যায্যতা দেওয়ার চেষ্টা করা। সেসব নিপীড়নের ব্যাপ্তি এতই বেশি যে তা ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ শান্তিপ্রিয় মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছে এবং এক কোটি মানুষকে পাশের দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে।

আজকে নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্ট বৈঠকের শুরুতে তার উদ্বোধনী ভাষণেও সবাইকে পরিষ্কারভাবে মনে করিয়ে দিয়েছেন সেই লক্ষ লক্ষ মানুষের দুর্ভোগের কথা। এই ঘটনাটি আমলে না নিলে এই সমস্যার সঠিক সমাধান বের করা অসম্ভব, তেমনি অসম্ভব কোন উপায়ে সেটির সমাধান করা সম্ভব তা বের করা।

এই বাস্তবতার প্রেক্ষিতে, পাঁচ জাতির খসড়া প্রস্তাবে যে নীতিমালার প্রস্তাব করা হয়েছে সেটি অপর্যাপ্ত। এটি একপাক্ষিক এবং তা এই অঞ্চলে শান্তি এবং স্থিরতা বয়ে আনতে পারেনা। প্রধাণত যেই কারণে ভারতীয় উপমহাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে, যেটি বর্তমানে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সামরিক সংঘাত সৃষ্টি করেছে, সেটাকে যদি শক্তভাবে দ্রুততার সাথে কার্যকরভাবে নিরসণ করা না যায়, নিরাপতা পরিষদ সঠিক এবং কার্যকর সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারবে না।
সেজন্য, এটা আবশ্যিক যে যুদ্ধ-বিরতির প্রস্তাবের সাথে এটি সংযুক্ত করা হোক যে পাকিস্তান সরকারকে এটা বলা যে, অনতিবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ১৯৭০ এর ডিসেম্বরের নির্বাচনে তাদের যে ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছে তাকে স্বীকৃতি দিয়ে রাজনৈতিক মীমাংসার উদ্যোগ নিতে হবে।
নিরাপত্তা পরিষদ ঐ অঞ্চলে যে রাজনৈতিক বাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে তার প্রতি অন্ধ হয়ে থাকতে পারেনা, পারেনা শুধুমাত্র সংঘাতের একটিমাত্র দিকের সমাধানের চেষ্টা করতে এর উদ্ভব হওয়ার প্রধান কারণকে পাশ কাটিয়ে, যেটি এই গুরুতর সমস্যার প্রাথমিক উৎস। এটি বর্তমানে হিন্দুস্তান উপদ্বীপে সশস্ত্র সংঘাতে রূপ নিয়েছে এবং একটি আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। যদি নিরাপত্তা পরিষদ এই বাস্তবতার প্রতি চোখ বন্ধ করে একটি একপাক্ষিক পথ নেয়, সেটি শুধুমাত্র একটি বাহ্যিক সমাধান হবে কিন্তু কোন আসল সমাধান হবেনা।
নিরাপত্তা পরিষদ এই রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে রাজনৈতিক বাস্তবতা আমলে না নিয়ে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা। এটা জাতিসংঘ সনদে এবং গতকাল সোভিয়েত প্রতিনিধিদলের বক্তব্য উল্লেখিত অনুচ্ছেদগুলোয় স্পষ্টভাবে বলা রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে, একমাত্র সঠিক পন্থা যেটা নিরাপত্তা পরিষদ নিতে পারে সেটি হল এমন একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ যেটিতে দুটি প্রশ্নই, যুদ্ধবিরতির প্রশ্ন এবং পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছাকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন একসাথে রয়েছে। অন্যকথায়, যুদ্ধবিরতির প্রশ্ন এবং রাজনৈতিক মীমাংসার প্রশ্ন অবিচ্ছেদ্যভাবে স্থাপন করতে হবে।

এটাই হচ্ছে সেই কারণ যার জন্য সোভিয়েত প্রতিনিধিদল এই প্রশ্নের উপর পুরো আলোচনাব্যাপী লড়াই করেছে, করছে এবং করবে। আমরা স্বীকার করি এই প্রস্তাবিত উপায় কিছু বিশেষ মহলের পছন্দ নাও হতে পারে, কিন্তু সেটি তাদের ব্যাপার। আমরা এই ব্যপারে নিশ্চিত আমাদের প্রস্তাবিত উপায়টি সঠিক,ন্যায্য এবং ভারতীয় উপমহাদেশের আসল অবস্থার উপর ভিত্তি করে তৈরি। পূর্বপাকিস্তানের জনগণ যদি চায় তাদের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা পাকিস্তান সরকার এবং এর সাথে তাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা পুনরায় শুরু করবে কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা যেটি তুলে ধরেছি, পাঁচ জাতি প্রস্তাবিত খসড়ার ত্রুটি হল সুনির্দিষ্টভাবে যুদ্ধবিরতির প্রশ্নের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মীমাংসা অর্জনের প্রশ্নের সম্পর্ক না থাকা। আমাদের অবশ্যই মানুষের ইচ্ছার অবিচ্ছেদ্য অধিকারকে আমলে নিতে হবে।

আমাদের অবশ্যই দেশটির ঐঅংশের জনগণের ইচ্ছার অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং আইনগত স্বার্থসমূহ আমলে নিতে হবে। সোভিয়েত প্রতিনিধিগণ এমন কোনো প্রস্তাবনার সাথে একমত হতে পারে না যেখানে এসবের প্রতিফলন ঘটে না। প্রতিনিধিগণ অবিলম্বে যুদ্ধবিরোতির পক্ষে, একইসাথে তারা পূর্বপাকিস্তানের জনগণের ওপর পাকিস্তান সরকারের সশস্ত্র শক্তির হত্যাকান্ড এবং নিপীড়ন চলতে থাকার সম্ভাবনা উপেক্ষা করে চোখ বন্ধ করে আছে। অন্য কথায় তারা রাজনৈতিক মীমাংসার বিষয়টি তুলে ধরছে না।
অন্যান্য শান্তিপ্রিয় দেশগুলোর মতো সোভিয়েত ইউনিয়ও হিন্দুস্তান উপদ্বীপে সৃষ্টি হওয়া এই সমস্যাটির প্রতি উদাসীন থাকে নি
যেমনটা এবছর ৫ ডিসেম্বর তাদের বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে :
‘সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্বপাকিস্তানের জনগণের আইনগত অধিকার এবং স্বার্থের প্রতি পূর্ণ সম্মান রেখে চলমান রক্তপাতের দ্রুত সমাপ্তি ও রাজনৈতিক মীমাংসার দাবী জানাচ্ছে ’
সমস্যাটির বাস্তব প্রকৃতি এবং আলোচ্য সমস্যার পূর্ণ পরিসর,প্রথম এবং শীর্ষস্থানীয় প্রধান দুইটি বিষয় : রাজনৈতিক মীমাংসা এবং যুদ্ধাবসান আমলে রেখে এটি যথাযথ এবং একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রস্তাবনা যার আলোকে সোভিয়েত প্রতিনিধিগণ নিরাপত্তাপরিষদের জন্য দ্রুতগতিতে কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহণ প্রয়োজনীয় মনে করে
পরিষদ হবে বাস্তবসম্মত। পরিষদে অবশ্যই এর গৃহীত সিদ্ধান্তে এই দুটি প্রশ্নের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা আমলে রাখতে হবে যা মূলত সমস্যা তৈরি করছে। আমি আবারও বলছি পূর্বপাকিস্তানে রাজনৈতিক মীমাংসা এবং যুদ্ধবিরতির প্রশ্ন দুইটির সাংগঠনিক সম্পর্ক।
আমরা পাকিস্তান সরকারের কাছে রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহণ এবং অবিলম্বে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের দাবীকে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানাই।
এই প্রস্তাবনার আলোকে এবং পূর্বপাকিস্তান ও হিন্দুস্তান উপমহাদেশের বাস্তবিক পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে সোভিয়েত প্রতিনিধিদল পাঁচ জাতি কর্তৃক উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবের সংশোধনী পেশ করে-
প্রথম সংশোধনী-
‘বলবৎ অনুচ্ছেদ ১, ‘ সরকারের সংশ্লিষ্টতা’ এর পপরিবর্তে ‘সকল পক্ষের সংশ্লিষ্টতা’ হবে; একই অনুচ্ছেদের শেষে ‘এবং সকল সামরিক অভিজানের অবশান ’ সংযুক্ত হবে।
দ্বিতীয় সংশোধনী :
‘‘বলবৎ অনুচ্ছেদ ১ এবং২ এর মধ্যে নিম্নবর্ণিত অনুচ্ছেদ গুলো, ২ এবং ৩ হিসাবে বলবৎ করে সন্নিবেশিত হবে’’
২. পাকিস্তান সরকারকে একযোগে পূর্বপাকিস্তানের জনগণের ডিসেম্বর,১৯৭০ সালের নির্বাচনে ব্যাক্ত করা দাবীসমূহ অবিলম্বে স্বীকৃতি দিয়ে পূর্বপাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক মীমাংসার জন্য কার্যকর ব্যাবস্থা গ্রহনে আহ্বান করা হবে;
৩. এই প্রস্তাবনার বলবৎ অনুচ্ছেদ ১ এবং ২ এর শর্তসমূহ একযোগে গঠনের ঘোষণা করা হবে ’’
পরবর্তী বলবৎ অণুচ্ছেদগুলোর আনুষঙ্গিক ভাবে পুনরায় ক্রম নির্ধারিত হবে।
এই সংশোধনী গুলো এখন সোভিয়েত প্রতিনিধিগণ পাঁচ জাতি কর্তৃক উত্থাপিত খশড়া প্রস্তাবে সন্নিবেশিত করেছে।
সংশোধনী সমেত গৃহীত হওয়া খসড়া প্রস্তাবটি হত্যাযজ্ঞের অবশান এবং পূর্বপাকিস্তানে উদ্ভূত জটিল রাজনৈতিক সমস্যার একটি রাজনৈতিক মীমাংসার ব্যাবস্থা গ্রহণে নিরাপত্তাপরিষদের নেয়া একটি বাস্তব এবং কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে।ইউ এস এস আর এর প্রতিনিধিগণ আমাদের আমাদের উত্থাপিত সংশোধনী সমেত খসড়া প্রস্তাবটির প্রতি তাদের সমর্থন জানায়। সংশোধনী গুলো ছাড়া প্রস্তাবনাটি এর উদ্দেশ্য অর্জন করতে ব্যার্থ হতো এবং ভারতীয় উপমহাদেশের দ্বন্দ্ব সমঝোতা করণে একটি কার্যকর হাতিয়ার হতে পারত না। সংশোধনী সমূহ গৃহীত না হলে ইউ এস এস আর প্রতিনিধিগণ পাঁচ জাতি কর্তৃক উত্থাপিত খসড়া প্রস্তাবনার সমর্থন করত না।