You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.18 | জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান প্রদত্ত বিবৃতি | জাতিসংঘ ডকুমেন্টস - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান প্রদত্ত বিবৃতি জাতিসংঘ ডকুমেন্টস ১৮ নভেম্বর , ১৯৭১

জাতিসংঘ সাধারন পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রিন্স সদরুদ্দীন আগা খান প্রদত্ত বিবৃতি
নভেম্বর ১৮, ১৯৭১
মাননীয়া চেয়ারম্যান, এর পূর্বেও এই কমিটির সামনে আমার বক্তব্য রাখার সুযোগ হয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে এপর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে দেয়া এটি আমার ষষ্ঠ রিপোর্ট। প্রতি বছর আমি অভিবাসী পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা উল্লেখ করেছি, এবং এই সংকট উত্তরণের ক্ষেত্রে আমাদের নেয়া পদক্ষেপগুলোর দিকে আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। বিগত বছরগুলোতে যখনই কোথাও পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে, অথবা কোথাও নতুন কোনো সংকটের সৃষ্টি হয়েছে, তখনই আন্তর্জাতিক মহল আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এবং সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। আপনাদের এহেন সহায়তা পেয়ে আমি অত্যন্ত অভিভূত এবং কৃতজ্ঞ। সংকটের মুহূর্তগুলোতে আপনারা পাশে দাঁড়ান বলেই আমাদের পক্ষে তা মোকাবেলা করা সহজ হয়, বিশেষ করে যখন কোনো সমস্যার একটি স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানোর প্রয়োজন হয়, যা এই পদে থাকাকালীন আমার মূল লক্ষ্য ছিলো। দুঃখজনক ভাবে আজও আমি এক সুগভীর সংকটের দিকে আপনাদের জরুরী মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই। এটি এমন এক সংকট যা বাড়তে বাড়তে এরই মধ্যে সহ্যের সকল সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে, এবং এর বুদ্ধিবৃত্তিক সমাধান ক্রমশ দূরহ হয়ে পড়ছে। পরিহাসের ব্যাপার হলো, এই ঘটনাটা ঘটছে এমন একটি সময়ে যখন আমরা ইউএনএইচসিআর এর বিশতম বার্ষিকী উদযাপন করতে যাচ্ছি। ঠিক যখন শরণার্থী সমস্যা থেকে আমাদের স্থায়ী সমাধানে পৌঁছানোর কথা ছিলো। চার মাস আগে, ১৬ই জুলাই তারিখে আমি জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের হিউম্যানিটারিয়ান এফোর্টকে জানিয়েছি ভারতে আশ্রয় নেয়া পূর্ব পাকিস্তানী শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ লাঘবের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে। এছাড়া গত অক্টোবর মাসের শুরুতে সেসময়ে চালু থাকা আমাদের রেগুলার প্রোগ্রামের নির্বাহী কমিটির সাথেও আমি কথা বলেছি। কিন্তু এটি এমন এক বেদনাদায়ক পরিস্থিতি যা প্রতিনিয়ত খারাপের দিকে যাচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগ কমছে তো না, বরং বাড়ছে। চাহিদা এবং সামর্থ্যের ভেতর যে বিশাল ফারাক তৈরি হয়েছে, পরিস্থিতি ক্রমশ যেভাবে আমাদের প্রতিকূলে চলে যাচ্ছে, তাতে মনে হয় আমরা এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে চলেছি। সমস্যা সমাধানে ভারতের সরকার ও জনগণের আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং আন্তর্জাতিক মহলের সহানুভূতি সত্ত্বেও যে প্রশ্নটা এখন সকলের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, তা হলো, এই সংকটের শেষ কোথায়?
আপনাদের কাছে যদি মনে হয় বক্তৃতার শুরুতেই কেন আমি আশংকার বাণী শোনাচ্ছি, আসলে পরিস্থিতিই আমাকে বাধ্য করেছে এই বিষয়টি আপনাদের সামনে উত্থাপন করতে। অন্তত আজ আমি রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক বা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে কার দ্বারা অথবা কিভাবে এই সংকটের উদ্ভব হলো তার বিচার করতে আসিনি। মাননীয় মহাসচিবের নেতৃত্বে জাতিসংঘের নিজস্ব পর্যালোচনা, যা রিপোর্টের সূচনাতে যুক্ত করা আছে, তাতে খুব স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে এই ব্যাপারে (নথি এ/৮৪০১/এডিডি। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ সালের ১নং)। আমি এখানে যা বলতে এসেছি তা সম্পূর্ণভাবেই একটি হিউম্যানিটারিয়ান টাস্ক, জাতিসংঘের প্রতিনিধি হিসেবে যে দায়িত্ব পালনে আমি দায়বদ্ধ। এবং এই কাজে আমি এখন এমনভাবে আপনাদের অকুণ্ঠ সহায়তা চাই, যেভাবে পূর্বে কখনো হয়তো চাইনি। কারণ এর সাথে লাখো নিরীহ শরণার্থীর ভাগ্য জড়িয়ে আছে, একটি গোটা উপমহাদেশের শান্তি পুনরুদ্ধারের প্রশ্ন এর সাথে জড়িয়ে আছে। এই শরণার্থীদের থেকে আমরা আর মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারি না। আমাদের কাছ থেকে, জাতিসংঘের কাছ থেকে তাদের অনেক প্রত্যাশা। এপ্রিলের ২৩ তারিখে ভারতের সরকার জাতিসংঘের মাননীয় মহাসচিবের কাছে যখন সাহায্যের আবেদন জানালেন, শরণার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য যেন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয় এবং ভারত সরকারের উপর থেকে বোঝা কিছুটা কমানোর ব্যবস্থা করা হয়,তখনই স্পষ্ট হয়ে গেছে, গুরুত্ব বিবেচনায় এই সংকটটি জাতিসংঘের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবী রাখে। আর এই সংকটের ব্যাপ্তি এতোটাই বিশাল আর ঘটনাপ্রবাহ এত দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে যে ইউএনএইচসিআর এর একার পক্ষে খাদ্য, বাসস্থান বা লজিস্টিক সাপোর্ট প্রদান করাটা অর্থনৈতিক বা টেকনিকাল উভয় ক্ষেত্রেই সাধ্যের বাইরে চলে গেছে। অতএব, ২৯শে এপ্রিল তারিখে, সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা প্রশাসনিক কমিটির মিটিং এ আলোচনার ফলশ্রুতিতে, মাননীয় মহাসচিব সিদ্ধান্ত নেন যে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সহায়তার বিষয়টি সমন্বয়ের কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করবেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাই কমিশনার। জাতিসংঘে ভারত সরকারের বক্তব্যের যে সহায়তার অনুরোধ জানানো হয়েছিলো, এই সিদ্ধান্তটি তার সাথেও মিলে গেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তাৎক্ষনিক ভাবে আমি ডেপুটি হাই কমিশনারের নেতৃত্বে একটি দলকে ভারতে পাঠিয়েছিলাম সেখানকার বাস্তব চিত্র পর্যবেক্ষণের জন্য। এই দলটির পর্যবেক্ষণের উপর প্রস্তুত করা একটি সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট ইতোমধ্যেই দুদেশের সরকারের কাছে পাঠানো হয়েছে। ভারত এবং পাকিস্তান উভয় দেশের সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি বিচার করে তৈরি একটি পর্যালোচনায় খুব স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে এই ব্যাপারে জাতিসংঘকে দুইটি উদ্দেশ্য সাধনে মনোনিবেশ করতে হবে। প্রথমত, ভারতে আশ্রয় নেয়া শরণার্থীদের জন্য দ্রুত ত্রাণ সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শরণার্থীদেরকে পুনরায় নিজ ভূখণ্ডে ফিরে যাওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে, স্থায়ী সমাধানের স্বার্থে তাদেরকে স্ব-ইচ্ছাতে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে প্রাথমিকভাবে ঐকমতে এসেছি আমরা। ইতোমধ্যে, ১৯৭১ সালের ১৯শে মে তারিখে শরণার্থীদের সংখ্যার ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতিতে মাননীয় মহাসচিব আশা প্রকাশ করেন, “যত দ্রুত সম্ভব তাদের স্বেচ্ছায় নিজ দেশে ফেরত পাঠানো” সম্ভব হবে, এবং “ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া যেহেতু আপাতত ঝুলে আছে, সেক্ষেত্রে ত্রাণ সহ জরুরী সহায়তা প্রয়োজন” এবং তিনি “সরকারী, আন্ত-সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সমূহ সহ অন্যান্য ব্যক্তিগত সোর্সের উদ্দেশ্যেও” আবেদন পেশ করেন, যেন এই জরুরী সহায়তা প্রদানে তারা হাত বাড়িয়ে দেন। সেই সময়ের হিসেব মতে, ধারণা করা হয়েছিলো তিরিশ লক্ষ শরণার্থীদের ছয় মাসের ন্যুন্যতম ভরণ পোষণের জন্য ভারত সরকারের প্রায় সাড়ে সতের কোটি ডলার প্রয়োজন। এরপর সময় অতিবাহিত হয়েছে, চাহিদা এবং সংখ্যা শুধু বেড়েই চলেছে এই সময়ে, আর আমাদের ক্ষুদ্র প্রয়াসকে দৌড়াতে হয়েছে সময়ের বিপরীতে। চলতি বছরের জুন মাসের ২৬ তারিখে ভারত সরকারের দেয়া তথ্য ও হিসাব মতে, ৬০ লক্ষ শরণার্থীর জন্য ছয় মাসের সহায়তা প্রদানে সম্ভাব্য ব্যয় ধরা হয়েছিলো ৪০ কোটি ডলার। পরবর্তীতে ১লা অক্টোবর তারিখে ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া আরো বৃহৎ কলেবরের রিপোর্টে আমরা দেখতে পাই খরচের সম্ভাব্য অংকটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ কোটি ৫৮ লক্ষ ডলারে এবং তা ৮০ লক্ষ শরণার্থীর ছয় মাসের ভরণপোষণের ব্যয়। খুব সম্প্রতি, বিশ্বব্যাংকের আয়োজনে ভারতের সরকার এবং ভারতের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখতে আগ্রহী প্রতিষ্ঠান সমূহের অংশগ্রহণে প্যারিসে এক বিশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৬শে অক্টোবর ১৯৭১ সালে অনুষ্ঠিত সেই সভার ঘোষণা অনুযায়ী, “সাম্প্রতিক সময়ে পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের ব্যাপক প্রবেশের ফলে ভারতকে যে ত্রাণ সহায়তা প্রদান করতে হচ্ছে তার মোট ব্যয় ১৯৭২ অর্থবছরের মার্চ নাগাদ প্রায় ৭০ কোটি ডলারে পৌঁছাবে।”
আমি এই পরিসংখ্যানটি বিশ্বব্যাংকের মূল ঘোষণাপত্র থেকে উল্লেখ করলাম। উল্লিখিত কনসোর্টিয়াম সভা অনুষ্ঠানের পূর্বে বিশ্বব্যাংক শরণার্থীদের উপর একটি রিপোর্ট প্রস্তুত করেছিলো, যাতে ১৯৭১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর নাগাদ ক্যাম্পে শরণার্থীর সংখ্যা ৯০ লক্ষ ধরা হয়েছে। এখানে প্রকৃত ব্যয় নিঃসন্দেহে উল্লিখিত তারিখে ক্যাম্পে অবস্থান করা শরণার্থীদের প্রকৃত সংখ্যার সমানুপাতিক হবে। শরণার্থীদের ত্রাণ সহায়তার মূল ব্যয়ভার নিয়ন্ত্রণে সাধারণত তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেয়া হয়। প্রথমত, শরণার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা, দ্বিতীয়ত, কতদিন ধরে ত্রাণ সহায়তা দিতে হবে, এবং তৃতীয়ত, সহায়তার ধরণ। প্রথম এবং দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অর্থাৎ শরণার্থীদের সংখ্যা এবং সময় নির্ধারণে, ভারত সরকার শরণার্থীদের নিবন্ধন সম্পর্কিত বিগত সাত মাসের তথ্য আমাদেরকে প্রদান করেছে, এবং এই প্রক্রিয়া এখনো চলমান আছে। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ১২ই নভেম্বর পর্যন্ত শরণার্থীর সংখ্যা ৯৭,৪৪,৪০৪ জন। এছাড়া পাকিস্তানের সরকার জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানিয়েছেন ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান থেকে দেশ চ্যুত মানুষের সংখ্যা ২০,০২,৬২৩ জন। আমি এখন নিজ উদ্যোগে কোনো তথ্য সংগ্রহে নামতে চাচ্ছি না, কারণ উল্লিখিত সূত্রগুলোকে অনেক ক্ষেত্রেই তথ্যের ব্যাপারে অনুমানের আশ্রয় নিতে হয়েছে। আর সত্যি বলতে আমি এটা করতে চাই না, কারণ আমি আশাবাদী যে দেশত্যাগ করা মানুষগুলো শীঘ্রই আবার তাদের বাসগৃহে ফেরত যেতে পারবে। তথাপি, একটি কার্যকর হাইপোথিসিস ছাড়া আমাদের পক্ষে প্রস্তুতি গ্রহণ করাটা কষ্টকর, এবং আমি এই কমিটিকে আশ্বস্ত করতে চাই যে আমরা সম্ভাব্য ঘটনাবলী সম্পর্কে সচেতন। তৃতীয় ফ্যাক্টর, অর্থাৎ সহায়তার ধরণ সম্পর্কে যদি বলি, এর সাথে আমরা কমবেশি পরিচিত। এবং পূর্বে আমি যে প্রত্যাশিত ব্যয় এবং অন্যান্য হিসাব দিলাম তার মূল খাত এটি। আরেকটু পরিষ্কার করে বলি, এই নীতি অনুসারে আমাদের ব্যয়ের ধরন হচ্ছে দুই প্রকারের, প্রাত্যহিক ব্যয় (যেমন খাদ্য, ঔষধ, ত্রাণকর্মীদের বেতন, ইত্যাদি খাতে খরচ) এবং এককালীন ব্যয়, (যেমন শেল্টার নির্মাণ, চিকিৎসার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য সামগ্রী, যাতায়াত ইত্যাদি খাতে খরচ)। এ পর্যন্ত তৈরি করা সমস্ত খরচের হিসাবে এককালীন ব্যয়কে এককালীন হিসেবেই দেখানো হয়েছে। কিন্তু যদি এই সংকট দীর্ঘমেয়াদী হয় সেক্ষেত্রে এককালীন ব্যয়ের খাতগুলোতেও পুনরায় খরচ করতে হতে পারে, যেমন, বেশকিছু অংশে শেল্টার তৈরিতে পলিথিন ব্যাবহার করা হয়েছে। মানের দিক দিয়ে বিচার করলে তা অবশ্যই যথার্থ। এই সব ক্ষেত্রে ফোকাল পয়েন্ট এবং অন্যান্য জাতিসংঘের এজেন্সি সমূহের সহায়তা নেয়া হয়, যেভাবে পূর্বে উল্লেখ করেছি, রিলিফ কার্যক্রমের গড় ব্যয় আপাতত ধরা হয়েছে দৈনিক ২.৭৪ টাকা প্রতি ক্যাপিটা (মার্কিন ডলারের হিসাবে প্রায় ৩৭ সেন্ট)।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, এগুলোই রিলিফ প্রোগ্রামের প্রত্যক্ষ ব্যয়, যা আপাতত আমাদের ভাবনার মূল বিষয়। এছাড়া আরও কিছু অপ্রত্যক্ষ ব্যয় আছে, যা ভারতের অর্থনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব রাখতে সক্ষম। এই বিষয়গুলো সাম্প্রতিক ভারতের কনসোর্টিয়াম আয়োজিত সভায় আলোচিত হয়েছে, যেখানে আমার অফিসের প্রতিনিধিত্ব ছিলো। এবং আমি খুব পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এই অপ্রত্যক্ষ মূল্যের বিষয়টি, দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক প্রভাব এবং ব্যাপক পরিসরে শরণার্থীদের আগমনের মতো বিষয়গুলো ফোকাল পয়েন্ট খুব গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করছে। এখানে আমি শুধুমাত্র রিলিফ অপারেশনের প্রত্যক্ষ ব্যয়ের দিকেই বেশী জোর দিতে চাই। এবং এই খরচগুলো, তিনটি শ্রেণীর ভিত্তিতে হিসাব করা হয়েছে, যার কথা আমি আগে বলেছি, শরণার্থীদের সংখ্যা, কতদিন পর্যন্ত তাদের ত্রাণ সহায়তা প্রয়োজন এবং সেই সহায়তার ধরণ, এক্ষেত্রে যা বলছিলাম, প্রয়োজনীয় সামগ্রী প্রায়শই আমাদের পূর্ব-অনুমানের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে, প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে খাদ্য বস্ত্র দিয়ে সহায়তা করার এই বিশাল ত্রাণ কর্মযজ্ঞ এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রমের সকল নজিরকে ছাপিয়ে গেছে। আর আন্তর্জাতিক মহলের সহায়তার কথা যদি বলি, জাতিসংঘের অভিজ্ঞতা বিচারে এই দৃষ্টান্ত অনন্য এবং আপনাদের কাছে আমি আমার কৃতজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। ১৬ই নভেম্বর ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত ফোকাল পয়েন্ট সর্বমোট ১৬১৪১২৮৬.৮৪ ডলার সমমূল্যের ত্রাণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে নগদ টাকার পরিমাণ ৮৯২৬১৭৫৩ ডলার এবং বাকী ৭২১৫১২৩৩.৪৯ ডলার সমমূল্যের ত্রাণ সামগ্রী এবং অন্যান্য বস্তু। এই খাতে সমস্ত সহায়তা এবং হিসাব নিকাশ একসাথে করে প্রস্তুত করা একটি তথ্য সূচী আমি পূর্বেই কমিটির কাছে প্রদান করেছি। এই পেপারটি মূলত গত মাসে জেনেভাতে অনুষ্ঠিত কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে আমি যে তথ্য উপস্থাপন করে ছিলাম তারই হালনাগাদ করা সারসংক্ষেপ। এছাড়া এই পেপারে ৩১শে অক্টোবর ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত জাতিসংঘের তরফ থেকে ভারতে বিলিকৃত প্রকৃত এবং প্রত্যাশিত সহায়তার বিস্তারিত হিসাব বর্ণনা করা আছে। আমি সমস্ত সরকারী এবং বেসরকারি সংস্থা এবং যেসকল ব্যক্তিবর্গ নিজ উদ্যোগে এই সহায়তা জাতিসংঘের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
যারা সরাসরি বা দ্বিপাক্ষিক ভাবে এই কার্যক্রমে যুক্ত হয়েছেন তাদের অবদানের কথা স্মরণ করতে চাই। এটি এমন একটি পরিস্থিতি যা নিঃসন্দেহে বৈশ্বিক সহায়তার দাবী রাখে, এবং এই সহায়তা যত বেশী হয়, আমাদের জন্য পরিস্থিতি সামলানো তত সুবিধাজনক হয়। সকল হিসাব একত্র করে, বাইরের উৎস থেকে মোট প্রাপ্ত সহায়তার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৪ কোটি ৭৬ লক্ষ ডলার। ত্রাণের অপ্রতুলতার বিষয়ে আর কি কিছু বলার অবকাশ আছে? এই সহায়তা অপর্যাপ্ত হওয়ায় ১৯শে মে মাননীয় মহাসচিবের আবেদনের পর আমি একটু ব্যাপক পরিসরে বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর সাথে বৈঠক করি এবং পরবর্তীতে ১১ই অক্টোবর তারিখে রেডিও এবং টেলিভিশনে পুনরায় ত্রাণ সহায়তা প্রেরণের জন্য আবেদন জানাই। স্বতন্ত্রভাবে, সহায়তা প্রেরণের সুবিধার্থে আমি নগদ অর্থ সাহায্য গ্রহণ করতে শুরু করি এবং এর উপর জোর দিতে থাকি। এছাড়াও ফোকাল পয়েন্ট এবং ভারত সরকারের সদিচ্ছার প্রেক্ষিতে জানাতে চাই, দ্রুত প্রয়োজন মেটানোর সুবিধার্থে কিছু দ্রব্য (যেমন চাল,ডাল,চিনি) ইত্যাদি ক্রয়ের জন্য আমরা এখন নগদ অর্থ সাহায্যও গ্রহণ করছি।
অক্টোবরের মাঝামাঝিতে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সংগ্রহীত নগদ টাকা বা অন্যান্য প্রায় সমস্ত প্রকার ত্রাণ সামগ্রী হয় ভারত সরকারকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে, অথবা এই বছরের শেষ নাগাদ ভারতে পৌঁছানোর জন্য পাইপলাইনে অবস্থান করছে। শেল্টার নির্মাণ সামগ্রী, ঔষধ, খাদ্যদ্রব্য, কাঁথা, কাপড় চোপড় সহ লজিস্টিক সাপোর্ট ক্রয় এবং স্থানান্তরের কাজ এই সহায়তা ব্যবহার করে সম্পন্ন করা হয়েছে।
এর ফলশ্রুতিতে, সহায়তার জন্য গচ্ছিত অর্থ ও সামগ্রীর মজুদ শেষ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি অত্যাসন্ন হয়ে পড়েছে। সহায়তা প্রদানের সর্বশেষ আবেদনের পর থেকে দানের ক্ষেত্রে দাতারা যথেষ্ট উদারতার পরিচয় দিয়েছেন বটে, তবে পরিস্থিতি এখনো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। কার্যক্রমের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ বর্ণনা করে এই কমিটিকে বিব্রত করবো না, তথ্য সূচীতে এসম্পর্কিত সমস্ত তথ্য দেয়া আছে, তারচেয়ে বরং জাতিসংঘের সহায়তা কার্যক্রম থেকে একেবারে দৃশ্যমান কিছু উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই: খাদ্য: প্রায় ১৪২০০০ মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে, এবং ৬২৬৭১ টন ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। ট্রান্সপোর্টের জন্য ২২০০টির অধিক যানবাহন অর্ডার দেয়া হয়েছিলো যার দুই-তৃতীয়াংশ ইতোমধ্যে পৌঁছে গেছে। শেল্টার: তিরিশ লক্ষাধিক শরণার্থীর মাথার উপর পলিথিনের তৈরি ছাউনি তৈরি করা হয়েছে যা বাইরে থেকে আনা হয়েছিলো। কাঁথা: বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রাপ্ত প্রায় তিরিশ লক্ষ কাঁথা ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে। ঔষধ: ৭০০ টনের অধিক ঔষধ এবং মেডিকেল সাপ্লাই ভারতে পৌঁছে দেয়া হয়েছে যা ছিলো সম্ভবত আকাশ যোগে ত্রাণ সামগ্রী স্থানান্তরের দীর্ঘতম লাইন। স্বাস্থ্য: সীমান্তের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ক্যাম্পগুলোতে প্রাথমিক স্টেজের পুষ্টি হীনতা রোধ এবং আরোগ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হচ্ছে। জাতিসংঘের দাপ্তরিক বিভাগের সাথে আমার অফিসের চমৎকার বোঝাপড়া এবং পারস্পারিক সমন্বয় ছাড়া অবশ্য এতো কাজ সম্পন্ন করা একেবারেই সম্ভব ছিলো না। যার উপর ভর করেই আমি ফোকাল পয়েন্টের কার্যক্রম দাড় করাতে সক্ষম হয়েছে। এই পদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে জানার সাথে সাথেই আমি জেনেভাতে একটি আন্ত-এজেন্সি কনসালটেন্সি ইউনিট গঠন করি। এর কাজ হলো প্রথমত, প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক সহায়তাকে চলমান রাখে এবং নিরাপত্তা প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, সহায়তা সংগ্রহের জন্য নিয়মমাফিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রাপ্ত সহায়তাকে ভারত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। তৃতীয়ত, খুব সক্রিয়ভাবে ভারত সরকারের সাথে লিঁয়াজো বজায় রাখা। এই কনসাল্টেশন ইউনিটের সাথে সাথেই, ভারত সরকারের উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রমের সাথে জড়িত কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো, ফোকাল পয়েন্ট সহ জাতিসংঘের অন্য এজেন্সির প্রতিনিধিদের নিয়ে দিল্লী ভিত্তিক একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে।
দিল্লী এবং জেনেভার এই দুই তরফা তদারকি কার্যক্রম বেশ সফলতার সাথেই প্রত্যাশিত ফলাফল এনে দিচ্ছে। আমি জাতিসংঘের বিশেষ এজেন্সিগুলোর তড়িৎ সক্রিয়তা এবং ফলপ্রসূ সহায়তার জন্য তাদেরকে উষ্ণ অভিনন্দন জানাই। জাতিসংঘের দাপ্তরিক বিভাগের সাথে আমার অফিসের চমৎকার বোঝাপড়া এবং পারস্পারিক সমন্বয় ছাড়া অবশ্য এতো কাজ সম্পন্ন করা একেবারেই সম্ভব ছিলো না। যার উপর ভর করেই আমি ফোকাল পয়েন্টের কার্যক্রম দাড় করাতে সক্ষম হয়েছে। এই পদের দায়দায়িত্ব সম্পর্কে জানার সাথে সাথেই আমি জেনেভাতে একটি আন্ত-এজেন্সি কনসালটেন্সি ইউনিট গঠন করি। এর কাজ হলো প্রথমত, প্রাপ্ত আন্তর্জাতিক সহায়তাকে চলমান রাখা এবং নিরাপত্তা প্রদান করা। দ্বিতীয়ত, সহায়তা সংগ্রহের জন্য নিয়মমাফিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং প্রাপ্ত সহায়তাকে ভারত পর্যন্ত পৌঁছে দেয়া। তৃতীয়ত, খুব সক্রিয়ভাবে ভারত সরকারের সাথে লিঁয়াজো বজায় রাখা। এই কনসাল্টেশন ইউনিটের সাথে সাথেই, ভারত সরকারের উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রমের সাথে জড়িত কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রণালয়গুলো, ফোকাল পয়েন্ট সহ জাতিসংঘের অন্য এজেন্সির প্রতিনিধিদের নিয়ে দিল্লী ভিত্তিক একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। যৌথ প্রয়াসের এই ত্রাণ কার্যক্রমকে ভালোভাবে বোঝার জন্য একটি বিষয় পরিষ্কারভাবে জানানো প্রয়োজন, এখানে জাতিসংঘের ভূমিকা মোটেই অপারেশনাল নয়। ভারতের সরকারের ইচ্ছার ভিত্তিতেই, আমরা অপারেশনাল কার্যক্রম সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। আমার প্রতিনিধি এবং ফোকাল পয়েন্ট টিমের কাজ মূলত দিল্লীর ডিউটি স্টেশন এবং অন্যান্য পক্ষের ভেতর সমন্বয় ও লিঁয়াজো বজায় রাখা। সেখান থেকে তারা বিভিন্ন প্রদেশ ভ্রমণ করেছেন, যেখানে শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছে, এবং প্রতিটি প্রদেশে এমন অগণিত ক্যাম্প আছে। এছাড়া ইউনিসেফ, ডাব্লিউএফপি এবং ডাব্লিউএইচও এর বিভিন্ন মিশনের কাজে শরণার্থীদের এলাকায় যারা নিয়োজিত রয়েছেন এমন স্টাফ সদস্যগণও তাদের সাথে ছিলেন। কোলকাতায় ইউনিসেফের একটি অফিস আছে, এবং পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরাতে তাদের অধীনে লিঁয়াজো অফিসাররা কর্মরত আছেন। এখানে জাতিসংঘের দায়িত্ব মূলত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডল থেকে ত্রাণ সহায়তার ব্যাপ্তি বৃদ্ধি করা, এবং সেই সহায়তা ভারতের সরকারের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা এবং সামগ্রিক কার্যক্রম সমন্বয় করা যেন ভারত সরকারের সাহায্য নিয়ে ফোকাল পয়েন্টের পক্ষে দাতাগোষ্ঠীর কাছে তাদের দেয়া সহায়তার পূর্ণ বিবরণ পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়। এছাড়া, দিল্লীতে অবস্থান করা দলের সদস্যবৃন্দ প্রয়োজন এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণের কাজে নিয়োজিত আছে, বিশেষ করে বাইরে থেকে আসা ত্রাণ সাহায্য কোন খাতে ব্যাবহার করা যুক্তিসংগত তা নির্ধারণের কাজটি তারা করে থাকে। এক্ষেত্রে প্রত্যাশিত সাফল্য আসার বিষয়টিই নিশ্চিত করে দলটির পারস্পারিক ঐক্য কতটা দৃঢ়। তথ্য ও কার্যক্রম তদারকির কাজে জাতিসংঘের পক্ষে কেন্দ্রীয় ভূমিকায় রয়েছে এই দলটি। এর ফলে সরকারী এবং বেসরকারি উভয় প্রকার প্রতিষ্ঠানের সাথে আন্তঃযোগাযোগ রক্ষা করা সহজতর হয়েছে। এছাড়া জাতিসংঘের তরফ থেকে মূলত শেল্টার নির্মাণ সামগ্রী, যানবাহন, কাঁথা ইত্যাদি পণ্য সংগ্রহ করাটা একটু দুঃসাধ্য ছিলো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস বিপদের মুহূর্তে এই পদ্ধতির কারণেই ত্রাণ কার্যক্রম যথেষ্ট ফলপ্রসূ হয়েছে। এর ফলে আমরা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সুবিধাজনক দামে বিশ্ববাজার থেকে কিনে নগদ অর্থসাহায্যের সর্বোচ্চ ব্যাবহার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছি। এই সমস্ত সুবিধার পাশাপাশি, একটি আশংকার কথাও আপনাদের মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, জাতিসংঘের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল ধরে এই ত্রাণ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া মোটেই সম্ভব নয়, এবং এমন কোনো পরিকল্পনাও আমাদের নেই। তাই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার মাধ্যমে এই কার্যক্রমকে স্থায়ী রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা মোটেই আমাদের কাম্য নয়, বিশেষ করে আশ্রয় দানকারী দেশের স্বার্থে এই ঝুঁকি যদি আমাদেরকে নিতে না হয়, সেটাই বরং আমাদের জন্য মঙ্গল। এমনটি হলে আন্তর্জাতিক মহলকেও সীমাহীন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বোঝা বহন করতে হবে। এটি শরণার্থীদের মনোবলে আঘাত হানবে, এবং ক্রমে তা পরিণত হবে হতাশ স্বীকারোক্তিতে। এখন প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত, দ্রুততার সাথে ভলান্টারি কার্যক্রমের দিকে বেশী করে ঝুঁকে পড়া। অপরদিকে নন-অপারেশনাল হওয়ার ফলে সহায়তার জন্য গৃহীত পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে তাৎক্ষণিক ভাবে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করে রিপোর্ট করা কিছুটা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে, আবার সংগত কারণেই সাহায্য গ্রহীতাদের হাতে ত্রাণ সামগ্রী কিভাবে পৌঁছচ্ছে বা তার ব্যাবহার কিভাবে হচ্ছে সেই ব্যাপারে দাতাদের স্বাভাবিক আগ্রহকে উপেক্ষা করাটাও আমাদের কাছে সমীচীন মনে হয় না। এই ক্ষেত্রে, আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি ভারত সরকারের পূর্ণ সহায়তার বিষয়টি সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে। শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের ব্যবস্থা করতে সকল পরিসংখ্যানের বিপরীতে গিয়ে ভারতের নারী-পুরুষদের একনিষ্ঠ প্রচেষ্টার কথা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। ত্রাণ কার্যক্রম কিভাবে পরিচালনা হচ্ছে বা কি পরিমাণ ত্রাণ প্রয়োজন এবং কি পরিমাণ আমাদের হাতে এসেছে, সেসব আপনারা ইতোমধ্যেই শুনেছেন। এখন আপাতত সমাধান হতে পারে যদি আমরা আমাদের প্রচেষ্টার দ্বিগুণ শ্রম দিতে পারি, কারণ দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের পথ এখন অনেক দূরে বলেই মনে হচ্ছে।
এ হলো বর্তমান পরিস্থিতির এক বিরাট এক প্যারাডক্স। আমরা সবাই জানি এবং মানি যে, এই বিশাল এবং নির্মম সংকটের সমাধান হতে পারে একটি মাত্র উপায়ে এবং তা হলো শরণার্থীদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কিভাবে এই কর্মটি সুসম্পন্ন করা যায়, যখন দুই দেশের সরকারও শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে নীতিগতভাবে একমত। নিঃসন্দেহে, নিজভূম থেকে বিতাড়িত একজন শরণার্থীর জীবন অত্যন্ত বেদনার এবং কষ্টের, এবং তার দুর্দশা লাঘবের জন্য সবচেয়ে ভালো সমাধান হতে পারে তাকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজের দেশে ফেরত যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়া, যেখানে সে নিজের পরিবেশে আগের মতো বসবাস করতে পারে। আমার অফিসের গত প্রায় বিশ বছরের অভিজ্ঞতা এমনটাই বলে, এবং তৃতীয় কমিটির বক্তাদের মুখেও এই একই কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে, কোনো দেশে যদি কখনো বসতি স্থাপনের ঘটনা ঘটে সেক্ষেত্রে ইউএনএইচআর এর সক্রিয় অংশগ্রহণে দ্বিপক্ষীয় একটি সমন্বয় কার্যক্রম শুরু করা যেতে পারে, যারা মূলত পুনর্বাসনের দিকে বেশী জোর দিবে। যতদিন পর্যন্ত আমরা সেই ধাপে পৌছাতে না পারছি, তত দিন পর্যন্ত বড় পরিসরে সংগঠিত প্রত্যাবর্তন কার্যক্রম সফল হবে না এবং এই কার্যক্রম একবার শুরু করলে তা থেকে ফিরে আসাটাও দুরূহ ব্যাপার, এখানে একটি বিষয় আপনাদের মনে করিয়ে দেয়া প্রয়োজন, ইউএনএইচআর তখনই পুনর্বাসন কার্যক্রম অনুষ্ঠানে সফল হয়েছে যখন দুই দেশ আন্তরিকভাবে এই কার্যক্রমের চালানোর ব্যাপারে একমত হতে পেরেছে। এই ঐকমত শুধু সমাধানে পৌঁছানোর ব্যাপারে হলেই হবে না, বরং কার্যক্রম কখন এবং কিভাবে হবে, সে ব্যাপারেও একটা সিদ্ধান্তে পৌছাতে হবে। এই বিষয়টি আমাদের চিন্তার ভেতর আছে, এবং আরও দুইটি উদ্দেশ্যের কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি, গত ছয় মাসে আমি দুইবার ভারত এবং পাকিস্তান সফর করেছি, গত সপ্তাহেই আমি সফর শেষে ফিরলাম। ভারত সফরে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে এবং মেঘালয়ের শরণার্থী শিবির গুলোর সর্বশেষ অবস্থা নিজ চোখে দেখার সুযোগ আমার হয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখেছি শরণার্থীদেরকে সুশৃঙ্খল ভাবে রেজিস্ট্রি করে প্রত্যেককে রেশন কার্ড দেয়া হয়েছে, এবং তাদের রেশন প্রদানের সময়ও আমি নিজে উপস্থিত ছিলাম। এরপর আমি দিল্লীতে ফিরে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছি। এছাড়া কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের সিনিয়র অফিসারদের সাথে বিভিন্ন টেকনিকাল বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগও আমার হয়েছে। আমি ভারতের প্রশাসনকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই আমার প্রতিনিধিদের এবং বিশেষ করে আমাকে এভাবে সহযোগিতা করার জন্য। পাকিস্তানে গিয়ে আমি রাষ্ট্রপতি এবং সিনিয়র অফিসারদের সাথে পুনরায় দেখা করেছি। আপনারা জানেন, ঢাকায় অবস্থিত আমার প্রতিনিধিকে সরকার পূর্ণ সহযোগিতা প্রদান করছে। আমার সর্বশেষ ভ্রমণের সময় সে ফিল্ড সহকারীদের একটি ছোট দলকে নিয়ে কাজ করছিলো। সেই প্রতিনিধি আমাকে জানিয়েছে যে সকল শরণার্থীরা ফেরত এসেছিলো, তাদেরকে সীমান্ত সংলগ্ন রিসিপশন সেন্টারগুলোতে পাঠানো হয়েছে। সেখানে তাদের রেজিস্ট্রেশন এবং সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে, এবং একদিন বা দুইদিনের ভেতর তাদের প্রত্যেককে নিজ গ্রামে পৌঁছানোর জন্য বাসের টিকেট, প্রয়োজন অনুসারে কাপড়, পনেরো দিনের খাবার, এবং নগদ পাঁচ রূপী করে দেয়া হয়েছে। আমাকে সে আরও জানিয়েছে যে, সরকারের তরফ থেকে শরণার্থীদের গ্রামের কর্তৃপক্ষকে নোট দেয়া হয়েছে যেন তারা এই পুনর্বাসন প্রক্রিয়াতে প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদান করে। পাকিস্তান সরকারের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ২ লক্ষ শরণার্থী যার ভেতর অন্তত ৩০% সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্য ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ফেরত গেছে, এর মধ্যে ৬৪ হাজার শরণার্থী ফেরত এসেছে সরকারী রিসিপশন সেন্টারের মাধ্যমে এবং বাকীরা নিজ উদ্যোগে। আমাদের বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশের সময় এই কমিটি গতকাল আবারও এই অফিস এবং আমাদের কার্যক্রমের ব্যাপারে তাদের নীতিগত সমর্থন প্রদান করেছেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যখন আমার অফিসের নীতিমালার মুসাবেদা করা হয়, তখন হাই কমিশনারকে নিজ কার্যক্রমে পুরোপুরিভাবে মানব হিতৈষী ভূমিকা পালনের জন্য বলা হয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষেই অত্যন্ত ভালো উদ্যোগ বলে মনে করি। আপনারা যেভাবে চান তার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই আমি আমার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করে যাবো। যখন শরণার্থীদের ফেরত যাওয়ার মতো পরিবেশ তৈরি হবে, তারা একমাত্র তখনই স্বেচ্ছায় ফিরে যেতে শুরু করবে, যখন তাদেরকে শান্তি এবং নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হবে, ততদিন পর্যন্ত আমি সরকার গুলো এবং বিশ্বের মানুষের কাছে আবেদন জানাই তাদের প্রতি উদার হওয়ার জন্য। নিজের বাড়ী থেকে বহুক্রোশ দূরে গিয়ে হতাশা এবং অনিশ্চয়তার ভেতর এভাবে বেঁচে থাকা একজন শক্ত সামর্থ্য বান মানুষকেও ভেঙ্গেচুরে দিতে সক্ষম, এই মানুষগুলো একজন সাধারণ মানুষের সহ্যসীমার অনেকগুণ বেশী কষ্ট সহ্য করছে। তাই উদারতা বিবর্জিত এবং তাদের সমস্যা সমাধানের সাথে সংশ্লিষ্ট নয় এমন কথা বলাটা প্রকৃতপক্ষে এই মানুষগুলোর বুকে এখনো জিইয়ে থাকা আশার প্রতি পরিহাসেরই নামান্তর। এখন আমাকে যদি আরও কিছু যোগ করতে হয়, তাহলে বলবো এই চ্যালেঞ্জটা অনেক বড়, আমাদেরকে সম্ভাব্য সবগুলো পথেই সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। আজ যদি আমি বলতে পারতাম যে এই সমস্যার সমাধান সন্নিকটে এবং আমরা একদম ঠিক পথেই এগুচ্ছি, তাহলে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু এখন এই কথা বলার একেবারেই কোনো উপায় নেই। তারমানে আবার এই নয় যে পরিস্থিতি শুধু খারাপই থাকবে। সংকটে ভুগতে থাকা লাখো মানুষ শান্তি প্রত্যাশা করে। ঠিক অডেন যেভাবে জাতিসংঘের সংগীতে লিখেছেন “শান্তির জন্য” “সঠিক সময়ে পরিবর্তনের জন্য”। আমি আশাবাদী সেই পরিবর্তন একদিন আসবে, এবং খুব শীঘ্রই। একদিন না একদিন শান্তি ফিরে আসবেই, কিন্তু খুব বেশী দেরী হয়ে গেলে তা হবে অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।