শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ প্রশ্নে চীনের ভাষ্যঃ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গণচীনের প্রতিনিধি চিয়াও কুয়ান হুয়ার বক্তৃতা | চায়না, পাকিস্তান এন্ড বাংলাদেশ | ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গণচীনের প্রতিনিধি চিয়াও কুয়ান হুয়ার বক্তৃতা, ৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১
ভারত ও পাকিস্তান চীনের নিকটতম প্রতিবেশী। চীন সরকার ও জনগণ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সশস্ত্র সংঘাতের ব্যপারে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। চীনের প্রতিনিধি এই ব্যপারে কিছু বিষয় তুলে ধরবে।
১। ভারতীয় সরকার একটি সরাসরি আক্রমণকারী।
এখানে উপস্থিত আমাদের সহকর্মীবৃন্দ সকলেই জানেন কিভাবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ শুরু হয়েছিল। ভারত সরকার বার বার বলে আসছে যে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বাস্তু প্রশ্ন যা এমন পরিস্থিতিতে নিয়ে আসে যা পাকিস্তানে আক্রমণ করার জন্য সৈন্য দল প্রেরণ ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। এটি প্রকৃতপক্ষে বিচ্ছিরি চরমপন্থা। কিছুদিন আগেও ভারতীয় শাসকগোষ্ঠী বলপূর্বক চাইনিজ তিব্বতের দশ হাজারের মত অধিবাসিকে ভারতে যেতে দিয়েছে এবং চীনের বিশ্বাসঘাতক দালাই লামাকে প্রধান করে তথাকথিত নির্বাসিত সরকার তৈরি করে। তথাকথিত উদ্বাস্তু প্রশ্নের অজুহাতে ভারত সরকারের পাকিস্তান আক্রমনকে সমর্থনযোগ্য বলে মেনে নিলে একইভাবে তথাকথিত “তিব্বতী উদ্বাস্তু” প্রশ্নের অজুহাতে ভারত সরকারের চীন আক্রমনকে সমর্থনযোগ্য বলে মেনে নিতে হবে। এই ধরনের অজুহাত সম্পূর্ণরূপে অদ্ভুত নয় কি?
একটি বিশেষ ক্ষমতার ছত্রছায়ায়, ভারত সরকার অনেক যুদ্ধংদেহী ও প্রভাববিস্তারকারী হয়ে উঠছে। এটি স্পষ্টত গোলমেলে যে যখন থেকে পাকিস্তান ভারতের প্রতিবেশী, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানী সৈন্যদলের অবস্থান ভারতের জন্য হুমকি। এটি নিছক ফ্যাসিস্ট কর্মকাণ্ড। ভারত চীনেরও প্রতিবেশী, ভারতে ভারতের সেনাবাহিনীর অবস্থান কি চীনের জন্য হুমকি তৈরি করে না?
ভারতের ক্ষমতাশীল দল দাবী করে যে ভারত একটি দেশ যা গনতন্ত্র, স্বাধীনতা এবং শান্তি ভালবাসে। এসবের সাথে যার যোগসূত্র নেই তাদের জন্য এটি হতে পারে কেবল ছলাকলা অথবা প্রতারণা। আজকের বিশ্বে, কেবল ভারতে দশ মিলিয়নের বেশী অস্পৃশ্য পাওয়া যাবে। আফ্রিকা ও এশিয়ার নতুন স্বাধীন হওয়া দেশগুলোর মধ্যে কেবল ভারতে রয়েছে একটি “আশ্রয় রাজ্য”। প্রায় সকল প্রতিবেশী রাষ্ট্র একবার কিংবা বারবার ভারত কর্তৃক নিপীড়িত হয়। এ কেমন গনতন্ত্র? এ কেমন স্বাধীনতা? এবং এ কেমন শান্তি?
ভারতের সম্প্রসারণবাদের ইতিহাস অনেক লম্বা। নেহরু তার ডিসকভারি অব ইন্ডিয়া বইয়ে নগ্নভাবে দাবী করেন যে দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশ ও ভারত মহাসাগর ভারতের প্রভাব বলয়ের মধ্যে আছে। এই বছরগুলোতে ভারতের ক্ষমতাশীল দল তাদের প্রচেষ্টা “পরাশক্তি” কিংবা “প্রাক- পরাশক্তি” হওয়ার অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে কখনো ছেঁড়ে দেয় নি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তাদের বর্তমান আগ্রাশন এমন সম্প্রসারণ প্রক্রিয়ার বাস্তবায়নে অনিবার্য পরিণতি।
২। ভারতের আগ্রাসনের পেছনে সোভিয়েত সরকারই প্রধান।
ভারতীয় স্বভাবত বর্ধনশীলতার এত সাহস নেই। তারা এখন এত চরমপন্থি হয় কেন? কারণ হল একটি পরাশক্তি, সোভিয়েত সমাজ-সাম্রাজ্যবাদ, তাদের পেছনের যোগান দিচ্ছে। যেমনটি আমি আগে বলেছি, তথাকথিত ভারতীয় সোভিয়েত শান্তি চুক্তি। বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা সামরিক সংঘের শান্তি চুক্তির একটি প্রভাব। যখন থেকে এই চুক্তির উপসংহার টানা হয়, ভারতীয় সরকার আরও চরমপন্থি হয়ে উঠে, কোন সংকোচ না রেখে পাকিস্তানের উপর বিধ্বংস এবং আগ্রাসন চালায়। ৫ই ডিসেম্বর, টিএএসএস একটি বিবৃতি প্রকাশ করে যাতে সম্পূর্ণই ছিল উত্তেজনার গন্ধ। এটি গোলমেলে যে ভারত ও পাকিস্তানের টানাপড়েন সোভিয়েত ইউনিয়নের তথাকথিত নিরাপত্তা স্বার্থকে হুমকিতে ফেলছে এবং তারা উদাসীন থাকতে পারে নি। এটি প্রতারণা এবং চীনকে ভীতিপ্রদর্শন করা একই সাথে প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানকে। বিশিষ্ট সোভিয়েত প্রতিনিধি, আসলে আপনারা কি পরিকল্পনা করছেন? এখানে আমাদের বলতে পারেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সভায় ৪,৫,৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত প্রতিনিধি জনাব মালিক ও ভারতীয় প্রতিনিধি একে অন্যকে পুনরাবৃত্তি করেন, নিরাপত্তা পরিষদে প্রতিনিধিগণ তথাকথিত “বাংলাদেশ”কে উপস্থাপন করাতেই বেশী জোর দেয়। বেশিরভাগ পরিষদ সদস্য কর্তৃক স্বীকৃত দুটি খসড়ায় সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রতিনিধি ভেটো দেয়। তিনি সকলের সাথে অননুমিত বিদ্রুপ করেন যারা তার সাথে ভিন্নতা প্রদর্শন করেন। তিনি প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে তিনি একাই সকল খসড়ায় ভেটো দিবেন। এটি আক্রমনাত্বক ও নিষ্ঠুর চরমপন্থা। তার আচরণ বর্ণনা করতে আমি কদাচিৎ যথাপোযুক্ত শব্দ পাই।
এটা কোন বিস্ময়ের ব্যপার না যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বোচ্চ দল ভারতীয় আগ্রাসীদেরকে এমন নগ্ন সমর্থন দিবে। এমনকি সোভিয়েতের শীর্ষ দল মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং পরিবর্তনের বীজ বপন করে, এটি সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদের অনুগমন পন্থা। এটি সকল জায়গায় অন্য দেশের উপর আগ্রাসন, বিধ্বংস, কর্তৃত্ব ও প্রভাব বিস্তার করেছে। ১৯৬৮ সালে, এটি নিদারুনভাবে চেকোস্লোভাকিয়া আক্রমণ এবং দখল করতে সৈন্য প্রেরণ করে। এই বছর এটি প্রকাশ্যে আফ্রিকার একটি দেশের বৈধ সরকারকে উৎখাত করতে প্রদক্ষেপ নেয়। এই বাস্তবতাগুলো এখানে আমাদের অনেক সহকর্মীদের ভাল ভাবেই জানা। আমি এটি সহজ করছি। ভারতের আদিপত্য সম্প্রসারণের লক্ষ্যকে কাজে লাগিয়ে, বিশ্বের আরেকটি পরাশক্তি হওয়ার চেষ্টায় সোভিয়েত সর্বোচ্চ দল ভারতকে আরও নিয়ন্ত্রণ করার উদেশ্যে এবং পরবর্তীতে ইন্দো-পাকিস্তান উপমহাদেশ এবং ভারতীয় উপসাগর নিয়ন্ত্রণ করতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় সৈন্যের আগ্রাসনের সমর্থন করছে।
৩। লীগ অব নেশনসের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করা জাতিসংঘের উচিৎ হবে না।
বর্তমান ইন্দো-পাকিস্তান পরিস্থিতি আমাদের ৩০-এর সময়কার পরিস্থিতির কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৩১ সালে, জাপানী সেনাবাহিনী আমাদের উত্তর-পূর্ব তিনটি প্রদেশে আক্রমণ ও দখলের মাধ্যমে চীনের বিরুদ্ধে একটি আগ্রাসী যুদ্ধের অবতারণা করে এবং তথাকথিত “মাঞ্চুকু” স্থাপন করে। জার্মান ও ইতালিয়ান ফ্যাসিস্টরা তথাকথিত অঞ্চলের “স্বীকৃতি” দানের মাধ্যমে সর্বাত্মকভাবে তাদের সাহায্য করে। লীগ অব নেশনস, যা কিনা তখন ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অন্যান্য শক্তির অধীনে নিয়ন্ত্রিত ছিল, ভুল-সঠিক ও আক্রমণকারী-ভোক্তভোগীদের মাঝে কোন প্রভেদ করে নি এবং তারপর চীন অসহায় হয়ে পড়ে এবং জাপান তাদের নিজের মত করে অনুমোদিতভাবে চীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসন চালায়। এটি ছিল আগ্রাসনের উৎসাহপ্রণোদনার একটি প্রভাবস্বরূপ। এই পারিপার্শ্বিকতায় জাপান আবারও চীনের বিরুদ্ধে তাদের আগ্রাসী যুদ্ধ বিস্তার করে, ইতালিয়ান ফ্যাসিস্টরা ইথিওপিয়ার বিরুদ্ধে তাদের আগ্রাসী যুদ্ধের অবতারণা করে এবং হিটলার একের পর এক ইউরোপিয়ান রাষ্ট্র জার্মানির অধিভুক্ত করে। ফলস্বরূপ, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং তারপর, লীগ অব নেশনস ধ্বংস হয়।
ঐতিহাসিক শিক্ষা মনোযোগের যোগ্য। জাতিসংঘ এখন ৩০-এর একই অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। আক্রমণাত্মক যুদ্ধয়ের আগুন এখন ভারত চালনা করে এশিয়া ও বিশ্বের শান্তি বিনষ্ট করছে। জাতিসংঘকে অবশ্যই সোভিয়েত ইউনিয়নের বাঁধা কাটিয়ে উঠতে হবে এবং দ্রুত এই বিপদজনক পরিস্থিতি থামানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সর্ব প্রথমেই, অবশ্যই আক্রমণকারী ও ভোক্তভোগির তফাৎকারী দাগ টানতে হবে, শক্তভাবে আক্রমণকারীর নিন্দা ও আগ্রাসনে ভোক্তভোগিকে অবশ্যই দৃঢ় সমর্থন জানাতে হবে। অস্পষ্ট অবস্থান আক্রমণকারীকে লালন ও তার ঢাল হওয়ার শামিল। একটি অথবা দুইটি পরাশক্তির শক্তি প্রদর্শনের কাছে, বেশিরভাগ সদস্য রাষ্ট্রকে লঙ্ঘনের মাধ্যমে জাতিসংঘ অতীতে বেশ কিছু ভুল করে। জাতিসংঘের অবশ্যই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়া এবং অবশ্যই লীগ অব নেশনসের পুরাতন পথে না হাঁটা উচিৎ।
৪। চীন মানে যে জাতিসংঘঃ
(১) কঠোরভাবে পাকিস্তানের উপর ভারতের আগ্রাসনের নিন্দা জানাবে ও সম্পূর্ণভাবে ভারতীয় আগ্রাসনকে নির্লজ্জ সমর্থনকারী সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদীদের দুষ্কর্মের প্রকাশ করবে।
(২) পাকিস্তান সরকার ও জনগণকে ভারতের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের সমর্থন জানাতে সকল দেশকে আহ্বান করবে।
(৩) পাকিস্তান ভূখণ্ড থেকে ভারতের সকল সেনা ও পাঠানো কর্মীবৃন্দকে অতি দ্রুততার সাথে ও বিনাশর্তে সরিয়ে আনতে ভারতীয় সরকারকে আহ্বান করবে ও প্রতি আক্রমণে পাকিস্তান যে বাহিনী ভারতীয় ভূখণ্ডে পাঠিয়েছে তা প্রত্যাহার করতে পাকিস্তানী সরকারকে আহ্বান করবে।
(৪) ভারত ও পাকিস্তান উভয়কে অতি দ্রুততার সাথে একে অন্যের ভূখণ্ড থেকে তাদের নিজ নিজ বাহিনী প্রত্যাহারের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতি করতে আহ্বান করবে।
(৫) সুপারিশ করবে যে, যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সীমানা থেকে দুই পক্ষের সশস্ত্র বাহিনী প্রত্যাহার করতে ও একে অন্য থেকে আলাদা হয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিবাদের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে।
জনাব প্রেসিডেন্ট,
সারগর্ভে বলছি, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘাত ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের পরবর্তী অবস্থা। চীন সরকার সব সময়ই চায় নতুন আফ্রো-এশিয়ান দেশগুলো তাদের মধ্যবর্তী সমস্যাগুলো পরামর্শ গ্রহনের মাধ্যমে একটি সম ভিত্তিতে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সমাধান হোক। তারা সাম্রাজ্যবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত না হোক। এটিই আজ আমাদের অবস্থান। ভারত সরকার কি তার একগুঁয়ে ধারা বজায় রাখবে, ভারত তার নিজের তৈরি তিক্ত ফল একাই ভোগ করবে। যদি সোভিয়েত সরকার একটি কায়দা অনুসরণ করে, তবে এর শেষ ভাল কিছু নিয়ে আসবে না।