জাসদের ভবিষ্যৎ | সাপ্তাহিক বিচিত্রা | ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৮৩
কাজী জাওয়াদ / ফজলুল বারী
প্রতিষ্ঠা কালেই বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) চমক সৃষ্টি করেছিল। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর পরই সাধারণ মানুষ যখন গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের কথা ভাবছেন আর মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান চিন্তা করছিলেন মুজিববাদের কথা তখন বিপ্লবী জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব করে একজন ছাত্র নেতা হঠাৎ বিজলির ঝলকানি সৃষ্টি করেন। পরে তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠনে সক্রিয় ভাবে অংশ নেন। এই দলেরই নাম বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)।
স্বাধীনতার পর পর ডাকসু নির্বাচনে ব্যাপক জয়লাভ করে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিব সমর্থিত ছাত্রলীগ নয়। কারণ ছাত্রলীগের মধ্যে বিভক্তির মেরুকরণের প্রক্রিয়া তখন জোরদার। তা ছাড়া সাধারণ ছাত্র সমাজের বিরোধী সংগঠিত ছাত্র দল ছিল এটিই। পরে অবশ্য তা’ আবার সরকারের লেজুড়ে পরিণত হলে ছাত্র সমাজ এ দলটিকে প্রত্যাখান করে।
ছাত্রলীগের মধ্যে বিভক্তির আভাস পেয়ে পর্যবেক্ষক মহল মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেও ফাটল ধরবে। কিন্তু সদ্য পাওয়া ক্ষমতা ত্যাগ করে নেতৃত্বের মধ্যে থেকে উল্লেখযোগ্য কেউ বের হয়ে আসেননি। মূলতঃ ছাত্রলীগের নেতৃত্ব, দ্বিতীয় সারির রাজনৈতিক নেতা এবং সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে সংগৃহীত আরো কিছু নেতার সমন্বয়ে ১৯৭২ সালে জাসদ আত্মপ্রকাশ করে। ছাত্রলীগের প্রতি ব্যপক সমর্থনকে ব্যবহার করে জাসদ ব্যপক পরিচিত লাভ করে।
১৯৭২ থেকে ৭৫ সালের মধ্যে অন্য সব রাজনৈতিক কার্যক্রমের সাফল্য কম থাকায় এবং জাসদের পেছনে ছাত্র সমাজের এক বিরাট অংশের সমর্থন থাকায় জাসদ প্রকৃত প্রস্তাবে দেশের যুব মানুষের প্রতিভূ হিসেবে দেখা দেয়। এ সময় জাসদ ছিল একের পর এক কর্মসূচীর বাস্তবায়নের মাধ্যমে দলের জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।
শেখ মুজিবের ‘স্বৈরতান্ত্রিক’ শাসনামলে জাসদ ছিল একটি সনাতনী প্রতিবাদী রাজনৈতিক দল। অথচ এ শ্লোগান ছিল সমাজতন্ত্রের। তাই প্রকাশ্য রাজনীতিতে জাসদ এবং আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসের রাজনীতির সশস্ত্র জবাবে সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে শুরু করে।
জাসদ সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্যের কথা বললেও মূলতঃ বিভিন্ন ইস্যুকে কেন্দ্র করে তৎকালীন সরকারের অন্যতম বিরোধী দল বলে গণ্য হতে থাকে। কিন্তু জনচেতনায় জাসদের হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার বিষয়টি দানা বেঁধে ওঠেনি। ১৯৭৪ সালের শেষ নাগাদ ক্ষমতাসীন সরকারের ‘বিভিন্ন বাহিনীর ‘ অত্যাচার চরমে উঠলে জাসদ শ্বেত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লাল সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেয়ার রাজনীতিতে মেতে ওঠে।
জাসদের রাজনীতিতে তিনটি ঘটনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ তিনটি ঘটনা থোেই জাসদের কর্মী বাহিনী এবং নেতৃত্বের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে আসলেই জাসদ সঠিক পথে এগুচ্ছে কি না। ঘটনাগুলো হলো, আওয়ামী লীগের মন্ত্রী মনসুর আলীর বাড়ি ঘেরাও এবং সেখানে পুলিশের গুলি, ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীর একাংশের মাধ্যমে সিপাহী – জনতার অভ্যুত্থানকে নিজ খাতে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা এবং তারপর ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরনের চেষ্টা। এসব ব্যর্থ ও হঠকারী প্রচেষ্টার পর বিভক্তি আসে জাসদে। জন্ম নেয় বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল। অবশ্য এর আগে সেনাবাহিনীকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখলের চেষ্টার অপরাধে জাসদের বহু নেতা ও কর্মীর প্রাণদণ্ড থেকে শুরু করে বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয়। প্রকৃত প্রস্তাবে জাসদ এরপর থেকেই বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এর আগে বিরাট আকৃতির গণ সংগঠন সঙ্গে নিয়েও ১৯৭৫ সালের প্রথম ভাগে গোপন ‘গণবাহিনী’ও গঠন করেছিল জাসদ।
ভাঙ্গনের শব্দ শুনি
জাসদের বাহ্যিক রূপ সম্পর্কে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে তার সাংগঠনিক বিষয়াবলীর ইতিহাসও নিঃসন্দেহে উল্লেখের দাবীদার। ১৯৭২ সালে জাসদের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নেয় ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ এবং শ্রমিক জোট। ১৯৭৪ সালে জাসদ বিপ্লবের খসড়া থিসিস প্রণয়ন করে। থিসিস পরিশীলিত রূপ নেয় ১৯৭৫ সালে। থিসিসের মীল লক্ষ্য ছিল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। লক্ষ্যের সৈনিক চারটি সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক দের নিয়ে সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত সমন্বয় কমিটিই চারটি সংগঠনেকে মূলত পরিচালনা করে। ১৯৭৬ সালের এক পর্যায়ে সেন্ট্রাল অর্গানাইজিং কমিটি (সিওসি) গঠন করা হয়। রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন সহ অন্যান্য কারণে সিওসি পরবর্তী কালে ভেঙ্গে দেয়া হয়। তারপর থেকে সমন্বয় কমিটি চার সংগঠনের মধ্যে সমন্বয়ের কাজ করছিল। এ অবস্থায় চারটি সংগঠনের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ফলে আরও চারজন দায়িত্বশীল ও অভিজ্ঞ সাথী’ কে সমন্বয় কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমন্বয় কমিটির সদস্যরা ছিলেন মেজর জলিল, আ স ম আবদুর রব, মোঃ শাহজাহান, রুহুল আমিন ভূইয়া, খন্দকার আবদুল মালেক, শহিদুল্লা, হাসানুল হক ইনু, মনিরউদ্দিন আহমেদ, আবুল হাসিব খান, শাজাহান সিরাজ, মির্জা সুলতান রাজা, নুরে আলম জিকু এবং সিরাজুল আলম খান। এ বারোজনের কমিটি সংগঠনের অভ্যন্তরে বিরাজমান বিভিন্ন বিতর্কিত বিষয়ের উপর একটা যৌথ মতামতে উপনীত হয়ে একটি খসড়া দলিল প্রণয়ন করেন। যা কিনা কর্মসূচী সংগঠন আন্দোলন প্রসঙ্গে সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ নামক একটি পুস্তিকার রূপ নেয়। এ পুস্তিকার ভূমিকার এক স্থানে বলা হয়েছে ‘আমাদের মধ্যে বহু বিষয়ে অনৈক্য বিরাজ করছিল। আমাদের মধ্যে অনৈক্য যে বিরাজ করছে তা উপলব্ধি করলেও আমাদের ভুল ভ্রান্তি ও ত্রুটি প্রসঙ্গে মোটেই ঐক্যমত পোষণ করি না। অর্ণব আমাদের অনৈক্যের রূপ ও চরিত্র নির্ধারণ করার প্রশ্নে আমাদের চিন্তায় উল্লেখযোগ্য অনৈক্য বিদ্যমান। তাই বিগত আন্দোলনের অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের ত্রুটি সমূহকে চিহ্নিত করার প্রশ্নে এবং ভবিষ্যতে আন্দোলন রওনার ক্ষেত্রে আমাদের মধ্যে দেখা দিয়েছিল বিতর্ক। সেই বিতর্কের ঝড়ের ঝাপটায় আন্দোলন ও সংগঠনের মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গীগুলো পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিল। মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গীই যদি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, মৌলিক দিকগুলো যদি অস্বীকার করা হয় তবে বিতর্কের মধ্যে থেকে কোন সুনির্দিষ্ট সঠিক চিন্তা আর গড়ে তোলা সম্ভব হয় না।….. পুস্তিকাটির কোথাও প্রকাশকাল উল্লেখ নেই।
অনৈক্যের কারণ
জাসদের অনেকেই মনে করেন জাসদ ইতিমধ্যেই বার দুয়েক রাষ্ট্রক্ষমতা প্রায় দখল করে ফেলেছিল। এসব কাজ করতে গিয়ে জাসদকে কতকগুলো কর্মসূচী নিতে হয়। ক্ষমতা ছুঁই ছুঁই করে শেষ পর্যন্ত নাগাল না পাওয়ার সকল স্তরেই হতাশা প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ মনে করেননএ ধরণের কর্মসূচীর পুরোটাই ছিল ভুল। কেউ কেউ মনে করেন পুরোপুরি ভুল তারা করেননি।
অনেকে মনে করেন বিক্ষোভের মধ্য থেকে জাসদের জন্ম। স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগ চাহিদা পূরণ করতে পারেনি বলে যে বিক্ষোভ জন্ম নেয় তা থেকেই জাসদের উৎপত্তি। তারপন সরাসরি সরকারের বিরোধী দলে পরিণত হওয়ার আঘাতও এসেছে জাসদের উপর সবচেয়ে বেশী। ফলে জাসদকে আন্দোলন নিয়ে বেশী ব্যস্ত থাকতে হয়। ফলতঃ আন্দোলন বা সংগঠন কোটিই জাসদ পুরোপুরি গঠন করতে পারে নি। কেউ কেউ মনে করেন, ১৯৭৬ সালের পর সংগঠন গড়ার যে সুযোগ পাওয়া যায় তা কাজে লাগানো যায়নি। তার মূল কারণ ছিল নেতৃত্বের মধ্যে যোগাযোগের অভাব। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মী জেলে থাকায় সংগঠন গড়া সম্ভব হয় নি। ফলে ভুল বোঝাবুঝির পরিমাণ বাড়তেই থাকে।
আগে জাসদের নেতৃত্বের যে কাঠামো ছিল বর্তমানে সে কাঠামো কাজ করছে না। তা ভেঙ্গে গেছে। আগে মনে করা হত জাসদের রাজনৈতিক দর্শন এবং সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে গণনেতাদের কাছে পৌছাতো। গণনেতারা তা বাস্তবায়িত করতেন। বর্তমানে সে ব্যবস্থাটি ভেঙ্গে গেছে।
জাসদ রাজনীতির ‘দ্রষ্টা’ সিরাজুল আলম খান সব সময়ই সাংগঠনিক কাঠামোর বাইরে থাকতেন। কিন্তু জেল থেকে মুক্তি লাভের পর সব কয়টি গণ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন এবং হন। এর আগেই যে অনৈক্যের সৃষ্টি হয় তাতে তার সরাসরি সংগঠনে জড়িত হওয়াটা গুণগত সংযুক্তি প্রদান করে। অনেকে মনে করে থাকেন তাহলে কি তাদেরননেতা তাদের আর বিশ্বাস করছেন না?
জেনারেল এম এ জি ওসমানীকে নিয়েও জাসদের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই হয়ে যায়। জেনারেল ওসমানীকে প্রার্থী করার চিন্তা জাসদের ছিল। জেনারেল ওসমানীকে নাগরিক কমিটির সর্ব বিবেচনায় প্রার্থী মনোনীত করায় এবং সমর্থনদানের আহবান জানালে অনেকেই তা মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু রাজনৈতিক দিক থেকে জেনারেল ওসমানীকে সমর্থন দানের সুযোগ জাসদের ছিল। পেশাজীবীদের রাজনীতিতে সরাসরি অংশগ্রহণের কথা বলে পেশাজীবীদের রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে অস্বীকার করার কোন যুক্তিই টেকে না। কিন্তু জাসদের অনেকেই তা মেনে নিতে পারেন নি। এতে বিভেদ তীব্র আকার ধারণ করে। মেজর জলিল নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর কোন জাসদ নেতা দলের বাইরে চলে যাবেন এটা জাসদের অনেকেরই কাংক্ষিত ছিল না।
সিওসি সংগঠনের বৃহত্তর স্বার্থেই গঠিত হয়েছিল। পরে তা রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ও বিভিন্ন কারণে ভেঙ্গে দেয়া হয়। অনেকে মনে করেন সিওসি ভেঙ্গে দেয়ার ফলে আস্থাহীনতার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছে। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে মনে হয়, বৃহত্তর স্বার্থে তা গঠিত হয়েছিল। যদি বৃহত্তর স্বার্থে (আপেক্ষিক ভাবে ক্ষুদ্র কোন কৌশল নয়) তা গঠিত হয়ে থাকে, তবে কোন রাজনৈতিক কারণে তা ভেঙ্গে দেয়া হয় তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তার উল্লেখ থাকা উচিত ছিল। বলা হয়, সিরাজুল আলম খান নিজেই সিওসি ভেঙ্গে দেন। এ প্রেক্ষিতেই বলা হয়েছে, সিরাজুল আলম খানের পক্ষে আগের মত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ফিরে যাওয়া অসম্ভব নয়। কিন্তু তিনি কি বলতে চান বা করতে চান তা যদি মুখ খুলে বলেন বা করেন তা হলে বিভ্রান্তির আশংকা কমে যাবে। বাস্তবে তা হয়নি, হচ্ছে না। বরং অন্যরা মনে করছেন কেন্দ্রীয় ফোরাম ভেঙ্গে যাওয়ায় ভুলগুলো আঙ্গুল দিয়ে দেখানোর কেউ থাকছে না।
অন্তর্বিরোধের শ্লোগান
জাসদের অভ্যন্তরে এখন যে রাজনৈতিক বিষয়টি প্রখর হয়ে উঠছে তা হলো পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব। অত্যন্ত প্রকট ভাবে বলা হচ্ছে জাসদ যে ১৮ দফাকে তার অন্যতম কর্মসূচী বলে দাবী করছে তাতে পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন মনে করা হচ্ছে জাসদ ১৮ দফাকে বাস্তবায়িত করার উপযোগী সংগঠন নয়। এতে পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব নেই এটাকে কারণ বলে দাবী করা হচ্ছে। যে বা যারাই কথাটি তুলে থাকুননা কেন বলতেই হবে কথাটি অত্যন্ত সফলভাবে প্রচারিত হয়েছে। জাসদের সকল মহলে এ ধারণাটি সৃষ্টি হয়েছে যে ১৮ দফা বাস্তবায়নের উপযোগী করে জাসদকে গড়তে হবে। এজন্য পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব নিয়েই সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গড়ে তোলা দরকার। অনুমান করা যায় তারই পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে দলের সাধারণ সম্পাদক কোন একটি পেশা গ্রহনের কথা চিন্তা ভাবনা করছেন। (সাক্ষাৎকার দ্রষ্টব্য)
সমন্বয় কমিটির তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে আন্দোলনে নেতৃত্বে পার্টি প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘একটি সফল পার্টি গড়ে তুলতে হলে আন্দোলনের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসা কর্মী ও নেতাদের অবশ্যই বুঝতে হবে যে পার্টি গড়ার জন্য দরকারঃ ১। পরীক্ষিত কর্মী ও নেতাদের গনতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতায় বিশ্বাস ২। জীবনের সর্ব ক্ষেত্রে ব্যাপ্ত করে চিন্তার একতা গড়ে তুলে আদর্শগত কেন্দ্রিকতা কায়েম। ৩। একই কায়দায় চিন্তা করার পদ্ধতি। ৪। কার্য পদ্ধতির মধ্যে ঐক্য এবং ৫। একগুচ্ছ পেশাদার বিপ্লবী।
তাই যদি হয় তবে পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের অবকাশ কোথায়? আর যদি না থেকে থাকে তবে তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের এই বিভ্রান্তির জন্য দায়ী কে? নাকি বর্তমানে যারা পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব কিংবা ১৮ দফার উপযোগী সংগঠনের কথা বলেন তারা ভুল করছেন বা অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে এ কথা বলছেন? পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের কথা যদি বলা হয় তবে জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রত্যেকেরই তা রয়েছে। আর কিছু না হলেও জাসদের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত সামরিক ব্যক্তি, সাধারণ সম্পাদক চাকরী করেন না বলে তারা বেকার। এবং বেকার হলে সংগঠন করতে পারবেন না এমন কথা বোধহয় পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব দাবীকারীরা বলবেন না। আর পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের কথা বলতে হলে বেকারদের প্রতিনিধিত্বও স্বীকার করে নিতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে মানতে হবে কারও অবসর নেয়ার অধিকারও।
আসলে আলোচিত হওয়া দরকার পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের বিষয়টিই। জাসদ যে সমাজতন্ত্রের কথা বলছে তার মূল উপাদান হচ্ছে সমাজে বুর্জোয়া শ্রেণী কর্তৃক সর্বহারা শ্রেণীকে শোষণ। জাসদ চায় এ শোষণের অবসান ঘটাতে। তাই যদি হয় তবে জাসদের উচিত শ্রেণী প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ করা। একই পেশার মধ্যে বিভিন্ন শ্রেণীর লোক থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্বের কথা বললে শ্রেণী প্রতিনিধিত্ব গুরুত্ব হারায়৷ আর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে সর্বহারা শ্রেণীর একনায়কত্ব। এখানে অন্য কারো অংশীদারীত্বের অবকাশ নেই। অবশ্য পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার জন্য জাসদ যদি মূল বিষয় থেকে সরে আসতে চায় তাতে কারও কিছু বলার নেই৷ তা নির্ধারণ করবেন জাসদের রাজনৈতিক দর্শনের নিয়ন্তারা।
সিরাজুল আলম খান প্রণীত ‘শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা’ র ‘কেন এই প্রস্তাবনার এক স্থানে বলা হয়েছে ‘এই নতুন প্রস্তাবের মধ্যে যারা কেবল নৈরাজ্য – বিশৃঙ্খলা এবং পদ্ধতিগত বিপদ দেখতে পান তারা কি জানেন না বর্তমানে দেশে কি সাংঘাতিক নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা এবং অনিশ্চয়তা বিরাজ করছে? বন্দুক অথবা বল প্রয়োগের মাধ্যমে নীতি নির্ধারণ হবে নাকি একটি রাজনৈতিক প্রণালীই হবে আমাদের দিক নির্দেশক – এ বিষয়ে ভাবনা চিন্তা করা আমাদের প্রত্যেকের উচিত। ‘
এ কথা থেকে মনে করা যেতে পারে তার প্রস্তাবনাকে নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী বলে সমালোচনা করলে তিনি তার সরাসরি জবাব দিচ্ছেন না। এতে ঘুণাক্ষরে হলেও সন্দেহ থেকে যায় তার প্রস্তাবনায় নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে৷ তাহলে অর্থ দাড়ায় এই যে এক নৈরাজ্যকে তিনি কাটাতে চাইছেন আরেক নৈরাজ্য দিয়ে৷ আসলে আধুনিক বিশ্বে কোন রাষ্ট্র ব্যবস্থাই নির্ভুল নয়৷ মাও সে তুং – এর চিন্তাধারা নিয়েও খোদ চীনেই বিতর্কের কথা এখন আর কারো অজানা নয়৷ জনাব সিরাজের লেখা সম্পর্কে কেউ যদি বলে যে এতে বিশেষ পেশাকে প্রাধান্য দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে তবে তা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
বর্তমান অবস্থা
গত ২৬ থেকে ৩০ আগস্ট জাসদের জাতীয় কমিটির সভায় গৃহীত ৫ম প্রস্তাবটি নিম্নরূপ ‘জাসদ জাতীয় কমিটির এই সাধারণ সভা সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেছে যে দলের গত জাতীয় কমিটির সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের পর পত্র – পত্রিকায়, রেডিও – টেলিভিশনে দলীয় সভাপতির নামে প্রকাশিত ও প্রচারিত বিভিন্ন সংবাদ, সাক্ষাৎকার ও বিবৃতি দলের গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহের সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় এবং উহা দলের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করায় কর্মী ও জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ায় এই সভা গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করছো এবং এ ধরণে কার্যক্রমকে অনভিপ্রেত ও অসাংগঠনিক বলে বিবেচনা করছে। তাই এ ধরণের অসাংগঠনিক কার্যকলাপ রোধ কল্পে এই সভা নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেঃ দলীয় সভাপতির সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে এখন থেকে আগামী ডিসেম্বর ‘৮৩ ইং এ অনুষ্ঠিতব্য কাউন্সিল পর্যন্ত কোনরূপ কর্মীসভা, জনসভা ও পত্র পত্রিকা সহ সকল প্রকার মাধ্যমে বক্তৃতা বিবৃতি সাক্ষাৎকার প্রেস ব্রিফিং বক্তব্য ইত্যাদি দিতে পারবেন না৷ উপরোক্ত সিদ্ধান্ত লংঘন করলে অত্র সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে এবং এই সিদ্ধান্তের অংশ হিসাবে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য ও কার্যকর করা হবে। ‘
এর পাশাপাশি মেজর জলিলের বিদেশ গমন এবং জিয়া উদ্দিনের দেশে প্রত্যাবর্তন দলে মেজর জলিলের অবস্থান এবং দলীয় সংহতি মারাত্মক সংকটের সম্মুখীন বলে পর্যবেক্ষক মহল অনুমান করছেন।
সিরাজুল আলম খানের পদত্যাগ প্রশ্নে তার কারণ জানা এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জনাব খানের সঙ্গে আলোচনা করে এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট পেশ করার জন্য আ স ম আবদুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম জিকু, হাসানুল হক ইনু এবং কাজী আরিফ আহমেদকে নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে উক্ত সভায়ই আ স ম আবদুর রবও সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। অন্য দিকে কেউ কেউ মনে করছেন, ক্ষমতার টোপে জাসদের ১৮ দফার বহুলাংশে মিল রয়েছে এই ধুয়ো নতুন গঠিতব্য ফ্রন্টে যোগদান করবেন। জাসদের অভ্যন্তরে এ চিন্তাটি আছে। সন্দেহও আছে বর্তমান প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কে উচ্ছসিত প্রশংসা, জিয়াউর রহমানের গ্রাম সরকারকে ঘুমন্ত গ্রাম বিপ্লব নামে অভিহিত করার মত চাটুকারিতাই করা হচ্ছে?
এ অবস্থায় জাসদ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে জাসদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ আলোচনা করা হয়। তাদের কেউ কেউ বলেন, জাসদের বিলুপ্তি অবশ্যম্ভাবী, কেউ কেউ প্রথাসিদ্ধ ভাবে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। কেউ কেউ ভবিষ্যৎ সম্পর্কে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। আলাপ আলোচনার পর আমাদের বিশ্বাস জন্মেছে জাসদে বিভক্তি এখন কেবল সময়ের ব্যাপার এবং তা ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। ডিসেম্বর মাসের দিকে যা কিছু একটা ঘটে যাওয়ার আশংকা (সম্ভাবনা) রয়েছে। দলের সভাপতি অবসরপ্রাপ্ত মেজর এম এ জলিলের সাক্ষাৎকার চাইলে তিনি জানান’ এখন তিনি কিছুই বলবেন না। ৩০ সেপ্টেম্বরের কর্মসূচী সফল করার জন্য তিনি চেষ্টা করছেন। তবে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা এমন যে চুপ করে থাকা সম্ভব নয়। ৩০ সেপ্টেম্বরের (এ প্রতিবেদন প্রকাশের তারিখে) পর তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন তার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সম্পর্কে। দলীয় সিদ্ধান্তের জন্যই তিনি সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকার করছেন কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন সাংবাদিকদের কাছে তিনি কিছুই বলবেন না। সাংবাদিকদের সম্পর্কে তার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে ১১ টি অভিযোগের খবর দিতে তারা তাকে একবার জিজ্ঞাসাও করেননি। তবে মুখ বন্ধ করে থাকার পাত্র তিনি নন। যখন দল ছিল না তখনও তিনি সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম কথা বলেন। অনেক অনুরোধের পর তিনি দেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনায় রাজী হন৷ কিন্তু নির্ধারিত সময়ে তিনি জরুরী কাজে বাইরে চলে যান।
এখানে অন্য কয়েক জন জাসদ নেতার সাক্ষাৎকার পত্রস্থ করা হলো। আমাদের বিশ্বাস এ থেকেই পাঠক জাসদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ অবস্থার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাবেন।
***
জাসদও পুরনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিলুপ্ত হবে
– সিরাজুল আলম খান
জাসদের রাজনৈতিক রূপরেখা তৈরি করেছিলেন সিরাজুল আলম খান। এখন তিনি দৃশ্যতঃ জাসদে নেই। জাসদের কর্মী এবং নেতাদের মহলে তিনি ছিলেন পিতামহ তুল্য। অথচ জাসদ ও তার সব অঙ্গ সংগঠনের সকল কমিটি থেকে তিনি পদত্যাগ করেছেন। যিনি জাসদ রাজনীতির দ্রষ্টা তার পদত্যাগ নিশ্চয়ই জাসদের ভবিষ্যতের উপরও সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে এই ধারণায় সাক্ষাৎকার নেয়ার চেষ্টা করা হয়।
শ্মশ্রুমন্ডিত মুখমন্ডল, দীর্ঘ একহারা অবয়বের উপর স্থাপিত। জাসদ ছেড়ে দিয়ে তিনি এখন ‘মশাল’ নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার অফিসে দিনের দীর্ঘ সময় কাটান। বোঝাই যায়, পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে তিনি নিজেকে জড়িত করেছেন। বলেন, আগামী দু’ বছর খুব ব্যস্ত থাকবেন।
সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য অনুরোধ করলে তিনি জানান, সাক্ষাৎকার দেয়ার ব্যাপারে তিনি বিন্দুমাত্র উৎসাহী নন। কখনও তা দেন নি এবং দেবেনও না। পত্রিকায় তাকে নিয়ে কি লেখা হলো তাতেও তার কিছু এসে যায় না। তবে আমাদের সঙ্গে তার বই ‘শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা’ সম্পর্কে ও রাজনৈতিক আলোচনায় তিনি আগ্রহী।
আমরা আমাদের আলোচনার সারবস্তু প্রকাশের অনুমতি চাইলে তিনি বলেন তা সাক্ষাৎকার হিসেবে ছাপা যাবে না। এই শর্ত মেনে নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনায় যা বোঝা গেছে তা তুলে দেয়া হলো। আমরা আশা করি, পাঠক এ থেকে তার সঙ্গে আলোচনার পরিধি অনুমান করতে সক্ষম হবেন। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়। (১) দেশের রাজনৈতিক অবস্থা কেমন? (২) বর্তমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে মঙ্গলজনক রাজনৈতিক ব্যবস্থা কি হতে পারে? (৩) বর্তমান রাজনৈতিক দল গুলো সম্ভাব্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারে কি না? (৪) শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা পুস্তিকায় যে ধরণের সংবিধানের সুপারিশ করা হয়েছে তা বাস্তবায়নের কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে কি না? (৫) তার দল জাসদে কোন সংকট আছে কি না? (৬) পদত্যাগের সিদ্ধান্তে তিনি অনড় থাকবেন কি না? (৭) জাসদের বিলুপ্তির আশংকা আছে কিনা? (৮) ১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ সালের মধ্যে জাসদের রাজনীতিতে পরিবর্তন এসেছে কিনা? কথোপকথন থেকে যা পাওয়া গেছে তা নিম্নরূপঃ
১। ‘শুরু থেকেই বাংলাদেশ অব্যবস্থার শিকার। মুক্তিযুদ্ধে জন্ম নেয়া সামাজিক শক্তি গুলো ভুল পথে পরিচালিত হয়। তাদের ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে দেয়া হয়নি। বার বার সরকার পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন ছিল না। অনাকাঙ্ক্ষিত উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে জাতি এগুতে থাকে। সেই অস্থির অবস্থা এখনও বিরাজমান।
বর্তমান সরকারনপ্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে। কারও পক্ষে এ বিকেন্দ্রীকরণের ফলফলের অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা সম্ভব হবে না। কারণ জনগণ এ থেকে সুফল গ্রহণ করা শুরু করবে। এ থেকে জনগণের সঙ্গে সরকারের পরিচিতি গড়ে উঠেছে। আগে যা কেবল নগরবাসীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই সবাই একে যার যার ইচ্ছে মত রূপ দিতে চেষ্টা করবে। আমাদের করণীয় হচ্ছে একে আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে যতটুকু কাজে লাগানো যায় তার চেষ্টা করা। (উদ্ধৃতি শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা পুস্তিকা থেকে)
২। ‘আমাদের মত শোষণমূলক একটি সমাজে কেবলমাত্র একটি সমাজ বিপ্লবই স্থিতিশীলতা ও উন্নতির নিশ্চয়তা বিধান করতে পারে। যার পরবর্তীতে গড়ে উঠবে একটি শোষণহীন সমাজ। শ্রেণী ও পেশাজীবি গ্রুপ প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি সমাজ বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারে। বস্তুতঃ যখন সামাজিক শক্তিগুলো ‘নীচের দিক থেকে’ ঘনীভূত হতে থাকে তখন সেই শক্তিগুলোকে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায় রূপান্তরিত হতে সহায়তা করার জন্য ‘উপর থেকে’ পরিচালিত ক্রিয়াকর্মের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। প্রস্তাবিত এই শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা এক্ষেত্রে অগ্রদূতের ভূমিকা পালন করতে পারে। ‘
৩। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো সম্ভাব্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব দিতে পারবে না। কারণ এতে পেশাজীবীদের নেতৃত্ব নেই। দলের নেতৃত্বে তা না থাকলে দল রাজনৈতিক সুবিধাভোগ নেতৃত্বের কব্জাগত হয়ে পড়ে। বর্তমানে দোশের কোন দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পেশাজীবীদের সমন্বয় ঘটেনি।
৪। অবশ্যই কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। বর্তমান সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যায়ে যত প্রকার কাঠামোগত বিন্যাস আছে তার পরিবর্তন করতে হবে। রাজনৈতিক দল গুলো পুনর্গঠন করতে হবে৷ রাজনৈতিক দল গুলোকে কোন বা কোন কোন পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব করবে তা নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক দল গুলোর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হবে পেশাজীবীদের মধ্যে থেকে৷ ব্যক্তিগত বা ব্যাক্তি পছন্দ থেকে তা হবে না। এ মুহূর্তে রাজনৈতিক দল গুলো দিয়ে পুনর্গঠন সম্ভব নয়। তা করতে গেলে বক্তৃতা বিবৃতির শিকারে পরিণত হতে হবে। ক্ষমতাসীনদের মধ্যে থেকে তা হতে পারে।
৫। জাসদের মধ্যে অন্তর্দন্দ আছে৷ তার কারণ জাসদের কোন কমিটিতে পেশাজীবির প্রতিনিধিত্ব নেই। জাসদের ১৮ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়নের উপযোগী কমিটি নেই৷ এ সব সমস্যা উত্তরণের জন্য সময়ের প্রয়োজন। জাসদের অনেকের মধ্যে যতদিন পারি নেতৃত্ব টিকিয়ে রাখবো এ ধরণের মনোভাব রয়েছে৷ জিয়া সরকার ক্ষমতায় আসার পর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে পেশাজীবীদের সমন্বয় করার চেষ্টা করেছিলেন। জাসদের পেশার সংগঠন নেই৷
৬। কোন কাজ তিনি হুট করে করেন না। ভেবে চিন্তে করেন। পদত্যাগের ব্যাপারে যে টুকু করার তা তিনি করেই ফেলেছেন। এখন অনড় থাকা না থাকার কোন প্রশ্নই উঠকে পারে না।
৭। পেশাজীবীদের সংগঠন গড়ে উঠতে উঠতে নিরাকরণের নিরাকরণ পদ্ধতির মধ্য দিয়ে পুরনো রাজনৈতিক শক্তি বিলুপ্ত হয়ে যাবে৷ জাসদও পুরনো রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিলুপ্ত হবে।
৮। বিষয়বস্তুকে নয় ধারায় পরিবর্তন এসেছে।
***
যখন মনে করব পরিস্থিতি আমার অনুকূলে তখন আবার দায়িত্ব নেব
– আ স ম আবদুর রব
প্রশ্নঃ জাসদের সাংগঠনিক অবস্থা কি?
উত্তরঃ আমি জাসদের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে পদত্যাগ করেছি। বর্তমানে বিভিন্ন জায়গায় চাকরীর খোঁজ করছি৷ এমন হতে পারে আমি সাংবাদিকতায়ও আসতে পারি৷
প্রশ্নঃ হঠাৎ করে পদত্যাগের কারণ কি?
উত্তরঃ পদত্যাগের কারণ দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতি সমাজের নতুন নতুন দ্বন্দ্বের সৃষ্টি। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদা আমি আর পূরণ করতে পারছি না বলে মসে করছি৷ তেমনি আমার সহকর্মীরাও হয়তো চান পুরনো কায়দায় সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করতে৷ কিন্তু ‘৭৩ এবং ‘৮৩ সালের পরিস্থিতি এক নয়৷ সে সময়ে সমাজে যে সমস্ত কারণগুলো বিদ্যমান ছিল – ‘৮৩ সালে তা আর নেই৷ দেশে মুক্ত অর্থনীতি চালু হবার পর দেশের সামগ্রিক অবস্থার প্রেক্ষিত পরিবর্তন হয়েছে। সরকার স্বীয় উদ্যোগে বানিজ্য পুঁজিকে শিল্প পুঁজিতে রূপান্তরিত করার প্রয়াস নিয়েছে। ‘৭৩ সালে শেখ মুজিবের কাছে প্রাক্তন শিল্পপতিরা পাত্তা পায় নি। তাই তারা জাসদকে চাঁদা দিয়েছে। বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। আজকে সরকার নিজে তাদের আশ্রয় দিয়েছেন। মুজিব যা করেনি, জিয়া যা পারেনি এরশাদ তাই করেছে। বর্তমান সরকার দেশে মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রবর্তন করেছে।
সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর দ্বন্দ্বগুলোকে সংগঠিত ও তীক্ষ্ণ করতে না পারলে এ থেকে পরিত্রাণ পাবার পথ নেই।
তাছাড়া সবচেয়ে বড় কথা, দেশের রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি জনগণের আস্থা কমে গিয়েছে। সর্ব মহল থেকে প্রচারণা চালানো হচ্ছে, দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য রাজনীতিবিদরাই দায়ী। তারাই দেশের সর্বনাশ করেছে। অথচ কেউ এর কোন প্রতিবাদ করছেন না।
প্রশ্নঃ রাজনৈতিক দল গুলোর প্রতি জনগণের আস্থা কমে যাবার পেছনে কি শুধুমাত্র অপপ্রচারণাই কাজ করছে – না রাজনীতিবিদরাও এর জন্য দায়ী?
উত্তরঃ রাজনীতিবিদরাও তাদের দায়িত্ব এক কথায় এড়াতে পারবেন না। দেশের আর্থ- সামাজিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আন্দোলন ও সংগঠনের মাধ্যমে জনগণকে পরিচালনা করা রাজনৈতিক দল গুলোর কর্তব্য। তা তারা করতে ব্যর্থ হয়েছে। তা ছাড়া একজন পার্টি প্রধান যদি আদম রফতানীর কাজে নিয়োজিত হন তবে সে পার্টির প্রতি জনগণের আস্থা থাকে কি করে? তারা কিভাবে বিশ্বাস করবে জলিল সাহেব আদম রফতানী করেন, রব সাহেব করেন না।
প্রশ্নঃ আপনারা পেশাভিত্তিক রাজনীতির কথা বলছেন। একজন রাজনীতিকের যদি জনশক্তি রপ্তানীর ব্যবসা পেশা হয়, তাতে ক্ষতি কি?
উত্তরঃ আদম রপ্তানী আর আদম রপ্তানীর নামে জনগণের সাথে প্রতারণা করা এক কথা নয়। একজন সচেতন ব্যক্তি কোন ক্রমেই আদম রপ্তানীর কাজে নিয়োজিত হতে পারেন না। একজন সমাজতান্ত্রিক নেতা কোনক্রমেই তার কর্মী ও জনগণকে জায়গা, জমি বিক্রি করে বিদেশে যাবার প্রলোভন দেখাতে পারেন না। সে তার জায়গা জমিতে উৎপাদন বৃদ্ধি করার উপদেশ দিবে। প্রয়োজন বোধে সরকারী ঋণ নিয়ে সে তার উৎপাদন বৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করবে। এতে দেশের উৎপাদন বাড়বে। তাছাড়া বাংলাদেশের মতো একটি দেশে জনশক্তি রফতানী করা অপরাধেরই নামান্তর।
এর মাধ্যমে দেশের দক্ষ জনশক্তি মেধা দেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশীয় জনশক্তি বিদেশের উন্নয়নের কাজে লাগছে। নিজের দেশ অনুন্নত থেকে যাচ্ছে। দক্ষ গাড়ির চালকদের বিদেশে পাচার করার ফলে দেশে দূর্ঘটনার হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রশ্নঃ সরকারী নীতিতে জনশক্তি রফতানী বৈধ। সেক্ষেত্রে একজন রাজনীতিবিদও যদি….
উত্তরঃ আগেই বলেছি সরকারী এ নীতির বিরোধী আমি। তাছাড়া একটা নির্দিষ্ট সময় সীমা পর্যন্ত পণ্য মজুদ রাখা বৈধ হলেও কালোবাজারী করা নিশ্চয়ই বৈধ নয়।
প্রশ্নঃ আপনার পদত্যাগ ও চাকরি অন্বেষণ কি আপনার দলের রাজনৈতিক দর্শনের জন্য?
উত্তরঃ আপনি এটাকে যেভাবেই ব্যখ্যা করেন না কেন, আমার জন্য আজকে এটাই বাস্তবতা। রাজনীতি পেশা হিসেবে স্বীকৃত নয়। আর রাষ্ট্র পরিচালনায়, রাষ্ট্রের উৎটাদন ও বন্টনে জনগণের অংশীদারিত্ব ছাড়া অন্য কোন ব্যবস্থায় জনগণের কোন উপকার হবে না। তার প্রক্রিয়ায় পেশাজীবীদের ভূমিকা নিশ্চিত করতেই হবে। আমি আগেই বলেছি পুরনো ঢং এ সংগঠন ও আন্দোলন পরিচালনা করা এই দেশে আর সম্ভব নয়। কারণ এটা ‘৮৩ সাল, ‘৭২ সাল নয়। ‘৮৩ সাল হল রাজনীতিবিদদের জন্য মহামারীর বছর৷ এর আগে জিয়াউর রহমানের আমলে ‘কলেরা’ দেখা দিয়েছিল। ‘৮৩ সালের মহামারীতে কয়টা রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ যে টিকে থাকবে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। ‘৮৩ সালের সমাজের বাস্তবতা ও জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তুলতে না পারলে কোন রাজনীতিবিদের পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ জাসদের সাংগঠনিক বিন্যাস কি জাসদের কর্মসূচী বাস্তবায়নের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে সাজানো হয়েছে?
উত্তরঃ ‘৭২ থেকে ‘৭৪ পর্যন্ত জাসদ ছিল একটা বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। এ সময়ে জাসদের উপর বহু আঘাত এসেছে। ‘৭৫ এর পর জাসদ তার দলীয় পুনর্গঠনের যে সুযোগ পেয়েছে – জাসদ তা পুরোপুরি সদ্ব্যবহার করতে পারেনি।
প্রশ্নঃ সিরাজুল আলম খান এবং আপনি প্রায় একই সময় পদত্যাগ করলেন। দুজনের পদত্যাগের কারণ কি একই?
উত্তরঃ না। তিনি কি কারণে পদত্যাগ করেছেন তা তিনি কাউকে বলেননি। আমি কারণ বলেছি। সেটা হল আমার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে অক্ষমতা। আমার কাছে জনগণ, আমার সহকর্মীরা যা চায় তা আমি দিতে পারছি না। ‘৭৩ সালে আমার পেছনে বিশ হাজার লোক ছিল, আজ আমার পেছনে ২০ জন লোকও আছে কি না তা আমাকে ভেবে দেখতে হবে৷ এ সত্যটা যদি আমার সহকর্মীরা না বোঝেন তাহলে আমি কিভাবে এগুবো। তাই আমি চাই আমার পক্ষে যা অসম্ভব অন্য কারও পক্ষে যদি তা সম্ভব হয় তা হলে তিনি এগিয়ে আসুন। দলে নতুন নেতৃত্ব সব সময়ই কাম্য। এক জনই যে সব নেতৃত্ব দেবে এ চিন্তা করা ঠিক না। আবার যখন মনে করব পরিস্থিতি আমার অনুকূলে তখন আবার দায়িত্ব নেব। আমি সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেছি, জাসদ থেকে নয়।
প্রশ্নঃ জাসদের বর্তমান ১৮ দফা কর্মসূচী সঠিক বলে আপনি মনে করেন কি?
উত্তরঃ বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক অবস্থার সরাসরি পরিবর্তন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। বুর্জোয়াদের পক্ষেও নয় – বিপ্লবীদের পক্ষেও রাতারাতি বিপ্লব করা সম্ভব নয়। সমাজের শ্রেণী শক্তিগুলোকে সংগঠিত করতে জাসদের কর্মসূচীর কোন বিকল্প কর্মসূচী নেই। সেই প্রেক্ষিতে জাসদের কর্মসূচী সঠিক ও এ উপমহাদেশে এটা নতুন।
প্রশ্নঃ জাসদের সাংগঠনিক বিন্যাস যদি এর কর্মসূচী বাস্তবায়নের উপযোগী না হয় – তাহলে?
উত্তরঃ জাসদ না পারুক। অন্য যে কেউ, যে কোন দল তা বাস্তবায়ন করতে পারে৷ তবে এ উপমহাদেশে বিপ্লব করতে হলে বিভিন্ন উপাদানগুলোকে এভাবেই বিন্যস্ত করতে হবে।
প্রশ্নঃ সিরাজুল আলম খানের শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা সঙ্গে জাসদের ১৮ দফার কোন অমিল আপনি লক্ষ্য করেন কি?
উত্তরঃ সিরাজুল আলম খান জাসদের পক্ষ থেকে এ বই লেখেননি। এটা হল শাসনতান্ত্রিক ব্যাপার। শাসনতন্ত্রে কোন দল কি করবে তা লিখা থাকে না৷ এবং এটা হল একটি নতুন চিন্তা ধারা। পৃথিবীর কোথাও পেশাজীবীদের প্রতিনিধিত্ব সহ শাসনতান্ত্রিক রূপরেখার কোন রেফারেন্স খুঁজে পাওয়া যাবে না। জাসদের সিরাজুল আলম খান এ বই লিখেছেন, তিনি এখনো পর্যন্ত জাসদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। এ ব্যাপারে জাসদের ১৮ দফা কর্মসূচীর সঙ্গে আমার যে সমস্ত জায়গায় খটকা ঠেকেছে সে সমস্ত ব্যাপারে তার সঙ্গে আলাপ করতে হবে। আলাপ না করে এ সম্পর্কে মন্তব্য করা যাবে না।
প্রশ্নঃ ৩০ সেপ্টেম্বরের দাবি দিবস সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
উত্তরঃ আমি তো পদত্যাগ করেছি৷ তবে ৩০ তারিখ যদি বিরোধী দলগুলি জনগণের কাছে তাদের ভবিষ্যৎ কর্মসূচী ঘোষণা করকে না পারে তবে এ দেশে বর্তমান বিরোধী রাজনৈতিক দল গুলো অনেক পিছিয়ে পড়বে।
প্রশ্নঃ আপনি তো বলেছেন, শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমান মুক্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করতে পারে নি বলে তারা প্রাণ দিয়েছেন। বর্তমান সরকার তা করছেন। তবে কি এ সরকার টিকে যাবে?
উত্তরঃ এর উত্তর এখন দেয়া যাবে না। সময় এবং পরিস্থিতি এর উত্তর দিবে৷
***
কাজের মধ্য দিয়েই জনগণ জানুক আমরা কি চাই।…. মুখ খুলে লাভ কি?
– শাহজাহান সিরাজ
প্রশ্নঃ গত জাতীয় কমিটির বৈঠকে আপনাদের সভাপতি সম্পর্কে আপনারা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?
উত্তরঃ পত্র-পত্রিকায় যে ভাবে খবরটি এসেছে ঠিক সে ভাবে তা ঘটেনি। তবে কিছু কিছু সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে৷ এ ব্যাপারে পার্টির সিদ্ধান্ত তা প্রকাশ না করা। পার্টির আগামী দিনের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই আপনারা তা জানতে পারবেন।
প্রশ্নঃ জাসদের রাজনীতিতে অদূর ভবিষ্যতে কোন পরিবর্তন আসবে কি?
উত্তরঃ এ ব্যাপারে পার্টির কিছু সিদ্ধান্ত আছে। তবে এ মুহূর্তে বলতে পারি না। দেশে একটা ঝড় উঠেছে। তাতে বেশ কিছু ওলট-পালট হবে।
প্রশ্নঃ ঝড়ের আকৃতিটা কি হতে পারে?
উত্তরঃ এ সব বিষয়ে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত আছে মুভমেন্ট করা। দেশে সামরিক শাসন বিদ্যমান। গণতান্ত্রিক অধিকার, নির্বাচন, সার্বভৌম পার্লামেন্টের ভিত্তিতে নির্বাচন, মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা, এসব তো আন্দোলন ছাড়া আদায় করা সম্ভব নয়। এ ব্যাপারে আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত পরিষ্কার, দলীয় ভাবে এবং ঐক্যবদ্ধ ভাবে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা। আমরা চেষ্টা করবো আমাদের দলীয় সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে।
প্রশ্নঃ অতীতে আন্দোলন সংক্রান্ত বহু সিদ্ধান্ত আপনারা দলীয়ভাবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে দলীয়ভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয়া হয়নি!
উত্তরঃ সেটা তো সব সময় সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে না৷ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনটাই হল ব্যাপক জনগণের ঐক্য এবং বিভিন্ন দলের ঐক্য। বাংলাদেশে বিভিন্ন দলের ঐক্যের অবস্থাটা যে কি তা তো আপনারা বুঝেনই। তবে জাসদ বহু দিন ধরেই চেষ্টা করে আসছে জনগণকে সংগঠিত করে একটা ব্যাপক গণ আন্দোলন গড়ে তুলতে।
প্রশ্নঃ জাসদের ১৮ দফা এবং সরকারের ১৮ দফার মধ্যে মিল কতটুকু?
উত্তরঃ সরকারী ১৮ দফার মধ্যে আর জাসদের ১৮ দফার মধ্যে পার্থক্য আকাশ পাতাল৷ আমরা মনে করি দেশ জনগণের কিন্তু পরিচালনা করার অধিকার কোন দিন এ দেশের জনগণ পায়নি৷ একটা দল ক্ষমতায় এলেই সে জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে – তা ঠিক। কিন্তু যারা খেটে খায়, এ দেশের কৃষক, শ্রমিক, মেহনতি মানুষ, বিভিন্ন পেশার মানুষ, দেশের শাসন ক্ষমতায় এদের অংশীদারিত্ব নিশ্চিত না হলে – আসলে দেশের কোন মঙ্গল হবে না। এ জন্যই আমরা মনে করি, ৭২ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ৩শ সিটের পার্লামেন্টের সঙ্গে বিভিন্ন পেশার আংশিক আসন যোগ হলে, অর্থাৎ যারা আসলে দেশটাকে চালায় তাদের সঠিক প্রতিনিধিত্ব পার্লামেন্টে থাকলে তবেই আংশিক হলেও পার্লামেন্টে জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকবে৷
পার্লামেন্টে বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিত্ব কায়েম হলে বিভিন্ন পেশার লোক সংগঠিত হবার সুযোগ পাবে এবং তারা সংগঠিত শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রাষ্ট্র পরিচালনায় ইতিবাচক ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
ক্ষমতায় যাওয়ার চাইতে ক্ষমতা ধরে রাখাটাই বড় কথা। আমাদের দেশে অনেক বড় বড় দল আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছে। কিন্তু তারা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। ভাসমান জনতার সমর্থন দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা যায় না৷ সংগঠিত জনগণের সমর্থনই ক্ষমতা ধরে রাখার সহায়ক। আর বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা যা, তাতে করে একটি দলের ইচ্ছা থাকলেও সে কোনমতেই এ পার্লামেন্টে জনগণের পক্ষে আইন পাশ করাতে পারবে না।
সরকারের ১৮ দফার সঙ্গে জাসদের ১৮ দফার কোন মিল নেই৷
প্রশ্নঃ আপনাদের এ আন্দোলন ও কর্মসূচীর ব্যাপারে আপনাদের মধ্যে কোন মত পার্থক্য আছে কি?
উত্তরঃ লক্ষ্যের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আন্দোলনের কৌশল সম্পর্কে মতের ভিন্নতা আছে।
প্রশ্নঃ জাসদের মধ্যে যে অবস্থা, যে অবস্থাটাকে দলের অনেক কর্মী নেতৃত্বের সংকট বলে মনে করে, সে অবস্থায় দলের কর্মসূচী বাস্তবায়নের আন্দোলন পরিচালনা করা কতটা সম্ভব?
উত্তরঃ আন্দোলন বা পার্টি দু একজন নেতার উপর নির্ভর করে না। সমগ্র দল যা সিদ্ধান্ত নেবে পার্টি বা আন্দোলন সেভাবেই পরিচালিত হবে। নেতৃত্বের ব্যাপার তো এখানে গৌণ, পার্টিই প্রধান।
প্রশ্নঃ আগে জাসদে যে শৃঙ্খলার বিন্যাস ছিল তা কি এখনো অটুট আছে?
উত্তরঃ গত ১০ বছরে জাসদ বিভিন্ন ঘাত – প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এখানে এসেছে৷ রাজনৈতিক, সাংগঠনিক প্রশ্নে দলে বিভিন্ন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। তবে দলে এমন কোন অবস্থার সৃষ্টি হয়নি যে দল ভেঙে যাবে। আমি তো মনে করি জাসদে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক প্রশ্নে যে সব প্রশ্ন উথ্বাপিত হয়েছে – তার মাধ্যমেই দল আরো শক্তিশালী হবে।
প্রশ্নঃ ১১ সেপ্টেম্বরের দাবি দিবসে আপনারা কেন্দ্রীয় ভাবে কোন সমাবেশের আয়োজন করতে পারেন নি। কেন?
উত্তরঃ আমাদের কর্মীরা বসে নেই। তারা কাজ করছেন। তাদের কাজের মধ্য দিয়েই আমাদের যে লক্ষ্য সে দিকে এগিয়ে যাব।
প্রশ্নঃ দলের মধ্যে এমন কি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে যে আপনারা আপনাদের মত করে মুখ খুলে কথাও বলতে পারেন না।
উত্তরঃ বলতে পারি না এটা ঠিক নয়। কাজের মধ্য দিয়েই জনগণ জানুক আমরা কি চাই। এবং আমরা মনে করি এটাই সঠিক। এ ব্যাপারে মুখ খুলে কথা বলে লাভ কি? আমাদের সমস্ত কাজের মধ্য দিয়েই জানবেন আমাদের পার্টির অবস্থা কি? পার্টি কোন দিকে যাচ্ছে।
প্রশ্নঃ শোনা যায় আপনাদের দল থেকে অনেকের বর্তমান সরকারে যোগ দেয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে?
উত্তরঃ জাসদের জাতীয় কমিটিতে আজ পর্যন্ত কেউ এ ব্যাপারে কোন প্রস্তাব উথ্বাপন করেনি৷ দলের এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত নেই। ব্যক্তিগত ভাবে কেউ যদি এভাবে চিন্তা করে বা যোগাযোগ করে থাকে তা পার্টির জানা নেই৷ তবে ভবিষ্যতে তা জানা যাবে।
প্রশ্নঃ জাসদ নেতাদের মধ্যে কেউ যদি সরকারের সঙ্গে যায় তাহলে কি পার্টি ক্ষতিগ্রস্ত হবে না?
উত্তরঃ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যদি কেউ সরকারী দলে যোগ দেয় তাতে পার্টির কোন ক্ষতি হবে না। দলের সিদ্ধান্ত যদি থাকে আন্দোলনে আর যদি কেউ যায় সরকারের মধ্যে সেটার দায় দায়িত্ব সম্পূর্ণ ভাবে তার। এতে জাসদের ক্ষতি হবে না। জাসদ জাসদই থাকবে।
প্রশ্নঃ জাসদ বা জাসদ নেতৃত্বের প্রতি কি জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে?
উত্তরঃ সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিই জনগণ হতাশ। রাজনৈতিক দল গুলো যদি সঠিকভাবে কর্মসূচী নিয়ে জনগণের পাশে দাড়াতে পারে তবেই আবার আস্থা ফিরে আসবে।
প্রশ্নঃ আপনাদের দলীয় নেতা ‘সংবিধান ও সাংবিধানিক রূপরেখা’ নামে একটি বই লিখেছেন। এ ব্যাপারে দলের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া পড়েছে কি?
উত্তরঃ এটা দলীয় বই নয়। এটা তিনি ব্যক্তিগত ভাবে লিখেছেন।
প্রশ্নঃ যিনি এ বই লিখেছেন তিনি আপনাদের দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন। তার বই কি ব্যক্তিগত…….
উত্তরঃ তার সঙ্গে আলোচনার জন্য আমাদের দলের পক্ষ থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। আমরা এ ব্যাপারে আলাপ করব। আলাপ আলোচনার পরই আমরা বুঝতে পারব এবং মন্তব্য করতে পারব।
প্রশ্নঃ দলের কর্মীদের ধারণা জাসদের বর্তমান অবস্থার জন্য দায়ী নেতৃত্বের সংকট। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তরঃ নেতৃত্বের সংকট মানে এই নয় যে, লীডারশীপ নিয়ে গন্ডগোল। লীডারশীপের মধ্যে, রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ও বিভিন্ন প্রশ্নে মত বিরোধ থাকতে পারে। এ মত বিরোধ যদি জাসদ রাজনীতির একেবারে পরিপন্থী হয় – তবে এর পরিণতি যা হবার তাই হবে। তবে এখনো পর্যন্ত আমরা একই সিদ্ধান্তে আছি।
প্রশ্নঃ শোনা যায় জাসদ মূলতঃ ৭৫ সাল পর্যন্ত দলের নেপথ্য নেতৃত্ব দ্বারাই পরিচালিত হত৷ জননেতা নামে পরিচিতরা তা শুধু বাস্তবায়ন করতো। বর্তমানে নেপথ্য নেতাদের অবস্থান কেমন। এবং এদের সঙ্গে গণনেতাদের বর্তমানে কোন বিরোধ আছে কি?
উত্তরঃ জাসদ তো এখন ৪ টি ফর্মের মধ্যে আছে, জাসদ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ ও শ্রমিক জোট। এই ৪ টি ফর্ম ছাড়া পর্দার অন্তরালে কোন ফর্ম নেই। সুতরাং এ ব্যাপারে আর কোন বক্তব্য এখনকার মত নেই।
***
ঘরের সব খবর আপনাদের জানা উচিত নয়
– নূরে আলম জিকু
প্রশ্নঃ জাসদের রাজনীতির মূল্যায়ন আপনি কিভাবে করেন?
উত্তরঃ এ দেশের সমাজের প্রেক্ষিতে সঠিক উপলব্ধি এবং কর্মসূচী একমাত্র জাসদই প্রনয়ণ করতে পেরেছে৷ জাসদ এ দেশের শ্রেণীকে যে ভাবে বিশ্লেষণ করেছে ১৯৭৪ সালে, আজকে দেশের সমস্ত বাম দলগুলো তাতে পুরোপুরি না হলেও প্রায় একমত৷ তাছাড়া আজকের বিতর্কঃ সামরিক অংশগ্রহণ করবে কি করবে না। এ প্রশ্ন আজকে সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়ে দিয়েছে।
এ সেনাবাহিনী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে। ফলে এর মধ্যে রাজনৈতিক আকাংক্ষা বিকশিত হয়েছে। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানই তার প্রমাণ৷ তাই আমরা সেনাবাহিনীর রাষ্ট্র ক্ষমতায় অংশগ্রহণের কথা বলেছি৷ শুধু তাই নয়, অন্যান্য পেশাজীবীদেরও প্রতিনিধিত্ব আমরা সরকারে চাই। তবে বর্তমানে আমরা একটু বেকায়দায় পড়ে গেছি। এখন এককভাবে কিছু করার মত শক্তি জাসদের নেই।
প্রশ্নঃ আপনার দলের পক্ষে সমর্থক টানার জন্যে সেনাবাহিনীর মধ্যে কাজ করছেন?
উত্তরঃ আমাদের রাজনৈতিক বক্তব্যই এ ব্যাপারে যখেষ্ট। আজকে সে কথাটাই তারা প্রকাশ্যে বলছে। তাতের সঙ্গে আলাদা গ্রুপিং করে আলাদা কথা বলে এগুলো ঠিক বলে মনে করি না।
প্রশ্নঃ জাসদের বর্তমান শক্তি ৭৩-৭৪ এর চাইতে বেশী না কম?
উত্তরঃ গুণগত ভাবে বেশী, পরিমাণগত ভাবে কম।
প্রশ্নঃ জাসদের জাতীয় কমিটির সর্বশেষ বৈঠকের পর আপনি কি মনে করবেন জাসদ…..
উত্তরঃ এটাতে জাসদ প্রমাণ করেছে জাসদ পরিপক্ব হচ্ছে। জাসদের নেতৃত্ব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সংগঠনের অভ্যন্তরে এ ধরণের কাজ একটা পরিপক্ব দল ছাড়া সম্ভব নয়।
প্রশ্নঃ জাসদের অভ্যন্তরে এখন কি ঘটছে?
উত্তরঃ ঘরের সব খবর আপনাদের জানা উচিত নয়।
প্রশ্নঃ আপনার এ ঘর ১০ কোটি লোকের কাজেই এ সম্পর্কে জানার অধিকার আছে।
উত্তরঃ অধিকার যেমন আছে তেমনি যেটুকু জানানোর তা আমরা সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছি। আজকে যে অবস্থা জাসদের ভিতরে তা সমাজের অস্থিরতা এবং নৈরাজ্যেরই প্রতিফলন।
প্রশ্নঃ আমরা কি বলতে পারি সমাজের নৈরাজ্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে রাজনৈতিক দল গুলো ব্যর্থ হয়েছে?
উত্তরঃ এক অর্থে আপনি তা বলতে পারেন। অন্য দিকে রাজনৈতিক দলগুলো সমাজের সার্বিক অবস্থার বাইরে নয়। সমাজের হতাশা থেকে জনগণকে মুক্ত করার যে নেতৃত্ব তা আবার রাজনৈতিক দল গুলো দিতে পারে নি।
আমি মনে করি সমাজের বর্তমান অবস্থায় পুরনো ঢংয়ে কেউ আর রাজনীতি করতে পারবে না৷ আজকে কিন্তু থিসিস হয়ে দাড়াচ্ছে সরকারের নীতি। এটাকে এন্টিথিসিসে নিয়ে যেতে হবে। জনগণ বুঝে হোক আর না বুঝে হোক প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ থেকে মোটামুটি ধরে নিচ্ছে তাদের সরকার আছে। এবং তা তাদের উপকারে আসবে। আমি মনে করি এতে নতুন এলিট শ্রেণীর সৃষ্টি হবে। বর্তমান থিসিস গুলো তখনই এন্টিথিসিস হবে যতক্ষণ পর্যন্ত বর্তমান থিসিস গুলো দ্বন্দ্বের মাধ্যমে এন্টিথিসিসে নিয়ে যাওয়া না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত এখানে আন্দোলন হবে না। দেশের রাজনৈতিক দল গুলো এখনো পর্যন্ত পুরনো কায়দায় আন্দোলন এবং সংগঠন পরিচালনা করার কথা চিন্তা করছে। কিন্তু উদ্ভুত নতুন সমস্যা গুলো বুঝতে পারছে না বলেই সমস্যা সমাধানে দলগুলো ব্যর্থ হচ্ছে।
প্রশ্নঃ এ প্রেক্ষিতে আপনার দলে কোন নতুন রাজনীতি শুরু হবে কি?
উত্তরঃ আমি বলেছি পুরনো কায়দায় কোন রাজনীতি এখানে হবে না। বর্তমানে জনগণের আকাংক্ষা বাম দলগুলো বুঝতে পারছে না। অন্য দিকে বুর্জোয়ারা সমাজ পরিবর্তনের আকাংক্ষাকে নিজেদের পথে ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। জনগণ এখন তাদের অংশগ্রহণ চাইছে বলেই বিকেন্দ্রীকরণ এসেছে।
প্রশ্নঃ জাসদ নেতা সিরাজুল আলম খানের লিখিত বই – এর সঙ্গে জাসদের বর্তমান রাজনৈতিক মতবাদের কোন মত পার্থক্য আছে কি?
উত্তরঃ জাসদের এই মুহূর্তে যে কর্মসূচী বা মতামত তার সঙ্গে এই বইটা একেবারেই অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবে নতুন ডেভেলপমেন্ট এই বইয়ে সংযোজিত হয়েছে।
প্রশ্নঃ জাসদের অভ্যন্তরে বর্তমানে নেতৃত্ব কোন্দল বা ভুল বোঝাবুঝি বা মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব কতটুকু আছে?
উত্তরঃ মতাদর্শগত ভাবে তেমন কোন দ্বন্দ্ব নেই। তবে আমাদের যে অবস্থা, সে অবস্থার প্রতিফলন দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক দলেই পড়েছে। আমাদের দলেও পড়েছে। ফলে আমাদের দল সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন যেমন জনগণের আছে। আমাদের কোন কোন নেতাদের ব্যাপারেও নিজেদের মধ্যে নিজেদের অনেক প্রশ্ন উঠেছে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা। তবে আমরা যে ভাবে এগুচ্ছি, তাতে সঠিক পথই বেরিয়ে আসবে।
প্রশ্নঃ কোন কোন জাসদ নেতার বিরুদ্ধে আদম ব্যবসা সংক্রান্ত অভিযোগ শোনা যায়। এ ব্যাপারে আপনার অভিমত কি?
উত্তরঃ আমরা এ বিষয়টি নিয়ে দলীয় বৈঠকে আলাপ আলোচনা করেছি। এ ব্যাপারে একটা জনশ্রুতি আছে। সেই জনশ্রুতির প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যই অভিযোগ সত্যি কি মিথ্যা তা যাচাই করার জন্য দল থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তা তদন্ত করে দেখবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত কমিটি কোন রিপোর্ট না দিবে ততক্ষণ পর্যন্ত এ ব্যাপারে কোন মন্তব্য করতে পারি না।
***
জাসদের অভ্যন্তরে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে
– হাসানুল হক ইনু
প্রশ্নঃ জাসদের জন্মের পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত তার রাজনীতিকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
উত্তরঃ জন্মলগ্ন থেকেই জাসদের রাজনীতি ও আন্দোলনকে ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা বহির্ভূত রাজনৈতিক অঙ্গন কখনো উপেক্ষা করতে পারে নি। জাসদের সফলতা – বিফলতার প্রশ্নে এখনো বিতর্কের শেষ না হলেও এটা সবাই স্বীকার করবেন যে, পরিস্থিতির উপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে জাসদ কখনো ব্যর্থ হয়নি এবং সকল দেশী বিদেশী শাসকগোষ্ঠী লেজুড়বৃত্তির বিরুদ্ধে জনগণকে প্রতিবাদের ভাষা জোগান দিতে এবং প্রতিরোধের বলিষ্ঠ কায়দা রপ্ত করতে সাহায্য করেছে। সশস্ত্র প্রতিরোধ ও নিরস্ত্র গণ আন্দোলন, এই দুই কায়দায় জনগণকে রুখে দাড়াতে সাহায্য করেছে এবং এই প্রথমবারের মত এত ব্যাপকভাবে সমাজতন্ত্রের স্বপক্ষে ও বাম গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রতি জনসমর্থন গড়ে তুলেছে৷
বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ঘোষণা ৭২-৭৩ এ বিদেশী প্রভাব, স্বৈরতান্ত্রিক বিধি ব্যবস্থা ও অর্থনৈতিক শোষণের বিরুদ্ধে সাধারণ কর্মসূচী প্রণয়ন করে আন্দোলনের পদক্ষেপ গ্রহণ করার পর হতে বিগত বছরগুলোতে জাসদ রাজনীতির কর্মসূচীগত দিকে যথেষ্ট বিকাশ সাধন হয়েছে। ৭৪ সনের ১৩ অক্টোবর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২৯ দফার পূর্ণাঙ্গ আর্থ সামাজিক কর্মসূচী প্রনয়ণ করে জন সমক্ষে হাজির করা হয়। কিন্তু ৭৭ এর পরবর্তী কালে ২৯ দফা কর্মসূচীতে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের কোন সুস্পষ্ট বক্তব্য না থাকার কারণে তা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। মৌলিক ঘোষণার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরিপূর্ণ বিলোপ সাধন ও অনুন্নত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার অবসান কল্পে – (১) বিভিন্ন শ্রেণী, পেশাসহ প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রতিনিধি সমন্বয়ে সার্বভৌম সংসদ ও (২) ‘কেন্দ্রীয় সংস্থা’, (৩) স্তরে স্তরে শ্রেণী ও পেশার প্রতিনিধি সহ স্বশাসিত নির্বাচিত সংস্থা, (৪) ক্ষেত মজুরদের লেবার ওয়ার্ক বিগ্রেড, (৫) রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণ, (৬) ‘খোদ কৃষকের হাতে জমি ও সমবায়’ এর ভিত্তিতে ব্যাপক ভূমি ও কৃষি সংস্কার, (৭) বৃহৎ শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে, ছোট ও মাঝারি শিল্প ব্যক্তিগত খাতে সহ আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য সমন্বয়ে ১৮ দফা কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয়, যার উল্লেখযোগ্য দিক গুলোর রাজনৈতিক গুরুত্বের কথা কেউই অস্বীকার করতে পারছেন না এবং সব মহলেই আলোচিত হচ্ছে।
৭২ থেকে জাসদ রাজনীতি ও আন্দোলনের গতিধারা সমাজ ও রাষ্ট্রকে যেভাবে আলোড়িত করেছে, তা ৭৭ এর পরে জাসদ আত্মস্থ করে ১৮ দফার মত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচী প্রণয়ন করতে সক্ষম হলেও ইদানিং কালে ১৮ দফা কর্মসূচীর আলোকে উপযুক্ত পদক্ষেপ ও রাজনৈতিক কার্যক্রম করতে তেমন ভাবে সফল হয়নি। কিন্তু তারপরও সমাজ প্রগতির আন্দোলনে জাসদ রাজনীতি এখনো যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ক্রিয়াশীল।
প্রশ্নঃ জাসদের জন্মলগ্নে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি যা ছিল বর্তমানেও কি তা আছে? পরিবর্তন হলে উল্লেখযোগ্য দিক গুলো কি কি?
উত্তরঃ জাসদের জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত ৭২ সনের সংবিধান আজ বিভিন্ন সংশোধনীর বেড়াজালে আটকে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী সংবিধানে পরিণত হয়েছে৷
৭২ থেকে ৭৬ পর্যন্ত একটা পর্ব এবং ৭৭ থেকে ৮৩ পর্যন্ত আরেকটা পর্ব ধরে নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের ধারায় যে চিত্র আমরা দেখতে পাই তা হচ্ছে –
১। জাসদের জন্মলগ্নে জাতীয় চেতনা প্রবল ও বলিষ্ঠ ছিল এবং তার বহিঃপ্রকাশও ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বের সূচনা থেকেই জাতীয় চেতনা স্তিমিত হতে থাকে এবং এখন তা যথেষ্ট স্তিমিত হয়ে পড়েছে।
২। প্রথম পর্বে জনগণের মধ্যে সাম্প্রদায়িক চেতনা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়েছিল, কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে সাম্প্রদায়িক ধ্যানধারণা ধূমায়িত হয়ে উঠেছে৷
৩। প্রথম পর্বে রাজনৈতিক অঙ্গনে সন্ত্রাস ছিল কিন্তু তার বিপরীতে প্রতিরোধও ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে প্রতিরোধের ধার প্রায় নেই বললেই চলে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে দূর্নীতি ও অসততা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৪। প্রথম পর্বের তুলনায় দ্বিতীয় পর্বে সাম্রাজ্যবাদ ও পশ্চিমা বিশ্বের লগ্নী পুঁজির অনুপ্রবেশ বেশী ঘটেছে এবং তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। ফলে রাষ্ট্র বাঁধা পড়ছে অসম্মানজনক চুক্তিতে এবং নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
৫। প্রথম পর্বে কুলীন বামপন্থী দল ও গ্রুপগুলো জাসদকে বাম সংগঠন হিসেবে স্বীকার না করলেও দ্বিতীয় পর্বে বাম গণতান্ত্রিক সংগঠন হিসেবে স্বীকার করে নিয়ে ঐকবদ্ধ চেষ্টায় শরীক হচ্ছে।
প্রশ্নঃ দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে জাসদের রাজনীতিতে কোন পরিবর্তন কি হয়েছে?
উত্তরঃ জাসদের রাজনীতি ও আন্দোলন মূলত পুঁজিবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রেণী সংগ্রামকে ত্বরান্বিত করে সামাজিক বিপ্লবের মাধ্যমে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হলেও দেশ ও জাতি এখনো পুঁজিবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের সমস্যা থেকে মুক্ত নয়৷ রাজনৈতিক অঙ্গনে যে পরিবর্তন গুলো ঘটছে তা মূলতঃ পুঁজিবাদী শোষণেরই স্থায়িত্ব দান করারই চেষ্টা করছে। তাই মৌলিক ঘোষণার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে এবং তা অর্জন করার জন্য জাসদ সংগতিপূর্ণ কর্মসূচীর ভিত্তিতে আন্দোলন সংগঠন করার কৌশল পাল্টেছে মাত্র। এতে লক্ষ্য অর্জনের জন্য জাসদ রাজনীতি আরো সমৃদ্ধ হয়েছে।
প্রশ্নঃ জাসদের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা কেমন? জাসদ কি বিভক্তির মুখে?
উত্তরঃ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে সেনাবাহিনীর প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ব্যবহার করার ফলে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। অপর দিকে যে আন্দোলনের প্রয়োজন তা গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি বলেই সামগ্রিক রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। জাসদও এই প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। ফলে জাসদের অভ্যন্তরে কিছু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে প্রয়োজনীয় আন্দোলন দরকার তা গড়ার উদ্যোগের মধ্য দিয়ে এবং যে আন্দোলনের উত্তাপে জাসদের অভ্যন্তরে সৃষ্ট সাময়িক সংকট কেটে যেতে বাধ্য।
প্রশ্নঃ জাসদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কি?
উত্তরঃ বর্তমান পরিস্থিতিতে জাসদ প্রণীত ১৮ দফা কর্মসূচীর প্রেক্ষিত ও দৃষ্টিভঙ্গী জনগণের সামনে তুলে ধরাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন অবিলম্বে উপযুক্ত আন্দোলন ও সংগঠন গড়ার পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রয়োজনীয় আন্দোলন সংগঠন গড়ার উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণে যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আগামীতে ক্ষমতাসীন দের দ্বারা প্রবর্তিত কর্মসূচীর খড়গের আঘাতে জাসদ রাজনীতি চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। এটা জাসদ রাজনীতির অপরিসীম ক্ষতিই করবে না, দেশ ও জাতির জন্যও দুর্ভাগ্যজনক হবে। তাই এই মুহূর্তে জনগণের মতামত প্রকাশ, অংশগ্রহণ ও নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নটির উপর জোর দিয়ে প্রয়োজনীয় আন্দোলন সংগঠন গড়ার সর্বাত্মক উদ্যোগ দরকার। সে উদ্যোগে সফল হলে জাসদ রাজনীতির ভবিষ্যত উজ্জ্বল।
প্রশ্নঃ জাসদের যে ভবিষ্যৎ আপনি চিন্তা করেন তা বর্তমান সাংগঠনিক প্রেক্ষিতে কতখানি যৌক্তিক?
উত্তরঃ বর্তমান জাসদের অভ্যন্তরে কিছু সাময়িক সমস্যার সৃষ্টি হলেও প্রয়োজনীয় আন্দোলন সংগঠন গড়ে তোলার জন্য যে প্রাথমিক পদক্ষেপ ও উদ্যোগ দরকার তা গ্রহণ ও কার্যকরী করার শক্তি এখনো জাসদের রয়েছে। প্রয়োজনীয় আন্দোলন ও তার উত্তাপ ছাড়া জাসদের রাজনীতি ফলপ্রসূ হতে পারবে না। সাময়িক সাংগঠনিক সংকটে সে উদ্যোগ গ্রহণের পথে বাধা নয় এবং বাঁধা হতে পারে না। প্রয়োজনীয় আন্দোলন সংগঠন গড়ার পদক্ষেপই এই সাময়িক সংকট থেকো উত্তরণ ঘটাবে।
***
জাসদে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংঘাতের কোন অস্তিত্ব নেই
– কাজী আরিফ আহমেদ
প্রশ্নঃ জাসদের জন্মলগ্নে যে রাজনৈতিক পটভূমি ছিল তা কি এখনও আছে?
উত্তরঃ মৌলিক কোন পরিবর্তন হয় নি। তবে মৌলিক সমস্যাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দল সমূহের যে অবস্থান তাতে পরিবর্তন এসেছে৷ তখন দেশ শাসন চলছে ভোটের অপব্যবহার করে আর এখন দেশে চলছে সামরিক শাসন। তখন দেশ শাসন চলছে ভোটের অপব্যবহার করে আর এখন দেশে চলছে সামরিক শাসন। তখন যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল এখন তারা বিরোধী দলে আর তখন যারা পাকিস্তানীদের দালালীর অভিযোগে পালিয়ে বেড়িয়েছে এখন তারা রাষ্ট্র ক্ষমতার আশেপাশে ঘুরঘুর করছে৷ তখন সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণের মাঝে প্রচুর আশা ছিল, প্রতিরোধও ছিল। আজ রাজনৈতিক শূন্যতায় সেখানে বিরাজ করছে হতাশা আর নৈরাজ্য। সাম্প্রদায়িকতা বেড়েছে এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনা ও সমাজতন্ত্র আজ আরও গভীরভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন।
প্রশ্নঃ আপনার মূল্যায়নে জাসদের রাজনৈতিক কোন পরিবর্তন হয়েছে? হয়ে থাকলে তা কি?
উত্তরঃ না কোন পরিবর্তন হয়নি। বিভিন্ন অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সময় সময় কৌশল পরিবর্তন হয়েছে মাত্র৷ এবং সকল অবস্থাতেই শত প্রতিকূলতার মুখেও নিরবিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার মাঝ দিয়ে দলের বলিষ্ঠতাই প্রমাণিত হয়েছে।
প্রশ্নঃ জাসদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ কি?
উত্তরঃ অত্যন্ত উজ্জ্বল। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে ইতিমধ্যে সরকার কি বিরোধী দল সবাই জাসদের রাজনীতি নিয়ে যেমন পেশাভিত্তিক পার্লামেন্ট, কেন্দ্রীয় সংস্থা, বিকেন্দ্রীকরণ ইত্যাদি কর্মসূচী বিশেষভাবে আলোচনা করছে এবং গভীর ভাবে বিবেচনা করছে। সর্বত্র এক নতুন মূল্যবোধ সৃষ্টির পূর্বাভাস পরিলক্ষিত হচ্ছে। যা জাসদের রাজনীতির পক্ষে একটা আশার বিষয়।
প্রশ্নঃ বর্তমানে জাসদের যেসব কর্মসূচী রয়েছে আগামী এক বছরের মধ্যে তার কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা রয়েছে কি?
উত্তরঃ যতক্ষণ সমাজের মৌলিক সমস্যার কোন সমাধান না হচ্ছে ততক্ষণ মৌলিক রাজনীতির পরিবর্তনের কোন প্রশ্নই আসে না। আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার পথে জনগণের ও তাদের রাজনৈতিক সমস্যাকে অনুধাবন করে মৌলিক রাজনীতিকে আরো স্পষ্ট করে তোলার জন্য বিভিন্ন দাবীকে সময় সময় তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর করে তোলা হয় মাত্র। এ ধরণের তীক্ষ্ণ করণ ও সময় বিশেষে গুরুত্ব আরোপকে নিশ্চয়ই কর্মসূচী পরিবর্তন বুঝায় না। ফলে আগামী এক বছরে কর্মসূচী পরিবর্তন হওয়ার কোন কথাই আসতে পারে না৷
প্রশ্নঃ বর্তমানে জাসদের সাংগঠনিক অবস্থা কি? সংগঠনের বর্তমান অবস্থা কি রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে?
উত্তরঃ জাসদের বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থায় তার ঘোষিত কর্মসূচী বাস্তবায়নের প্রশ্নে পুরোপুরি সন্তোষজনক নয়। জাসদ যে রাজনৈতিক কাঠামো দেশে কার্যকর করতে চায় তার সঙ্গে জাসদের বর্তমান কাঠামো এখনো পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জাসদের ১৮ দফা কর্মসূচীর আলোকে অবশ্য এখনো জাসদ তার সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তুলকো সক্ষম হয়নি৷ তবে এখনো জাসদের যে কর্মী বাহিনী রয়েছে তাতে যথাযথ উদ্যোগ নিলে এ সাংগঠনিক সমস্যার মোকাবিলা করা সম্ভব এবং অবশ্যই সফলতা আসবে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগের।
প্রশ্নঃ জাসদের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বের সংঘাত রয়েছে তা ভবিষ্যতে কি রূপ নেবে?
উত্তরঃ রাজনৈতিক আন্দোলন ও কার্যক্রমের অনুপস্থিতিতে দেশে এক রাজনৈতিক সংকটের জন্ম দিয়েছে। এই রাজনৈতিক সংকটের প্রভাব থেকে জাসদও মুক্ত নয়৷ তবে জাসদে ব্যক্তি কেন্দ্রিক কোন সংঘাতে মূলত কোন অস্তিত্ব নেই। জাসদ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের মাঝে যে বিরোধ আপনারা খুঁজে বের করতে চান তা সার্বিক ভাবে চূড়ান্ত নয়। অবশ্য জাসদের নেতৃত্ব ও আন্দোলনের মাঝে এক অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হতে পারে – তা খুবই সাময়িক ব্যাপার। সাধারণ রাজনৈতিক আন্দোলনের অভাবে সচল একটা সংগঠনে কিছুটা স্থবিরতার কারণে একটু আধটু মরচে ধরতে পারে। আর আমাদের দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়া জিয়া সরকার যেভাবে দূষিত করেছেন তাতে এটা এমন কোন অসম্ভব বিষয় নয়। আমার বিশ্বাস আন্দোলনে অংশগ্রহণের মাঝ দিয়ে সংগঠন ও নেতৃত্বের এ স্থবিরতা কাটিয়ে তোলা সম্ভব।
প্রশ্নঃ জাসদের ভাঙ্গন কি অত্যাসন্ন? ভাঙ্গনের কোন শংকাই কি নেই? ভাঙ্গন কি এড়ানো যাবে?
উত্তরঃ জাসদের ভাঙ্গন বলতে কি বুঝাতে চাইছেন? যদি এর অর্থ বিভক্তি বুঝিয়ে থাকেন তাহলে কোন সময়ই এর সম্ভাবনা নেই৷ আর যদি ভাঙ্গনের অর্থ ধ্বংস বুঝিয়ে থাকেন তাহলে বলার কিছু নেই। সৃষ্টি আর ধ্বংস দুটি বিপরীত শব্দ। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে জাসদের কর্মী ও সমর্থকদের মাঝে কি সুনিবিড় ঐক্য রয়েছে এবং যারা কোন অবস্থাতেই বিভক্তি চায় না। এও নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে স্বার্থান্বেষী মহল জাসদে ফাটল ধরাতে আদা জল খেয়ে লেগেও ব্যর্থ হয়েছে। প্রতিক্রিয়াশীলদের এই ক্রমাগত আক্রমণে খুব বেশী ক্ষতি হলে একটু আধটু বাকল ছিটকে যেতে পারে মাত্র৷
প্রশ্নঃ জাসদের মধ্যে মূল রাজনৈতিক ধারাগুলো কি কি? অন্তঃদলীয় সংগ্রাম জাসদে কত তীব্র?
উত্তরঃ আমার কাছে জাসদের মাঝে একাধিক মূল ধারা চোখে পড়েনি তবে বেশ কিছু ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। যেমন আন্তর্জাতিকতা নির্ভর রাজনৈতিক ঝোঁক, কেবল মাত্র সংসদীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দিকে ঝোঁক, জনগণের আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে ষড়যন্ত্রের আশ্রয় গ্রহন বা যেভাবেই হোক সরকারে যোগ দেয়ার ঝোঁক ইত্যাদি। তবে জাসদের এ ঝোঁকগুলোকে মোকাবিলা কারী মতাদর্শগত সংগ্রাম তীব্র নয়। বা খুব শীঘ্রই তীব্র হয়ে উঠবে৷
প্রশ্নঃ জাসদ রাজনীতির আদর্শ নির্ধারকরা এখনো াি তার কৌশল নির্ধারণ করছেন?
উত্তরঃ জাসদ রাজনীতির আদর্শ নির্ধারণকারী মেহনতী সংগ্রামী জনতা আজো এর নীতি নিয়ন্ত্রণকারী আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এই মেহনতী জনতার প্রতিনিধিত্বকারীদের স্তরভিত্তিক নির্বাচনে গঠিত সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক কাউন্সিল সভা এবং এই কাউন্সিল সভার অনুপস্থিতিতে জাতীয় কমিটি নীতি নির্ধারণ করে। তাই আমার জানা মতে জাসদের আদর্শ নির্ধারণকারীরাই এখনো জাসদের কৌশল নিয়ন্ত্রণ করে।
প্রশ্নঃ শাসনতন্ত্র ও শাসনতান্ত্রিক রূপরেখা বইটি সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
উত্তরঃ প্রস্তাবনাটা তার ব্যক্তিগত মতামত। তার উচিৎ ছিল সংগঠনের আলোচনার মাধ্যমে একটা মতামত দেয়া। এ নিয়ে সংগঠনে এখনো আলোচনা হয়নি তাই চুড়ান্ত মতামত রাখা এখন সম্ভব নয়। সাধারণ দৃষ্টিতে প্রস্তাবনাটি দেখলে যা দেখা যায় সেটুকুই মাত্র এই মুহূর্তে মন্তব্য করা সম্ভব। প্রস্তাবনাটি দেখলে যা দেখা যায় সেটুকুই মাত্র এই মুহূর্তে মন্তব্য করা সম্ভব। প্রস্তাবনাটিতে সংগ্রামী জনতার ধারণের প্রশ্নটি অনুপস্থিত। সমগ্র প্রস্তাবনাটি আন্দোলনকে পাশ কাটিয়ে এমন ভাবে তুলে ধরা হয়েছে যেখানে জনগণের আন্দোলনের প্রশ্নটি অস্বীকার করা হয়েছে। সর্বস্তরের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। প্রস্তাবনাটি এমন ভাবে এসেছে যা থেকে মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে সকল পেশার চেয়ে কোন একটি বিশেষ পেশাকেই আইনসম্মত অধিকার দেওয়ার প্রবণতাটি প্রধান। কাঠামো বিন্যাসে জনগণের অধিকার রক্ষার পথ অনেক কম। কিন্তু ষড়যন্ত্রের পথ প্রচুর রয়েছে। আমলাতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন এই প্রস্তাবনাটি জাসদের ঘোষণা পত্র – এর সাথে সামঞ্জস্য পূর্ণ নয়। তবে তিনি যদি এই প্রস্তাবনাটির পূর্বাপর বিষয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় আসেন তাহলে আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রস্তাবনাটি অবশ্যই বিবেচনার অধিকার রাখে।
***
[pdf-embedder url=”https://songramernotebook.com/wp-content/uploads/securepdfs/2021/04/1983.09.30-bichitra.pdf” title=”1983.09.30 bichitra”]