You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.14 | পাকিস্তান সংকটে আমেরিকান সাহায্যের ভূমিকাঃ এনা ব্রাউন টেইলর এর একটি প্রতিবেদন | এনা ব্রাউন টেইলর - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
পাকিস্তান সংকটে আমেরিকান সাহায্যের ভূমিকাঃ এনা ব্রাউন টেইলর এর একটি প্রতিবেদন এনা ব্রাউন টেইলর ১৪ জুন, ১৯৭১

পাকিস্তানের সংকটের সন্ধিক্ষণে সাহায্য প্রেরণের দুরদর্শিতা

অর্থনৈতিক ও মানবিক বিষয়াদি কখনই রাজনৈতিক আলোচনার বহির্ভুত কোনো বিষয় নয়। তাই যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী অন্যান্য রাষ্ট্র সমূহের পাকিস্তানকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে সুদুর প্রসারী প্রভাব নিয়ে ভেবে দেখতে হবে।
পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা খুব একটা আশাব্যাঞ্জক নয়। এর দুটি প্রদেশ কেবল যে ১০০০ মেইল বিস্তৃত ভারতীয় অঞ্ছল ও সম্পূর্ণ আলাদা দুটি সংস্কৃতি দ্বারা বিভাজিত- শুধু তাই ই নয়, বরং দুটি প্রদেশের সম্পৃতির মাঝে বাধ সেধেছে পারস্পারিক ঘৃণা এবং ভয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মতবিরোধ সত্বেও পাকিস্তানী সরকার একঘেয়েভাবে “সবই ঠিক আছে” আউড়ে যাচ্ছে। যেখানে পূর্ব পাকিস্থানে বসবাসরত আমেরিকান এবং করাচি থেকে পলায়নরত বাংগালিদের চিঠি ও দলিল সম্পুর্ণ ভিন্ন গতি নির্দেশ করে। এসব চিঠি ও দলিল বেলুচিস্তান, সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক দৈন্যদশার আভাস আরও দৃঢ় করেছে। লাহোর ও পিন্ডির হাস্পাতাল গুলো যুদ্ধাহত সৈনিকে পরিপুর্ণ। ব্যাবসায়ীগণ যারা কিনা পুর্বে সরকারকে মদদ যুগিয়েছে, বর্তমানে রাষ্ট্রের দেউলিয়া ভাবাপন্ন অবস্থার কারণে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করছে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের মনোভাব সর্বদাই তাচ্ছিল্য ও অবজ্ঞাপূর্ণ ছিল যা পরবর্তীতে নিষ্ঠুরতায় রূপ নেয়। পুর্ব পাকিস্তানের প্রতি এই তাচ্ছিল্য পশ্চিম পাকিস্তানকে কিছু বিশাল ভুলের দিকে ঠেলে দেয়; যেমন-
পাকিস্তানী সামরিক শক্তি সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা অনুধাবন করতে পারেনি, বিধায় তারা গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে সমর্থন দেয়। ফলশ্রুতিতে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদে সংখ্যা গরিষ্ঠ পদলাভ করেন। ২৪ বছর ধরে পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করার ফলস্বরূপ শেখ মুজিবের এই বিজয় সামরিক শক্তির কাছে অত্যন্ত বিস্ময়কর ছিল।
তাদের পরবর্তী ভুল ছিল পুর্ব বাংলাকে নির্মমতা এবং বর্বরতা দেখিয়ে সন্ত্রস্ত করা। সামরিক বাহিনী যুদ্ধ পরিচালনার খরচ এবং বাংগালিদের প্রতিরোধ ক্ষমতাকে অবমুল্যায়ন করেছিল। পুর্ব বাংলা ছিল একটি আদর্শ গেরিলা যুদ্ধক্ষেত্র এবং গতানুগতিক সৈন্যবাহিনীদের জন্য জাহান্নাম স্বরূপ। এখানে গমনীয় রাস্তার অভাব ছিল এবং বন্যাকালে ধানক্ষেত গুলো নদীর মত হয়ে যেত।

গ্রামাঞ্চল আধুষ্যিত পুর্ব বংলায় বোম্বিং কোনো উপযোগী যুদ্ধকৌশল ছিলনা। ততকালীন সুত্র থেকে জানা যায় যে এই অঞ্চলে গেরিলা যুদ্ধ বেড়েই চলেছিল এবং ঢাকা বিমানবন্দর ধ্বংস হয়ে গেলে পাকিস্তানী সেনা বাহিনী প্রচন্ড প্রতিকুল পরিবেশে নিক্ষিপ্ত হতে পারতো।
সামরিক নেতৃত্ব ইতোমধ্যেই যথেষ্ট নিষ্ঠুরতা ও নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়ে ফেলেছিল। একমাত্র আমেরিকা ও এর সহযোগি রাষ্ট্রগুলোরই এ মুহুর্তে যুদ্ধ অব্যাহত রাখার জন্য প্রয়োজনীয় সৈন্যবর্গ সরবরাহ করা সম্ভব ছিল।

এ ভুলগুলো থেকে বাচার একমাত্র উপায়, ধারণামতে, ছিল তত্ত্বাবধায়ক সাহায্য। যদিও গবেষণামুলক ভাবে এর সাফল্য ব্যাপক, কিন্তু কোনোভাবেই এটি বাস্তবসম্মত ছিলনা। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সাহায্য বলতে মুলত বোঝানো হয়েছিল কতিপয় বিদেশী কুটনৈতিক ঢাকা আসবেন এবং দেশের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করবেন। সামরিক তত্ত্বাবধানের অধীনে তাঁদের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল এ থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হবে এবং যাতায়াতের জন্য সামরিক গাড়ী ব্যবহারের সুবিধা দেওয়া হবে। এছাড়াও বাঙ্গালি গেরিলাদের হাত থেকে রক্ষার প্রতিশ্রুতি ও দেওয়া হবে।
এসকল বিদেশী তত্ত্বাবধায়কদের উপস্থিতি সত্ত্বেও কোন উপযুক্ত সাহায্য ততক্ষণ পর্যন্ত পাওয়া যাবেনা যরক্ষণ পর্যন্ত সামরিক শক্তি পুর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করে চলেছে। পুর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের মনোভাব কেমন ছিল তা সেই বছরের নভেম্বরে সাইক্লোন আক্রান্ত বাংগালিদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানীদের সহানুভুতিহীন মনোভাব থেকে সম্ভবত খুব ভালোভাবেই বোঝা যায়। নয় সপ্তাহ ব্যাপী জনগণের উপর অত্যাচার চালানো সৈন্যদের সাহায্যার্থে টিক্কা খানের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর কাছে সাহায্য প্রার্থনাও এর বড় একটি উদাহরণ। এসব সেনাদের পণ্য সাহায্য প্রদানও বর্বরতার সমান অন্যায়, কারণ উক্ত পণ্য সাহায্য সেনাদের বর্বরতায় সহায়ক হিসাবে কাজ করবে। আমেরিকা থেকে পূর্ব বাংলায় আসা একটি চিঠিতে উল্লেখিত, পশ্চিম পাকিস্তানের একজন কর্মকর্তা বলেন, “আমরা ব্রিটিশদের মত করে তাদের অনাহারে রেখে মেরে ফেলবো। ” বাংগালিরা এ চিঠির প্রতিক্রিয়া স্বরূপ আমেরিকার কাছে পশ্চিম পাকিস্তানকে কোনরূপ সাহায্য না পাঠানোর জন্য আহব্বান জানায়। কারণ তাদের কাছে সেনাদের অত্যাচারে মরার চেয়ে অনাহারে মারা যাওয়া কম কষ্টের মনে হয়েছিল।
সমস্ত সাহায্য সরাসরি সামরিক নেতাদের হাতেই পৌঁছাতো। ফলে সাহায্যদাতারা পুনরায় তাদের সাহায্য দানের প্রক্রিয়াটি ভেবে দেখতে বাধ্য হন। কারণ নির্মম সামরিক নেতাদের হাত দিয়ে দেশের গরিব সম্প্রদায়ের উন্নয়ন সম্ভব নয়। পশ্চিমা বিশ্ব পুর্ব পাকিস্তানের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের এ হেন ব্যাবহার থেকে শিক্ষা না নিলে ভবিষ্যতে এর কু প্রভাব আরও অনেকদুর পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে।
ফস্টার ডিউলাসের সময় থেকে সামরিক সাহায্য ব্যবহারের একমাত্র শর্ত হল তা কেবল বহিরাগত কমিউনিস্ট আক্রমণ থেকে বাচার জন্যেই ব্যভৃত হতে পারবে। ১৯৫৬ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পাকিস্তান প্রায় ২ বিলিয়ন দোলারের সামরিক সাহায্য পায় যা ১৯৬৫ সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এবং এখন ৭৫ মিলিয়ন নিরীহ বাংগালির বিরুদ্ধে ব্যভৃত হচ্ছে।

পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে চীনের একটি উষ্ণ সম্পর্ক বজায় থাকলেও ১৯৬৮ সালের শেষের দিকে ইলেক্ট্রনিক নজরদারি সংক্রান্ত জটিলতার কারনে আমেরিকার সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

বৈদেশিক সাহায্যের সিংহভাগ অংশই পাকিস্তানী শাসকদের পকেটে চলে যেত। এ ঘটনার আত্ম পক্ষ সমর্থন করা হয়েছিল এভাবে যে পাকিস্তানী শাসকেরা সেসব টাকা ব্যবসায় খাটালে তা শেষ পর্যন্ত গরিবের কাজেই লাগবে, যদিও শেষ পর্যন্ত ব্যবসায়ের লাভ গরিব দের বদলে সুইস ব্যাংক এবং হংকং এ চালান করা হয়।
হার্ভার্ডের প্রফেসর ডোর্ফম্যানের হিসাব অনুযায়ি, এগারো বছরে পাকিস্তান প্রায় তিন বিলিয়ন দোলার বৈদেশিক অনুদান পায়, যার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় ৭৫ এবং পুর্ব পাকিস্তানের মাথাপিছু আয় ছিল ৪৫। সুতরাং পাকিস্তানের বৈদেশিক অনুদানের ব্যবহার দেশের পক্ষে অনুকুল ছিলনা।
১৯৬৫ সালে আমেরিকা, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক এবং অন্যান্য সহযোগি রাষ্ট্র অস্ত্র ও অনুদান সরবরাহে বাধা শাপন করে এবং ইন্দো-পাকিস্তান যুদ্ধ কিছুদিনের জন্যে রহিত হয়। এখন যদি আমেরিকা ও সহযোগি রাষ্ট্ররা অনুদান স্থগিত করে এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ঋণ আদায়ে অতঃপর হয়, তাহলে পাকিস্তানী সেনাবাহীনিওকে পুর্ব বাঙ্গলা থেকে সরিয়ে নেওয়া ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের হাতে অন্য কোণো উপায় থাকবেনা।
কিন্তু তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তান চীনের তালুবন্দি হয়ে যেতে পারে। চীন ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে সর্বাত্মক সহায়তা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কারণ পশ্চিমাদের কাছে পাকিস্তানের আবদ্ধতা চীনের কুটনৈতিক দুর্বতার কারণ হয়ে দাড়াতে পারে।
ক্ষণস্থায়ী ভীতির বশবর্তী হয়ে ভুল পক্ষ সমর্থন করলে পরবর্তীতে ভিয়েতনাম অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে। শেখ মুজিবুর রহমান একজন মডারেট পশ্চিমাবাদী ছিলেন। তাঁর ছয়দফা দাবি পুর্ব বাঙ্গলার সমস্যাবলির প্রতি আলোকপাত করা সত্ত্বেও সমগ্র পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার প্রয়াস পেয়েছিল। পুর্ব বাংলায় কম্যুনিস্ট মতবাদ খুব বেশি প্রচার পায়নি। বামপন্থী জাতিয় আওয়ামী দলের তেমন একটা সমর্থন ছিলনা। ফলে পসছিম বাঙ্গলার মাও নক্সালরা পুর্ব বাঙ্গলায় খুব বেশি অগ্রগতি করতে পারেনি। কিন্তু আওয়ামী প্রতিনিধিদের অপসারন সেই সম্ভাবনা বাড়িয়ে তুলতে পারে।
যদি আমেরিকা পশ্চিম পাকিস্তানকে পুর্ব বাঙ্গলায় সৈন্য মোতায়েন রাখতে সাহায্য করে, তবে শরণার্থীদের প্রস্থান অব্যাহত থাকবে। ইতিমধ্যেই ভারতে ৬০ লক্ষ শরনার্থী আশ্রয় নিয়েছে এবং প্রতিদিন ১ লক্ষ হাতে শরনার্থী সংখ্যা বাড়ছে। ইহা ভারতের পক্ষে বোঝা হওয়া সত্ত্বেও ভারত যথেষ্ট রাজনৈতিক সঙ্গযম দেখিয়েছে।
কিন্তু ওয়াশিঙ্গটনে বসবাসরত ভারতীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে যে পশ্চিমা বিশ্ব যদি পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ না করে তাহলে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর পুর্ব বাঙ্গলায় অভিযান চালানো অপরিহার্য হয়ে উঠবে। ফলস্বরূপ আমেরিকা, চীন ও রাশিয়া যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। এমতাবস্থায় অতিসুক্ষ বুদ্ধিমত্তা ও সংযম ছাড়া হলোকাস্ট এড়ানো কঠিন হয়ে পড়বে।

তাই এখন নিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহন করে প্রজ্ঞা ও স্থিরতার সাথে সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৯৬৫ সালের ন্যায় পাকিস্তানের অনুদান স্থগিত করাই সবচেয়ে নিরাপদ কৌশল।

এ ব্রাউন টেইলর
কেমব্রিজ, জুন ১৪।