শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
পররাষ্ট্র বিভাগের উপসচিবকে লিখিত মিঃ উইলিয়াম বি গ্রীনোর চিঠি পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির অসারতা ব্যাখ্যা | জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়
|
৩ জুন, ১৯৭১ |
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়
মেডিক্যাল স্কুল
৩ জুন, ১৯৭১
মি ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন
উপ সহকারি সচিব
নিকট প্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত বিভাগ,
ওয়াশিংটন ডি সি ২০৫২০
জনাব মি ক্রিস্টোফার ভ্যান হলেন
আমি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছে এই জেনে যে আপনি কষ্ট করে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা সম্বন্ধে সচিব রজার্সের নিকট আমার চিঠির উত্তর দিয়েছেন। এই জেনে খুবই ভাল লাগছে যে, আপনি ব্যক্তিগতভাবে সময় নিয়ে আমার বক্তব্যে সাড়া দিয়েছেন, এছাড়াও কলেরা গবেষণা ল্যাবরেটরির সহকর্মী বিশেষ করে ডা লিঙ্কন চেন এবং জর্জ কারলিনের সাথে আলোচনা করেছেন।
প্রথমত, আমি আপনাকে হলপ করে বলতে চাই যেসব খবর আমার কাছে রয়েছে সেগুলো পদাধিকারবলে আপনি ঢাকা থেকে প্রতিদিন সরাসরি পেয়ে থাকেন। সেহেতু আমার কাছে বাস্তব অথবা চাক্ষুষ তথ্য ছাড়া আমি কোন গালগল্প আপনার সামনে তুলে ধরব না। আমি একজন সামান্য মানুষ হিসেবে আমি এটা বুঝতে পারছি না যে কোন নির্দেশের কারণে আপনি এরকম ব্যাপক আধেয়গুলোকে ব্যবহারে বাধা দিচ্ছেন। বিশেষ করে, এটাও বুঝছি না যে কেন আপনি প্রাপ্ত তথ্যগুলোকে ব্যবহার করে কংগ্রেসে বিবৃতি প্রদানে বাধা দিচ্ছেন। এই ব্যাপারটি আমাকে বিশেষভাবে দুশ্চিন্তায় ফেলছে যে, যখন আমাদের অনেক আইনবিদ অসমর্থিত সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তুলে ধরছেন, সচেতন নাগরিক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আমরা এসব তথ্যাদি তালিকাভুক্ত করেছি। সৌভাগ্যক্রমে তথ্যগুলো বিভিন্ন উৎস থেকে নির্ভুল, সত্যতা নির্ণয় করা হয়েছে তাই এগুলো বিশ্বাসযোগ্য। আমি এটাও পরিস্কারভাবে বুঝতে পারছি না যে কিভাবে আমাদের নির্বাচিত আইন প্রণেতারা তাদের সরকারের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত তথ্যাদি না পেলে যথার্থ পদক্ষেপ নিতে পারবেন। সম্ভবত আপনি আমাদের এই বিষয়টি পরিস্কার বোঝাতে পারবেন।
স্টেট ডিপার্টমেন্টের থেকে বের হওয়া বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সকলেই শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য ‘আশা’, ‘অবগত’, এবং ‘আকাঙ্ক্ষা’ করতে পারেন এবং ‘আলোচনা’ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। যদিও এই সংবাদ আসলে প্রকৃত ঘটনায় জড়িতদের জন্য কোন গুরুত্বই বহন করে না। ইউ এস সি-১৩০ মিলিটারি পরিবহন বিমানপোত (তুরস্কের জন্য মঞ্জুরীকৃত ) পূর্ব পাকিস্তানে যেকোনো সামরিক আক্রমণের জন্য অস্ত্র পরিবহন সহায়তার মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে এবং অত্যাধুনিক হুয়েই কোবরা জঙ্গি হেলিকপ্টার(সর্বশেষ মার্কিন সরঞ্জাম) ইতালি থেকে ইরানের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে সরবরাহ করা হচ্ছে যা কিনা শান্তির জন্য আশা, আকাঙ্ক্ষা থেকে জোরে কথা বলছে। প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সরাসরি সম্পৃক্ততা এতই নিশ্চিত এবং একপাক্ষিক যে বিশ্বাস করা কঠিন আমরা সরাসরি কোন এক পক্ষের হয়ে নাক গলাচ্ছি না বিশেষ করে এই নৃশংস গৃহযুদ্ধে। ভিন্নপথে একটি সাধারণ সামরিক সহায়তা প্রদানের মাধ্যমেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
এখানে প্রশ্নের কোন অবকাশ নেই যে, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বৈধ সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করছে, এছাড়া, অসংখ্য উপাত্ত দেখাচ্ছে সরকারের এই নিয়ন্ত্রণ প্রশ্নবিদ্ধ। কেন রাতের অন্ধকারে ট্রাকভর্তি পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকায় ফিরে যাচ্ছে? কিভাবে সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত এবং নিরাপদ বৃহৎ নৌপথে বাংলাদেশি যোদ্ধারা জাহাজ দখল করছে এবং গত সপ্তাহে প্রধান জলপথে পাটের চালান ধ্বংস করা হয়েছে? কেন বিগত দুই মাসে খাদ্য বোঝাই কোন জাহাজ গত নভেম্বরে সাইক্লোন আক্রান্ত অঞ্চলে পৌঁছায়নি? কেন প্রধান বন্দর চট্টগ্রাম দিয়ে কোন জাহাজ চলছে না? কেন সেনাবাহিনী ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যানবাহন চালাতে পারছে না? নিয়ন্ত্রণ যদি বাস্তবেই হয়ে থাকে তাহলে কেন প্রতিদিন গ্রাম জ্বালিয়ে এবং মানুষ হত্যা করা হচ্ছে?
সুনির্দিষ্টভাবে এরকম মারাত্মক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির চিত্রকে অগ্রাহ্য করা হয় এগুলো ‘হিন্দু দুর্বৃত্তদের’ কারসাজি। এটা কি পরিস্কার নয় যে এরকম অটল নীতির ক্ষেত্রে ভারত অবশ্যই হস্তক্ষেপ বা আগ্রাসী অবস্থান গ্রহন করবে না? আমরা কি ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে আরেকটি যুদ্ধের মদদ দিতে চাচ্ছি? এখন অবশ্যই স্বাভাবিক কূটনৈতিক আচরণের সময় নয় যখন এসব নীতি অবধারিতভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে দুর্ভিক্ষ এবং যুদ্ধ ডেকে আনছে।
এটি অবশ্যই ভ্রান্ত বক্তব্য যে অর্থনৈতিক সাহায্য সামরিক কর্মকাণ্ডে সহায়তা করছে না অথচ এই অর্থ নাগরিক চাহিদা পূরণে ব্যয় হতে পারত, যা সম্পর্কে আমরা সকলেই অবগত আছি। এছাড়াও জনগণ অবগত আছে যে মানবিক সাহায্যের পরিবর্তে সামরিক উদ্দেশ্যে সহায়তা বৃদ্ধি করা হয়েছে। আপনি জানেন যে ত্রাণ সহায়তার জন্য ৫০ টি নৌকা সাইক্লোন আক্রান্ত অঞ্চলে দেওয়ার পরিবর্তে সামরিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সরকার এই অপসারণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করে নি নৌকাগুলোর ছবি পত্রিকায় প্রকাশ করে যেখানে পাঞ্জাবি সৈন্যরা ‘হিন্দু দুর্বৃত্তদের’ শাস্তি দিচ্ছিল।
মানবিক এবং ত্রাণ সহায়তা কর্মকাণ্ড সম্পর্কে, ইউএসএআইডির কর্তাব্যক্তিরা গত সপ্তাহে নিম্ন কক্ষের প্রতিনিধিদের পূর্বে স্বীকার করেছেন যে পূর্ণ আন্তর্জাতিক সহায়তা দেয়া হলেও পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় এককোটি মানুষ না খেয়ে মারা যাওয়ার হুমকিতে রয়েছে। এরকম অবস্থায় ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পরে। রাস্তার পাশে মানুষের মৃতদেহ ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। এমতাবস্থায় যদি প্রস্তাবিত খাদ্য সহায়তা প্রত্যাহার করা হয় তাহলে ভারতীয় সীমান্তের হাজার হাজার মানুষ যারা পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাকাণ্ড থেকে পালিয়ে আসছে এর সংখ্যা লক্ষাধিক হয়ে যাবে। ভারত কোনভাবেই যৌক্তিক কারনেই এই অবস্থা মেনে নিবে না। এরপর সমস্যার সমাধান ভয়ঙ্কর ও অসম্ভব হয়ে পড়বে। যেকোনো দৃষ্টিভঙ্গিতেই এটি অগ্রহণযোগ্য যে একদিকে পূর্ব পাকিস্তানি ১ কোটি জনগণকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ‘হিন্দু দুর্বৃত্ত’ আখ্যা দিয়ে নির্যাতনকে সমর্থন করা, অন্যদিকে যারা অত্যাচার ও নিপীড়ন সহ্য করে ভারতীয় সীমান্তে গিয়েছে তাদের ‘মানবিক’ সাহায্য প্রদান করা।
এটি প্রত্যাশিত যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ’স্বাভাবিক’ কূটনৈতিক চর্চা এবং অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা (সেন্টোর মাধ্যমে) পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে সফলভাবে এক থেকে দেড় কোটি বাঙালিকে নিপীড়ন করতে সাহায্য করছে এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ভারতকে উত্তেজিত করার মাধ্যমে পরিশেষে একটি রক্তাক্ত ও বিধ্বংসী যুদ্ধের প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। এই অস্বাভাবিক চিত্র সাধারণের চেয়ে অতিরিক্ত কূটনৈতিক তৎপরতা নির্দেশ করছে। আমি বিশ্বাস করি যদি স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং বিশেষ শাখা গাঙ্গেয় বদ্বীপের পরিবর্তনশীল পরিস্থিতির জন্য যথেষ্ট না হয় তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা এবং পূর্ব পাকিস্তানীদের আশার জন্য কংগ্রেসকে পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সুনির্দিষ্ট বিধি প্রণয়ন করে ওই অঞ্চলে দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক নির্ধারণ করতে হবে। যদি তাই প্রয়োজন হয়, আপনার বিভাগ কতৃক হঠকারী কর্মকাণ্ড দ্বারা অর্জনের মত দ্রুত বা নেতিবাচক নাও হতে পারে।
আমি ইতোমধ্যেই স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতির বিভিন্ন পয়েন্টে বিস্তারিত মন্তব্য করেছি, এছাড়াও মি ডেভিড এম আবসহায়ার থেকে সিনেটর জে গ্লেন বেল জুনিয়রের নিকট সংশ্লিষ্ট বিষয়ের যোগাযোগের দলিলগুলো চিঠির সাথে সংযুক্ত করেছি। আমি এই প্রতিবেদনগুলো এই কারণে সন্নিবেশিত করেছি যাতে আপনি বুঝতে পারেন যে কেন পাকিস্তানের দূতাবাসের সাথে স্টেট ডিপার্টমেন্টের যোগাযোগকে সামান্য মনে করা হচ্ছে যেখানে প্রথম শ্রেণির তথ্য কংগ্রেস এবং প্রেসের রেকর্ডে রয়েছে। আমি আশা করব যে পরবর্তীতে কংগ্রেসের সাথে যোগাযোগের সময় অধিক হারে সত্য ও নির্ভুল তথ্য আপনাদের কাছ থেকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রেরিত হবে।
চূড়ান্তভাবে, আমি এই প্রশ্ন করতে চাই যে আমাদের রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শক্তির ঘাটতিগুলোকে পর্যালোচনা করতে হবে, কেননা গত বিশ বছর বা তারও অধিক সময় ধরে আমাদের বৈদেশিক নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, যেমন ভিয়েতনাম, যে কারমে আমাদের অবশ্যই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে যার ভিত্তি ব্যক্তির অধিকার এবং স্বাধীনতা, অন্যান্য সামরিক শাসন, একনায়ক অথবা বর্তমানের পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে নৈতিক অবস্থান নিতে হবে কেননা তা আমাদের চর্চিত বিশ্বাসের বিপরীত। আমরা কি দুর্ভিক্ষ ও অস্ত্রের দ্বারা নিরীহ মানুষের উপর গণহত্যাকে মৌন সম্মতি দিব? আপনি এবং আপনার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানেন যে এটিই এখন পূর্ব পাকিস্তানের আইন? কি ধরনের হ্রসদৃষ্টির কারণে আমাদের সরকারের বিশেষ শাখার মেধাবী সদস্যরা ইতিহাসে আমাদের স্বার্থের জন্য সর্বোত্তম উপায়কে দূরে ঠেলে বিশৃঙ্খল দিনগুলিকে সামনে নিয়ে আসছেন?
আমি বিশ্বাস করি যে উঠতি ফোরাম আমাদের নীতিগুলোর পরিবর্তনে নির্দেশনা দিবেন। আমি এটি দেখেছি যখন আমাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এই মহান জাতির জন্য গৃহীত হয়েছে। এই শক্তি এবং অন্যান্যরা যারা বাংলাকে জানেন কথা বলবেন, এবং আমি ক্ষীণ আশা করি যে, পূর্ব পাকিস্তানে এই মর্মান্তিক অবস্থাকে তুলে ধরবেন এবং অতীব জরুরী পরিবর্তনগুলো সাধন করে ট্রাজেডির হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করা হবে।
বিনীত
উইলিয়াম বি গ্রিনোগ, এম. ডি.
প্রধান, সংক্রামক রোগ বিভাগ।