You dont have javascript enabled! Please enable it! সাক্ষাৎকারঃ মেজর সৈয়দ মুনিবুর রহমান | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

সাক্ষাৎকারঃ মেজর সৈয়দ মুনিবুর রহমান

প্রশ্নঃ অক্টোবরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করার পর আপনাকে কোথায় পাঠানো হলো ?
উত্তরঃ সেখানে একটা ইকো কোম্পানী ছিল। সেটা তৈরী হয়েছিল বেশীর ভাগ ময়মনসিংহের ছাত্রদের নিয়ে। আমাকে তারা সেখানকার কোম্পানী কমান্ডার করে পাঠান। আমি কোম্পানী কমান্ডার হিসাবে প্রথমে তাদেরকে কিছু ট্রেনিং করাই কদমতলায়, তারপর আমরা কিছু অপারেশন করি। আমাদের প্রথম অপারেশন হয় নভেম্বরের ২/৩ তারিখ। লাঠিটিলা বিওপি’র মধ্যে আমরা এ্যামবুশ করি। তারপর আমি লাঠিটিলায় বিওপি’র উপর একটি রেইড কন্ডাক্ট করি।

প্রশ্নঃ কিভাবে কন্ডাক্ট করেন একটু খুলে বলবেন ?
উত্তরঃ আমরা খবর পাই এক সেকশন পাকিস্তানী ভোরবেলায় লাঠিটিলার ভিতর দিয়ে রাস্তাঘাট ক্লিয়ার করার জন্য ‘মুভ’করে এবং ব্রীজে ছিল রাজাকার পাহারায়। আমরা কিছু বেশী লোক নিয়ে এ্যামবুশ করি। তারা মাইনের বিরুদ্ধে প্রটেকশন নেয়ার জন্য প্রথমে একটা ট্রাক্টর চালিয়ে যায়। তারপর তারা প্রুফ পেট্রোল হিসাবে একটা সেকশন মুভ করায়। এরা সব পাকিস্তানী সোলজার ছিল। আমরা রাতে এ্যামবুশ লাগাই। ভোরে খবর আসে লোক চলে আসে। আমাদের কাছে মাইন ছিল কিন্তু আমরা মাইন লাগাতে পারিনি। ট্রাক্টরটা চলে যাবার পর আমরা ফায়ার করি। ফায়ার করে আমরা এ্যামবুশ করি। এ্যামবুশ করার সময় দৌড়াদৌড়ির মধ্যে আমাদের একটা ছেলে হারিয়ে যায় এবং আমরা উইথড্র করে চলে আসি। আমাদের প্লাটুনের বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা ছিল। আমার সিগনালার যে ছিল সে হারিয়ে যায়।

প্রশ্নঃ এ্যামবুশের ফলাফল কি ছিল?
উত্তরঃ এ্যামবুশের ফলাফল ছিল ১০ জন আর্মির মধ্যে ৫ জন মারা যায় এবং ১ জন আহত হয়েছিল। আমরা পরে অন্যান্যের কাছে খবর পাই। নিজেরা কোন ডেডবডি রিকভার করিনি ঐ এ্যামবুশে।

প্রশ্নঃ এই এ্যামবুশে আপনাদের কোন ক্ষতি হ ?
উত্তরঃ না, আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। শুধুমাত্র আমার সিগনালার হারিয়ে যাওয়া ছাড়া। অবশ্য তাকে স্বাধীন হবার পর ফিরে পাই।

প্রশ্নঃ পরবর্তীতে আপনার অপারেশন কি ?
উত্তরঃ পরের অপারেশনে লাঠিটিলা বিওপি’র উপর আমি রেইড করি। রেইড করার সময় আমাকে এ্যাসিস্ট করেছিলেন মর্টার দিয়ে কর্নেল সাদেক। তখন তিনি ক্যাপ্টেন ছিলেন। তিনি আমাদের ইউনিটে কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন।

প্রশ্নঃ এটা কোন মাসে হয়েছিল?
উত্তরঃ এটা নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে হয়েছিল।

প্রশ্নঃ পাকিস্তানীদের কি পরিমাণ শক্তি ছিল সেখানে ?
উত্তরঃ পাকিস্তানীদের শক্তি বলতে প্রায় দেড় প্লাটুনের মত রাজাকার ছিল এবং এক প্লাটুনের মত পশ্চিম পাকিস্তানী মিলিশিয়া ছিল। আর্মিরা তখন বর্ডারে ছিলনা, অন্যদিকে ছড়িয়ে ছিল। আমরা রেইড করেছিলাম এজন্য যে, তাদের বুঝিয়েছিলাম আমাদের অপারেশন এখনও চলছে এবং আমরা অপারেশন করার মত সামর্থ্য রাখি। আমরা ফিজিক্যালী রেইড করিনি। আমরা ফায়ারের মাধ্যমে রেইড করেছিলাম। মর্টার ফায়ার দিয়ে ‘রেইড’করার কথা ছিল। আমরা একটা হিলটপে ছিলাম। বিওপি’টা অন্য হিলটপে ছিল। মাঝখানে দু-তিনশ গজের পার্থক্য।

প্রশ্নঃ আপনারা কতজন ছিলেন
উত্তরঃ এই রেইডে আমি এক কোম্পানী নিয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের ব্যাটালিয়ানে ৩” মর্টার ছিল। মর্টার দিয়েই ফায়ার করা হয়েছিল। এটাতে কোন ক্যাজুয়ালটি হয়নি। এটা একটা মোরাল বুস্টিং-এর মত অপারেশন ছিল। এরপর আমি ইউনিটে ফিরে আসি। এ সময় আমাদেরকে বলা হয়, ‘তোমাদের বাংলাদেশের ভিতর জায়গা ক্লিয়ার করে ডিফেন্স নিতে হবে’।

২২শে নভেম্বর আমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করি। সিলেট বড়লেখা বলে একটা জায়গা আছে, সেই জায়গাতে আমরা ডিফেন্স নেই। এই ডিফেন্স নেওয়ার সময় আমাদের উপর ২/৩ বার আক্রমণ চালায় পাকিস্তান আর্মি। কিন্তু আমরা প্রতিবারই এই আক্রমণ সাফল্যের সাথে দমন করি। মুজিব ব্যাটারী-২ যেটাতে মেজর রাশেদ এবং মেজর সাজ্জাদ ছিলেন- সেই ব্যাটারী প্রথমবারের মত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ফায়ারিং সাপোর্ট দেয় এবং ফায়ার সাপোর্টের প্রথম গোলাই টার্গেটের উপর পড়ে। ২৯শে নভেম্বর আমরা কৈলাশ শহরে কনসেনট্রেট করি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চূড়ান্তভাবে প্রবেশের জন্য। ২৯ তারিখ রাতে বাংলাদেশে ঢোকার জন্য মার্ট করে যাই পুরো ব্যাটালিয়ন। এই সময় ইন্ডিয়ান ব্রিগেডের একটা কাজের জন্য আমাদেরকে বলা হয়। ব্রিগেডের প্ল্যান ছিল শমসেরনগরের উপর আক্রমণের। আমাদেরকে বলা হয় শমসেরনগর থেকে শ্রীমঙ্গলে যে এক্সসেস আছে সেটাকে গার্ড করতে হবে। ভানুগাছে কিছু এ্যানিমি ট্রপস আছে সেখানে আমাদেরকে কাট-অফ করে একটা ডিফেন্স লাগাতে হবে। আমাদের কাছে তথ্য ছিল যে ভানুগাছে এক আর্মি প্লাটুন আছে। আমরা সেভাবে ডিফেন্স নেই। কিন্তু আমরা যখন ১ লা ডিসেম্বর ভানুগাছে পৌঁছি তখন দেখি সেখানে এক প্লাটুনের বেশী আর্মি আছে এবং কিছু ১২০ মিঃ মিঃ মর্টারও ছিল সেখানে। তারপর ২/৩ তারিখ ডিসেম্বরে আমাদেরকে ওদের উপর আক্রমণ চালাতে বলা হয়। প্রথমে আমাদের দুই কোম্পানী আক্রমণ চালায়। দুই কোম্পানী আক্রমণ চালালে আমাদের বেশ কিছু-প্রায় ১২৭ জন নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়।

প্রশ্নঃ দুই কোম্পানী কে কে নিয়ে গিয়েছিলেন ?
উত্তরঃ একটা মেজর মাহবুব ও আর একটা মেজর ওয়ালিউল ইসলাম। একটা ছিল ব্রেভো কোম্পানী আর একটা ছিল আলফা কোম্পানী। পরে চার্লি কোম্পানীকে পাঠানো হয় এবং আমরা ইন্ডিয়ান আর্টিলারীর সাপোর্ট নিয়ে সেই আক্রমণকে সাকসেসফুল করি এবং পরের দিন সকালবেলায় আমরা ভানুগাছ দখল করি।

প্রশ্নঃ সেটা কত তারিখে হবে ?
উত্তরঃ সেটা ডিসেম্বর ৩/৪ তারিখে হবে। আমার মনে আছে ভানুগাছে থাকতেই যুদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং ইন্দিরা গান্ধীর বক্তৃতা ভানুগাছেই শুনেছিলাম। এটা করার পর আমাদেরকে বলা হয় মঙ্গলাবাজার হয়ে ফেঞ্চুগঞ্জ আসতে হবে। আমরা ভানুগাছ থেকে মঙ্গলাবাজারে আমাদের বেশকিছু ক্যাজুয়ালটি হয়। মাইন ক্যাজুয়ালটি ছিল। একটা ট্রাক এবং একটা বাস এন্টিট্যাঙ্ক মাইনে উড়ে যায়, ফলে বেশকিছু ক্যাজুয়ালটি হয়।

প্রশ্নঃ এটা কবে হয় ?
উত্তরঃ এটা ৭/৮ ডিসেম্বরে। ভানুগাছ থেকে একটা কাঁচা রাস্তা আছে ফেঞ্চুগঞ্জের দিকে। আমরা সেই রাস্তা দিয়ে আসার সময় আমাদের ক্যাজুয়ালটি হয়। ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেটের কাছে গোলাপগঞ্জ বলে একটা জায়গা আছে সেখানে এসে একটা স্কারমিশের মত হয়। সেখানে কিছু ‘থলস’স্কাউট ছিল। তাদেরকে আমাদের ব্যাটালিয়ন ঘেরাও করে ফেলে। এক সেকশন ‘থলস’স্কাউটকে আমরা বন্দী করে ফেলি।

প্রশ্নঃ এটা কত তারিখ ছিল ?
উত্তরঃ এটা ৯/১০ তারিখ ছিল। ইতিমধ্যে আমরা দেখছিলাম যে, সিলেট রেডিও স্টেশনের ওপর ভারতীয় ৫৫ গুর্খা রাইফেলস হেলিকপ্টারযোগে নামিয়ে দেয়- তাদের সঙ্গে পাকিস্তান আর্মির বেশ যুদ্ধ চলছিল। আমাদের মধ্যে বেশ কিছু স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ছিল। তাদেরকে আমরা নদী ক্রস করে ওপারে পাঠিয়ে দিই খবর নেওয়ার জন্য। ১৩/১৪ তারিখে আমরা খবর পাই আমাদের আর ওদিকে যাবার দরকার নেই। কেননা পাকিস্তানী আর্মিরা পালিয়ে গেছে এবং সালুকটিকরের দিকে “কনসেনট্রেটেড” হয়েছে। ১৬ তারিখ আমরা সিলেট প্রবেশ করি। কিন্তু আনফরচুনেটলি আমাদের সিলেট শহরে যেতে দেয়া হয়নি। আমাদের স্টেশনে থাকতে বলা হয়েছে।

প্রশ্নঃ কেন যেতে দেয়া হয় নাই ?
উত্তরঃ আমাদেরকে বলা হয়েছিল, আমরা যদি পাকিস্তান আর্মিদের সাথে ঝগড়া করি কিংবা তাদের মেরে ফেলি। তাছাড়া আরো হয়ত কারণ ছিল। আমরা স্টেশনে থাকাকালীন সময়ই খবর পাই যে সমস্ত দখল করা ম্যাটেরিয়ালস, আর্মস সেগুলো ট্রেনে করে ইন্ডিয়ায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সিলেট স্টেশন থাকাকালীন সময়ই ফাস্ট বেঙ্গল আমাদের সাথে যোগদান করে। ঐ সময় জেনারেল ওসমানী আসেন। জেনারেল জিয়া আসেন। জেনারেল ওসমানী সিলেট স্টেশনে ফার্স্ট বেঙ্গল এবং ৮ম বেঙ্গলের উদ্দেশে ভাষণ দেন। ইন্ডিয়ান ডিভিশনাল কমান্ডার যিনি ছিলেন জেনারেল রাও বা অন্য কেউ, আমার নামটা ঠিক মনে নেই- তিনিও আমাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি একটা কথা বলেছিলেন, আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছো খুব ভাল তোমাদের যুদ্ধ এখন শেষ। এখন তোমরা যার যার জায়গায় চলে যাবে। এবং তোমাদের এখন কাজ হবে দেশের গঠনকাজে আত্মনিয়োগ করা”। হয়ত তিনি আমরা যেন আর্মি থেকে সরে যাই সেই উদ্দেশ্যে বলেছিলেন।

যাই হোক, আমরা ‘জেড’ফোর্সের আন্ডারে ছিলাম। এর মধ্যে খবর পাই ‘জেড’ফোর্সের আরেক ব্যাটালিয়ন, ৩য় বেঙ্গল যেটা ছিল ওটা ছাতক এসে পৌঁছে গেছে।

প্রশ্নঃ সিলেট পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ফাইনালি কবে সারেন্ডার করে ?
উত্তরঃ ঢাকায় যেমন ১৬ই ডিসেম্বর করেছিল তখনও সম্পূর্ণ সারেন্ডার করেনি। ১৩,১৪,১৫,১৬ ডিসেম্বর এক জায়গায় এক এক সময় করেছে। তবে ঢাকায় যেদিন হয়েছে সেদিন সিলেটের কিছু কিছু জায়গা বাকী ছিল। ১৬ তারিখে যখন আমরা রেলওয়ে স্টেশনে আসি তখন আমরা শুনতে পাই যে পাকিস্তান আর্মিরা সালুটিকর এবং এখন যেটা সিলেট কলেজ সেখানে ‘কনসেনট্রেট’করেছে। আমি নিজে ১৮ তারিখ সেই ক্যাম্পে যাই এবং দেখি তারা অলরেডি সারেন্ডার করে ফেলেছে। এক এক জায়গায় এক এক সময় যেমন ৯/১০ তারিখে শ্রীমঙ্গল আমাদের দেখে পিছু হটে গেছে। মৌলভীবাজারে আরো আগে হয়েছে। আমরা মৌলভীবাজার হয়ে এসেছিলাম। তখন সেখানে ব্রিগেড কমান্ড বা আর কোন কমান্ডার ছিল তাদের শেষের দিকে কোন কমান্ড ছিল না। ছাতকে কিছু আগে সারেন্ডার করেছে। ১৬ তারিখের দিকে সিলেট ক্যাডেট কলেজে সিলেটের পুরো আর্মি সেখানে জড়ো হয়। সেখানে পাকিস্তান আর্মির তিনজন ব্রিগেডিয়ার ছিল এবং বেশকিছু অফিসার ছিল।

প্রশ্নঃ আপনাদের মধ্যে কে কে ছিলেন সারেন্ডারের সময় ?
উত্তরঃ সারেন্ডারের সময় আমরা কেউ ছিলাম না। ইন্ডিয়ান আর্মি সারেন্ডার কন্ডাক্ট করে। আমাদের বাংলাদেশের ফোর্সকে সিলেটে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সুরমা ব্রীজ তখন ভেঙ্গে গিয়েছিল, ইন্ডিয়ান আর্মি তা মেরামত করছিল। তাদেরকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, বাংলাদেশের কোন গাড়ী এদিক-ওদিক করবেনা এবং আমাদেরকে যেতে নিষেধ করা হয়েছিল।

প্রশ্নঃ পরে আপনারা পুরো ব্যাটালিয়ন মুভ করেন কিভাবে ?
উত্তরঃ পরে আমরা শ্রীমঙ্গল যাই। সেখানে জানুয়ারী-ফেব্রুয়ারী ছিলাম। পরে ২১শে ফেব্রুয়ারী চিটাগাং এ পৌঁছাই কমান্ডিং অফিসারের সঙ্গে।