সাক্ষাৎকারঃ মেজর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
১০ই জুন ‘জেড’ফোর্সে যোগদানের জন্য ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের এডভান্স পার্টি হিসাবে ৪ জন জে-সি-ও ও ১১৯ জন জোয়ান নিয়ে হিলি থেকে তেলঢালার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ১৪ই জুন তেলঢালায় পৌঁছে। তেলঢালায় ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ৩য় বেঙ্গল ও ৮ম বেঙ্গলের অফিসার ও জোয়ানদের একত্রিত করে যুদ্ধের জন্য পুনর্গঠন করা হয়। ছাত্র-যুবকদেরকেও সৈনিক হিসাবে ভর্তি করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ২৮শে জুলাই পর্যন্ত পূর্ণোদ্যমে প্রশিক্ষণ চলে। ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন তৎকালীন মেজর (বর্তমান কর্নেল) শাফায়াত জামিল সাহেব। আরও ছিলাম ‘জেড’ফোর্সের ‘এ’কোম্পানী কমান্ডার আমি ক্যাপ্টেন আনোয়ার হোসেন, ‘বি’কোম্পানী মেজর আকবর, ‘সি’কোম্পানী কমান্ডার মেজর মহসীন, ‘ডি’কোম্পানী কমান্ডার লেঃ নূরুননবী।
‘জেড’ফোর্সের প্রথম অপারেশন হিসাবে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ময়মনসিংহ জেলার বাহাদুরাবাদ ঘাট, দেওয়ানগঞ্জ বাজার ও দেওয়ানগঞ্জ চিনির কলের পাক-বাহিনীর ঘাঁটির উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
২৯শে জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় অধিনায়ক শাফায়াত জামিল এবং আমরা ‘এ’ও ‘ডি’কোম্পানী বাহাদুরাবাদ ঘাটের উদ্দেশে রওয়ানা হই। সারা রাত ৩০ মাইল পায়ে হেটে বাহাদুরাবাদ ঘাটের অনতিদূরে ব্রহ্মপুত্র নদের অপর পাড়ে চরে পৌঁছি। সারাদিন জোয়ানগণ বিশ্রাম নেয়। বিকালে অধিনায়ক ও আমরা দুই কোম্পানী কমান্ডার এলাকা রেকি করি।
৩১শে জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ২ কোম্পানী বাহাদুরাবাদ ঘাটের উদ্দেশে রওনা হয়। রাত্রি সাড়ে এগারটায় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পৌঁছি। রাত্রি ১২টার সময় আমরা ২ কোম্পানী অতর্কিতভাবে পাক ডিফেন্সের উপর আক্রমণ করি। পাকবাহিনীর সহিত ১ ঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। পরে পাকবাহিনীদের গোলাবারুদ বোঝাই একটি বার্জ ডুবে যায় এবং পাকবাহিনীর ১০০ সৈন্যের মত হতাহত হয়। সেখানে আমরা ৩” মর্টার, রকেট লাঞ্চার ও মেশিনগান ব্যবহার করি। রাত্রি ভোর হওয়ার আগেই পুনরায় ব্রহ্মপুত্র নদ পার হয়ে ২ মাইল ভিতরে অপর এক চরে আমরা সকলে আত্মগোপন করি।
১লা আগস্ট পাকবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার সারাদিন আমাদের খুঁজে বেড়ায় কিন্তু আমরা খুব সতর্ক থাকায় আমাদের সন্ধান পায়নি। তারপর আমরা দেওয়ানগঞ্জ অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হই।
২রা আগস্ট সন্ধ্যার সময় ৬টা নৌকাযোগে দেওয়ানগঞ্জ বাজার ও চিনি কলের দিকে রওনা হই। পথে বাহাদুরাবাদ ঘাট ও দেওয়ানগঞ্জের মাঝখানে একটি রেলওয়ে ব্রীজ লেঃ নুরন্নবী উড়িয়ে দেন, যাতে পাকবাহিনী বাহাদুরবাদ সহজে আসতে না পারে। গভীর রাতে দেওয়ানগঞ্জের অনতিদূরে গিয়ে আমরা ‘এ’কোম্পানি নিয়ে দেওয়ানগঞ্জের সুগার মিলে পাক ডিফেন্সের দিকে অগ্রসর হই। লেঃ নুরন্নবী দেওয়ানগঞ্জ বাজারের দিকে চলে যান। রাত্রি পোনে চারটায় একই সময়ে নিজ নিজ টারগেটের উপর আক্রমণ চালাই। ৪৫ মিনিট এই হামলা চলে। আমাদের আক্রমণে দেওয়ানগঞ্জ সুগার মিল ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বহু পাকসেনা হতাহত হয়। দেওয়ানগঞ্জ বাজারে রাজাকার প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ও রেলওয়ে ষ্টেশনের বহু ক্ষতি সাধিত হয়। সেই সময় সেখান থেকে নৌকাযোগে আমরা অপর চরে আত্মগোপন করি। আমাদের এই দুটি আক্রমণে ঐ এলাকার স্থানীয় জনগণ ও স্থানীয় এফ-এফ কমান্ডার আমাদের সর্বপ্রকার সাহায্য করেন।
২রা আগস্ট আমরা তেলঢালার উদ্দেশ্যে রওনা হই। ৫ই আগস্ট আমরা তেলঢালায় এসে পৌঁছি।
৮ই আগস্ট আমার ‘এ’কোম্পানী নিয়ে রৌমারী থানাকে আমাদের দখলে রাখার উদ্দেশ্যে কীর্তিমারী চরে ডিফেন্স নিই, পরে কোদালকাটির চর, পীরের চর ও চর সাজাইতে আমার বিভিন্ন প্লাটুনকে ডিফেন্সে লাগাই। উক্ত চরে ১৫ই সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিফেন্সে থাকি। এই পাঁচ সপ্তাহে পাকবাহিনী কয়েকবার নদীপথে হামলা চালায়, কিন্তু প্রতিবারই আমাদের হাতে আক্রান্ত হয়ে পিছনে হটে যায়। এখানে পাক বাহিনীর অনেক সৈন্য আহত হয়। আমাদের পক্ষের পনের জন জোয়ান আহত হয়। এই পাঁচ সপ্তাহে আমরা চীলমারী থানার কয়েকটি গেরিলা অপারেশন করি।
১৬ই সেপ্টেম্বর প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের লেঃ কাইয়ুম তার কোম্পানী নিয়ে আমাদের নিকট থেকে দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন। আমি আমার কোম্পানী নিয়ে তেলঢালায় ফিরে আসি। ৪ঠা অক্টোবর পর্যন্ত তেলঢালার আশেপাশে কয়েকটি ছোট ছোট অপারেশন করি।
৬ই অক্টোবর ‘জেড’ফোর্স তেলঢালা ছেড়ে দিয়ে তৎকালীন ৪ ও ৫ সেক্টরের দিকে সেক্টর কমান্ডার লেঃ কর্নেল মীর শওকত আলী ছাতক আক্রমণের জন্য আমাদের কোম্পানী কমান্ডারদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। ১০ তারিখ সকালে উক্ত এলাকা রেকি করা হয়। ১১ তারিখ রাত্রে ছাতকের সন্নিকটে মহড়াটিলা নামক জায়গা দখল করে ফেলি। আমার বাম পার্শ্বে মেজর আকবর তার কোম্পানী নিয়ে জয়নগর টিলাতে ডিফেন্স নেন। ১২ তারিখ সকালে পাক বাহিনী আমাদের গতিবিধি দেখতে পায় এবং সেখানে পাক বাহিনীর সাথে আমাদের সঃঘর্ষ হয়। আমরা সেখানে সর্বাধুনিক হাতিয়ার ব্যবহার করি। এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর ২ জন অফিসার নিহত হয় ও একজন কর্নেল আহত হয়। তাছাড়া বহু পাকসেনা হতাহত হয়। ঐ দিন রাত্রিতে আমরা সেখানেই থেকে যাই।
১৩ তারিখ রাত্রি ৯ ঘটিকার সময় সুরমা নদীর পাড়ে নড়াই গ্রাম ও সিমেন্ট কারখানার উপর আক্রমণ করি। আমাদের আক্রমণে পাকবাহিনী পিছু হটে যায়। আমরা নড়াই গ্রাম ও সিমেন্ট কারখানা দখল করে ফেলি এবং রাত্রেই সেখানে ডিফেন্স করি।
১৪ তারিখ সকালে পাক বাহিনীর একটি লঞ্চ ছাতক আসার পথে রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে সেটিকে ডুবিয়ে দিই। সেখানে ৯ জন খান সেনা নিহত হয় এবং রাজাকার ইসাহাকসহ ৯ জন আমাদের হাতে ধরা পড়ে। এখানে ১৪টি রাইফেল উদ্ধার করি। সারা দিন তাদের সাথে আমাদের যুদ্ধ চলে। আমাদের ৩ জন আহত হয়।
১৫ তারিখ আমরা ছাতক ঘিরে ফেলি। সেই দিন পাকবাহিনীর একটি গানবোট নদী পার হবার চেষ্টা করলে রকেট লাঞ্চারের সাহায্যে ডুবিয়ে দিই। সেখানে ৩ জন খান সেনা নিহত হয়।
১৬ই অক্টোবর দুপুরের দিকে আমাদের ডিফেন্স পাক বাহিনী ভীষণ শেলিং করে এবং সন্ধ্যার দিকে ‘বি’কোম্পানীর পজিশনে হামলা করে ও তাদের জয়নগর টিলা দখল করে নেয়। এই দিন বিকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত আমার জন্য সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তজনক সময় ছিল। কারণ অয়্যারলেস সেট নষ্ট ছিল। সন্ধ্যায় প্রথমে শুনতে পাই ‘পাক ফৌজ জিন্দাবাদ’ও পরে শুনতে পাই ‘মুক্তি ফৌজ জিন্দাবাদ’। এ নিয়ে সন্দেহে পড়ে যাই। তখন সঠিক সংবাদের জন্য ২ জনকে পাঠাই কিন্তু তারা আর ফিরে আসেনি। শেষে রাত্রি সাড়ে ন’টার সময় মেজর আকবর আমার সিমেন্ট কারখানায় এসে সঠিক খবর দেন। জয়নগর টিলা পাকবাহিনী দখল করে নেবার পর বাধ্য হয়ে রাত্রি ১০টায় আমার কোম্পানী ও ‘বি’কোম্পানী নিয়ে সমস্ত রাত্রি বিলের মাঝ দিয়ে পানিতে হেঁটে টিলাগাও আসি। সেই সময় পাক বাহিনীর উপর হামলার প্রস্তুতি নেই। কিন্তু সেই সময় সেখানে পাক বাহিনী ছিল না। পরে বলুয়া হয়ে বাঁশতলা ক্যাম্পে পৌঁছি। এই ৫ দিনের যুদ্ধে আমাদের ব্যাটালিয়নের হাতে পাক বাহিনীর প্রায় ৪০০ মত হতাহত হয়। আমাদের ৭ জন শহীদ ও বেশকিছুসংখ্যক আহত হয়।
ছাতক অপারেশনের পর ৩ নং ব্যাটালিয়ন নিয়ে সিলেটের বিমান বন্দর আক্রমণ করার জন্য তামাবিল সীমান্তে ডিফেন্স নেই। সেখানে বেশ কয়েকটি অপারেশনের পর আমার কোম্পানী গোয়াইনঘাট থানা মুক্ত করে। ডিসেম্বর মাসের ৯ তারিখে আমার কোম্পানী নিয়ে সালুকটির বিমান বন্দরের অনতিদূরে পৌঁছে যাই। তখন আমাদের সাথে ভারতীয় আসাম রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী ছিল। সালুকটির নদী এলাকা পর্যন্ত মুক্ত হওয়ার পর ১০ই ডিসেম্বর আমাকে ও আসাম রেজিমেন্টের উক্ত কোম্পানীকে মীর শওকত ছাতক ডেকে পাঠান আমাদের ব্যাটালিয়নরে ‘বি’ও ‘সি’সাহায্য করার জন্য। ১১ তারিখে সুনামগঞ্জ-ছাতক রোড জংশনে আমাদের উক্ত দুই কোম্পানীর সাথে একত্রিত হই এবং সম্মিলিতভাবে পাক বাহিনীর উপর তীব্র আক্রমণ চালাই। পাকবাহিনী আমাদের হাতে মার খেয়ে সিলেট অভিমুখে রওনা হয়। ১৬ই ডিসেম্বর আমরা মালাগাছ ফেরির পশ্চিম পাড়ে ডিফেন্স লাগাই। সেদিন পাকবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। আমরা আমাদের ব্যাটালিয়নসহ সিলেটে পাক্কা ডিফেন্স করি।
স্বাক্ষরঃ মোঃ আনোয়ার হোসেন/মেজর
কুমিল্লা সেনানিবাস