সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার মোসলেহউদ্দীন আহমদ
২৬-৬-৭৩
আগষ্ট মাসের ৩০ তারিখে ঢাকা সেনানিবাসের কড়া পাহারার মধ্যে দিয়ে অন্ধকার রাত্রিতে পাহারাদারের কাছ থেকে রাইফেল হস্তগত করে পালাতে সক্ষম হই।অতঃপর সেনানিবাসের কিছু দূরে এক জঙ্গলে রাত্রি অতিবাহিত করি।পরেরদিন সকালে রাইফেলটি একটি গর্তে পুঁতে ছদ্মবেশে ময়মনসিংহের পথে রওনা হই।১০ দিন চলার পর নেত্রকোনা মহকুমার উত্তর অংশের সীমান্ত মহেশখোলা দিয়ে ভারত প্রবেশ করি।ঐ দিন ছিল মে মাসের ৯ তারিখ।সেখানে ডাক্তার আখলাক হোসেন এম-পি-এ র কাছে হাজির হই।তার কাছ থেকে পরিচয়পত্র নিয়ে তুরা চলে যাই।সেখানে আমাদের ১১ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল।তখন ঐ সেক্টরের নেতৃত্বে দিচ্ছিলেন কর্ণেল আবু তাহের।তিনি কামালপুরের যুদ্ধে আহত হওয়ার পর স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ নেতৃত্বে দেন।সেই সময়ে সাবসেক্টরের (কিশোরগঞ্জ,নেত্রকোনা) নেতৃত্বে দিতেন ভারতীয় আর্মির একজন ক্যাপ্টেন।এর কিছুদিন পর বাংলাদেশ আর্মির ক্যাপ্টেন হামিদ ( বর্তমানে মেজর মতিয়ার রহমান) ঐ কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনা অর্থাৎ ১১ নং সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন।ক্যাপ্টেন হামিদের নেতৃত্বে আর্মি মেডিক্যাল অফিসার মনোনীত হয়ে কয়েকশত মুক্তিযোদ্ধাসহ মহেশখোলা দিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে প্রবেশ করি।সেখান থেকে নৌকাতে হাসপাতালের যাবতীয় ঔষধপত্র ও সরঞ্জাম নিয়ে বাংলাদেশের ভিতরে ধরমপাশা থানার দিকে রওনা হই।বাংলাদেশে প্রবেশ করার পথেই আমাদেরকে যোগাযোগ এবং নিরাপত্তার জন্য স্থানীয় আওয়ামীলীগ কর্মীবৃন্দের সহায়তায় স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প তৈরি করে আসি।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায় যে,আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ ছিল ধরমপাশা থানা মুক্ত করা।কারণ সেখানে তিন মাইল চতুর্দিকে খান দস্যুরা অগ্নিসংযোগ,নারী নির্যাতন,হত্যা,লুন্ঠন ও ব্যভিচার করে উক্ত স্থানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল।উক্ত থানা হেডকোয়ার্টারে প্রায় ২৫০ জন পাকসেনা,রাজাকার,আলবদর মুজাহিদ নিয়ে গঠিত এক ঘাঁটি ছিল।সেই দূর্ভেদ্য ঘাঁটিকে প্রথমে আমরা টার্গেট করলাম। কিন্তু কয়েকবারই আমরা ব্যর্থ হই।এর পরপরই মরণপণ করে তিনটি প্লাটুনে বিভক্ত হয়ে তিনদিক থেকে আক্রমণ করি।প্রথম প্লাটুনের নেতৃত্বে দেন মেজর মতিয়ার রহমান,২ নং প্লাটুনের নেতৃত্বে দিই আমি নিজে এবং ৩ নং প্লাটুনের নেতৃত্বে দেন নায়েক আব্দুর রহমান (বাংলাদেশ রাইফেল)। আমার ২ নং প্লাটুন সামনের দিকে ছিল।তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়।অয়ারলেস সেটের সাহায্য আমরা অভ্যন্তরীণ যোগা্যোগ রক্ষা করে চলি।এই যুদ্ধে আমাকে নেতৃত্ব দেওয়া ছাড়াও মেডিক্যাল অফিসারের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে।পাক বাহিনীর পাল্টা আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন শহীদ হন।প্রচন্ড আক্রমণের ভিতর দিয়ে শহীদ বীরের মৃতদেহ আমি নিজে বহন করে নিয়ে আসি।বাকী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে উৎসাহের সহিত সামনের দিকে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিই এবং আমি নিজে তাদের সংগে যুদ্ধ করি।যার ফলে তারা সাহস হারায়নি।মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তাদের মনোবল অটুট থাকে।তিনদিকের প্রচন্ড আক্রমণে খানসেনারা দিশেহারা হয়ে ১৫ জনের মত খতম হয়।বাকিরা সন্ধার অন্ধকারে পালিয়ে মোহনগঞ্জ থানার দিকে চলে যায়।উক্ত স্থান মুক্ত করে একটি প্লাটুনকে এখানে ডিফেন্সের জন্য রেখে বাকি দুই প্লাটুন ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধা সহ পরেরদিন মোহনগঞ্জ আক্রমণ করি।উক্ত ধরমপাশা থানা মুক্ত হবার পর আমার সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর মতিয়র রহমান আমার বীরত্বের পরিচয়সূচক বীর প্রতীক উপাধিতে আমাকে ভূষিত করেন।যা বাংলাদেশ সরকার শেষে মঞ্জুর করেছেন।
মোহনগঞ্জ আক্রমণ করে প্রায় ২৫ জন খানসেনাকে হত্যা করি এবং উক্ত থানা মুক্ত করি।এরপর আমাদের কাজ পরিবর্তনের নির্দেশ পাই।ভৈরব বাজার থেকে কেন্দুয়া পর্যন্ত যে রেল যোগাযোগ আছে তা বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ পাই।এরপর ক্রমান্বয়ে কেন্দুয়া,আঠারোবাড়ি,নীলগঞ্জ,করিমগঞ্জ,মদন প্রভৃতি স্থানে যুদ্ধ করি ও অসংখ্য খানপশুদের হত্যা করে উল্লেখিত স্থানগুলো মুক্ত করি।তখন ব্যাটালিয়ন আ্যডজুট্যান্ট,এ্যাডমিনিসট্রেটিভ অফিসার ও অন্যান্য গুরুদায়িত্ব পালন করি।দেশ মুক্ত হবার পর সেক্টরের যাবতীয় কাগজপত্র সেক্টর হেডকোয়ার্টার ময়মনসিংহে জমা দিয়ে আমার পুরানো চাকরিতে যোগদান করি।
স্বাক্ষরঃ মোসলেহউদ্দিন আহমদ