সাক্ষাৎকারঃ লেঃ শামসুল আরেফিন*
২০/৩/১৯৭৩
মুজিবনগরে বাংলাদেশ সেনানিবাসে হাজির হই ১১ ই মে। সেখান থেকে ফিল্ড কমিশন নিয়ে ৯ নং সেক্টরে পাঠিয়ে দেয়। খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী ৯ নম্বরের অধীনে ছিল। প্রথম হিঙ্গলগঞ্জ অপারেশন ক্যাম্পে আসি। এখানে দেড় মাস থাকি।
১৩ ই মে থেকে ৬ ই জুলাই পর্যন্ত আমি ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে ৪টি অপারেশন যন-খাঞ্জিয়া বি-ও-পি, বসন্তপুর বি-ও-পি, কালিগঞ্জ থানা হেডকোয়ার্টার এবং উকশা বি-ও-পি (খুলনা)।
৭ ই জুলাই খলনা জেলার প্রধান হিসাবে আসি এবং খুলনা জেলার আশাশুনি থানার বড়দল এলাকায় (বাংলাদেশ) আমার ঘাঁটি স্থাপন করি। আমার সঙ্গে ১০০ জন এফ-এফ এবং ১৫ জন নিয়মিত বাহিনীর সদস্য ছিল। ১১ ই জুলাই পাইকগাছা থানার কপিলমুনির রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করি। সারারাত যুদ্ধ করে আমরা ফিরে আসি। বড়দলে একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলি এবং লোক ভর্তি করতে থাকি।
জুলাই মাসের শেষের দিকে আমার উপর নির্দেশ আশে মঙ্গলা পোর্ট আক্রমণ করবার জন্যে। ইতিমধ্যে ১০ জন ন্যাভাল কমান্ডোসহ একজন লিডিং সীম্যান (ফ্রান্স থেকে পালিয়ে এসেছিল), এম, বি, আলকে অস্ত্রসহ আমার কাছে পাঠানো হয়। ন্যাভাল ১১ জন মিলে মঙ্গলা পোর্টে রওনা হই। আমি কমান্ডিং অফিসার ছিলাম।সুসন্দরবনের ভিতর লাওতাড়াতে ঘাঁটিতে আসি, যেখানে পূর্বেই আমার কিছু বাহিনী ছিল। ৯ই আগস্ট রাত ১২/১ টার দিকে সাঁতার দিয়ে বাহিনী চলে আসে মঙ্গলা পোর্টের দিকে। সাঁতরে গিয়ে চুম্বক মাইন লাগিয়ে চলে আসে তিনটি জাহাজে। আধঘন্টা পর মাইন বিস্ফোরিত হয়, আমরা সঙ্গে সঙ্গে ফায়ার ওপেন করি। আমরা সবাই নিরাপদে আসি। জাহাজ তিনটা ডুবে যায়। ১১ আগস্ট তারা পুনরায় যায়। সেদিন দুটি জাহাজ আমরা ধ্বংস করি। ঐ দিন গফুর নামে একজন ন্যাভালকে হারাই। তবে দু’দিন পর সে আমাদের ক্যাম্পে ফিরে আসে।
১২ ই আগস্ট ভোরে পাক নেভী দু’দিক থেকে আমাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। আমরা ওখান থেকে পিছু হটতে বাধ্য হই। আমরা মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসি। মুল ঘাটিতে এসে প্রত্যেক থানাতে একটি করে ঘাঁটি তৈরীর জন্য ব্যাস্ত হয়ে পড়ি। রাজনৈতিক কর্মীসহ মুক্তিবাহিনী গঠন করে খুলনার দিকে অগ্রসর হতে থাকি। আমাকে সহায়তা করতে এম-সি-এ গফুর।
আগষ্ট মাসের শেষের দিকে খুলনা জেলার আশাশুনি থানাতে রাজাক্র ও পাকিস্তানী ডেককোয়ার্টার আক্রমণ করি। একদিন অবরোধ করার পর দ্বিতিয় দিনে সাতক্ষীরা থেকে পাকবাহিনীর এবং খুলনা থেকে নেভী এসে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। ১২/১৪ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ হয় ওদের সঙ্গে। পাকবাহিনী ২ জনকে ধরে ফেলে এবং মনোরঞ্জন হালদার নামে একজন মুক্তিসেনা মারা যায়। আমরা ৩ জন মিলিশিয়াসহ ১৬ জন ১৬ জন রাজাকারকে হত্যা করে ২৬ টি অস্ত্র উদ্ধার করি। পাকসেনারা পিছু হটে চলে যায়।
সেপ্টম্বর মাসের প্রথম দিকে পাইকগাছা থানার বাকাঘাটি পাকবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ করে। ওখানে আমদের দলের দুজনকে ধরে নিয়ে যায়। একজন মারা যায় এবং ১ জন আহত হয়। আমরা বাকাঘাঁটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যাই। ৭ দিন পর বাকাঘাটি পুনরায় দখল করি। এসময় প্রধান উপদেষ্টা এবং সহকারী ছিলেন জনাব বাবর আলী (বর্তমানে জাতীয় পরিষদ সদস্য)।
এরপর ক্রমশ ঘাঁটির সংখ্যা বাড়াতে থাকি। হেডকোয়ার্টার বড়দল থেকে বদলী করে পাইকগাছা থানার হাতিয়ারডাঙ্গাতে নিয়ে আসি এবং ৪টি প্রশিক্ষন কেন্দ্র খুলি। মুক্তিবাহিনী এবং নেভী দুটরই ট্রেনিং হতো। সেপ্টম্বর মাসের শেষের দিকে পাইকগাছা গরুইখালি গ্রাম থেকে অস্ত্রসহ ২২ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসে ঐ মাসেই পাইকগাছা থানা আক্রম করি এবং স্তাফসহ ৬/৭ জন রাজাকারকে ধরে নিয়ে আসি।
অক্টোবর মাসের প্রথমে দুটি দল দু’দিকে পাঠাই- একটি দাকোপ থানায়, অন্যটি তালা থানাতে। দাকোপ থানার খাটালি গ্রাম থেকে ১৭ জন রাজাকারকে অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে আমার বাহিনী তালা থানার দল ১৮ মাইল রাস্তার মোড়ে পাকবাহিনীর মুখোমুখি হয়। যশোর-পাটকেলঘাটা রাস্তা নষ্ট করে দেয়। যাবতীয় যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে নির্দেশ আসে সুন্দরবনের ভিতর নিউজপ্রিন্ট মিল আক্রমণ করার জন্য। ওই ঘাঁটিতে বোট এবং শিপ ছিল ‘লালশেরা’। আমরা ওইগুলি ডুবিয়ে দিই মাইন দিয়ে। এখানে আমার ভাই আয়ুবআলী গাজি প্রধান সহকারী ছিল। ভাই পরবর্তীকালে মারা যায়।
অক্টবরের শেষের দিকে আবার মনহলা পাট আক্রমণ করি। এবার তিনটি শিপ ডুবিয়ে দেই। এসময় বাজুয়াতে আমাদের সাথে ভীষন যুদ্ধ হয়। আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। পাক পক্ষ বাজুয়া ঘাঁটি ছেড়ে চলে যায়। বাজুয়াতে আমাদের ঘাঁটি স্থাপন করে খুলনাতে অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়ে দিই আমাদের লোকের কাছে।
১৯ শে নভেম্বর পাকবাহিনীর ক্যাম্প কালিগঞ্জ থানা আমরা আক্রমণ করি। দিনটি ছিল ঈদের দিন। পাকবাহিনী বহু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে কামান্ডিং অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন হুদা।
২৫শে নভেম্বর কপিলমুনি পাইকগাছা থানা আমরা আক্রমণ করি। এখানে আমার প্রধান সহকারী ছিলেন মিঃরহমতুল্লাহ (নেভী), কামরুজ্জামান( টুকু) এবং বাবর আলী। তিনদিন যুদ্ধের পর ৩৫০টি রাইফেল উদ্ধারসহ ১০৭ জনকে গ্রেফতার করি। আমার ২ জন শহীদ হন ;ইয়ান্সনায়ক গাজী ও আনোয়ার ২ জন আহত হোন। এই সময় আমার আর একটি দল আশাসুনি থানা হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করে। থানা ষ্টাফসহ দেড়শ’ রাইফেল, ২ জন পাঞ্জাবী পুলিশ, ৫৭ জন রাজাকার হরে নিয়ে আসে। আশাসুনি থানার ব্যাঙ্গদোহাতে আমার একটি দল আক্রমণ চালিয়ে ৩ জন পাঞ্জাবী পুলিশ ২ জন মিলিশিয়া এবং দেড়শ’ রাইফেলসহ ১০০ রাজাকার গ্রেফতার করা হয়।
২০ শে নভেম্বর আমার হেডকোয়ার্টার বৈঠাঘাটাতে স্থানান্তরিত করি। এসময় চালনা বাজারের সব রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। ২৮শে ডুমুরিয়া থানার বার আড়িয়া বাজার আক্রমণ করি। আজিজ সহ আমাদের ৩ জন মারা যায়। বিপুল অস্ত্রশস্ত্রসহ ১৬ জন রাজাকার আমরা ধরে নিয়ে আসি।
৮ই ডিসেম্বর মেজর জয়নাল আবেদীন ইঞ্জিনিয়ার আমার সাথে যোগ দেন। ১০ই ডিসেম্বর খুলনা বেতার ভবন আক্রমণ করি। সারারাত যুদ্ধ করি, কিন্তু জোয়ারের পানি আসার জন্য আমরা ফিরে আসি। আমাদের ২ জন আহত হয়।। এ সময় অয়ারলেস মারফত কর্নেল মঞ্জুর সাহেবের সাথে আমার যোগাযোগ হয় এবং তিনি খুলনা আক্রমণের পরিকল্পনা দেন। ১৫ই ডিসেম্বর ভোরবেলা খুলনা আক্রমণ করি। দু’ভাবে আক্রমণ করি একটি জলপথে অপরটি স্থলপথে। নদীপথে কামান্ডার ছিলাম আমি এবং স্থলপথে ছিলেন মেজর জয়নাল আবেদীন, বাবর আলী নেভী রহমতুল্লাহ। সকাল ৬টার দিকে খুলনা জেলা জয় করি এবং বাংলাদেশের পতাকা তুলে দিই ১৬ ই ডিসেম্বর। আমার বাহিনীর কিছু সেনা (৫ জন) মারা যায়।
বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাঞ্জাবী শোষণ থেকে মুক্তি লাভের জন্য অস্ত্র ধরি।
স্বাক্ষরঃ এম, আরেফিন
২৮-৩-৭৩
** পাকিস্তান মইলিটারী একাডেমিতে জেন্টেলম্যান ক্যাডেটরুপে প্রশিক্ষণ গ্রহনকালে সেখান থেকে পালিয়ে এসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।