সাক্ষাৎকার শামসুল আলম তালুকদার
মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতৃত্বে শরণখোলা থানা আক্রমন করলে পুলিশবাহিনী সাথে সাথে অস্ত্র দিয়ে- ৩২ টি রাইফেল এবং আরও অনেক গোলাগুলি পাওয়া গিয়েছিল। ওখান থেকে ক্যাপ্টেন জিয়া কিছু অস্ত্র আমাকে দেন এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার আজিজকে (ফুলমিয়া) দেন।
আমি আমার কিছু লোক, খাবার এবং অস্ত্র নিয়ে সুন্দরবনের ভোলা নদীর পশ্চিম পাড়ে শরণখোলা এবং চানপায়ে রেঞ্জ অফিসের মধ্যবর্তী স্থান ধানসাগর নামক অফিসের বিতরে প্রথম ঘাঁটি গাড়ি। পরিকল্পনা নিই গ্রাম আক্রান্ত হলে সবাইকে এই ঘাঁটিতে নিয়ে এসে পরবর্তীতে বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালাবো।
শরণখোলা থানা এবং মোড়লগঞ্জ থানার অঞ্চল অধিকাংশ হিন্দুগ্রাম। মওলানা ইউসুফের নেতৃত্বে জামাতে ইসলাম মুসলিম লীগ এবং অন্যান্য পাকিস্তান পন্থীরা ঐ এলাকায় লুটপাট শুরু করে। আমার দলের লোকজন দিয়ে প্রায় ১০ টি গ্র“প করে কিছু অস্ত্র দিয়ে পাহারার ব্যবস্থা করি। মাওলানা ইউসুফের দল শুধু লুট নয় নয় নারীদর্ষণও শুরু করে। আমরা প্রতিরোধ দিলে অবস্থা কিছুটা আয়ত্তে আসে। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে শরনখোলা থানাতে রাজাকার বাহিনী তৈরী হয় রাজস্ব দল নিয়ে মোড়লগঞ্জ থানায় যায়। মধু থানাতে পৌঁছুলে আমি এবং মধু যৌথভাবে কাজ শুরু করি। ৪০ জন রাজাকার ইতিমধ্যে মোড়লগঞ্জ থানাতে আসে।
২রা জুন আমরা যৌথভাবে মোড়লগঞ্জ থানা আক্রমণ করি। ওখানে ভাসানী ন্যাপের সংগঠনিক সম্পাদক আবু বকর শহীদ হলেন। রাজাকার ৩ জন খতম হয়। ভোর হয়ে গেলে আমরা পিছু হটি। তারপর রাজাকাররা বাগেরহাট পালিয়ে যায়। প্রাথমিক অবস্থায় বিক্ষিপ্তভাবে বিভিন্নজন অস্ত্র নিয়ে গিয়েছিল। তার ফলে মোড়লগঞ্জ থানার সোনাখালী, ফুলহাতা হ্যামড়া, পাঁচগাঁও, ঢুলিগাতি গজারিয়া ইত্যাদি অঞ্চলে ডাকাতি শুরু হয় ব্যাপকভাবে। হিন্দুবাড়ি লুটপাট, নারীধর্ষণ করে তার সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো। ক্যাপ্টেন জিয়া জুন মাসের মাঝামাঝি আমাদের সাথে যোগ দেন। তিনি তখন দক্ষিন অঞ্চলের সর্বাধিনায়ক হয়। আমি, হাবিলদার মধু এবং ক্যাপ্টেন জিয়া ১০০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে ঐসব গ্রামে গিয়ে ৮ জন ডাকাত খতম করি এবং অস্ত্র উদ্ধার করি।
জুন মাসের ২০/২২ তারিখ হবে পাঁচখানা গানবোট ও ২ টি জাহাজে করে প্রায় ৫০০ পাকসেনা এবং ৪০০ রাজাকার মোড়লগঞ্জে উপস্থিত হয়। মোড়লগঞ্জে আমাদের যে ঘাঁটি ছিল সেখান থেকে যাবতীয় অস্ত্র এবং সব বাহিনী নিয়ে আমি সুন্দরবনের পুরানো ঘাঁটিতে নিরাপদে চলে যাই। পাকসেনা এবং রাজাকাররা ওখানে গিয়ে আমাদের ক্যাম্প সহ বহু ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং অসংখ্য লোককে হত্যা করে। পরে রাজাকাদের রেখে পাকসেনারা চলে যায়। এরপরে আমরা সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্প করা শুরু করি। ক্যাপ্টেন জিয়া এখান থেকে বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের আনোয়ার এবং হাবিদার আজিজ (ফুলমিয়া) ২০০-এর উপরে মুক্তিযোদ্ধা থানা আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সাথে তিনি যোগাযোগ করেন এবং জুন মাসের শেষের দিকে রায়েন্দা থানা আক্রমণ করেন সুবেদার আজিজের নেতেৃত্ব। ওখানে আনোয়ার সহ আরও ক’জন শহীদ হন। ঐ মাসেই ক্যাপ্টেন জিয়া ভারতের চলে যান অস্ত্রের জন্যে।
শরণখোলা, মোড়লগঞ্জ থানাতে রাজাকারা ক্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে থাকে। হিন্দুসহ ন্যাপ এবং আওয়ামী লীগের সমর্থকদের বাড়িঘর ভোগদখল এবং নারীদের উপর অত্যাচার করতে থাকে। লোকজন ধরে হত্যা শুরু করে। এই অবস্থায় আমাদের বাহিনী নিয়ে কায়দার মাঝে মাঝে আক্রমণ চালাতে থাকি এবং বিক্ষিপ্তভাবে রাজারদের খতম করতে থাকি। ইতিমধ্যে হাজার হাজার লোক ঘরবাড়ি মান-ইজ্জত হারিয়ে সুন্দরবনে আশ্রয় নিতে থাকে ভারত যাবার জন্য।
ক্যাপ্টেন জিয়া ১৩ ই আগস্ট ভারত থেকে প্রচুর অস্ত্র নিয়ে এখানে আসেন । সেই সাথে ৫০ জন ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলা এবং ন্যাভাল কমান্ডো নিয়ে আসেন। ১৪ ই আগস্ট সুন্দরবন এলাকাতে তিনি সকাল মুক্তিযোদ্ধার কনফারেন্স ডাকেন। ওখানে তিনি বাংলাদেশে সরকারের নিয়োপত্র দেখান। সেখানে ৪ টি জেলার গেরিলা কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ ছিল। সভায় ১০০০-এর মত উপস্থিত ছিল। তিনি এই সভাতে সম্পূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা জন্যে কতগুলি বিভাগ এবং উপবিভাগুলি ছিলঃ (১) অপারেশন বিভাগ (২) খাদ্য বিভাগ (৩) অর্থ সংগ্রহ বিভাগ (৪) যোগাযোগ বিভাগ (৫) বেতন বিভাগ (৬) হাসপাতাল বা চিকিৎসা বিভাগ (৭) ভারতের সাথে যোগাযোগ বিভাগ (৮) শরনার্থী দেখাশোনা এবং পাঠানোর জন্যে বিভাগ (৯) ট্রেনিং বিভাগ (১০) রিক্রিুটিং বিভাগ। খুলনা জেলার যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক সাব- কমিটিও গঠন করা হয়। নিম্নলিখিত লোক নিয়ে কমিটি গঠিত হয় (১) ক্যাপ্টেন জিয়া- কমান্ডিং অফিসার (২) সেকেন্ড-ইন-কমান্ড- শামসুল আলম তালুকদার (৩) আবুল কালাম মহিউদ্দিন- সিকিউরিটি অফিসার (৪) আবুল আসাদ- অপারেশন অফিসার (৫) শহীদুল আলম বাদল- অস্ত্রগারের দায়িত্ব (৬) নূর মোহাম্মদ হাওলাদার- কনস্ট্রকশন বিভাগ (৭) মোস্তফা হেলাল খাদ্যের ভারপ্রাপ্ত। বাগেরহাট মাহকুমার জন্যঃ (১) নায়েক সুবেদার মধু কমান্ডিং অফিসার (২) সাতক্ষীরার আফজাল (৩) মোড়লগঞ্জ থানার জন্য আলী, (৪) শরণখোলা থানার জন্য হাবিলদার আজিজ (ফুলু) এছাড়া বাগেরহাটের উত্তর অঞ্চলে যোগাযোগের জন্য লোক নিযুক্ত করা হয়। বরিশাল ক্যাপ্টেন জিয়া হাবিলদার মধু এবং আজিজকে অস্ত্র ভাগ করে দেন এবং বাকি অস্ত্র নিজের কাছে রাখেন।
সুন্দরবনের ঘাঁটিকে খুলনা বিভাগের সামরিক হেডকোয়ার্টার ঘোষাণা করা হয়। ঐ সভাতেই ১৩ ই আগস্ট মোড়লগঞ্জ থানা আক্রমণ করা হবে বলে সিদ্ধান নেয়া হয়। ১৫ ই আগস্ট সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন জিয়া নিজেই ১০০-এর মত মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মোড়লগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হন, মোড়লগঞ্জের পশ্চিম টাউন হাইস্কুল নামক স্থানে রাত ৩ টায় এসে পৌঁছান ১০০ লোককে পাঁচটি দলে বিভক্ত করা হয় । কুটিবাড়ি রাজাকার ঘাঁটি দখল করার জন্য এডজুট্যান্ট খোকনের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়। কবিরাজ বিল্ডিং রাজাকার ঘাঁটি দখল করার জন্য নায়েক সুবেদার মধুর উপর ভার দেয়া হয়।সুকুমার বাবুর দালানে রাজাকার ঘাঁটি দখলের জন্য সুবেদার আজিজকে ভার দেওয়া হয় এবং অম্বিকা চরণ হাইস্কুলে রাজাকার ঘাটি দখল করার জন্য মোতাহারকে পাঠানো হয়। ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি ২০ জন নিয়ে রিজার্ভে থাকি। ভোর ৪টার একই সাথে আক্রমণ চালানো হয়। সকাল ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে, কিন্তু ঘাঁটি দখল করা সম্ভব হয় না। ইতিমধ্যে রায়েন্দা থানা থেকে এক লঞ্চ রাজাকার আসে মোড়লগঞ্জে। ক্যাপ্টেন জিয়া প্রতিরোধ করেন, রাজাকাররা পিছু হটে। ৯ টার পর ক্যাপ্টেন জিয়া নিজেই আমাকে সহ অম্বিকা হাইস্কুল আক্রমণ চালান। ওখানে গ্রেনেড ছুড়তে গেলে মুকুল (স্পেশাল গেরিলা কমান্ডা) এবং মোহরাবের হাত-পা ভেঙ্গে যায় রাজাকারদের গুলিতে। ক্যাপ্টেন জিয়া উত্তর দিক থেকে এল-এম-জি ব্রাশ চালিয়ে জানালা ভেঙ্গে ফেলে। আসাদ এবং হেললকে বিল্ডিংয়ে উঠিয়ে দেওয়া হয়। ভেনটিলেটারের ভিতর দিয়ে ২ জন গ্রেনেড ছুড়তে থাকে। গ্রেনেড ব্রাস্ট হলে বহু রাজাকার মরত থাকে, তবু তারা আত্মসর্মপন করেনি। পরবর্তীকালে ক্রমাগত ১০ টি গ্রেনেড ফেলা হয়। রাজাকাররা চিৎকার শুরু করে। ক্যাপ্টেন জিয়া উত্তর দিকের জানালা দিয়ে লাফিয়ে ঘরের ভিতর পড়ে স্টেনগান দিয়ে ব্রাশ ফায়ার শুরু করে। ৫ জনের সাথে সাথে মৃত্যু ঘটে ২২ জনকে হ্যান্ডস আপ করে বাইরে নিয়ে আসেন। বাইরে আরও ২ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়। স্কুল তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা হচ্ছিলো। ৮০০ ছেলেকে বাইরে বের করে দেওয়া হয়। যাবতীয় কাগজপত্র পানিতে ফেলে দেয়া হয়। আমি ক্যাপ্টেন জিয়া এক স্থানে বিশ্রাম নেবার অবসরে ব্যক্তিগত শত্রুটা থাকায় নায়েক সুবেদার মধুর নির্দেশে ৪ জন শিক্ষক সহ ২২ জন রাজাকারকে মধুর সাথে আমাদের বেশ কথাকাটি হয়। ফেরার পথে কুটিবাড়ি থেকে ২জন রাজাকার জলঙ্গ অবস্থায় পালাচ্ছিল, কিন্তু মাঠে কৃষকরা ধরে গরুর জোয়াল দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়। বেলা ১২ টার দিকে আমরা সবাই সুন্দরবনে যাত্রা করি। যাবার পথে প্রতিটি গ্রামের মানুষ আমাদের শুভেচ্ছা জানায় এবং চাল, ডাল, মুরগী, খাসি, দিয়ে নৌকা ভর্তি করে দেয়। পথের মাঝে শুনলাম পাকসেনারা এসে গোলাগুলি চালাচ্ছে মোড়লগঞ্জে। একটি ক্যাম্প আমরা দখল করি এবং ৪৪ টি রাইফেল উদ্ধার করি।
১৭ ই আগস্ট আমরা শুনলাম আওমী লীগ নেতা ডাঃ আব্দুল মজিদ, বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি মারুফ হোসেন ভাসানী ন্যাপের থানা সহ-সভাপতি সাহেব আলীকে পাকসেনারা ধরে এনে হত্যা করেছে। এছাড়া গ্রামের নিরীহ আরও বহুজনকে হত্যা করেছে ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। ঐ ক্যাম্পে জিয়া মুক্তিযোদ্ধাদের কনফারেন্স ডাকেন এবং বরিশার জেলার কয়েকটি থানা আক্রমণ করার জন্য কয়েকটি দল গঠন করেন । সুবেদার আজিজ এবং লতিফের নেতৃত্বে ২০ জনের একটি দল ভান্ডারিয়া থানার জন্য, কমান্ডার হাবিবের নেতৃত্বে থানার জন্য পাঠান হয় । এছাড়া ক্যাপ্টেন জিয়ার নেতেৃত্ব ৫০ জনের একটি দল মঠবাড়িয়া থানা দখলের জন্য শরণখোলা রেঞ্জ অফিসার রওনা হয়। ভোরবেলায় পৌঁছাতেই গানবোটের শব্দ পাওয়া যায় শরণখোলা রেঞ্জ অফিসে সুবেদার ফুলুর নেতৃত্বে ১০০ জনের মত মুক্তিযোদ্ধা ছিল।
১৮ আগস্ট ভোর ভোলা নদীর দু’পারে মাত্র ১০ জন করে ২০ জন রেখে জিয়া সাবইকে সুন্দরবনের ভিতরে যাবার নির্দেশ দেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ৭টি গানবোটের ফরেস্ট অফিসের উত্তর দিকে এসে পড়ে। মোড়লগঞ্জে পাকসেনা এবং রাজাকাররা চরমভাবে মার খেলে তার প্রতিশোধ নেবার জন্য গানবোটগুলি পাঠানো হয়েছিণ। ৪ খানা গানবোট শরণখোলা রেঞ্জ অফিস অতিক্রম করে উত্তর দিকে যাবার পরে পরবর্তীতে ৩ খানা গানবোটের উপর ভোলা নদীর দুই পারে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা গুলিবর্ষণ করে। সুবেদার গফফার রকেট লাঞ্চার থেকে গোলা নিক্ষেপ একটা গানবোট বিধ্বস্ত করে। গানবোটটি গুলি খেয়ে দক্ষিন দিকে ৩ মাইল পর্যন্ত গিয়ে ডুবে যায়। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবীদের ৪ টি মরা লাশ নদীতে ভাসতে দেখা যায়। বাদবাকি ৬টি গানবোট থেকে খানসেনারা মর্টার, আর-আর, হেভী মেশিনগান, লাইট মেশিনগান থেকে আমাদের উপর প্রবলভাবে গোলাবর্ষণ করে এবং মুক্তিযোদ্ধারা ত্যারাব্যাকা হাট নামক স্থানে একত্রিত হয় এবং কাজার থেকে চিড়া মুড়ি কিনে খাওয়া-দাওয়া করে। ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি শরণখোলা রেঞ্জ অফিস এবং বঘি ফরেষ্ট অফিস ও শরণখোলা থানার দক্ষিণ অঞ্চলে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা জন্য ৫০ জন সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে সশস্ত্রভাবে রেখে আমাদেরকে গন্তব্যস্থান ধানসা রে চলে যাই। এই সময় তারা যেন কোন আক্রমণ না করে। পরবর্তীকালে বরিশাল জেলার বিভিন্ন থানাতে অপারেশন করার জন্য তাদের পাঠান হয়েছিল। তারা বীরত্বের সাথে সেসব জায়গায় অপারেশন করে এবং বহু রাজাকার ও খানসেনাকে হত্যা করে অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়।
ক্যাপ্টেন জিয়া পরবর্তীকালে মুক্তিযোদ্ধাদের একটা কনফারেন্স ডাকেন এবং সেখানে এই সিদ্ধান্ত হয় যে খুলনা, পটুয়াখালী, বরিশালের কলেজ এবং স্কুলে যেসব ছেলে মেয়ে আছে তাদেরকে সুন্দরবনে নিয়েনতুন করে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দিতে হবে। সেই অনুযায়ী ওখান থেকে ২০ মাইল দক্ষিণে হেলা নদী থেকে তাম্বল নদীতে ঢুকে তেতুলিবাড়ির খাল দিয়ে উত্তর দিকে ঢুকে ছোট খালের দুই পাশে সুন্দরী কাঠদিয়ে গোলাপাতার ঘর করি। প্রতম অবস্থায় খুলনা জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের হেডকোর্য়টার এখানেই করা হয়।
পরবর্তীকালে শরণখোলা থানার মুক্তিযোদ্ধাদের কামান্ড নিযুক্ত করা হয় সুবেদার আজিজের পরিবর্তে সুবেদার গফফারকে। কারণ আজিজ (ফুলমিয়া) ছিল অত্যন্ত অত্যাচারী। বিনা অন্যায় নিজের ইচ্ছামত অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে মেরেছে এবং সাধারণ মানুষের উপর অনেক অন্যায়-অত্যাচার করেছে। ক্যাপ্টেন জিয়া সুবেদার আজিজকে বন্দী করে ভারত পাঠিয়ে দেন। অন্যদিকে ক্যাপ্টেন জিয়া তাম্বুলবুনিয়া নদীর দুই পার্শ্বে ছোট খালগুলির মধ্যে ঘর তৈরী করার নির্দেশ দিলেন। এক এক গ্রুপের জন্য এক এক জায়গায় ব্যবস্থা করলেন। তাম্বুলবুনিয়া খালের পূর্বদিকে একটি খালে তিনি ছাত্রদের জন্য একটি ক্যাম্প তৈরী করেন। সেখানে অনেক জায়গা নিয়ে ট্রেনিং দেবার সুন্দরীগাছ কেটে একটি খোলা মাঠ তৈরী করলেন। সেই মাঠে বাংলাদেশী জাতীয় পতাকা তোলা এবং যুবকদের রীতিমত সামরিক কায়দায় ট্রেনিং দেয়া হত। উক্ত ছাত্রদের ক্যাম্পের দায়িত্ব হয়েছিল পরিতোষ কুমার ও লিয়াকত আলী খানের উপরে। একদিকে শারীরিক পরিশ্রম করে ট্রেনিং দেয়া হত, অন্যদিকে গেরিলা যুদ্ধ সম্পর্কে ক্লাস নেয়া হতো। সময় সময় সামরিক কায়দায় শারীরিক পানিশমেন্ট দেয়া হতো। উক্ত ছাত্রদের ক্যাম্পের সুন্দরী গাছ কেটে অনেক জায়গা নিয়ে পুকুর কাটা হয়েছে। টিনের দোচালা ঘর করা হয়েছিল। আসামীদের রাখার জন্য জেলখানা রাখা হয়েছে। খাদ্য রাখার জন্য গোডাউন ঘর করা হয়েছিল। আসামীদের দেখারশুনার জন্য জেলের কর্মকতা এবং ষ্টাফ নিযুক্ত করা হয়েছিল। ছাত্রদের ক্যাম্পে বিশ খানার মত বড় এবং ছোট নৌকা রাখা হয়েছিল। মাঝে মাঝে ক্যাপ্টেন জিয়া এবং আমি অতর্কিতে দেখাশুনার জন্য ক্যাম্প ভিজিট করতার। তাম্বুলবুনিয়া নদীর পাশ্বে তেতুলবাড়ীয়া হতে হেডকোয়ার্টার নিয়ে আসা হয়। সেখানে নানা প্রকার ঘর করা হলোঃ
(ক) খুলনা জেলা কমান্ডিং অফিসের জন্য অফিস ঘর তৈরী করা হলো। সেখানে সামরিক কায়দায় সব প্রস্তুতি নেয়া হল।
(খ) সহকারী অধিনায়কের জন্য অফিস করা হলে এবং টাইপিষ্ট ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হলো।
(গ) প্যারেড মাঠ তৈরী করা হলো। সেখানে যোদ্ধাদের একত্রিত করা এবং অপারেশন যাবার পূর্বে সব ফল-ইন-করিয়ে চারদিকে পাঠান হতো।
(ঘ) মুক্তিযোদ্ধাদের খাওয়ার জন্য আলাদা ক্যাম্প করা হয়েছিল। রান্না করার জন্য আলাদা লোক নিয়োগ করা হয়েছিল। আলাদা আলাদা গ্রুপ করে খাওয়ার ব্যবস্তা ছিল। রান্না পরিদর্শনের জন্য আলাদা লোক ছিল।
(ঙ) হাজার হাজর মুক্তিযোদ্ধার খাওয়ার জন্য একদল লোক নিযুক্ত করা হয়েছিল, যারা মাছ ধরে খাওয়াবে এবং অন্য আর এক দল ছিল, যারা হরিণ শিকার করে আনবে।
(চ) মুক্তিযোদ্ধাদের রোগ বা দুর্ঘটনাজনিত আঘাত নিরাময়ের জন্য ৪ জন বিজ্ঞ ডাক্তার ছিল এবং হাসপাতাল ও খোলা হয়েছিল। হাসপাতালে নানা ধরনের ঔষধ ছিল।
(ছ) সমস্ত মুক্তিযোদ্ধাদের নানাবিধ সুবিধা দেয়ার জন্য গুদাম ছিল। গুদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছিল, যা প্রয়োজন অনুযায়ী ওখানে থেকে দেওয়া হতো।
(জ) বিভিন্ন স্থানে থেকে নানা ধরনের জিনিসপত্র রাখার জন্য আলাদা একটি ঘর তৈরী করা হয়েছিল। তার মান ছিল ইমার্জেন্সী ষ্টোর। ওখানে নানা ধরনের জিনিস জমা রাথা হয়েছিল। উক্ত মালপত্র দেয়ার জন্য ৫ জনকে নিয়ে একটি ইমার্জেন্সী কমিটি গঠন করা হয়েছিল এবং একজন ইমার্জেন্সী অফিসার নিযুক্ত করা হয়েছিল।
(ঝ) মহিলাদের জন্য আলাদা ক্যাম্প ছিল। সেখানে মহিলারা ট্রেনিং নিত। মহিলাদের কমান্ডার ছিল খুরশিদ জানে আলম তালুকদার। মহিলারা প্রতিদিন প্রায় এক হাজারের মত রুটি তৈরী করত। তারা কাপড়ও সেলাই করত। তাদেরকে ৩০৩ রাইফেল, এস-এল-আর, এস-এম,জি, এল-এম-জি চালানোর প্রশিক্ষণ দেয়া হোত। নিজেরা নৌকা চালাতো।
(ঞ) ভারত হতে যে সমস্ত নেভাল কমোন্ড আসত তাদের আলাদা ক্যাম্প ছিল। তাদের প্রতি ক্যাম্পের পক্ষ থেকে স্পেশাল কেয়ার নেওয়া হতো।
(ট) হেডকোয়ার্টার সমস্ত অস্ত্র ক্যাম্পে যদিও ভাগ করে দিয়েছিল তবুও বিরাট অস্ত্রাগার ছিল। অস্ত্র দেখাশুনা ও পরিক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নেওয়া হতো।
গেরিলা ক্যাম্পঃ সুন্দরবনে দুই প্রকার ট্রেনিং দেয়া হতো। একদল ডাইরেক্ট ফাইট করবে। আর এক দল গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ পরিচালনা করবে। তাই গেরিলাদের জন্য একটি আলাদা ক্যাম্প তৈরী করা হয়েছিল। তার কমান্ডার ছিল শহীদ আলী। সেখানে কামডিং অফিসারের জন্য অফিস ছিল। প্যারেড গ্রাউন্ড ছিল। কোত ছিল। গুদাম ছিল খোনে প্রায় ৫ শত গেরিলা যোদ্ধা ছিল। অপারেশন যাবার পূর্বে তার হেডকোয়ার্টারে আসত এবং সেখান থেকে যাত্রা করত।
প্রত্যক্ষ সৈন্যদের ক্যাম্পঃ তাম্বুলবুনিয়া নদীর পূর্বে পার্শ্বে একটি খালের মধ্যে রীতিমত সামরিক বাহিনীর ক্যাম্প করা হলো। তার দায়িত্ব দেওয়া হলো বাংলাদেশের সি-এন-সি কর্নেল ওসমানীর স্পেশালিষ্ট আলতাফকে। তার অধীনে এক হাজারের মত সৈন্য ছিল। তারা অত্যন্ত সাহসী যোদ্ধা ছিল।
রেকি পার্টিঃ রেকি পার্টির কমান্ডার পরিতোষ কুমার পালকে করা হলো। হেডকোয়ার্টার থেকে ১৫ মাইল দক্ষিণে তাম্বুলকুনিয়ার পূর্বে পাশে পাঙ্গাশিয়া নামক খালের মধ্যে তাদের ক্যাম্প করা হলো। সেখানে হতে গানবোট, লঞ্চ বা জাহাজের গতিবিধি লক্ষ্য করে প্রতিদিন হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট পাঠানো হতো। মূলত তার উপর দায়িত্ব ছিল খুলনা এবং বরিশালের শক্রদের যোগাযোগ পর্যবেক্ষণ করা। হেডকোয়ার্টারে তৈরী করার পর এক মাসের মত সময় লেগেছিল সব ঠিক করে নিতে। তারপর যুদ্ধের পালা শুরু হলো।
বগিঃ বরিশালে-খুলানা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে বলেশ্বর নদী। এই নদী ৬ মাইলের মত প্রশস্ত বগি শরণখোলা থানার দক্ষিনে অঞ্চলে জনবহুল এলাকা সংলগ সুন্দরবন ফরেষ্ট অফিস। বলেশ্বর নদীর পূর্ব সীমান্তে অবস্থিত এই বগিতে আমাদের যোগাযোগের প্রধান ঘাঁটি করা। বগিতে আমাদের মজবুত সৈন্য বাহিনী ছিল। গানবোটের সাথে প্রতিদিন যুদ্ধ চলত। শত চেষ্টা করেও গানবোট হতে পাক সেনারা তীরে উঠতে পারেনি।
বগির যুদ্ধঃ আগষ্ট মাসের দিকে বরিশালে-পটুয়াখালী-ফরিদপুর থেকে প্রায় এক লক্ষ শরণার্থী খানসেনা ও রাজাকারদের অত্যাচারে বগিতে আশ্রয় নিল। এমনি এক সময় হঠাৎ ৫ খানা গানবোট বগিতে আমাদের ক্যাম্পের উপর গুলি চালায়। তারা বলেশ্বর নদী হতে সব স্বয়ক্রিয় অস্ত্র দিয়ে গুলি করে। মর্টার ও আর-আরের গুলিতে মাটি কেঁপে উঠেছিল। তখন আমাদের মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা ৫ খানা গানবোটের মোকাবেলা করে। যখন গানবোট তীরের দিকে আসতে থাকে তখন মুক্তিযোদ্ধারা চুপচাপ। গানবোট যখন নদীর কিনারে আসে এবং খানসেনারা তীরে উঠবার জন্য গানবোটের উপরে ওঠে, ঠিক এমনি সময়ে মুক্তিবাহিনী এল-এম-জির ব্রাশ ফায়ার করে-অনেক খানসেনার মারা যায়। দুইদিন যাবৎ যুদ্ধ চলে, কিন্তু তারা তীরে উঠতে পারেনি।
এদিকে গানবোট ভয়ে শরণার্থীরা গ্রাম ছেড়ে বগি নদী পার হয়ে সুন্দরবনে মধ্যে প্রবেশ করে। ৪জন শরনার্থী মারা যায় মর্টারের গুলিতে। অনেক ছোট ছেলেমেয়ে হারিয়ে যায়। পরবর্তীকালে ক্যাপ্টেন জিয়া ও আমি ২৫ জন লোক নিয়ে একটি কমিটি গঠন করি এবং তাদের ভারতে পাঠাবার ব্যবস্থা করি।
ভারত থেকে ৯নং সেক্টরের কমান্ডার মেজর জলিল ১৫/২০ দিন অন্তর শত শত মুুক্তিযোদ্ধাকে বগিতে পাঠাতেন এবং অস্ত্র পাঠাতেন। আমরা তাদের বরিশাল জেলায় কমার্ডি অফিসার ক্যাপ্টেন শাহজান ও পটুয়াখালী জেলায় কমান্ডিং অফিসার ক্যাপ্টেন মেহেদীর নিকট কাঠকাটা নৌকায় অতি সাবধানে পাঠাতাম। যুদ্ধের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এরূপ চলত।
শরণখোলা রেঞ্জ অফিসঃ এটাও মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ঘাঁটি ছিল। এটাকে বলা হতো পশ্চাৎভূমি। হেডকোয়ার্টার হতে এসে প্রথম এখানে স্থান নেয়া হতো, তারপর নির্দেশ অনুসারে যাত্রা করা হতো। এখানে স্থানীয় জনসাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য পাঠাতো। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস হতে উত্তর দিকে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার ধরে আনতো এবং বিচার-আচার করা হতো।
পাকিস্তান হাটের যুদ্ধঃ একদিন শোনা গেল ‘পাকিস্তান’ নামক একটি হাট রয়েছে শরণখোলা থানায়। সেখানে রাজাকাররা জনসাধারণের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তখন শহীদ আসাদ মাত্র ১০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আক্রমণ করে। দেড়শত রাজাকার রয়েছে ওখানে। দুইঘন্টা যুদ্ধ চলে। মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকারদের হটিয়ে দিতে ৩ জনকে বন্দী করে নিয়ে আসে এবং দুটি রাইফেল পায়।
তাফলবাড়িতে যুদ্ধঃ তাফলবাড়িতে আমাদের একটি ক্যাম্প ছিল। রাজাকার এবং পাঞ্জাবী পুলিশরা হঠাৎ ক্যাম্পে আক্রমণ করে এবং ক্যাম্পের চারদিকে ঘিরে ফেলে। দীর্ঘ তিন ঘন্টা যুদ্ধ চলে। ইতিমধ্যে বগি ক্যাম্প হতে ২০ জন নিয়ে যখন পিছন হতে আক্রমন চালানো হয়, তখনি পাকসেনারা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ৪ জন রাজাকার মারা যায়। ১০ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।
বরিশালে মাপলাজাড়ঃ বরিশালে জেলায় মাঠবাড়িয়া থানায় মাপলাজাড় নামক স্থানে ব্যাপক অত্যাচার করে এবং সেখানেকার জনসাধারণ খুব অসুবিধা ভোগ করে। বগি ক্যাম্প হতে ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা রাত্রে গোপনে এক বাড়িতে আশ্রয় নেয়। বেলা ১০ টার সময় পাঞ্জাবী পুলিশ এবং রাজাকার ৫০ জন গ্রামে এস ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিতে থাকে। মাত্র ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা গেরিলা কায়দায় আক্রমণ করে। সেখানে ১০ জন শত্রু প্রাণ হারায় এবং বাকীরা পালিয়ে যায়। ৫ জনকে বন্দী করে নিয়ে আশা হয় এবং ১২ টি রাইফেল উদ্ধার করা হয়।