সাক্ষাৎকারঃ ডা: মোহাম্মদ শাহজাহান
মেজর জলিলকে ৯ নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয় এবং হাসনাবাদ ৯ নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। তারপর হাসনাবাদ থেকে টাকীতে হেডকোয়ার্টার স্থানান্তরিত করা হয় এবং স্বাধীনতার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত সেখানে হেডকোয়ার্টার ছিল।
টাকীর নিকটবর্তী তাকিপুরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প খোলা হয়। শাহ জাহান মাষ্টার টাউন শ্রীপুর হাইস্কুলে হেড মাষ্টার ছিলেন। তিনি তার এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করেন। সে এলাকার ছেলে এবং যারা আমাদের সাথে ছিল সবাইকে নিয়ে প্রথম তাকিপুরে ট্রেনিং শুরু হয়।
প্রথম দিকে আমাদের খাবার সমস্যা প্রকট ছিল। সেখানে প্রায় ১৮২ জন মুক্তিযোদ্ধা ট্রেনিং নিচ্ছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী প্রথম অবস্থায় আমাদের অনেক সাহায্য করেছে। ৭২ ব্যাটালিয়ান বি-এস-এফ’র কমান্ডার মুখার্জীর সহযোগিতার কথা অবিস্মরণীয়।
খারাপ খাদ্য, পানীয় এবং খারাপ অবস্থায় থাকার জন্য অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধার জ্বর এবং নানারকম পেটের অসুখ শুরু হয়। এদের চিকিৎসার জন্য বি-এস-এফ থেকে (৭২ ব্যাটালিয়ান) ঔষধ সাহয্য দেয় হয়। আমি নিজে সে মুক্তিয়োদ্ধাদের চিকিৎসার ভার নিয়েছিলাম।
দিন দিন মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা রাড়তে লাগল। জুন মাসে প্রথম ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা ট্রেনিং শুরু হয় বিহারে। আমরা প্রথম বেইস বিহারে পাঠাই তাকিপুর থেকে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত গেরিলা বিহারে থেকে ফিরে আসলে আমাদের তৃতীয় ক্যাম্প বাকুন্দিয়াতে খোলা হয়। এখানে কেবল ট্রেনিংপ্রাপ্ত গেরিলাদের রাখা হত।
আমাদের দ্বিতীয় ক্যাম্প ছিল হিংগলগঞ্জে। এটা খোলা হয় জুন মাসে। এখানে থেকেই ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা সর্বপ্রথম খুলনার কালীগঞ্জ থানা আক্রমণ করে (জুন) এবং সফলতা অর্জন করে। তারপর মাঝে মাঝে এখানে থেকে ভিতরে গিয়ে ছোটখাট অপারেশন চালাত।
আমার সাথে কয়েক জন মেডিক্যালের ছাত্র ছিল। তাদের মধ্যে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র জহিদ, মজিবর এবং চট্রগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র সরল এবং মৃণাল এদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রথমদিকে প্রত্যেকটা ক্যাম্পের সাথে একটি করে আউটডোর ছিল। কয়েকটা স্পেশাল বেড রাখা হতো কেবলমাত্র গুরুতরভাবে আহত রোগীদের জন্য। এখানে থেকে পরে আমরা ভারতীয় হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতাম। তারা এ ব্যাপারে আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য-সহযোগিতা করেছে। উল্লিখিত চারজন ছেলে চারটি ক্যাম্পের মেডিক্যাল অফিসার হিসাবে কাজ করছিল। আমি প্রত্যেকটি ক্যাম্প থেকেই পরিচালনা কর হত। তাই প্রায়ই আমাকে সেখানে যেতে হতো।
সেপ্টেম্বর মাসে টাকীতে সর্বপ্রথম ১৫ বেডের হাপাতাল খোলা হয়। এখানে অস্ত্রোপচারের কোন ব্যবস্থা ছিল না। প্রকৃতপক্ষে একটা ট্রানজিট হসপিটাল এর কাজ করত-আহত মুক্তিযোদ্ধাদের। এখানে রাখা হত ফার্ষ্ট এইড দেয়ার জন্য এবং পরে ভারতীয় হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হত। ২২ শে নভেম্বর কালীগঞ্জ থানা মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে। একই সাথে শ্যামনগরও দখল করা হয়। হিংগলগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা শ্যামনগর ও কালীগঞ্জে ঘাঁটি স্থাপন করে।
২৩/২৪ সেপ্টেম্বর বাকুন্দিয়া থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সাতক্ষীরার দিকে অগ্রসর হয়। সাতক্ষীরার প্রায় ১১ মাইল দূরে কুলিয়াতে পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধ ৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে।
২৪ নভেম্বর কালীগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা কুলিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যে এগিযে আসে। কুলিয়ার যুদ্ধে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ছয়জন আহত হন। ৬ই ডিসেম্বর মেজর জয়নাল আবেদীন আমাদের সেক্টরে যুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবহিনী পিছূ হটতে শুরু করে এবং খুলনার দিকে চলে যায়।
৩রা ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করতে থাকে।
৬ই ডিসেম্বর একটি লঞ্চ এবং একটা গানবোট নিয়ে জনাব নুরুল ইসলাম মঞ্জুর ৪০০ মুক্তিযোদ্ধা সমভিব্যহারে বরিশালে দিকে রওনা হয়ে যান। ১০/১১ই ডিসেম্বর তারা বরিশাল পৌছেন। ইতিমধ্যে বরিশালের সাবসেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওমর বরিশাল দখল করে নিয়েছিলেন।
খুলনা শত্রুমুক্ত হয় ১৭ই ডিসেম্বর। খুলনাতে পাকিস্তানী সেনাবাহীর অধিনায়ক ছিলেন ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান। তিনি ১৭ ডিসেম্বর বাংলাদেশে-ভারত যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেন।