বড়খাতা ব্রীজ, ব্রীজ অন রিভার তিস্তা
রাজধানী ঢাকার প্রেক্ষাগৃহে বসে যারা ‘ব্রীজ অন রিভার কাউয়াই’ দেখে আতঙ্কে ভয়ে শিউড়ে ওঠেন তাদের কেউ জানলেন না কোনদিন যে একাত্তরে সারা বাংলার বুক জুড়ে ‘ব্রীজ কাউয়াই’ এর এর চেয়ে লোমহর্ষক বহু অপারেশন করেছিল আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
‘বড়খাতা ব্রিজ’ অপারেশন তার একটি। এই ব্রিজটি উড়ানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধারা প্ল্যান করে মে মাসে। এই ব্রিজটি পাক হানাদারদের জন্য ছিল অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ। কেননা এই ব্রীজের ওপর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন। যার সাথে রংপুরের সমগ্র এলাকা যুক্ত রেখে পাকবাহিনী ভারী রসদ ও সমরাস্ত্র সরবরাহ অটুট রখেছে। এই ব্রীজ খতম করতে পারলে সরাসরি রংপুরের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করা যায় এবং পুরোপুরি মুক্ত হতে পারে হাতিবান্ধা, বড়খাতাসহ ২২ মাইল এলাকা।
৬ নং সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার খাদেমুল বাশার সিদ্ধান্ত নিলেন হানাদারদের রেললাইন বিচ্ছিন্ন করে ওদের কাবু করতে হবে এবং এই বড়খাতা ব্রীজ উড়িয়ে দিতে হবে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে একটা কমান্ডো গ্রুপ পাঠালেন তিনি। বড়খাতা ব্রীজের ওপর পাক-পাঞ্জাবীর বাহিনী ছিল প্রস্তুত। কোন সুযোগ ই ছিলনা মুক্তিইবাহিনীর কমান্ডো গ্রুপ টার কাছে ভিরবার। ফিরে এলো তারা।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি আতক কমান্ডো গ্রুপ কে পাঠালেন। দুর্ভেদ্য সে অঞ্চল। পিঁপড়ের মত ছেয়ে আছে পাকফৌজ ব্রীজের ওপরে।নীচে। ডাইনে ও বামে। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তারা।
আগস্ট মাসের ৪ তারিখ। তৃতীয়বারর মত একটা গ্রুপ গেল সাথে প্রাক্তন ই টি আর বাহিনি বাঙালি জোয়ান। ব্রীজের কাছাকাছি প্রায় পৌঁছেছিল তারা। কিন্তু না। হানাদার বাহিনি শকুনের চোখ মেলে প্রস্তুত ছিল। ফায়ার ওপেন করে দিল আমাদের কমান্ডো গ্রুপটার ওপর। ক্যাজুয়েলটিসহ ব্যর্থ হয়ে ফিরে এল তারা।
বসলেন কমান্ডার খাদেমুল বাশার। হেডকোয়ার্টারে ডাকলেন ঐ এলাকার সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্টেন মতিয়ুর রহমান কে (বীরবিক্রম), ডাকলেন কোম্পানী কমান্ডার হারেসউদ্দিন সরকার কে। চুলচেরা বিশ্লেষন হয়ে গেল হাতিবান্দার ম্যাপ নিয়ে। পথঘাট একে দিয়ে দিলেন তিনি ক্যাপ্টেন মতিয়ুর ও হারেসউদ্দিনের কাছে।
পাকিস্তানের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১ কোম্পানি ফোর্স ছিল এই ব্রিজ রক্ষায়। এতেই অনুমান করা যায় এই ব্রিজের গুরুত্ব তাদের জন্য কত অপরিসীম ছিল। পাকিস্তানিদের পজিশন ছিল বড়খাতা ২ নং ব্রীজের উপর ও দুই সাইড। রেলওয়ে স্টেশন ও গড্ডিমারির সংযগ এই ব্রীজটি ছিল তিস্তা নদীর ওপর।
তিন তিনবার ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসার পর এই গুরুত্বপূর্ণ ‘এসাইনমেন্ট’ ঘাড়ে তুলে নিলেন বাংলার দুই বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর ও হারেস। তৃতীয় ব্যর্থতার ৮ দিন পর ১২ ই আগস্ট, রাত ৮ টা। এক কোম্পানি শক্তিশালী পাঞ্জাবি আর্মির সামনে কতজন বাঙালি বীর গেলেন? ১২ জন। হ্যা, মাত্র ১২ জন বাঙ্গালী বুকে দেশপ্রেমের মন্ত্র নিয়ে মুখে কলেমা শাহাদাত ‘লা ইলাহা ইল্লালাহ’ পড়তে পড়তে বাউরা রেলস্টেশন থেকে যাত্রা করল ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান (বীরবিক্রম), কোম্পানি কমান্ডার হারেস উদ্দিন সরকার (বীর প্রতীক), মুক্তিযোদ্ধা আফজাল হোসেন (পরে যিনি পাটগ্রামে হানাদার দের সাথে শহীদ হন), নজরুল ইসলাম, মন্সুর আলি, শওকত আলি প্রমুখ। হাতে তাদের এক্সপ্লোসিভস, ডেটনেট, এল এম জি, স্টেনগান ও তিন ইঞ্চি মর্টার। তাদের পেছনে প্রয়োজনমত কাভারিং দেয়ার জন্য লেঃ মেজবাউদ্দিনের (বীরবিক্রম)ও সুবেদার আব্দুল মালেকের নেতৃত্বে ২ টা এফ এফ কোম্পানি থাকল। মুক্তিযদ্ধারা যখন বাউরা থেকে জিপে যাত্রা শুরু করে তখন পাক বাহিনীর পজিশন ছিল মাইল দূরে ‘বড়খাতা ব্রীজ’। পাকবাহিনীর পজিশনে দুই মাইল দূরে গিয়ে জীপ যখন থামল রাত তখন পৌনে ১২ টা। জীপ থেকে সবাই নামল। এবার হাঁটার পালা। পায়ের তলায় শুকনো পাতাও যেন না পরে এমন সতর্কতায় পা ফেলে চলেছে ১২ জন বংগ জননির বীর সন্তান। সামনে লক্ষ্য শুধু ব্রিজ বড়খাতা। তিন তিনবার ফিরে গেছে মুক্তিবাহিনী। এবার তারা জীবন দেবে শুধু ব্রীজ অক্ষত রেখে যাবে না। কদম কদম পা ফেলে যকন তারা এগুচ্ছে এলো আল্লাহর আশীর্বাদ, মুশলধারে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিকে সাথি করে গায়ের জামা খুলে ‘এক্সপ্লোসিভ’ গুলকে জড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে চলল ব্রীজ বড়খাতার দিকে। আকাশ ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। বৃষ্টির গতি গেলো বেড়ে। ব্রীজ বড়খাতার ওপর চোখ পরল মুক্তিবাহিনীর। বৃষ্টিতে মুখ বুজে আছে পাকিস্তানীদের বাঙ্কারগুলো। ব্রীজের দুই মুখে পৌঁছে গেল হারেসউদ্দিন মতিউর রহমান ও অন্য সাথীরা। রাত তখন দেড়টা হবে। পাঞ্জাবীরা বৃষ্টির মুখে বাঙ্কারে ঢুকে বসে আছে। তলায় ততক্ষনে ত্রস্ত হাতে ক্ষিপ্রগতিতে এগিয়ে চলেছে মুক্তিবাহিনী অপারেশন। ব্রীজের তিন জায়গায় এক্সপ্লোসিভ বাঁধা হল। মুল প্লান ছিল দুই জায়গায়। কিন্তু বৃষ্টির জন্য পাক হানাদাররা যখন ‘ওয়াচ’ করতে পারছে না কিছুই তখন মতিউর রহমান সেই সুযোগটা কাজে লাগালেন। মাত্র ২৫ মিনিটে এক্সপ্লোসিভস লাগানর কাজ শেষ হয় যেটার জন্য সময় দেয়া ছিল ৩০ মিনিট। এটা সম্ভব হল কেননা মুক্তিবাহিনীর যেসব ছেলেদের তিস্তার পারে গার্ড থাকার কথা ছিল তারা বরং ব্রীজের তলায় কাজ করে। বৃষ্টির সুবিধার জন্য সিদ্ধান্ত টা অন দা স্পট চেঞ্জ করা হয়। এক কোম্পানী পাঞ্জাবি হানাদার ব্রীজের ওপর ডানে বামে দুর্ভেদ্য বাঙ্কারে বসে বসে যখন বৃষ্টির শব্দ শুনেছে ততক্ষনে তাদের মৃত্যুঘন্টা বেজে গেছে তিস্তা নদীর স্রোতের উপর।
অত্যন্ত সন্তর্পণে ধীরে ধীরে ক্যাপ্টেন মতিউর তিস্তার ওপর থেকে তুলে আনলেন তাঁর ১২ জন সাথিকে। গুনে গুনে নিলেন তিনি। হ্যা এবার পেছনে চলো সবাই। ৬০০ গজ দূরে এসে থামলেন তিনি। সেই মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে রাত পৌনে দুটার দিকে ডেটনেটে আগুন ধরালেন তারা। প্রচন্ড শব্দে সেই বৃষ্টিপাতের মধ্যে মনে হল আকাশ ভেঙ্গে রাশি রাশি বৃষ্টিপাত হচ্ছে ‘ব্রীজ বড়খাতার’ উপর। তিস্তার বুকে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ভেঙ্গে পরছে হানাদারদের বাঙ্কার ভেঙ্গে পরছে হানাদারদের শরীর। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে এল এম জির ফায়ার ওপেন করে দিল মতিউর হারেসরা। বাংলার দুশমনরা পেছনে ১৫ টি ডেডবডি ফেলে রিট্রিট করল। ব্রীজ বড়খাতার ওপারে উড়ল মুক্তির পতাকা। তিস্তার ওপাশ মুক্ত হয়ে গেল চিরতরে। যে ব্রীজের জন্য পাঞ্জাবিরা গর্ব করে বেড়াত তাদের দালালরা যে বড়খাতা ব্রীজের কথা বলে মুক্তিবাহিনীর পরাজয়ের প্রমান খারা করত সেই বড়খাতা ব্রীজের বিজয় যখন সম্পন্ন হল আনন্দে আবেগে কাঁদল ক্যাপ্টেন মতিউর, কাঁদল হারেসরা। একে অপরকে জড়িয়ে ধরল বুকে।
যুদ্ধের ইতিহাসে “ব্রীজ রিভার অন কাউয়াই” যদি থাকে, থাকবে আমাদের মুক্তিযদ্ধাদের বিরত্বগাঁথা নিয়ে “ব্রীজ রিভার অন তিস্তা” এর নাম।