সাক্ষাতকারঃ মেজর মোঃ আব্দুস সালাম
জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে আমি ফুলবাড়িতে যে ক্যাম্প দেখে এসেছিলাম সেখানে যোগদান করি। শুরু থেকে আমার গেরিলা জীবনের শেষ পর্যন্ত এখানেই ছিলাম, অর্থাৎ নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত এখান থেকেই ছোটখাটো অনেক অপারেশনে গিয়েছি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল বোয়ালিয়া ব্রীজ অপারেশন। আমরা বড় পুল বলতাম। এখানে রাজাকাররা পাহারায় ছিল। আমাদের পরিকল্পনা ছিল এই ব্রীজে গ্রেনেড নিক্ষেপ করা। আমরা এ পরিকল্পনায় বেরিয়েছিলাম। ঐদিনই সম্ভবতঃ কুড়িগ্রাম থেকে একটা দল ট্রেনে করে তিস্তার দিকে যাচ্ছিল। এই ব্রীজের আরেকটু দূরে আরেকটা দল বি ডি আর এর নায়েক সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে তাদের উপর আক্রমন শুরু করে। পরে আমরাও যোগ দেই সেই আক্রমনে এবং আশেপাশের অনেক লোক আনসারদের মধ্যে যারা ছিল তারা সবাই যোগ দেয়। পরবর্তী পর্যায়ে হানাদারদেরকে ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। আমরা সেখানে গিয়ে অনেক রক্তের দাগ দেখতে পাই এবং পরে জেনেছিলাম তাদের অনেক হতাহত হয়েছে। তারপর রেললাইনের নীচু দিয়ে অপর পাশের কভার দিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এই ঘটনাতা একটা পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
প্রশ্নঃ কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল?
উত্তরঃ এটা “আনন্দবাজার” পত্রিকায় ছাপা হয়। ঐ সময়ে প্রাথমিক পর্যায়ে গেরিলা তৎপরতার একটা উল্লেখযোগ্য সাফল্যের খবর ছিল এটা।
দ্বিতীয় ঘটনাটা তবে সম্ভবতঃ জুলাই এর শেষের দিকে বা আগস্টের প্রথম দিকে। আমি এই ঘটনায় প্রথমে ছিলাম না পরে জড়িয়ে পরি। ঘটনাটা আমাদের এলাকায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একজন সদস্য মেয়েলোকের পোষাকে ঐ এলাকায় আসে। মকবুল খান তার নাম ছিল। মহিলা সেজে অন্য মেয়েলোক ধরতে সমস্যা হবে না এই রকম একটা মোটিভ নিয়ে সে এসেছিল। আমরা গ্রামের মধ্যে “ আর্লি ওয়ারনিং” সিস্টেম রেখেছিলাম। গ্রামের কোনে কোনে আমাদের যুবকরা পাহারা দিত। গ্রামের মধ্যে কেউ ঢুকলে ওরা তাড়াতাড়ি খবর দিত। একজন এসে বলল যে একটা মেয়েলোক গ্রামের দিকে আসছে সে দেখতে অস্বাভাবিক। আমাদের দেশের মেয়েলোক সাধারনতঃ এই রকম দীর্ঘকায় মোটাসোটা হয়না। তাই সবার মনেই একটা সন্দেহ হল। সে গ্রামে ঢুকেছে মেয়েলোকদের ধরার চেষ্টা করেছে, পারেনি রবং এক জায়গায় একটা মেয়েকে ধরেছিল সে চিৎকার করে পালিয়ে গেছে। এই খবর টা কিছুদূর পর্যন্ত পৌছে যায়। এক পর্যায়ে যুবক দলের মধ্যে আব্দুর রহমান নামে এক সাহসী ছেলে লোকটিকে ধরে ফেলে। লোকটির কাছে বোধ হয় একটা হুইসেল ছিল অথবা তার ঠোট দিয়ে সে খুব জোরে একটা হুইসেল দেয়। হুইসেল দেয়ার ফলে সেই বোয়ালিয়া ব্রিজ থেকে গুলি শুরু হয়। সেখানে পোস্ট ছিল। সেখানকার লোক এসে তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। ছেলেদের সেই দল মকবুল খান কে ধরে নিয়ে ধরলা নদী পার হয়ে ফুলবাড়িতে চলে আসে। সেদিন ই আমরা যাচ্ছিলাম একটা অপারেশনে। ধরলার পারে ওদের দেখা পেলাম। মকবুল খানকে ফুলবাড়ি ক্যাম্পে নিয়ে আসি। পরে তাকে সাহেবগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমাদের সাব সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল ক্যাপ্টেন নওয়াজেশের নেতৃত্বে। তার কাছ থেকে অনেক কথা জানা যায়। সে ছিল পাঞ্জাবি। তার উদ্দেশ্য ছিল ঐ একটাই গ্রামে এসে মেয়ে ধরে নিয়ে যাওয়া। এটা একটা চমকপ্রদ ঘটনা বলতে হবে।
তারপর ডাইরেক্ট কোন সংঘর্ষ হয়নি। তবে একটা ঘটনার কথা মনে পরে। তখন আমরা ফুলবাড়ি ডিফেন্সে ছিলাম। লালমনিরহাট থেকে ফুলবাড়ির দিকে একটা রাস্তা গেছে। লালমনিরহাট থেকে ফুলবাড়ির দিকে একটা রাস্তা গেছে। লালমনিরহাট এবং ফুলবাড়ি মধ্যে ধরলা নদী। ফেরীর ওপারে অর্থাৎ ফুলবাড়ির দিকে আমাদের এফ এফ ডিফেন্স ছিল। এম এফ কোম্পানী ছিল মোবাইল। তারা ঐ এলাকায় যেত পেট্রোলিং করে আবার ফিরে আসত। কিন্তু এফ এফ কম্পানি পারমানেন্টলি ওখানে থাকত। একবার আমরা অখানে গিয়েছিলাম সারারাত ওখানে পেট্রোলিং করেছি। আমার জীবনে এই প্রথম সেদিন গুলি ছুড়ি। আমাকে সেখানে শিক্ষা দেয়া হয় কিভাবে গুলি ছড়তে হয়। সারারাত খাওয়া হয়নি। দুপুরবেলা খাবার কিছু পাইনি। স্থানীয় এক বাড়িতে বসে আমরা জাউ খাচ্ছিলাম। এমন সময় আমাদের উপর মেশিনগানের ফায়ার। নদীর এপার থেকে ওপার। মাঝখানে নদীর দূরত্ব ৫০০/৬০০ গজ। আমরা যে বাড়িতে খাচ্ছিলাম সে বাড়ির কলাগাছে এবং টিনের চালে খুব গুলি পড়ছে। আমরা তাড়াতাড়ি করে দৌড়ে গিয়ে পজিশন নিলাম। প্রশিক্ষন তখনো কিছু নেই। তবে একটা রাইফেল হাতে কেবল নিয়েছি, দৌড়ে কিভাবে গুলি করতে হয় সেটা শিখেছিলাম। ওরা সবাই দৌড়ে গিয়ে রাইফেল হাতে তাড়াতাড়ি পজিশন নিয়েছে। আমিও নিয়েছি তবে তত তাড়াতাড়ি না পারায় ১০/১৫ হাত পিছনে পজিশন নিয়েছি। ওরা সেখান থেকে ফায়ার করছে পালটা জবাব দিচ্ছে। আমিও অনুমান ১০/১৫ হাত পিছনে একপাশ থেকে পালটা জবাব দিচ্ছি। আনসারের একজন লোক ছিল সে আমাকে যেভাবে গালি দিচ্ছিল সে গালির কথা আমি কখনো ভুলব না। খুব মজার গালি। “সামনে সামনে এসে ফায়ার কর নাইলে তোকে মেরে ফেলবে”। ও শেখাচ্ছিল যেন আমি আমার নিজের জীবন বাঁচাতে পারি। এবং একি সময় আমি আমার বন্ধুর জীবন কেও যেন রক্ষা করতে পারি। তারপর সামনে গিয়ে বেশ কিছুক্ষন ফায়ার করলাম।২” মর্টার ছিল আমাদের কাছে। এক সময় ফায়ার বন্ধ করি। পরে জানতে পেরেছিলাম ওদের উদ্দেশ্য ছিল নদী পার হয়ে আসা। কলাগাছ দিয়ে ভেলা তৈরি করেছিল তারা। পাকসেনারা লং রেঞ্জে ফায়ার করে দেখতে চেয়েছিল আমরা এপারে কেউ আছি কিনা। পরে আমাদের পালটা জবাব পেয়ে তারা আর নদী পার হবার সাহস পায়নি। এটা আগস্টের ঘটনা হবে। তারপর সেখান থেকে আমরা চলে যাই বাগভান্ডার বি ও পি তে। বাগভান্ডারে বিডিআর এর সুবেদার মেজর আরব আলী ছিল। তার একটি কোম্পানি ছিল এবং আমি সেই কোম্পানির ভিতর একজন সাধারন সৈনিক ছিলাম। সুবেদার আরব আলি ই সেই কোম্পানীর কমান্ডার ছিলেন। সাহেবগঞ্জ সাব সেক্টর অধীন বাগভান্ডার ডিফেন্স ই আমি বেশ কিছুদিন ছিলাম ওখানে থাকাকালীন আমাদের কটা উল্লেখযোগ্য অপারেশন হয়েছিল অক্টোবরের শেষের দিকে। লেঃ সামাদ যিনি শহিদ হয়েছেন এবং লেঃআবদুল্লাহ এরা কেবল কমিশন পেয়ে এসেছেন আর আমরা সেকেন্ড ব্যাচের জন্য সিলেক্ট হয়েছি যাবো। এরা যখন পথম আসলো তখন এদেরকে নিয়ে একটা অপারেশন করা হল জয়মনিরহাটে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা কোম্পানী সেখানে ছিল। আমরা তা জানতে পেরেছিলাম। এই রেইডের পরিকলনা করেন ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ আমি সেদিন তার সাথেই ছিলাম। আমি ছিলাম তাঁর সিগনাল অপারেটর, অয়ারলেস সেট নিয়ে একটা তেঁতুল গাছের উপর মাচা তৈরি করে উনি ছিলেন আর আমি তেঁতুল গাছের নীচে অয়ারলেস সেট নিয়ে ছিলাম। সেখান থেকে তিনি পাক ক্যাম্পের উপর ডাইরেক্ট আক্রমন করেছিলেন। আমার কম্পানী অর্থাৎ যেটা সুবেদার আরব আলির কোম্পানি এবং ডানদিকে একটা এফ এফ কোম্পানি ছিল সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে এই দুটো কোম্পানীর একটি দেয়া হল লেঃ সামাদের নেতৃত্বে এবং অপরটা লেঃ আবদুল্লাহর নেতৃত্বে। এই দুটো কোম্পস্নি নিয়ে ভুরুঙ্গামারী আক্রমন করি সন্ধ্যের পর। পরিকল্পনা মোতাবেক দুটো কোম্পানি প্রায় ভুরুঙ্গামারির কাছে পৌঁছে যায়। বাঁ দিকে সোনারহাটে যে কোম্পানি ছিল তাদেরকে রাস্তার উপর ব্লক করতে বলা হল যাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনি ঐ দিকে পালিয়ে যেতে না পারে। তাদের একটাই পথ খোলা রাখা হয়েছিল সেটা হল নাগেশ্বরির দিকে। কিন্তু ঐ কোম্পানী ঠিকমত একশন নিতে পারেনি ফলে পাকিস্তানীরা ভুরুঙ্গামারী ছেড়ে সোনাহাটা দিয়ে ভেতরে ঢোকে এবং উলটা দিক দিয়ে আমাদের দিকে হায়ার করতে শুরু করে। আমরা জানতে পাই যে ওটা এফ এফ কোম্পানির দল না। ওটা পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হয়ে উলটা দিক দিয়ে ভিতরে এসে আমাদের উপর আঘাত হানছে এজন্যে সেখানে বেশীক্ষন থাকা সম্ভব হয়নি। সবকিছু তছনছ করে বাঙ্কার ভেঙ্গে দিয়ে আমরা রাতের অন্ধকারেই ওখান থেকে ফিরে আসি। রেইড হিসাবে এটিকে আমরা সফল রেইড বলতে পারি, তবে আক্রমন হিসাবে এটা সফল ছিল না। কেননা পরবর্তীতে পাকিস্তানীরা আবার সেখানে ডিফেন্স গড়ে তুলেছিল।
*সাক্ষাৎকারটি প্রকল্প কর্তৃক ২২-০১-১৯৮০