You dont have javascript enabled! Please enable it! ৬ নং সেক্টরের যুদ্ধ বর্ননা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কথা | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র            তারিখ
৬ নং সেক্টরের যুদ্ধ বর্ননা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক কথা বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র জুন-ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

সাক্ষাতকার এয়ার ভাইস মার্শাল এম কে বাশার*
১৫-৫-১৯৭৩

১৪ই মে আমরা কুমিল্লা হয়ে সোনামুড়ার নিকটবর্তী শিবের বাজারে রাত্রিযাপন করি। স্থানীয় জনসাধারণ আমাদের যথেষ্ট আদর-যত্ন করে এবং তারাই পরের দিন আমাদেরকে সোনামুড়ায় পৌছায়। সোনামুড়া বি-এস-এফ ক্যাম্পে আমরা নিজেদেরকে ব্যাবসায়ী বলে পরিচয় দেই। সেখানে ইষ্ট বেঙ্গল রিজিমেন্টের একজন অফিসার মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুট করেছিলেন। আমরা তার কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দেই। আমার সাথে ছিলেন তৎকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন খোন্দকার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ফ্লাইট লেঃ বদরুল আলম, ফ্লাইট লেঃ কাদের, এক্স ফ্লাইট লেঃ রেজা। এখান থেকে আমাদেরকে মুজিবনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জেনারেল ওসমানী আমাদের সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন। আমরা ওনাকে বিমান বাহিনী গঠন করার প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু সে সময় এটা সম্ভব ছিল না। তারপর আমরা স্থলযুদ্ধে সংকল্প জানালাম। সেখানে আমাকে ৬নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

৬নং সেক্টরে রংপুরে একটা মুক্তিবাহিনী মেজর নওয়াজেশের অধীনে ভূরুংগামারীর কাছে সংগব্ধ হয়েছিল এবং আর একটা বাহিনী দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁও হয়ে মেজর নাজমুলের অধীনে ভজনপুরে নদীর উপরে একটা পুল উড়িয়ে নদীর উত্তর পারে প্রতিরক্ষাবুহ্য তৈরি করে। দুটো জায়গাই বাংলাদেশের ভিতর ছিল এবং এখান থেকে কখনো আমরা পিছু হটিনি, বরং এগিয়ে গিয়েছিলাম। মেজর নওয়াজেশের একটা দল সুবেদার বোরহান উদ্দীনের (ই-পি-আর) নেতৃত্বে রংপুরের রুহুমারী এলাকায় প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করে এবং এ যায়গা বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি পর্যন্ত মুক্ত ছিল। এলাকা পরিবর্তন কালে ১১ নং সেক্টরকে দিয়ে দেওয়া হয়।

রংপুরে পাটগ্রাম থানাও মুক্ত এলাকা ছিল। এখানেও মেজর নওয়াজেশের একটা দল প্রতিরক্ষা বুহ্য তৈরি করেছিল। মেজর নওয়াজেশ এবং মেজর নাজমুলের দুটো বাহিনী (ই-পি-আর আনসার, মোজাহেদ, পুলিশ, ছাত্র, শ্রমিক, ড্রাইভার) মিলিয়ে ৭০০ জন ছিল। অস্ত্র বলতে ছিল শুধু রাইফেল সামান্য ক’টা, এল-এম-জি, মর্টার এবং একটা মেশিনগান। গোলাবারুদও খুব কম ছিল।

আমার দুটো সমস্যা ছিল। প্রথমত আমি বাহিনীর অফিসার-ঐ এলাকায় সৈনিক, অফিসার এবং জনগণ আমাকে ঠিকভাবে গ্রহন করবে কিনা সে প্রশ্ন, এবং দ্বিতীয়ত: সৈনিকদের সংঘবদ্ধ করা এবং সংগঠিত করা। আমাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদও কম ছিল। কিভাবে আরোও বেশি অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে সেটাও একটা প্রধান সমস্যা ছিল। ভারত থেকে কিভাবে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে হবে সেটাও একটা সমস্যা। রিক্রুটমেন্ট এবং ট্রেনিং সমস্যা ছিল। তাছাড়া হাসপাতালও ছিল না, ঔষধপত্র ও ডাক্তারের অভাব ছিল। রেশন আমরা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী থেকে পেতাম কিন্তু খাদ্য সরবরাহ নিয়মিত ছিল না। যে সমস্ত মুক্তিযোদ্ধা তাদের পরিবার নিয়ে এসেছিল তাদেরকে রেশন সরবরাহ করা কষ্টকর ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের কোন পোশাক ছিল না। লুঙ্গী এবং গেঞ্জি পরেই তারা যুদ্ধ করছিল। তাদের কোন বিছানাপত্র ছিল না। তাদেরকে খোলা মাঠে থাকতে হত। টাকা-পয়সারও যথেষ্ট অভাব ছিল।

এখানে বলে রাখা ভাল যে, যে সমস্ত টাকা-পয়সা ঠাকুরগাঁও এবং কুড়িগ্রাম ব্যাংক থেকে মুক্তিযোদ্ধারা নিয়ে এসেছিল সে সমস্ত টাকা সীলমোহর করা ব্যাংকে মুজিবনগরে বাংলাদেশের সরকারের কাছে অর্পণ করা হয়েছিল। সে টাকা কিভাবে খরচ করা হবে তা বলতে পারছি না। তখন পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীতে শরণার্থী শিবির থেকে নিয়োগ করতো এবং ট্রেনিং দিচ্ছিল। শরণার্থী শিবিরগুলোতে অধিকাংশ হিন্দু ছিল। তারা তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ট্রেনিং-এর জন্য পাঠাত। এ ব্যাপারে আমাদের কোন কতৃত্ব ছিল না। কিন্তু সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব গ্রহন করার পর আমি এ ব্যাপারে ওদের সাথে আলাপ-আলচনা করি এবং তাদেরকে বলি যে রিক্রুটমেন্ট আমরা করব। আপনারা আমাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র এবং ট্রেনিং এর ব্যাবস্থা করবেন। অপরেশনে পাঠানোর দায়িত্ব আমাদের থাকবে। অনেক বাকবিতণ্ডার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সম্মত করা হয়। সৌভাগ্যবশত ভারতে আমাদের যে ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল (মূর্তি টি এষ্টেট) সেখানকার কমান্ডার লে: কর্নেল সেনগুপ্ত ছিলেন একজন বাংগালী হিন্দু। তিনি আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। ব্রিগেডিয়ার জোসীও আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য এবং সহানুভূতি দেখিয়েছেন।

সেনগুপ্ত ট্রেনিং এর চার্জে ছিলেন। সীমান্ত এলাকায়, যারা বাংলাদেশের ভেতর থেকে ট্রেনিং-এর জন্য আসত তাদেরকে প্রথমে হোল্ডিং ক্যাম্পে রাখা হত, তারপর কেন্দ্রীয় একটা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ৩ সপ্তাহের গেরিলা ট্রেনিং দেওয়া হতো। পরে এদেরকে আমার কাছে পাঠানো হতো বিভিন্ন অপরশনে পাঠানোর জন্য। এবং আমার মনে হয় সমস্ত সেক্টরে এই নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছিল।

তিন সপ্তাহের ট্রেনিং যথেষ্ট ছিল না। তাই ঠিক করা হয়েছিল গেরিলাদের নিয়মিত বাহিনীর সাথে আরোও ১৫ দিন রাখার এবং যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে ট্রেনিং দেয়ার। এ সময়ের মধ্যে আমরা কাকে কোন দলের নেতৃত্ব দেয়া যায় তা ঠিক করতে পারতাম। তারপর বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয় ছেলেদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে ভিতরে পাঠিয়ে দেওয়া হতো শত্রুর অবস্থানের কাছে গিয়ে রেকি করার জন্য। তারপর তাদেরকে অপারেশন চালানোর নির্দেশ দেওয়া হতো।

শত্রুর অবস্থানের আশেপাশে আমাদের গেরিলা বেইসগুলো ছিল। আমার সেক্টরে প্রায় ১২০টার মতো গেরিলা বেইস ছিল। প্রতেকটি গেরিলা বেইস থেকে কুরিয়াররা প্রতি সপ্তাহে এসে আমাদের কাছে অপরেশনের খবর এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন খবর দিয়ে যেত। কোন কোন সময় নিয়মিত বাহিনী নিয়েও শত্রুর অবস্থানগুলোতে আক্রমণ চালাতে হত। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে আমরা গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিতাম।

মেজর নওয়াজেশ সাব-সেক্টর কমান্ডার (রংপুর) ছিলেন-ভুরুংগামারী থেকে পাটগ্রাম পর্যন্ত। ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ছিলেন মোগলহাটে। ক্যাপ্টেন মতিউর ছিলেন বাউরাতে। চিলাহাটিতে ছিলেন ফ্লাইট লে: ইকবাল। ক্যাপ্টেন নজরুল ছিলেন হলদীবাড়িতে। সুবেদার মেজর ওসমান গনি (ই-পি-আর), স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন-ইনডাকশন ট্রেনিং শেষ হবার পর বিভিন্ন অপরেশনে পাঠানো এদের দায়িত্ব ছিল।

দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহকুমার অমরখান নামক জাইগায় আমাদের প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। রংপুর জেলার বড়খাতায় আমাদের প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। ভুরংগামীর নিকটে আমাদের আরেকটা প্রতিরক্ষা বুহ্য ছিল। এখানে মেজর নওয়াজেশ ছিলেন। বড়খাতায় ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। অমরখানে ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার। আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল পাটগ্রামের কাছে বুড়িমারী নামক জায়গায় (বাংলাদেশের অভ্যস্তরে)। আমাদের নিয়মিত বাহিনী নিতান্ত নগণ্য ছিল, সুতরাং আমাদেরকে হ্যারাসিং, ফায়ার, রেইড, এমবুশ, মাইন পুঁতে রাখা এগুলোর উপর জোর দিতে হয়েছিল।

প্রধান আক্রমণ যে সমস্ত জায়গায় চালানো হয়েছিল সেগুলো হল: ভূরুংগামারী (রংপুর), মোগলহাট (রংপুর), অমরখান (দিনাজপুর), বড়খাতা (তেঁতুলিয়া) এবং পাটগ্রাম। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারবর্গের থাকার জন্য দুটো ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের পুরো সেক্টরের জন্য দুজন এমবিবিএস ডাক্তার ছিলেন। তেঁতুলিয়াতে ৫০ বেডের একটা হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। বুড়িমারীতে ২৫ বেডের একটা হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হোসেন এখানে ছিলেন। দুজন ছাত্র ফন্টে ছিল। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম এদের কাছে পাঠানো হত। এরা ছোটখাটো অস্ত্রপচার করত এবং প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হত। রংপুর কলেজের কয়েকজন ছাত্রী হাসপাতালে নার্সিং ডিউটি করার জন্য তাদের ভলান্টিয়ার করে। মারাত্তকভাবে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাগডোগরা কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে এবং জলপাইগুড়ি বেসামরিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঔষধপত্র যন্ত্রপাতি ভারতীয় সামরিক বাহিনী থেকে পাওয়া গিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার বিভিন্ন সুত্রে যোগাড় করেছিলেন। স্থানীয় ভারতীয়রাও সাহায্য করেছিলন। জুলাই-আগষ্ট থেকে খাদ্যদ্রব্য, কাপড়চোপড়, ঔষধপত্র, অস্ত্রশস্ত্র সরবাহ আগে থেকে নিয়মিত ছিল। যদিও পর্যাপ্ত পরিমানে ছিল না, তবুও মুক্তিযুদ্ধের গতি বৃদ্ধি পেতে থাকল। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকেই ট্রেনিং প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা নিয়মিতভাবে আসতে থাকল। এই সময় বিভিন্ন সেক্টরে অফিসারদের সল্পতা দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার মূর্তিতে অফিসারদের ট্রেনিং এর জন্য ক্যাম্প স্থাপন করেন। এখানে প্রথম ব্যাচে প্রায় ৬৪ জন অফিসার ট্রেনিংপ্রাপ্ত হন। এখানে পাসিং আউট প্যারেডে সালাম গ্রহন করেছিলেন তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল ওসমানী, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ। এই পাসিং আউট প্যারেডের খবর পাকিস্তানে গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে চলে গিয়েছিল।

এই সময় বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ আমার সেক্টরে পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, এবং চারদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমাদের অবস্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন। তিনি তেঁতুলিয়া, ভজনপুর, পাটগ্রামে জনসভায়ও ভাষণ দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। জনাব কামরুজ্জামান যখন আমাদের সেক্টর পরদর্শনে তখন তিনি তার মন্ত্রণালয় পটগ্রামে স্থানান্তরিত করার সিধ্যান্ত নিয়েছিলেন। সমস্ত সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর লোকেরা ৭৫ টাকা করে মাসিক পকেট খরচ এবং খাদ্য, কাপড়-চোপড় পেতো। অফিসাররা ২০০ টাকা করে পেতো এবং গোরিলারা পেত ৫০ টাকা করে পকেট খরচ এবং ফ্রি রেশন এবং অথবা দু’টাকা করে প্রত্যহ রেশন মানি।

অমরখানাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি ছিল- তাদের ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং মিলিশিয়া বাহিনী মিলে প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য ছিল। জুলাই মাসে টাস্ক ফোর্স দুই কোম্পানি এবং এক কোম্পানি ফ্রিডম ফাইটার নিয়ে শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। শত্রুবাহিনীর পেছনে গোরিলাদের অনুপ্রবেশ করানো হয় ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের নেতৃত্বে। দুই কোম্পানি ই-পি-আর সৈনিকদের সাহায্য প্রধান আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমনে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীরও সাহায্য নেয়া হয়েছিল। যদিও শত্রুঘাটি আমরা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম কিন্তু পাকিস্তানী গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমনের ফলে আমাদেরকে ঐ স্থান ত্যাগ করতে হয়।

এই ব্যর্থতা থেকে আমরা কতোগুলো শিক্ষা গ্রহন করেছিলাম। আক্রমনের পূর্বে শত্রুবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। রেডিও বা অয়ারলেসে যোগাযোগের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে। আর যদি পুর্বাহ্নেই পাকিস্তান গোলন্দাজ বাহিনীর অবস্থান জানতে পারতাম তাহলে ঐ অবস্থানের উপর সেলিং করা যেত।

ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ই-পি-আর এবং আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র নিয়ে বড়খাতায় (রংপুর) জুলাই মাসে অপারেশন চালানো হয়। এখানে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নেয়া হয়েছিল। অবশ্য এই আক্রমনে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়। আমাদের সৈন্যদের ভালো প্রশিক্ষণ ছিল না। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। এই সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আমাদের সৈন্যদের সুশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন অপারেশনে আমাদের ব্যর্থতা আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল। আমাদের নিজেদের দোষক্রুটি শোধরাতে পেরেছিলাম। যার ফলে বিভিন্ন আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলাম।

অক্টোবর মাস থেকেই আমাদের বিজয় শুরু হয়। অক্টোবর মাসে বড়খাতা ভুরংগামারী অমরখানা দখল করতে সমর্থ হই।

মেজর নওয়াজিশের নেতৃত্বে তিন কোম্পানির সৈন্য ভূরুংগামারীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করা হয় (জুলাই-আগষ্ট মাসে)। এর আগে ভূরুংগামারীতে রেইড, এম্বুশ ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এই আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি।

এই তিনটি বৃহৎ আক্রমণের ফলে শত্রুবাহিনী বুঝতে পারে যে মুক্তিযোদ্ধারা যে কোন বড় আক্রমণ করতে পারে। তাই তারা আরোও সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র আনতে শুরু করে। এমবুশ রেইড এতে আরোও বেড়ে যায়। এইসব আক্রমণের ফলে আমরা বুঝতে পারি সৈন্যসংখা বৃদ্ধি করতে হবে। অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে হবে।

অক্টোবরের মাঝামাঝি ভূরুংগামারীর উপর আবার আক্রমণ চালানো হয় মেজর নওয়াজেশের নেতৃত্বে। তিন কোম্পানি সৈন্য দিয়ে এই আক্রমণ চালানো হয়েছিল। ১৮ ঘন্টা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভূরুংগামারী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এই আক্রমণে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়। শত্রুবাহিনীকে আমরা পিছু ধাওয়া করি। শত্রুবাহিনীর সাথে আবার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট সামাদসহ অনেকই শহীদ হন। লেফটেন্যান্ট সামাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। জয়মনিরহাটে মসজিদের সামনে তাকে সমাহিত করা হয়। জয়মনিরহাটকে সামাদনগর নামকরণ করা হয়। সামাদের মৃতদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দু’ভাই মৃত্যুবরণ করেন। এদেরকেও সামাদের সাথে সমাহিত করা হয়।

ভূরুংগামারীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোম্পানি-হেডকোয়ার্টার ছিল। ঐ বিল্ডিং এর এক কক্ষে ১৫ জন যুবতীকে বন্দি অবস্থায় পাওয়া যায়। কাছাকাছি এক স্কুলের বিল্ডিংএ নারী, পুরুষ, ছেলেমেয়ে, প্রায় ২০০ জনকে বন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের জোর করে খাটিয়ে নিত। অনেককে ভোগের সামগ্রী হিসাবে ব্যাবহার করা হয়েছিল।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেকের মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ভূরুংগামারীর আশেপাশের সমস্ত বাড়িঘর সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চাষাবাদ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। জনমানবের কোন চিহ্নই পাওয়া যায় নাই। চারিদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। সমস্ত এলাকা একটা ভুতুড়ে বাড়ির মত মনে হচ্ছিল। ভূরুংগামারীতে বাস্কারের মধ্যে অনেক যুবতীর লাশ পাওয়া যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাস্কারের মধ্যে এসব মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল।

এর পরপরই অমরখানা এবং বড়খাতাতে আক্রমণ চালানো হয়। দুই জায়গা থেকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বড়খাতার পতনের পর পাক সেনাবাহিনীর মনোবল একেবারে ভেংগে যায়। তাদের বিভিন্ন ঘাঁটির দ্রুত পতন ঘটতে থাকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল পুরাপুরি ভেংগে গিয়েছিল। অমরখানা থেকে মুক্তিযোদ্ধারা পচাঁগড়, বোদা দখল করে ঠাকুরগাঁও দিকে অগ্রসর হয়। এ দলটার নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন। দলটি হাতিবান্ধা আক্রমণ করেছিল। হাতিবান্ধা পতনের পর তার ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হয়।
ভূরুংগামারী পতনের পর মেজর নওয়াজিশের এই বাহিনীটি নাগেশ্বরী দখল করে এবং ধরলা নদীর উত্তর পাশে পৌঁছায়।

এ ছাড়াও আরোও দুটি গেরিলা বাহিনীর দুটো কলাম ফ্লাইট লেঃ ইকবালের নেতৃত্ব চিলাহাটি দিয়ে ডোমার, ডিমলা এগুলো দখল করে নীলফামারীর দিকে অগ্রসর হয়। মোগণহাট থেকে আর একটি কলাম ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের নেতৃত্বে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হয়।

রংপুর, সৈয়দপুর সেনানিবাস ছাড়াও ৬ নং সেক্টরের সমস্ত এলাকা ১৬ই ডিসেম্বরের আগে মুক্ত হয়।

স্বাঃ খাদেমুল বাশার
১৫-৫-১৯৭৩