সাক্ষাৎকারঃ মোঃ রফিকুল আলম
২রা সেপ্টেম্বর শিলং থেকে আমাদেরকে ট্রেনিং সেন্টারে পাঠানো হয়। শিলং থেকে ৮২ কিলোমিটার দূরে খাসিয়া জয়ন্তিকা হিলে পৌঁছার পর। এরপর আমরা ই-২ সেক্টরেএ ফরম পূরণ করি। তার পরই শুরু হয় ট্রেনিং। ৯ই সেপ্টেম্বর ট্রেনিং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তামাবিল চেকপোষ্টে (সিলেট জেলায়) আমার পোষ্টিং হয়। ঐ দিনই আমি তামাবিল পৌঁছে এবং একটি প্লাটুনের দায়িত্ব গ্রহন করি।
আমি ছিলাম জুনিয়র কমিশন অফিসার- সেনাবাহিনীর সুবেদার র্যাংকের সমতুল্য। তামাবিলে অবস্থানকালেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মুজিবনগর সরকার আমাকে একটা বিশেষ দায়িত্ব দেন। কিন্তু সসরাসরি মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত থাকার তামাবিল সাব-সেক্টর থেকে আমাকে রিলিজ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়নি। ফলে ঐ সময় আমি স্টাফ ইন্টেলিজেন্স পোষ্টে যোগদান করতে পারিনি।
১১ই সেপ্টেম্বর রাতে একদল মুক্তিফৌজ নিয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থানের উপর আমরা আক্রমণ চালাই। এই আক্রমণে গুলি বিনিময়ের সময় সাবেক সেনাবাহিনীর সিপাহী অফিসার বুলেটবিদ্ধ হন। পাকিস্তানী সৈন্যদের চারজন নিহত ও ছয়জন রাজাকার আহত হয়। সংঘর্ষের পর ষ্টেনগান, একটি ৩০৩ রাইফেল ও ঝুড়িভর্তি মাছ উদ্ধার করা হয়।
১৮ই সেপ্টেম্বর জৈন্তাপুর পাকসৈন্যদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালানো হয়। ক্যাপ্টেন ফারুক ও সুবেদার খোরশেদ আলম এই অভিযানে আমাদের সাথে ছিলেন। তীব্র সংঘর্ষের মধ্যে একটি অয়ারলেস সেট ফেলেই আমরা চলে আসি।
১৯শে সেপ্টেম্বর ক্যাপ্টেন ফারুকের নেতৃত্বে রাধানগরে পাকসেনাদের অবস্থানে আক্রমণ চালানো হয়। ২০শে সেপ্টেম্বর পাকসেনাদের উক্ত অবস্থানে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমরা পুনরায় আক্রমণ চালাই।
২৩শে সেপ্টেম্বর আমরা নয়াবস্তি নামক স্থানে ডিফেন্স দেই। ২৫শে সেপ্টেম্বর আমাকে তামাবিল সাব-সেক্টরে ডেকে পাঠানো হয়। ২৬শে সেপ্টেম্বর আমি কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করি।
১লা অক্টোবর ২০/২২ জন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে মুবাবস্তি নামক স্থানে পাকিস্তানী সৈন্যদের বাংকার আক্রমণ করি। এই আক্রমণে বেশ কিছু সৈন্য হতাহত হয়। আমাদের পক্ষে আহত হয়েছিল দু’জন। আমাদের ওয়ারলেস সেটটি খারাপ হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা দ্রুত সরে আসি।
২রা অক্টোবর ভারতীয় মেজর মিত্র সস্ত্রীক আমাদের ক্যাম্পে আসে (বাউরভাগ ক্যাম্প)। উক্ত ক্যাম্পে অবস্থানকালে আমরা পাঞ্জাবী সৈন্যদের প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়েছিলাম। যার ফঅলঅলে রাতে আমরা কেউ ঘুমাতে পারতাম না। মুক্তারপুর ক্যাম্প থেকে আরো ৭৫ জন মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে আমাদের শক্তি বৃদ্ধি করা হয়েছিল। ঐদিন ভারতীয় বার্মাশেল ও ই-এস এস-ওর কিছু অফিসার এবং পাংতুং থেকে মিস লিন্ডা নামে একজন লেডী ডাক্তার আমাদের ক্যাম্পে এসে খোঁজখবর নিয়ে যান।
৭ই অক্টোবর ইয়োথ ক্যাম্প থেকে জনৈক মিঃ ঘোষ ক্যাপ্টেন বি, এস রাওয়ের সাথে আমাদের ক্যাম্পে আসেন।
৮ই অক্টোবর পাকিস্তানী সৈন্যরা ৪ নং ব্রিজের পাশ থেকে আমাদের উপর প্রবল গুলিবর্ষণ শুরু করে। সারারাত আমরা জেগে থাকি।
১১ই অক্টোবর মাত্র পনেরজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি কাপুরা নামক স্থানে পাকসৈন্যদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাই। এই সংঘর্ষের পর বিএসএফ-এর একজন লেঃ কর্নেল এবং ষ্টেটসম্যান পত্রিকার একজন সাংবাদিক আমার সাক্ষাৎকার গ্রহন করেন।
১৮ই অক্টোবর আমি লামহাদার পাড়ায় যাই। টুনু মিয়া চেয়ারম্যানের বাড়ি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তখন তার বাড়িতে পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশজন রাজাকারসহ ৫ জন পাঞ্জাবী অয়ারলেস সেট ও মেশিনগান সজ্জিত হয়ে পাহারা দিচ্ছিল। যাই হোক পরে টুনু মিয়া চেয়ারম্যানের বাড়ি অপারেশন করা হয়নি।
২০শে অক্টোবর খবর পাই ১০/১২ জন পাঞ্জাবী সৈন্য গোরকচি গ্রামে এসে জনসভা করার পর বেশ কিছুসংখ্যক গ্রামবাসীকে বাংকার খননের জন্য রাধানগর নিয়ে গেছে। ঐ দিন আমরা মুক্তিযোদ্ধারা রাজাকার সন্দেহে ৪ ব্যাক্তিকে ধরে নিয়ে এসে, তাদেরকে স্থানীয় লিবারেশন কমিটির চেয়ারম্যান বশির সাহেবের নিকট সোপর্দ করা হয়।
২৫শে অক্টোবর সারিগোয়াইন রাস্তার উপর নির্মিত সেতু (১ নং ব্রীজ নামে অভিহিত) উড়িয়ে দেবার জন্য নির্দেশ পাই। এই কাজের জন্য আমাকে এক প্লাটুন গেরিলা যোদ্ধা দেওয়া হয়। ইতিপূর্বে সেতুটি উড়িয়ে দেবার জন্য গেরিলা যোদ্ধারা তিনবার চেষ্টা চালিয়ে ব্যার্থ হয়। ২জন পুলিশ, ২১জন রাজাকার ও অপর ১৬জন বেসামরিক ব্যাক্তি সেতুটির পাহাড়ায় নিয়জিত ছিল। পুরা প্লাটুন আমরা তাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাই। ৫ জন রাজাকার সংঘর্ষ স্থানেই নিহত হয়। অন্যান্য রক্ষীরা ১টি ৩০৩ রাইফেল, ইউনিফর্ম, ব্যাজ, বেল্ট ও তাদের কাপড়-চোপড় রেখেই পালিয়ে যায়। আমরা সাফল্যের সাথে সেতুটি উড়িয়ে দিতে সক্ষম হই।
১লা নভেম্বর আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের অবস্থান কাপুরা আক্রমণ করি।
২রা নভেম্বর ঐ একই অবস্থানে আমরা আক্রমণ চালাই। ঐদিন পাকিস্তানী সৈন্যদের অভস্থানে আক্রমণকালে সুবেদার সালাম ও তার পার্টি, এ এস আই হাবিবুর রহমান, ইন্ডিয়ান বি এস এফ-এর খড়ক বাহাদুর থাপা (হাবিলদার) ও ক্যাপ্টেন ফারুক আমাদের সাথে ছিলেন।
৩রা নভেম্বর বারোপনে নামক গ্রাম অপারেশন করি। সে স্থানে পাক সৈন্যদের সাথে গোলাগুলি বিনিময় হয়। ইন্ডিয়ান মেজর সৎপতি আমাদের দেখে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে যান।
২০শে নভেম্বর বড়হাট নামক স্থানে সারিগোয়াইন রাস্তার উপর, ২৪শে নভেম্বর অটলু নামক স্থানে সারিগোয়াইন রাস্তার উপর এবং ২৬শে নভেম্বর মুকাম নামক স্থানে সারিগোয়াইন রাস্তার উপর মাইন বসাই। ঐ রাস্তাটি তখন পাকসেনাদের দখলে ছিল। রাস্তাটির বিভিন্ন স্থানে সৈন্য ও রাজাকার পাহারা থাকত। বড়হাট নামক স্থানে বসানো মাইনের বিস্ফারণে শত্রুসৈন্যের একটি জীপ বিদ্ধস্ত হয়। ফলে দুইজন নিয়মিত পাকসৈন্য নিহত হয়। মুকাম নামক স্থানে বসানো মাইনের বিস্ফারণে শত্রুসমর্থিত একজন বেসামরিক ব্যাক্তি নিহত এবং অপর দুই ব্যাক্তি আহত হয়। পর পর এই ঘটনার পর শত্রুসৈন্যরা রাস্তাটির ব্যাবহার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়।
২৮শে নভেম্বর ২ প্লাটুন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা, ভারতীয় বি এস এফ-এর একটি সেকশনসহ আমি সারিগোয়াইন রাস্তার নিকটবর্তী গুয়াখারা নামক স্থানে শত্রুসৈন্যদের প্রত্যাশায় এমবুশ করি। ২৯শে নভেম্বর ১-৪৫ ঘটিকায় সারিগোয়াইন রাস্তার উপর টুকেরবাজার ব্রীজটি আমরা উড়িয়ে দেই। এই স্থানে প্রহরারত রক্ষীদের সাথে সংঘর্ষে একটি ৩০৩ রাইফেলসহ চারজন রাজাকার আটক করি। কিন্তু ফেরার পথে আমাদের দলটি পাকিস্তানী সৈন্যদের এমবুশ-এর আওতায় পড়ে যায়। পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে আজাদ কাশ্মীর রিজার্ভ ফোর্স ছিল। এরা আমাদের দলটির উপর এইচ-এম-জি ও অন্যান্য স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আক্রমণ চালায়। শত্রুসৈন্যরা চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলেছিল। এই অবরুদ্ধ এবং প্রচণ্ড গোলাগুলির মাঝেও অসীম সাহস, উন্নত কৌশল ও উপস্থিত বুদ্ধির জোড়ে শত্রুবেষ্টনি ভেদ করে বেরিয়ে আসতে সক্ষম হই। আজাদ কাশ্মীর রিজার্ভ ফোর্সের মোট ১১জন আমাদের হাতে নিহত এবং ৪ জন রাজাকার আহত হয়। আমাদেরও খুব ক্ষতি হয়। ইন্ডিয়ান বিএসএফ-এর একজন সুবেদারসহ তিনজন, একজন পুলিশের এএসআই ও কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা মারা যান।
১৬ই ডিসেম্বর যুদ্ধবিরতি ঘোষণার প্রাক্কালে আমরা সালুটিকর বিমান বন্দর (সিলেট) পর্যন্ত পৌঁছি। ঐদিক দুইজন রাজাকার আমাদের কাছে অস্ত্রসহ আত্নসমর্পণ করে। তারা হলো: (১) মোঃ আলী- খাস মৌজা বারহলি, ৩০৩ রাইফেল মার্ক নং ৩, নং ৪৯৬২। (২) মনোহর আলী- ফুডপুর, কুপুনাখাই, রাইফেল নং পি এফ ১৬১২৮৫ নং ৪, মার্ক-১।
সাক্ষর: মোঃ রফিকুল আলম
২২-৭-৭৮
*সাক্ষাৎকারটি ২২-০৭-৭৮ তারিখে প্রকল্প কর্তৃক গৃহীত।