You dont have javascript enabled! Please enable it! বীর মুজাহিদ দুলা | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

॥বীর মুজাহিদ দুলা॥

এ প্রসঙ্গে কয়েকজন মুজাহিদের নাম করা যায় যাদেরকে আমি তেলিয়াপাড়াতে দেখেছি। এদের মধ্যে মনে রাখার মতো দুটি নাম দুলা এবং আহাদ। দুলার বয়স ছিল ২৬ বছর। তার বাড়ি কুমিল্লা জেলার শালদা নদীর কাছে। সে মুক্তিবাহিনীর প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলের কোম্পানীতে মেজর মতিনের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সমগ্র মুক্তিবাহিনীতে দুলার মত সাহসী যুবক আর কজন ছিল আমার জানা নেই।

তেলিয়াপাড়ার যুদ্ধে সে যে সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার তুলনা হয় না। বৃষ্টির মতো গোলাবর্ষণের মধ্যেও এই অকুতোভয় যবুক লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেনি কিংবা রণক্ষেত্র ছেড়ে দূরে সরে যায়নি, আপন লোকদেরকেও সে গোলাবারুদ বিতরণ করেছিল।

২১শে জুন আমি যখন শত্রুর ত্রিমুখী প্রচণ্ড আক্রমণের দরুন মনতলা থেকে সরে আসতে বাধ্য হই সেদিন দুলা কলকলিয়ার লড়াইয়ে যে বীরত্ব দেখিয়েছিল তার কিছুটা পাঠকের সামনে তুলে ধরছি।

কলকলিয়া ছিল ক্যাপ্টেন মোর্শেদের অধীনে এবং দুলা সেই ফ্রন্টেই লড়ছিল। ২১শে জুন রাতে শত্রু বাহিনী যখন আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায় সেই একই সময়ে কলকলিয়াতেও তারা আক্রমণ চালায়। মোর্শেদের সৈন্যরা শত্রুদের সাথে সারারাত প্রচণ্ড যুদ্ধ করে। কিন্তু শত্রুর সংখ্যা বহুগুন বেশী থাকায় মোর্শেদের দল সেখান থেকে অবশেষে পিছনে হটতে বাধ্য হয়। সে সময় দুলা মিয়ার হাতে ছিল একটা হালকা মেশিন গান। সে তার হালকা মেশিন গান দিয়ে অনবরত গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল এবং শত্রুর অগ্রগতিকে সারারাত ব্যাহত করে রেখেছিল। নিঃশঙ্কচিত্তে অপারবিক্রমে সে এক ভয়াবহ শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছিল। অবস্থা প্রতিকূল দেখে যখন তার সংগীরা আত্নরক্ষা করতে পিছু হটছিল তখন দুলা সেই পশ্চাদপসরণে অংশগ্রহণ না করে নির্ভয়ে তার হালকা মেশিন গান থেকে অবিরাম গুলি ছুড়ে যাচ্ছিল। তারই অসীম সাহসীকতা ও গুলি ছোড়ার ফলে দলের অন্যান্যরা পিছু হটার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু দুলার বড়ই দুর্ভাগ্য, সে অন্যকে বাঁচাতে গিয়ে নিজেই এক মহা বিপদে আটকে পড়ে। শত্রু পক্ষের মেশিনগানের এক ঝাঁক গুলি এসে দুলা কে বিদ্ধ করে। দুলার পক্ষে একমাত্র দুলার মেশিনগানই সক্রিয় ছিল এবং শত্রুদের আক্রমণের তীব্রতাকে তারই মেশিনগানটি কিছুটা বাধা দিচ্ছেল। ফলে শত্রুর একমাত্র লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠেছিল দুলা। অবশেষে শত্রুরা দুলাকে আহত করতে সক্ষম হয়ে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু নিদারুণ আহত অবস্থায় দুলা সংজ্ঞা হারায়নি এবং শেষ কর্তব্য স্থীর করে সে তার হালকা মেশিনগান থেকে অন্তিম মুহুর্ত পর্যন্ত শত্রুকে বাধা দিয়ে যাবে তা স্থির করল। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে সে জান দিবে কিন্তু জীবিত অবস্থায় তার শরীরকে শত্রু হস্তে কলুষিত হতে দেবে না।

আমি যখন মনতলা থেকে সরে এসে ভারতের সিদাই থানায় (আগরতলার উত্তরে) তখন লেঃ কর্ণেল শফিউল্লাহ আমার এখানে উপস্থিত হলেন। কিছুক্ষণ আলাপের পর তিনি আমাকে মোর্শেদের অবস্থানের কথা জানালেন এবং তাড়াতাড়ি কলকলিয়া চলে যেতে নির্দেশ দিলেন। তিনি আরো বললেন, “মোর্শেদের সৈন্যরা দারুণ বিপদে আছে। তারা সবাই শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত। তুমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাদের বিপদ মুক্ত করতে সাহায্য কর।”

এই কথা বলে তিনি কলকলিয়া চলে গেলেন এবং তাঁর পিছুপিছু আমিও কলকলিয়া পৌঁছুলাম। আমরা যাওয়ার পর দেখতে পেলাম আল্লাহর মেহেরবাণীতে ক্যাপ্টেন মোর্শেদসহ তার কোম্পানীর সবাই নিরাপদ স্থানে পৌঁছে গেছে। তাদের সবাই কে দেখে আমরা আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায়
করলাম।

সবাই এলো কিন্তু তখনো পর্যন্ত দুলা এলো না। তখন বেলা ১১টা। খবর এলো দুলার পেটে এবং ডান পায়ে কয়েকটি গুলি লেগেছে। সে কাদা পানির মধ্যে অসহায় অবস্থায় পড়ে আছে। ছোট্ট একটা সৈন্যবাহিনী গিয়ে তাকে উদ্ধার করতে না পেরে ফিরে এসেছে। শত্রু তখন মেশিনগান বসিয়ে পজিশন নিয়ে আছে এবং কাউকে নড়তেই দেখলেই গুলি ছুড়ছে। শত্রু মেশিনগান বসিয়েছিল ছোট্ট একটি টিলার উপর।

আমরা সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লাম। ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের কাছ থেকে দূরবীন নিয়ে দেখলাম শত্রুর কিছু সৈন্য পজিশন নিয়ে আছে এবং অন্যান্যরা পরিখা খনন করেছে। আমরা সবাই চিন্তা করছি দুলাকে কিভাবে শত্রুদের ঐ বেড়াজাল থেকে উদ্ধার করবো। কোনো একটা ফন্দি উদ্ভাবনে আমরা যখন চিন্তিত তখনই একটা ছেলে দৌড়ে এসে খবর দিল যে দুলাকে নিয়ে আসা হচ্ছে। আহত দুলা গুলি ছুড়তে ছুড়তে সম্পূর্ন নিস্তেজ এবং নিশ্চুপ হয়ে গেলে শত্রুরা তাকে মৃত মনে করেছিল এবং তার দিকে আর গুলি ছোঁড়া প্রয়োজন নেই মনে করে তারাও গুলি ছোড়া বন্ধ করেছিল। এই রকম একটা সুযোগ পেয়ে আমাদের দুই সাহসী ছেলে সন্তর্পণে নালার ফাঁকে ফাঁকে গিয়ে দুলাকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল।

দুলাকে যখন আমদের সামনে আনা হলো তখনকার দৃশ্য এত করুণ এবং বেদনাদায়ক যে তা ভাষায় ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। মুমূর্ষু দুলা বাম হাত দিয়ে তার গুলিবিদ্ধ পেট চেপে ধরে আছে। কেননা ক্ষতস্থান থেকে তার নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম করছিল। ডান পায়ে গুলি লেগে ছিন্নভিন্ন মাংসগুলি কোনোক্রমে পায়ের হাড়ের সংগে লেগেছিল।আর তার সমস্ত শরীর রক্তরঞ্জিত।

একটা গুলিবিদ্ধ বাঘের মতো সে ছটফট করছিল। তখনও সে বাকশক্তি হারায়নি। আমাদের চোখের দিকে চোখ রেখে সে বলল, স্যার আমি আর বাচঁব না, এক্ষুনি মারা যাব। আমার আফসোস রয়ে গেল স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমি মরতে পারলাম না। স্বাধীন বাংলা দেখা আমার ভাগ্যে হয়ে উঠল না। স্যার আমাকে কথা দিন যেভাবেই হোক স্বাধীন বাংলার মাটিতে আমাকে কবর দেবেন। আজ হোক কাল হোক বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। তাই আমার লাশ বাংলাদেশের মাটিতে কবর দেবেন।

সে আরো বললো, স্যার গুলির আঘাতে আমার পেটের নাড়িভূড়ি বের হয়ে গেছে। আমার বাঁচার কোনোই সুযোগ নেই।

মুমূর্ষু দুলার করুণ কণ্ঠ শুনে সেদিন আমরা সবাই গভীর শোকে মূহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। সমস্ত হৃদয় আমাদের বিষাদে ভরে গিয়েছিল। আমরা আবেগ সংযত কণ্ঠে তাকে যতই সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি সে তাতে শান্ত হয় না, সে তার অন্তিম মুহূর্তের আভাস পেয়ে শেষ মনের কথাটি আমাদের জানিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সে বলতে থাকে, স্যার পাঞ্জাবী দস্যুরা যখন আমাদের বাঙ্গালিদের নির্মমভাবে, নির্বিচারে হত্যা শুরু করে তখন আমার ৮ বছরের মেয়েটি আমাকে কি বলেছিল জানেন? বলেছিল, আব্বা তুমিও মুক্তি ফৌজে যোগ দাও, পাঞ্জাবীদের বিরুদ্ধে লড়াই কর, দেশকে স্বাধীন কর। আব্বা তুমি বাড়ি থেকে কি করবে? যদি দেশ স্বাধীন না হয় আমাদের অবস্থা কি হবে? তারা ত যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করে মারছে।

আমার হাত ধরে দুলা বলল, “স্যার আপনার বাড়ি কুমিল্লা, আপনি নিশ্চয়ই শালদা নদী চেনেন। সেখানে আমার বাড়ি। আমার এলাকার সবাই আমাকে চেনে। দয়া করে আমার মেয়েকে এবং সেই এলাকার কাউকে আমার মৃত্যুর খবরটা দেবেন না। আমার মৃত্যুর খবর পেলে আমার মেয়েটি বাঁচবে না। সে আমার জান। দয়া করে তার কাছে আমার মৃত্যুর খবরটা গোপন রাখবেন। তবে আমার একটা দাবী, আমার হতভাগিনী মেয়েটিকে দেখবেন। স্যার আমার এই একটি কথা ভুলে যাবেন না।”কথা বলার মাঝে মাঝে একটা কথা ঘুরেফিরে বারবার বলছিল, “জয় বাংলা দেখে যেতে পারলাম না।”

দুলার এই মুমূর্ষু অবস্থায় এম্বুল্যান্স আসতে কিছুটা দেরী হবে বলে মনে করে লে. কর্নেল শফিউল্লাহ তাকে নিজের জীপে করে আগরতলা পিজি হাসপাতালে নিয়ে গেলেন। আমাদের মুক্তিফৌজের ডাক্তার আবুল হোসেনও দুলার সাথে হাসপাতালে গেলেন যাতে দুলা তার মনের ভরসা না হারায়। হাসপাতালে যাওয়ার পর দুলার অপারেশন করা হয় এবং যখন ডাক্তার জানালেন যে দুলার সঙ্কটাবস্থা কেটে গেছে তখন লেঃ কর্ণেল শফিউল্লাহ হাসপাতাল ত্যাগ করেন। সেদিন দুলার সাথে আরো কয়েকজন আহত হয়েছিল। তাদেরকেও হাসপাতালে পাঠানো হলো।

দুলার অবস্থা দেখে সেদিন আমার মত অনেকে ধরনা করেছিল দুলা আর বাঁচবে না। কিন্তু আল্লাহর অসীম ক্ষমতা আমাদের ক্ষুদ্র ব্যক্তির পক্ষে নিরুপণ করা অত্যন্ত কঠিন। তাঁরই অশেষ কৃপায় এবং অত্যন্ত করুণায় দুলা দেড় মাস পর আরোগ্য লাভ করল এবং পুনরায় ক্যাপ্টেন মোর্শেদের কোম্পানীতে যোগদান করল। পরবর্তীকালে অসীম বীরত্বের সংগে দুলা অনেক রণক্ষেত্রে পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে বাঙালীর বীর্যবত্তার ইতিহাস সমুজ্জ্বল করে তুলেছে।

এবার বলছি আহাদের কথা। আহাদের বয়স মাত্র ১৫ বছর। অতুলনীয় সাহসী ছিল এই বীর মুজাহিদ কিশোর। মুজাহিদ হিসাবে তেলিয়াপাড়া যুদ্ধে তার বীরত্ব প্রদর্শন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাসে একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল ঘটনা। দুলা ও আহাদের বীরত্বের সম্মানস্বরুপ লেফটেন্যাণ্ট কর্ণেল শফিউল্লাহ তাদের কে ২৫০০ টাকা করে পুরুস্কার প্রদান করেন।

এর পর আসে পুলিশ প্রসঙ্গ। আমার সঙ্গে যে ৫ জন পুলিশ ছিলেন তারা হলেন মিজান, সুরুয মিয়া, খোরশেদ মিয়া, তাহের মিয়া এবং কানু মিয়া। আমার কোম্পানীতে এরা মর্টার ছুড়তেন। মাত্র সামান্য কয়েকদিনের শিক্ষায় এরা মর্টার চালনায় প্রায় পেশাদার সৈনিকের মত দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে এই ৫জন পুলিশ সৈনিকের দান সামান্য নয়। অসীম বীরত্বের সঙ্গে এঁরা শত্রুসৈনিকের সাথে বারবার লড়াই করেছেন।

মেজর মতিনের কোম্পানীটি ছিল পুরোপুরি প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী দ্বারা সংগঠিত। আমি এবং মেজর মতিন যখন তেলিয়াপাড়ায় লড়াই করেছি তখন দেখেছি কি রকম নিষ্কম্প হৃদইয়ে ঐ পূর্ব পাকিস্থান রাইফেলের জোয়ানরা লড়াই করেছে। মেজর মতিনের ই-পি- আর কোম্পানী পরবর্তীকালেও বিভিন্ন ফ্রন্টে খুব সাহসের সঙ্গে লড়েছিল। তাদের এই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের প্রশংসা না করে আমি পারি না।