সাক্ষাৎকারঃ মেজর জাফর ইমাম
৬ই নভেম্বর হেডকোয়ার্টার আমাকে ডেকে পাঠালেন। তখন বেলুনিয়া পকেটটি পুরোপুরি পাকবাহিনীর দখলে ছিল।
আমাকে ডেকে বলা হলো, বেলনিয়া রেলওয়ে স্টেশন থেকে শুরু করে ফেনী পর্যন্ত এই পকেটটি মুক্ত করার ভার তোমার উপর দেওয়া হলো। পরশুরাম, চিতলিয়া, ফুলগাজী, বেলুনিয়া ও ফেনী এই বিশেষ স্থানগুলো তখন ছিল পাকবাহিনীর মজবুত ঘাঁটি। আমি এ জায়গাগুলো থেকে শত্রুদের পুরোপুরি বিতাড়িত করার জন্য দৃঢ়সংকল্প নিলাম। এই সংকল্পকে বাস্তবায়িত করার কাজ হতে নিলাম ৮ই নভেম্বর। এই দিনটি চিল আমার জীবনে একটি স্মরণীয় দিন। ১০ম বেঙ্গল ও ২য় বেঙ্গলের একটি কোম্পানীর সাথে গভীর আত্মবিশ্বাস ও অসীম মনোবল নিয়ে আমি এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের প্রস্তুতি কাজের নিতে লাগলাম। ২য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের দলটি চিল ক্যাপ্টেন মোরশেদের অধীনে।
পরশুরাম ও বেলুনিয়াম পকেট থেকে শত্রুদের হটানোর ব্যাপারে মিত্র বাহিনীর জেনারেল হীরা আমায় চ্যালেঞ্জ করলো। আমি দৃঢ়ভাবে এ চ্যালেঞ্জ গ্রহন করলাম এবং অতি সুনিপুণভাবে এ অভিযানকে সফল করে তুলবোই। তাই দৃঢ় আত্মপ্রত্যয় নিয়ে সামরিক কৌশলের অন্যতম কৌশল হিসাবে গোপন অনুপ্রবেশ দ্বারা শত্রুদের গোপন অবরোধ করার সিদ্বান্ত নিলাম।
এখানে একটা কথা উল্লেখযোগ্য যে, আমরা যে বাহীনি দ্বারা এ অভিযান শুরু করেছিলাম তারা পুরোপুরি সব দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ন ছিল। এই অভিযানে ১০ বেঙ্গলের ও ২য় বেঙ্গলের শতকরা ৮০ জন সৈন্য চিল পুরনো বেঙ্গল রেজিমেন্টর এবং বাকী শতকরা ২০ জন সদস্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত। তাছাড়া মিত্র বাহিনী আমাদের এ অভিযানে অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে সক্রিয় সহযোগিতায় করেছিল। রাতের অন্ধকারেই আমরা গোপন অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করবো বলে সাব্যস্ত করলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল রাতের মধ্যেই অনুপ্রবেশের কাজ শেষ করে ভোর হবার আগেই ওদের সাথে মোকাবিলা জন্য প্রস্তুতি নেওয়া।
নভেম্বর অন্ধকার শীতের রাত। টিপ টিপ করে হালকা বৃষ্টি পড়ছিল। হিমেল হাওয়ায় গাছের পাতায় যেন একটি অশরীরি শব্দ সৃষ্টি করছিল। মনে হচ্ছিল সমস্ত রাতটা যেন কিছুুর প্রতীক্ষায় আছে। রাত অনুমানিক ১০-৩০ মিনিট। আমাদের অনুপ্রবেশের কাজ শুরু করলাম। আমার এমন একটা এলাকা ঘেরাও করার অভিযানে নেমেছি যার তিনটা দিক ছিল ভারত সীমান্ত দ্বারা বেষ্টিত। আমরা এই ভারতের এক প্রান্তের সীমান্ত থেকে পরশুরাম চিতলিয়ার মাঝ দিয়ে অগ্রসর হয়ে ভারত সীমান্তের অপর প্রান্ত পর্যন্ত অবরোধ করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমদের এই অবরোধ যদি সফল হয় তবে শত্রুরা সহজই ফাঁদে আটকা পড়বে।
অবরোধের কাজ শুরু হলো। অন্ধকার রাতে মুহুরী নদী ও চিলনিয়া নদীর কোথাও বুক পানি, কোথাও কোমর পানি, কোথাও বা পিচ্ছিল রাস্তা বাধা পেরিযে এগিয়ে চলছি সবাই। সে এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। অন্ধকার রাত। সামান্য কাছের লোককেও ভাল করে দেখা যাচ্ছিল না। কমাণ্ডার হিসাবে সবাইকে সুশৃংখলভাবে পরিচালিত করে আমাদের নির্ধারিত গন্তব্যস্থলে পৌঁছানো সত্যই কষ্টকর ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবুও সব বাধাকে তুচ্ছ করে আমরা এগিয়ে চললাম এবং সাথে সাথে আমি আমার দলের অন্যান্য অফিসারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চললাম। নিঃশব্দ হয়ে সবাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছি। কারো মুখে কোন কথা নাই। শত্রুরা ঘূর্ণাক্ষরেও জানতে পারলো না যে ওদের জালে আটকবার জন্য আমরা এগিয়ে আসছি। শত্রুরা যদি আমাদের এ অনুপ্রবেশ টের পায় তবে আমাদের সমস্ত পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে, কারণ যুদ্ধক্ষেত্র গোপন অনুপ্রবেশ যদি অপরপক্ষ টের পায় তবে পরিকল্পিত অভিযান সফল করা সম্ভব হয় না। আমরা আরো অনেক পথ এগিয়ে এলাম। আমাদের এ কাজে বেশ সময় লাগছিল। কারণ অন্ধকার রাতে নির্ভুল পথে এগিয়ে যাওয়া সত্যিই বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল। এছাড়া আরো একটা ভয়ের সম্ভবনা ছিল। শত্রুদের লোকেরা রাতে বিভিন্ন জায়গায় পেট্রোলিং-এ ছিল। তাদের খপ্পরে পড়াও বিচিত্র ছিল না। সে ভয় আমাদের অমূলক ছিল না। আমরা যখন রেলওয়ে ও কাঁচা রাস্তার কাছাকাছি এগিয়ে এলাম তক্ষুণি দেখলাম শত্রুপক্ষের ডিউটিতে একটি দল রেললাইন ধরে সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। আমরা টুপ করে লুকিয়ে গেলাম- কেউ বা রাস্তার আড়ালে, কেউ বা জমিনের আড়ালে। ওরা কিছুই টের পেল না। নিশ্চিত মনে গল্প করতে করতে চলে গেল। বিপদ কেটে গেল। এদিকে রাত বাড়ছে। আমি তাড়াতাড়ি আমার কোম্পানীর কমান্ডারদের সাথে যোগাযোগ করলাম। ওরা জানালো সব ঠিক আছে। ওরা নিরাপদেই অবরোধের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ভোর হবার বেশ বাকী নেই। আমরা আমাদের নির্ধারিত স্থানে হাজির হলাম এবং এর ফলে শত্রুদের পশুরাম ও চিতলিয়া ঘাঁটি পুরোপুরি আমাদের অবরোধের মাঝে আটকা পড়লো।
আমরা শত্রুরা চিতলিয়া ঘাঁটির দিক থেকে যাতে কোন প্রকার আক্রমণ না আসতে পারে তার জন্য প্রতিরোধ গড়ে তুললাম। ভোর হয়ে আসছিল। আমরা প্রতিরোধের সকল ব্যবস্থা শেষ করতে লাগলাম। বাঙ্কার খোঁড়ার কাজ শুরু হলো। এবং অন্যান্য সব ব্যবস্থাও করলে লাগলাম। পথশ্রমে ও ক্ষুধার তাড়নায় সবাই ক্লান্ত। তবুও বিশ্রামের সময় নেই। ভোরের আলো ফুটবার আগেই প্রতিরোধের কাজ শেষ করতে হবে, তাই প্রাণপণে সবাই কাজ করতে লাগলাম। ভোর হলো। আমরাও সম্পূর্ণ প্রস্তুত হয়ে গেলাম। শত্রুরা আমাদের অবরোধের মাঝে। এ সফলতার খবরটা জেনারেল হীরাকে জানাতে ইচ্ছা হলো। ওয়ারলেসে হীরাকে জানালাম যে শত্রুদের আমরা পুরোপুরি জালে আটকিয়েছি। খবরটা শুনে জেনারেল হীরা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। ধন্যবাদ দেবার সময় খুশিতে তার বার বার কথা আটকে যাচ্ছিল। আমি আমার চ্যালেঞ্জে জিতেছি বলে জে: হীরা ব্যক্তিগতভাবেও আমাকে প্রচুর ধন্যবাদ জানালো। এদিকে ভোরে আলোয় চারদিক আলোকিত হয়ে উঠছিল। ভোরের আলোয় চারদিকে ভালো করে দেখতে লাগলাম। তারপর বুঝতে চেষ্টা করলাম যে শত্রুরা আমাদের অনুপ্রবেশ টের পেয়েছে কিনা। কিন্তু না। তা বোঝার কোন উপায় নেই। চারিদিক নীরব। কোথাও মানুষের কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছিল না।
বেলুনিয়া থেকে রেললাইনের সাথে সমান্তরালভাবে কাঁচা রাস্তাও চলে এসেছে ফেনী পর্যন্ত। এই রাস্তার পাশেও আমাদের বেশকিছু বাঙ্কার গড়ে উঠেছে। বাঙ্কারে বসে সবাই সামনের দিকে চেয়ে আছি। বেশ কিছু সময় কেটে গেল। হঠাৎ দূর থেকে একটা ট্রলির আওয়াজ অস্পষ্ট শুনতে পেলাম। শব্দটা চিতলিয়ার দিক থেকেই আসছে বলে মনে হলো। রেললাইন ও রোডের কাছে বাঙ্কারে যারা ডিউটিতে ছিল তাদের মধ্যে নায়েব সুবেদার এয়ার আহমদ ছিল খুবই সাহসী। যুদ্ধের প্রথম থেকেই সে আমার সাথে থেকে নির্ভীকতার সঙ্গে লড়াই করে আসছিল।
ট্রলিটা এগিয়ে আসছে। সবাই প্রতিক্ষায় বসে রইল। আস্তে ট্রলির শব্দটা আরো কাছে এগিয়ে আসছে। আমরা পরিষ্কারভাবে দেখতে পেলাম কয়েকজন সৈন্য বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে এগিয়ে আসছে। ওরা নিশ্চিত মনে আসছে। ওরা বুঝতেও পারেনি ওদের শত্রু এত কাছে রয়েছে।
এক, দুই, তিন… মিনিটের কাটা ঘুরতে লাগল। ট্রলিটা একেবারে কাছে এসে গেলো। এয়ার আহমদ ও তার সঙ্গীদের হাতের অস্ত্রগুলো একসঙ্গে গর্জে উঠলো। মুহূর্তের মধ্যে জায়গাটা ধোঁয়ায় ঢেকে গেল। অনবরত ফায়ারিং-এর শব্দে চারিদিক মুখরিত হয়ে উঠলো। শত্রুরা অনেকেই পালাতে চাইলো কিন্তু তা সম্ভব হতে আমরা দিলাম না। একজন শত্রুও প্রাণে বাঁচতে পারলো না। আনন্দে এয়ার আহমেদ ও তার সঙ্গীরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো। উত্তেজনায় আনন্দে ওদের সারা শরীর কাঁপছিল।
ফায়ারিং-এর শব্দ শুনে চিতলিয়া ও পশুরাম ঘাঁটির শত্রুরা মনে করলো ট্রলিটা হয়তো বা কোন মুক্তিবাহিনীর গেরিলার দলের হাতে পড়েছে। প্রকৃত অবস্থাটা তারা কিন্তু বুঝতে পারেনি। তখন দুদিক থেকেই শত্রুরা আক্রমণ করতে শুরু করলো।
এদিকে এয়ার আহমদ আনন্দে বাঙ্কার ছেড়ে উঠে দৌড়ে গেল অদূরে পড়ে থাকা শত্রুদের মৃত অফিসারটির কাছে। গোলাগুলির কথা যেন মুহূর্তের মধ্যে ভুলে গেল। অফিসারের পকেট থেকে সে পিস্তলটি উঠিয়ে নিল। তারপর তাকে টেনে নিয়ে আসতে লাগলো নিজ বাঙ্কারের দিকে। ঠিক তক্ষুণি শত্রুদের চিতলিয়া ঘাঁটির দিক থেকে একটি বুলেট এসে বিঁধলো এয়ার আহমেদের মাথায়। চোখের সামনেই দেখতে পেলাম ও শরীরটা যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেল। ঢলে পড়লো বাঙ্কারের মুখে। রক্তে ঢেকে গেলে ওর জয়ের আনন্দে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠা মুখটা। নিজের জান দিয়ে এয়ার আহমেদ শত্রুদের ঘায়েল করেছে। কিন্তু এর শেষ দেখে যাওয়া তার কপালে সইলো না।
৯ই নভেম্বর। সেদিন ওকে হারিয়ে বেদনায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম। একজন বীরকে হারিয়ে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম ঠিকই তবুও কর্তব্যের ডাকে সাড়া দিয়ে এয়ার আহমেদের রক্তের বদলা নেবার জন্য শত্রুদের হামলার যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়ে চললাম, শত্রুর আক্রমণের দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়ে চললাম। শত্রুরা সারাদিন ধরে আমাদের বিভিন্ন পজিশনের উপর তুমুলভাবে আক্রমণ চালালো।
সারাদিন কেটে গেল। বৃষ্টির মত আর্টিলারী আর শেলিং-এর শব্দে আশেপাশের নীরব এলাকা কেঁপে উঠতে লাগলো। ক্রমে রাত হয়ে এলো। অন্ধকার রাত। শত্রুরা এবার পশুরাম ঘাঁটি থেকে আমাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ শুরু করলো। আমাদের জোয়ানরা তার পাল্টা জবাব দিয়ে চললো। পরশুরাম থেকে এ আক্রমণের আকার ছিল অতি ভয়ঙ্কর। ওরা এমনভাবে আমাদের জালে আটকা পড়েছে যে, বের হবার কোন পথই নেই। ওরা বুঝতে পারলো এটা ওদের জীবন-মরণ সমস্যা। তাই তারা প্রাণপণে লড়ে যেতে লাগলো। কিন্তু ওদেরকে আমাদের জাল ছেড়ে বের হতে দিলাম না। আমরা তাদের সকল চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিতে লাগলাম।
শত্রুদের বেলুনিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটিতে যারা ছিল তারা শুধু প্রতীক্ষায় ছিল। যে করেই হোক ওরা চিতলিয়া থেকে সাহায্য ও যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে লাগলো- কিন্তু আমরা তা ব্যর্থ করে দিলাম। ওদের এই প্রাণপণ লড়াইয়ের জবাব দিয়ে আমরা শত্রুদের পরশুরাম আক্রমণ প্রতিহত করি।
তারপর ভোর হলো। ওরা আমাদের উপর অনবরত শেলিং ও ফায়ারিং করতে লাগলো। আমরা উচিত জবাব দিয়ে চললাম।
সেদিন বেলা ৪টার সময় হঠাৎ রা আমাদের উপর বিমান হামলা শুরু করলো। কিন্তু ওরা এতে আমাদের বিশেষ কোন ক্ষতি করতে পারলো না। এবার আমরা আরো সতর্কতা অবলম্বন করলাম।
সেদিন গেল। তার পরের দিনও আগের দিনের মতই ফায়ারিং ও শেলিং চললো। দুপক্ষ থেকেই সমানে আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ চললো। ওদের শুধু একটিই উদ্দেশ্য, হয় চিতালিয়ার সাথে যোগাযোগ না হয় পলানো। কিন্তু সে মুহূর্তে পলানো ছাড়া তাদের আর কোন পথই আসলেই ছিল না। শুধু ফায়ারিং ও শেলিং-এর শব্দে মাঝে মাঝে সে এলাকার প্রকৃতি আর গাছপালা যেন কেঁপে কেঁপে উঠছিল, অনেক সময় এক মিনিটও বিরাম ছিল না। শব্দের জন্য অতি কাছের লোকের কথাও শোনা যেত না।
সেদিন বেলা ৩-৫০ মিনিট। হঠাৎ দেখলাম তিনটা শত্রু বিমান আমাদের এলাকায় উড়ে আসছে। এসেই ওরা সে এলাকার উপর বোম্বিং করতে শুরু করলো। অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে যেতে লাগলো। চারিদিকে দাউ দাউ করে বাড়িঘরে আগুন জ্বলছে। ওরা বেশ নিচু হয়েই বোম্বিং করছিল। যদিও আমাদের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বহু ছিল কিন্তু বিমান বিধ্বংসী কামান আমাদের ছিল না। আমরা তাই শেষরক্ষা হিসেবে এমএমজিকে এ কাজে ব্যবহার করতে লাগলাম। যেহেতু ওরা জানতো আমাদের কোন বিমান বিধ্বংসী কামান নেই, তাই নিশ্চিত হয়ে নিচু দিয়ে বিমান চালাচ্ছিল।
সবাই অপেক্ষায় আছি। কখন আমাদের এমএমজির আওতায় বিমানগুলো আসে। আর দেরী হলো না। এমএমজি’র আওতায় এসে গেল বিমানগুলো। মুহূর্তে গর্জে উঠলো এমএমজি। দুটি বিমান উড়ে চলে গেল ওদের সীমানায়। আর একটি ফিরে যেতে পারলো না। শূন্যে ঘুরপাক খেয়ে ছিটকে পড়লো মাটিতে। জোয়ানরা চেঁচিয়ে উঠলো উল্লাসে। সেদিন ছিল নিঃসন্দেহে ১০ম ও ২য় বেঙ্গলের সংগ্রামী দিনগুলোর একটি স্মরণীয় দিন। কোন যুদ্ধের ইতিহাসে হয়তো বা এর আগে এমএমজি দিয়ে কোন বিমানকে ভূপাতিত করা হয়নি- আমরা তাই করতে পেরেছি। গর্বে সবার সবার বুক ভরে উঠলো। এই কৃতিত্বপূর্ণ ঘটনাটা সে এলাকার জনসাধারণের মনে রেখাপাত করেছিল বেশী। তাদের মুখে মুখে ফিরতে এ কথা। আমাদের জন্য ওরাও যেন গর্বিত।
সেদিনই মিত্রবাহিনীর জেনারেল হীরা অয়ারলেসে আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান। সেদিন রাতে আমরা মিত্রবাহিনীর সক্রিয় ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহযোগীতায় শত্রুদের বেলুনিয়া ও পরশুরাম ঘাঁটির ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালাম। ওরা আমাদের হামলার মুখে বেশীক্ষণ টিকতে পারলো না। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ওরা। শত্রুদের শতকরা ৮০ ভাগ সৈন্যই আমাদের আক্রমণে প্রাণ দিল। রাতের মধ্যেই আমরা পরশুরাম ও বেলুনিয়া দখল করতে সক্ষম হলাম।
অভাবনীয় ও অবর্ণনীয় এক দৃশ্য দেখলাম ওদের পরিত্যক্ত ঘাঁটিতে গিয়ে। চারিদিকে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। ধানক্ষেত, বাঙ্কারে, বাঙ্কারের অদূরে খালের পানিতে কোথাও ফাঁক নেই। যারা আহত হয়ে পালাতে চেয়েছিল তারা শরীরের অসমর্থতার জন্য পারেনি। অসহায়ভাবে কাতরাচ্ছিল বাঁচার আশায়। আহত এসব সৈন্যদের চিকিৎসা করা আমাদের কর্তব্য- তাড়াতাড়ি তার ব্যবস্থা করতে বললাম, কিন্তু ওদের মাঝে বেশীরভাগ সৈন্য মারা গেল। মাত্র ৩/৪ জন বাঁচতে পারলো। আমরা সম্পূর্ণ সুস্থ অবস্থায় প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্রসহ ৪৯ জনকে বন্দী করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাদের সাথে এদেরও বন্দী করা হলো।
পরশুরাম ও বেলুনিয়া ঘাঁটির এ মর্মান্তিক পরিণতিতে শত্রুরা ভেঙ্গে পড়লো। চিতলিয়া ঘাঁটির শত্রুরা মনে হলো এতো ভয়ানক নিরাশ হয়ে পড়লো। ওরা পালিয়ে গেল মুন্সীরহাটে।
আমরা আস্তে আস্তে আরো এগিয়ে আসতে লাগলাম এবং ওদের প্রকৃত অবস্থাটা বুঝে আরো কিছু কায়দা বের করতে চাইলাম। এবারে আমরা অবস্থা বুঝে পুরনো কায়দা হিসেবে গোপন অনুপ্রবেশ করার পরিকল্পনা নিলাম। আমরা নীলক্ষেতে ঘাঁটি করে ওদের ফুলগাজী ঘাঁটির উপর চাপ সৃষ্টি করবো- যাতে ওরা দুর্বল হয়ে পালাতে বাধ্য হবে হয়তো। নীলক্ষেতে মজবুত ঘাঁটি করে বসলাম। ওরা আমাদের পরিকল্পনাটা টের পেল মনে হয়। তাই তারা চিতলিয়ায় ঘাঁটি ছেড়ে সবাই ফুলগাজীতে এসে মিললো। আমরা তখন সরাসরি ফুলগাজীর উপর চাপ সৃষ্টি করলাম। এরা অবস্থা বুঝতে পারলো। ব্যাপার সুবিধের নয় ওদের জন্য। ওরা একেবারে সব ঘাঁটি ছেড়ে বান্দুরা রেল স্টেশনের কাছে এসে ঘাঁটি স্থাপন করলো।
আমরা আরো এগিয়ে আসলাম। কালিহাট ও পাঠানণগর থেকে আমরা শত্রুদের মুখোমুখি হয়ে ঘাঁটি স্থাপন করলাম। আমাদের দক্ষিণ দিকে ছিল সোনাগাজী। সেখানে আমরা আগেই গেরিলা বাহিনী পাঠিয়ে সব ঠিক করে রেখেছিলাম। ওরা এখন আমাদের তিনদিক দিয়েই চাপের ভিতর পড়েছে। তখন বাধ্য হয়ে সোনাগাজী দিয়ে পালাতে চাইবে, সেহেতু আমরা সে ওদের জন্য ইচ্ছা করে মুক্ত রেখেছি আর গেরিলা বাহিনী রেখেছি গোপনে, যাতে তারা পালাতে গেলেই ওদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হবে। কিন্তু বাস্তবতা তা হলো না। ওরা আমাদের প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ হয়ে লাকসাম চলে গেল এবং এতেও ওদের অধিক সংখ্যক সেনাই পালাতে সক্ষম হলো।
৬ ডিসেম্বর আমরা ফেনী মুক্ত করলাম। ফেনীর এতদিনকার গুমোট ও ধোঁয়াটে আকাশে স্বাধীনতার পতাকা উড়লো। অগণিত জনতার শ্লোগানে আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠলো। দীর্ঘ ৯টি মাস পরে মুক্ত বাতাসে সবাই দাঁড়িয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললো। ফুলের মালা আর জনতার বরণডালার আতিশয্যে আমরা সেদিন অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম। দু’ চোখ শুধু বারে বারে পানিতে ভরে উঠেছিল। মাথায় বাংলা মায়ের অশ্র“ভেজা আশীর্বাদ নিয়ে বাংলাদেশের সবুজ সূর্য আঁকা পতাকা ছুঁয়ে শহীদ এয়ার আহমেদের মতো লাখো লাখো বীর শহীদদের আমরা অবনতচিত্তে স্মরণ করলাম। কিন্তু আমাদের আরো অনেক কাজ বাকী, অভিভূত হয়ে বসে থাকার কথা নয়।
আর দেরী করলাম না। সবাই আমরা মার্চ করে নোয়াখালীর দিকে রওনা দিলাম। নোয়াখালীর সদর মুক্ত করতে যেয়ে আমরা সেদিন বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিলাম প্রচুর। কিন্তু তা যদি পাক সৈন্যদের দ্বারা হতো তবে বোধহয় সান্ত্বনা পেতাম। তারা ছিল বর্বর আর ঘৃণ্য রাজাকার আর আলবদরের দল। ওরা নানাভাবে আমাদের বাধা দিয়েছে, কিন্তু আমাদের অগ্রগতি তারা রুদ্ধ করতে পারেনি। আমরা তাদের সব বাধা ডিঙ্গিয়ে ওদের সমূলে ধ্বংস করে নোয়াখালীর সদর মুক্ত করলাম।
আমরা ক্ষমা করিনি সেই ঘৃণ্য আলবদর আল রাজাকারদের। তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে দেশের সাথে, নিজের মায়ের সাথে। অস্বীকার করেছে নিজের রক্তকে। তাই ওদের হত্যা করতে কারো এতটুকু বুক কাঁপেনি। কারণ ওরা ক্ষমার যোগ্য নয়। নিজের মায়ের বুকফাটা কান্নায় হৃদয় টলেনি যাদের, নিজের বোনের নির্যাতনের মানবতার সামান্য উদাহরণ দেখাতে পারেনি যারা, নিজের ভাইকে হত্যা করতে হাত কাপেনি এতটুকু ওদের। ওদের ক্ষমা করা যায় না। দেশের সাথে, নিজের অস্তিত্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। তবুও বিবেকের দংশনে জ্বলেপুড়ে মরেনি ওরা। ওরা কি মানুষ? পলাশীর যুদ্ধে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আবার তার পুনরাবৃত্তি ঘটলো।
৯ই ডিসেম্বর আমরা নোয়াখালী মুক্ত করলাম। নোয়াখালীর মুক্ত নীল আকাশে সূর্য আঁকা পতাকায় আমরা বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষদের সালাম জানালাম। সে সময়ক্ষার আনন্দ আর অনুভূতি ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না। সফলতার আনন্দে আর দেশ মুক্তির আনন্দে সবাই শুধু কেঁদেছিল। দলে দলে জনতা মালা হাতে ভিড় জমালো শুধু একনজর আমাদের দেখার আশায়। সেদিন আমরা সবাই শুধু বাঙ্গালী এই পরিচয়ে অভিভূত হয়ে পড়েছিলাম।
আমি শুধু অবাক হয়ে ভাবছিলাম এই আমার দেশবাসী। এরা কত ভালবাসে আমাদের। তাইতো ওদের জন্য আমাদের দেশমুক্ত করার জন্য সংগ্রামে নেমেছি আমরা। এরা আমার বাবা মা-বোন, এদের আনন্দে আমরাও মিশে গেলাম তাই একান্ত হয়ে। সেদিন শুধু আমি এই জেনেছি আমার একটি পরিচয়। আমি বাঙ্গালী, এই বাংলাদেশ আমার, এরা সবাই আমার আপন। একই স্নেহ ভালবাসা একই সংস্কৃতি কৃষ্টি ও সভ্যতার বাঁধনে আমরা বন্দী। কাউকে কেউ অস্বীকার করতে পারি না। ওদের মত আমিও দেশের মাটিকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসি। ভালবাসি দেশের এই দুর্ভাগা মানুষগুলোকে।
৬ই ডিসেম্বর ফেনী মুক্ত হলো, তারপর নোয়াখালীর সদর এলাকা। শত্রমুক্ত করলাম ৯ই ডিসেম্বর, কিন্তু বিশ্রামের অবকাশ হলো না। ইতিমধ্যে আদেশ এলো চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হওয়ার জন্য। চট্টগ্রাম শত্রুমুক্ত করতেই হবে। আমার কাছে যখন এ আদেশ এলো তখন আমি ফেনীতে। চিটাগাং ফেনী থেকে প্রায় ৬৫ মাইল দূরে। তখন চিটাগাং এবং তার পাশ্ববর্তী প্রায় সমস্ত এলাকাই শত্রুদের কবলে ছিল। এসব স্থানে তারা বেশ মজবুত ঘাঁটি করে বসেছিল। সংখ্যায় শক্তিতে তারা বেশ শক্তিশালী হয়েই আছে।
সেদিনই চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা দেবার সমস্ত কাজ শুরু করলাম। দেরী করার সময় ছিল না। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আমরা সেদিন দুপুর নাগাদ রওনা দিলাম চট্টগ্রাম অভিমুখে। পিচঢালা একটানা পথ চলে গেছে সম্মুখ বরাবর। আমাদের এ অভিযানে ১০ বেঙ্গলের জোয়ানেরা ছাড়া মিত্রবাহিনী জোয়ানদের পূর্ণ ও সক্রিয় সহযোগিতা ছিল। যদিও সমস্ত কিছু পরিচালনা ও পরিকল্পনা করার দায়িত্ব আমরাই নিয়েছিলাম। অবশ্য এর কারণ ছিল যে, বাংলাদেশের সমস্ত পথঘাট ও প্রয়োজনীয় অনেক কিছু আমাদেরই জানা।
বেলা বাড়ছে। আমরা সবাই এগিয়ে যাচ্ছি। নিশ্চিন্তে চলার অবকাশ ছিল না। পথে দুশমনের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়ে অভিযান বিলম্ব হচ্ছিল। আমরা এতে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলাম না। সব বাধা প্রতিরোধ ডিঙ্গিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম গন্তব্যস্থল অভিমুখে। থেমে থাকলে চলবে না। অভিযান সফল করতেই হবে।
১৩ই ডিসেম্বর। আমরা তখনো গন্তব্যস্থলের অনেক দূরে। আর ৪ মাইল দূরেই কুমিরা। এখানেও শত্রুরা বেশ শক্তিশালী ঘাঁটি করে আছে। আমরা বেলা প্রায় ১২টায় কুমলার অদূরে এসে পৌঁছলাম। এরপর আর সামনে অগ্রসর হওয়া সম্ভব হলো না। কুমীরায় অবস্থিত শত্রুদের ঘাঁটি থেকে আমাদের উপর প্রবল আক্রমণ শুরু হলো। আমরাও প্রবলভাবে ওদের এ আক্রমণের জবাব দিয়ে চললাম। কিন্তু সামনে অগ্রসর হওয়া সমীচীন মনে করলাম না। তখন মিত্রবাহিনীর বিগ্রেডিয়ার আনানস্বরূপের তরফ থেকে আমার কাছে আর একটি বিকল্প আদেশ এলো। আনানস্বরূপ আমাকে বললো, ‘তুমি ১০ম বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানী ও মিত্রবাহিনীর দলকে রেখে কুমীরা পাহাড় পার হয়ে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়ে যাও।’
আমি সেই অনুযায়ী ১০ম বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানী লে: দিদারের অধীনে রেখে এবং মিত্রবাহিনীর কোন সহযোগিতা ছাড়া আমার ১০ম বেঙ্গল নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারেই কাজ শুরু করতে মনস্থ করলাম।
আমরা যখন ফেনী থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হয়েছিলাম সেই সময়েই চতুর্থ বেঙ্গলের একটি দল ক্যাপ্টেন গফফারের অধীনে পরিচালিত হয়ে চিটাগাং-রাঙ্গামাটি রোড ধরে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়ে গিয়েছিল। আমরা কুমীরা পাহাড় পার হয়ে গোপনে হাটহাজারী আক্রমণের পরিকল্পনা নিলাম। সন্ধ্যার সাথে সাথে আমরা সব ঠিক করে রওনা দিলাম। ডিসেম্বরের শীতের সন্ধ্যা। অন্ধকার হওয়ার সাথে সাথে শীতের মাত্রাও যেন বাড়ছিল। কিন্তু সেসব ভাববার অবকাশ ছিল না। এ রাতের অন্ধকারেই, শীতের সাথে মিতালী পাতিয়ে আমাদের এগয়ে যেতে হবে। পাড়ি দিতে হবে অচেনা অজানা পথ। এ পথে আমরা একেবারেই নতুন। পাহাড়ী বন্দুর পথ। কোথাও ঢালু, কোথাও উঁচু-নীচু। কোথাও বা ছোট ছোট খাল। চারিদিকে গাছগাছালির ভিড়। অন্ধকার যেন তাই আরো নিবিড় লাগছিল। সাথে আমাদের ভারী অস্ত্রশস্ত্র। নিজেদের চলতেই কষ্ট হচ্ছিল। তার উপর এসব ভারী বোঝা নিয়ে চলা বড়ই দুঃসাধ্য ব্যাপার। কিন্তু তবুও অতিক্রম করতেই হবে আমাদের।
আমরা তাই পথ চলছি। অতি কষ্টে নিঃশব্দে ঝিঁ ঝিঁ পোকার একটানা ডাক। মাঝে মাঝে পথ ভুলে যাচ্ছিলাম। আবার পিছিয়ে এসে চলছিল সঠিক পথে। এ পাহাড়ী পথে কোথাও তেমন মানুষজনের সাড়া পেলাম না। শুধু মাঝে মাঝে দু’একটা পাহাড়ী কুটিরে কিছু লোকের দেখা পেলাম। তাদের কাছ থেকে পথ চিনে নিয়ে পথ চলতে লাগলাম। ক্রমশ: রাত বাড়ছে। ঠিক কত জানি না। ক্ষুধায়, পথশ্রমে সবাই ভীষণ ক্লান্ত। কিন্তু অন্ধকারে অচেনা, অজানা স্থানে কোথায নেব বিশ্রাম। তাছাড়া এখন সময় নেই বিশ্রামের।
রাত শেষ হলো। চারিদিকে ভোরের আলো ফুটছে। গাছগাছালির পাতার ফাঁকে ফাঁকে ভোরের সূর্যের আলো পরশ বুলিয়ে যাচ্ছিল। ভোরের পাখীদের কলতানে বনাঞ্চলে মুখরিত হয়ে উঠছিল। দিনের আলোয় সবাই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। পথঘাট চলতে আর চিনতে কিছুটা সুবিধা হবে হয়তো এবার। তাই মিনিট দশেক সবাই একটু বিশ্রাম নিলাম। তারপর…। আবার যাত্রা শুরু হলো। আগের পথ চলার অভিজ্ঞতাগুলো ডিঙ্গিয়ে চললাম। বেলা বাড়ছে। মাথার উপর সূর্যের তাপ ক্রমশ বাড়ছে। আমরা প্রায় পাহাড়ের শেষপ্রান্তে। আর একটু এগুলেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা।
দুপুর ১২টা বেজে ৫ মিনিট। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় পৌঁছে গেলাম। শত্রুরা তখন হাটহাজারী পুলিশ স্টেশনে ছিল। আমরা এখানে পৌঁছেই শত্রুদের প্রকৃত অবস্থা জানতে তৎপর হলাম। ওরা কি পরিমাণে, কোথায় কোথায় কি ধরনের শক্তি নিয়ে আছে, সর্বাগ্রে তা আমাদের জানা দরকার। কিন্তু তৎক্ষণাৎ সেটা জানতে চেষ্টা করা ঠিক হবে না। তাই চুপচাপ নিজেদের অবস্থা সুদৃঢ় করতে লাগলাম। আমরা সেখানে বাজার করে পজিশন নিয়ে বসতে শুরু করলাম। ইতিপূর্বে চতুর্থ বেঙ্গলের যে দল চিটাগাং-রাঙ্গামাটি রোড ধরে হাটহাজারী অভিমুখে রওনা হয়েছিল তারা কোথায়, কদ্দূর অগ্রসর হয়েছে তা জানার জন্য আমি তিনজন লোকের একটা দলকে গোপনে সে রাস্তা ধরে পাঠালাম। বেশীক্ষণ লাগলো না। ওরা খবর নিয়ে এলো। ওরা হাটহাজারীর প্রায় ৩/৪ মাইল দূরে ঘাঁটি ফেলেছে। আমি তখন ওদের সাথে যোগাযোগ করলাম এবং প্রয়োজনীয় তথ্যাবলী পরস্পরের সাথে আদান-প্রদান করলাম। ক্রমে রাত হয়ে আসছিল। আমরা চুপচাপ রাতটা কাটানো মনস্থ করলাম। বুঝতে পারলাম ওরা আমাদের অবস্থা সম্বন্ধে কিছু জানতে পারেনি। চুপচাপ ১৪ ডিসেম্বর রাত কেটে গেল। আমরা সকাল হওয়ার সাথে সাথেই শত্রুদের প্রতিউত্তর আসলো। বোঝা গেল ওরা বেশ মজবুত ভাবেই হাটহাজারীতে ঘাঁটি করেছে। আমরাও তাই দুপুর নাগাদ ওদের উপর আক্রমণ চালালাম। ওরা আমাদের আক্রমণের প্রচণ্ড সহ্য করতে না পেরে আত্মসমর্পণ করতে রাজী হলো। ২৪-এফএফএর ‘বি’ কোম্পানীর মেজর হাদীসহ সবাই আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলো। আমরা তখন হাটহাজারী ছাড়িয়ে গিয়ে নয়াপাড়া ক্যান্টনমেন্টের উপর প্রচণ্ড চাপ দিতে লাগলাম। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন গফফারের অধীনে পরিচালিত চতুর্থ বেঙ্গলের দলটিও আমাদের সাথে এসে মিলিত হলো। ওদিকে মিত্রবাহিনী ও লে: দিদারের অধীনে ১০ বেঙ্গলের যে চার্লি কোম্পানী ছিল তারা ১৫ই ডিসেম্বর কুমীরার উপর প্রচণ্ড হামলা চালায়। কুমীরার শত্রুরা এ আক্রমণের মুখে বেশিক্ষণ টিকতে পারলো না। তারা পালিয়ে তাদের পরবর্তী ঘাঁটি ফৌজদারহাটে গিয়ে মিলিত হলো। আমাদের চার্লি কোম্পানী ও মিত্রবাহিনী আরো এগিয়ে গেল। আমাদের মত তারাও ফৌজদারহাটের শত্রুদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে লাগলো। বার বার তাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য ঘোষণা করতে লাগলাম। কিন্তু তবুও আত্মসমর্পণ করতে রাজী হলো না। কিন্তু আমরা জানতাম আত্মসমর্পণ ওদের করতেই হবে। এছাড়া ওদের কোন পথই নেই।
১৬ই ডিসেম্বর সকাল। নিয়াজীকে নির্দিষ্ট সময় দেয়া হলো আত্মসমর্পণের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের বেশ কিছু পরে নিয়াজী আত্মসমর্পণ করলো। বাংলাদেশের প্রত্যেক রণাঙ্গনেই মিত্র ও আমাদের মুক্তিবাহিনীর অধিনায়কদের হাতে পাকসেনারা আত্মসমর্পণ করলো।