You dont have javascript enabled! Please enable it! ২ নম্বর সেক্টর ও ‘কে’ ফোর্সের যুদ্ধের বিবরণ | সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ ১৯৭৪-১৯৭৫ - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
২ নম্বর সেক্টর ও ‘কে’ ফোর্সের যুদ্ধের বিবরণ সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ* ১৯৭৪-১৯৭৫ ………১৯৭১

 

সাক্ষাৎকারঃ ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ

সামগ্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য আমি আমার যুদ্ধের এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টর-এ বিভক্ত করে নেই। আ

মার সাব-সেক্টরগুলি নিম্নলিখিত জায়গায় তাদের অবস্থান গড়ে তুলি।

(ক) গঙ্গাসাগর, আখাউড়া এবং কসবা সাব-সেক্টরঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন। তার সঙ্গেছিল লেঃ ফারুক, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং সেকেন্ড লেঃ হুমায়ূন কবির। এখানে ৪র্থ বেঙ্গলের ডেল্টা কোম্পানী এবং ই, পি, আর-এর দুটি কোম্পানী ছিল। এদের সঙ্গে মর্টারের একটা দল ছিল। এই সাব সেক্টর কসবা, আখাউড়া, সাইদাবাদ, মুরাদনগর, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাত।

(খ) দ্বিতীয় সাব-সেক্টর ছিল মন্দভাগেঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন গাফফার (বর্তমানে মেজর)। তার অধীনে চার্লি কোম্পানী এবং একটা মর্টারের দল ছিল। এ দলটি মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন হতে কুটি পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাতো।

(গ) তৃতীয় সাব-সেক্টরে ছিল শালদা নদীঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী (মরহুম)। এর অধীনে এ কোম্পানী এবং ই,পি,আর-এর একটা কোম্পানী ছিল। এ দলটি শালদা নদী, নয়নপুর এবং বুড়িচং এলাকা পর্যন্ত তাদের অপারেশন চালাত।

(ঘ) চতুর্থ সাব-সেক্টর ছিল মতিনগরেঃ কমান্ডে ছিল লেঃ দিদারুল আলম। হেডকোয়ার্টার কোম্পানীর কিছুসংখ্যক সৈন্য এবং ই,পি,আর-এর একটা কোম্পানী গোমতীর উত্তর বাঁধ থেকে কোম্পানীগঞ্জ পর্যন্ত এই সাব-সেক্টরে অভিযান চালাতো।

(ঙ) গোমতীর দক্ষিণে ছিল নির্ভয়পুর সাব-সেক্টরঃ এর উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন আকবর এবং লেঃ মাহবুব। এ দলটির অপারেশন কুমিল্লা থেকে চাঁদপুর এবং লাকসাম পর্যন্ত ছিল।

(চ) রাজনগর সাব-সেক্টর ছিল সর্বদক্ষিণেঃ এ সাব-সেক্টরের উপ-অধিনায়ক ছিলেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ এবং লেঃ ইমামুজ্জামান। এই সাব-সেক্টর বেলুনিয়া, লাকসামের দক্ষিণ এলাকা এবং নোয়াখালীতে অপারেশন চালাতো। এই সাব-সেক্টরে ৪র্থ বেঙ্গল এর ‘বি’ কোম্পানী, ই, পি, আর-এর ১টি কোম্পানী ও গণবাহিনীর লোক নিয়ে তৈরি এক সদ্যগঠিত কোম্পানী। জুলাই মাসে পাকিস্তানী সেনারা কসবা এবং মন্দভাগের পুনঃদখলের প্রস্তুতি নেয় এবং কুটিতে ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের বাহিনী এবং গোলন্দাজ বাহিনী সমাবেশ করে। ক্যাপ্টেন গাফফারের অধীনে মন্দভাগ সাব-সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের মোকাবেলার জন্য তৈরি ছিল। জুলাই মাসের ১৯ তারিখে শত্রুসেনারা একটা কোম্পানী নিয়ে শালদা নদীতে নৌকাযোগে অগ্রসর হয়। সুবেদার ওহাবের নেতৃত্বে মন্দভাগ সাব-সেক্টরের একটা প্লাটুন মন্দভাগ বাজারের নিকট শত্রুদের এই অগ্রবর্তী দলটির উপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। এ সংঘর্ষে শত্রুসেনারা সম্পূর্ণ হতবুদ্ধি হয়ে যায়। শালদা নদীর তীর থেকে সুবেদার ওহাবের প্লাটুন্টি শত্রুসেনার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে অন্ততঃপক্ষে ৬০/৭০ জন লোক হতাহত হয় এবং অনেকেই নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ হারায়। এই আক্রমণে ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যরা ৩১তম বেলুচ রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্নেল কাইয়ূম, ৫৩ তম গোলন্দাজ বাহিনীর কুখ্যাত অফিসার ক্যাপ্টেন বোখারী, আরো তিন-চারজন অফিসার এবং ৮/১০ জন জুনিয়র অফিসার প্রাণ হারায়। ক্যাপ্টেন বোখারী ২৫ মার্চের পর থেকে কুমিল্লা শহরে অনেক হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী ছিল। তার মৃত্যুতে কুমিল্লাবাসীরা অত্যন্ত আনন্দিত হয়। শত্রুসেনারা শালদা নদীতে এই বিরাট পর্যুদস্তের পর তাদের বাহিনীকে পিছু হটিয়ে কুটিতে নিয়ে যায়। এবং আমি আমার ঘাঁটি মন্দভাগ ও শালদা নদীতে আরো শক্ত করে তুলি।

পাকিস্তানের ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে লাইন সম্পর্কে জেনারেল টিক্কা খাঁ দম্ভ করে ঘোষণা করেছিল যে ওটা জুলাই মাসের মধ্যে খুলবে। তাঁর সেই আশা চিরতরে ধূলিসাৎ হয়ে যায়। পাকিস্তান আমলে এই রেললাইনে ট্রেন চলেনি। ইতিমধ্যে জুলাই মাসে আমি খবর পাই যে, পাকবাহিনী বেলুনিয়াতে ঢোকার চেষ্টা করছে। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম কে নির্দেশ দেই যেন তাদেরকে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম ছাগলনাইয়াতে পাকবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল। পাকবাহিনী ছাগলনাইয়ার উপরে ফেনীর দিক থেকে চট্টগ্রাম সড়কের উপর আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে তাদের ২০/২৫ জন লোক হতাহত হয়। শত্রুসেনারা পিছু হটে যায়। কিন্তু তাঁর কয়েকদিন পরে পাকসেনারা ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ থেকে ফেনী-চট্টগ্রাম পুরনো রাস্তায় অগ্রসর হয়। এবং ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের সৈনিকদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের কিছুসংখ্যক হতাহত হওয়ায় এবং শত্রুদের গোলার মুখে টিকতে না পেরে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমার কাছে পরবর্তী কর্মপন্থার নির্দেশ চেয়ে পাঠান। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বলি ছাগলনাইয়া থেকে তাঁর সৈন্যদের সরিয়ে বেলুনিয়ার সাব-সেক্টর রাজনগরে আনার জন্য। আমাদের এই মুভে বেলুনিয়াতে অবস্থিত শত্রুসেনারা ঘিরে যাওয়ার আতঙ্কে বেলুনিয়া থেকে ফেনীতে পশ্চাদপসরণ করে এবং ফেনীতে তাদের প্রধান ঘাঁটি গড়ে তোলে। বেলুনিয়া শত্রুমুক্ত হওয়ায় আমি আমি বেলুনিয়াকে শত্রুকবল থেকে মুক্ত রাখার দৃঢ়মনস্থ করি। ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বান্দুয়াতে (ফেনী থেকে ২ মাইল উত্তরে) এবং ইমামুজ্জামানকে তাদের নিজ নিজ কোম্পানী নিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরি করার নির্দেশ দেই। বান্দুয়াতে সম্মুখবর্তী অবস্থান গড়ার পথ মুন্সিরহাটে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের অধীনে আমার সেনাদল বেশ মজবুত প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। বেলুনিয়া একটি ১৭ মাইল লম্বা এবং ১৬ মাইল চওড়া বাঙ্কার। এই বেলুনিয়াতে আমরা যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তুলি সে প্রতিরক্ষাব্যূহকে ধ্বংস করার জন্য পাকসেনারা এর পর থেকে যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যায়। পরবর্তীকালে অনেক যুদ্ধে তাদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি এবং সৈন্য হতাহত হয়। বেলুনিয়া সেক্টর পাকসেনাদের জন্য ভয়ংকর বিভীষিকা রূপ ধারন করে। এর সঙ্গে সঙ্গে এই স্থানের জনসাধারণও যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি ও কষ্ট স্বীকার করে। এখানকার জনসাধারণের কষ্টকে ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। পাকবাহিনীর গোলার আঘাতে প্রতিটি বাড়ি প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় ও অনেক নিরীহ লোক মারা যায়। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণ কোনদিনও তাদের মনোবল হারায়নি। যুদ্ধ যতদিন চলে ততদিনই তারা মুক্তি বাহিনীর অসামরিক ব্যবস্থাপনায় হাসিমুখে সাহায্য করে। অনেকক্ষেত্রে তারা সেনাবাহিনীর সাথে সাথে রক্ষাবুহ্য শক্তিশালী করার জন্য পরিখা খননে ও অন্যান্য কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাহায্য করে। মে মাসে আমাদের মুন্সিরহাট ডিফেন্স এবং বান্দুয়ার অবস্থানটি বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠে। এ জায়গাটি আমরা এজন্যে প্রতিরক্ষা ঘাঁটির জন্য মনোনিত করেছিলাম। জায়গাটার সামনে কতগুলো প্রাকৃতিক বাধাবিঘ্ন ছিল যেগুলি শত্রুসেনার অগ্রসরের পথে বিরাট বাধাস্বরূপ। এতে শত্রুসেনাদের নাজেহাল করার যথেষ্ট সুযোগ ছিল। আমাদের অবস্থানটি মুহুরী নদীর পাশ ঘেঁষে পশ্চিম দিক থেকে ছিলোনিয়া নদীকে ছাড়িয়ে পশ্চিম সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ব্যূহটি কমপক্ষে ৪ মাইল চওড়া ছিল। আমরা এই অবস্থানটি এইভাবে পরিকল্পনা করেছিলাম যে, শত্রুসেনাদের বাধ্য হয়ে আমাদের ঘাঁটি আক্রমণ করার সময় প্রতিরক্ষার শুধু সামনে ছাড়া আর কোন উপায়ে আসার রাস্তা ছিলনা। এ পরিকল্পনা অনুযায়ী শত্রুসেনাদের আসার মনোনীত জায়গাগুলোতে এলে সবচেয়ে বেশি ধ্বংস করা যায়। পরবর্তীকালে আমাদের এ পরিকল্পনা ঠিকই কাজে লেগেছিল। যেসব জায়গা দিয়েই শত্রুরা আসার চেষ্টা করেছে যথেষ্ট হতাহত হয়েছে। এই সেক্টরে প্রথমে আমাদের সৈন্যসঙ্খ্যা ছিল দূ’কোম্পানী(৩০০ জনের মত) এবং কিছুসংখ্যক গণবাহিনী। শত্রুওসংখ্যা আমাদের চেয়ে সব সময় বেশীছিল এবং এছাড়া শত্রুদের ছিল শক্তিশালী অস্ত্র, গোলাবারুদ, বিমান বাহিনী ও ট্যাংক। আমাদের মুন্সিরহাটে প্রধান ঘাঁটি সম্বন্ধে শত্রুদের ধোঁকা দেওয়ার জন্য বন্দুয়া রেলওয়ে স্টেশনের কাছে ছিলোনিয়া নদীর উপর একটি অগ্রুবর্তী ঘাঁটি স্থাপনের নির্দেশ দেই। এটা ছিল ডিলেয়িং পজিশন। এ পজিশনের সামনে রাস্তা ও রেলের সেতুগুলি ধ্বংস করে দেয়া হয় যাতে শত্রুদের অগ্রসরে আরো বাধার সৃষ্টি হয়। শত্রুসেনার সম্ভবত অগ্রসরের রাস্তার পশ্চিম এবং পূর্ব পার্শ্বে রাস্তার দিকে মুখ করে আমরা বেশ কতগুল উঁচু জায়গায় এবং পুকুরের উঁচু বাঁধে শক্ত এবং মজবুত বাঙ্কার তোইরি করি এবং তাতে হালকা মেশিনগান এবং মেশিনগান লাগিয়ে দেই। এ ছিল একরকমের ফাঁদ যাতে একবার অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হলে দু’পাশের গুলিতে শত্রুসেনারা ফিরে যেতে না পারে। এসব বাঙ্কার এমনভাবে লুকানো ছিল যে সম্মুখ থেকে বোঝার কোন উপায় ছিল না।

৭ই জুনের সকাল। আমরা জানতে পারলাম শত্রুসেনারা ফেনী থেকে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ১০টার দিকে বন্দুয়ার আশে পাশে শত্রুসেনারা এসে জমা হতে লাগলো এবং প্রথম্বারের মত আমাদের পজিশনের উপর গোলাগুলি চালাতে লাগলো। আমার নির্দেশ ছিল যে শত্রুদের এই গোলাগুলির কোন জবাব যেন না দেয়া হয়। শত্রুসেনারা বন্দুয়া সেতুর উপর একটা বাঁশের পুল নির্মাণ করে যেমনি পার হওয়ার চেষ্টা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের অগ্রবর্তী ডিলেয়িং পজিশনের বীর সৈনিকরা তাদের উপর গুলি চালায়। এতে প্রথম সারিতে যে সব শত্রুসেনা সেতু অতিক্রম করার চেষ্টা করে তারা সবাই গুলি খেয়ে পানিতে পড়ে যায়। এ পর্যায়ে শত্রুসেনাদের অন্তত ৪০/৫০ জন লোক হতাহত হয়। এরপর শত্রুসেনারা পিছে হতে যায়। কিছুক্ষণ পর আবার প্রবল গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র আক্রমণ চালায়। আমাদের ডিলেয়িং পজিশনের সৈনিকরা শত্রুদের আরো বহুসংখ্যক লোক হতাহত করে বীরত্বের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করতে থাকে কিন্তু আক্রমণ যখন আরও তীব্ররূপ ধারণ করে ডিলেয়িং পজিশন কে তারা পরিত্যাগ করে প্রধান ঘাঁটি মুন্সিরহাটে পিছু হটে আসে। শত্রুরা কিছুটা সফলতা লাভ করায় আরো প্রবল বেগে সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকে এবং ছিলোনিয়া নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। এখানে এসে তারা নদী পার হওয়ার সকল প্রস্তুতি নেয়। আমাদের প্রধান ঘাঁটি থেকে ৮০০ গজ সামনে আনন্দপুর নামক গ্রামে শত্রুসেনারা তাদের সমাবেশ ঘটাতে থাকে। নদী পার হয়ে আমাদের আক্রমণ করার জন্য শত্রুরা সকল প্রস্তুতি নিতে থাকে। নদী পার হবার পূর্ব মুহূর্তে কামানের সাহায্যে আমাদের ঘাঁটির উপর তারা প্রবল আক্রমণ আরম্ভ করে। তারা বৃষ্টির মতো গোলা আমাদের অবস্থানের উপর ছুড়ছিল। এ আকস্মিক আক্রমণ চালানোর উদ্দেশ্য আমরা ভালভাবেই বুঝতে পারছিলাম। এই সুযোগে পাকসেনারা নদী পার হবার জন্য নৌকা এবং বাঁশের পুলের সাহায্যে এগিয়ে আসতে থাকে। যদিও আমরা শত্রুদের কামানের গোলায় যথেষ্ট বিপর্যস্ত ছিলাম তবুও মানসিক দিক দিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনোবল ছিল বিপুল। ওদের বেশ সংখ্যক সৈন্য নদী পার হয়ে আমাদের অবস্থানের ২০০/৩০০ গজ ভিতরে চলে আসে এবং কিছুসগখ্যক তখনও নদী পার হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে আমাদের মর্টার এবং মেশিনগান গর্জে উঠে। আমাদের এ অকস্মাত পাল্টা উত্তরে শত্রুসেনারা অনেক হতাহত হতে থাকে। তবুও তারা বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে প্রবল বেগে অগ্রসর হতে থাকে। আর আমাদের সৈনিকরাও তাদের ব্যাপক ক্ষয় ক্ষতি করতে থাকে। তবুও টাটা নিঃসহায় অবস্থাতে ও দক্ষতার সাথে অগ্রসর হতে থাকে। কিন্তু আল্লাহ হয়তো অদের সহায় ছিলেন না। এ স্ময়ে তারা আমাদের সামনের মাইন ফিল্ডের মুখে এসে পড়ল। তাদের পায়ের চাপে একটার পর একটা মাইন ফাটতে আরম্ভ করলো। আমাদের চোখের সামনে অনেক শত্রুসেনা তুলোর মত উড়ে যেতে লাগলো। আমাদের গোপনে অবস্থিত পাশের মেশিনগাঙ্গুলির বৃষ্টির মতো গুলি ও মাইনের আঘাত তাদের মধ্যে একটা ভয়াভহ বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। শধু কয়েকজন শত্রু এসব বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে আমাদের কয়েকটি অগ্রবর্তী বাঙ্কারের সামনে পর্যন্ত পৌছায়, কিন্তু আমাদের সৈনিকরা গ্রেনেড হাঁতে তাদের জন্য প্রস্তুত ছিল এবগ তারা সেখানেই আমাদের গ্রেনেডের মুখে ধ্বংস হয়। এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়ে শত্রুসেনারা আর সামনে এগোতে সাহস পায়নি। যারা পিছনে ছিল তারাও এই সংকট জনক অবস্থা এবং ভয়াবহতা বুঝতে পেরে পিছন দিকে পলায়ন করতে শুরু করে। শত্রুসেনাদের পালাতে দেখে আমাদের সৈনিকরাও উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠে এবং আরো প্রবল গতিতে তাদের গুলি করে মারতে থাকে। আমাদের মর্টারও পসগচাদপসরণরত শত্রুদের উপর অনবরত আক্রমণ চালিয়ে তাদের হতাহত করতে থাকে। আমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে ওদের খুব কম সৈন্য ছিলোনিয়া নদীর অপর পারে পিছু হটে যেতে সক্ষম হয়। এ সময় আমাদের উপর শত্রুসেনারা অনবরত কামানের গোলা চালিয়ে যাচ্ছিল যাতে তাদের বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত যে সমস্ত অবশিষ্ট সৈনিক ছিল তারা নিরাপদে আরো পশ্চাৎঘাঁটি আনন্দপুর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এর কিছু পরে দুটোর সময় তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে নীরবতা নেমে আসে। আমরা কিছুক্ষণ আবার তাদের পুনঃআক্রমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি কিন্তু পরে জানতে পাই যে তাদের অবস্থা সত্যি বিপর্যস্ত এবং তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। পুনঃআক্রমণের শক্তি আর তাদের নেই। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অন্ততঃপক্ষে ৩০০ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং ছিলোনিয়া নদীতে কত ভেসে গেছে সেটারও হিসাব আমরা পাই না। পরে জানতে পারি যে পাকিস্তানীরা একটা ব্যাটালিয়নের চেয়েও বেশি সৈন্যদল নিয়ে এ আক্রমণ চালিয়েছিল এবং ব্যাটালিয়নের ৬০ ভাগের মত লোক নিহত বা আহত হয়েছে। এদের অনেকের কবর এখনও ফেনীতে আছে।

এর পর থেকে শত্রুসেনারা আনন্দপুরে স্থায়ী ঘাঁটি করার জন্য বাঙ্কার খোঁড়ার কাজ শুরু করে দিল। আস্তে আস্তে ওদের সৈন্যসংখ্যাও অনেক বেড়ে যেতে লাগল। আমরা খবর পেলাম ওরা প্রচুর অস্ত্র এবং নতুন সৈন্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকা থেকে এনে সমাবেশ করছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর কামান ও ট্যাঙ্ক তারা নিয়ে এসেছে। ৭ই জুনের বেলুনিয়া যুদ্ধের পর তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং হতাহতের সংখ্যা দেখে পাকিস্তানীরা বুঝতে পেরেছিল যে আমি এই জায়গাতে তাদের সঙ্গে আবার সম্মুখ সমরে যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সে জন্য আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে আমি ফাঁদে ফেলার জন্য তৈরি ছিলাম। পাকসেনারা আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হয়ে সে ফাঁদে পা দিয়ে যথেষ্ঠ ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। সেই কারণে ভবিষ্যতে যাই করুক খুব সতর্কতার সাথে কাজ করার প্রস্ততি নিতে থাকে। বেলুনিয়ার বিপর্যয় পাকিস্তানী সেনাদের সবাইকে বিচলিত করে তোলে। তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোন উপায়ে বেলুনিয়াকে পুর্নদখল করতেই হবে। তাই তাদের সৈন্য সমাবেশ চলতে থাকে। জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, চীফ অফ স্টাফ স্বয়ং জুলাই মাসে ফেনীতে আসেন বেলুনিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং পরিচালনার জন্য। আমি আমার প্রতিরক্ষার অবস্থান আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করি। মন্দভাগ থেকে ক্যাপ্টেন গাফফারকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর ‘সি’ কোম্পানী নিয়ে এবং আরো কিছু মর্টার নিয়ে বেলুনিয়া সেক্টরে গিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ আরো শক্তিশালী করে তোলার নির্দেশ দেই। যেহেতু আমার কাছে আর কোন সৈন্য ছিল না, তাই আমি এ তিনটি কোম্পানী দিয়ে জাফর ইমামকে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তৈরী থাকার নির্দেশ দেই। শত্রুরা আমাদের প্রতিরক্ষা থেকে মাত্র ৮০০ গজ দূরে গতিয়ানালার অপর পারে তাদের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। উভয়পক্ষে অনবরত গোলাগুলি বিনিময় হত, আর তাছাড়া শত্রুদের গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের ঘাঁটির উপর অবিরাম শেলিং চালিয়ে যেত। আমাদের সৈনিকদের বাঙ্কার ছেড়ে বাইরে চলাফেরার উপায় ছিল না। কিন্তু শত্রুর এই গোলাগুলির এবং আর্টিলারী ফায়ারিং-এর মধ্যেও আমাদের বীর বঙ্গশার্দুলরা তাদের মনোবল হারায়নি এবং এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা এ গোলাগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রে বাজনার মত মনে করত। মাঝে মাঝে আমাদের সৈনিকরা পরিত্যক্ত গ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে শত্রুদের অনেক হতাহতও এবং অনেক সময় ১০৬ মিলিমিটার ট্যাঙ্কবিধ্বংসী-কামানের সাহায্যে তাদের বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়ে আসত। এসব আকস্মিক আক্রমণাত্নক কার্যে শত্রুরা যথেষ্ট ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত এবং তাদের যথেষ্ট হতাহত হত। তারপরই তারা শুরু করত গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে অবিরাম বৃষ্টির মত গোলাগুলি। এভাবে জুলাই মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত চলল। পাকিস্তানীদের যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখে ঐ এলাকার জনমনে যথেষ্ট ত্রাসের সৃষ্টি হয়। প্রথমবারের আক্রমণে যদিও জনসাধারনের বেশী ক্ষতি হয়নি, সেহেতু সেবার শত্রুসেনারা ছিল আমাদের হাতে পর্যুদস্ত। যুদ্ধের বিভীষিকা তারা প্রত্যক্ষভাবে সেবার দেখেছিল, কিন্তু এবারের পাকবাহিনীর প্রস্তুতির খবরে সত্যি তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এ সময় ছিল ভরা বর্ষা। সব জায়গাতে ছিল পানি। পানি ভেঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়ে শত্রুদের অকস্মাৎ আক্রমণের মুখে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়া অসম্ভব হতে পারে। এ জন্য আমরা স্থানীয় লোকদের নির্দেশ দেই যাতে তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগেই দূরে সরে যায় বা সরে যেতে পারে। কেউবা সেচ্ছায় আর কেউবা নিরুপায় হয়ে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে স্ব স্ব স্থানে রয়ে যায়। আমাদের সৈনিকরা প্রতিরক্ষাব্যূহের উন্নতি চালিয়ে যেতে থাকে। যে সব জায়গাতে শত্রুদের আমাদের অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল আমরা সেসব জায়গাতে মাইন লাগাতে থাকি। ১৭ জুলাই রাত ৮টায় আমাদের উপর শত্রুরা অকস্মাৎ আক্রমণ শুরু করে দেয়। প্রায় আধাঘন্টা পর তিনটা হেলিকপ্টার আমাদের অবস্থানের পাশ দিয়ে পিছনের দিক চলে যায়। চারিদিকে অন্ধকার ছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। হেলিকপ্টারগুলো অবস্থানের পিছনে অবতরণ করার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের সৈনিকরা বুঝতে পেরেছিল যে শত্রুসেনারা প্রতিরক্ষা ব্যূহের পিছনে ছত্রীবাহিনী নামিয়েছে। আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো থেকেও খবর আসতে লাগল যে শত্রুরা মুহুরি ও ছিলোনিয়া নদীর পাড় দিয়ে এগিয়ে আসছে। ওদের সঙ্গে ট্যাঙ্কও আছে। অবস্থানের সামনে বিপুল সৈন্য নিয়ে শত্রুর আক্রমণের প্রতিরক্ষা আর পিছনে তাদের ছত্রীবাহিনী আমাদের সৈনিকদের পিছন থেকে ঘিরে ফেলার জন্যও প্রস্তুত। এরকম একটা সংকটময় অবস্থাতেও ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম এবং ক্যাপ্টেন গাফফার এবং লেঃ ইমামুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন শহীদের নেতৃত্বে সামান্য শক্তি নিয়েও যুদ্ধের জন্য আমাদের সৈনিকদের মনোবল ছিল অটুট। আমার সব অফিসার ঐ চরম মূহুর্তে তাদের সাহস এবং দৃঢ়প্রত্যয়ের পরিচয় দিয়েছিল। রাত তখন সাড়ে ৯টা। বৃষ্টি বেশ একটু জোরালো হয়ে উঠেছে। শত্রুরা তাদের অগ্রসর অব্যাহত রেখেছে। এ সময়ে ক্যাপ্টেন গাফফারের অবস্থানের পিছন থেকে শত্রুরা হামলা চালায়। ক্যাপ্টেন গাফফার এবং তার সৈনিকরা বীরত্বের সাথে শত্রুসেনাদের হামলা মোকাবেলা করে। প্রায় ১ ঘন্টা যুদ্ধের পর শত্রুসেনারা বেশ কিছু হতাহত সৈনিক ফেলে ক্যাপ্টেন গাফফারের অবস্থান থেকে বিতাড়িত হয়ে যায়। এ সময় ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের কোম্পানীর সামনেও শত্রুরা আক্রমণ চালায়। শত্রুদের ট্যাঙ্কগুলিও আস্তে আস্তে যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে এগিয়ে আসছিল। শত্রুদের কামানের গুলি সমস্ত অবস্থানের উপর এসে পড়ছিল। লেঃ ইমামুজ্জামান,যাঁর কোম্পানী সবচেয়ে বামে ছিল, সেখানেও শত্রুরা আস্তে আস্তে চাপ দিতে থাকে। ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম আমাকে এ পরিস্থিতির কথা জানায়। আমি বুঝতে পারলাম যে শত্রুসেনারা ডানে, বামে হেলিকপ্টারের সাহায্যে আমার প্রতিরক্ষাব্যূহের পিছনে পজিশন নিয়েছে এবং আস্তে আস্তে আমার সমস্ত ট্রুপসদের ঘিরে ফেলার মতলব এঁটেছে। শত্রুর চাপ আস্তে আস্তে বেড়েই চলছিল। উভয়পক্ষেরই হতাহত ক্রমেই বেড়ে চললো। তাদের অনেকেই আমাদের মাইন ফিল্ডের ভিতরে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছিল, কিন্তু তবুও তারা অগ্রসর হচ্ছিল। ইতিমধ্যে আমার ৫ জন লোক নিহত ও ৩৫ জন লোক আহত হয়। এই অন্ধকারে সমস্ত অবস্থান জুড়ে চলছিল সম্মুখসমরে হাতাহাতি যুদ্ধ। যদিও শত্রুদের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা আমাদের চেয়ে অনেক বেশী হচ্ছিল, তবুও আমার পক্ষে ৩০/৪০ জন- হতাহতের পরিমাণ খুবই মারাত্নক ছিল। তাছাড়া আমার সৈন্যসংখ্যা ছিল অনেক কম আর অস্ত্রশস্ত্রেও ছিলাম আমি তাদের চেয়ে অনেক দূর্বল। আমি বুঝতে পারলাম সকাল পর্যন্ত তারা যদি আমাকে এভাবে ঘিরে রাখতে পারে, তাহলে তাদের বিপুল শক্তিতে দিনের আলোতে এবং ট্যাংক ও কামানের গোলায় আমার সৈন্যদের সম্পূর্নরূপে ধ্বংস করে দেবে।

রাতের অন্ধকারে তাদের ট্যাঙ্ক এবং কামানের গোলা আমাদের উপর কার্যকরী হয়নি। কিন্তু দিনের আলোতে এসব অস্ত্র আমার অবস্থানের জন্য মারাত্নক হয়ে দাঁড়াবে। আমি ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে বর্তমান অবস্থান থেকে ডাইনে বা বামে সরে গিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে পিছনে এসে চিতুলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষাব্যূহ তৈরী করার নির্দেশ দেই। এ নির্দেশ অনুযায়ী রাত ১টায় ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ এবং ক্যাপ্টেন গাফফার তাদের স্ব স্ব দল নিয়ে শত্রুদের এড়িয়ে চিতুলিয়াতে নতুন প্রতিরক্ষা অবস্থানে পৌঁছে। পৌছার সঙ্গে সঙ্গে নতুন অবস্থানের জন্য তৈরী শুরু হয়ে যায়। তখন সকাল ৯টা কি ১০টা। আমি নিজেই যথেষ্ট উদ্বিগ্ন ছিলাম লেঃ ইমামুজ্জামান এবং তার দলটি না পৌঁছানোর জন্য। যখন প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরী চলছিল আমি তিন-চারজন সিপাই সঙ্গে নিয়ে আগে অগ্রসর হয়ে যাই- শত্রুদের সম্বন্ধে জানবার জন্য। চেতুলিয়া থেকে বেশ কিছু দূর আগে মুন্সিরহাটের নিকট যেয়ে দেখতে পাই যে শত্রুরা সকাল পর্যন্ত মুন্সিরহাটে রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত দখল করে নিয়েছে এবং এর আগে আর অগ্রসর হওয়ার সাহস করেনি। তারা ভাবছিল যে আমাদের পিছনের পজিশনগুলো হয়ত এখনও আছে। আমরা যে রাত্রে এসব ঘাঁটি ত্যাগ করে চেতুলিয়াতে নতুন ব্যূহ রচনা করেছি এ সম্বন্ধে তারা সকাল ১০টা পর্যন্ত জানতে পারেনি এবং তারা খুব সতর্কতার সাথে অগ্রসর হচ্ছিল। আমি প্রায় ১টা পর্যন্ত আমার রেকি বা অনুসন্ধান শেষ করে চেতুলিয়াতে ফেরত আসি, ঠিক এই মুহূর্তে শত্রুদের আরো তিন চারখানা হেলিকপ্টার আসে এবং আমাদের অবস্থানের ৭০০/৮০০ গজ ডানে রেলওয়ে লাইনের উঁচু বাঁধের পিছনে অবতরণ করে। এছাড়া আরো দুটি হেলিকপ্টার আসে যেগুলি আমাদের বামে আধা মাইল দূরে একটা পুকুরের বাঁধের পিছনে অবতরন করে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেদিক থেকে ভয়ংকর গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই। আমি বুঝতে পারলাম শত্রুরা আমার ট্রুপসদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে এবং আমাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান তখনও কিছুই তৈরী হয়নি। এ সময় ছিল আমার পক্ষে চরম মুহূর্ত। বাম থেকে গোলাগুলির আওয়াজ আরো প্রচন্ড হচ্ছিল। আমি তৎক্ষনাৎ সিদ্ধান্ত নেই এবং ক্যাপ্টেন জাফর, ক্যাপ্টেন গাফফারকে নির্দেশ দেই এখনই এই মুহূর্তে তাদের নিজ নিজ কোম্পানী নিয়ে বর্তমান অবস্থান পরিত্যাগ করার জন্য। আমি এবং আমার সমস্ত সৈন্যকে অবস্থানটি পরিত্যাগ করার আধা ঘন্টার মধ্যে শত্রুরা সেদিন আক্রমণ চালায়।

এবারও শত্রুসেনারা আমাকে এবং আমার সেনাদলকে সামান্য মুহূর্তের জন্য ধরার সুবর্ণ সুযোগ আবার হারিয়ে ফেলে। হয়তবা এ ছিল পরম করুণাময় আল্লাহর আশীর্বাদ। আমি পরে জানতে পারি আমার অবস্থানের বাম থেকে যে গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম তা ছিল লেঃ ইমামুজ্জামানের সৈনিকদের সঙ্গে পাকসেনাদের সংঘর্ষ। পাকসেনারা হেলিকপ্টারযোগে বামে অবতরণ করেছিল সে সময় লেঃ ইমামুজ্জামানের সৈন্যদলের সামনে পড়ে যায়। এতে তাদের যথেষ্ঠ ক্ষয়ক্ষতি হয়। লেঃ ইমামুজ্জামান শত্রুদের প্রচন্ড আঘাত হেনে পরে বাম দিক দিয়ে পিছনে হটে আসে এবং আমার সঙ্গে মিলিত হয়। যদিও আমাকে অবস্থান পরিত্যাগ করতে হয়েছিল এবং পাকবাহিনী বেলুনিয়া পুনঃদখল করে নেয় তবুও শত্রুদের যা হতাহত হয় তা ছিল অপূরনীয়। আমাদের পশ্চাদপসরন একটা রণকৌশল ছিল। সৈন্য, অস্ত্র, গোলাবারুদ সবকিছুই ছিল নগণ্য। সে তুলনায় শত্রুদের শক্তি ছিল বিরাট। আমার তখনকার যুদ্ধের নীতি এবং কৌশলই ছিল শত্রুদেরকে অকস্মাৎ আঘাত হানা বা তাদেরকে প্রলোভন দেখিয়ে আমার মনোনীত জায়গা অগ্রসর হতে দেওয়া এবং তাদেরকে পর্যুদস্ত এবং ধ্বংস করা-শত্রুদের এভাবে ব্যতিব্যস্ত রেখে আস্তে আস্তে নিজের শক্তি আরো গড়ে তোলা এবং সংগঠনকে শক্তিশালী করা। অংকুরেই ধ্বংস হয়ে যাওয়াটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। এ পরিপ্রেক্ষিতে সব সংঘর্ষেই আমি পাক সেনাবাহিনী কে আঘাত হানতাম অতর্কিতে। আবার যখন যথেষ্ঠ ক্ষতিসাধন হত তখন অকস্মাৎভাবেই সংঘর্ষ এড়িয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতাম। এতে শত্রুরা আরো মরিয়া হয়ে উঠত এবং পাগলের মত আমার নতুন অবস্থানে এসে আঘাত হানত। বারবারই এ রণকৌশল পুনরাবৃত্তি হত। যে সময় বেলুনিয়ার সম্মুখসমর চলছিল, ঠিক সে সময় আমি শত্রুর পিছনের এলাকায় আঘাত হানার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। আমার হেডকোয়ার্টারস-এ অন্ততঃপক্ষে চারহাজার গেরিলা সে সময় প্রশিক্ষণরত ছিল। এদেরকে আমি বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে বিশেষ বিশেষ ধরনের গেরিলা যুদ্ধের পদ্ধতিতে শিক্ষা দিচ্ছিলাম। একটি দলকে শিক্ষা দিচ্ছিলাম ডিমোলিসন (বিস্ফোরক) ব্যবহার- যাদের প্রথম উদ্দেশ্য ছিল দেশের অভ্যন্তরে যত রাস্তা ও রেলওয়ে সেতু আছে সেগুলি ধ্বংস করে দেওয়া- যাতে শত্রুরা অনায়াসে যাতায়াত করতে না পারে এবং বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাক সেনাদল তাদের রেশন ঠিকমত পোঁছাতে না পারে। এ ছাড়া এ দলটির আরো কাজ ছিল শিল্পক্ষেত্রে-কিছু মনোনীত শিল্পকে সাময়িকভাবে অকজো করে দেওয়া। বিশেষ করে ঐ সব শিল্প, যাদের তৈরী মাল পাকবাহিনী বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে সক্ষম হবে। এসব শিল্প অকেজো করার সময় আমাকে অনেক সতর্কতার সাথে পরিকল্পণা করতে হয়েছে, যেহেতু সব শিল্পই আমাদের দেশের সম্পদ এবং এগুলি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিলে পরবর্তীকালে স্বাধীনতার পর আমাদের নিজেদেরই আবার সংকটের সম্মুখীন হতে হবে, সে কারণে প্রতিটা টার্গেট সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর পরিকল্পণাগুলিকে যথেষ্ঠ বিবেচনার সাথে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করতে হত এবং তারপরই সিদ্ধান্ত গ্রহন করতাম। শিল্পগুলিকে ধ্বংস না করে এগুলিকে সাময়িক অকেজো করার এক অভিনব পদ্ধতি আমি খুঁজে পাই। আমার সেক্টর-এর বেশীরভাগ শিল্প ঢাকার চারপাশে- ঘোড়াশাল এবং নরসিংদীতে অবস্থিত ছিল। আমি জানতে পেরেছি যে, এসব শিল্পের জন্য বৈদ্যুতিক শক্তি সাধারণত সাজিবাজার পাওয়ার হাউস ও কাপ্তাই থেকে পাওয়ার লাইনের মাধ্যমে আসে। আমি আমার গেরিলাদের প্রথম টার্গেট দেই ওই সব পাওয়ার লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য। প্রতি সপ্তাহে ২০টি টিম বিভিন্ন এলাকায় পাওয়ার লাইন ধ্বংস করতে থাকে। এর ফলে প্রায় ৭৫ শতাংশ বিদ্যুৎ সরবরাহ শিল্প এলাকাগুলোতে বন্ধ হয়ে যায়। পাকবাহিনী নিরুপায় হয়ে প্রত্যক পাইলনের নীচে এন্টি-পার্সোনাল মাইন পুঁতে রাখত যাতে আমার লোকজন পাইলনের কাছে আসতে না পারে। তারা সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার হাউস থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে শুরু করে। আমি যখন এ খবর জানতে পারি, তখন সিদ্ধিরগঞ্জের সরবরাহ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ যাতে না যেতে পারে তার পরিকল্পনা করতে থাকি। আমার হেডকোয়ার্টাস থেকে তিনটি দলকে ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ পদ্ধতি সম্বন্ধে সমস্ত তথ্য আনার জন্য প্রেরন করি। এক সপ্তাহের মধ্যে তারা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে যায় এবং আমাকে সমস্ত খবর পৌঁছায়। তারা আরো জানায়, পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল ট্যাঙ্কসহ সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রে আস্তানা গড়েছে। চতুর্দিকে বাঙ্কার প্রস্তত করে সে জায়গাটি পাহারা দিচ্ছে। সে কেন্দ্রটিকে অকেজো করতে হলে একটা বিরাট যুদ্ধের পর সেটিকে দখল করতে হবে। শত্রুঘাঁটি যেরূপ শক্তিশালী ছিল তাতে সফল হাওয়া সম্ভব হতেও পারে , নাও হতে পারে। আর তাছাড়া আমি প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রটি সম্পূর্ণরূপে উড়িয়ে দেওয়ার পক্ষেপাতী ছিলাম না। আমি এসব ভেবে অন্য পন্থা অবলম্বন করার জন্য চিন্তা করতে থাকি। এই সময়ে ওয়াপদার একজন ইঞ্জিনিয়ার আমার কেন্দ্র আসেন। তাঁর সঙ্গে এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা হয়। আমার যে অনুসন্ধান দলটি খবরাখবর এনেছিল, তারা আসার সময় বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রের একটা নীলনকশা ওয়াপদার প্রধান দপ্তর থেকে চুরি করে এনেছিল। আমি ইঞ্জিনিয়ার জনাব ভূইয়াকে এ নীলনকশা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহের একটা সম্পূর্ণ মডেল আমার হেডকোয়ার্টারে-এ তৈরীর নির্দেশ দেই। ইঞ্জিনিয়ার জনাব ভূঁইয়া আমার নির্দেশ অনুযায়ী ঢাকা, টঙ্গি, ঘোড়াশাল, নারায়নগঞ্জের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের একটা পূর্ণাঙ্গ মডেল তৈরী করেন। সে মডেলের উপর ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সাথে আলোচনাকালে আমি বুঝতে পারি যে, ঢাকাতে মোট ন’টি জায়গাতে (পোস্তাগোলা, ডেমরা, হাটখোলা, জংসন, খিলগাঁও, মতিঝিল, ধানমণ্ডি, শাহবাগ, কমলাপুর, উলন) গ্রীড সাবস্টেশন আছে এবং এই সাবস্টেশনগুলি যদি আমরা ধ্বংস করে দিতে পারি তবে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাবে। এও বুঝতে পারি যে, বিদ্যুৎ সরবরাহ সিদ্ধিরগঞ্জ থেকে মোটামুটি তিনটি লাইনে আসে এবং যদি সবগুলো সাবস্টেশন একসঙ্গে উড়িয়ে না দেয়া যায়, তাহলে বিদ্যুৎ সরবরাহ অন্য পথ দিয়ে চলবে। ঢাকার এবং শিল্প এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ অকেজো করে দেওয়ার জন্য আমি জুলাই মাস থেকে ১৬টি টিম ট্রেইন করতে থাকি। এসব টিমে ৮ থেকে ১০ জন গেরিলাকে এভাবে ট্রেনিং দেই যাতে তারা সাবস্টেশন গুলির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি খুব কম সময়ের মধ্যে চিনে নিতে পারে এবং সেগুলো অনায়াসে ধ্বংস বা অকেজো করে দিতে পারে। ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা এমনভাবে করা হয় যাতে তারা এ কাজে সম্পূর্ন পারদর্শিতা অর্জন করে। দু’মাস ট্রেনিং-এর পর এসব টিমগুলোকে আমার হেডকোয়ার্টারে মডেলের উপর একটা পূর্ণাঙ্গ রিহার্সালের বন্দোবস্ত করি যাতে প্রত্যেকটা টিমের প্রতিটি ব্যক্তির তার কার্য সম্বন্ধে কোন সন্দেহ না থাকে। নিজ নিজ কার্য যাতে তৎপরতার সাথে করতে পারে সে জন্য এ ব্যবস্থা করা হয়। এ টিমগুলি কে আমি কসবার উত্তরে আমাদের যে গোপন প্রবেশপথ ছিল, সে পথে ঢাকাতে প্রেরন করি। টিমগুলি নবীনগর এবং রূপগঞ্জ হয়ে নদীপথে ঢাকার উপকন্ঠে পোঁছে এরা প্রথম তাদের রেকি (সন্ধানী) সম্পন্ন করে। অনুসন্ধানের পর জানতে পারে যে কতগুলো সাবস্টেশনে পাকিস্তানীরা ছোট ছোট আর্মি পাহারা দলের বন্দোবস্ত করেছে। আবার কোন কোনটিতে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ কিম্বা রাজাকার দ্বারা পাহারার বন্দোবস্ত করেছে। দলগুলি তাদের সমস্ত সরঞ্জাম এবং অস্ত্র ঢাকাতে বিভিন্ন জায়গাতে লুকিয়ে রেখে বর্তমান অবস্থান সম্বন্ধে আমাকে খবর পাঠায় এবং নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে। আমি বুঝতে পারলাম যদিও কোন কোন জায়গায় ছোট ছোট পাহারার বন্দোবস্ত করা হয়েছে তবুও এগুলি ধ্বংস করার সুযোগ এখনই। এরপর পাহারা আরও সুদৃঢ় হওয়ার আশঙ্কা আছে। সে জন্য আর কালবিলম্ব না করে সবগুলো পাওয়ার সাবস্টেশন একযোগে অতিসত্বর ধ্বংস করার বা অকেজো করার নির্দেশ পাঠাই। আমার নির্দেশ পাওয়ার পর সব টিমই নিজ নিজ কমান্ডারদের নেতৃত্বে একযোগে জুন মাসের ২৭ তারিখের রাতে অকস্মাৎ তাদের আক্রমন চালায়। তারা এইসব আক্রমণে ধানমণ্ডি, শাহবাগ, পোস্তাগোলা, উলন, মতিঝিল, ডেমরা প্রভৃতি সাবস্টেশনগুলি ধ্বংস বা সাময়িক অকেজো করে দিতে সক্ষম হয়েছিল। আক্রমণের সময় আমার লোকদের সঙ্গে অনেক জায়গায় পাকসেনাদের সংঘর্ষ হয়- বিশেষ করে ধানমণ্ডি সাবস্টশনে। এই দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছিল রুমি। সে একাই স্টেনগান হাতে পাকসেনাদের উপর হামলা চালায় এবং সকলকে গুলি করে মেরে ফেলে। তার অসীম সাহসিকতার ফলে অন্যান্য লোকরাও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে এবং পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং সাবস্টেশনটি ধ্বংস করে দেয়। এরূপ সংঘর্ষ শাহবাগ ও ডেমরাতে ঘটে। বাকি জায়গাগুলোয় আমার লোকেরা এমন অকস্মাৎভাবে সাবস্টেশনগুলির ভিতরে ঢুকে পড়ে যে পাকসেনারা বা পাকিস্তানী পুলিশেরা কিছু বোঝার আগেই তাদের হাতে বন্দী বা নিহত হয়। এ অপারেশন-এ অন্তত ৭৫ শতাংশ সফলতা লাভ করি। ঢাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ ২৪ ঘন্টার জন্য সম্পূর্ণ অচল হয়ে যায়। যদিও পাকিস্তানীরা বিমানযোগে সাবস্টেশনের যন্ত্রপাতি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসে এবং কিছুটা সরবরাহ পুনরুদ্ধার করে-তবুও শিল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চিরতরে কমে যায়। এতে পাটকলগুলি চালাবার প্রচেষ্টা অনেকাংশে কমে যায়।

এ সময়ে আমি আরো জানতে পারি যে, প্রিন্স সদরুদ্দিন জাতিসংঘের পক্ষ থেকে ঢাকায় আসছেন সরেজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য। জেনারেল টিক্কা খান সে সময়ের প্রস্ততি নিচ্ছিল প্রিন্স সদরুদ্দিনকে বাংলাদেশের সবকিছু স্বাভাবিক অবস্থা দেখাবার জন্য। আমি তার এই প্রচেষ্টা বানচাল করার জন্য আরো পাঁচটি দল তৈরী করি। তাদের কাজ ছিল ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় গ্রেনেড বিষ্ফোরণ ঘটানো এবং অবস্থা যে স্বাভাবিক নয় সে সম্বন্ধে প্রিন্স সদরুদ্দিনকে বুঝিয়ে দেওয়া। পরিকল্পনা অনুযায়ী দলগুলি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিষ্ফোরণ ঘটায়-প্রিন্স সদরুদ্দিনের অবস্থানকালে। সবচয়ে বড় বিষ্ফোরণ ঘটায় মতিঝিলে। আলম এবং সাদেক এ দুজন গেরিলা ১টা গাড়ীর ভিতরে ৬০ পাউন্ড বিষ্ফোরক রেখে মতিঝিল হাবিব ব্যাঙ্ক বিল্ডিং-এর সামনে বিলম্বিত ফিউজের মাধ্যমে ভয়ংকর বিস্ফোরণ ঘটায়। এ বিস্ফোরণের ফলে হাবিব ব্যাঙ্কের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ঘটনায় সমস্ত ঢাকা শহরে আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জনসাধারন সঙ্গে সঙ্গে সব কাজ কর্ম বন্ধ করে দেয়। সেদিন রাতেই প্রিন্স সদরুদ্দিন যখন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বিশ্রাম করছিলেন এ দলটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বারান্দায় আরেকটা বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ী বিস্ফোরণ ঘটায়। চতুর্দিকে এসব বিস্ফোরণে জাতিসংঘে মহামান্য পর্যবেক্ষক বেশ ভাল করে বুঝতে পেরেছিলেন যে টিক্কা খান যাকে স্বাভাবিকভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছে, তা স্বাভাবিক নয়। ঢাকার অপারেশন যখন চলছিল তখন আমি আমার বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনাদের এবং প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাদের মিলিত দল বিভিন্ন থানায় পাঠাচ্ছিলাম থানাগুলি দখল করে নেওয়ার জন্য। এই দিনগুলি ছিলো বিশেষ অসুবিধার-কারণ আমার ট্রেনিংপ্রাপ্ত ছেলেরাও সেনারা সবাই ছিল যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু ছিল না শুধু অস্ত্র আর গোলাবারুদ। অনেক চেষ্টা করেও গোলাবারুদ আর অস্ত্রের কোন ব্যবস্থা করতে পারছিলাম না।

আমাদের বন্ধুরা সবসময় আশ্বাস দিত ‘এই অস্ত্র এসে পড়ছে’। কোন সময় বলত ট্রেনে মালভর্তি হয়ে গেছে, বন্যার জন্য আসতে পারছে না, কেননা রেললাইন বন্ধ। আবার কোন সময় বলত ফ্যাক্টরিতে তৈরী হচ্ছে। এমনও সময় গেছে যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন পরিকল্পনা তৈরীর পর আমাদের সে পরিকল্পনা পরিত্যাগ করতে হতো অস্ত্রের অভাবে। নিজেদের কাছে যে সব অস্ত্র ছিল সেসবেরও গোলাবারুদ অত্যন্ত রেশনিং-এর পরেও প্রায় শেষ হওয়ার পথে ছিল। এ সময় সমস্ত মুক্তিবাহিনীতে হতাশার ভাব পরিলক্ষিত হয়। অনেক সময় বহু অনুরোধের পর হয়ত ৩০৩ রাইফেলের ৫ রাউন্ড করে গুলির সাহায্য পেতাম। এ ধরনের যুদ্ধের জন্য যা ছিল অতি নগণ্য। এসব অসুবিধা এবং সংকটের মধ্যেও আমরা ভেঙ্গে পড়িনি। আমি আমার সেনাদলকে নির্দেশ দেই, যে উপায়ে হোক আর যেখানেই হোক পাক বাহিনীকে এ্যামবুশ করে যা অতর্কিতে আক্রমন করে তাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ ছিনিয়ে নিয়ে নিজেদেরকে সজ্জিত করে তুলতে হবে। এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। সকলকে আত্ননির্ভরশীলতা এবং আত্নবিশ্বাস আরো বাড়াতে হবে। আমার এ নির্দেশ বেশ কাজে লাগে।সকলেই আবার পূর্ণ উদ্দ্যমে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকে।

জুলাই মাসে টিক্কা খান আবার মন্দভাগ এবং শালদা নদী পুনর্দখল করার প্রচেষ্টা চালায়। পাকিস্তানীরা বেলুচ কুট্টি নামক জায়গায় সৈন্য সমাবেশ করে। আমাকে এ খবর আমাদের লোকেরা পৌঁছায়। আমি ক্যাপ্টেন গাফফারকে মন্দভাগের অবস্থান আরো এগিয়ে বাজারের নিকট অবস্থান শক্তিশালী করার নির্দেশ দেই। শত্রুসেনারা সকালে বেলুচ রেজিমেন্টের দুটি কোম্পানীকে সামনে রেখে অগ্রসর হয়। সকাল সাড়ে দশটায় শত্রুসেনারা অবস্থানের অগ্রবর্তী স্থান পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং আমাদের মাইনফিল্ডের ভিতর আটকা পড়ে যায়। তবুও তারা অগ্রসর হতে থাকে। তারা যখন আমাদের থেকে ৫০ গজের মধ্যে এসে পড়ে, ক্যাপ্টেন গাফফারের সেনাদল তাদের উপর অকস্মাৎ গুলিবর্ষণ শুরু করে। শত্রুরা আমাদের অবস্থান এত সামনে আছে তা জানত না। চতুর্দিকের গুলিতে তাদের দুটি কোম্পানী সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং শত্রুসেনারা চারিদিকে ছুটাছুটি করতে থাকে। এতে তাদের নিহতের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। ৩১ বেলুচ কিছুক্ষন পর তাদর আক্রমন পরিত্যাগ করে। কিন্তু এক ঘন্টা পরে পাক সেনারা শলদা নদীর দক্ষিন তীরের সাথে আমাদের অবস্থানের ডান পাশ দিয়ে পিছনে আসার চেষ্টা করে। তারা যে এরূপ একটা কিছু করতে পারে ক্যাপ্টেন গাফফার তা পূর্বেই অনুমান করেছিল। এ জন্য ক্যাপ্টেন গফফার তৈরীও ছিল। সুবেদার ওহাবের অধীন একটি কোম্পানীকে সে আগে থেকেই শালদা নদীর দক্ষিণ তীরে এ্যামবুশ পজিশনটির ফাঁদে পড়ে যায়। নিরুপায় হয়ে তারা অবস্থানটির উপর প্রবল আক্রমণ চালায় কিন্তু আমাদের গুলির মুখে এ আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আর উপায় না দেখে পরবর্তী আক্রমণ স্থগিত রেখে পাকসেনারা পিছু হটে যায়। ক্যাপ্টেন গাফফারের সেনাদল ও সুবেদার ওহাবের সেনাদল পশ্চাৎগামী শত্রুদের পিছনে ধাওয়া করে। এ সময় চতুর্দিক ধানক্ষেতে এবং অন্য জায়গায় বেশ পানি ছিল। শত্রুরা এসব পানি ভেঙ্গে পশ্চাদপসরণ করার সময় অনেক আহত ও নিহত হয়। যুদ্ধের শেষে সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে খুঁজে আমরা অন্তত ১২০টা মৃতদেহ খুঁজে পাই এবং আরো অনেক মৃতদেহ যেগুলি পানিতে ছিল, খুঁজে পাওয়া যায় না। এ যুদ্ধের ফলাফল আমার পক্ষে অনেক লাভজনক ছিল। আমরা ৮টা মেশিনগান, ১৮টা হালকা মেশিনগান প্রায় দেড়শ (১৫০) রাইফেল, ২ টা রকেট লাঞ্চার, ২ টা মর্টার ও অজস্র গোলাবারুদ হস্তগত করি। আরো অনেক অস্ত্রশস্ত্র যেগুলি পানিতে ছিল সেগুলি খুঁজে পাওয়া যায়নি। মৃতদেহগুলির মধ্যে ১ জন ক্যাপ্টেন, ১জন লেফটেন্যান্ট এবং আরো কয়েকজন জুনিয়ার কমিশন্ড অফিসার কে সনাক্ত করা হয়। শত্রুরা এই সময় বৃষ্টি এবং বন্যার জন্য আমাদের হাতে বেশ নাজেহাল হচ্ছিল এবং তাদেরকে বাধ্য হয়ে গতিবিধি শুধু রাস্তায় সীমিত রাখতে হচ্ছিল। কিন্তু আমরা শত্রুদের এ দুর্বলতা সম্পুর্ণভাবে কাজে লাগাতে পারছিলাম না যেহেতু তখন আমরা অস্ত্রশস্ত্রের দিকে দুর্বল ছিলাম-যদিও ইতিমধ্যেআমাদের বেশ সংখ্যক লোক ট্রেনিং পেয়ে প্রস্তুত ছিল। অস্ত্রের অভাবে এসব ট্রেনিং প্রাপ্ত লোকদের আমরা ভেতরে পাঠাতে পারছিলাম না। শত্রুরা আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরে তাদের গতিবিধি আরো বাড়াবার জন্য জলযানের যোগাড় করতে লাগল- বাংলাদেশের যত লঞ্চ, স্টিমার, স্পীডবোট ছিল, সেগুলি দখল করে মেশিনগান ফিট করে এগুলিকে গানবোট হিসাবে ব্যবহার করতে লাগল।

আমাদের কাছে খবর আসে যে, শত্রুরা ‘পাক বে’ কোম্পানীকে তিনশত ফাইবার গ্লাস স্পীডবোট তৈরীর নির্দেশ দিয়েছে। নারায়নগঞ্জের ‘পাক বে’ ডকইয়ার্ডে এসব স্পীডবোট তৈরীর কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। এই ‘বে’ কোম্পানীর একজন অফিসারের ভাই আমার মুক্তিবাহিনীতে ছিল। সে এসে খবর দেয় যে এই স্পীডবোটে লাগাবার জন্য তিনশ ইঞ্জিন সদ্য আনা হয়েছে এবং সেগুলি ‘পাক বে’র গুদামে মওজুত রাখা আছে। আমি তৎক্ষণাৎ সেই ছেলেটিকে আরো দশজন গেরিলা মনোয়ন করার নির্দেশ দিই এবং এই সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে, ফাইবার গ্লাস স্পীডবোট প্রস্তুত হয়ে গেলে শত্রুদের গতিবিধি অনেক গুণে বেড়ে যাবে, এই বর্ষার মওসুমে শত্রুসেনারা বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে পৌঁছাতে পারবে। তখন আমাদের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সুদূর গ্রামের গোপন অবস্থানগুলি অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে পড়বে। সে জন্য এই মেশিনগুলিকে এখনই ধ্বংস করে দিতে হবে। নির্দেশমত মনোনীত দলটিকে প্রশিক্ষণের পর নারায়ণগঞ্জ পাঠিয়ে দিই। নারায়ণগঞ্জ এসে তারা প্রথম ‘পাক বে’র গুদামটি রেকি (অনুসন্ধান) করে এবং জানতে পারে যে, দু’জন পুলিশ এবং দু’জন চৌকিদার যে গুদামটিতে মেশিনগান রাখা আছে সেখানে পাহাড়া দিচ্ছে। সেদিন সন্ধ্যায় আমার দলটি অতর্কিত পুলিশদের নিরস্ত্র করে ফেলে এবং পুলিশ ও চৌকিদারদের একটি কামড়ায় বন্ধ করে গুদামের তালা ভেঙ্গে গুদামে প্রবেশ করে। গুদামের ভিতরে ডিজেল এবং পেট্রোল ছিল। সেগুলি সব মেসিনের উপর ঢেলে দেয় এবং যে সব ফাইবার গ্লাস নৌকা প্রস্তুত ছিল তাতেও ঢেলে দেয়। এরপর অগ্নিসংযোগ করে বেড়িয়ে আসে। কয়েক সেকেণ্ডের ভিতর সমস্ত মেশিনে এবং ফাইবার গ্লাস নৌকাগুলিতে আগুন লেগে যায় এবং বিষ্ফোরণ ঘটে। এই বিষ্ফোরণে শত্রুদের সমস্ত মেশিন এবং ৩০০ নৌকা ধ্বংস হয়ে যায়।

এ অপারেশনের ফলে পাক বাহিনী তাদের গতিবিধি অনেকাংশ সীমিত করতে বাধ্য হয়। অপরদিকে এই অপারেশনের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সুদূঢ় গ্রামাঞ্চলে তাদের গোপন স্থান বিপদমুক্ত রাখা সম্ভব হয় এবং তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালাতে থাকে।

২রা জুলাই সকাল সাড়ে ৫টায় সময় একটা দল মোঃ হুমায়ুন কবিরের নেতৃত্বে শত্রুদের লাটুমুড়া অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এ আক্রমণে মার্টারের সাহায্যও নেইয়া হয়। আক্রমণে ফলে ১২ জন পাকসেনা নিহত অ ৪ জন আহত হয়।

কুমিল্লাতে আমাদের এ্যাকশন তীব্রতর হওয়ার জন্য পাকসেনারা কুমিল্লার উত্তরে গোমতী বাঁধের উপর তাদের অবস্থান তৈরী করে এবং এরপরে তারা তাদের কর্তৃত্ব আরও উত্তরে বাড়ানোর জন্য টহল দিতে শুরু করে। পাকসেনারা যাতে শহরের বাইরে কর্তৃত্ব পুনঃস্থাপন করতে না পারে সেজন্য আমি ‘বি’ কৌম্পানীর দু’টি প্লাটুনসহ কোটেশ্বর নামক স্থানে শক্তিশালি ঘাঁটি গড়ে তুলতে নির্দেশ দেই। পাকসেনারা ২/৩ দিন এই এলাকায় সম্মুখবর্তী জায়গায় তাদের টহল বজায় রাখে। এরপর ৪ ঠা জুলাই পাকসেনাদের একটি ভারী দল সকাল ৪ টার সময় আমাদের অবস্থানের আধামাইল পশ্চিম কোটেশ্বর গ্রামের ভিতর পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সকাল ৪ টা ১৫ মিনিটে তারা আরো অগ্রসর হয়ে আমাদের ২০০/৩০০ গজের মধ্যে পৌঁছে। এ সময় আমাদের সৈন্যরা তাদের উপর গুলি চালায়। পাকসেনারা ২/৩ ঘন্টা প্রবল চাপ চালিয়ে যায় অগ্রসর হবার জন্য কিন্তু আমাদের গুলির মুখে বারবারই পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এরপর তারা ৫০০/৬০০ গজ পিছু হটে গিয়ে আমাদের বামে ‘সারিপুরের’দিক থেকে আবার অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। এবারও পাকসেনারা আমাদের গোলাগুলির সামনে টিকতে না পেরে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের কমপক্ষে ৩০জন হতাহত হয়। আমাদের ১ জন প্রাণ হারায়।

হোমনা থানা পাকসেনাদের জন্য সামরিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল। ঢাকাতে যেসব গেরিলাকে পাঠাতাম অপারেশনের জন্য, তারাও এই হোমনা দিয়ে যাতায়াত করত। সে জন্য পাকসেনারা লঞ্চে করে সব সময় দাউদকান্দি থেকে হোমনা টহল দিয়ে আসত। আর হোমনায় দালাল পুলিশেরা পাকসেনাদের মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে খবরাখবর দিতো। এ পুলিশ স্টশনটি আমার আমার জন্য বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে জন্য এই থানাটি দখল করে নেয়ার জন্য আমি হাবিলদার গিয়াসকে নির্দেশ দেই। হাবিলদার গিয়াস তার সেনাদল ও স্থানীয় গেরিলাদের নিয়ে থানাটি আক্রমণ করার প্রস্তুতি নেয়। তারা খবর নিয়ে জানতে চায় যে, থানাতে বাঙালী দালাল পুলিশ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশও যথেষ্ঠ আছে। থানা রক্ষার্থে পুলিশ থানার চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরী করেছে এবং কয়েকয়েকটা হালকা মেশিনগানও তাদের কাছে আছে। সম্পূর্ণ খবরাখবর নিয়ে হাবিলদার গিয়াস থানা আক্রমণের একটা পরিকল্পনা নেয়। ১লা জুলাই রাত ১১টার সময় হাবিলদার গিয়াস তার গনবাহিনী ও নিয়মিত বাহিনীকে নিয়ে থানাটি অতর্কিতে আক্রমণ করে। এ আক্রমণে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরা হালকা মেশিনগানের সাহায্য বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যে আক্রমণের মুখে তারা সবাই নিহত হয়। হাবিলদার গিয়াস থানাটি দখল করে নেয়। এর ফলে থানার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র তার হস্তগত হয় এবং আমাদের ঢাকা যাবার রাস্তাও শত্রুমুক্ত হয়।

আমাদের একটি প্লাটুন মিয়াবাজার থেকে ফুলতুলীতে টহল দিতে যায়। রাত ৩টার সময় তারা দেখতে পায় পাকসেনাদের ১টি জীপ এবং ২টি ট্রাক কুমিল্লা থেকে দক্ষিণের দিকে টহল দিতে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্লাটুনটি কুমিল্লা চট্টগ্রাম রাস্তার উপর এ্যামুশ-এর জায়গায়অ তারা ১টি মেসিনগান রাস্তার দুদিঙ্ক থেকে লাগিয়ে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করে। রাত সারে ৪টায় পাকসেনাদের গাড়ীগুলি মিয়াবাজার অবস্থানে ফেরত আসে। আসার পথে গাড়ীগুলি আমাদের এ্যামুশ-এ পড়ে যায়। এ্যামবুশ পার্টি খুব নিকটবর্তী স্থান থেকে মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের গুলি চালিয়ে গাড়ীগুলি ক্ষতিগ্রস্ত করে দেয়। পাকসেনারা গাড়ী থেকে লাফিয়ে নীচে নামার চেষ্টা করে কিন্তু এতেও তাদের অনেক লোক মেশিনগানের গুলিতে হতাহত হয়। পাকসেনাদের কমপক্ষে ৩ জন অফিসার সহ ২১ জন নিহত ১৫ জন আহত হয়। পরে খবর পাওয়া যায় যে নিহতের মধ্যে ১ জন লেঃ কর্ণেলও ছিলেন। এ এ্যামবুস সময় পাকসেনারা কুমিল্লা বিমানবন্দর তাদের সাথীদের সাহার্য্যেথে কামানের সাহায্যে আমাদের এ্যামবুশ অবস্থানের উপর প্রচন্ড গোলা ছুঁড়তে থাকে। গোলার মুখে বেশীক্ষন টিকতে না পেরে আমাদের এ্যামবুশ পার্টি স্থানটি পরিত্যাগ করে পিছু হটে আসে।

জুলাই মাসের ১ লা তারিখে পাকসেনারা আবার তাদের শালদা নদী ও কসবা অবস্থানের ভিতরে যোগাযোগের স্থাপনের চেষ্টা চালায়। সকাল ১০টার সময় শালদা নদী থেকে পাকসেনারাদের একটি দল কসবার দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি কিছুদূর অগ্রসর হবার পর মন্দভাগের নিকট গফফারের ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানী, পাকসেনারা যখন তাদের অবস্থানের সামনে দিয়ে কসবার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল, ঠিক সে সময় তাদের উপর অতর্কিত হমলা চালায়। পাকসেনারা আর অগ্রসর হতে পারে না এবং ছত্রভঙ্গে তাদের মৃতদেহগুলি ফেলেই শালদা নদীর অবস্থানে পালিয়ে যায়। পালানোর পথে আমাদের মর্টারের গোলাও তাদের যথেষ্ঠ ক্ষতিসাধন করে। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৮ জন আহত ও ৩ জন নিহত হয়।

পাকসেনারা জুলাই মাসের ৩ তারিখে ফেনী থেকে দুটি কোম্পানী নিয়ে বেলুনিয়ার দিকে অগ্রসর হয়। রাস্তায় তারা ‘শালদা বাজার’ নামক স্থানে সাময়িক অবস্থান নেয়। এই সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের ১টি প্লাটুন ৩ মর্টারসহ দুপর দুটার সময় শত্রুদের এই দলটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল না। তাদের মনোবল বেলুনিয়াতে আগে থেকেই যথেষ্ট কমে গিয়েছিল। এ ছাড়া সে সময়ে বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির মধ্যে সাময়িকভাবে বানানো ট্রেঞ্চগুলোতে থাকাও বেশ অসুবিধাজনক হয়ে পড়েছিল। অতর্কিত আক্রমণের ফলে মেশিনগান ও মর্টারের গোলাগুলিতে তদের অসংখ্য লোক হতাহত হয়। পরে জানা যায় যে, তদের অত্যন্তপক্ষে ৩০ জন লোক নিহত ও ২০ জন লোক আহত হয়েছে। পাকসেনারা এরপর শালদা বাজারের পার্শ্ববর্তী সাহেবনগর ও অন্যান্য গ্রামগুলি থেকে স্থানীয় লোকদের অন্য স্থানে চলে যেতে বলে। মতলববাজার এলাকাতে মুক্তিবাহিনীর একটি প্লাটুনকে লেঃ মাহবুব পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি মতলব এলাকায় গিয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। সেখানে তারা জানতে পারে মতলব থানাতে পাকিস্থানী পুলিশ এবং রেঞ্জার মোতায়েন করা হয়েছে। এ পুলিশের অত্যাচারে স্থানীয় লোকরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। পাকিস্থানী পুলিশরা স্থানীয় দালালদের সহয়তায় শাসনকার্য আয়ত্তাধীন আনার চেষ্টা করেছে। আমাদের দলটি মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে এই থানাকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা থানার সম্বন্ধে সকল খবর যোগাড় করে। জুলাই মাসের ২ তারিখের রাতে গেরিলা দলটি থানার উপর আক্রমণ করে। পাকিস্থানী পুলিশ ও রেঞ্জাররা এই আক্রমণকে প্রতিহত করার চেষ্টা করে কিন্তু তীব্র আক্রমণের মুখে ৫ জন পুলিশ নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। ঠিক এই সময়ে গেরিলাদের নিকট যে হালকা মেশিনগানটি ছিল সেটা খারাপ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে গেরিলা আক্রমণ পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। গেরিলাদেরও ১ জন নিহত হয়। কিন্তু এই আক্রমণের পর থেকে পাকিস্থানী পুলিশরা আর থানার বাইরে আসার সাহস পায়নি। সমস্ত মতলব থানা এলাকা মুক্তিবাহিনী আয়ত্তাধীন এসে যায়।

শালদা নদীতে আমাদের কার্যকলাপ সব সময় চালানো হচ্ছিল। মেজর সালেকের এক পেট্রল পার্টি খবর আনে যে রেলওয়ে সড়কের পূর্ব দিক দিয়ে একটি ছোট রাস্তা পাকসেনারা তদের শালদা নদী ও নয়ানপুর অবস্থানের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য ব্যবহার করে। মেজর সালেক ৫ জনের একটি ডিমোলিশন পার্টি পাঠিয়ে সেই রাস্তার উপর মাইন পুঁতে দেয়। ৯ই জুলাই সকাল সাড়ে ৫টার সময় পাকিস্থানীদের একটি প্লাটুন শালদা নদী থেকে নয়ানপুর যাবার পথে এইসব এন্টি-পার্সোনাল মাইনের উপর পড়ে যায়। মাইন বিষ্ফোরণে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে শালদা নদীতে ফিরে আসে।

৬ই জুলাই পাকসেনারা প্রায় ১টি ব্যাটালিয়ন নিয়ে মন্দভাগ বাজার পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সেখান থেকে তারা সামনে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। আমাদের ‘এ’ কোম্পানি এবং ‘সি’ কোম্পানি মেজর সালেক এবং ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে পাকসেনাদের শালদা নদী এঙ্কলেভ এর ভিতর অগ্রসর হটে প্রচণ্ড বাঁধা দেয়। পাকসেনারা তাদের ফিল্ড আর্টিলারি মন্দভাগ বাজার পর্যন্ত নিয়ে আসে এবং কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর এবং পার্শবর্তী গ্রামগুলোতে তীব্র গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষণে আমাদের ১১ জন আহত হয় এবং অন্তত ৩২ জন বেসামরিক ব্যাক্তি হতাহত হয়। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে এবং শালদা নদী এঙ্কলেভ দখল করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে। আমাদের মুক্তিসেনারাও তাদের এ আক্রমণে তীব্র বাঁধা দিতে থাকে। যদিও আমাদের মর্টারের গোলা তাদের কামানের অবস্থান পর্যন্ত পৌছতে পারেনি তবুও মর্টারের গোলা এবং মেশিনগুলোতে তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়ে যায়। তারা পিছু হটে মন্দভাগ বাজারে অবস্থান নিতে বাধ্য হয়। মেজর সালেক পাকসেনাদের শালদা নদীর অবস্থানের বিরুদ্ধে তার কার্যকলাপ আরও তীব্রতর করার জন্য ৯ই জুলাই পাক অবস্থানের উপর ঘোরাফিরা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের কামানগুলি এবং মর্টার পাকসেনাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এই গোলাবর্ষণ প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে চলে। এই অকস্মাৎ প্রচণ্ড মর্টার এবং কামানের গোলাবর্ষণে শত্রুরা হতভম্ভ হয়ে পড়ে। এতে তাদের অনেক হতাহত হয়। পরে জানতে পারা যায় যে এই গোলাগুলিতে ১৯ জন পাকসেনা নিহত এবং ১১ জন আহত হয়। একটি মেশিনগান বাঙ্কার সহ তিনটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। কামানের গোলার আঘাতে তাদের একটি এম্যুনিশন ডাম্প বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যায়। এর পড় দিন একটি স্পিড বোট পাকসেনাদের নিয়ে শালদা নদী হয়ে পশ্চিম দিকে যাচ্ছিল। আমাদের পেট্রোল পার্টটি, যেটি আগে থেকেই শালদা নদীর পিছনে অবস্থান নিয়েছিল, তারা পাকবাহিনীর স্পীড বোট এম্বুশ করে। এম্বুশের সময় আমাদের গুলির আঘাতে স্পিড বোট ডুবে যায়। ১২ জন পাকসেনা গুলিতে না হয় পানিতে ডুবে মারা যায়। মরিতদের মধ্যে ১ জন মেজর ও ১ জন ক্যমাটেন ছিল এবং তাদের মদমর্যাদার ব্যাজ এম্বুশ পার্টি নিয়ে আসে। এম্বুশ পার্টি পানি থেকে একটি মেশিনগান, একটি ওয়ারলেস সেট এবং একটি ম্যাপ (যাতে শত্রুর অবস্থাগুলি চিনহিত ছিল) উদ্ধার করতে সমর্থ হয়। এর পরই পাকসেনাদের কামানের গোলা আমাদের দলের উপর পড়তে থাকে। আমাদের দল তখন বাধ্য হয়ে এম্বুশ স্থান পরিত্যাগ করে।

১০ই জুলাই পাকসেনারা একটি কোম্পানি নিয়ে বিকেল ৪তার সময় পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। পাকসেনারা শালদা নদীর উঁচু স্থান সাগরতলা স্থানটি দখল করার জন্য অগ্রসর হয়। তাদের সঙ্গে তাদের গোলন্দাজ বাহিনীও সহায়তা করে। কিন্তু সাগরতলা উঁচু অবস্থানের উপর আমাদের যে প্লাটুন টি ছিল সেটি এবং রেললাইনের পশ্চিমে আমাদের আরেকটা প্লাটুন তাদেরকে প্রচণ্ডভাবে বাঁধা দ্যায়। তাদের প্রায় ৩০/৪০ জন হতাহত হয়। এরপর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে শালদা নদীতে নিজ অবস্থানে পালিয়ে যায়।

পাকিস্তানীদের একটি দল নবীনগরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। পাকসেনাদের নবীনগরে অবস্থানের পড় আমাদের নরসিংদী, ভৈরববাজার এবং কালীগঞ্জে যাতায়াতের রাস্তায় বাঁধার সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা কয়েকজন স্থানীয় দালালের সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর জন্য সমস্ত এলাকায় ত্রাসের সৃষ্টি করে। ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন এই এলাকাকে পুনরায় বিপদমুক্ত করার জন্য ১৬ জনের একটি দলকে হাবিলদার আওয়ালের নেতৃত্বে নবীনগর পাঠায়। হাবিলদার আওয়াল কষবার উত্তর দিয়ে অনুপ্রবেশ করে নবীনগরের ৩ মাইল পশ্চিমে তার গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে। এরপর স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে সম্পূর্ণ খবর যোগাড় করে। এর পর ৮ই জুলাই সকাল ৬টায় পাকসেনাদের নবীনগরের অবস্থানটির উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এ অতর্কিত আক্রমণের জন্য পাকসেনারা মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। তারা হকচকিয়ে যায় এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দলটি পাকসেনাদের ৭জন ও ৫জন দালালকে নিহত করতে সক্ষম হয়। সঙ্ঘর্ষে আমাদের ১ জন আহত হয়। আমি এসময় ঢাকাতে আরও কয়েকটি গেরিলা পার্টি পাঠাই। এই দলগুলি আগের প্রেরিত দলগুলির সাথে যোগ দ্যায় এবং ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ ও পার্শবর্তী এলাকায় তাদের গেরিলা কার্যকলাপ চালিয়ে যায়। একটি দল জুলাই মাসের প্রথমেই পাকসেনাদের ছোট একটি এম্যুনিশন পয়েন্ট আক্রমণ করে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত করে। এর ফলে পাকবাহিনী সমস্ত ঢাকাতে সান্ধ্য আইন জারি করে এবং ঢাকা শহরে প্রহরার ব্যাবস্থা করে। ঐ দিনই দুজন গেরিলা নিউমার্কেটের নিকট পাকসেনাদের একটি জিপের ভিতর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে ১জন অফিসার ও ৩ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৫ই জুলাই নারায়ণগঞ্জে ২ জন আর একটি দল গুলশান সিনেমা হলের পর্দার ভিতর ১টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে পর্দাটি সম্পুর্ন পুড়ে যায় এবং নিকতবর্তী ৫জন দালালও আহত হয়। সমস্ত নারায়ণগঞ্জে এবং ঢাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। ৪ঠা জুলাই দুপুর ১২টার সময় ৫জন গেরিলার একটি দল পাগলাটে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাইল উড়িয়ে দ্যায়। ১০ জনের গেরিলার একটি দল নিউমার্কেটের নিকট পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং পাকসেনাদের একটি মিলিত দলের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। ফলে ৮ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়।

এদিকে ১১ই জুলাই সকাল ৮টা থেকে অকস্মাৎ পাকসেনারা ভারি কামান এবং মর্টারের সাহায্যে আমাদের শালদা নদী অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালাতে থাকে। এই গোলাগুলির ফলে আমাদের শালদা নদী অবস্থানে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকসেনাদের গোলাগুলি সমস্ত দিন ধরে চলতে থাকে। মর্টার স্প্লিন্টারের আঘাতে ৪র্থ বেঙ্গলের হাবিলদার তাজুল মিয়া এবং সিপাই আব্দুর রাজ্জাক মারাত্মকভাবে আহত হয়। এছাড়াও দুজন বেসামরিক লোক নিহত ও ৮জন বেসামরিক লোক আহত হয়। কিন্তু বিকেলের দিকে গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায় এবং আক্রমণও হয়নি।

৯ই জুলাই পাকসেনারা আমাদের কোটেশ্বর অবস্থানের উপর সকাল ৬টায় আবার তাদের আক্রমণ শুরু করে। আমাদের কোটেশ্বর অবস্থানের সৈন্যরা মর্টার এবং কামানের সহায়তায় পাকসেনাদের এই আক্রমণের মোকাবিলা করে। পাকসেনারা প্রথমে দুটি কোম্পানি নিয়ে আক্রমণ চালায়। পরে আরও দুটি কোম্পানিকে শক্তি বৃদ্ধির জন্য নিয়ে আসে। ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় আমাদের কামানের গোলায় এবং মেশিনগানের গুলিতে পাকিস্তানীদের আক্রমণ ব্যাহত হয়। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের অন্তত ২৪/২৫ জন নিহত হয়। তারা আক্রমণ বন্ধ করে পিছু হটে যায়।

আমাদের Petrol পার্টি ৯ই জুলাই পাকসেনাদের কোম্পানি হেডকোয়ার্টার রেকি করে এবং অবস্থান সম্পর্কে জানতে পারে। আমাদের কামানগুলি এই কোম্পানি হেডকোয়ার্টারের উপর প্রচণ্ড গোলা নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে দুজন পাকসেনা নিহত এবং ৬জন আহত হয়। এর মধ্যে একজন অফিসার ও তার Signaller ছিল। স্থানীয় লোকেরা অফিসারটিকে কাঁধে ব্যাজ দেখে সনাক্ত করতে পেরেছিল। শত্রুদের মনোবল ভেঙ্গে গিয়েছিল।

১০ই জুলাই রাতে ক্যাপ্টেন গাফফার ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি থেকে দুটি সেকশন সালদা নদীর পশ্চিমে কামালপুর এবং মাইঝখাইরের ভিতর এম্বুশ অবস্থানের ভিতর এসে পড়ে – ঠিক সে সময় পাকসেনাদের সম্মুখবর্তী অংশের উপর আমাদের সৈন্যরা গুলি চালাতে শুরু করে। অতর্কিত আক্রমণে পাকসেনারা হতভম্ভ হয়ে যায় এবং কিছু বোঝার আগেই তাদের অনেক লোক হতাহত হয়। ছত্রভঙ্গ হয়ে তারা পেছনের দিকে পালাতে শুরু করে। এঅবস্থাতেও তাদের অনেক হতাহত হয়। সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদের একজন মেজর, দুজন ক্যাপ্টেন ও ৮জন সিপাই নিহত হয়। আমাদের Ambush পার্টি ১টি MIGA মেশিনগান এবং Am-PRC-10 Wireless Set হস্তগত হয়।

হোমনাতে হাবিলদার গিয়াসের অধীনে যে মুক্তিবাহিনীর দলটি হোমনা থানায় আক্রমণ চালিয়ে অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়, সেই দলটি এ এলাকাতেই তাদের ঘাঁটি গড়ে তোলে। এ দলটির কার্যকলাপে পাকবাহিনী নিকটবর্তী সমস্ত থানাগুলিকে আরও শক্তিশালী গড়ে তোলে। পাকসেনারা রাস্তার প্রত্যেকটি সেতুর উপর তাদের কড়া পাহারার ব্যাবস্থা করে। প্রতিটি হাঁট বাজার এলাকাতেও তারা ক্যাম্প তৈরি করে। এছাড়া নিকটবর্তী সমস্ত এলাকার চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের ডেকে ‘শান্তি কমিটি’ গড়ার কড়া নির্দেশ দ্যায়। প্রতিটি এলাকার চেয়ারম্যানকে স্থানীয় লোক নিয়োগ করে পাকসেনাদের অধীনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে বাধ্য করে এবং তাদের কাজ করতে বাধ্য করে। কন স্থানীয় লোক যদি তাদের নির্দেশমোট কাজ করতে অস্বীকার করত, পাকসেনারা তাদের পিতামাতা বাড়িঘরের ক্ষতি করে বা ভয় দেখিয়ে তাদের নির্দেশমত কাজ করাতে বাধ্য করত। পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় হাবিলদার গিয়াসের দলটির সঠিক সন্ধান পায় এবং তাদের অবস্থিতি সম্বন্ধে পাকবাহিনীর মন্তব্য আমরা নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানতে পাই। তাদে ধারণা ছিল যে হোমনা এবং দাউদকান্দি এলাকাতে কমপক্ষে আমাদের ৬ হাজারেরও বেশী লোক কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এজন্য পাকসেনারা কখনো রাতে তাদের ক্যাম্পগুলির বাইরে আসতে সাহস পেতনা। এছাড়া কোন সময়েই দলে ভারি না হলে ক্যাম্পের বাইরে টহলে বের হতোনা। পাকসেনাদের ভীতসন্ত্রস্ত মানসিক অবস্থার জন্য আমাদের দলটির নির্বিঘ্নে কাজ চালিয়ে যেতে সুবিধা হয়। সপ্তাহে একদিন কি দুদিন লঞ্চের সাহায্যে পাকসেনাদের এসব ক্যাম্পে রসদ যোগানো হত। এ সংবাদ আমাদের দলটি জানতে পারে। ৬ই জুলাই দাউদকান্দি থানার অন্তর্গত মাসিমপুর বাজারের অর্ধমাইল পশ্চিমে জয়পুর গ্রামে শাখানদীর পাড়ে হাবিলদার গিয়াস তার দলটি নিয়ে পাকসেনাদের জন্য একটি এম্বুশ পাতে। সকাল ১০টার সময় পাকসেনাদের দুটি লঞ্চ দাউদকান্দির দিক থেকে গোমতী হয়ে এই শাখানদীতে আসে। লঞ্চগুলি এম্বুশের সামনে পড়তেই আমাদের দলটি অতর্কিতে গোলাগুলি ছুড়তে থাকে। পাকসেনারা নদীর ভিতর থেকে অ্যামবুশ দলটির উপর হামলা না করতে পারায় এবং তীরে অবস্থিত এম্বুশ পার্টির তীব্র গোলাগুলিতে লঞ্চগুলির যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হওয়ায় অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে লঞ্চগুলি পিছু হটে যায় এবং দাউদকান্দির দিকে পালিয়ে যায়। পড়ে বিভিন্ন সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি যে অন্তত ২০/২৫ জন পাকসেনা আহত বা নিহত হয়েছে। লঞ্চগুলি অ্যামবুশের ভিতর পড়ে যাওয়া সত্ত্বেও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া সম্বভ হয়নি, কারণ এম্বুশ পার্টির নিকট রাইফেল এবং হাল্কা মেশিনগান ছাড়া বড় অস্ত্র, যেমন রকেট কিংবা কামান ছিলোনা, তবুও এ এম্বুশের ফলাফল ছিল আমাদের বিশাল সাফল্য। ফলে পাকসেনারা এ এলাকায় চলাফেরা কমিয়ে দ্যায়। এতে আমাদের কর্তৃত্ব ও স্থানীয় লোকের মনোবল আরও বেড়ে যায়। এর পড় হোমনা ও দাউদকান্দি থানার জনসাধারণ সতস্ফুর্তভাবে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।

৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’কোম্পানির একটি প্লাটুন চৌদ্দগ্রাম এলাকায় পাকসেনাদের বিরুদ্ধে তাদের আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনারা কুমিল্লা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক খোলার জন্য তাদের প্রচেষ্টা দিন দিন বাড়িয়ে যাচ্ছিল। যাসব সড়ক সেতু আমরা ধ্বংস করে দিয়েছিলাম সেগুলি পুননির্মান করার চেষ্টা করছিল। ৯ই জুলাই সকাল ৮টায় আমাদের প্লাটুনটি চৌদ্দগ্রামের উতরে স্রকের উপর বালুজুরি ভাঙ্গাল্পুরের নিকট অ্যামবুশ পাতে। ১১টার সময় পাকসেনারা একটি সিআর বি ট্রাকে করে এবং দুটি জিপে রাস্তা দিয়ে আসে এবং ভাঙ্গালপুড়ের নিকট থামে। পুলটি মেরামত করার কাজের প্রস্তুতি চলতে থাকে। ঠিক সে সময়ে আমাদের এম্বুশ পার্টি তাদের উপর গোলাগুলি চালাতে থাকে। এর ফলে পাকসেনাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। অ্যামবুশ পার্টির গুলিতে তাদের অনেক হতাহত হয়। পাকসেনারা পুলের নিকট থেকে পিছু হটে অবস্থান নেয় এবং পড়ে চৌদ্দগ্রাম থেকে আরও পাকসেনা এসে তাদের সাথে যহ দ্যায়। এরপর পাকসেনারা আমাদের এম্বুশ অবস্থানের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। আমাদের দলটিও একটু পিছু হটে উঁচু জায়গায় আরও শক্ত অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা ৩টার সময় মর্টার, কামান, মেশিন গানের সহায়তায় আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ করে। আমাদের গুলিতে পাকসেনারা পর্যদুস্ত হয়ে ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় বিকেল ৫টায় আক্রমণ পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। যুদ্ধে পাকসেনাদের ৩০ জন নিহত ও ৬ জন আহত হয়। যুদ্ধক্ষেত্রের চারিদিক মৃতদেহগুলি বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ফেলে রেখে তারা পালিয়ে যায়। পাকসেনারা পিছু হটার পর আমাদের দলটি অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয় এবং শত্রুদের ক্ষতিগ্রস্ত ট্রাকটিও নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয় কিন্তু ট্রাকটির এত বেশী ক্ষতি হয়েছিল যে এটা আনা সম্ভব হয়নি এবং টট্রাকটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয়। পাকসেনাদের যে দুজন দালাল যুদ্ধের সময় পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছিল তারাও গুলিবিদ্ধ হয়। পাকসেনারা পিছু হটে যাবার পথ আমাদের দলটি তাদের ২/৩টি পেট্রল ও পর্যবেক্ষন ঘাঁটিতে অবস্থিত পাকসেনাদের তাড়িয়ে দেয়। বিকেল সাড়ে ৪টার সময় পাকসেনাদের একটি জঙ্গি বিমান যুদ্ধক্ষেত্র পর্যবেক্ষন করে এবং আমাদের দলটিকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের দলটি সেখান থেকে একটু দূরে সরে যাওয়াতে জঙ্গি বিমানটি কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে চলে যায়। এ সঙ্ঘর্ষের পর ১০ই জুলাই সন্ধ্যায় একটি এম্বুশ পার্টি উক্ত অবস্থানের ১ মাইল দক্ষিণে লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে আবার এম্বুশ পাতে। আমাদের ধারনা ছিল যে, পাকসেনারা আবার উক্ত সেতুর নিকট আসবে। ১০ই জুলাই সারাদিন পাকসেনাদের জন্য তারা অপেক্ষা করে থাকে কিন্তু আমাদের ধারনা মত সেদিন না এসে ১১ই জুলাই ১১টার সময় পাকসেনাদের একটা কোম্পানি দুটি গাড়ী সহ আস্তে আস্তে ভাঙ্গা সেতুর দিকে মিয়াবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনারা যখন এম্বুশ অবস্থানের ভিতর পৌঁছে ঠিক সেই সময় এম্বুশ পার্টি তাদের উপর প্রচণ্ড গোলাগুলি চালাতে থাকে। এতে শত্রুদের বেশ হতাহত হয়। তারা পিছু হটে গিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায় এবং উভয়পক্ষে যুদ্ধ সারাদিন ধরে চলতে থাকে। এ যুদ্ধে পাকসেনাদের ১০/১৫ জন আহত হয়। বিকেল ৩টায় পাকসেনারা যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করে আবার পিছু হটে যায়। আমাদের দলটি রাত ২টা পর্যন্ত পুনরায় আক্রমনের অপেক্ষায় থাকে। এরপর বালুজুরির ভগ্নাবশেষ সেতুটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হলে লেঃ ইমামুজ্জামান তার দলটি নিয়ে ঘাঁটিতে চলে আসে। আসার পথে চৌদ্দগ্রাম লাকসাম রোডের উপর বাংগোডার পশ্চিমে এবং চৌদ্দগ্রামের উত্তরে আরেকটা ভাঙ্গা ব্রিজের নিকট এন্টি ট্যাঙ্ক এবং এন্টি পার্সোনাল মাইন পেতে রাখে। মাইন পাতার সময় আমাদের কমান্ডো প্লাটুনের দুজন লোক দুর্ঘটনায় সামান্য আহত হয়।

এ সময় পাকিস্তানীরা ফেনী দিয়ে চট্টগ্রাম রেল লাইন পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করে। আমরা রাজনগর সাবসেক্টর থেকে ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম একটি প্লাটুন ও ইঞ্জিনিয়ার এর একটি দলকে এক্সপ্লোসিভ সহ মিয়াবাজারের দক্ষিণে পাঠিয়ে দেয়। এ দলটি সরিসদি রেলওয়ে ব্রিজ সম্বন্ধে খবরাখবর নেয় এবং গোমতীর নিকট সরিসদি রেলওয়ে ব্রিজটি আক্রমণ করার জন্য বেছে নেয়। কিছু সংখ্যক স্থানীয় দালাল পাকবাহিনীর অস্ত্র দিয়ে এই ব্রিজটি পাহার দিত। ১৩ই জুলাই রাত ১১টার সময় দলটি সরিসদি ব্রিজটি আক্রমণ করে। পাহারারত সশস্ত্র দালালদের কিছু নহত এবং বাকিদের তারিয়ে দিয়ে তারা ডিমলিশন লাগিয়ে ব্রিজটিকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে পাকিস্তানীরা শুধু ফেনী এবং গুণবতীর মধ্যে ট্রেন মাঝে মাঝে চলাচল চালু রাখত। অবশ্য এর আগে ট্রেন চলাচল করতে পারত না। এ দলটি পাকিস্তানীদের নয়াপুর বি ও পি অবস্থানের উপর ৩ মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। এর ফলে দুজন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।

১৩ই জুলাই রাত ১০টায় পাকসেনাদের দত্তসার দীঘি এবং আমতলা অবস্থানগুলির ওপর ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে দুটি দল আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের পাকসেনাদের ১৫ জন আহত ও কিছু নহত হয়। শালদা নদীতে পাকসেনারা আবার নতুন করে তাদের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে। ১১ই জুলাই পাকসেনারা আমাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে মারমুখী পেট্রলিং চালাতে থাকে। আমাদের সৈন্যরাও মেজর সালেকের নেতৃত্বে তাদের অবস্থানের সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের উপর লক্ষ রাখে। ১২ই জুলাই রাত ৮টায় পাকসেনারা প্রচণ্ডভাবে আমাদের সালদা নদী অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি মেজর সালেকের নেতৃত্বে এ আক্রমণ মোকাবিলা করে। আমাদের সৈন্যদের গুলির আঘাতে পাকসেনাদের প্রচুর হতাহত হয়। তারা পর্যদুস্ত হয়ে আক্রমণ পরিত্যাগ করে রাত ১১টায় পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। সমস্ত রাত উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলতে থাকে। ভোর ৫টায় পাকসেনারা একটি ব্যাটালিয়ন নিয়ে আবার সালদা নদীর দক্ষিণে গরঙ্গলা অবস্থানের উপর নতুনভাবে আক্রমণ শুরু করে। সেই সঙ্গে তারা আমাদের আশাবাড়ি অবস্থানেও হামলা চালায়। এই দুই আক্রমণ ও আমাদের মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের গোলার সামনে তারা পর্যুদস্ত হয়। পাকসেনাদের অসংখ্য হতাহত হয়। দিনের আলোতে আমাদের সৈন্যরা বাঙ্কার থেকে অগ্রসরমান শত্রুদের হতাহত করে। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ ভঙ্গ করে দিতে বাধ্য হয় এবং পিছু হটে যায়। আমাদের সৈন্যরা পলায়নপর শত্রুদের তাড়া করে। যুদ্ধের সময় আমাদের মর্টারের গোলাতে পাকসেনাদের চাপাইতে অবস্থিত একটি এম্যুনিশন এবং রেশন স্টোরে বিস্ফোরণ ঘটে, ফলে ২১ জন আহত ও কিছু সংখ্যক নিহত হয়। ঐ দিনই লেঃ হুমায়ুন কবিরের একটি দল পাকসেনাদের লাটুমুড়াতে যে অবস্থান ছিল তাঁর পিছনে অবস্থান চালায় এবং বেশ কয়েকজন আহত ও নিহত করে। পাকসেনাদের গসাইলস্থ বি ও পি র একটি টহলদার ক্যাপ্টেন গাফফারের একটি দল সন্ধ্যা ৬টায় মন্দভাগ বাজারের শত্রু অবস্থানের উপর এবং নক্তের বাজার শত্রু অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনাদের ১২ জন নিহত হয় এবং বেশ কয়েকটি বাঙ্কারও ধ্বংস হয়। পাকিস্তানীরা আমাদের মন্দভাগ অবস্থানের উপর কামানের সাহায্যে পাল্টা আক্রমণ চালায়। এতে আমাদের ১ জন নায়েক এবং ৩ জন সিপাই আহত হয়।

আমাদের স্পেশাল কমান্ডোরা জুলাই মাস্যা ৯,১০,১১ তারিখ ঢাকা শহরে তাদের কার্যকলাপ আরও তীব্র করে। গেরিলা কমান্ডার হাবিবুল আলম এবং কাজির নেতৃত্বে একটি ইম্প্রুভাইজড টাইম বোমা ফার্মগেঁটের নিকট পাঞ্জাবিদের ‘মাহরুফ রেস্টুরেন্টে’ স্থাপন করা হয়। এই রেস্টুরেন্টে পাকসেনারা এবং দালালরা সবসময় আসতো। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী বোমাটি বিস্ফোরিত হয় এবং এতে ১৬ জন পাকসেনা কয়েকজন দালাল সহ হতাহত হয়। এর মধ্যে ৮ জন মারা যায় এবং ১২ জন আহত হয়। হলিক্রস কলেজ ভবনেও কিছু ক্ষতি হয়।

৪ জনের আরেকটি গেরিলা দল ডি আই টি ভবনের নিকট প্রহরা রত ২ জন পাকসেনাকে নিহত করে। এই পার্টি এর পড় সিদ্দিক বাজারের নিকট ১টি টহলদার পাকসেনাদলকে এম্বুশ করে এবং ২/৩ জন পাকসেনা এতে নিহত হয়। মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক , স্টেট ব্যাংক, নাজ সিনেমা হল, ওয়াপদা ভবন ইত্যাদি স্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এসব ঘটনার ফলে সমস্ত ঢাকায় আতংকের সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা ব্যাতিব্যাস্ত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। ঢাকার স্বাভাবিক অবস্থাও সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে যায় এবং এলাকাবাসীদের মনোবল আরও বেড়ে যায়।

জুন মাসে আমি যখন পাকসেনাবাহিনীর সঙ্গে সব ফ্রন্ট যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম সে সময় আমি বুঝতে পারলাম যদিও আমাদের যোদ্ধাদের আঘাতে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছিল এবং যতই আমাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল তবুও আমাদের চেয়ে তাদের শলি অনেক বেশী ছিল। বিশেষ করে যেখানে পাকসেনারা শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে বাঙ্কারে অবস্থান নেয় সেখান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করা আমাদের পক্ষে বিশেষ করে সব সময় সম্ভব হতনা। আমি সবসময়ে সংগঠিত গোলন্দাজ বাহিনীর অভাব আনুভব করতাম। বাংলাদেশে অবস্থিত পাকসেনাদের বেশ কয়েকটি গোলন্দাজ রেজিমেন্ট ছিল। এসব রেজিমেন্টে যেসব বাঙলাই নিযুক্ত ছিল ২৫শে মার্চের পড় অনেককে পাকসেনারা হত্যা ও বন্দি করে। আবার অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় এবং পরে সেসব গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা আমাদের সেক্টরে যোগ দেয়। তাদের আমি বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োগ করি। যুদ্ধে এসব সৈন্যরা যথেষ্ট সাহসেরও পরিচয় দিয়েছে। এসব সৈন্যদের নিয়ে আমি একটি গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে গোলন্দাজ বাহিনীর সব সৈন্যকে কনাবনে একত্রিত করা হয়। একটি নতুন রেজিমেন্ট গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট কষ্টের সম্মুখীন হটে হয় এবং সেই কষ্ট নতুন রেজিমেন্টটিকেও বহন করতে হয়। এদের কোন থাকার জায়গা ছিল না , খাওয়া এবং রানার কোন ব্যাবস্থাও ছিলোনা। রেজিমেন্টের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রকৌশলী লোকের দরকার হয়, কিন্তু সব রকমের সৈন্য আমাদের ছিলোনা। তাছাড়া সবচেয়ে বড় জিনিস কামান এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি যা একটি গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য নিতান্ত প্রয়োজন ছিল। আমি পার্শবর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মিলিটারি অধিনায়কদের সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং অস্ত্রের জন্য অনুরোধ জানাই। অনেক ছোটাছুটির পর তারা কয়েকটি ৩.৭ ইঞ্চি ছোট কামান আমাদের দেয়। এই কামানগুলি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়কার ছিল এবং সম্ভবত সেকেলে হিসাবে পরিত্যাক্ত ছিল কিন্তু তবুও এগুলি পাবার পড় আমার গোলন্দাজ বাহিনীর লোকদের মধ্যে একটি নতুন সাড়া জাগে। তারা তৎক্ষণাৎ এই কামানগুলি প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে দেয়। প্রকৌশলী লোকের অভাব থাকায় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং গণবাহিনী থেকে লোক ভর্তি করে তাদের ট্রেনিং দেয়া হয়। এসময় ক্যাপ্টেন পান্না পাকিস্তান থেকে কোন রকমে সীমান্ত অতিক্রম করে পালিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। তিনি গোলন্দাজ বাহিনীর লোক ছিলেন। ক্যাপ্টেন পান্না রাত দিন খেতে আমাদের এই গোলন্দাজ বাহিনীকে ট্রেনিং করিয়ে শত বাঁধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে মোটামুটি যুদ্ধের জন্য উপযোগী করে তোলেন। এভাবে বাংলাদেশের প্রথম গলন্দাজ বাহিনীর জন্ম হয়। জন্মের পর থেকে ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে জুলাই মাস থেকে আমরা কয়েকটি সাবসেক্টরে কমান্ডার অপারেশনকে ফলপ্রসূ করে তোলে। বিশেষ করে সালদা নদী, কোনাবনে প্রথম এই রেজিমেন্ট এর সহায়তার জন্যই পাকবাহিনীর বারবার আক্রমণ ক্যাপ্টেন গাফফার এবং মেজর সালেক প্রতিহত এবং পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন পাশার নেতৃত্বে আমাদের সদ্য ট্রেনিংপ্রাপ্ত গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা অনেকসময় এমন ভাবে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়েছে যে গোলন্দাজ বাহিনীর ইতিহাসে তা বিরল। পাকসেনাদের নিকট ছিল অত্যাধুনিক কামান, আর সেসব কামানের গোলা নিক্ষেপের ক্ষমতা ছিল বেশী। সব সময় পাকসেনাদের চেষ্টা ছিল তাদের কামানের গোলাতে আমাদের এই ছোট পুরাতন কামানগুলিকে বিনষ্ট করে দেয়া। সেজন্য দিনরাত আমাদের প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট কোন জায়গাতেই বেশিক্ষণ এক স্থানে থাকতে পারতোনা। সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানীদের অর্ধেক গোলা তাদের উপর পড়ে। তাছাড়া আমাদের পুরাতন কামানগুলির গোলা ক্ষেপণের দূরত্ব ছিল পাকিস্তানীদের অর্ধেকের কম। সে কারণে অধিকাংশ সময় আমাদের প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট এর লোকেরা তাদের কামানগুলি মাথায় করে নিকটে বা পশ্চাতে দুর্গম রাস্তায় নিয়ে যেত এবং শত্রুদের উপর আক্রমণ করত। এসব আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে পড়ত। ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট এর কৌশল কতকটা কমান্ডো ধরণের। পরবর্তী পর্যায়ে প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট আমাদের মুক্তিবাহিনী যখন ডিসেম্বর মাসে ফেনী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়, তখন কে ফোর্সের ৪র্থ বেঙ্গল, ১০ ম বেঙ্গল এবং ৯ম বেঙ্গলকে পাক বাহিনীদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সাহায্য করে। গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য হবে এটা গৌরবের দৃষ্টান্ত।

জুলাই মাসের ১২ তারিখে লেঃ হুমায়ুন কবির সি এন্ড বি রাস্তার উপর একটি প্লাটুনের পেট্রল পাঠায়। এই পেট্রোলটি শত্রুর গতিবিধি সম্বন্ধে খবরাখবর নেবার জন্য কুটি পর্যন্ত অগ্রসর হয়। দুপুর দুটার সময় এই পেট্রোল পার্টি যখন কুটির নিকট দিয়ে টহল দিচ্ছিল তখন তারা দেখতে পায় অনেক গাড়িতে কুমিল্লা থেকে পাকিস্তানীরা সৈন্য সমাবেশ করছে। কুটিতে গাড়ী থেকে নেমে ওদের একটি ব্যাটালিয়নের মত দল মন্দভাগ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আমাদের পেট্রোলটি বুঝতে পারে যে, এই পাকসেনারা নয়নপুর, মন্দভাগ বাজারের দলটি বাজারের দিকে এসে অবস্থান নেয় এবং দোকানের ভিতর বাঙ্কার তৈরি করতে থাকে। এছাড়া তাদের অবস্থানের চতুর্দিকে পাট এবং ধান কেটে পরিষ্কার করে ফেলে যাতে তাদের গুলি সামনে আমাদের অবস্থানে এসে পড়ে। এসব সংবাদ পেট্রোল হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে। সংবাদ পাবার পর আমি পাকসেনাদের ঘাঁটিগুলি শক্তিশালী হয়ে ওঠার আগেই তাদের উপর আঘাত হানার সিদ্ধান্ত নেই। ক্যাপ্টেন গাফফারকে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানি দিয়ে ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্টের কামানগুলি মন্দভাগ বাজারের নিকট পর্যন্ত অগ্রসর হয়। সন্ধ্যা হবার আগেই ছোট ছোট কয়েকটি দল পাঠিয়ে বাজারটি এবং শত্রু অবস্থানটি সম্পূর্ণ খবরাখবর নেয়। সন্ধ্যায় ক্যাপ্টেন গাফফার তাঁর কোম্পানি এবং ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্টের সহায়তায় মন্দভাগ বাজারের শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আমাদের কামানগুলি গোপন পথে নৌকাযোগে বাজারের পার্শবর্তী গ্রামে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন গাফফারের আক্রমণের ঠিক পূর্ব মূহুর্তে কামাগুলি থেকে অতি নিকতবর্তী শত্রু অবস্থানের বাঙ্কারগুলি এবং বাজারের ঘরগুলিকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে, ফলে অনেক বাঙ্কার এবং ঘর ধ্বংস হয়ে যায় এবং বাজারে অবস্থিত পাকসেনারা আহত ও নিহত হয়। এত নিকট থেকে অতর্কিত কামানের গোলার আক্রমণ পাকসেনারা আশা করতে পারেনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাকসেনাদের অন্তত ৬০/৭০ জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের আর্তনাদ এবং চিৎকার আমাদের লোকরাও শুনতে পায়। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের প্রতিরোধশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে এবং তারা অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে যায়। দুঘণ্টা যুদ্ধের পর মন্দভাগ বাজার এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র ক্যাপ্টেন গাফফারের দখলে আসে। এর পরদিন আমাদের একটি পার্টি শালদা নদীতে এম্বুশ পাতে। পাকসেনাদের একটি স্পিডবোট দুপর ১টায় এম্বুশ পড়ে যায়। এম্বুশ পার্টির গুলিতে স্পিডবোটটি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ২০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। কেউ কেউ নদীতে পড়ে ভেসে যায়। এম্বুশ পার্টিটি পরে নিরাপদে মন্দভাগ অবস্থানে আসে। আমাদের হেডকোয়ার্টারে খবর পাই যে , দাউদকান্দিতে পাকসেনারা ফেরিঘাটের নিকটে ঘাঁটি স্থাপন করেছে। এখানে প্রায় দুকোম্পানির মত পাকসেনা বাঙ্কার নির্মান করে ঘাঁটিটি বেশ শক্তিশালী করে তোলে। এখানে পাকসেনারা ঢাকা-কুমিল্লাগামী প্রতিটি গাড়ি দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালায়। তাছাড়া নিকটবর্তী একটা স্পিডবোটে টহল দেয়। আমরা একটি প্লাটুন দাউদকান্দিতে পাঠিয়ে দেই। এদের সঙ্গে আরেকটি দল পাঠানো হয় সৈয়দনগর ওয়ারলেস স্টেশন এবং ইলিয়টগঞ্জ রাস্তার সেতু ধ্বংস করার জন্য। আমাদের দলগুলি দাউদকান্দিতে যেয়ে গৌরীপুর নামক স্থানে তাদের ঘাঁটি তৈরি করে। এরপর শত্রুদের গতিবিধি সম্বন্ধে খবর নেয়। ১৩ই জুলাই সন্ধ্যা ৮টার সময় প্লাটুনটি দাউদকান্দির উত্তরে গোমতী নদীতে পাকসেনাদের একটি টহলদারি স্পিডবোটকে এম্বুশ করে। এই এম্বুশে একজন লেফটেন্যান্ট এবং ২০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অফিসারটির র‍্যাঙ্কের ব্যাজ এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসা হয়। এরপর এই দলটি পরদিন রাতে সৈয়দনগর ওয়ারলেস স্টেশন ধ্বংস করে দেয়। দলে ওপর অংশ ইলিয়টগঞ্জ নতুন সেতুটি ডেমলিশন লাগিয়ে দুটি স্প্যান উড়িয়ে দেয়। তাদের কাজ সম্পূর্ণ করে দলগুলো নিরাপদে হেডকয়ার্টারে ফেরত আসে।

কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তায় হাজীগঞ্জের নিকট রামচন্দ্রপুরের ব্রিজ উড়িয়ে দেয়ার পর পাকসেনাদের যোগাযোগ ব্যাবস্থার বেশ অসুবিধা হয়। পাকসেনারা ঐ জায়গাতে ফেরীর বন্দোবস্ত করে। এই ফেরী যোগাযোগ বিনষ্ট করার জন্য লেঃ মাহবুব একটি কোম্পানি রামচন্দ্রপুরে পাঠায়। ৬ই জুলাই ভোরে এই দলটি রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটের নিকট এসে এম্বুশ পাতে। ঐ দিনই সকাল ৭টার সময় পাকসেনাদের একটি দল রামচন্দ্রপুর ফেরিঘাটে আসে। তাদের জিনিসপত্র তখন ফেরিঘাটে উঠছিল ঠিক সেই সময় এম্বুশ পার্টি তাদের উপর গুলি চালায়। এতে পাকসেনাদের ৪জন নিহত হয়। উভয়পক্ষে প্রায় ঘণ্টা খানেক গোলাগুলি চলে। গোলাগুলির সংবাদ পেয়ে চাঁদপুর থেকে পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য সাহায্যের জন্য আসে। পাকসেনারা ফেরিঘাটের কিছু দূরে এসে গাড়ী থেকে নামে এবং এম্বুশ অবস্থানে অগ্রসর হবার জন্য প্রস্তুত হয়। ঠিক সেই সময়ে আমাদের অন্য এম্বুশ পার্টিটি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে পাকসেনারা সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের ৩১ জন নিহত এবং ৫৪ জন আহত হয়। আমাদের এন সি ও এবং একজন সিপাই গুরুতর আহত হয়। এরপর আমাদের দলটি এম্বুশ অবস্থান পরিত্যাগ করে। আসার পথে ৮ই জুলাই মুদ্দাফরগঞ্জ সড়কসেতুটি উড়িয়ে দিয়ে আসে। এর পর পাকসেনারা সেতুটির নিকতবর্তী কয়েকটি গ্রামে মর্টারের সাহায্যে গোলাগুলি করে। সে সময়ে পাকসেনাদের অভ্যর্থনার জন্য অনেক স্থানীয় দালাল শান্তি কমিটি সভার আয়োজক এবং মিছিল করে পাকসেনাদের অভ্যর্থনার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এই মিছিলের উপর গুলি চালিয়ে অনেককে তাদের হত্যা করে।

আমাদের চাঁদপুর কোম্পানি যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করার কার্যকলাপ আরও বৃদ্ধি করে। স্থানীয় লোকদের সহায়তায় হাজীগঞ্জ এবং লাকসাম, চাঁদপুর ও কুমিল্লার সি এন্ড বি রাস্তা ও রেলওয়ে সড়কের ২০০ গজ কেটে ধ্বংস করে দেয়া হয়। এ সময়ে পাকিস্তানীরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ইঞ্জিনিয়ার, ইঞ্জিন ড্রাইভার এবং শ্রমিক এনে রাস্তা মেরামত করার চেষ্টা চালায়। আমাদের গেরিলারা এইসব পাকিস্তানী রেলওয়ে কর্মচারিদের মেরে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়। এর ফলে রেল এবং সড়ক যোগাযোগ সম্পুর্ন বন্ধ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে ২৬শে জুলাই পাকবাহিনী একটি কোম্পানিকে চাঁদপুর থেকে এই এলাকায় পাঠায়। পাকসেনাদের এই কোম্পানিটি রেলওয়ে লাইনের সঙ্গে সঙ্গে লাকসামের দিকে অগ্রসর হয়। ঠাকুর বাজারের নিকট আমাদের একটি এম্বুশ পার্টি আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছিল। দুপুর ২টার সময় পাকসেনাদের এই কোম্পানিটি যখন এম্বুশ অবস্থানের মাঝে আসে তখন আমাদের দলটি তাদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে পাকসেনাদের একজন জে সি ও সহ ২২জন পাকসেনা আহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে চাঁদপুর পলায়ন করে। এর পরদিন গেরিলারা মধু রেলওয়ে স্টেশনের নিকট রেলওয়ে এবং সড়ক সেতু ধ্বংস করে দেয় এবং যে পাকিস্তানী ইঞ্জিনিয়ার পরিদর্ষনের জন্য আসে তাকেও আহত করে।

আমাদের ঢাকার গেরিলা দল তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। ব্রিটিশ সরকারের একটি পার্লামেন্টারি দল বাংলাদেশের সে সময়ের পরিস্থিতি সারেজমিনে জানার জন্য ঢাকায় আসে। এই দলটি ঢাকা ইন্টার কন্টিনেন্টাল হোটেলে অবস্থান করছিল। ২৪শে জুন সকাল সাড়ে ৭টায় হোটেলের ভিতরে লবিতে বসে বিমান বন্দরে যাবার অপেক্ষা করছিল। ঠিক সে সময়ে আমাদের ৩ জন গেরিলা হোটেলের সামনে বারান্দায় দুটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায় এবং পরিষদীয় দলটিকে ঢাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করায়। এর কদিন পর আমাদের গেরিলারা জানতে পারে যে নারিন্দায় গউরিমা মন্দিরে পাকিস্তানীদের অনেক দালাল সমবেত হয়ে আলোচনার আয়োজন করছে। দালালরা যখন আলোচনায় ব্যাস্ত ঠিক সেই সময়ে আমাদের গেরিলারা আলোচনায় একটি বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে প্রায় ২০/২৫ জন পাক দালাল হতাহত হয়। ঢাকার গেরিলা দল টি এন্ড টি বিভাগের একজন পাকিস্তানী উর্ধতন কর্মচারির গাড়ীতে এম-১৪ মাইন দিয়ে বুবিট্র্যাপ লাগিয়ে রাখে। ফলে পাকিস্তানী অফিসারটি গাড়ীসুদ্ধ শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানী অফিসাররা মাঝে মাঝে ধানমন্ডির সাংহাই চাইনিজ রেস্টুরেন্টে সান্ধ্যভোজে আসত। এই সংবাদ পাবার পর আমাদের একটি গেরিলা দল ৮ই জুলাই রাত ৯টায় পাকিস্তানী অফিসাররা সেখানে আসলে তাদের উপর গ্রেনেড ছোঁড়ে। ফলে ২/৩ জন পাকিস্তানী অফিসার নিহত হয়। পাকিস্তানী পুলিশরা এ সময়ে রাতে ট্যাক্সিতে বা জিপে ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় পেট্রলিং করত। এসব টহলদার পাকিস্তানী পুলিশদের এম্বুশ করার জন্য ঢাকার গেরিলা দল একটি পরিকল্পনা নেয়। তাদের গতিবিধি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবরাখবর নেয়া হয়। ১০ই জুলাই একটি পাকিস্তানী টহলদার পুলিশ পার্টি ধানমণ্ডির রাস্তা নং ২ এর দিকে যাচ্ছিল। গেরিলাদের একটি পার্টি তাদের পিছি নেয়। পুলিশের পেট্রোলটি ২ নং রাস্তার মোড়ে যখন তেদের গতি কমিয়ে দেয় ঠিক সে সময়ে গেরিলারা তাদের গাড়ীতে একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। সঙ্গে সঙ্গে গাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায়। এতে একজন অফিসার সহ ৫ জন পাকিস্তানী পুলিশ নিহত হয়। আমাদের গেরিলা দলটি নিরাপদে সে স্থানটি পরিত্যাগ করে। এর কদিন পর আমাদের আরেকটি গেরিলা দল নিউ বেইলি রোডে পাকবাহিনীর একটি জিপের ওপর এক্রমন চালায়। এই আক্রমণে ৩/৪ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং জিপটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত আমাদের গেরিলা দলটি পোস্ট অফিসের ভিতর বিস্ফোরণ ঘটায় এবং মণ্ডলপাড়া ও চৌধুরীবাড়ী ইলেকট্রিক সাবস্টেশনটি ১২ই জুলাই রাত সাড়ে ১০টার সময় ধ্বংস হয়। এছাড়া সিদ্ধির নগর ও আশুগঞ্জের সাথে একটি বৈদ্যুতিক পাইলন উড়িয়ে দেয়। সিদ্ধিরগঞ্জ এবং নরসিংদীর মাঝে দুটি বৈদ্যুতিক পাইলন ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে কাঞ্চন এবং কালীগঞ্জের বেশ কয়েকটি শিল্প কারখানা বিদ্যুতের ওভাবে বন্ধ হয়ে যায়। এর কিছুদিন পর ফতুল্লা এবং ঢাকার মাঝে পাগলা রেলওয়ে সেতুটি উড়িয়ে দেয়। ফলে নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার মাঝে ট্রেন যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এসময়ে আমার হেডকোয়ার্টারে খবর আসে যে পাক সরকার পাক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই পরীক্ষাকে বানচাল করে দেয়ার জন্য আমরাও একটা পরিকল্পনা নেই। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমার হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকার গেরিলা দলগুলিকে নির্দেশ পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী পরীক্ষার দিন সিদ্ধেশ্বরী স্কুল এবং আরও অন্যান্য স্কুলে পরীক্ষার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে বিস্ফোরণ ঘটান হয়। ফলে খুব কম সংখ্যক ছেলেমেয়ে পরীক্ষা দেয়ার জন্য পরীক্ষা হলে আসে। ১৫ই জুলাই রাতে এই গেরিলা দল বকশীবাজারে অবস্থিত বোর্ড অফিস আক্রমন করে। ডিমলিশন দিয়ে বোর্ড অফিসের কিছু অংশ উড়িয়ে দেয়া হয়। তর ফলে বোর্ডের বেশ কিছু দলিল এবং কাগজপত্র ধ্বংস হয়ে যায়। এর ফলে এই পরীক্ষা প্রহসনে পরিণত হয় এবং অনেক ছাত্র ছাত্রী ইচ্ছাকৃতভাবেই পরীক্ষা বর্জন করে।

হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে আমাদের মুরাদনগরের দলটি ১৬ঈ জুলাই রাত ১টার সময় ইলিয়টগঞ্জের দেড় মাইল পশ্চিমে পুঁতিয়া গ্রামের সামনে কুমিল্লা-দাউদকান্দি সড়কের উপর কয়েকটি এন্টি ট্যাঙ্ক মাইন পুঁতে রাখে। পরদিন সকালে পাকবাহিনীর নিয়ন্ত্রণাধীনে একটি অয়াপদা ট্রাক মাইনের উপর বিস্ফোরিত হয়। ফলে ট্রাকটি ধ্বংস হয়ে যায়। ট্রাকে অবস্থানরত একজন পাকসেনা , দুজন রাজাকার ও ড্রাইভার সহ সবাই নিহত হয়। ফলে ৫জন পাকসেনা, ১ জন মেজর ও ৬জন রাজাকার নিহত হয়। এই সংবাদ পেয়ে কুমিল্লা থেকে পাকসেনারা ৩০টি গাড়িতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। পাকসেনাদের গাড়িগুলি ঘটনাস্থল থেকে অনেক দূরে এসে দাড়ায়।

সামনের গাড়ী থেকে বেশ কিছু সংখ্যক পাকসেনা নেমে আস্তে আস্তে ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। তারা রাস্তার পাশ দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। অগ্রসর হবার সময় আমাদের পুঁতে রাখা এন্টি পার্সোনাল মাইনের বিস্ফোরণে তাদের ৬/৭ জন বিস্ফোরিত হয় এবং আরও অনেক আহত হয়। এরপর পাকসেনারা আর সম্মুখে অগ্রসর হয়নি। সমস্ত দিন পাকসেনারা মাইন ডিটেক্টরের সাহায্যে ঘটনাস্থলের চতুর্দিকে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালায়। সমস্ত বেসামরিক যাতায়াতও বন্ধ হয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা পার্শবর্তী গ্রাম গুলিতে মুক্তি বাহিনীর সন্ধানে তল্লাশি শুরু করে। হাবিলদার গিয়াসের দলের একজন নায়েক মস্তফা কামাল স্থানীয় লোকদের সাথে মিশে পাকসেনাদের দুরবস্থা দেখে। দাউদকান্দি থেকে পশ্চিম নারায়ণগঞ্জে এবং দাউদকান্দি সড়কের উপর বাউসিয়ায় একটি গুরুত্তপূর্ণ সেতু ছিল। এই সেতুটি সম্পূর্ন কংক্রিটের তৈরি। এবং বেশ মজবুত। এই সেতুটি ধ্বংস করার জন্য জুলাই মাসের প্রথমে আমি মোঃ রফিক নামে বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত গেরিলাকে মনোনীত করি। তার সঙ্গে আরেকটি গেরিলাকে দিয়ে এই সেতু রেকি করার জন্য পাঠাই। মোঃ রফিক সেতুটি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে রেকি করে এবং একটি নকশা বানিয়ে নিয়ে আসে। এরপর অধ্যাপক মুনির চৌধুরীর ছেলে ভাষণের নেতৃত্বে ১০ জনের একটি ডিমোলিশন পার্টিকে রফিকে সঙ্গে নিয়ে বাউসিয়া সেতুটি ধ্বংস করার জন্য পাঠিয়ে দেই। এই দলটি প্রথম মুরাদনগরে গিয়ে তাদের স্থায়ী ঘাঁটি করে। এর পর তারা গোমতী নদী পাড় হয়ে বাউসিয়াতে পৌঁছে। সেখানে একদিন থাকার পর স্থানীয় গেরিলাদের সাহায্য নিয়ে ১২ই জুলাই রাতে বাউসিয়া সেতুতে ডিমলিশন লাগায়। কিন্তু ডেমলিশন বিস্ফোরণের সময় ইগ্নিশন ঠিকমত কাজ করেনা। ইত্যবসরে স্থানীয় ডালা চেয়ারম্যান এবং রাজাকার পাকবাহিনীদের খবর দেয়। পাকবাহিনী এবং রাজাকার অকস্মাৎ ভাষণের ডিমলিশন পার্টির উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ভাষণের দলের ৩ জন গেরিলা গুরুতরভাবে আহত হয়। এই ৩ জনের মধ্যে একজন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রাজ্জাক কোরাইশই ও ছিল। গেরিলা দলটি ইগ্নিশন কাজ না করার দরুন সেতু উড়িয়ে দিতে ব্যার্থ হয়ে পাকবাহিনীর আক্রমণের চাপে অবস্থান পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর ফলে আমাদের যথেষ্ট ক্ষতি হয়। যদিও আহত গেরিলাদের সঙ্গে আনতে সক্ষম হয় কিন্তু যেসব বিস্ফোরক সেতুটিতে লাগানো হয়েছিল সেগুলি উঠিয়ে আনা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। এবং তারা ২৬০ পাউন্ড আই এন টি সেখানেই ফেলে রেখে হেড কোয়ার্টারে ফেরত আসে। এত বিরাট পরিমাণ আই এন টির শত্রুর হাতে পড়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া আমাদের পক্ষে একটা বিরাট ক্ষতির কারণ। ঐ সময়ে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি আমাদের খুব কম ছিল। অনেক চেষ্টার পর হয়তো কিছু কিছু আমরা যোগাড় করতে সক্ষম হতাম। ধাকা-কুমিল্লা রাস্তা বন্ধ কোরে দেয়া আমার লক্ষ ছিল। সেই লক্ষ এইভাবে ব্যার্থতায় পর্যবসিত হওয়ায় আমি যথেষ্ট চিন্তিত হয়ে পড়ি। এবং পড় পরই আবার বিস্ফোরক জোগাড়ের চিন্তায় থাকি। ২/৩ সপ্তাহ পরে অনেক কষ্টে আবার কিছু পরিমাণ আই এন টি সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। আই এন টি জোগাড়ের পড় আমি মোঃ রফিকে ডেকে পাঠাই। শেষ পর্যন্ত আমরা বাউসিয়ার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করতে সমর্থ হয়েছিলাম। লাটুমুরাতে লেঃ হুমায়ুনের নেতৃত্বে যে কোম্পানি অবস্থান নিয়েছিল সেই অবস্থানের উপর পাক বাহিনী তাদের চাপ অব্যাহত রাখে। লাটুমুরার অবস্থান থেকে আমাদের বিতাড়িত করার চেষ্টা করে। লেঃ হুমায়ুনের কোম্পানিটি পাক বাহিনীর প্রচণ্ড চাপের মুখেও তাদের অবস্থানটি সাহসের সঙ্গে ধরে রাখে। মুক্তিযোদ্ধারা এই অবস্থান থেকে প্রায়ই পাকসেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালাতে থাকে। ১৭ই জুলাই বিকেল ৪টায় আমাদের ও-পি দেখতে পায় যে লাটমুড়া থেকে একটি শত্রুদল চন্দ্রপুর শত্রুঅবস্থানের দিকে এগিয়ে আসছে। লেঃ হুমায়ুন কবির তৎক্ষণাৎ একটি প্লাটুন চন্দ্রপুরের রাস্তায় পাকসেনাদের এম্বুশ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুনটি চন্দ্রপুর থেকে একটু দূরে অবস্থান নিয়ে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা যখনি সেই অবস্থানে পৌঁছে ঠিক তখনি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালানো হয়। ফলে ৪জন পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়। পাকসেনারা এম্বুশ থেকে বাঁচার জন্য লাটুমুড়ায় পলায়ন করে।

২০শে জুলাই সকাল ৯টার সময় একটি প্লাটুন পাকসেনাদের ইয়াকুবপুর , চন্দ্রপুর এবং বাগানবাড়ি অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ করার জন্য পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি গোপন পথে গ্রামের ভিতর দিতে পাকসেনাদের অবস্থানের অতি নিকটে যেতে সমর্থ হয়। রেকি করার পড় তারা দেখতে পায় যে, পাকসেনাদের কিছু লোক বিভিন্ন বাঙ্কারের উপর বসে চা পান করছে, এবং তাদের প্রহরার ব্যাবস্থা শিথিল। এছাড়াও আরও ৩/৪ টি দল বাঙ্কারের উপর দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের একজন ও-পি গাছের উপর বসা ছিল। আমাদের প্লাটুনটি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে অগ্রসর হয়ে তাদের বাঙ্কারগুলির উপর আক্রমণ চালায়। গোলগুলিতে যেসব পাকসেনা বাঙ্কারের উপর বসে চা পানে ব্যাস্ত ছিল এবং দাঁড়িয়েছিল তারা সঙ্গে সঙ্গে আহত ও নিহত হল। নিকতবর্তী একটি ঘর থেকে কিছু পাকসেনা বেরিয়ে আসে এবং বাঙ্কারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে তারাও আহত ও নিহত হয়। এরপর পাকসেনাদের প্রতি এক্রমন করারা আগেই আমাদের প্লাটুনটি অবস্থান ত্যাগ করে নিজেদের এলাকায় নিরাপদে ফিরে আসে। এই সঙ্ঘর্ষের ফলে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। আমাদের একজন গুরুতর ভাবে আহত হয়।

শালদা নদীতে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং সি কোম্পানি তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। পাকসেনারা শালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন থেকে নারায়নপুরের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করছিল। ১৭ই জুলাই তাদের একটি দল রেলওয়ে স্টেশনের প্রায় এক হাজার গজ দক্ষিণে মনোরা রেলওয়ে ব্রিজ পর্যন্ত অগ্রসর হয়। ব্রিজের কাছে এসে পাকসেনাদের দলটি ব্রিজের চতুর্দিকে বাঙ্কার তৈরির প্রস্তুতি নেয়। বেলা সাড়ে ১২টার সময় এ কোম্পানির একটি প্লাটুন মর্টার সহ পাকসেনাদের এই দলটির উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণের ফলে পাকসেনারা সম্পূর্ণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের বেশকিছু লোক আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা উপায়ান্তর না দেখে আবার শালদা নদীতে পিছু হটে যায়। পরদিন সকাল ৯টার সময় শালদা নদী থেকে পাকসেনারা আবার মনোরা ব্রিজের দিকে অগ্রসর হয়। সকাল ৯টায় আমাদের সৈনিকরা আবার তাদের বাঁধা দেয়। এবং পাকসেনাদের উপর মর্টার এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। ফলে পাকসেনাদের ৪জন লোক নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। পাকসেনারা আর অগ্রসর না হয়ে পিছু হটে মনোরা ব্রিজের উত্তরে অবস্থা নেয়। ১৯শে জুলাই পাকসেনারা ব্রিজের দক্ষিণে আবার অবস্থান নেয় বাঙ্কার খোঁড়ার চেষ্টা করে। এবারো পাকিস্তানীরা আমাদের মর্টার , কামান এবং মেশিনগানের গোলাগুলিতে অনেক হতাহত হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। পরে স্থানীয় লোকের কাছে জানা যায় যে, পাকসেনারা আহত ও নিহত সঙ্গীদের নৌকায় করে পিছনে নিয়ে যায়। এদের সঠিক সংখ্যা সম্বন্ধে তাৎক্ষনিকভাবে সংবাদ জানা না গেলেও পরে যানা যায় ৮ জন নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়। ২১শে সন্ধ্যায় ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানির একটা প্লাটুন শালদা নদীর অবস্থানের ভিতর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ৮জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়। দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের দলটি শত্রু অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ঘাঁটিতে ফিরে আসে। এই আক্রমণের সাথে আমাদের ফার্স্ট ফিল্ড রেজিমেন্ট পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে বহু পাকসেনাকে হতাহত করে। জুলাই মাসে কুমিল্লায় পাকসেনারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য যথেষ্ট চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিল এবং কিছুটা সফলও হয়েছিল। এ সময় কুমিল্লা শহরের ভিবিন্ন স্থানে পাকসেনারা তাদের ক্যাম্প গড়ে তুলেছিল। এসব ক্যাম্প থেকে তাড়া ঘন ঘন টহল চালাত। কুমিল্লায় পাকসেনাদের এই তৎপরতা খর্ব করার জন্য আমাদের গেরিলাদের ২০ জনের একটি দল একটি ৩ ইঞ্চি মর্টারসহ কুমিল্লার উত্তরে অনুপ্রবেশ করে। ২০শে জুলাই সকাল সাড়ে ১০টার সময় গেরিলাদের এই দলটি কুমিল্লা শহরে পাকসেনাদের বিভিন্ন অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে গোলা নিক্ষেপ করে। একটি গোলা আজাদ স্কুলে, একটি গোলা সাধনা ঔষধালয়ের নিকটে, একটি গোলা গোয়ালপত্রীতে, একটি গোলা কালীবাড়ির নিকটে এবং একটি গোলা এস ডি ওর অফিসের নিকটে বিস্ফোরিত হয়। গোলাগুলি বিস্ফোরণের ফলে পাকসেনাদের মনোবল ভেঙ্গে যায় এবং ভিতসন্ত্রত হয়ে কুমিল্লা সেনানিবাসের দিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সদ্য আগত সেনারা মনোবল হারিয়ে ফেলে। অনেক পাকসেনা স্থানীয় লোকদের সেনানিবাসের রাস্তা জানতে চায়। আবার অনেকে ভয়ে ব্রিজের তলায় লুকিয়ে পরে। আবার কুমিল্লাতে যখন গেরিলারা তাদের তৎপরতা চালাচ্ছিল ঠিক সে সময়ে গেরিলাদের আর একটি দল চাঁদপুরেও তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১৭ই জুলাই রাত ১০টায় বাবুর হাটের পূর্বে কুমিল্লা-চাঁদপুর রাস্তায় আশিকাটি গ্রামের নিকট পাকসেনাদের একটি কনভয় যখন যাচ্ছিল তখন আমাদের গেরিলারা গাড়ীতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করল। ফলে ৮ জন পাকসেনা নিহত ও আরও অনেকে আহত হয়। ১০শে জুলাই দুপুর ১টার সময় বাবুরহাটে পাকসেনাদের একটি গাড়ীর উপর গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এর ফলে ৫ জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন আহত হয়।

১১ই জুলাই বিকেল সাড়ে ৬টায় ২ জন গেরিলা চাঁদপুর পাওয়ার স্টেশনের সামনে পাহারারত ২জন পাকসেনা ও ২ জন পাকিস্তানী পুলিশের উপর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের হত্যা করে।

চাঁদপুরে শান্তি কমিটির দালালদের একটি আলোচনা সভায় গ্রেনেড নিক্ষেপ করার পর ৭ জন দালাল আহত হয়। এ ছাড়াও ইলিয়টগঞ্জে পাকসেনাদের স্থানীয় এক দালালের লঞ্চে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এ সমস্ত কার্যকলাপের ফলে স্থানীয় লোকদের মনোবল আরও বেড়ে যায়। তাদের মুক্তিবাহিনীর উপর আস্থা আবার ফিরে আসে।

কসবার উত্তরে কাশিমনগর রেলওয়ে সেতুর নিকট পাকিস্তানীদের ডুটি প্লাটুন অবস্থা নিয়ে সেতুটি প্রহরার কাজে নিযুক্ত ছিল। এই সেতুটিকে ধ্বংস করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনকে নির্দেশ দেই। নির্দেশ পেয়ে ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন সেতুটি রেকি করার জন্য ডিমলিশন এক্সপার্ট সহ একটি রেকি পাঠায়। এই রেকি পার্টি শত্রুঅবস্থান সম্বন্ধে এবং সেতুটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর দিয়ে আসে। এরপর ১৮ই জুলাই রাত ২টায় একটি রেইডিং প্লাটুন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে কাশিমপুর সেতুর উদ্যেশ্যে রওনা দেয়। রাত ৮টার সময় সেতুটির নিকতবর্তী পাক অবস্থানের উপর প্লাটুনটি আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ১৭ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং যারা বেঁচে ছিল তাড়া অবস্থান ত্যাগ করে খাইরাতুল্লাতে পালিয়ে যায়। আমাদের রেইডিং পার্টি সেতুটিকে বিস্ফোরণ লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের অবস্থান থেকে অনেক অস্ত্র উদ্ধার করে। আমি যখন কুমিল্লা ও নোয়াখালী এলাকায় যুদ্ধে ব্যাস্ত ছিলাম, সে সময় শত্রুদের খবরাখবর নেবার জন্য একটি ৬ ইন্টিলিজেন্স নেট স্থাপন করি। এদের দায়িত্ব ছিল শত্রুদের সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর আমাদের নিকট প্রেরণ করে। বিশেষ করে এইসব ইন্টিলিজেন্স এ এমন কতগুলো লোক কাজ করত যাদের সম্বন্ধে কিছু কোথা বলার দরকার। যেমন লাটু মিয়া। সে কুমিল্লা সেনানিবাস হাসপাতালে মালীর কাজ করত। সে আমাদের খবর পাঠায় সেনানিবাসে পাকসেনাদের ডুটি ব্রিগেড আছে এবং সেখানে একটি ডিপ হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া ৫০০-৬০০ রাজাকার এবং রেঞ্জার মোতায়েন করা হয়েছে। সে আরও খবর পাঠায় কুমিল্লা সেনানিবাসের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা খুবই উত্তম এবং মজবুত করা হয়েছে এবং এই প্রতিরক্ষাবুহ্য বাইরে উত্তরে গোরা কবরস্থান পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে।

কুমিল্লা বিমানবন্দরেও একটি ব্যাটালিয়ন শক্তিশালী প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করা হয়েছে।

কুমিল্লা এবং নোয়াখালী এলাকায় পাকসেনাদের শক্তি এক ডিভিশনেরও বেশী। কিন্তু পাকসেনাদের এত শক্তি থাকা সত্ত্বেও তাদের মনোবল বেশ কমে গেছে। সাধারণ সিপাইরা এই যুদ্ধের নইরাশ্যজনক ফলাফল সম্বন্ধে মন্তব্য করত। তাদেরকে জোর করে যুদ্ধে ব্যাবহার করা হচ্ছে। সে জন্য তাড়া যথেষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করত। তাদের মধ্যে পলায়নপর মনোভাব খুবই প্রবল। তাড়া যুদ্ধ এলাকা ছেড়ে নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যেতে ইচ্ছুক। আমাদেরকে আরও খবর পাঠায় যে, পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা খুবই বেশী। শুধু সেনানিবাস হাসপাতালেই প্রায় ৫০০-৬০০ জন আহত সৈনিক চিকিৎসাধীন আছে। হাসপাতালে স্থানের অভাবে তাঁবুর ভিতরে অনেক আহত সৈনিককে রাখা হয়েছে এবং গুরুতর আহত সৈনিকদের পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। আহতের সংখ্যা এত বেশী হওয়ার জন্য সাধারণ মনোবল ভেঙ্গে পড়েছিল। কুমিল্লা শহরে আমাদের এবং পাকিস্তানীদের তৎপরতার ফলে লোকজন শহর ছেড়ে গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক শহরবাসী পরিচয়পত্র ছাড়া শহরে বেড় হটে পারছেনা। কুমিল্লার উত্তরে পাকসেনারা আমাদের কোটেশ্বর অবস্থান পুনর্দখলের জন্য চেষ্টা চালায়। ২৪শে জুলাই পাকসেনাদের একটি কোম্পানিগঞ্জ পার হয়ে কোটেশ্বরের দিকে অগ্রসর হটে থাকে। সকাল ১০টায় পাকসেনাদের কোম্পানিটি যখন আমাদের অগ্রসর অবস্থানের সামনে পৌঁছে যায়, তখন আমাদের মুক্তিবাহিনী সৈনিকরা তাদের উপর মর্টার এবং হাল্কা মেশিনগানের সাহায্যে তাদের অগ্রসরে বাঁধা দেয়। আমাদের গোলাগুলিতে পাকসেনারা প্রচুর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও পাকসেনারা তাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারাও সাহসের সাথে তাদের আক্রমণ পরিত্যাগ করে ২ ঘণ্টা পরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই সঙ্ঘর্ষের ফলে পাকসেনাদের ১৫জন হতাহত হয়। পাকসেনারা সমস্ত দিন আমাদের অবস্থানের উপর কামানের গোলা নিক্ষেপ করে।

ঐ দিনই কোটেশ্বর এবং কসবা অবস্থান থেকে দুই দল গেরিলা বুড়িচং থানার নিকট একটি সড়কসেতু, তিনটি বিদ্যুৎ পাইলন এবং কসবা এবং কসবার নিকট একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেয়া হয়। বেলুনিয়াতে আমাদের সৈন্যরা যখন পাকিস্তানীদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে লিপ্ত এবং পাকিস্তানীরা ফেনীর দিক থেকে বেলুনিয়া ব্রিজে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিল ঠিক সেই সময়ে পাকসেনারাও আমাদের পেছনে ধ্বংসাত্মক চেষ্টা চালায়। তারা কিছু সংখ্যক দালালকে এই কাজে নিয়োগ করে। এইসব দালালকে মাইনসহ আমাদের অবস্থানের পিছনে পাঠায়। দালালরা আমাদের লাইনের পিছনে রাস্তায় ৬টা এন্টিপার্সোনাল এবং ৯টা এন্টিট্যাঙ্ক মাইন লাগায়। কিন্তু স্থানীয় জনসাধারণের সতর্কতার জন্যই এন্টিট্যাঙ্ক মাইনগুলিতে আমাদের কোন ক্ষতি হয়নি। মাইন পোঁতার খবরটি একজন স্থানীয় লোক আমাদের বেলুনিয়া হেডকোয়ার্টারে পাঠায়। খবর পাওয়ামাত্র হেডকোয়ার্টার থেকে আমাদের ডিমলিশন বিশেষজ্ঞ দল গাইডের সঙ্গে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে তৎক্ষণাৎ মাইনগুলি নিষ্ক্রিয় করে দেয়। আমরা স্থানীয় লোকদের পাকিস্তানী ধ্বংসাত্মক তৎপরতা সম্বন্ধে সজাগ থাকতে বলি। এরপর যখনি পাকিস্তানী দালালরা এরকম ধ্বংসাত্মক কাজের জন্য আমাদের অবস্থানের পিছনে আসার চেষ্টা করেছে স্থানীয় জনগণ তাদের প্রচেষ্টাকে ব্যার্থ করে দিয়েছে। জুলাই মাসের শেষের দিকে লেঃ মাহবুব মিয়াবাজার, চাঁদপুর, হাজীগঞ্জ ইত্যাদি এলাকাতে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে তৎপরতা জোরদার করে। পাকসেনারা মিয়াবাজারে যে ক্যাম্প করেছিল সেখান থেকে কুমিল্লা-চট্টগ্রাম রাস্তা আবার খোলার চেষ্টা করে। লেঃ মাহবুব মিয়াবাজার শত্রুক্যাম্পটি রেইড করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এই দলটি সন্ধ্যায় মিয়াবাজারের নিকট পৌঁছে যায়। সেখান থেকে তাদের একটি ছোট রেকি দল পাকসেনাদের অবস্থান সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ খবর সংগ্রহ করে। রাত ১২টায় কমান্ডো দলটি গোপন পথে অগ্রসর হয়ে শত্রু অবস্থানের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই অতর্কিত হামলার জন্য পাকিস্তানীরা মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। তারা দিগ্বিদিকজ্ঞ্যানশুন্য হয়ে যায়। আমাদের কমান্ডো দলটি এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে পাকসেনাদের বেশ কয়েকটি বাঙ্কার গ্রেনেড ছুড়ে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা আক্রান্ত হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকে এবং আমাদের সৈনিকদের গুলিতে প্রায় ২০ জন নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। এক ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর আমাদের কমান্ডো দলটি পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষতিসাধন করে। শত্রুসেনাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে চলে আসে। চাঁদপুরে পাকিস্তানীরা তাদের ঘাঁটি আরও শক্তিশালী করে তোলে। চাঁদপুরের এই ঘাঁটি থেকে তারা জায়গায় গাড়ীতে পেট্রলিং করত। এইসব পেট্রলিং এর জন্য ২-৩ টি ৩ টনের ট্রাক কনভয় এর আকারে ব্যাবহার করত। এইসব পেট্রলিং ভোরে, দুপুরে, সন্ধ্যায় এবং রাত ১২টার পর পাকসেনারা চালাত। এবং প্রত্যেক গাড়ির ব্যাবধান ৫০ থেকে ১০০ গজের মধ্যে। এই সংবাদ স্থানীয় গেরিলারা লেঃ মাহবুবের কাছে পৌঁছে দেয়। খবর পেয়ে লেঃ মাহবুব দুটি প্লাটুন ২০শে জুলাই চাঁদপুরের পূর্বে পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুন দুটি চাঁদপুর থানার আশিকাটির নিকট এম্বুশ পাতে। পরদিন ভোর ৫টায় চাঁদপুর থেকে একটি পেট্রোল কনভয় আশিকাটির দিকে অগ্রসর হয়। কনভয়টি যখন এম্বুশ অবস্থানের মাঝে পৌঁছে যায় ঠিক তখনি আমাদের অ্যামবুশ পার্টি মেশিনগান এবং হাল্কা মেশিনগানের সাহায্যে গুলি চালায়। এর ফলে কনভয় এর প্রথম তিনটি জিপ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রাস্তা থেকে পড়ে যায় এবং অবশিষ্ট গাড়ীগুলিরও যথেষ্ট ক্ষতিসাধন হয়। পাকসেনারা গাড়ি থেকে নেমে পাল্টা আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের এম্বুশ পার্টির গুলিতে তাদের অন্তত ১০ জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়। পাকসেনারা গুলির মুখে টিকতে না পেরে পালিয়ে যায়। ঐ দিন আশিকাটির ৩ মাইল পশ্চিমে সন্ধ্যায় আমাদের আর একটি এম্বুশ পার্টি পাকসেনাদের আর একটি কনভয়কে অ্যামবুশ করে। ফলে পাকসেনাদের ৩ জন নিহত এবং ৫ জন আহত ও একটি ট্রাক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদ আমাদের এম্বুশ পার্টির হস্তগত হয়। এছাড়া একটি মটর সাইকেলও দখলে নেয়। এম্বুশের খবর পেয়ে পাকসেনারা তাদের হাজীগঞ্জ ক্যাম্প থেকে আমটি শক্তিশালী কোম্পানি আমাদের এম্বুশ পার্টিকে আক্রমণ করার জন্য পাঠিয়ে দেয়। এই কোম্পানিটি ১ ঘণ্টা পর ঘটনাস্থলে আসে। ততক্ষণে আমাদের এম্বুশ পার্টি সংঘর্ষ শেষে মোটামুটি প্রস্তুত হয়েই অপেক্ষা করছিল। পাকসেনারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের এম্বুশ পার্টি আবার তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এর ফলে পাকসেনাদের ১২ জন নিহত ও ১০ জন আহত হয়। এরপর আমাদের দলটি অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল হাজীগঞ্জের নিকট নরসিংপুরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটি থেকে পাকসেনারা ঐ এলাকার চতুর্দিকে ত্রাসের সৃষ্টি করে। এই ঘাঁটিকে আক্রমণ করার জন্য লেঃ মাহবুব নিয়মিত ও গণবাহিনীর একটি সম্মিলিত কোম্পানি পাঠিয়ে দেয়। এই কোম্পানিটি ১৭ই জুলাই তারিখ হাজীগঞ্জের দক্ষিণে তাদের অস্থায়ী গোপন অবস্থান তৈরি করে। এরপর পেট্রোল পাঠিয়ে পাকসেনাদের অবস্থান সম্বন্ধে তথ্য যোগাড় করে। ১৭ই জুলাই সন্ধ্যায় আমাদের কোম্পানিটি অতর্কিত পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১৩জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এরপর আমাদের কোম্পানিটি অতর্কিত পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের ১৩ জন নিহত ও অনেক আহত হয়। এরপর আমাদের কোম্পানিটি নিরাপদে নিজ অবস্থানে ফিরে আসে।

ফরিদপুরে আমাদের গেরিলা দল তাদের কার্যকলাপ জুন মাস্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে, তারা যেন বেসামরিক সাধন শাসন ব্যাবস্থা কে সম্পুর্ন অচল করে দেয়। এই প্ররিপ্রেক্ষিতে ১২জিন গেরিলারা চিকা নিদই এবং মুন্সেফ অফিস ধ্বংস করে সমস্ত অফিসিয়াল কাগজপত্র জ্বালিয়ে দেয়। ১৮ই জুলাই একটি দল গসাইরহাট থার দামুদিয়া পুলিশ ফাঁড়ির উপর আক্রমণ চালিয়ে ফাঁড়ি ধ্বংস করে দেয়। ফাঁড়ি থেকে ৫টি রাইফেল, প্রচুর গুলি এবং একটি ওয়ারলেস সেট দখল করে নেয়। গেরিলা দল দামুদিয়া তহশিল অফিস ও সার্কেল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার দুদিন পর আরও একটি গেরিলা দল দামুদিয়া তহশিল অফিস ও সার্কেল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। এই ঘটনার দুদিন পর আরও একটি গেরিলা দল ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ করে দুজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে আহত করে এবং একটি ওয়ারলেস সেট হস্তগত করে। সঙ্গে সঙ্গে তহশিল অফিস ও পালং থানার আঙ্গালিয়া বাজারে জুট গোডাউন আগুন লাগিয়ে ২৫ হাজার মণ পাট জালিয়ে দেয়া হয়। গেরিলারা আঙ্গালিয়া তহশিল অফিসও জ্বালিয়ে দেয়। এসব কার্যকলাপের ফলে মাদারীপুরের শাসনব্যাবস্থা অচল হয়ে যায়।

শালদা নদীতে এবং মন্দভাগে ক্যাপ্টেন গাফফার এবং মেজর সালেক পাকবাহিনীকে বার বার আঘাত করতে থাকে। আমাদের রেকি পার্টি খবর নিয়ে আসে যে, ২৪ শে জুলাই বিকেল ৩টার সময় পাকসেনারা নওগাঁও স্কুলে স্থানীয় দালালদের নিয়ে একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। এই সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন গাফফার একটি প্লাটুন মর্টার সহ নওগাঁর নিকট পাঠিয়ে দেয়। বিকেল ৫টায় পাকসেনাদের ৫০-৬০ জন লোক ও স্থানীয় দালালরা স্কুল প্রাণগণে সমবেত হয়ে তাদের আলোচনা সভা শুরু করে। সভা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরই আমাদের প্লাটুনটি মর্তারের সাহায্যে পাকসেনাদের এই সমাবেশের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ফলে আলোচনা সভা বেঙে যায় এবং পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকসেনাদের ৩০জন লোক ৭ জন দালালসহ নিহত হয়। আমাদের প্লাটুনটি নিরাপদে ফিরে আসে। পাকসেনারা শালদা নদীর দক্ষিণে মনোরা ভাঙ্গা রেলওয়ে সেতুটি মেরামত করার জন্য আবার চেষ্টা চালায়। ২৬শে জুলাই সকাল ১০টায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল তাদের শালদা নদী অবস্থান থেকে মনোরা সেতুর নিকট সমবেত হয়। এরপর সেতুর চতুর্দিকে তারা বাঙ্কার তৈরির প্রস্তুতি নেয়। সংবাদ পেয়ে মেজর সালেক মর্টারসহ একটি প্লাটুন পাকসেনাদের মনোরা সেতু থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যে পাঠিয়ে দেয়। বিকেল ৪টায় আমদের দলটি আগরতলার নিকট অবস্থান নেয় এবং পাকসেনাদের উপর মর্টার এবং মেশিনগানের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের গোলাগুলিতে পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পরে এবং তাদের অনেক হতাহত হয়। মনোরা সেতু থেকে তারা পালিয়ে যায়। পরে বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা জানতে পারলাম যে পাকসেনাদের কমপক্ষে ৪ জন নিহত এবং অনেক আহত হয়।

২৬শে জুলাই ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন একটা এম্বুশ পার্টি নওগাঁ এবং আক্সিনার মাঝামাঝি রাস্তায় এম্বুশ পাতে। পাকসেনাদের একটি দল নওগাঁর পথে সেই এম্বুশে পরে যায়। ফলে ৭ জন পাকসেনা নিহত ও ৪ জন আহত হয়। আমাদের একজন গুরুতরভাবে আহত হয়। প্লাটুনটি ফেরার পথে কল্যাণসাগরে আবার একটি এম্বুশ পেতে বসে থাকে। পাকসেনাদের একটি কোম্পানি সাইদাবাদ থেকে কসবার পথে সেই এম্বুশে পড়ে যায়। ফলে ২১ জন পাকসেনা ও ১ জন দালাল নিহত হয় এবং ৯ জন আহত হয়। পাক পেট্রোল পার্টির একটি ট্রাক ও ধ্বংস হয়। ঐ দিন ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের একটি কমান্ডো দল বগাবাড়িতে একটি রেলওয়ে ব্রিজ ও ২-৩ টি টেলিফোন পাইলন উড়িয়ে দেয়। আমরা যেসব গেরিলাদের ঢাকা এবং কুমিল্লার পশ্চিম ও ভৈরব বাজার এলাকায় পাঠাতাম, তারা কসবার উত্তর দিকে ছাতুরা ও নবীনগর হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কার্যকলাপ সম্বন্ধে খবরাখবর নেয়ার জন্য পাকসেনারা দালালদের নিযুক্ত করে এবং আমাদের অনুপ্রবেশের রাস্তাকে বন্ধ করার জন্য রাজাকারদের রাস্তায় এবং নদীপথে পাহারায় মোতায়েন করে। এই সব দালাল এবং রাজাকাররা আমার অপারেশনের জন্য অসুবিধার সৃষ্টি করে। দালালদের ধরার জন্য এবং রাজাকারদের সমুচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ও লেঃ হারুন কে আমি নির্দেশ দেই। নির্দেশ অনুযায়ী ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন এবং লেঃ হারুন বিভিন্ন স্থানে তাদের লোকজনকে দালালদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয় এবং এম্বুশ পেতে রাখে। ২৫শে জুলাই সন্ধ্যায় নরসিংহের নিকট লেঃ হারুনের লোক পাকসেনাদের ৬ জন দালালকে এম্বুশ করে বন্দি করে। এদের নিকট ১৪ পাউন্ড বিস্ফোরক, ৩টি গ্রেনেড পাওয়া যায়। এর পরদিন আরও ৭ জন দালাল আমাদের এম্বুশে ধরা পরে এবং তাদের কাছ থেকে দুটি রাইফেল, ৪টি হ্যান্ড গ্রেনেড, ১টি ওয়ারলেস সেট এবং ১২০ রাউন্ড গুলি পাওয়া যায়। এর পর থেকে আমাদের এলাকাতে আর সাহস পায়নি। বন্দি দালালদের কাছ থেকে যানা যায় যে তাদেরকে পাকিস্তানী অফিসাররা প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং সঙ্গে করে এনে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের নিকট ছেড়ে দেয়। তাদের উপর নির্দেশ ছিল মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অন্যথায় তাদের পরিবার বর্গের উপর কঠোর ব্যাবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরপর রাজাকারদের শায়েস্তা করার জন্য ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন একটি কোম্পানি পাঠিয়ে দেয়। এই কমান্ডো কোম্পানিটি ছাতুরার নিকট রাজাকার ক্যাম্পের উপর ২৫শে জুলাই অতর্কিতে হামলা চালায়। হামলার ফলে ১৬ জন রাজাকার নিহত এবং ৫ জন আহত হয়। ঐ এলাকার রাজাকাররা ভিত হয়ে সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিকট আত্মসমর্পণ করে। তারা পরদিন তাদের নেতাকে আমাদের ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয় এবং মুক্তিবাহিনীর সাথে সহায়তা করার অঙ্গীকার দেয়। এছাড়া অনেক রাজাকার মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এর পর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত এই এলাকার রাজাকারদের সক্রিয় সহায়তা মুক্তিবাহিনী সব সময় পেয়েছে। অনেক সময় রাজাকাররাই আমাদের গেরিলাদেরকে নিরাপদ রাস্তায় তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছেছে। সি এন্ড বি রাস্তায় যে সেতুর নিচ দিয়ে আমাদের গেরিলারা নৌকায় যাতায়াত করত রাজাকাররা সেই সেতুর উপর পাকসেনাদের গতিবিধি সম্পর্কে সংকেত দিত। কোন সময় যদি পাকসেনারা ঐ জায়গায় টহলে আসতো তবে আগে থেকে হারিকেনের লাল আলো বা টর্চের সাহায্যে সংকেত দিয়ে আমাদের জানাত। আর ফলে এই রাস্তাটি আমাদের জন্য সম্পুর্ণ নিরাপদ হয়ে যায়।

মেজর সালেক একটি ডিমলিশন পার্টি ও একটি কমান্ডো প্লাটুনকে ২৮শে জুলাই রাত ২টার সময় হরিমঙ্গলে পাঠিয়ে দেয়। এই দলটি হরিমঙ্গলের নিকটে রেলওয়ে সেতুটির রেকি করে এবং সকাল সাড়ে ৬টা পর্যন্ত ডিমলিশন বানিয়ে সেতুটিকে উড়িয়ে দেয়। বিস্ফোরণের ফলে সেতুটির মাঝখানে ৪০ ফুটের একটি গ্যাপ সৃষ্টি হয়। এছাড়া সেতুটি দখন পাশে ২৭০ ফুট রেলওয়ে লাইন বারুদ লাগিয়ে নষ্ট করে দেয়া হয়। এর পরদিন এই ডিমলিশন পার্টি বিজন্মা রেলওয়ে সেতুটি বারুদ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ২৮শে জুলাই সকাল ৮তায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল বিজন্মা ব্রিজের নিকট পরিদর্শনে আসে। ঠিক সেই সময় আমাদের কামান তাদের উপর গোলাগুলি করে। ফলে পাকসেনাদের ৩ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। পাকসেনারা সেই অবস্থান পরিত্যাগ করে কায়েক গ্রামের দিকে পলায়ন করে। এরপর পহেলা আগস্ট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী কোম্পানি হরিমঙ্গল সেতুর নিকট অগ্রসর হয় এবং সেখানে তাদের ঘাঁটি গড়ার চেষ্টা করে। এবারো আমাদের সৈন্যরা তাদের অগ্রসরে বাঁধা দেয়। আমাদের সৈন্যদের গোলাগুলিতে পাকসেনাদের ৩০ জন হতাহত হয়। ফলে পাকসেনারা পিছু হটতে বাধ্য হয়।

কসবার টি আলির বাড়িতে পাকসেনাদের যে অবস্থান ছিল, সে অবস্থা থেকে পাকসেনারা চাল পর্যন্ত প্রায়ই যাতায়াত করত। এই সংবাদ লাটুমুরার নিকট লেঃ হুমায়ুন কবির সংগ্রহ করে। সে আরও জানতে পারে যে কাচা রাস্তায় পাকসেনাদের কমপক্ষে একটি কোম্পানি যাতায়াত করে। পাকসেনাদের এই দলকে আক্রমণ করার জন্য লেঃ কবির একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি এই প্লাটুনটি কল্যাণসাগরের নিকট ২৩শে জুলাই ভোর সোয়া ৪টায় এম্বুশ পড়ে যায়। আমাদের যোদ্ধাদের অতর্কিত গুলির আঘাতে পাকসেনাদের ২০জন নিহত ও ৮ জন আহত হয়। ১ জন স্থানীয় দালাল, যে পাকসেনাদের পথনির্দেশক ছিল, সেও মারা যায়। ২-৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং আমাদের লোকেরা অবস্থান তুলে নিজ ঘাঁটিতে ফেরত আসে।

কসবার উত্তরে পাকসেনাদের গোসাই স্থানে একটি শক্ত ঘাঁটি ছিল। এই ঘাঁটিতে অন্তত ৪০-৫০ জন পাকসেনা অবস্থান করছিল। আমাদের যেসব গেরিলা ঢাকার পথে যাতায়াত করত, এই অবস্থান থাকাতে তাদের যাতায়াতের গোপন পথে বিপজ্জনক হয়ে যায়। এই ঘাঁটিটি ধ্বংস করে দিয়ে যাতায়াতের গোপন পথে নিরাপদ করার জন্য আইনউদ্দিন ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানিকে পাঠায়। ডি কোম্পানি ৩১শে জুলাই রাত ১০টার সময় দক্ষিণ থেকে অগ্রসর হয়ে গোসাই স্থান অবস্থানের নিকট পৌঁছে। এই অবস্থানটি রেকি পূর্বেই করা ছিল। পাকসেনাদের অবস্থানটির দক্ষিণ হতে ডি কোম্পানি অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে যায়। আক্রমণ ২-৩ ঘণ্টা চলে। ডি কোম্পানির সৈন্যরা বেশ কয়েকটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয় এবং অন্তত ২০ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। আক্রমণের প্রবল চাপে টিকতে না পেরে পাকসেনারা গোসাই স্থান পরিত্যাগ করে পিছনে পলায়ন করে।

শালদা নদীতে আমাদের সঙ্গে পাকসেনাদের সঙ্ঘর্ষ পুরো জুলাই মাস চলতে থাকে। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে শালদা নদীর শত্রু অবস্থানটির উত্তর দিকে ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানি মোটামুটি ঘিরে ফেলেছিল। এদিকে দক্ষিণ দিকে আগরতলা ও কাঁটামোড়ায় মেজর সালেক ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি দিয়ে পাকসেনাদের শালদা নদী অবস্থানের উপর চাপ দিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনাদের পিছন থেকে সরবরাহের রাস্তা একমাত্র নদী ছাড়া সবই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছিলো। নদীপথেই লুকিয়ে মাঝে মাঝে পাকসেনাদের অবস্থানে রসদপত্র সরবরাহ করা হত। এই সরবরাহ পথে পাকসেনাদের এম্বুশ পেতে বসে থাকে। রাত ১টার সময় ৭-৮ টি নৌকায় প্রায় ১৫০ জন সৈন্য ও অন্যন্য সরবরাহ সহ পাকসেনারা তাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। নৌকাগুলি যখন এম্বুশ অবস্থানের ভিতরে আসে আমাদের প্লাটুনটি মেশিনগানের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে নৌকা ডুবে যায়। পাকসেনারাও পিছন হতে পাল্টা গোলাগুলি শুরু করে। সঙ্ঘর্ষ প্রায় অর্ধঘণ্টা স্থায়ী থাকে। এরপর পাকসেনাদের পিছনের নৌকাগুলি ফেরত চলে যায়। এই সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদের প্রায় ৬০-৭০ জন হতাহত হয় , ৪-৫ টি নৌকা ডুবে যায় এবং অনেক রসদ নষ্ট হয়। নৌকার আরোহী পাকসেনারা ডুবে যায়। পাকসেনাদের গুলিতে আমাদের ৪ জন নিহত ও একজন আহত হয়।

কুমিল্লার উত্তরে কালামছড়ি চা বাগানের নিকট পাকসেনাদের একটি ঘাঁটি ছিল। এখানে মাসাধিককাল ধরে পাকসেনা ও মুক্তি বাহিনীর মধ্যে সঙ্ঘর্ষ চলে আসছিল। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে অতিস্ট হয়ে পাকসেনারা কালামছড়ি চা বাগানে বাঙ্কার তৈরি করে। ২রা আগস্ট রাত ১২টার সময় লেঃ হারুনের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র দল শত্রুঅবস্থানের উপর হামলা চালায়। পাকসেনাদের এক কোম্পানি সৈন্য কামান এবং মর্টারের সহায়তায় শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তুলেছিল। ২রা আগস্ট মুক্তিবাহিনীর অমর সাহসী ক্ষুদ্র দলটি হ্যান্ড গ্রেনেড ও ৩০৩ রাইফেলের সাহায্যে আক্রমণ চালায়। গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শত্রুদের ১০টি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ৫০ জন নিহত সঙ্গীকে ফেলে পিছনে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানেও গ্রামের লোক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে অনেক পাকসেনা নিহত হয়। দুজন পাকসেনা আমাদের হাটে বন্দি হয়। এম জি আই এ ও মেশিনগান সহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র এবং ২০-২৫ হাজার গুলি আমাদের হস্তগত হয়। এছাড়া অনেক খাদ্যসামগ্রী ও কাপড় আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের পক্ষে দুজন মুক্তিসেনা নিহত হয়। জুলাই মাসে নোয়াখালীতে অপারেশনের জন্য ১৪ জন গণবাহিনীর গেরিলা গোপন পথে চৌদ্দগ্রামে আলোকরা বাজার হয়ে দক্ষিণ দিকে যাচ্ছিল। রাত ১টার সময় বাজারের নিকটে শত্রুদের একটি দল অতর্কিতে গেরিলাদের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের গেরিলারা সাহসের সঙ্গে আক্রমণের মোকাবিলা করে, কিন্তু শত্রুদের আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়। সঙ্ঘর্ষে আমাদের একজন গেরিলা নিহত ও কয়েকজন আহত হয়। এবং বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র ফেলে তারা পালিয়ে আসে। হাবিলদার গিয়াসের নেতৃত্বে যে দলটি হোমনা থানায় অবস্থান করছিল সেই দলটি ২৮শে জুলাই রাতে হোমনা থানার সাঘুটিয়া (হোমনা, বাঞ্ছারামপুর, রামচন্দ্রপুরের সঙ্গমস্থল) লঞ্চঘাটে পাকবাহিনীর টহলদার একটি লঞ্চের উপর এম্বুশ ফাঁদে আটকা পড়ে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সুবেদার গিয়াসের দল আকস্মিকভাবে শত্রুদের উপর হামলা চালায়। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় ২০-২৫ মিনিট পর্যন্ত পাকসেনারা কোন জবাব দেয়না। দুর্ভাগ্যবশত রকেট লাঞ্চার কাজ না করায় সুবেদার গিয়াসের দল লঞ্চটাকে ডুবাতে সক্ষম হয়নি। ১ ঘণ্টা ধরে উভয় পক্ষে প্রচণ্ড সংঘর্ষ চলে। পাকসেনারা বিক্ষিপ্তভাবে মর্টারের গোলা ছুড়তে থাকে। সুবেদার গিয়াসের দলের এতে কোন ক্ষতি হয়নি। ১ঘন্টা সঙ্ঘর্ষের পর পাকসেনাদের লঞ্চটি পালিয়ে যায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের পিছে ধাওয়া করে। পাকসেনাদের হতাহতের সংবাদ সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানা না গেলেও প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ ক্ষতবিক্ষত লঞ্চটি দেড় ঘণ্টা হোমনা থানার ঘাটে নোঙ্গর করে থাকে। সেখানে বেশ কিছু আহতকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয় এবং অবশেষ অনেক মৃতদেহ সহ লঞ্চটি ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করে। জুলাই মাসে পাকসেনারা চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রোড খুলতে চেষ্টা করে। এই সময় মাঝে মাঝে পাকসেনাদের শক্তিশালী দল এই রাস্তায় টহল দেয়ার জন্য আসত। চৌদ্দগ্রামের উত্তরে ও দক্ষিণে ইমামুজ্জামান এইসব পাকসেনাদের টহলদারি দলগুলোকে তাড়িয়ে দিত।

৩০ শে জুলাই সকাল ৭টায় ইমামুজ্জামানের একটা প্লাটুন চৌদ্দগ্রামের ৪ মাইল দক্ষিণে নানকরা নামক স্থানে এম্বুশ পাতে। এম্বুশ পার্টি সারাদিন অপেক্ষা করার পড় জানতে পারে যে জগন্নাথ দীঘির নিকট একটি জিপ টহলে বেরবার জন্য তৈরি হচ্ছে। এই জিপকে এম্বুশ করার জন্য অ্যামবুশ পার্টি তখনি তৈরি হয়ে যায়। সন্ধ্যাসাড়ে ৬টার সময় পাকবাহিনীর এই জীপটি চৌদ্দগ্রামের ডিকে অগ্রসর হয় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশ অবস্থানে পৌঁছে। পৌছার সঙ্গে সঙ্গে অ্যামবুশ পার্টি জিপটির উপর মেশিনগান এবং হাল্কা মেশিনগান থেকে গুলি চালায়। গুলিতে ড্রাইভার আহত হয়। ৬ জন পাকসেনা জিপ থেকে লাফিয়ে নিচে নামে, কিন্তু তারাও আমাদের এম্বুশ পার্টি গুলিতে নিহত হয়। পরে এম্বুশ পার্টি একটি মৃত পাক সেনার পকেটে একটি চিঠি পায়। তা থেকে জানা যায় এই পাকসেনারা ২৯ তম বেলুচ রেজিমেন্টের সি কোম্পানির লোক। নিহত পাকসেনাদের নিকট হতে রাইফেল এবং যথেষ্ট গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। একজন আহত পাকসেনা আমাদের হাটে বন্দি হয়। এই অ্যামবুশের পর পাকসেনারা কুমিল্লা থেকে আরও সৈন্য চৌদ্দগ্রামে নিয়ে আসে এবং সারারাত ধরে আমাদের অবস্থানের উপর মর্টার এবং কামানের গোলা নিক্ষেপ করে। আমাদের লোকেরাও শত্রু অবস্থানের উপর মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করে। পরদিন ৩১শে জুলাই সকালে পাকিস্তানীদের একটি কোম্পানি চৌদ্দগ্রাম থেকে ও আর একটি কোম্পানি জগন্নাথ দীঘি থেকে ট্রাঙ্ক রোড হয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনারা যখন আমাদের অবস্থানের ২০০ গজের মধ্যে পৌঁছে তখনি আমাদের এম্বুশ অবস্থান থেকে তাদের উপর অতর্কিত গুলি চালানো হয়। গুলির আঘাতে ২০ জন পাকসেনা রাস্তার উত্তরে এবং ৬ জন দক্ষিণে আহত ও নিহত হয়। পাকসেনারা কামানের গোলার সহায়তায় পিছনে সরে যেতে থাকে। এই সময়েও আমাদের গুলির আঘাতে আরও কিছু সৈন্য হতাহত হয়। এরপর আমাদের এম্বুশ পার্টি সেই অবস্থান পরিত্যাগ করে হরিশ্বরদার হাটের নিকট নতুন অবস্থান নেয়। এর দুদিন পড় দোসরা আগস্ট সকাল ৭তায় পাকসেনাদের একটি ব্যাটালিয়ন উত্তর, দক্ষিণ, পশ্চিম হতে হরিশ্বরদার হাটের দিকে অগ্রসর হয়। এই সময়ে আমাদের অবস্থানে লেঃ ইমামুজ্জামান আরও দুটি প্লাটুন পাঠিয়ে অবস্থানটি শক্তিশালী করে। পাকসেনারা হরিশ্বরদার হাটের নিকট অবস্থিত ৩টি ভাঙ্গা সে পর্যন্ত অগ্রসর হয় এবং সেখানে পিছন থেকে গোলাগুলি চালায়। আমাদের কোম্পানিটিও সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতহত করতে থাকে। সমস্ত দিনের যুদ্ধে পাকসেনাদের ২৫ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা দোসরা আগস্ট রাতে প্রধান সড়কের উপর তাদের প্রতিরক্ষাবুহ্য তৈরি করে। এর পরদিন তাড়া ৩রা আগস্ট সমস্ত দিন ধরে পাকসেনাদের সাথে সঙ্ঘর্ষ চলে। ঐ দিন সন্ধ্যায় আমাদের কোম্পানিটি অবস্থা পরিত্যাগ করে তাদের ঘাঁটিতে ফিরে আসে।

পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল নয়ানপুর রেলওয়ে স্টেশন এলাকায় সুদৃঢ় ঘাঁটি করে অবস্থান করছিল। অনেক সময় এই অবস্থানের সঙ্গে অতীতে আমাদের যথেষ্ট সঙ্ঘর্ষ হয়। পাকসেনারা এই ঘাঁটিতে আরও বাড়িয়ে শালদা নদীর অবস্থান পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছিল। মেজর সালেক পাকসেনাদের নয়ানপুর ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ঘাঁটিতে পাকসেনাদের অন্তত এক কোম্পানির বেশী সৈন্য ছিল। পাকসেনারা স্টেশন ও নিকটবর্তী রেলওয়ে গুদাম এলাকায় তাদের সুদৃঢ় বাঙ্কার তৈরি করে। মেজর সালেক ভদের এই অবস্থানটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবরাখবর সংগ্রহ করে। এর পড় ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং কিছু সংখ্যক গণবাহিনী নিয়ে রাত সাড়ে ১২টার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের নিকট জমায়েত হতে থাকে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাত আড়াইটার সময় স্টেশনের ২০০ গজ উত্তরে রেললাইন পর্যন্ত প্রথম পর্যায়ে দখল করে নিতে সক্ষম হয়। এই সময়ে পাকসেনাদের গোলাগুলি ভীষণ তীব্র হতে শুরু করে এবং আমাদের সেনাদের আক্রমণ কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। মেজর সালেক অন্য প্লাটুন অর্থাৎ যারা স্টেশনের দিকে ছিল তাদের আক্রমণ আরও তীব্র করার নির্দেশ দেয়। এই প্লাটুনটি পাকসেনাদের প্রবল গুলিবৃষ্টির মধ্যে রেললাইনের পাশ দিয়ে আস্তে আস্তে অগ্রসর হতে থাকে। এত প্লাটুনের লোকেরা রেলস্টেশনের ২৫ গজের মধ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। এবং পাকসেনাদের প্রায় ৬-৭টি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। এই সময়ে স্টেশনের নিকটস্থ গুদাম এলাকা থেকে আমাদের লোকদের উপর তীব্র আক্রমণ শুরু হয়। অতর্কিত এই আক্রমণে আমাদের অনেক লোক হতাহত হয়। অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটে। মেজর সালেকের পক্ষে আক্রমণ চালিয়ে যাওয়া আর সম্ভব হয় না। নিরুপায় হয়ে মেজর সালেক তার আহত ও নিহত সৈনিকদের নিয়ে পশ্চাতে হতে আস্তে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে আমাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ কোম্পানির ৭ জন নিহত ও ৯ জন আহত হয়। এই যুদ্ধে সৈনিকদের মনোবল কিছুটা করে যায়। পাকসেনার তাদের অবস্থান অক্ষত রাখতে সক্ষম হয়। আমার সেক্টরে এটাই ছিল প্রথম এবং সবচেয়ে মারাত্মক বিপর্যয় যাতে এতজন এক সাথে নিহত ও আহত হল।

ঢাকা এবং ঢাকার চারপাশে গেরিলারা তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছিল। ২৫শে জুলাই সকাল ৬টা পূবাইলের নিকট কালসজা স্থানে রেলওয়ে লাইনের ওপর বৈদ্যুতিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে একটি ট্রেন উড়িয়ে দেয়া হয়। ইঞ্জিন্সহ তিনটি রেলওয়ে বগি লাইনচ্যুত হয় এবং ইঞ্জিনে আগুন লেগে বিধ্বস্ত হয়। ট্রেনের আরোহী ৩০-৩৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ সেই সাথে নিহত হয়। বগিগুলি লাইনচ্যুত হয়ে পানিতে পড়ে যায়। গেরিলাদের আরেকটি দল ৪ঠা আগস্ট আড়াইহাজার থানার নিকট পাঞ্চকাপি সড়কসেতু এবং দরগাও সড়কসেতু উড়িয়ে দেয়। এর ফলে নরসিংদী – ডেমরার মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এদিকে ২৭শে জুলাই ৪ জনের একটি গেরিলা দল মতিঝিলের (পীরজঙ্গি মজার) নিকট বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনের উপর আক্রমণ চালায়। পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এই সাবস্টেশনটিকে পাহার দিচ্ছিল। গেরিলারা দুজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশকে নিহত এবং বাকিদের নিরস্ত্র করে। তাড়া তালা ভেঙ্গে সাবস্টেশনে প্রবেশ করে ও সাব স্টেশনটি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে ধ্বংস করে দেয়। ফলে মতিঝিল, কমলাপুর স্টেশন, শাহজাহানপুর , গোপীবাগে বিদ্যুৎ সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। গেরিলা দলটি এরপর ফেরার পথে শাহজাহানপুরে রাজাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হয়; কিন্তু সাহসের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ৮-১০ জন রাজাকারকে নিহত করে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে আসে। জুলাই মাসে শেষ সপ্তাহে আরে একটি গেরিলাদল সিদ্ধিরগঞ্জ এবং খিলগাঁও ও কমলাপুরের মাঝে বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের পাইলন উড়িয়ে দেয়। ফলে টঙ্গি, কালীগঞ্জ প্রভৃতি শিল্প এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। ১৫ ই জুলাই পাগলা এলাকার গেরিলা দল ফতুল্লা এবং ঢাকার মাঝে একটি রেলওয়ে সেতু এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ঢাকা- নারায়ণগঞ্জ রেল যোগাযোগ সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। ফার্মগেটের নিকট পাকিস্তানীদের একটি চেকপোস্ট আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েকদিন গাড়িতে রেকি করার পড় তারা দেখতে পায় যে, পাহারারত মিলিটারি পুলিশ সব সময় মোটেই সতর্ক থাকে না। একদিন সন্ধ্যায় আলম, কাজি, গাজি এবং স্বপন নামের চার জন ঢাকার গেরিলা একটি গাড়ীতে ফার্মগেটে আসে। মিলিটারি চেক পোস্টের নিকটে পৌছার সময় তাদেরকে পাকসেনারা আস্তে নির্দেশ দেয়। তারা তাদের গাড়ীটি নির্দেশ অনুযায়ী দ্বিতীয় রাজধানীর দিকে মুখ করে রাস্তার পাশে দাড় করায়। চারজন পাকসেনা গাড়ীর দিকে চল্লাশির জন্য অগ্রসর হয়। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ী থেকে গেরিলারা তিনটি চায়নিজ স্টেনগান থেকে গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের অন্যান্য লোকও গাড়ীর দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। গেরিলা দল তাদের লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছোড়ে এবং তীব্র গতিতে গাড়ী চালিয়ে অবস্থান ত্যাগ করে। এ সঙ্ঘর্ষের ফলে পাকসেনাদের ৫ জন মিলিটারি পুলিশ আহত ও ৪ জন নিহত হয়। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত ফার্মগেট এবং কাওরান বাজার এলাকায় আতংকের সৃষ্টি হয়। ২রা আগস্ট ঢাকার গেরিলাদের আরেকটি দল ‘গ্যানিস’ এবং ‘ভোগ’ নামক দুটি বড় দোকানে গ্রেনেড ছুড়ে দোকান দুটির ক্ষতিসাধন করে।

লেঃ ইমামুজ্জামানের রেকি পার্টি সংবাদ নিয়ে আসে যে, পাকসেনাদের দুটি জিপকে রেশন এবং গোলাবারুদ সরবরাহের জন্য বালিয়াজুরি ভাঙ্গা ব্রিজের নিকট শত্রু অবস্থানের নিকট যেতে দেখা গেছে। লেঃ ইমামিজ্জামান তৎক্ষণাৎ একটি প্লাটুন জিপ দুটিকে এম্বুশ করার জন্য হরিসর্দার বালিয়াজুরি ব্রিজের নিকট পাঠিয়ে দেয়। লেঃ ইমামুজ্জামান প্লাটুনটি সঙ্গে সঙ্গে অবস্থান নিয়ে জিপের উপর রাইফেলের সাহায্যে গুলি চালাতে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের দুজন নিহত হয়। একটি জিপ মৃত সঙ্গীদের নিয়ে দ্রুত ঘুরে পালিয়ে যায়। অন্য জিপটির উপর প্লাটুনটি গুলি চালাতে থাকে। পাকসেনাদের রাস্তার পশ্চিম পাশে অবস্থান নিয়ে আমাদের প্লাটুনটির উপর গুলি চালাতে থাকে। তাদের গুলি ফুরিয়ে এলে তারা গাড়ি থেকে গুলি নেবার চেষ্টা করে – কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যার্থ হয়। এ আক্রমণে তাদের ৬ জন মারা যায়। পরে পাকসেনারা আমাদের এম্বুশ অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলা ছুড়তে থাকে। বাধ্য হিতে আমাদের প্লাটুনটি অবস্থান পরিত্যাগ করে। শত্রুদের গাড়িটি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এরপর পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল দুপুর দেড়টার দিকে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। প্রচণ্ড সঙ্ঘর্ষে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরও কয়েকজন আহত হয়। পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের আক্রমণ পরিত্যাগ করে ফেরত চলে যায়।

মেজর সালেক ১০ই আগস্ট একটি প্লাটুন নিয়ে শালদা নদীর পশ্চিমে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কুমিল্লা সি এন্ড বি রাস্তার নিকট শিলদাই গ্রামে তার গোপন ঘাঁটি স্থাপন করে। পরদিন স্থানীয় লোকের নিকট খবর পায় যে সি এন্ড বি রাস্তার উপর দিয়ে প্রতিদিন কুমিল্লা থেকে উজানিরশার পাক অবস্থানে ৩-৪ টি জিপ যাতায়াত করে। এই সংবাদ পেয়ে মেজর সালেক পাকসেনাদের জন্য সিএন্ড বি রাস্তায় একটা এম্বুশ পাতে। সমস্ত দিন ও রাত অপেক্ষা করার পরেও পাকসেনারা সেদিন আর আসেনি। বোঝা গেল যে হয়তো বা তাদের কোন ডালা বা রাজাকার আগে থেকেই এম্বুশ সম্পর্কে সতর্ক করে দিয়েছিল। অনেক অপেক্ষা করার পর রাস্তায় মাইন লাগিয়ে মেজর সালেকের দলটি তার ঘাঁটিতে রওনা হয়। পথে রসুল্গ্রামের নিকট একটি রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। আক্রমণের সময় ক্যাম্প ভবনের ভিতর বেশ কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এই আক্রমণের ফলে ২০ জন রাজাকার নিহত ও ৩০ জন বন্দি হয়। এরপর দলটি নিজেদের অবস্থানে নিরাপদে ফিরে আসে।

শালদা নদী , মন্দভাগ এবং এর চতুর্দিকে আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের উপর প্রায়ই আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যাও দিন দিন আরও বেড়ে যাচ্ছিল। আমাদের আক্রমণের ফলাফল সম্বন্ধে দুটি সঠিক বিবরণ গ্রামবাসী মারফত জানতে পাই। শালদা নদীর শত্রু অবস্থানের উপর আমরা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় গোলার আক্রমণ চালানোর ফলে আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে শত্রুপক্ষের অন্তত ৬০ জন নিহত হয়। বাধ্য হয়ে শত্রুরা স্টেশন ছেড়ে নয়ানপুর গ্রাম, শালদা নদী গোডাউন ইত্যাদি এলাকায় অবস্থান তৈরি করে। মন্দভাগেও শত্রু অবস্থানের ওপর আমাদের গোলার আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের প্রায় ১৫০ জন হতাহত হয়। পাকসেনাদের একটি ১২০ এম এম মর্টারের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করা হয়। সন্ত্রস্ত পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের কামানের অবস্থানের পিছু হটিয়ে ব্রাহ্মণপাড়া নিয়ে যায়। আমাদের এম্বুশের ফলে শালদা নদুর রাস্তা পরিত্যাগ করা নাগাইশ হয়ে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে একটি নতুন রাস্তা খোলার চেষ্টা করে। ১১ই আগস্ট পাকসেনাদের একটি কোম্পানি এই নতুন রাস্তায় আসে। আসার পথে নাগাইশ গ্রাম থেকে একজন স্থানীয় লোককে পথপ্রদর্শক হিসাবে নিয়ে আসে। এই লোকটি পরে আমাদের জানায় যে পাকসেনাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। নৌকাতে আসার সময় অনেক সৈন্যই সামনে অগ্রসরে অনিচ্ছা প্রকাশ করে। তাদের কমান্ডোরা অনেক ভাবে তাদের উৎসাহিত করার চেষ্টা চালায়। এছাড়াও তেদের অনেককে চিন্তিত ও বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। তারা তাদের পুরনো দাম্ভিক স্বভাব অনেকটা পরিত্যাগ করেছে। পাকসেনারা গ্রামবাসীদের সাথে মিশবার চেষ্টাও করছিল। শত্রুদের এই নতুন রাস্তার খবর পেয়ে মেজর সালেক একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দেয়। প্লাটুনটি নাগাইশ গ্রামে পাকসেনাদের দুটি রসদ বোঝাই নৌকা ব্রাহ্মণপাড়া থেকে নয়ানপুরের দিকে যাচ্ছিল। আমাদের প্লাটুনটি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ করে এবং ১১ জন পাকসেনাকে নিহত করে নৌকাটি ডুবিয়ে দেয়।

কিছুক্ষণ পর পাকসেনাদের আরও ৩টি নৌকা শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে যাচ্ছিল। এই নৌকাগুলিকেও আমাদের এম্বুশ পার্টি শশিদল গ্রামের নিকট এম্বুশ করে এবং এতে ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। পরদিন পাকসেনাদের দুটি শক্তিশালী প্লাটুন আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দমনে নাগাইশের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের প্লাটুনটি সংবাদ পেয়ে সুবেদার নজরুল ও নায়েব সুবেদার মনিরের নেতৃত্বে পাকসেনাদের এই দলটিকে নাগাইশ পৌছার আগেই অতর্কিত আক্রমণ করে ২৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। পাকসেনারা পিছু হতে যায়। ১৭ই আগস্ট ব্রাহ্মণপাড়া এই নদীপথ খোলার জন্য পাকসেনাদের একটি বিরাট দল নদীর পাড় দিয়ে অগ্রসর হয়। এবং সঙ্গে সৈন্য বোঝাই ৩টি নৌকাও অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটিকে আমাদের সৈন্যরা আবার এম্বুশ করে। অ্যামবুশের ফলে নৌকার আরোহী ১৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনাদের যে দলটি পাড় দিয়ে আসছিল তাদের প্রবল চাপে বাধ্য হয়ে আমাদের সৈন্যরা পিছু হটে আসে। পাকসেনারা দুই তিনবার এম্বুশে পড়ার পরেও শালদা নদীর নাগাইশ-ব্রাহ্মণপাড়া যোগাযোগ খোলার চেষ্টা চালিয়ে থাকে। এই খাল ছাড়া পিছন থেকে শালদা নদীতে সরবরাহের আর কোন রাস্তা ছিল না।

১৯শে আগস্ট দুপুর ১২টার সময় পাকসেনাদের তিনটি নৌকা শালদা নদী থেকে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এই নৌকাগুলি যখন ছোট নাগাইশের নিকট পৌঁছে তখন আমাদের সৈন্যরা নৌকাগুলির উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা পালটা গুলি চালিয়ে আমাদের আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে , কিন্তু আমাদের সৈন্যদের তীব্র আক্রমণের মুখে তাদের দুটি নৌকা ডুবে যায় এবং ২০ জন নিহত হয়। পিছনের নৌকাটি দ্রুত পিছনের ফিরে পাড়ে পৌঁছায়। পাকসেনারা নৌকা থেকে নেমেই আমাদের সৈন্যদের ওপর আক্রমণের চেষ্টা করে। প্রায় চার ঘণ্টা উভয় পক্ষে গোলাগুলি চলার পড় পাকসেনারা পিছু হটে যায়। ঐ দিনই বেলা ১টার সময় আমাদের কামানের গোলায় শালদা নদী গুদামে অবস্থিত পাকসেনাদের একটি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। ফলে ৮জন পাকসেনা ঘটনাস্থলেই নিহত হয়।

মন্দভাগেও ৪র্থ বেঙ্গলের সি কোম্পানি অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাকসেনাদের চারটি বাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। ফলে ১১ জন নিহত ও তিনজন আহত হয়। লেঃ ইমামুজ্জামান পাকবাহিনীর হরিসর্দার হাটের অবস্থানের উপর তার চাপ রেখে যাচ্ছিল। এই চাপের ফলে পাকসেনাদের মনোবল দ্রুত ভেঙ্গে পড়েছিল। এই অবস্থানটিতে বরাবর অতর্কিত আক্রমণ এবং এম্বুশ চালানোর ফলে পাকসেনারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে সব সময় সজাগ থাকত।

শত্রুদের এই অবস্থানটি মুক্ত করার জন্য একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ভিতসন্ত্রস্ত পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য অবস্থানটির নিকতবর্তী এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, পাকসেনাদের এই অবস্থানটির ওপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ অবশ্যাম্ভাবি। ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট আক্রমণ করার জন্য অতিসত্বর হরিসর্দার হাটের দিকে উত্তর থেকে অগ্রসর হচ্ছে এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুরাষ্ট্রের দেয়া অনেক কামানও আছে। এছাড়াও অনেক মুক্তিযোদ্ধা এ আক্রমণের জন্য একত্রিত হচ্ছে। এই ধরণের গুজব প্রায় ই পাকসেনাদের আমানগোন্ডা অবস্থানের এলাকায় প্রচার করা হচ্ছিল। এর ফলে পাকসেনাদের মনোবলে আরও ভাঙ্গন ধরে। ১৪ই আগস্ট আরও গুজব ছড়িয়ে দেয়া হয় যে, পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসেই এই আক্রমণ চালানো হবে। ১৪ই আগস্ট রাত ১০তার সময় লেঃ ইমামুজ্জামান কয়েকজন সিপাই আমানগোণ্ডার নিকটে গিয়ে লাইন পিস্তল এবং ২ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে ইল্যুমিনেটিং প্যারাস্যুট বোমা ছোড়া হয় এবং কয়েক রাউন্ড গুলি চালানো হয়। এর পরদিন আমানগোন্ডা অবস্থানের নিকট পৌঁছে দেখা গেল যে, পাকসেনারা সমস্ত প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে রাতে ভয়ে পালিয়ে গেছে এবং এলাকাবাসী পাকসেনাদের পরিত্যাক্ত জিনিসপত্র সংগ্রহ করছে।

এ ছাড়াও পরে আমরা আরো অনেক সূত্রে জানতে পারি যে, মুক্তিবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ সম্বন্ধে পাকিস্তানীরা এত বেশী সন্দিহান এবং চিন্তিত হয়ে পড়েছিল যে, ১৩ই আগস্ট ঢাকা থেকে এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য এবং চারটি লাইট ট্যাংক কুমিল্লাতে আনা হয়। এই ব্যাটালিয়নটি বানাসিয়া থেকে গাজীপুর পর্যন্ত রেললাইনের পাশে প্রতিরক্ষা অবস্থান তৈরি করে, দুটি ট্যাংক কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিকট মোতায়েন করে এবং বাকিগুলি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে রাখা হয়। কুমিল্লার সামরিক প্রশাসক ব্রিগেডিয়ার মাসুদ ঘোষণা করেন যে, যদি কোন বাঙ্গালী সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করে যে, মুক্তিবাহিনী তার বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে তবে তাকে সম্পূর্ণ ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। এইভাবে পাকবাহিনী তাদের দোষ মুক্তিবাহিনীর উপর চাপাবার প্রচেষ্টা চালায় এবং এইসব অভিযোগকে তাদের কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা করে।

পাকসেনারা হোমনা থানায় একবার আক্রান্ত হবার পর এই থানাটিতে আবার পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং কিছুসংখ্যক পাকসেনা মোতায়েন করে শক্তিশালী করে তোলে। থানাটিতে পাকসেনাদের অবস্থান শক্তিশালী হবার পর হোমনা এলাকায় মুক্তিবাহিনীর পক্ষে তাদের কার্যকলাপ চালিয়ে যাওয়াতে বাধার সৃষ্টি হয়। এই এলাকা আবার মুক্ত করার জন্য হাবিলদার গিয়াস থানাটিকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রথমে থানাটির প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবর সংগ্রহ করে। স্থানীয় গেরিলাদেরকেও তার প্লাটুনের সঙ্গে একত্রিত করে। ১৫ই আগস্ট রাত ১২টার সময় আমাদের সম্মিলিত দলটি হোমনা থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ করে। কিন্তু ২ ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধের পর তারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে তাদের ১০ জন নিহত ও ১৪ জন বন্দী হয়।

আমাদের দলটির দুজন আহত হয়। থানাতে ২৪টি রাইফেল, দুটি বন্দুক, ১৬টি বেয়োনেট, একটি ওয়্যারলেস সেট, দুটি টেলিফোন সেট, ১০টি গ্রেনেড ও দেড় হাজার গুলি আমাদের হস্তগত হয়। বন্দীদের থানা হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দেয়া হয়। হোমনা থানার বিস্তৃত এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রনে আসে। এর দুদিন পর হোমনা পতনের খবর পেয়ে পাকসেনাদের ৩টি দল মুরাদনগর থেকে হোমনার দিকে নৌকায় অগ্রসর হয়। মুরাদনগরে অবস্থিত আমাদের গেরিলারা এই সংবাদ পেয়ে যায়। স্থানীয় গেরিলা কমান্ডার মুসলেউদ্দিনের নেতৃত্বে দুপুর ২টার সময় নদীর পাড়ে অগ্রসরমান পাকসেনাদের জন্য এমবুশ পাতে।

মুরাদনগর থেকে ৮ মাইল দূরে সন্ধ্যা ৬টার সময় পাকসেনাদের নৌকাগুলি এমবুশে পড়ে যায়। আমাদের গেরিলাদের গুলিতে দুটি নৌকা ডুবে যায়। গোলাগুলিতে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ২৯ জন পাকসেনা এবং পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়। আমাদের গেরিলারা ৩টি এমজি-৪২ এবং দুটি বেল্ট বক্স (৫০০ গুলিসহ), ৫০০ চাইনিজ রাইফেলের গুলি এবং ১টি ৩০৩-রাইফেল হস্তগত করে। অবশিষ্ট অস্ত্রশস্ত্র পানিতে ডুবে যাওয়ায় উদ্ধার করা সম্ভব হয় নি। কুমিল্লা থেকে তিন মাইল উত্তর-পূর্বে কংসতলাতে পাকসেনারা আগস্ট মাসে তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। এই ঘাঁটিতে পাকসেনাদের অন্তত এক কোম্পানী শক্তি ছিল। পাকসেনাদের এই ঘাঁটির সংবাদ ক্যাপ্টেন মাহবুবের নিকট পৌঁছে। তিনি একটি পেট্রোল পার্টি পাঠিয়ে এই ঘাঁটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করেন। ১৬ই আগস্ট সন্ধ্যা ৭টায় ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে দুই প্লাটুন শত্রুঘাঁটির দিকে অগ্রসর হয়। রাত ২টায় ক্যাপ্টেন মাহবুবের দলটি পাকসেনাদের ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা পাকঘাঁটির ভিতরে অনুপ্রবেশ করে পাকসেনাদের হতচকিত করে দেয়। তুমুল সংঘর্ষে কিংকর্তব্যবিমূঢ় পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ে তাদের ঘাঁটি ছেঁড়ে পালিয়ে যায়। আমাদের দলটি পলায়মান পাকসেনাদের খায়েশ বাজার এবং লক্ষ্মীপুর ঘাঁটি থেকেও হটতে বাধ্য করে। সমস্ত রাতের সংঘর্ষে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ৩০ জন হতাহত হয়। এরপর আমাদের দলটি নিরাপদে তাদের কেন্দ্রে ফিরে আসে।

এর তিনদিন পর কুমিল্লার ১ মাইল উত্তরে আমাদের আরও একটি দল পাকসেনাদের জন্য একটি এমবুশ পেতে বসে থাকে। ২০শে আগস্ট রাত ৮টায় পাকসেনাদের একটি টহলদার প্লাটুন এই এমবুশের আওতায় পড়ে যায়। পাকসেনাদের প্লাটুনটি যখন পুরোপুরি আমাদের এমবুশ পার্টির সম্মুখে এসে যায় তখন আমাদের দলটি হালকা মেশিনগান এবং অন্যান্য অস্ত্রের সাহায্যে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। পাকসেনারা অতর্কিত এই আক্রমণে হতচকিত হয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পলায়ন করে। এই এমবুশে ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং তিনজন আহত হয়। আমাদের দলটি পাকসেনাদের একটি এমজিআইএ মেশিনগান ও কয়েকটি জি-৩ রাইফেল দখল করে।

পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল জগন্নাথ দিঘীতে ঘাঁটি করেছিল। এই দলটি মাঝে মাঝে নিকটবর্তী চিয়ারা গ্রামে রাত্রিতে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করত। এই খবর আমরা পেয়ে যাই। ২৩শে আগস্ট মেজর জাফর ইমাম এই দলটিকে আক্রমণ করার জন্য দুটি প্লাটুন নিয়ে চিয়ারা গ্রামের নিকট পাকসেনাদের অপেক্ষায় অবস্থান করে। রাত সাড়ে ১২টায় জগন্নাথ দিঘী পাক অবস্থানের উপর মুক্তিযোদ্ধা একটি দল আক্রমণ চালায়। একই সঙ্গে চিয়ারা গ্রামে অবস্থিত পাকসেনাদের উপর মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের ফলে চিয়ারা গ্রামে অবস্থিত পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং ২৪ জন পাকসেনা আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে নিহত হয়। কিছু শত্রুসেনা আহত অবস্থায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। জগন্নাথ দিঘীতেও চারটি ব্যাঙ্কার আমাদের মুক্তিবাহিনী ধ্বংস করতে সক্ষম হয়। নয়ানপুর রেল স্টেশনে পাকসেনাদের উপর ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানী এবং ‘সি’ কোম্পানী তাদের চাপ আরো জোরদার করে। ২৩শে আগস্ট সকাল ১১টায় উক্ত কোম্পানী দুটি মিলিতভাবে স্টেশনের উত্তর এবং দক্ষিণ দিক থেকে মর্টার ও ১০৬-রিকোয়েললেস রাইফেল নিয়ে পাক অবস্থানের উপর সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। ১০৬-রিকোয়েললেস রাইফেলের আঘাতে পাকিস্তানীদের বেশ ক’টি শক্ত ব্যাঙ্কার বিধ্বস্ত হয়। স্টেশনের কিছু দূরে একটি গুদাম ছিল। তার ভিতরেও পাকসেনারা ব্যাঙ্কার বানিয়েছিল। গুদামটিতেও রকেট মারা হয়। ফলে গুদামে আগুন ধরে যায়। রকেটিং-এর পর মর্টার এবং মেশিনগানের সাহায্যে শত্রু অবস্থানের উপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করা হয়। এই আক্রমণ এত সফল হয়েছিল যে, শত্রু অবস্থান থেকে ভীতসন্ত্রস্ত্র আর্তনাদ এবং চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। পাকিস্তানীরা আমাদের আক্রমণের জবাব দেবার সুযোগ পায়নি। শত্রুদের প্রকৃত হতাহতের সংখ্যা সে সময়ে জানা যায়নি। পরে আমরা গ্রামবাসী সূত্রে খবর পেয়েছি যে, আক্রমণে পাকসেনাদের যথেষ্ট হতাহত হয়েছে।

নোয়াখালী এবং বেলুনিয়াতে আমাদের সৈনিকরা এবং গেরিলা দল পাকসেনাদের নাজেহাল করে তুলেছিল। ২২শে আগস্ট পাকসেনাদের একটি দল সোনাগাজীর দিকে ট্রাকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের একটি দল রাস্তায় এন্টি-ট্যাংক মাইন পেতে ভোর ৫টায় পাকসেনাদের দলটিকে এমবুশ করে। মাইনের আঘাতে পাকসেনাদের তিনটি ট্রাক ধ্বংস হয় এবং সেই সঙ্গে তাদের ২০ জন সৈন্য নিহত হয়। এছাড়াও এমবুশ পার্টির গুলিতে প্রায় ৪০ জন পাকসেনা এবং রাজাকার হতাহত হয়। প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের দলটি অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ফিরে আসে। এই ঘটনার দুদিন পর চৌদ্দগ্রাম এবং লাকসাম সড়কের উপর আমাদের গেরিলারা মাইন পুঁতে রাখে। পাকসেনাদের একটি ডজ গাড়ী মাইনের আঘাতে বিধ্বস্ত হয়। গাড়ীতে অবস্থানরত একজন অফিসার এবং একজন পাকসেনা নিহত হয়। একই সময় ফেনী থেকে একটি ট্রাক পাকসেনাসহ চৌদ্দগ্রামের দিকে আসছিল। আমাদের একজন গেরিলা ট্রাকের ভিতর একটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। প্রায় ২৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। অপরপক্ষে পাকসেনাদের গুলিতে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শাহ্‌জাহান শহীদ হয় এবং একজন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে। গেরিলারা ফেনীর কাছে গুমদন্ডী রেলওয়ে লাইন ডিমোলিশন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ফেনী এবং কুমিল্লার মধ্যে ট্রেন যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ২১শে আগস্ট সকাল সাড়ে ৭টায় আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি পাকসেনাদের একটি দলকে কুমিল্লার উত্তরে গাজীপুর রেলওয়ে সেতুর দিকে অগ্রসর হতে দেখে। আমাদের পেট্রোল পার্টিটি পুলের নিকট এমবুশ পেতে পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা এমবুশ অবস্থানটির মধ্যে এসে যায় এবং আমাদের মুক্তিযোদ্ধা দ্বারা অতর্কিতভাবে আক্রান্ত হয়। এই আক্রমণে একজন লেফটেন্যান্ট সহ ছ’জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অবশিষ্ট পাকসেনারা পালিয়ে বাঁচে। বহু অস্ত্রশস্ত্র এবং ম্যাপ আমাদের দখলে আসে।

৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানী আগস্ট মাসের শেষের দিকে কুমিল্লার উত্তরে মন্দভাগ এবং সি-এন্ড-বি সড়কের উপর তাদের কার্যকলাপ জোরদার করে তোলে। ২৩শে আগস্ট রাত ১টায় ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে দুটি প্লাটুন মন্দভাগ বাজারের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের সময় আমাদের সৈনিকেরা গ্রেনেড চার্জ করে পাকসেনাদের চারটি ব্যাঙ্কার ধ্বংস করে দেয়। এই আক্রমণে পাকসেনাদের অন্তত ২৫ জন নিহত এবং ১২ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষে দু’জন মারাত্মকভাবে আহত এবং একজন শহীদ হন। ১ ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের যোদ্ধারা শত্রু অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে ফিরে আসে। ২৫শে আগস্ট আমাদের একটি ডিমোলিশন পার্টি সি-এন্ড-বি সড়কের কালামোড়া সেতুতে প্রহরারত পাকসেনাদের আক্রমণ করে। সেতুটিকে আমাদের দলটি উড়িয়ে দেয়। ঐদিন ভোর ৫টায় পাকসেনাদের একটি জীপ দ্রুতগতিতে বিধ্বস্ত হয় এবং ঐ জীপের আরোহী তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। আমাদের আরেকটি দল সি-এন্ড-বি রাস্তার উপর একটি এমবুশ পেতে রাখে।

২৫শে আগস্ট সকাল ৮টার সময় পাকসেনাদের একটি ডজ গাড়ী এমবুশের আওতায় এলে গাড়ীটি ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং ডজের আরোহী চারজন পাকসেনাকে (একজন হাবিলদার ও তিনজন সিপাহি) বন্দী করা হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এ যান থেকে ছ’টি রাইফেল, ২২৫ রাউন্ড গুলি, দুটি পিস্তল ও তিনটি গ্রেনেড হস্তগত করে। কুমিল্লার উত্তরে কামবাড়ি ও আম্রতলী এলাকায় পাকসেনারা প্রায়ই টহল দিতে আসত। পাকসেনাদের এই দলটিকে এমবুশ করার জন্য পরিকল্পনা নেয়া হয়। ২৫শে আগস্ট তারিখে আমাদের একটি প্লাটুন ক্যাপ্টেন দিদারুল আলমের নেতৃত্বে বিকেল চারটায় মর্টারসহ পাকসেনাদের টহল দেয়া রাস্তার পাশে এমবুশ পেতে বসে থাকে। সন্ধ্যা ছয়টার সময় পাকসেনাদের একটি কোম্পানী পার হয়ে জামবাড়ীর দিকে অগ্রসর হয়। এমবুশের নিকট পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর প্রবলভাবে মর্টারের গুলিবর্ষণ করা হয়। পাকসেনারা এই আকস্মিত আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পালাবার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের এমবুশ পার্টি পলায়নপর শত্রুসেনাদের উপর মেশিনগান এবং হালকা মেশিনগানের সাহায্যে তাদের প্রতি আক্রমণ চালায়। এই এমবুশ ৩০ জন পাকসেনা নিহত এবং ১০ জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা রাতের আঁধারে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।

পাকসেনারা শালদা নদী এবং নয়নপুরে তাদের সরবরাহ নদীপথে পাঠাত। তাদের এই নদীপথ বন্ধ করার জন্য প্রায়ই পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে আমাদের এমবুশ পার্টি পাঠানো হতো। ২৩শে আগস্ট আমাদের এমবুশ পার্টি সেনেরবাজার অবস্থান নিয়েছিল। সকাল এগারোটায় পাকসেনাদের একটা নৌকা সেনেরবাজারের পশ্চিম পাড় ঘেঁষে আসতে থাকে। আমাদের এমবুশ পার্টি দ্রুত শত্রুর নৌকার উপর গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়, অবশিষ্ট সৈন্যরা নৌকাটিকে তাড়াতাড়ি পশ্চিম তীরে ভিড়িয়ে নৌকা থেকে নেমে গ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। এই ঘটনার তিন দিন পর আমাদের আরেকটি টহলদার দল ব্রাহ্মণপাড়া গ্রামের নিকট পাকসেনাদের ছ’টি নৌকা নয়ানপুরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। প্রত্যেকটি নৌকায় ছয় থেকে আটজন করে পাকসেনা ছিল। টহলদার দলটি হাবিলদার সৈয়দ আলী আকবরের নেতৃত্বে সেনেরবাজারের নিকট নদীর পশ্চিম তীরে এমবুশ পেতে বসে থাকে। নৌকাগুলি যখন এমবুশের আওতায় আসে তখন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নৌকাগুলোর উপর মেশিনগানের সাহায্যে গুলিবর্ষণ শুরু করে। প্রথম নৌকাটি গুলির আঘাতে উল্টে যায় এবং তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট তিনজন আরোহী পানিতে ঝাঁপ দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে। আমাদের আরেকটি দল সুবেদার নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে পলায়নপর পাকসেনাদেরকে নাগাইশ গ্রামের কাছে আক্রমণ করে এবং তাদের তিনটি নৌকা ডুবিয়ে দেয়। এতে আঠারজন পাকসেনা পানিতে ডুবে মারা যায়। শুধু দুটি নৌকা থেকে পাকসেনারা রক্ষা পায় এবং নয়ানপুরের দিকে পলায়ন করে। এই সংঘর্ষে আমাদের ছাত্র গেরিলা আবদুল মতিন বুলেটবিদ্ধ হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন।

২৭শে আগস্ট সকালে পাকসেনারা নয়ানপুরের পশ্চিম পাশে শশীদল গ্রামের নিকট তাদের সৈন্য সমাবেশ করে সেনের বাজারের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটি মর্টারের গোলার সাহায্যে সেনের বাজারের উপর প্রচণ্ড আক্রমন চালায়। সমস্ত দিন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রচণ্ড গুলি বিনিময় হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় আমাদের সেনারা পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। পাকসেনারা অগ্রসর হতে ব্যর্থ হয়ে পিছু হটে যায়। পরে জানা যায় যে, এই সংঘর্ষে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।

২৮শে আগস্ট পাকবাহিনী ব্রাহ্মণপাড়া থেকে নৌকায় শালদা নদীর দিকে অগ্রসর হওয়ার পথে আবার আমাদের এমবুশ পার্টি দ্বারা আক্রান্ত হয়। এই এমবুশে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুসেনাদের পাঁচটি নৌকা ডুবিয়ে দেয়। এখানে একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৩০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এর ফলে পাকসেনাদের জন্য নদীপথে অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলোতে সরবরাহ পুরোপুরিভাবেই বন্ধ হয়ে যায়।

৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের ‘এ’ কোম্পানীর একটি টহলদার দল মাধপুর এলাকার নিকটে ২৭শে আগস্ট তাদের গোপন বেইস গড়ে তোলে। এখান থেকে পাকসেনাদের বিরুদ্ধে কার্যকলাপ চালিয়ে যাবার জন্য সি-এন্ড-বি সড়কে তাদের লোক পাঠায়। ২৮ তারিখে সকাল সাতটায় খবর আসে যে, পাকসেনারা একটি জীপ ও ট্রাকে সি-এন্ড-বি সড়ক থেকে কাঁচা রাস্তায় মাধবপুরের দিকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানোর জন্য এগিয়ে আসছে। আমাদের টহলদার দলটি এই সংবাদ পেয়ে মাধবপুর গ্রামের বাইরে কাঁচা রাস্তায় যে পথে পাকসেনারা অগ্রসর হচ্ছিল সেখানে একটি এমবুশ পেতে বসে থাকে। এগারটার সময় পাকসেনাদের জীপ এবং ট্রাকটি এমবুশের আওতায় আসে। আমাদের এমবুশ পার্টি আক্রমন চালিয়ে গাড়ী দুটির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। এই এমবুশে ৯ জন পাকসেনা নিহত এবং ৬ জন আহত হয়। কিছুসংখ্যক পাকসেনা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়।

আগস্ট মাসের শেষের দিকে কুমিল্লার দক্ষিণে আমাদের গেরিলারা তাদের কার্যকলাপ আরো জোরদার করে। ট্রেনিংপ্রাপ্ত একটি গেরিলা দল বরুরাতে তাদের বেইস-এ যাওয়ার পথে পাকসেনা এবং রাজাকার দ্বারা আকস্মিকভাবে আক্রান্ত হয়। এই সময় ফরিদগঞ্জ, হাজীগঞ্জ, দাউদকান্দি, চাগোরা প্রভৃতি জায়গায় পাকসেনাদের সঙ্গে গেরিলাদের সংঘর্ষে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। এসব সংঘর্ষে ২০টি রাইফেল এবং প্রচুর গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। আগস্ট মাসের ২৯ তারিখে আমাদের মিয়ার বাজার সাব-সেক্টরে খবর আসে যে, পাকসেনারা লাকসাম থানার বুটচি গ্রামে সন্ধ্যা সাতটায় শান্তি কমিটির একটি সভা করার প্রস্তুতি নিয়েছে। এই সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন ইমামুজ্জামান সভাটি পণ্ড করার জন্য এক প্লাটুন মুক্তিযোদ্ধা পাঠিয়ে দেয়। পাকসেনা এবং রাজাকাররা সভা শুরু করলে আমাদের প্লাটুনটি তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে ৮ জন পাকসেনা, ৯ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ এবং ২০ জন রাজাকার হতাহত হয়। শান্তি কমিটির সভাটি আর অনুষ্ঠিত হতে পারে নি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা নিরাপদে নিজেদের আশ্রয়ে ফিরে আসে।

২৫শে আগস্ট সকাল ৯টার সময় পাকসেনাদের একটি প্লাটুনকে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে ধানদাইল গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। আমাদের একটা পেট্রোল পার্টি দূর থেকে পাকসেনাদের অগ্রসর হতে দেখে ধানদাইল গ্রামে এমবুশ পাতে। পাকসেনারা এমবুশের ভিতর এসে গেলে তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এতে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ১০ জন পাকসেনা নিহত হয়। অবশিষ্ট সেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। পরদিন আমাদের এই টহলদার দলটি উত্তর নাগাইশ এবং ছোট নাগাইশ গ্রামের মাঝে মালদা নদীর পাড়ে এমবুশ পাতে। সকাল পাঁচটায় আমাদের এমবুশ দল পাকসেনাদের একটি টহলদার দলকে শালদা নদীর পূর্ব তীর ঘেঁষে অগ্রসর হতে দেখে। পাকসেনাদের এই দলটি তাদের কয়েকটা সরবরাহকারী নৌকাকে নয়ানপুর থেকে মন্দভাগের দিকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। এই দলটি আমাদের এমবুশ পার্টির আওতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে দুটি নৌকা ধ্বংস এবং ১৪ জন লোক নিহত হয়। পাকসেনাদের ওপর পাহারা দল আমাদের এমবুশ পার্টির প্রতি পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় এক ঘণ্টা উভয় পক্ষের মধ্যে গোলা বিনিময় চলতে থাকে। নয়ানপুর থেকে আরো দুটি নৌকায় পাকসেনারা তাদের দলটিকে আরো শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হয়। প্রথম নৌকাটি আমাদের গুলিতে ডুবে যায় এবং ৫ জন পাকসেনা নিহত হয়। অন্য উপায় না দেখে দ্বিতীয় নৌকার সৈন্যরা তীরে নেমে পালিয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা সমস্ত দিন এবং রাত হরিমঙ্গল, শশীদল এবং সেনেরবাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে আমাদের সেনের বাজার এবং গৌরাঙ্গল অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে। পরের দিন সকাল ৯টায় ৩০ জন পাকসেনা দুটি নৌকায় সেনের বাজার অবস্থানের দিকে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে আমাদের মেশিনগানের গুলিতে দুটি নৌকাই ডুবে যায় এবং সকল পাকসেনাই নদীতে ডুবে মারা যায়।

আগস্ট মাসের শেষে ঢাকাতে আমাদের গেরিলাদের শক্তি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তারা পাকসেনাদের ঢাকায় ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। পাকসেনারা প্রায়ই রাতে ঢাকা শহরে ট্রাকে করে টহল দিতে বেরুত। টহল দেয়ার সময় অনেক ক্ষেত্রে শহরবাসীদের উপর জঘন্য অত্যাচার চালাত। পাকসেনাদের রাতের এই তৎপরতা সীমিত করার জন্য আমাদের গেরিলারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। যেসব রাস্তায় সাধারণত পাকসেনারা টহল দিতে গেরিলারা সেসব রাস্তার ওপর বেশ কয়েকদিন লক্ষ্য রাখে। কোন রাস্তায় কতটার সময় কতগুলো গাড়ী কত গতিতে চলে, কত ব্যবধান দুই গাড়ীর ভিতর বিরাজ করে প্রভৃতি তারা সংবাদ সংগ্রহ করে। ২৭শে আগস্ট রাত সাড়ে ১১টায় গ্রিন রোডের (স্টাফ কোয়ার্টারের বিপরীত দিকে) কতগুলো নির্মাণাধীন দোকানের ছাদে আমাদের গেরিলাদল এমবুশ পেতে বসে থাকে। গেরিলারা রাস্তার উপর গাড়ীবিধ্বংসী মাইন পেতে রাখে। এরপর এমবুশ পার্টি পাকসেনাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। রাত প্রায় সাড়ে বারোটায় পাকসেনাদের ৪/৫টি বেডফোর্ড গাড়ী এবং জীপ তেজগাঁর দিক থেকে গ্রিন রোড হয়ে অগ্রসর হয়। প্রথম গাড়ীটি যখন এমবুশ সাইট-এর সেশপ্রান্তে পৌঁছে তখন একটি মাইন-এর আঘাতে গাড়ীটি সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়। দ্বিতীয় গাড়ীটির চালক এই অবস্থা দেখে হতচকিয়ে পাশ কাটতে গিয়ে পার্শ্ববর্তী দালানের সঙ্গে ধাক্কা মারে, ফলে এই গাড়ীটিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর পেছনে পেছনে পাকসেনাদের আরেকটি জীপ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে মাইনের আঘাতে সেটিও উল্টে যায়। যেসব পাকসেনা ক্ষতিগ্রস্ত গাড়ীগুলোতে অক্ষত অবস্থায় ছিল তারা গাড়ী থেকে বেরুবার চেষ্টা করে এবং গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের এমবুশ পার্টির গেরিলারা ছাদ থেকে তাদের উপর গ্রেনেড আক্রমণ চালায় এবং গুলি ছুড়তে থাকে। এর ফলে অধিকাংশ পাকসেনা হতাহত হয়। পেছন থেকে আরো একটি গাড়ীতে পাকসেনারা ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। এবং গাড়ী থেকে নেমে আমাদের গেরিলাদের উপর আক্রমণ চালাবার চেষ্টা করে। আমাদের গেরিলারাও তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের হতাহতের সংখ্যা যখন বাড়তে থাকে তখন কোন উপায় না দেখে তারা ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়। গোলাগুলির শব্দে স্থানীয় জনসাধারণ তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। তারা ২৪ জন পাকসেনার মৃতদেহ ও ৪১ জনকে আহত অবস্থায় এবং দুটি বিধ্বস্ত ট্রাক এবং একটি জীপ রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখে। আমাদের পক্ষে দু’জন সামান্য আহত হয়। আমাদের গেরিলারা কিছুসংখ্যক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে গ্রিন রোডের পিছন দিকের নিচু জায়গা দিয়ে নিরাপদে চলে আসতে সক্ষম হয়। পরের দিন এই খণ্ডযুদ্ধ এবং পাকিস্তানীদের দুরাবস্থার কাহিনী হাজার হাজার মানুষ প্রত্যক্ষদর্শীদের মুখে জানতে পারে। এই সংবাদ সমস্ত ঢাকায় মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে ঢাকা শহরের মুক্তিকামী জনগণের মনে আশার সঞ্চার হয়। দুদিন পরে ঢাকার গেরিলারা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা বন্ধ করার জন্য নিউ মডেল ডিগ্রী কলেজে এবং আরো কয়েকটি কলেজে আক্রমণ চালায়। তারা পরীক্ষার খাতাপত্র জ্বালিয়ে দেয়। টঙ্গী এবং জয়দেবপুরের মাঝে দুটি বিদ্যুতের পাইলনও তারা উড়িয়ে দেয়। ২রা সেপ্টেম্বর রাতে পাকিস্তানীদের একটি জীপ যখন গ্রিন রোড দিয়ে যাচ্ছিল তখন আমাদের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা জীপটির ভিতর গ্রেনেড নিক্ষেপ করে চারজন পাকসেনাকে নিহত করে। গ্রেনেড নিক্ষেপে জীপটির আংশিক ক্ষতি হয়।

এছাড়া ঢাকার গেরিলা দল পশ্চিম পাকিস্তানী একটি পুলিশের দলকে কলাবাগানের কাছে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে দশজনকে নিহত করে। কালিগঞ্জ-ডেমরা এবং কালিগঞ্জ-টঙ্গীর মধ্যস্থিত বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের চারটি পাইলন উড়িয়ে দেয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দল রুপগঞ্জের নিকট নদীর পাড়ে পাকসেনাদের যাতায়াতের রাস্তায় একটি এমবুশ পেতে রাখে। ১লা সেপ্টেম্বর বিকেল ৫টায় কালিগঞ্জ থানার দারোগা, ৭০ জন পাকসেনা এবং ৭০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ মুক্তিবাহিনীর সম্পর্কে তদন্তের জন্য ঢাকা থেকে কোন দূরবর্তী গ্রামে নৌকাযোগে যাচ্ছিল। নৌকাটি যখন এমবুশের আওতায় পৌঁছে তখন গেরিলারা নৌকার উপর হালকা মেশিনগান দ্বারা গুলি চালায়। গুলিতে নৌকার আরোহী পাকসেনা, পশ্চিম পাকিস্তানী এবং দারোগা নিহত হয় এবং নৌকাটি ডুবে যায়। ঢাকার আজিমপুরে গেরিলারা অতর্কিতে একটি রাজাকার দলের উপর আক্রমণ চালিয়ে চারজন রাজাকারকে নিহত এবং চারটি রাইফেল ও ৬০ রাউন্ড গুলি দখন করে। টঙ্গীতেও একটি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণ করে গেরিলারা কয়েকজন রাজাকারকে হত্যা করে চারটি রাইফেল দখল করে নেয়। ডেমরার নিকট আমাদের একটি গেরিলা দল ১৩ই আগস্ট বিকাল তিনটার সময় পাক বিমান বাহিনীর একটি জীপ এমবুশ করে ধ্বংস করে দেয়। এমবুশে ৪ জন বিমান বাহিনীর এবং সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সৈনিক নিহত হয়। তাদের কাছ থেকে অনেক কাগজপত্র, পরিচয়পত্র এবং কয়েকটি রিভলবার দখল করা হয়। দখলীকৃত কাগজপত্র আমাদের হেডকোয়ার্টারে গেরিলারা পাঠিয়ে দেয়।

আগস্ট মাসের শেষের দিকে পাকসেনাদের কোন গুপ্তচর আমাদের ঢাকার গেরিলাদের ধোলাই খাল ঘাঁটি পাকসেনাদের অবহিত করে। সংবাদ পেয়ে পাকসেনারা ২০/২৫টি ট্রাক ধোলাই খালে আমাদের ঘাঁটিটি আক্রমণের জন্য আসে। পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণে আমাদের গেরিলারা কোন উপায় নে দেখে তাদের সঙ্গে সম্মুখসমরে লিপ্ত হয়। প্রায় ২ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। সংঘর্ষে পাকসেনাদের প্রায় ৪০-৪৫ জন হতাহত হয় বলে খবর পাওয়া যায়। অপরদিকে আমাদের দু’জন গেরিলা মারাত্মকভাবে আহত হয়। প্রবল চাপের মুখে টিকতে না পেরে আমাদের গেরিলারা সাতঁরিয়ে ধোলাইখাল পার হয়ে ধোলাইখাল অবস্থানটি পরিত্যাগ করে। পিছু হটার সময় একটি ২’’ মর্টার, ৩টি ম্যাগাজিন খালে ফেলে দিয়ে আসতে বাধ্য হয়। পরদিন পাকসেনারা সেগুলি উদ্ধার করে এবং তাদের প্রচারের কাজে ব্যবহার করে। এর পরদিন আমাদের গেরিলারা সুত্রাপুর থানার আক্রমণ চালিয়ে দুজন পাকসেনাকে নিহত করে। সুত্রাপুরের সার্কেল ইন্সপেক্টর এবং ওসি গুরুতরভাবে আহত হয়।

আগস্টের শেষের দিকে আমাদের ২/৩ জন গেরিলা একজন মেজর ও দুইজন ক্যাপ্টেনকে (পাক গোলান্দাজ বাহিনীর) একটি জীপে করে আজিমপুরের নিকট এসে জীপ থেকে নেমে দূরে কোন এক বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখে। কিছুক্ষণ পর সে বাড়ি থেকে চিৎকারের শব্দ শুনে আমাদের গেরিলারাও সেই বাড়িতে প্রবেশ করে। তারা বুঝতে পারে যে অফিসাররা ঐ বাড়ীর মহিলাদের শ্লীলতাহানির চেষ্টা করছে। তৎক্ষণাৎ গেরিলারা অফিসারদেকে লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। গেরিলারা পাক অফিসারদের মৃতদেহ দূরে অপেক্ষামাণ পাক জীপের মধ্যে রেখে দেয় এবং নিরাপদে সে স্থান পরিত্যাগ করে। পাক-পুলিশের একটি টহলদার দলকে আমাদের ধানমণ্ডির গেরিলারা প্রতিদিন ধানমণ্ডি সাত-মসজিদ রোড ও নিকটবর্তী রাস্তায় টহল দিতে দেখে। আমাদের গেরিলারা ২৫শে আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় ১৮নং রোডের মোড়ে একটি চলন্ত গাড়ী থেকে স্টেনগানের গুলি দ্বারা ৯ জন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করে। গুলির সংবাদ পেয়ে নিকটবর্তী টহলদারী পাকসেনারা জীপ নিয়ে গেরিলাদের পিছু ধাওয়া করে। গেরিলারা গাড়ী থেকে গুলি ছুড়ে জীপের ড্রাইভারকে নিহত করে। এসময় দ্রুত গতিসম্পন্ন চলন্ত জীপটি আয়ত্তের বাইরে চলে যায় এবং পার্শ্ববর্তী দেয়ালে প্রচন্ডভাবে ধাক্কা খেয়ে বিধ্বস্ত হয়। এর ফলে গাড়ীর আরোহী দুজন পাকসেনা নিহত এবং তিনজন আহত হয়। এই গেরিলাদের নেতৃত্ব দেয় রুমী (শহীদ, বীরবিক্রম)। পাকসেনারা পরে রুমীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় এবং তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে। আগস্টের ২৯ তারিখে ছ’জনের একটি গেরিলা দল ঢাকার সৈয়দাবাদ সেতুটি এক্সপ্লোসিভ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। এর ফলে ঐ সেতু দিয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এসময় গেরিলারা একটি বাসে দুশো মণ পাটসহ লতিফ বাওয়ানী জুটমিলে যাওয়ার পথে বাসটিকে ধ্বংস করে দেয়। বরাইদের নিকট আরো তিন’শ মণ পাট ফসফরাস বোমা ফেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। গেরিলারা নারায়ণগঞ্জের জিএমসি ঘাটে পাঁচ হাজার বেল বহনকারী কামচাম ফ্ল্যাটটি ডুবিয়ে দেয়। আর-সি-এম জুটমিলের শ্রমিক (আমাদের একজন গেরিলা) ফসফরাস ৮০ গ্রেনেড নিক্ষেপ করে আর-সি-এম মিলের গুদামস্থিত প্রায় ১ লাখ মণ পাট জ্বালিয়ে দেয়। পরে জানা যায় যে, দমকল বাহিনীর সাতটি গাড়ী ৩/৪ ঘণ্টা চেষ্টা করেও সেই জ্বলন্ত পাটের অগ্নিনির্বাপণে ব্যর্থ হয়। ফলে সমস্ত পাট পুড়ে যায়।

৩০শে আগস্ট আমাদের গেরিলারা আড়াই হাজার থানা অতর্কিত আক্রমণ করে থানার দারোগাকে নিহত করে। গেরিলারা থানার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসে। এর পরদিন গেরিলারা একজন পাক দালালের দু’লাখ টাকা মূল্যের সুতাবাহী নৌকা ডুবিয়ে দেয়। তারা থানা থেকে ৮টি রাইফেল, ৫টি শর্টগান এবং ৪০ রাউন্ড গুলি দখল করে। এই খবর পেয়ে নরসিংদী থেকে পাকসেনাদের একটি কোম্পানী ঘটনাস্থলের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের গেরিলারা আগে থেকেই এর জন্য প্রস্তুত ছিল। পুটিয়রের নিকট আমাদের একটি গেরিলা দল পাকসেনাদেরকে আক্রমণের জন্য এমবুশ পাতে। পাকসেনারা এমবুশের ফাঁদে পড়লে গেরিলারা গুলি চালায়। চার ঘণ্টা সংঘর্ষের পর ৩৩টি মৃতদেহ ফেলে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে নরসিংদীর দিকে পালিয়ে যায়। যুদ্ধে পাকসেনাদের পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন সেলিমও নিহত হয়। মৃতদেহ থেকে পরিচয়পত্র অন্যান্য কাগজপত্র উদ্ধার এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের গেরিলারা হস্তগত করে। গেরিলারা নরসিংদীর বিভিন্ন মিলে গ্রেনেড এবং মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে মিলের ভিতর সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে। ফলে পাকসেনারা একে একে সব মিলগুলো বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। পাকসেনাদের একটি দল ঝিনারদিতে (ঘোড়াশালের নিকট) তাদের ক্যাম্প স্থাপন করে। আগস্ট মাসের ১৩ তারিখ দুপুর আড়াইটায় আমাদের একটি গেরিলা দল পাকসেনাদের এই ক্যাম্পটিতে অতর্কিতে আক্রমণ করে। সাতজন পাকসেনা পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। গেরিলারা ঝিনারদি রেল স্টেশনটিকে ধ্বংস করে দেয়। স্টেশনের টেলিফোন যোগাযোগের সেটটিও তারা ধ্বংস করে দেয়। টিকিট ও অন্যান্য কাগজপত্রও তারা জ্বালিয়ে দেয়। ক্যাম্প থেকে আমাদের গেরিলারা একটি হালকা মেশিনগান, ১১টি রাইফেল, হালকা মেশিনগানের ৪৫০০টি গুলি, ১টি স্টেনগান, ১০০ রাউন্ড স্টেনগানের গুলি, ১৪টি বেল্ট, ২৬ জোড়া বুট, ১৭ ব্যাগ আটা, ১১ পেটি দুধের টিন এবং আরো অন্যান্য জিনিসপত্র দখল করে। কয়েকদিন পর পাকসেনারা গোপন সূত্রে খবর পেয়ে আমাদের গেরিলা ইউনিট হেডকোয়ার্টারে দু’দিক থেকে আক্রমণ করে। আমাদের গেরিলা দুর্জয় সাহসের সঙ্গে তাদের সে আক্রমণের মোকাবিলা করে এবং আক্রমণ প্রতিহত করে। দু’ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। ১৪ই আগস্ট পাকসেনাদের একটি দল ঝিনারদি স্টেশনের কাছে একটি গ্রামে লুটতরাজের উদ্দেশ্যে আসে। এই খবর পেয়ে আমাদের একটি গেরিলা দল পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা তিনঘণ্টা যুদ্ধের পর দুটি মৃতদেহ ও কয়েকটি আহত সেনাকে ফেলে পালিয়ে গেলে আমাদের গেরিলারা নরসিংদী-তারাবো সড়কে পাঁচদোনার নিকট একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতুতে প্রহরারত পাকসেনাদের একটি দলের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ প্রায় এক ঘণ্টা চলে। আমাদের আক্রমণ প্রবল হওয়ায় আহত পাকসেনাদের বাঁচাও বাঁচাও চিৎকার শোনা যায়। এমন সময় চার ট্রাক পাকসেনা তাদের সাহায্যে সেখানে উপস্থিত হয়। পাকসেনারা ভারী অস্ত্রের সাহায্যে আমাদের গেরিলাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। ভারী অস্ত্রের মোকাবিলা করতে না পেরে আমাদের গেরিলারা বাধ্য হয়ে পিছু হটে আসে। পাকসেনাদেরকে পাঁচটি মৃতদেহ উঠিয়ে নিয়ে যেতে দেখা যায়। পাকসেনারা নরসিংদীর নিকটস্থ আমাদের গেরিলা অবস্থানের খবর পেয়ে আগস্টের ২১ তারিখে প্রায় এক কোম্পানী শক্তি নিয়ে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পর পথিমধ্যে আমাদের একটি গেরিলা দল তাদেরকে অতর্কিতে আক্রমণ করে। প্রায় এক ঘণ্টা গোলাগুলির পর পাকসেনারা তাদের গোলাগুলি বন্ধ করে আমাদের অবস্থানের ২/৩ মাইল দূরে থাকতেই আর অগ্রসর না হয়ে পিছু হটে যায়।

আমাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করার প্রচেষ্টা চলতে থাকে। কিন্তু পাকসেনারাও খুব দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইনগুলো যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি মেরামত করে ফেলে। এর ফলে কিছুদিন বন্ধ থাকার পর শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো সীমিত পরিমাণে বিদ্যুৎ সরবরাহ পায়। পাকসেনাদের বিদ্যুৎ সরবরাহে আরো বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য নতুন করে আরেকটি পরিকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিতাস গ্যাসের পাইপলাইনের নকশা যোগাড় করি এবং পরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, গ্যাসের পাইপ কেটে দিলে সিদ্ধিরগঞ্জ এবং ঘোড়াশালের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্রগুলো গ্যাসের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। হানাদার কর্তৃপক্ষ এইসব বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র চালাবার ব্যবস্থা করলে তাদের তেলের সংকট দেখা দেবে। পাইপলাইন উড়িয়ে দেবার জন্য নরসিংদী এবং রূপগঞ্জের গেরিলাদের নির্দেশ দেই। আমার নির্দেশ অনুযায়ী ২০শে আগস্ট রাত ১টায় নরসিংদী গেরিলা ইউনিটের ডিমোলিশন পার্টি তিতাস গ্যাস লাইন বারুদ লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। এই অপারেশন পুরাপুরি সফল হয়। বিস্ফোরণের ফলে প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা প্রায় ১০ মাইল দূর থেকে দেখা যায় এবং ৬/৭ মাইল দূর থেকে বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যায়। ঘোড়াশালের উত্তরে সমস্ত এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। নরসিংদী, ঘোড়াশাল এবং পাঁচদোনাতে অবস্থানরত পাকসেনারা এই বিস্ফোরণের বিকট শব্দে ভীষণভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অনেকেই তাদের অস্ত্রশস্ত্র এবং জিনিসপত্র ফেলে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে চেষ্টা করে। পরে স্থানীয় লোকজনের মুখে শোনা যায় যে, পাকসেনারা ধারণা করেছিল ভারতীয় বিমান বোমা ফেলেছে। এর পরদিন আশুগঞ্জের নিকট কয়েক জায়গাতে পাইপ লাইন উড়িয়ে দেয়া হয়। এই গ্যাসের পাইপলাইন মেরামত করতে বেশ ক’দিন সময় লাগে। ততদিন শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ থাকে।

রূপগঞ্জের একটি গেরিলা দল ২২শে আগস্ট রাতে নরসিংদী এবং ঝিনারদি রেলস্টেশনের মাঝে রেল লাইনের নিচে মাইন পুঁতে রাখে। রাতে একটি ট্রেন দুটি বগিসহ সেখানে দিয়ে চলে যায়। ট্রেন এবং বগি দুটি চলে যাবার সাথে সাথেই মাইনটি বিস্ফোরণের হয়। এতে ট্রেনটির ক্ষতি না হলেও রেল লাইনের অনেকখানি ধ্বংস হয়। আমাদের বৈদ্যেরবাজার থানার গেরিলা দল সোনারগাঁও এবং সি-এন্ড-বি রোডের অনেক জায়গায় মাইন পুঁতে রাখে। ১৬ই আগস্ট রাতে পাকসেনাদের একটি ট্রাক মাইনের আঘাতে ধ্বংস হয় এবং সাথে সাথে ১১ জন পাকসেনা ও তিনজন রাজাকার নিহত হয়। ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তার বাতেরচরের নিকটস্থ সড়কসেতুতে অবস্থানরত পাকিস্তানীদের ওপর আমাদের গেরিলারা ৩১শে আগস্ট অতর্কিত আক্রমণ চালায়। সংঘর্ষে কয়েকজন পাকসেনা এবং রাজাকার নিহত হয়। গেরিলারা সেতুটির ৬০ ফুট লম্বা স্প্যান উড়িয়ে দেয়। তার পরদিন রাতে ঢাকা-দাউদকান্দি সড়কে বারুনিয়া এবং ভবেরচর সেতু দুটিও বিস্ফোরক লাগিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়। ফলে ঢাকা-কুমিল্লা রাস্তা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। পাকসেনারা ভবেরচর সেতুর যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করার জন্য ফেরীর বন্দোবস্ত করে। সেপ্টেম্বরের দু’তারিখে আমাদের গেরিলারা ফেরীঘাট আক্রমণ করে এবং ফেরীটি ধ্বংস করে দেয়। এই আক্রমণে ফেরী থেকে চারটি ব্যাটারী মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়।

নারায়ণগঞ্জ-দাউদকান্দি সড়কে গজারিয়াতে পাকসেনাদের একটি পোস্ট-চৌকি ছিল। সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ রাত ৮টায় আমাদের গেরিলাদের একটি দল সেই চৌকি আক্রমণ করে। এক ঘণ্টা যুদ্ধে তিনজন ইপিকাফ নিহত ও একজন বন্দী হয়। এখান থেকে ২০০ রাউন্ড গুলিসহ ১১ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে।

ঢাকার মুন্সীগঞ্জ এবং মানিকগঞ্জ মহকুমার গেরিলারাও তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। গেরিলাদের একটি দল হরিরামপুর থানার নিকট পাকসেনাদের একটি লঞ্চ আক্রমণ করে। লঞ্চে পাকসেনারা হরিরামপুর অবস্থান থেকে তাদের সৈনিকদের জন্য রসদ নিয়ে যাচ্ছিল। এক ঘণ্টা গোলাগুলির পর ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা আর অগ্রসর হতে না পেরে লঞ্চ নিয়ে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এর পরদিন হরিরামপুর থানার সেকেন্ড অফিসার এবং কয়েকজন পাকিস্তানী পুলিশ আমাদের গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পুলিশদের নিহত করে আমাদের গেরিলারা তিনটি রাইফেল দখল করে নেয়। ঘিওর থানাতেও পাকসেনারা একটি টহলদারী দলের উপর আমাদের গেরিলারা আক্রমণ চালিয়ে ৮ জন নিহত করে এবং ৮টি রাইফেল দখল করে। সেপ্টেম্বর মাসের ১ তারিখে নওয়াবগঞ্জ থানা আমাদের গেরিলারা আক্রমণ করে। এই আক্রমণে সেখানকার সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র গেরিলাদের হস্তগত হয়। আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে আমাদের গেরিলারা লৌহজং, শিবালয়, সিরাজদীখান এবং শ্রীনগর থানাগুলিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে পাক পুলিশ হত্যা করে এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। সেপ্টেম্বরের ১ম সপ্তাহে শিবালয় থানার গেরিলা দল পাকসেনাদের একটি প্লাটুনকে টহল দেয়ার সময় এমবুশ করে। এই এমবুশে ১৩ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেকে আহত হয়। পাকসেনারা ঢাকা থেকে আরো সৈন্য এনে শিবালয়ে আমাদের গেরিলা দলটির ঘাঁটিতে ১৭ই সেপ্টেম্বর আক্রমণ চালায়। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের পিছু হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে ১০ জন পাকসেনা এবং ১১ জন রাজাকার নিহত হয়।

১৯শে সেপ্টেম্বর আমাদের গেরিলারা মালোচিন বাজারে অবস্থানরত পাক পুলিশের একটি দলকে আক্রমণ করে ১৯ জন পাক পুলিশকে নিহত এবং তিনজনকে আহত করে। ঘোড়াশালের গেরিলা দল ৯ই আগস্ট রাতে আড়াইহাজার থানার নিকটে পুরিন্দা বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনে আক্রমণ চালায়। এই ঘটনার দুই দিন পর সিদ্ধেশ্বরী-ঘোড়াশালের বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের ক্ষতিসাধন করে। গেরিলা দল মাশরেকী জুট মিলস লিমিটেডের বিদ্যুৎ সরবরাহ সাবস্টেশনটিও ধ্বংস করে দেয়। ফলে ঐ এলাকার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কলকারখানাগুলি সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের গেরিলারা রূপগঞ্জের নিকট যে গ্যাসলাইন ধ্বংস করে দিয়েছিল পাকসেনারা পশ্চিম পাকিস্তানী প্রকৌশলীদের দ্বারা তা মেরামত করে নেয়। এই সংবাদ আমাদের হেডকোয়ার্টারে যথাসময়ে পৌঁছে। এই গ্যাসলাইনকে পুনরায় ধ্বংস করার জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ঘোড়াশালের গেরিলাদেরকে গ্যাসলাইনটি মেঘনা নদীর মাঝে ক্ষতি করার জন্য নির্দেশ দেই। ঘোড়াশালের নিকট গ্যাসলাইনটি মেঘনা নদীর মাঝ দিয়ে গেছে। নির্দেশ অনুযায়ী গেরিলারা লাইনটির পথ গোপনে অনুসন্ধান করে। ৯ই সেপ্টেম্বর রাতে নৌকার সাহায্যে নদীর মাঝামাঝি জায়গায় যায় এবং প্রায় ১৫/২০ ফুট পানির নিচে অবস্থিত গ্যাস পাইপে ডিমোলিশন দ্বারা ‘ডিলে সুইচ’ (বিলম্বে কার্যকরী সুইচ)-এর সাহায্যে পাইপটি উড়িয়ে দেয়। ফলে গ্যাস পাইপের ভিতর পানি ঢুকে যায়। এতে গ্যাস সরবরাহ অনেক দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আড়াইহাজার থানার গেরিলারা জানতে পারে যে, পাকসেনারা কামানদি চরে তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করেছে এবং স্থানীয় লোকদের উপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। তারা আরও জানতে পারে যে, পাকসেনারা নিকটস্থ গ্রাম থেকে মেয়েদের তাদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে অত্যাচার চালাচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে ২৯ জন গেরিলার একটি দল ১১ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পাকসেনাদের ঘাঁটি আক্রমণ করে। ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাঁচজন পাকসেনা এবং ৬ জন রাজাকার নিহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা ক্যাম্প ছেঁড়ে পালিয়ে যায়। গেরিলারা ক্যাম্প থেকে মেয়েদের উদ্ধার করে তাদের স্ব স্ব বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেয়।

পাকসেনারা সিরাজদীখান থানার আবদুস সালাম নামক আমাদের একজন গেরিলাকে গ্রেফতার করে তালতলা ক্যাম্পে নিয়ে যায়। স্থানীয় প্রায় ৫০ জন গেরিলার একটি দল পরদিন রাত সাড়ে আটটায় এই ক্যাম্পটির উপর আক্রমণ চালায়। তারা প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর একজন পাকিস্তানী সুবেদার-মেজরসহ কিছুসংখ্যক পাকসেনা, পাক পুলিশ ও রাজাকারকে হতাহত করে আবদুস সালামকে উদ্ধার করে আনে। এই ঘটনার একদিন পর নওয়াবগঞ্জ থানার গেরিলারা একটি লঞ্চকে (এম এল পয়েন্টার) পাকসেনা বহন করে নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। ২৪শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ছ’টার সময় লঞ্চটি যখন গালিমপুরের নিকট পৌঁছে তখন আমাদের গেরিলারা লঞ্চটির উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে প্রথমেই পাকসেনাদের কিছু লোক হতাহত হয়। পাকসেনারা লঞ্চটিকে পিছু হটিয়ে পাড়ে অবতরণের চেষ্টা করে। আমাদের গেরিলারা আবার তাদের উপর আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ ২৫ তারিখ দুপুর পর্যন্ত চলে। শেষ পর্যন্ত আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদেরকে সম্পূর্ণরূপে পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে পিএসএস ৯১৩৩ ক্যাপ্টেন জাফর আলী খান, সুবেদার আব্দুল্লা, ৪৪ জন পাকসেনা এবং একজন বাঙ্গালী পথপ্রদর্শক পুলিশ নিহত হয়। লঞ্চটিকে পরে ডুবিয়ে দেয়া হয়। আমাদের দু’জন গেরিলা আবদুর রহিম এবং মুহম্মদ আলী শহীদ হন। এই খবর পেয়ে পাকসেনারা আরেকটি লঞ্চে করে বড় খাল দিয়ে নওয়াবগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয়। আমাদের গেরিলাদের ৪০ জনের আরেকটি দল পাকসেনাদের লঞ্চটিকে ২৬ সেপ্টেম্বর সকাল ৭টা ৩০মিনিটের সময় অতর্কিতে আক্রমণ করে। অতর্কিত আক্রমণের ফলে ৩ জন পাক সেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। পাকসেনারা লঞ্চটির দিক পরিবর্তন করে দ্রুত নাগালের বাইরে চলে যায়। ২৭শে সেপ্টেম্বর দুপুর ১টায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল নওয়াবগঞ্জের দিকে আবার অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। এই সংবাদ নওয়াবগঞ্জের গেরিলা হেডকোয়ার্টারে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ৫০ জনের একটি শক্তিশালী দল গালিমপুরের নিকট পাকসেনাদের জন্য একটি এমবুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। পাকসেনারা গালিমপুরে এমবুশের আওতায় পড়ার সঙ্গে সঙ্গে গেরিলারা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণে একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩৫ জন পাকসেনা নিহত এবং অনেকে আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে তাদের কিছু আহত লোককে নিয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের গেরিলারা একটি এলএমজি, ৩টি স্টেনগান, প্রচুর গুলি ও বেশ কিছু রাইফেল দখল করে। এর দু’দিন পর পাকসেনারা আরো শক্তিশালী হয়ে বড় খাল এবং আড়িয়াল বিল দিয়ে আবার অগ্রসর হবার চেষ্টা করলে আমাদের গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ করে। গেরিলারা তাদের এই চেষ্টাকেও ব্যর্থ করে দেয়। প্রায় তিনদিন ধরে পাকসেনারা অগ্রসরের চেষ্টা চালিয়ে যায়। তিনদিনের যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়। ওপর পক্ষে আমাদের একজন শহীদ এবং কিছু সংখ্যক গেরিলা আহত হয়। অক্টোবরের প্রথম তারিখ পর্যন্ত নওয়াবগঞ্জের সম্পূর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ আয়ত্তে আসে। দোহার থানার পাকসেনারাও আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের চাপে দুর্বল হয়ে পড়ে। ২৭শে সেপ্টেম্বর পাকসেনাদের একটি দল মাগুরা বাজার থেকে তাদের রসদ নিয়ে দোহার থানার ক্যাম্পে যাবার পথে আমাদের গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। আক্রমণে ১৪ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। পাকসেনাদের সমস্ত রসদ মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এরপর দোহার থানার পাকসেনাদের ক্যাম্পের সৈনিকরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং ক্যাম্পের বাইরে আসা বন্ধ করে দেয়।

২৪শে সেপ্টেম্বর লৌহজং থেকে নারায়ণগঞ্জগামী ১৮ হাজার মণ পাটবাহী একটি জাহাজ পদ্মা নদীতে ডুবিয়ে দেয়া হয়। অক্টোবর মাসে পাকিস্তানীরা আবার ঢাকাতে শান্তির পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে এবং ঢাকা শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করে তোলে। পাক সামরিক জান্তা সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় জনসাধারণের মধ্যে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য বাণিজ্য এবং শিল্প ক্ষেত্রকে উৎসাহিত করে তোলার চেষ্টা করে। এসময় আমরা ভবিষ্যতে ব্যাপক আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ফলে ঢাকা শহরে আমাদের গেরিলাদের কার্যকলাপও কিছুটা শিথিল করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু হানাদার বাহিনীর স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টার খবর পেয়ে আমরা আমাদের হেডকোয়ার্টার থেকে একটি গেরিলা দলকে একটি বিশেষ মিশনে প্রেরণ করি। আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী গেরিলাদল একটি গাড়ীর পেছনে ২৫ পাউন্ড এক্সপ্লোসিভ নিয়ে গাড়ীটিকে তদানীন্তন ইপিআইডিসি এবং হাবিব ব্যাংকের সামনে পার্ক করে রাখে।

সে সময় এই ব্যাংকে যথেষ্ট পরিমাণ পাকিস্তানী ব্যবসায়ীর আনাগোনা ছিল। এছাড়াও এই ব্যাংকটি পাকিস্তানীদের বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে অর্থ পাচারে সাহায্য করছিল। গেরিলারা দুপুর সাড়ে এগারটার দিকে গাড়ীতে ভর্তি বিস্ফোরকের বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে এই গাড়ীর পার্শ্ববর্তী পার্ক করা ১০/২০টি গাড়ী ধ্বংস হয় এবং হাবিব -ব্যাংকের বেশ ক্ষতি হয়। বিস্ফোরণে প্রায় ২৫ জন পাকিস্তানী ব্যবসায়ী আহত হয়। বিস্ফোরণের বিকট শব্দ এবং ধ্বংস দেখে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার সমস্ত জনতা ছুটে পালায় এবং সকল ব্যবসা কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যায়। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই গোটা এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। পাকিস্তানী ব্যবসায়ী মহলের মধ্যেও একটা আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান রেডিও’র ঢাকা কেন্দ্র থেকে এই বিস্ফোরণের ঘটনা স্বীকার করা হয়। হেডকোয়ার্টার থেকে দুটি ৮১ এম-এম মর্টারসহ একটি ডিটাচমেন্ট ঢাকাতে পাঠানো হয়। এই ডিটাচমেন্টকে ঢাকা বিমান বন্দর এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় পাকসেনাদের ওপর এবং পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর ঘাঁটির উপর রকেট নিক্ষেপ করার নির্দেশ দিয়ে পাঠানো হয়। আমাদের এই দলটি হেডকোয়ার্টার থেকে ঢাকার পূর্বে এসে তাদের বেইস স্থাপন করে। এরপর একটি ছোট রেকি (অনুসন্ধানী) দল বিমান বন্দর ও ক্যান্টনমেন্টের চতুর্দিকে ৩/৪ দিন অনুসন্ধান চালায়। এই সময় পাকসেনারা বিমান বন্দর এবং ক্যান্টনমেন্টের নিরাপত্তার জন্য পার্শ্ববর্তী এলাকায় বাঙ্কার তৈরি করে এবং টহল দিয়ে আমাদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করে। যেহেতু মর্টারের রকেট চার হাজার গজ দূরত্বের বেশী নিক্ষেপ করা যায় না এবং মর্টার ফায়ার করার সময় ফ্ল্যাশ দেখে এবং মর্টার পজিশন থেকে শব্দ শুনে পাকিস্তানী টহলদারী সৈনিকেরা এর অবস্থান খুঁজে বের করতে পারে সেহেতু অনুসন্ধান চালাবার পর আমাদের দলটি বাড্ডার নিকট থেকে ৯ই অক্টোবর রাত ১টা ৪০মিনিটের সময় মর্টারের গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। ৬টি গোলা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের একটি লাইনের মধ্যে পড়ে। এতে ১৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। কয়েকটি গোলা বিমানবন্দরের নিকটে পড়ে কিন্তু কোন এয়ারক্রাফট-এর ক্ষতি সাধিত হয় নি। আরো কয়েকটি গোলা পাক টোব্যাকো কোম্পানীর ফ্যাক্টরিতে পড়ে। এতে ফ্যাক্টরির বেশ ক্ষতি হয়। কয়েকটি গোলা মহাখালী হাসপাতালের নিকটে রাস্তায় পড়ে। এই অতর্কিত মর্টার আক্রমণের ফলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পরে আমাদের কাছে খবর পৌঁছে যে, পাকিস্তানীরা ভেবেছিল মুক্তিবাহিনী ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করেছে। সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সমস্ত পাকসেনারা চতুর্দিকে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে- স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র এবং ট্যাংকসহ গুলশান এবং ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় সমস্ত রাত পাগলের মত ছুটাছুটি করতে থাকে এবং সারারাত গোলাগুলি চালায়। আমাদের দলটি আরো কয়েকটি গোলা নিক্ষেপ করে পাকসেনাদেরকে আরো ব্যতিব্যস্ত করে সেখান থেকে সরে পড়ে।

১১ই অক্টোবর দুপুর ১২টায় আমাদের গেরিলারা তিতাস গ্যাস পাইপ লাইন আবার বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ঢাকার গ্যাস সরবরাহ পুনরায় বন্ধ হয়ে যায়।

পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল পিলখানাতে অবস্থান করছিল। পিলখানার পাশের রাস্তা দিয়ে নিউ মার্কেটের দিকে পাকসেনাদের অনেক গাড়ী যাতায়াত করত। আমাদের আজিমপুরের গেরিলা দল সেই রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখে। ১৬ই অক্টোবর রাত সাড়ে ৯টায় পাকসেনাদের একটা জীপ এই রাস্তায় টহল দেবার সময় মাইনের আঘাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ৪ পাকসেনা নিহত এবং দুজন গুরুতরভাবে আহত হয়। এর একদিন পর দুজন পাক পুলিশ মিরপুর রোডে টহল দেবার সময় ধানমন্ডির নিকট আমাদের গেরিলাদের হাতে নিহত হয়।

ঢাকা শহরে মুক্তিবাহিনীর তৎপরতা এবং পাকসেনাদের নাজুক অবস্থা বিদেশী সংবাদ সংস্থাগুলি থেকেও ব্যাপক প্রচার করা হয়। এছাড়া এসব খবর ভয়েস অব আমেরিকা এবং বিবিসি থেকেও প্রচারিত হয়। ফলে হানাদার অধিকৃত এলাকার জনগণের মনেও মুক্তিসংগ্রামের সাফল্য সম্পর্কে নতুন আশার সৃষ্টি হয়।

৩০শে আগস্ট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল শালদা নদীর দক্ষিণ প্রান্তে সমবেত হয় এবং বিধ্বস্ত রেলওয়ে সেতুর উপর বাঙ্কার তৈরি করার প্রস্তুতি নেয়। আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি তাদের উপর গুলি চালিয়ে বেশকিছু পাকসেনাকে হতাহত করে। পাকসেনারা পিছু হটে যায়। পরদিন সকাল আটটায় পাকসেনারা অগ্রসর হয়ে আবার বাঙ্কার তৈরি করার চেষ্টা করে। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের ওপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ৬ জন পাকসেনা নিহত এবং আরো অনেক হতাহত হয়। এরপর পাকসেনারা তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। পাকসেনাদের ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত কামানগুলি এরপর ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানীর অবস্থানের উপর ব্যাপকভাবে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। এতে আমাদের একজন সৈনিক শহীদ এবং ২/৩ জন আহত হয়। পাকসেনাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য কোনাবন থেকে ক্যাপ্টেন গাফফার ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানীকে চাঁদলাতে পাঠান। এই কোম্পানীটিও ৩০শে আগস্ট বিকেল ৪টায় পাকসেনাদের একটি দলের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৯ জন পাকসেনা ও ২৪ জন রাজাকারকে নিহত করে। সংঘর্ষে অনেক পাকসেনা আহত হয়। পরে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ব্রাহ্মণপাড়ার দিকে পালিয়ে যায়। ফলে একটি হালকা মেশিনগান, ৩টি রাইফেলসহ অনেক গোলাবারুদ আমাদের সৈনিকরা দখল করে। এরপর দিন আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের একটি দলকে মন্দভাগ বাজারের পূর্ব পাশে শালদা নদীতে আক্রমণ করে। পাকসেনাদের এই দলটি নৌকাযোগে মন্দভাগ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আক্রমণে একটি নৌকা ডুবে যায় এবং ২০ জন পাকসেনা নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা মন্দভাগ, সেনেরহাট, চাঁদলা প্রভৃতি এলাকায় অবস্থিত আমাদের অবস্থানের ওপর তাদের চাপ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে থাকে। ৩০শে আগস্ট বিকাল ৪টার সময় পাকসেনারা চারটি নৌকা বোঝাই করে এসে ছোট চাঁদলার নিকট অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে ১৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। এরপর সেনারা আমাদের অবস্থানের ওপর ব্রাহ্মণপাড়া এবং শাকুটিতে অবস্থিত মর্টার এবং কামানের সহায়তায় চড়াও হবার চেষ্টা করে। আমাদের সৈনিকরাও সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের এই আক্রমণ প্রতিহত করে। উল্লেখ্য যে, পাকসেনারা প্রায় তিন কোম্পানী সৈন্যশক্তি নিয়ে এই আক্রমণ পরিচালনা করে। সারা রাত ধরে আক্রমণ অব্যাহত থাকে। এই আক্রমণে একজন অফিসারসহ ৩০ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। পাকসেনারা পরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পশ্চাদপসরণ করে। আমাদের দু’জন মুক্তিযোদ্ধা গুরুতরভাবে এবং ৬ জন সামান্য আহত হয়। ৪ঠা সেপ্টেম্বর পাকসেনারা আমাদের চালনা ও শীতলা অবস্থানের ওপর দু’দিক থেকে আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিন যুদ্ধের পর আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয়। পাকসেনাদের পক্ষে অনেক হতাহত হয়- তবে সঠিক ক্ষতির পরিমাণ জানা সম্ভব হয় নি। পরাজয়ের গ্লানিতে পশ্চাদপসরণকারী পাকসেনারা মনের আক্রোশে ব্রাহ্মণপাড়া, ছোট চাঁদলা এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলো জ্বালিয়ে দেয় ও নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। দুই-তিন দিন বিরতির পর পাকসেনারা আবার আমাদের সেনেরহাট অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। সেনেরহাট অবস্থানটি দখল করে নেবার জন্য পাকসেনারা সেনেরহাট পশ্চিমে এবং শালদা নদী স্টেশনের পশ্চিমে বিপুল সংখ্যক সৈন্যের সমাবেশ ঘটায়। তারা দু’দিক থেকে আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নেয়। পাকসেনাদের সমাবেশের কৌশল দেখে আমরা বুঝতে পারি যে, পাকসেনারা মন্দভাগের পশ্চিমে আশাবাড়ি পর্যন্ত আমাদের দখলকৃত সমস্ত এলাকা পুনরুদ্ধারের পরিকল্পনা নিয়েছে। এতে তাদের পক্ষে কসবা এবং মন্দভাগ পুনর্দখল করা সহজ হবে। পাকসেনাদের পরিকল্পনা বুঝতে পেরে আমরা সেনেরহাট অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করে তুলি। ৮ই সেপ্টেম্বর সকালে পাকসেনারা তাদের নয়ঘরে অবস্থিত ১২০ এম এম মর্টার, ব্রাহ্মণপাড়ায় অবস্থিত কামান এবং শশীদলে অবস্থিত ৩ ইঞ্চি মর্টারের সাহায্যে আমাদের সেনেরহাট অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে-সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা সেনেরহাট অবস্থানের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। পাকসেনাদের কামানের গোলায় আমাদের বেশকিছু লোক শহীদ ও আহত হয়। পাকসেনাদের রকেট লাঞ্চারের গোলায় আমাদের ৪টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের দেড়শ গজ পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও আমাদের সৈনিকরা এতটুকু মনোবল না হারিয়ে বরং দৃঢ়তার সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। আমাদের সৈনিকদের গুলিতে অগ্রসরমান অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। আমাদের মুজিব ব্যাটারী গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের উপর গোলাবর্ষণ করে অনেক পাকসৈন্যকে হতাহত করে। পাকসেনারা সমস্ত দিন তাদের আক্রমণ চালিয়ে আমাদের প্রতিরোধ ব্যূহ ভেদ করতে না পেরে এবং তাদের অনেক হতাহত হওয়াতে সন্ধ্যায় তাদের আক্রমণ বন্ধ করতে বাধ্য হয় এবং পিছু হটতে বাধ্য হয়। এর পরদিন পাকসেনারা আমাদের মন্দভাগ এবং মইনপুর অবস্থানের ওপরও আক্রমণ চালায়। সেই আক্রমণও একইভাবে প্রতিহত করা হয়। যাবার পথে পরাজয়ের আক্রোশে সকাল সাতটার সময় পাকসেনাদের প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য প্রবল কামানের গোলার সহায়তায় আমাদের মইনপুরের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দু’ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনাদের প্রায় ৪০ জন সৈন্য হতাহত হয়। আমাদের সৈন্যরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে সেই আক্রমণকেও প্রতিহত করে। আমাদের পক্ষে আমাদের অবস্থানে অবস্থান করা অসম্ভব হয়ে ওঠে। ফলে বাধ্য হয়ে আমাদের সৈনিকরা সে অবস্থান পরিত্যাগ করে ৬০০ গজ পিছে বায়েকের নিকট জেলা বোর্ডের রাস্তায় নতুন অবস্থান গড়ে তোলে। পাকসেনারা এই অবস্থানের ওপরও আক্রমণ চালায়। তাদের সেই আক্রমণকে আমাদের সৈনিকেরা দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করে। পাকসেনারা আর অগ্রসর হতে না পেরে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা মনরা, বাগরা, নাগাইশ, দুশিয়া, আরাদুয়শিরা, ধান্দুহল, সিদলাই প্রভৃতি প্রায় একুশটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং নিরীহ জনসাধারণকে হত্যা করে। ৯ই সেপ্টেম্বর রাতে ক্যাপ্টেন গাফফার একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি ৩’’ মর্টার ও ৬৫ এমএমআরআর সহ পাকসেনাদের অবস্থানের দিকে পাঠিয়ে দেন। এই দলটি শালদা নদীর উত্তর তীর দিয়ে লক্ষিপুরস্থ পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে অনুপ্রবেশ করে এবং দু’দিন রেকি করার পর ১১ই সেপ্টেম্বর বিকাল পাঁচটার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের অতি নিকটে পৌঁছে গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। এতে শত্রুদের দুটি বাঙ্কার রকেটের গোলায় ধ্বংস হয়। গোলার আঘাতে ১১ জন শত্রুসৈন্য নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। পাকসেনারা পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয় এবং বিক্ষিপ্তভাবে গ্রামের মধ্যে কামানের গোলাবর্ষণ করে। এরপর আমাদের রেইডিং পার্টি ১৪ই সেপ্টেম্বর সকাল ৮টায় কায়েকপুরে পাকসেনাদের আরো দু’টি বাঙ্কার রকেটের সাহায্যে ধ্বংস করে। এতে ১৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। ১৫ই সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার সময় আমাদের আরেকটি রেইডিং পার্টি লক্ষ্মীপুরের নিকট পাকসেনাদের দু’টি বাঙ্কার অতর্কিত আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। এতে ৩ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। ১৯শে সেপ্টেম্বর সকাল ৬টায় লক্ষ্মীপুরস্থ পাকসেনাদের আরো দু’টি বাঙ্কার রকেটের গুলিতে উড়িয়ে দেওয়া হয়। এতে দু’জন পাকসেনা নিহত এবং একজন আহত হয়।

ফরিদপুরে আমাদের মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা তাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখে। ৩রা আগস্ট বিকাল ৪টার সময় আমাদের গেরিলারা মাদারীপুরের ভাঙ্গা এবং মুহাফিজ সেতুগুলোতে পাহারারত শত্রুসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। সে আক্রমণে তারা সেতুগুলো ধ্বংস করে দেয় ও ৭টি রাইফেল দখল করে। ১০ তারিখে মিঠাপুরের ডাকঘর এবং ইউসুফপুরের তহসীল অফিস জ্বালিয়ে দেয়। ১৪ তারিখ সকাল ৬টায় আমগ্রামের সমাদ্দার সেতু সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়। ঐ দিনই গেরিলারা আরেকটি দল পাকসেনাদের একটি গাড়ী মাদারীপুর-টেকেরহাট রাস্তায় গাটমাকির নিকট এমবুশ করে। গাড়ীটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে ৯ জন পাকসেনা আহত হয়।

২৭শে আগস্ট আমাদের একটি টহলদার দল পরাশুরাম থানার নিকট পাকসেনাদের একটি টহলদারী দলকে এমবুশ করে ৭ জন পাকসেনাকে নিহত করে। দুই ঘণ্টা সংঘর্ষের পর পাকসেনারা মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে আমাদের গেরিলাদের হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পালাতে সক্ষম হয়। আরেকটি দল ফেনী-বেলুনিয়া সড়কের উপর হাসানপুর সেতুটি ধ্বংস করে দেয়। শালদা নদীর নিকটে আমাদের একটি টহলদার দল দু’জন পাকসেনাকে রাতে টহল দিতে দেখে এমবুশ করে। এই এমবুশে দু’জন পাকসেনাই নিহত হয়। নিহত পাকসেনাদের পকেট থেকে পাওয়া কাগজপত্রে তাদের নাম পাওয়া যায়। এদের একজনের নাম হাবিলদার আবদুল আজিজ এবং অপরজনের নাম ছিল হাবিলদার রহমান গুল। ২০শে সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টায় পাকসেনাদের একটি দল আমাদের শালদা নদী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে। ছোট পাহাড়ের উপর অবস্থিত আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হওয়ার সময় আমাদের সৈনিকদের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের ফলে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। ক্যাপ্টেন গাফফার একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি নিয়ে ১৯শে সেপ্টেম্বর কায়েমপুরে পাকসেনাদের অবস্থানের পিছনে অনুপ্রবেশ করে। পরদিন ভোরে রেকি করার পর সকাল ১০টায় পাকসেনাদের পেছন দিকের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে পাকসেনারা হতভম্ব হয়ে পড়ে এবং আতঙ্কিত হয়ে ছুটাছুটি করতে থাকে। আমাদের রেইডিং পার্টির গুলিতে ৩২ জন পাকসেনা নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। এরপর আমাদের দলটি আক্রমণ প্রত্যাহার করে শত্রু অবস্থান থেকে নিরাপদ দূরত্বে চলে আসে। পাকসেনাদের একটি দল কায়েমপুরে তাদের অবস্থানের দিকে নৌকাযোগে অগ্রসর হবার পথে আমাদের এমবুশ পার্টি তাদের উপরও অতর্কিত আক্রমণ চালায়। দুটি নৌকা আক্রমণের ফলে ধ্বংস হয়ে যায় এবং এতে ১৫ জন পাকসেনা নিহত হয়।

আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের ওপর তাদের হামলা চালিয়ে যেতে থাকে।পাকসেনাদের চাপও আমাদের ওপর থেকে ধীরে ধীরে কমে যায়।পাকসেনারা তাদের বিপর্যস্ত অবস্থানগুলো বাঁচানোর জন্য ভারী তোপের সাহায্য আমাদের মন্দভাগ কোনাবন এবং শালদা নদীর অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে।এতে আমাদের ২-জন নন-কমিশন্ড অফিসার ও ১জন গোলন্দাজ বাহিনীর ও-পি শহীদ হয়।পাকসেনাদের একটি জঙ্গি বিমান ২৮শে সেপ্টেম্বর তাদের সেনাদের সাহায্যর জন্য দুপুর দুটো থেকে তিনটা পর্যন্ত আমাদের অবস্থানগুলোর ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের অবস্থানগুলো আমাদের আক্রমণে অনেকটা দুর্বল হয়ে পড়েছে আমরা বুঝতে পারি এবং তাদেরকে সম্পূর্ণ এই এলাকা থেকে হটিয়ে দেয়ার জন্য ২৭তারিখে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৮ তারিখ সাড়ে ১০টার সময় ৪র্থ বেঙ্গলের একটা শক্তিশালী দল উত্তর দিক থেকে কায়েমপুরের শত্রুঅবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়।৪ঘন্টা স্থায়ী যুদ্ধের পর পাকসেনাদের ১৫জন নিহত এবং ৩০জন আহত হয়।আমাদের কিছু সংখ্যক যোদ্ধাও শহীদ এবং আহত হয়।আমাদের সৈন্যদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা তাদের কায়েমপুর ঘাঁটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আমাদের সৈন্যরা তাদের পরিত্যক্ত অবস্থান থেকে মেশিনগান, মর্টার ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রচুর গোলাবারুদ দখল করে নেয়।এখানে উল্লেখযোগ্য যে,সেপ্টেম্বর মাসের ৯তারিখে আমাদের সৈন্যরা এইসব অবস্থান গুলো থেকে শত্রুর প্রবল চাপের মুখে পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রের অভাবে পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়।ফলে শত্রুরা এইসব জায়গা দখল করে নেয়। এর এক সপ্তাহ পরেই আমরা পুনরায় পাল্টা আক্রমণ চালাই।এই পাল্টা আক্রমণের ফলে প্রায় ২০১ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮৩জন আহত হয়,৭০টি ব্যাংকার ধ্বংস করা হয় এবং অসংখ্য অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে আসে। আমাদের ক্ষয়ক্ষতি ছিল সে তুলনায় অতি অল্প-১০জন শহীদ হয় এবং৬জন আহত হয়।আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের দখলকৃত কায়েমপুরা, শ্রীপুর, মঈনপুর, কামালপুর, লক্ষ্মীপুর প্রভৃতি জায়গা পুনরুউদ্ধার করে।এরপর সেপ্টেম্বর মাসের শেষ পর্যন্ত দাউসসহ মন্দভাগের পশ্চিমের বিস্তীর্ণ এলাকা সম্পূর্ণরুপে শত্রুমুক্ত করা হয়। এর ফলে পাকসেনাদের মন্দভাগ রেলওয়ে স্টেশন এবং তার পশ্চিমে আশাবাড়ি পর্যন্ত আমাদের দখলে থাকা এলাকা পুনরুদ্ধার সমস্ত আশাও পরিকল্পনা সম্পূর্ণরুপে ব্যর্থ হয়ে পড়ে এবং তারা হতাশ হয়ে পড়ে।

কসবার পশ্চিমে টি,আলীর বাড়ির নিকট অবস্থিত পাকসেনাদের অবস্থানগুলোর ওপর আমাদের সৈনিকরা ক্রমাগত চাপ বাড়িয়ে যাচ্ছিলো। ২৮শে আগস্ট ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানি থেকে একটা প্লাটুন পাক অবস্থানের পিছনে পাঠিয়ে দেয়। আমাদের কাছে খবর ছিল পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোতে নৌকার সাহায্য সরবরাহ কাজ চালাচ্ছে। এই প্লাটুনকে পাকসেনাদের সরবরাহকারি নৌকাগুলো এমবুশ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। প্লাটুনটি ২৯ তারিখ সকালে পাকসেনাদের পেছনে জলপথের ওপরে এমবুশ লাগিয়ে বসে থাকে। বেলা ২-৪০মিনিটে পাকসেনাদের দুটি নৌকা সেদিকে অগ্রসর হয়।এমবুশের আওতায় আসার সাথে সাথে আমাদের সৈনিকরা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়।প্রচণ্ড গোলাগুলির পর তাদের দুটি নৌকাই ডুবিয়ে দেওয়া হয় এবং সেই সঙ্গে ৩০জন পাকসেনাই নিহত হয়। আমাদের একজন সৈনিক শহীদ হয়। ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানির আরও দুটি প্লাটুন সেপ্টেম্বর মাসের ৫ তারিখ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত লাটুমুড়া,তাজিশ্বর,ফতেহপুর,চারনল,বগাবাড়ি প্রভূতি স্থানে পাকসেনাদের অতর্কিত আক্রমণ করে ৩৬ জন খানসেনা ও ১৭ রাজাকার নিহত হয় ও আহত করে।পাকসেনারা এই এলাকায় আমাদের সৈনিকদের আক্রমণাত্মক কার্যকলাপে অতিষ্ঠ হয়ে একটি শক্তিশালী দল তাজিশ্বর ও বগাবাড়ির দিক ১১ই সেপ্টেম্বর অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই দলটির অগ্রসরের খবর আমাদের কাছে আগেই পৌঁছে যায়। ডি কোম্পানির দুটি প্লাটুন বগাবাড়ির নিকট পাকসেনাদের পথে এমবুশ পেতে বসে থাকে।১১তারিখ সকাল ৬টায় সময় অগ্রগামী পাকসেনা দলটি আমাদের এমবুশের আওতায় পড়ে যায়।আমাদের সৈনিকরা তাদের অতর্কিত আক্রমণ করে।প্রবল আক্রমণের মখে টিকতে না পেরে আবার পশ্চাদপসরণ করে। এই যুদ্ধের ফলে ১৫জন পাকসেনা নিহত হয় এবং দুজন আহত হয়। পাকসেনাদের এই এলাকায় বিপর্যস্ত অবস্থায় তাদের সাহায্যর জন্য ১৩ তারিখে পাকসেনাদের পাঁচটি জঙ্গি বিমান বিকেল পাঁচটার সময় আমাদের অবস্থানগুলোর ওপর এক ঘন্টাব্যাপী প্রচন্ড বোমাবর্ষণ করে। পাকসেনাদের বিমান হামলা আমাদের সৈনিকদের মনোবল ভাঙ্গতে পারেনি। তারা তাদের অবস্থান শত্রুর চাপের মুখেও অটল থাকে। পাকসেনাদের সংঘর্ষ উপরোল্লিখিত এলাকায় এর পরেও অব্যাহত থাকে।

পাকসেনাদের এই সেক্টরে আরও সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে।তাদের অবস্থানগুলোর দিকে পাকসেনাদের অগ্রসর হওয়ার পথে বাধা দেওয়ার জন্য ৪র্থ বেঙ্গলের ডি কোম্পানি ১৬ই সেপ্টেম্বর শত্রু অবস্থানের মেহারী গ্রামে একটি এমবুশ পেতে বসে থাকে। ১৭তারিখ সকাল ৭টায় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালি দল পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসর হয়ে আমাদের আক্রমণের জন্য মেহারীতে আমাদের এমবুশ পার্টি তাদের ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। নিজেদের অবস্থানের এত কাছে তারা আক্রান্ত হবে তা তারা ভাবতেও পারেনি। ফলে এই আকস্মিক আক্রমণে তারা দিকবিদিক হারিয়ে ফেলে এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়।পাক গোলন্দাজ বাহিনী কামানের গোলাতে তাদেরকে পালাতে সহায়তা করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাদের অনেক সৈন্য হতাহত হয়। এই এমবুশে পাকসেনাদের ২১জন নিহত এবং ৪৩জন আহত হয়। আমাদের সৈনিকদের নিরাপদে পিছু হটে আসতে সক্ষম হয়। ঐদিন রাত্রে আমাদের এই দলটি সায়েদাবাদের নিকট পাকসেনাদের একটা ঘাটিতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে দুটো জীপ ও ১টি ৩টন গাড়ী ধ্বংস করে দেয়। এর পরদিন আমাদের রেইডিং পার্টি চারগাছা বাজারের নিকট পাকসেনাদের একটা টহলদার দলকে এমবুশ করে ২০জন পাকসেনাকে হতাহত করে। পাকসেনারা এই সংবাদ পেয়ে তাদের টহলদার দলের সাহায্যার্থে একটি শক্তিশালী দল তিন নৌকা বোঝাই করে চারগাছের দিকে অগ্রসর হয়। কিন্তু পৌঁছার আগেই আমাদের সৈনিকরা তাদেরকে শিমরাইলের নিকটে এমবুশ করে দুটি নৌকা ডুবিয়ে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে দু নৌকা ভর্তি পাকসেনাদের সবাই নিহত হয়। এই সংঘর্ষে আমাদের ১জন সৈনিক শহীদ হন। আমাদের সৈনিকদের জন্য এই এলাকার পাকসেনাদের এহেন বিপর্যয়ের ফলে তারা পুনরায় আরো ব্যাপক ভাবে এই এলাকায় সৈন্য সমাবেশ ঘটায় এবং চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে। এতে আমরা আরেক অসুবিধার সম্মুখীন হই। ঢাকাতে এবং ফরিদপুর যেসব গেরিলাদের পাঠানো হতো তারা এই এলাকার ভিতর দিয়ে যাতায়াত করতো। পাকসেনাদের তৎপরতার জন্য সমস্ত অনুপ্রবেশ পথগুলো প্রায় বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়। ২২শে সেপ্টেম্বর আমাদের ৬০জন গেরিলার একটি দল চারটি নৌকায় অনুপ্রবেশের পথে পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ফলে দুটি নৌকা ডুবে যায়। চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় এবং একজন আহত হয়।তিনটি স্টেনগান, চারটি রাইফেল এবং কিছুটাকা ও ১০০০গুলি পানিতে পড়ে হারিয়ে যায়। গেরিলারা আহত ও শহীদের নিয়ে আমাদের অবিস্থানে ফিরে আসে। এই রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আমার পক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো বিপজ্জনক হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায় আমি মেজর আইনুউদ্দিনকে যে কোন উপায়ে এই এলাকাকে পুনঃ মুক্ত করার জন্য নির্দেশ দেই। তাকে আরেকটি অতিরিক্ত দল দিয়ে তার শক্তি বৃদ্ধি করে কসবা থেকে নবীনগর পর্যন্ত আমাদের তৎপরতা বাড়িয়ে নেয়ার জন্য নির্দেশ দিই। পাকসেনাদের বিভিন্ন ঘাঁটির উপর বার বার আক্রমণ করে তাদেরকে এই এলাকা থেকে বিতাড়িত করার জন্য। সকল ব্যবস্থা নেয়া হয়।শক্তি বৃদ্ধি পাওয়াতে মেজর আইনুউদ্দীন তার তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১০/১২টির শক্তিশালী রেইডিং পার্টি কসবা, সাঈদাবাদ, চরগাছা প্রভৃত এলাকাতে পাঠিয়ে দেয়।এই রেইডিং পার্টিগুলো বিভিন্ন স্থানে পাকসেনাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ২৫জন পাকসেনা নিহত এবং ৩০জনকে আহত করে ও১টি গাড়ী ধ্বংস করে। আমাদের পুনঃ পুনঃ আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আস্তে আস্তে এলাকাতে আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করে। ২৪শে সেপ্টেম্বর সকাল ৭-৩০টায় সময় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল ১৭টি নৌকায় আমাদের একটা রেইডিং পার্টিকে আক্রমণ করার জন্য নবীনগরের দিকে অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের নৌকাগুলো যখন বিদাকোর্ট গ্রামের নিকট পৌছায় তখন আমাদের সৈনিকরা তাদেরকে অতর্কিত আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাঁচটি নৌকা ডুবে যায় এবং অন্তত ২৫জন পাকসেনা নিহত এবং পঁয়ত্রিশজন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই সকল আক্রমণে সে এলাকার সমস্ত জনসাধারণ স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলে এবং বিপুল আনন্দে মুক্তিযুদ্ধাদেরকে অভিনন্দিত করে। এর কয়েকদিন পর ৩রা অক্টোবর পাকসেনাদের একটি লঞ্চ, গোলাবারুদ ও রসদ নিয়ে সাইদাবাদ যাবার পথে আমাদের মুক্তিযুদ্ধাদের দ্বারা মলুগ্রামে আক্রান্ত হয়। আক্রমণের ফলে লঞ্চটির গোলাবারুদ আগুন লেগে ডুবে যায়। সেই সঙ্গে ১০জন পাকসেনা নিহত হয় ও আহত হয়।আমাদের চারজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয় এবং দুজন আহত হয়। এই খবর পেয়ে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল আরেকটি লঞ্চযোগে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে পরগাছার নিকট আক্রমণ করে। প্রায় ২-৩ঘণ্টা যুদ্ধের পর অনেক পাকসেনা লঞ্চ থেকে ঝাঁপিয়ে পালাবার চেষ্টা করে এবং ডুবে যায়। পাকসেনাদের ৭০/৮০জন নিহত ও আরো অনেক আহত হয়। লঞ্চটির ও বেশ ক্ষতি হয় এবং বহু কষ্টে বাকী সৈন্যদের নিয়ে লঞ্চটি সেখান থেকে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ঐদিন বিকেল ৫টায় পাকসেনাদের ২০টি নৌকা ও ৩টি স্পিডবোট আমাদের মুক্তিযুদ্ধাদের দ্বারা কসবার নিকট আক্রান্ত হয়। ফলে ৩য় পাঞ্জাবী রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লে:কর্ণেল জামান ও একজন ক্যাপ্টেন সহ ১২জন পাকসেনা নিহত হয় এবং তিনটি স্পীডবোট ও কয়েকটি ণৌকা ডুবে যায়।
সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে থেকে অক্টোবর প্রথম সপ্তাহ এই এলাকায় ছোট এমবুশ এবং ছোট ছোট আক্রমণের ফলে পাকসেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। ৩রা ও ৪ঠা অক্টোবরে চাতগাছা, মলুগ্রাম, কসবা প্রভূতি জায়গায় পাকসেনাদের অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ সৈনিক নিহত হয়। একটি লঞ্চ, তিনটি স্পিডবোট, ১০টি নৌকা ডুবে যায় কিংবা আমাদের দখলে আসে। একজন লে:কর্ণেলসহ বেশ কয়েকজন অফিসার নিহত হয়। এর ফলে এই এলাকায় পাকসেনাদের তৎপরতা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায় এবং তারা অনেক পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়।

কুমিল্লার দক্ষিণে এবং নোয়াখালী এলাকাতেও আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের তৎপরতা আরো জোরদার করে তোলে। ৩০শে আগস্ট সকাল ১০টায় লাকসাম থেকে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল চৌদ্দগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি আমাদের অবস্থানের ২০০গজের মধ্যে পৌঁছলে আমাদের মুক্তিযুদ্ধারা তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। উভয় পক্ষের মধ্যে সমস্তদিন ধরে গোলাগুলি চলতে থাকে। পাকসেনারা আক্রোশে রাস্তার চতুর্দিকের সমস্ত গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। প্রচণ্ড আক্রমণ সত্ত্বেও আমাদের সৈনিকরা নিজেদের অবস্থানে অটল থাকে। সমস্ত দিনের যুদ্ধে তাদের প্রায় ২০জন সৈন্য নিহত হয় এবং অনেক আহত হয়। তারা অগ্রসর হতে সক্ষম না হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। পরদিন ল্যান্সনায়েক লোকমান আলী ও ল্যান্সনায়েক আহসান উল্লার নেতৃত্ব একটি ডিমোলিশন পার্টিকে চৌদ্দগ্রাম -বাংগোড়া-লাকসাম রাস্তা দিয়ে শত্রু সৈন্যদের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাবার জন্য রাস্তার মাঝে মাঝে ডিমোলিশন দিয়ে ভেঙ্গে দেওয়ার জন্য পাঠানো হয়। দলটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছানোর পর তাদের ডিমোলিশন কাজ শুরু হয়। কিন্তু স্থানীয় শান্তিকমিটি ও তাদের লোকেরা পাকসেনা কর্তৃক প্রতিশোধের ভয়ে রাস্তায় ডিমোলিশন লাগাতে বাধা দেয়। ল্যান্স নায়েক স্থানীয় লোকদেরকে দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা বুঝিয়ে বলেন। বোঝানোর পর শান্তিকমিটির লোকেরা তাদের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সহযোগীতা করে। তারা নিজেরাই রাস্তা খুঁড়ে তিন জায়গাতে ৫০পাউন্ড জিলেটিন এক্সপ্লোসিভ এর ব্যাগ লাগায় এবং ৮০ফুট রাস্তা উড়িয়ে দেয়। এতে পার্শ্ববর্তী রাস্তার দুপাশের পানি রাস্তার খাদে প্রবেশ করে। ফলে চৌদ্দগ্রাম -লাকসাম যোগাযোগব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ঐদিন রাতে আমাদের আরেকটি টহল দল কুমিল্লার দক্ষিণ পূর্বে আর একটি দল নাঙল কোট ও লাকসামের মাঝামাঝি রেললাইনের উপর মাইনপুঁতে একটি ইঞ্জিনসহ তিনটি রেলওয়ে বগী ধ্বংস করে দেয়। কাজলপুরের নিকট আরেকটি মালবাহী ট্রেন আমাদের পোঁতা মাইনের আঘাতে লাইনচ্যুত হয়।ফেনী ও লাকসামের মাঝে নাওতি স্টেশনের নিকট ডিমোলিশন লাগিয়ে রেললাইনের ১৪ফুট রাস্তা ধ্বংস করে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা -ফেনী রেললাইনের পাশে টেলিফোন লাইনের তার কয়েক জায়গায় কেটে দেয়। ৩রা সেপ্টেম্বর আমাদের আর একটি ডিমোলিশন পার্টি লালমাই ও জাঙ্গালিয়া স্টেশনের মাঝে রেলওয়ে রাস্তার উপর ডিমিলিশন লাগিয়ে রেললাইনের খানিকটা ঊড়িয়ে দেয় এবং জমুয়া ও বেতুরার রেভিনিউ অফিস পুড়িয়ে দেয়।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বেলুনিয়াতে পাকসেনারা তাদের তৎপরতা আরও বাড়িয়ে তোলে। ৬ই সেপ্টেম্বর পাক সামরিক জান্তা নয়নপুরের নিকট বিপুল পরিমাণ সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। ওইদিন রাত প্রায় ৩টার সময় পাক সেনাদের দুটি প্লাটুন সোলেনিয়া নদী অতিক্রম করে। আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। পাকসেনাদের দলটি নৌকা যোগে যখন নদী পার হওয়ার চেষ্টা করে তখন আমাদের অগ্রবর্তী দল তাদের অপর আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলে ১৫ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছুসংখ্যক আহত হয়। অবশিষ্ট সৈন্যরা মর্টারের গোলার সহায়তায় পশ্চাদপসরন করে। পরদিন বিকেল ৪টায় পাকসেনাদের আরেকটি শক্তিশালী দল আরও পশ্চিমে মহুরী নদী অতিক্রম করার চেষ্টা করে। এখানেও আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থান থেকে তাদের অপর আক্রমণ চালানো হয়। গোলাগুলিতে পাকসেনাদের একজন অফিসার সহ ১৫ জন নিহত এবং প্রায় ২০ জন আহত হয়। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রাখে এবং আমাদের অবস্থানগুলোর অপর প্রচন্ডভাবে কামানের গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের সৈন্যরা টিকতে না পেরে অগ্রবর্তী অবস্থান পরিত্যাগ করে স্থায়ী অবস্থানে ফিরে আসে। পাকবাহিনী তাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখে। সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত এই আক্রমণ চলতে থাকে। আমাদের বীর সৈনিকরা তাদের অবস্থান থেকে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনাদের আক্রমণকে দেড় ঘণ্টার যুদ্ধে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। পাকসেনাদের অনেক হতাহত হয় ও পরে আমাদের পালটা আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এরপর পাকসেনারা পরশুরামের নিকট সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য পরশুরামে মোতায়েন করে। ৯ই সেপ্টেম্বর আমাদের খবর সংগ্রহকারী লোকেরা জানতে পারে যে পাকসেনারা বেশ কয়েকটি ১০৫ এর এম এম কামান সহ সালিয়ার নিকট অবস্থান নিচ্ছে। পাকসেনাদের তৎপরতা দেখে আমরা বুঝতে পারি যে মুহুরী নদীর পূর্ব পাড়ে তাদের অবস্থান পাকা করে নদী পার হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এছাড়া বিশ্বস্ত সূত্রে আমরা আরও জানতে পারি, যে কোন উপায়ে বেলুনিয়া এলাকা নিজেদের দখলে আনার জন্য তারা বদ্ধ পরিকর। ১০ই সেপ্টেম্বর সকাল ৯টা থেকে পাকসেনারা মহুরী নদী পার হয়ে প্রচণ্ড কালানের গোলার সহায়তায় আমাদের অবস্থানের অপর আক্রমণ চালায়। সমস্ত দিন যুদ্ধের পড় পাকসেনাদের এই আক্রমণকে আমাদের যোদ্ধারা প্রতিহত করে। বিপুল ক্ষয়ক্ষতির পড় আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের আবার পশ্চিম তীরে পশ্চাদপসরণে বাধ্য করে। আমাদের সেনারা যখন পাকসেনাদের ওপর সম্মুখসমরে প্রতিআক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল সে সময়ে গেরিলাদের বেশ কয়েকটি দল পাকবাহিনীর পিছনে আঘাত হেনে তাদেরকে বিপর্যস্ত করে তোলে।

মতিগঞ্জে গেরিলা পাকসেনাদের একটি ক্যাম্পে অতর্কিতে আক্রমণ করে একজন অফিসারসহ ১১ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ২০ জনকে আহত করে। পাকসেনাদের ক্যাম্প থেকে প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র দুটি মোটর সাইকেল, ৩টি রেডিও এবং তিনটি বাক্স ঔষধ দখল করে নেয়। আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা এই সঙ্ঘর্ষে শহীদ হয়। আরেকটি দল ১০ই সেপ্টেম্বর রাত ১০টায় নয়াপাড়ার শত্রুঘাঁটি আক্রমণ করে তাদেরকে সেখান থেকে বিতাড়িত করে। এখানেও আমাদের গেরিলারা বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেয়। ওপর আরেকটি গেরিলা দল ফেনীর নিকট ফতেপুর রেলসেতু ডিমোলিশন লাগিয়ে উড়িয়ে দেয়। ফলে ৫০ ফুটের একটি খাদের সৃষ্টি হয় এবং এর ফলে লাকসাম-ফেনীর মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া ফেনী শহরেও আমাদের গেরিলারা গ্রেনেড নিক্ষেপ করে পাকসেনাদের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। গেরিলারা ফেনী থেকে ফুলগাজী পর্যন্ত পাকসেনাদের টেলিফোন লাইন কেটে তাদের টেলিফোন যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলোতে ফেনী থেকে ট্রলির সাহায্যে রসদ সরবরাহ করত। তাদের আই সরবরাহ বন্ধ করবার জন্য চিতলিয়ার নিকট ঘানিমোড় রেলসেতুটি উড়িয়ে দেয়ার জন্য আমাদের পাইওনিয়ার প্লাটুন পাঠানো হয়। এই প্লাটুনটি বিপদের ঝুঁকি নিয়ে রাতে পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে অনুপ্রবেশ করে। পরদিন সকালে তারা সেতুটি সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে জানতে পারে পাকসেনারা সেতুটিকে কড়া প্রহরার ব্যাবস্থা করেছে। অতি কষ্টে তারা মহুরী নদী সাতরিয়ে রাতের অন্ধকারে সেতুটির নিচে ডিমোলিশন লাগিয়ে এই গুরুত্তপূর্ণ সেতুটি উড়িয়ে দেয়। এর ফলে ফেনী এবং বেলুনিয়াতে পাকসেনাদের ট্রলির সাহায্যে সরবরাহ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়।

শত্রুদের উপর আমাদের আক্রমণের চাপ অব্যাহত রাখা হচ্ছিল। ১১ই সেপ্টেম্বর আমাদের একটি শক্তিশালী দল কামানের সহায়তায় সন্ধ্যা ৭টায় পরশুরামের নিকট পাকঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে সাতজন পাকসেনাকে নিহত এবং পনের জনকে আহত করে। এর পরদিন আমাদের দুটি শক্তিশালী দল সালদার এবং জগন্নাথ দীঘির শত্রুঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে চারজন পাকসেনাকে নিহত এবং অনেককে আহত করে। আমাদের এই পুনঃ পুনঃ আঘাতের ফলে পাকসেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং ফেনীর দক্ষিণে তাদের কামানের অবস্থান গড়ে তোলে। সেখান থেকে আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড কামানের আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের ফলে আমাদের অবস্থান বেশ কিছুটা বিপর্যয়ের মুখে পড়ে যায়। পাকসেনারা তাদের কামানের আক্রমণ অব্যাহত রাখে। তাদের এই কামানের ঘাঁটিগুলোকে ধ্বংস করে দেবার জন্য ১৪ই সেপ্টেম্বর তারিখের সকালে আমাদের একটি কোম্পানিকে তিনটি মর্টার সহ পাকসেনাদের অবস্থানের পেছনে পাঠানো হয়। গোপন পথে অনুপ্রবেশ করে এই দলটি ফেনী বিমান বন্দরের পশ্চিমে বিকেলে পৌঁছে এবং পাকসেনাদের ব্রিঞ্চিতে অবস্থিত কামানঘাঁটি সম্বন্ধে বিস্তারিত খবর সংগ্রহ করে রাত ১-৩০টায় পাক অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এই ধরণের আক্রমণের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলোনা। আক্রমণের ছাপে উপায়ান্তর না দেখে তারা ফেণীতে অবস্থিত তাদের অন্য গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যের আবেদন জানায়। ফেনী থেকে পাকসেনাদের কামানগুলো আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের দুর্ধর্ষ গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের ফেনী অবস্থানের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। দুঘণ্টা যুদ্ধের পড় আমাদের রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের ১০ জনকে নিহত, ১৬ জনকে আহত এবং তাদের আরও বহু ক্ষতি সাধন করে নিরাপদে নিজেদের অবস্থানে ফিরে আসে। আমাদের কামানের আক্রমণ পাকসেনাদের ঘাঁটির যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করে এবং তারা তাদের গোলাবর্ষন বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পড়ে আমরা জানতে পারি যে, আমাদের এই আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের গোলন্দাজ ঘাঁটিতে ১১ জন পাকসেনা নিহত এবং ২৩ জন আহত হয়। ব্রিঞ্চিতে ৩ টি জিপ ধ্বংস হয়ে যায়। একটি কামানেরও মারাত্মক ক্ষতি হয়। ফানিতে পাকসেনাদের মনোবল অনেকটা ভেঙ্গে পড়ে। বিশেষ করে পাকসেনাদের সহকারী শান্তি কমটির সদস্য দালালরা ভয়ে ফেনী শহর পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। অপরদিকে এই আক্রমণের ফলে আমাদের মুক্তিবাহিনী ও স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের মানোবল আরো বৃদ্ধি পায়। এর পরদিন আমাদের একটি কোম্পানি সালদার শত্রুঘাটি রেইডিং করার জন্য পাঠানো হয়। সমস্ত দিন রেকি করার পড় রাত ৮-৩০ মিনিটে আমাদের কোম্পানিটি গোলন্দাজ বাহিনী এবং ৪ মর্টারের সহায়তায় পাকসেনাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায় এবং প্রায় এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের অগ্রবর্তী অবস্থানগুলো দখল করে নেয়। পাকসেনারাও তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে আমাদের অগ্রসর পথে বাঁধা দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের সৈনিকরা ক্ষিপ্রতা ও বীরত্বের সঙ্গে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর তাদের হামলা অব্যাহত রাখে। পাকসেনাদের গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের ফলে আমাদের অগ্রসর পথে কিছুটা বাঁধা আসে। কিন্তু তবুও আমাদের সৈনিকরা ডান দিক থেকে তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখে। সকাল পর্যন্ত সঙ্ঘর্ষে পাকসেনারা তাদের অবস্থান থেকে কিছুটা পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। আমাদের সৈনিকরা এই অবস্থানের পেছনে অবস্থিত একটি পেট্রোল ডাম্পও ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। এতে প্রায় ২০/২৫ জন সেনা হতাহত হয়। শালদার অবস্থান থেকে পাকসেনাদের বিতাড়ির করার পর আমরা পরশুরামের নিকট অনন্তপুর গ্রামে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর চাপ বাড়িয়ে তুলি। প্রথমদিন এই অবস্থানে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণ চালায়। ফলে ১০ জন পাকসেনা নিহত এবং আরও বেশ কিছু আহত হয়। এর একদিন পড় আবার অনন্তপুর গ্রামের অবস্থানের উপর আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী আক্রমণ চালায়। ফলে ১৩ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়।

২৯শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার সময় ৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানি পাকসেনাদের নয়ানপুর অবস্থানের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীও সহায়তা করে। যুদ্ধ প্রায় ৩০ তারিখ রাত দুটো পর্যন্ত চলতে থাকে। ছয় ঘণ্টার যুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা ১০ জন পাকসেনা নিহত, ১৫ জন আহত ও ৬ জনকে বন্দী করে। তাছাড়া অনেক অস্ত্রশস্ত্রও দখল করে নেয়। পাকসেনারা মাসীরহাট থিক আরও সৈন্য এনে শক্তি বৃদ্ধি করে আমাদের উপর পালটা আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা সাহসিকতার সাথে পড়ে আক্রমণের মোকাবিলা করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাদের বাহিনী গোলাবারুদ ফুরিয়ে এলে অবস্থান পরিত্যাগ করে নিরাপদে মূল অবস্থানে ফিরে আসে। এই সঙ্ঘর্ষে আমাদের পক্ষে একজন শহীদ ও ১১ জন আহত হয়। আমাদের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকসেনাদের একটি সরবরাহকারী ট্রলি মুন্সীরহাট থেকে বেলুনিয়ার দিকে যাওয়ার পথে আমাদের সৈনিকদের পুঁতে রাখা মাইনের আঘাতে ধ্বংস হয়। ট্রলিতে বোঝাই গোলাবারুদ এবং রেশনও ধ্বংস হয়ে যায়।

এই ঘটনার দুদিন পর ১লা অক্টোবর রাত ১১টার সময় আমাদের একটি শক্তিশালী দল পাকসেনাদের মুন্সীরহাট অবস্থানের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চলায়। মুন্সীরহাট পাকসেনাদের জন্য বেলুনিয়া সেক্টরে অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ ঘাঁটি ছিল। কারণ এই ঘাঁটির মাধ্যমে বেলুনিয়ার পশ্চিম দিকে তাদের অবস্থানগুলোতে সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। বস্তুত সেই জন্যই আমাদের আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে পালিয়ে যায়। এর পর দিন ২রা অক্টোবর পরশুরাম শত্রুঘাঁটির উপর আমাদের সৈনিকরা আক্রমণের চাপ বাড়াতে শুরু করে। পাকসেনারা বিপুল সংখ্যক সমাবেশ করে তাদের এই অবস্থানকে রক্ষা করার জন্য আমাদের উপরও পাল্টা আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের পরশুরামের দিক থেকে এই পালটা এক্রমন দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করে। এতে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকসেনাদের আক্রমণ প্রতিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অন্যান্য অবস্থান থেকে প্রায় ২/৩ কোম্পানি সৈন্য একত্রিত করে ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া পাকসেনাদের উপর পুনরায় আক্রমণ চালাবার জিনয় নির্দেশ দেই। আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালিয়ে তাদের পিছু হটিয়ে দেয় এবং মুহুরি নদী অতিক্রম করে পরশুরামের পাকসেনাদের অনেকগুলো অবস্থান দখল করে নেয়। পাকসেনারা তাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ হওয়াতে নিজেদের গোলন্দাজ বাহিনীকে সাহায্যের জন্য অনুরোধ জানায়। আমজাদনগরে অবস্থিত পাক গোলন্দাজ বাহিনী পরশুরামের উপর গোলাবর্ষণ শুরু করে। কিন্তু সৌভাগ্যবশত আমাদের আক্রমণের চাপ ও তাদের নিজেদের গোলার আঘাতে পাকসেনাদের অবস্থানটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। প্রায় ৩০/৪০ জন পাকসেনা নিহত ও প্রচুর সংখ্যক সৈন্য আহত হয়। তারা উপায়ান্তর না দেখে তাদের পরশুরামের অবস্থানটি পরিত্যাগ করে পিছনে এসে নতুন করে অবস্থান নেয়। কয়েকদিনের যুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় আমাদের সৈনিকদের কাছে বিপর্যস্ত হয়ে অঙ্কে ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে বেলুনিয়া ও পরশুরামের পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে যায়। পাকসেনাদের এহেন মোচনীয় অবস্থা দেখে আমরা তাদের উপর আমাদের চাপ অব্যাহত রাখি। ২রা অক্টোবর সন্ধ্যায় আমাদের একটি দল পাকসেনাদের শালদার অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ৯জন পাকসেনা নিহত করে এবং তাদের অনেক রসদ বিনষ্ট করে দেয়। পাকসেনারা তাদের অবস্থানগুলোকে রক্ষা করার জন্য ২রা বা ৩রা অক্টোবরের মধ্যবর্তী রাতে ফেনী থেকে মুন্সিরহাট ও চিতলিয়াতে আরও এক ব্যাটালিয়ন সৈন্য সমাবেশ করে। ৩ তারিখ সকাল ৬টার সময় তাদের একটি শক্তিশালী দল আমাদের অনন্তপুর ও ধানীকুন্ডার অগ্রবর্তী অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। ভারী কামা ও মর্টারের সাহায্যে তারা আমাদের অবস্থানগুলোতে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে এবং সেই সঙ্গে তাদের পদাতিক বাহিনীও আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা যখন অবস্থানের ৪০/৫০ গজের মধ্যে পৌঁছে, তখন আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর প্রচণ্ড গুলি চালিয়ে প্রায় ২৫/৩০ জন পাকসেনাকে নিহত করে। পাকসেনারা হামলা চালিয়ে আমাদের অনন্তপুরের অবস্থানের দক্ষিণাংশের ট্রেঞ্চগুলো দখল করে নেয়। দক্ষনাংশে একটি হাল্কা মেশিনগান বাঙ্কারের উপর কামানের গুলি লেগে ধ্বংস হয়। এই আঘাতে আমাদের কয়েকজন সৈনিক শহীদ হয়। পাকসেনাদের এই প্রবল চাপ ও প্রচণ্ড কামানের গুলির মুখে প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ ও অস্ত্রের ওভাবে টিকতে না পেরে আমাদের অগ্রবর্তির ঘাঁটির সৈনিকরা পিছু হটে মুখ্য অবস্থানে আসে। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ আমাদের মুখ্য অবস্থানের উপরও চালাতে থাকে। এই সময় আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী এবং মর্টারের গলাতে তাদের আক্রমণ প্রতিহত হয়ে যায়। মুখ্য অবস্থানের সামনে টিকতে না পেরে তারা ধীরে ধীরে পিছু হটতে চেষ্টা করে। আমাদের মুখ্য অবস্থান থেকে একটি শক্তিশালী দল তাদের উপর পাল্টা আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের পাল্টা আক্রমণকারী দলটি আরও অগ্রসর হয়ে অনন্তপুর এবং ধানীকুন্ডা পুনর্দখল করে। পাকসেনাদের প্রায় ৪০/৫০ জন হতাহত হয়। আমাদের একজন শহীদ ও ৫ জন আহত হয়। পাকসেনারা মুজুমদারহাট ও চিতলিয়াতে তাদের অবস্থাগুলোতে আরও সৈন্য সমাবেশ করতে থাকে। আমরাও আমাদের চাপ অব্যাহত রাখি। ৪ঠা অক্টোবার তারিখ রাতে আমাদের একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের অবস্থানে অনুপ্রবেশ করে সকাল ছ’টা পর্যন্ত চিতলিয়ার নিকট পৌঁছে। সকাল ছ’টায় ৩” মর্টারের সহায়তায় চিতলিয়ায় পাকসেনাদের অবস্থানের দক্ষিণে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আধঘণ্টা পর্যন্ত আক্রমণের ফলে প্রায় ৩০ জন পাকসেনা হতাহত করে এবং একটি আর আর ধ্বংস করে দেয়। এরপর পাক অবস্থান থেকে শরে পড়ে নিরাপদে ফিরে আসে। ৬ থেকে ১০ তারিখ পর্যন্ত আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পরশুরাম, মজুমদারহাট, চিতলিয়া এবং নোয়াপাড়ার উপর আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ১০ জন পাকসেনা হতাহত করে। ১১ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায় পাকসেনারা পরশুরাম ও মজুমদারহাটের দিক থেকে এক ব্যাটালিয়ন শক্তি সহ গোলন্দাজ বাহিনী ও ৩” মর্টারের সহায়তায় আমাদের অনন্তপুর অবস্থানের উপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের অতি নিকটে পৌঁছাতে সমর্থ হয়। কিন্তু আমাদের সৈনিকরা বীর বিক্রমে তাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। সমস্ত রাত আক্রমণ চালাবার পর পাকসেনাদের প্রায় ৩৫ জন সৈনিক নিহত হয়। স্কি প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়ে এবং প্রচুর ক্ষয়ক্ষতির জন্য পাকসেনারা তাদের মৃতদেহ ফেলে বোরে ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যায়। এই সাফল্যের ফলে আমাদের সৈনিকদের মনোবল আরও বৃদ্ধি পায়। ১৩ই এবং ১৪ই অক্টোবর পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের এলাকায় তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে চলে। ১৪ই অক্টোবর সালদরের নিকট পাকসেনাদের দুটি প্লাটুন আমাদের প্রতিরক্ষা মাইনের শিকার হয়। ফলে ১৮জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৩ তারিখ সকাল ১০টার সময় আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের পরশুরাম অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করে একটি মেশিনগান সহ পাঁচজন পাকসেনাকে ধ্বংস করে দেয়। পাকসেনারা ২/৩ দিন নীরব থাকার পর আবার তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ১৬ই অক্টোবর আমাদের দুটি প্লাটুন বিকেল ৩-৩০ টায় পাকসেনাদের শালদার উপর আবার অতর্কিত আক্রমণ চালায়। ২০ মিনিটের এই আক্রমণের মুক্তিযোদ্ধারা ৫ জন পাকসেনাকে নিহত ও ১০ জনকে আহত করে নিরাপদে ফিরে আসে। ওইদিনই সাড়ে চারটার সময় আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের পরশুরাম অবস্থানে হামলা চালিয়ে ১০ জনকে আহত করে এবং একটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা ১৫ তারিখ সন্ধ্যা ৭টায় প্রায় এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যশক্তি নিয়ে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আমাদের সাহেবনগর, চন্দনা এবং জঙ্গলখোলা অবস্থানগুলোর উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধে আমাদের প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছু হটে যায়। তাদের হতাহতের সংখ্যা জানা যায়নি।

কুমিল্লা দক্ষিণে জুলাই মাসের শেষের দিকে আমরা শত শত গেরিলাকে ট্রেনিং দিয়ে ভিতরে পাঠিয়ে দেই। এইসব গেরিলা কুমিল্লা, চৌদ্দগ্রাম, লাকসাম, হাজীগঞ্জ, বতরা, চাঁদপুর, ফরিদপুর প্রভৃতি জায়গাতে প্রবেশ করে নিজ নিজ জায়গায় বেইস তৈরি করে তোলে। আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ফরিদগঞ্জে অবস্থিত আমাদের গেরিলাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের একটি টহলদারি দলকে বোয়াল নামক স্থানে এম্বুশ করে। এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর ১২ জন পাকসেনা নিহত ও ১৫ জন আহত হয়। বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আমাদের গেরিলারা দখল করে নেয়। লাকসাম থানার সাহাপুর গ্রামে পাকসেনাদের একটি ছোট ঘাঁটি ছিল। লাকসামের গেরিলারা ৫ই আগস্ট সন্ধ্যা ৭টার সময় এই ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ১০ জন পাকসেনা নিহত ও ২ জন আহত হয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দলের দুটি প্লাটুন মিয়াবাজারের নিকট পাকসেনাদের একটি ঘাঁটির বিস্তারিত সংবাদ পায়। তিনটি প্লাটুন এর এই দলটি ৭ তারিখ রাত পৌনে ৩টার সময় সেই ঘাঁটিতে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। প্রায় আধ ঘণ্টা যুদ্ধের ফলে ২৮ জন পাকসেনা নিহত এবং একজন অফিসার ও জেসিও সহ ১২ জন আহত হয়। বেশ কিছু সংখ্যক বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়।

সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে চৌদ্দগ্রামের দক্ষিণে এবং কুমিল্লার দক্ষিণে কৃষ্ণনগর, কলাতলা, আমজাদহাট প্রভৃতি জায়গায় আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের উপর বিভিন্ন সময়ে আঘাত হেনে প্রায় ২০ জনকে নিহত ও ১৬ জনকে আহত করে। এসব সঙ্ঘর্ষে আমাদের ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ এবং ৩ জন আহত হয়। সেমটেম্বরের ২০ তারিখে আমাদের একটি গেরিলা দল চট্টগ্রাম-কুমিল্লার রাস্তায় জগন্নাথ দীঘির নিকট বাজানকারা সেতুটি উড়িয়ে দিয়ে সেতু থেকে কিছু উৎরে ১০ জন গেরিলা ও একটি নিয়মিত বাহিনীর পাকসেনাদের অপেক্ষায় এম্বুস পেতে বসে। সেতুটি ধ্বংসের সংবাদ পেয়ে ফেনী থেকে পাকবাহিনীর একটি শক্তিশালী দল সেতুর দিকে অগ্রসর হয়। সেতুতে পৌছার আগেই পাকসেনারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এম্বুশে পড়ে যায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে একজন অফিসার সহ ২৫ জন পাকসেনাকে নিহত করে। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে ফেনীর দিকে পালিয়ে যায়।

পাকসেনারা লাকসামের নিকট হাসনাবাদ নামক এক জায়গায় তাদের একটি ঘাঁটি তৈরি করে। তাদের সঙ্গে বেশ কিছু সংখ্যক রাজাকারও ছিল। এই ক্যাম্প থেকে তারা চাঁদপুর-লাকসাম-কুমিল্লা রাস্তায় অনবরত টহল দিয়ে বেড়াতো। ফলে চাঁদপুরে এবং দক্ষিণ ঢাকা ও ফরিদপুরে অনুপ্রবেশকারী আমাদের গেরিলাদের জন্য আমাদের গেরিলাদের জন্য মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। এই ঘাঁটিটি ধ্বংস করে দেবার জন্য ক্যাপ্টেন মাহবুবকে নির্দেশ দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন মাহবুব এই ঘাঁটিটি সম্পর্কে পুরোপুরি সংবাদ সংগ্রহ করে। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানি ও গেরিলা সমন্বিত একটি শক্তিশালী দল লাকসাম এলাকায় অনুপ্রবেশ করে এবং পরদিন পাকসেনাদের হাসনাবাদ ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে প্রায় ২৫জন পাকসেনা ও ৩০ জন রাজাকার নিহত হয়। পাকসেনারা ক্যাম্প ছেড়ে কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। হাসনাবাদ অবস্থান থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে আসে। এই সঙ্ঘর্ষের একদিন পর আমাদের দলটি হাজীগঞ্জে অবস্থিত রাজাকারদের একটি বিরাট ট্রেনিং ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে ৩০ জন রাজাকারকে নিহত করে। এর ফলে আমাদের গুরুত্তপূর্ণ অনুপ্রবেশ পথটি আবার বিপদমুক্ত হয়। পাকসেনারা এই অঞ্চলে আমাদের ধ্বংস করার জন্য আরও সৈন্য সমাবেশ ঘটায়। তাদের এই ব্যাটালিয়ন চৌদ্দগ্রামে মোতায়েন হয়। পাকসেনাদের ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার একটি মাদ্রাসা বিল্ডিং এ স্থাপন করে। এইসব সংবাদ আমাদের কাছে স্থানীয় গেরিলাদের মারফতে পৌঁছে। পাকসেনাদের এই নতুন ব্যাটালিয়নটিকে আসার সাথে সাথেই ব্যাতিব্যাস্ত করে তোলার জন্য লেঃ ইমামুজ্জামান সেপ্টেম্বর মাসের ১০ তারিখে আমাদের মর্টার পল্টুন ও একটি গেরিলা দলকে চৌদ্দগ্রামে পাঠায়। আমাদের দলটি বিকেল পাঁচটায় চৌদ্দগ্রামের নিকট উপস্থিত হয়ে পাকসেনাদের হেডকোয়ার্টারের উপর মর্টারের গোলাবর্ষণ শুরু করে। বেশ কটি গোলা মাদ্রাসা ঘরের মধ্যে পড়ে। এর ফলে পাকসেনাদের প্রায় ৩০/৪০ জন হতাহত হয়। আমাদের একজন প্রত্যক্ষদর্ষী স্থানীয় গেরিলা আহতদের লাকসামের দিকে নিয়ে যেতে দেখে। পাকসেনারা কামানের সাহায্যে আমাদের অবস্থানের উপর গোলাগুলি চালায়। এতে কিছু বেসামরিক লোক নিহত হয়। এর দুদিন পড় পাকসেনাদের একটি দল হরসর্দার বাজারের নিকট স্থানীয় দালাল, শান্তি কমিটির লোকদের নিয়ে এক সভায় মিলিত হয়। এই সভা পণ্ড করে দেয়ার জন্য আমাদের একটি টহলদার দল পাকসেনাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে একজন জেসিও সহ তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। শান্তি কমিটির লোকেরা ভয়ে পালিয়ে যায়। পাকসেনারা সেপ্টেম্বর মাসেই চৌদ্দগ্রামের উত্তরে হরিসর্দার বাজারের নিকট পুনরায় নতুন করে তাদের ঘাঁটি তৈরি করার চেষ্টা চালায়। এই সংবাদ পেয়ে লেঃ ইমামুজ্জামান পাকসেনাদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবর সংগ্রহ করার জন্য রেকি দল পাঠায়। রেকি দলটি রাত ৯টার সময় খবর সংগ্রহ করে ফিরে আসে। তারা দেখতে পায় পাকসেনাদের প্রায় এক কোম্পানি শক্তি হরিসর্দার বাজারের উত্তরে ঘাঁটি তৈরি করার জন্য ট্রেঞ্চ খোঁড়ায় ব্যাস্ত। সংবাদ পেয়ে লেঃ ইমামুজ্জামানের ৪র্থ বেঙ্গলের ‘বি’ কোম্পানি এবং দুটি গেরিলা কোম্পানি নিয়ে মর্টারের সহায়তায় রাত সাড়ে চারটার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। আমাদের তীব্র আক্রমণের ফলে পাকসেনাদের দুটি হাল্কা মেশিনগান পোস্ট ছাড়া সম্পূর্ণ অবস্থানগুলি পর্যুদস্ত হয়ে যায়। পাকসেনারা তাদের বাঙ্কার থেকে আক্রমণের চাপে পালাবার চেষ্টা করলে আমাদের সৈনিকরা তাদের নিহত করে। প্রায় ২৫ জন পাকসেনা রেঞ্জার সহ নিহত হয় ও অনেকে আহত হয়। দু’ঘণ্টা আক্রমণ চালাবার পর আমাদের সৈনিকরা নিরাপদে তাদের অবস্থানে ফিরে আসে। পরে পাকসেনারা তাদের আহত সৈনিক ও নিহতদের নিয়ে জিপে করে লাকসামের দিকে পালিয়ে যায়। প্রায় ৮টার সময় পাঁচটি হেলিকপ্টার করে পাকসেনাদের আরেকটি দল সেই অবস্থানের শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য আসে। শক্তি বৃদ্ধির পড় পাকসেনারা প্রায় ১০টার দিকে আমাদের অবস্থানের আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। আমাদের অবস্থানটি পাকসেনাদের এই আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিল। লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে পাকসেনাদের আক্রমণকে আমাদের সৈনিকরা প্রতিহত করতে থাকে। আমাদের প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেও পাকসেনারা আমাদের অগ্রবর্তী অবস্থানের নিকট পর্যন্ত আগ্রসর হতে সমর্থ হয়। এসময় আমাদের ৬’’ মর্টার ও ২’’ মর্টার তাদের উপর মারাত্মক আঘাত হানলে পাকসেনাদের আক্রমণ ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শুধুমাত্র ক্ষুদ্র একটি পাকসেনা দল আমাদের ডান দিক দিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু লেঃ ইমামুজ্জামান সময়মত পাল্টা আক্রমণের ফলে তারাও নিহত হয়। ৫/৬ ঘণ্টা যুদ্ধের পড় আমাদের বীর সৈনিকরা সাফল্যের সঙ্গে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এই যুদ্ধে একজন মেজর সহ ৩৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। মর্টারের গোলার আঘাতে পাকসেনাদের অফিসার নিহত হবার পড় পাকসেনারা মনোবল হারিয়ে পশ্চিম দিকে পিছু হটে যায়। এর দুদিন পড় ১৩ই সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার সময় আমাদের একটি গেরিলা দল ফতেপুরের নিকট একটি রেলসেতু উড়িয়ে দেয়। এতে ৫০ফুট গ্যাপ সৃষ্টি হয়। ফলে লাকসাম-ফেনীর মধ্যে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বাডিসা এবং গোবিন্দ্যমাণিক্যর দীঘিতে পাকসেনাদের দুটি ঘাঁটি ছিল। লেঃ ইমামুজ্জামান ১৯ শে সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে পাঁচটার সময় এই দুটি পাক অবস্থানের উপর এক যোগে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে ৮১ এম এম মর্টার, ১৫ এমআরআর এবং মেশিনগান ব্যাবহার করা হয়। মাণিক্যর দীঘিতে অবস্থিত পাকসেনারা আমাদের আক্রমণের পূর্বাভাস পেয়ে সতর্ক হয়ে ছিল। ফলে সাতসা অবস্থানের শুধু দুটি বাঙ্কার ধ্বংস ও ৬ জন পাকসেনা আমাদের আক্রমণে নিহত হয়। আমাদের দুজন সৈনিক আহত হয়। বাডিসা ঘাঁটির উপর আমাদের আক্রমণ সম্পূর্ণ সফল হয়। আরআরএর গুলির আঘাতে প্রায় ৬টি বাঙ্কার ধ্বংস হয়। পাকসেনাদের ২০ জন নিহত ও ১২ জন আহত হয়। আমাদের আক্রমণকারী দলটি দুঘণ্টা পর নিরাপদে নিজেদের অবস্থানে ফিরে আসে। এই সঙ্ঘর্ষের চারদিন পর ২৩শে সেপ্টেম্বর ভোর ৫তার সময় একটি প্লাটুন ও ১৬ জন গেরিলা লেঃ ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে মর্টার এবং আরআর এর সাহায্যে আবার গোবিন্দমাণিক্য দীঘিতে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের সময় আমাদের সৈনিকরা শত্রুর বেশ কিছু বাঙ্কার আর আর এর সাহায্যে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়। ফলে প্রায় ১৫ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। এক ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের সৈনিকরা তাদের অবস্থানে ফিরে আসে।

পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল কুমিল্লার দক্ষিণে পায়েলগাছা থেকে নারায়নপুরের দিকে অগ্রসর হয় এবং নারায়নপুরের অনেকগুলো বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় এবং নারী ধর্ষণ করে। ২/৩ ঘণ্টা যাবত তাদের অত্যাচার চলে। নারায়নপুরের নিকট অবস্থিত আমাদের মাত্র ১৩ সদস্যের ছোট একটি গেরিলা দল পাকসেনাদের নারায়নপুরের দিকে অগ্রসর হতে দেখে। পরে এই দল পায়েলগাছায় রাস্তায় এম্বুশ পাতে। পাকসেনারা নারায়নপুরে অত্যাচার চালাবার পর ফেরার পথে তাদের এম্বুশের আওতায় পড়লে গেরিলারা আক্রমণ চালায়। আক্রমণে ১৪ জন পাকসেনা ও ২৮ জন রাজাকার নিহত এবং ১৩ জন পাকসেনা ও ১৬ জন রাজাকার আহত হয়। আমাদের বীর যোদ্ধারা তাদের গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রাণপণে আক্রমণ চালিয়ে যায়। এই এম্বুশে শেষ পর্যন্ত পাঁচজন গেরিলা শহীদ হয় এবং বাকি ৮ জন ফিরে আসতে সমর্থ হয়। শকিশালি পাকবাহিনীর দলের সঙ্গে ক্ষুদ্র এই গেরিলা বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ এবং আত্নত্যাগ কোনোদিন ভুলে যাবার নয়।

চাঁদপুরের নিকট আকন্দহাট বাজারের নিকট আমাদের একটি কোম্পানি তাদের বেইস স্থাপন করে। স্থানীয় দালাল এবং রাজাকাররা পাকসেনাদেরকে এই বেইস সম্বন্ধে খবর দেয়। এই বাজারটির তিন দিকে পানি থাকায় আমাদের সৈনিকরা বেইসটিকে যথেষ্ট নিরাপদ মনে করত। ৬ই সেপ্টেম্বর সকাল ৬টার সময় পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল স্থানীয় দালালের সহযোগিতায় আমাদের এই বেইসটি আক্রমণের জন্য আসে। আক্রমণের সময় তাড়া নৌকার সাহায্যে খাল পাড় হয়ে বেইস-এ অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। পাকসেনারা নিকতে পউছিলা আমাদের সৈনিকেরা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। দু’ঘন্টার যুদ্ধে একজন মেজর সহ ৩৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। খাল পাড় হটে না পেরে এবং অনেক হতাহতের ফলে তাড়া ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। আমাদের কোম্পানিটা পরে নিরাপদে সেখান থেকে অন্য বেইসে চলে আসে।

কুমিল্লার দক্ষিণে পাকসেনাদের কংসতলা ঘাঁটিটি আমাদের গেরিলা বাহিনীর যাতায়াতে বিশেষ অসুবিধার সৃষ্টি করছিল। এই ঘাঁটি থেকে পাকসেনাদের টহলদার দল আমাদের যাতায়াত পথে বিশেষ তৎপরতা চালাতো। এই ঘাঁটিটিকে ধ্বংস করে দেবার জন্য ক্যাপ্টেন মাহবুবকে নির্দেশ দেয়া হয়। বিশেষ তথ্য অনুসন্ধান করে ৫০ জনের একটি দল ক্যাপ্টেন মাহবুবের নেতৃত্বে ৩০শে সেপ্টেম্বর রাত ১টায় এই ঘাঁটিতে অনুপ্রবেশ করে আক্রমণ চালায়। তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পড় সুবেদার শাহজামান সহ ১৬ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়। পাকসেনারা এই আক্রমণের ফলে এতোই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে , সেখান থেকে তাড়া তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে কুমিলায় চলে যেতে বাধ্য হয়। এর দুদিন পড় আমাদের ডিমোলিশন পার্টি পেপুলিয়া বাজারের নিকট লালমাই-সোনাজাজি সড়কের একটি সেতু বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেয়। পাকসেনারা এই রাস্তাটিকে ট্যাঙ্ক এবং গাড়ি চলাচলের জন্য পুনঃনির্মানের চেষ্টা করছিল। সেতুটি ধ্বংস করে দেবার পর তারা রাস্তা মেরামতের কাজ বন্ধ করে দেয়। আমাদের আরেকটি গেরিলা দল চান্দিনার নিকটে দোতুলাতে রাস্তায় মাইন পুঁতে পাকসেনাদের একটি গাড়ি ধ্বংস করে দেয়। এছাড়াও কুমিল্লার দক্ষিণে ও উত্তরে ১লা অক্টোবর থেকে ৩রা অক্টোবর আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন সঙ্ঘর্ষে প্রাণছড়া, কোটেশ্বর, অজনাপুর, বিবির বাজার, আম্রতলী প্রভৃতি জায়গায় ২৫ জন পাকসেনা নিহত এবং ৮ জন আহত হয়।

আমাদের ৪১ জনের গেরিলা দল ১লা অক্টোবর তাদের ট্রেনিং শেষ করে রাত ৮টায় ঢাকার উদ্যেশ্যে রওনা হয়। কসবার দক্ষিণ দিক দিয়ে এই দুটি নৌকায় উজানের শাহ সেতুর নিকট পৌঁছে। পাকসেনাদের একটি টহলদারি দল রাত ১১টায় আমাদের দ্বিতীয় নৌকাটিকে দেখতে পায় এবং আক্রমণ চালায়। আক্রমণের ফলের আমাদের ৫ জন গেরিলা শহীদ ও তিনজন আহত হয়। ১৫টি রাইফেল ও ৫টি স্টেনগান পানিতে পড়ে হারিয়ে যায়। বাকি গেরিলারা অতি কষ্টে শত্রুদের নাগালের বাইরে চলে আসতে সক্ষম হয়। এই ঘটনার ৩ দিন পর লেঃ ইমামুজ্জামানের ৪ঠা অক্টোবর সকাল ৫টায় চৌদ্দগ্রামের পাঁচ মাইল উত্তরে হরিসর্দার বাজারে পাক অবস্থানের উপর ১০৬ এম এম আর আর ও ৮১ এম এম মর্টারের সাহায্যে আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর ৭টি বাঙ্কার ধ্বংস করে ২৫ জন পাকসেনা ও ৭ জন রাজাকারকে হতাহত করে। মুক্তিযোদ্ধারা চৌদ্দগ্রামের তিন মাইল দক্ষিণে একটি সেতুও ধ্বংস করে দেয়। ৪ঠা ও ৫ ই অক্টোবর কুমিল্লার উত্তরে অজনাপুর ও জামবাড়ি এলাকায় আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের বেশ কটি টহলদারি দলকে আক্রমণ করে ১৫ জনকে নিহত ও ২০ জনকে আহত করে। আমাদের একজন শহীদ ও একজন আহত হয় কুমিল্লাতে গোমতী বাঁধে মাইন পুঁতে পাকসেনাদের ১টি জিপ ধ্বংস করে দেয়া হয়। সেইসঙ্গে একজন অফিসার সহ তিনজন পাকসেনা নিহত হয়। এছাড়া রামচন্দ্রপুর এবং বাঙ্গুরা ডাকঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। হোমনা থানায় অবস্থিত পাকসেনাদের একটি দলের সঙ্গে তিন তারিখ রাত সাড়ে তিনটার সময় আমাদের একটি গেরিলা দলের সঙ্ঘর্ষ হয়। ৬ ঘণ্টা যুদ্ধে পাকসেনারা স্পম্পূর্ণ রূপে পর্যুদস্ত হয়ে পালিয়ে যায়। আমাদের গেরিলারা পাকসেনাদের দ্বারা বন্দি ১৯ জন ব্যাক্তিকে মুক্ত করে দেয় এবং ৯টি রাইফেল দখল করে। এরপর হোমনা এলাকা সম্পূর্ণরূপে আমাদের কর্তৃত্বে আসে। ৬ই অক্টোবর রাত তিনটার সময় পাকসেনাদের একটি দল দুর্লভপুরের নিকট আমাদের এম্বুশে পরে যায়। এই এম্বুশে একজন ইঞ্জিনিয়ার কোরের অফিসারসহ ১২ জন পাকসেনা নিহত হয়। পাকসেনারা গোমতীর উত্তরে আবার তাদের আধিপত্য পুনরুদ্ধারের জন্য তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। পাকসেনাদের এই তৎপরতাকে বাঁধা দেবার জন্য ক্যাপ্টেন দিদারুল আলম দুটি প্লাটুন পানছাড়ার এবং মোহনপুরে পাঠায়। এই প্লাটুনগুলো পাকসেনাদের চলাচলের রাস্তায় এম্বুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। ৮তারিখ রাতে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল গোমতী পাড় হয়ে পানছাড়ার দিকে অগ্রসর হয়। সকাল ছ’টার সময় এই দলটি আমাদের এম্বুশের আওতায় আসে।

ফলে ২০ জন পাকসেনা নিহত ও ১০ জন আহত হয়। পরদিন পাকসেনাদের আরেকটি দল মনোহরপুরে আমাদের এম্বুশের আওতায় আসে এবং এম্বুশে ৬জন পাকসেনা নিহত হয়। ওইদিনই আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা পাকসেনাদের আরেকটি দলকে বুড়িচং এর নিকট সাদেকপুরে জেরুইনে এম্বুশ করে। এম্বুশে একজন মেজর ও একজন ক্যাপ্টেন সহ ২০ জন পাকসেনা নিহত ও ৭ জন ই পি সি এ এফ নিয়ত হয়। নিহত একজন ক্যাপ্টেনের নাম সৈয়দ জাভেদ শাহ বলে পরে আমরা জানতে পারি। একজন পাকসেনা আমাদের হাতে বন্দিও হয়। এই সঙ্ঘর্ষে আমাদের একজন শহীদ এবং তিনজন আহত হয়। ৭টি রাইফেল আমরা দখল করে নেই। এর দুদিন পড় ১১ই অক্টোবর সকাল সাড়ে ১১টার সময় আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার সার্কিট হাউস এবং গোমতীর চাঁদপুর ফেরীতে মর্টারের গোলাবর্ষন করে। কুমিল্লার সার্কিট হাউসে পাকসেনাদের মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার ছিল। এর গোলাবর্ষনের ফলে প্রায় ৩৯ জন পাকসেনা ও রাজাকার হতাহত হয়। শহরের ভিতরে ভসে মর্তারের গোলাবর্ষন করাতে পাকসেনাদের ভিতরে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পরে আমরা জানতে পারি যে শহরে অবস্থিত অনেক টহলদার পাকসেনা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে তাদের অস্ত্রশস্ত্র ফেলে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টের দিকে পালিয়ে যায়। আমরা জানতে পারি যে সার্কিট হাউসে গোলাবর্ষনের সময় সেখানে পাকিস্তানী ৯বম পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং উপস্থিত ছিলেন। অল্পের জন্য টনি আমাদের আক্রমণ থেকে রক্ষা পান। পাকসেনারা কুমিল্লা শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা এই আক্রমণের খবর পাকিস্তানী রেডিও থেকে প্রচার করে। তারা পাঁচজন সৈনিক নিহত ও ৩৯ জন আহতের কথা স্বীকার করে। আমাদের গেরিলারা কালির বাজার গ্রামে পাকসেনাদের একটি হেডকোয়ার্টারের সন্ধান পায়। এই সংবাদ পেয়ে লেঃ ইমামুজ্জামান একটি ৭৫ এম এম আর মেশিনগান ও হাল্কা মেশিনগান সহ একটি প্লাটুন পাঠিয়ে দেয়। এই প্লাটুনটি পথ প্রদর্শকের সহায়তায় পাকসেনাদের হেডকোয়ার্টারের নিকট রাতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। ১২ই অক্টোবর ভোর ৫টায় আমাদের এই দলটি রকেট এবং মেশিনগানের সাহায্যে পাকসেনাদের এই হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ করে একটি বিল্ডিং এ অবস্থিত দুটি বাঙ্কার সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়। ঐ অবস্থানের আরও পাকসেনারা রকেট হামলায় ইতস্তত পালাবার চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় তাদের প্রতি মেশিনগানের সাহায্যে গুলিবর্ষন করে তাদের ১২ জনকে নিহত ও ৪ জনকে আহত করে। এরপর আমাদের দলটি নিরাপদে আমাদের অবস্থানে ফিরে আসে। এই ঘটনার একদিন পড় বাগাবাড়ি ও জাজিশ্বরে আরেকটা আক্রমণে ৭জন পাকসেনা ও ৫ জন রাজাকার নিহত হয়।

বুড়িচং থানার রাম নগর গ্রামে আমাদের গেরিলাদের একটি অবস্থান ছিল। পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের নিকট সংবাদ পেয়ে ৮ই অক্টোবর দুপুরে একটি শক্তিশালী দল নিয়ে সেই অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে এই আক্রমণের মোকাবিলা করে। দুপুর একটা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে পাকসেনাদের প্রায় ১৬ জন সৈনিক ও ১৪ জন রাজাকার নিহত হয়। পাক আক্রমণের চাপ বারতে থাকলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অবস্থা পরিত্যাগ করে জাগলপুরে নতুন করে অবস্থান নেয়। পরদিন পাকসেনাদের আরেকটি শক্তিশালী দল সেই অবস্থানের উপরও আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ করে আমাদের যোদ্ধারা ৩৫ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। এরপর সেই অবস্থান পরিত্যাগ করে প্রধান ঘাঁটিতে আসে। আসার পথে ৫জন পাকসেনা আমাদের হাতে বন্দী হয়। আমাদের ১জন শহীদ, ২ জন আহত এবং ১ জন বন্দী হয়।

আমাদের একটি প্লাটুন ১৫ তারিখ সকাল ৮টায় কুমিল্লার দক্ষিণে পাকসেনাদের একটি অবস্থানের আধ মাইল দূরে বারচর গ্রামে এম্বুশ পাতে। এক ঘণ্টা অবস্থানের পড় পাকসেনাদের একটি দল তাদের ঘাঁটিতে ফেরার পথে এই এম্বুশের আওতায় পরে। এম্বুশে ১২ জন নিহত ও ৩ জন আহত হয়। ওইদিনই বিকেলে মনোহরের নিকট পাকসেনাদের আরেকটি দলের উপর আমাদের সৈনিকরা আক্রমণ করে। পাকসেনাদের এই দলটি নিকটবর্তী একটি গ্রাম জ্বালিয়ে তাদের ঘাঁটিতে ফেরত যাচ্ছিল। দুদিন পড় ১৮ই অক্টোবর রমজানপুরে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা একটি এম্বুশ পাতে। রাত প্রায় সাড়ে তিনটার সময় একটি টহলকারী দল এই এম্বুশে পরে যায়। উভয় পক্ষে প্রায় আধঘণ্টা গুলি বিনিময় হয়। এতে ১০ জন পাকসেনা ও ১৮ জন রাজাকার হতাহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে মৃতদেহ ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।

পাকসেনারা অক্টোবর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে মিয়াবাজারের নিকট তাদের একটি ঘাঁটি স্থাপন করে। আগস্ট মাসে এই অবস্থান থেকে আমরা পাকসেনাদের তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। পুনরায় এই ঘাঁটি স্থাপন করায় আমরা বুঝতে পারি যে পাকসেনারা আবার চট্টগ্রাম-কুমিল্লা রাস্তা খুড়বার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের এই পরিকল্পনা ব্যার্থ করার জন্য ক্যাপ্টেন মাহবুব একটি কোম্পানি পাকসেনাদের ঘাঁটি রেইড করার উদ্যেশ্যে তাদের নিজেদের বেইস থেকে রওনা হয়। রাত প্রায় ১১টার নিকট শত্রু ঘাঁটির নিকট পৌঁছে অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা যুদ্ধের পড় দুজন পাকসেনা নিহত ও ৫ জনকে আহত করে আমাদের দলটি অবস্থান পরিত্যাগ করে। এর তিনদিন পড় ২০শে অক্টোবর ভোর ৪টার সময় মিয়াবাজারের আরেকটি শত্রু ঘাঁটির উপর আমাদের সৈন্যরা আক্রমণ চালায়। এই অকস্মাৎ আক্রমণে অয়াক্সেনারা বিপর্যস্ত হয়ে পরে। দুঘণ্টা যুদ্ধের ফলে প্রায় ২১ জন পাকসেনা নিহত এবং আহত হয়। পাকসেনাদের নিহত ও আহত সৈনিকদেরকে পরের দিন গাড়ীতে কুমিল্লার দিকে নিয়ে যেতে দেখা যায়। আমাদের দলটি যে রাস্তায় ফিরে আসে পাকসেনাদের ঘাঁটির কিছু দূরে সেই রাস্তার উপর মাইনের সাহায্যে এফ বুবি ট্র্যাপ লাগিয়ে আসে। পরদিন সকালে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল সেই রাস্তায় খবরাখবর নেয়ার জন্য অগ্রসর হবার পথে বুবিট্র্যাপ এর কাছে পরে যায় এবং আমিন বিস্ফোরণের ফলে ১৬ জন পাকসেনা নিহত ও ৫ জন আহত হয়।

আমাদের আরেকটি দল ইমামুজ্জামানের নেতৃত্বে ২২শে অক্টোবর ভোর ৪টার সময় মর্টার এবং ১০৬ আর আর এর সহায়তায় হরিসর্দার রাজাপুরের পর পাকসেনাদের আরেকটি নতুন ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ১২ ঘণ্টা যুদ্ধে আমাদের মর্টার, মেশিনগান এবং আর আর এর রকেট পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি করে। আর আর এর সাহায্যে বেশ কটি বাঙ্কার আমাদের সৈন্যরা উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়। তাদের প্রায় ৩৫ জন হতাহত হয়। পাকসেনারা কুমিল্লা বিমান বন্দরে অবস্থিত কামানের সাহায্যে আমাদের আক্রমণকে প্রতিহত করে। প্রচণ্ড ক্যামনের আক্রমণের ফলে সন্ধ্যা ৬টার সময় আমাদের সৈনিকরা গোলার ওভাবে পিছু হটে আসতে বাধ্য হয়। আসার সময় পাকসেনাদের অবস্থানের নিকট রাস্তায় মাইন লাগিয়ে আসে। পরদিন সকালে মাইন বিস্ফোরণের ফলে ৭/৮ জন পাকসেনা আহত হয়। এর একদিন পর আমাদের আরেকটি দল সকাল ৭টার সময় চৌদ্দগ্রামের ১ মাইল উত্তরে পাকসেনাদের কালিরবাজার ঘাঁটির উপর মর্টার এবং আর আর এর সহায়তায় আক্রমণ চালায়। এই এক্রমনে প্রায় ১২ জন পাকসেনা হতাহত হয়। পাকসেনারা তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। এর কয়েকদিন পর পাকসেনাদের একটি টহলদারি দল চৌদ্দগ্রাম থেকে সাড়ে ৪মাইল দক্ষিণে আমাদের বাজারের নিকট আমাদের সৈন্যদের এম্বুশে পরে যায়। ফলে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়। ১৮ই অক্টোবর সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার সময় আমাদের একটি শক্তিশালী দল মর্টারের এবং আর আর এর সহায়তায় পাকসেনাদের বডিসা ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টার এই যুদ্ধে ২০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। বাডিসা ঘাতের আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনাদের রাজাসার দীঘির অবস্থানের উপরও আক্রমণ চালানো হয়। এই আক্রমণের ফলে প্রায় ৬ জন নিহত এবং বেশ কটি বাঙ্কার আমাদের সৈন্যরা ধ্বংস করে দিতে সমর্থ হয়। আমাদের একটি ছোট দল আরিউরার নিকট রাস্তায় মাইন পুঁতে রাখে। পাকসেনারা বাডিসা এবং রাজাসার দীঘি আক্রমণের সংবাদ পেয়ে ৪/৫ গাড়ি ভর্তি সৈন্য নিয়ে সাহায্যরে জন্য সেদিকে অগ্রসর হয়। পথে পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে একটি ট্রাক ও একটি জিপ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। ফলে ১৮ জন পাকসেনা নিহত এবং ২ জন অফিসার সহ ৫ জন আহত হয়। এই এলাকাতে সর্বত্র আমাদের আক্রমণের তীব্রতার দরুন পাকসেনারা নাজেহাল হয়ে যায়। ফলে এই এলাকায় পুনঃপ্রাধান্য ফিরে পাবার আসায় ২০শে অক্টোবর বিকেল ৪টার সময় তাদের একটি শক্তিশালী দল হরিসর্দার ঘাঁটি থেকে আমাদের অবস্থানের দিকে অগ্রসর হয়। এই দলটি কামানের প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা ৩ মর্টার এবং হাল্কা মেশিনগানের সাহায্যে পাকসেনাদের প্রচণ্ড আক্রমণে প্রতিহত করে। আমাদের গোলাগুলিতে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। এই এলাকা থেকে আমাদের বিতাড়িত করার উদ্যেশ্য সেই সাথে বিফল হয়ে যায়।

আগস্ট মাসের প্রথম দিকে নোয়াখালী এলাকায় আমাদের গেরিলাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। অনেক গেরিলাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে নিজ নিজ এলাকাতে পাঠানো হয়। সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের জন্য নোয়াখালী জেলাকে চারটি ভাগে বিভক্ত করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের চারজন সুবেদারকে এইসব এলাকায় গেরিলা এবং নিয়মিত বাহিনীর সৈনিকদের তত্ত্বাবধানের ভার দেয়া হয়। সোনাইমুড়ি ফরিদগঞ্জ এলাকার সুবেদার আলি আকবর পাটোয়ারী, নোয়াখালী সদরের ভার সুবেদার লুতফর রহমান, দক্ষিণ ফেনীর ভার সুবেদার জব্বার এবং লক্ষ্মীপুর ও রামগতির ভার অন্য আরেকজন সুবেদারের প্রতি আরোপিত হয়। এলাকা বিভক্তির পর স্থানীয় কমান্ডাররা সম্মিলিত গেরিলা ও নিয়মিত বাহিনীর পূর্ণ সহযোগিতায় তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। সুবেদার আলি আকবর পাটোয়ারির নেতৃত্বে আমাদের আরেকটি গেরিলা দল গুণবতী ও সরিষাদি রেল স্টেশনে আক্রমণ চালিয়ে প্রায় ৩২ জন পাকসেনা ও রাজাকারকে হতাহত করে। সোনাইমুড়ির উত্তরে কাদের বাজারের নিকট পাকসেনাদের ১০টি দলকে এম্বুশ করে ৩ জনকে নিহত ও ১০ জনকে আহত করে নেয়। পাকিস্তানী রেঞ্জার ও রাজাকাররা রায়পুরের নিকট এল এম হাই স্কুলে একটি শিবির স্থাপন করে। ৬ই আগস্ট সন্ধ্যার সময় আমাদের গেরিলা দল শত্রুদের এই ঘাঁটির উপর অতর্কিতে আক্রমণ করে। ফলে ৯ জন রেঞ্জার হতাহত হয়। আমাদের একজন আহত হয়। এর দুদিন পর আমাদের আরেকটি গেরিলা দল পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দলকে লক্ষ্মীপুর থানার দালাল বাজারে এম্বুশ করে ১৫ জন শত্রুসেনাকে হতাহত করে। ১৪ই আগস্ট কোম্পানিগঞ্জ থানায় বসুর হাটের নিকট পাক মিলিশিয়াদের এম্বুশ করে প্রায় ৩০ জনকে হতাহত করে। তারা একটি টয়োটা জিপও ধ্বংস করে দেয়। সঙ্ঘর্ষে আমাদের একজন সিপাই নুরুন্নবি মারাত্মকভাবে আহত হয়। পাকসেনারা ৩০টি অটোমেটিক এম জি এর সাহায্যে গোলাগুলি চালায়। ১৮ই আগস্ট রামগড় থানার সেকেন্ড অফিসার এবং কয়েকজন দালালকে পাকসেনাদের ক্যাম্পে যাবার পথে নিহত করে।

পাক পুলিশ এবং রাজাকাররা লক্ষ্মীপুর থানার চন্দ্রগঞ্জ প্রতাপ হাই স্কুলে একটি ঘাঁটি তৈরি করে। ১৫ তারিখ রাত ১১টার সময় আমাদের সৈনিকরা এই ঘাঁটি আক্রমণ করে প্রায় ৪০ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। এবং সেখান হতে তাদের তাড়িয়ে দেয়। ১৬ই আগস্ট সোনাইমুড়ি রেল স্টেশনের নিকট বাগাদিয়া রেল সেতু গেরিলারা উড়িয়ে দেয়। আমাদের গেরিলাদের এই সব তৎপরতায় পারসেনারা আরও ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে ওঠে। পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল বেগমগঞ্জ থানার সোনাপুর ও গোপালপুরের নিকট দালালদের কাছ থেকে আমাদের ঘাঁটির খবর জেনে ৩০শে আগস্ট সকালে আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। পাকসেনাদের এই আক্রমণকে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সাথে প্রতিহত করে। প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা যুদ্ধের পর পাকসেনাদের ৪০ জন নিহত হয়। আমাদের সেনাদের প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে তারা তাদের মৃতদেহগুলো ফেলেই পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আই যুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা ২০ টি অস্ত্র দখল করে। আমাদের একজন সিমাহী শহীদ হয়। এই ঘটনার দুদিন পর আমাদের সৈনিকরা মাইন পুঁতে সনাইমুড়ির নিকট বানোয়াইতে পাকসেনাদের একটি গাড়ি ধ্বংস করে। ফলে ১ জন পাকসেনা নিহত ও ৮ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দল রামগঞ্জের নিকট তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে। সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বাধীন ২০শে সেপ্টেম্বর আমাদের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল এই ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দুঘণ্টা যুদ্ধে ১৪ জন পাকসেনা নিয়ত ও ১৭ জন আহত হয়। এর ৩ দিন পর ২৬শে সেটেম্বর সকালে ২৫০ সদস্যবিশিষ্ট পাকসেনা ও রাজাকারদের একটি দল রামগঞ্জ বাজারের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের ৫০ সদস্যের একটি দল এই খবর পেয়ে রাজগঞ্জ বাজারের পূর্ব দিকে পাকসেনাদের জন্য একটি এম্বুশ পেতে রাখে। পাকসেনারা অগ্রসর হবার পথে এই অ্যামবুশে পরে যায়। ফলে ২০ জন পাকসেনা ও রাজাকার নিহত হয় ও ২৭ জন আহত হয়। আহত পাকসেনা ও রাজাকারদের মাইজদি বেসামরিক হাসপাতালে ভর্তি করে। ২৫শে সেপ্টেম্বর আরও দুজন আহত পাকসেনা হাসপাতালে মারা যায়।

আমাদের অপর একটি গেরিলা দল লৌহজং থানার নিকট পদ্মা নদীতে ১৮ হাজার মণ পাট সহ কয়েকটি নৌকা ডুবিয়ে দেয়। এই পাটগুলো নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন পাটকলে ব্যাবহারের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো। ফেনীর নিকট বারদিন সেতুটি ধ্বংস করে সদেয়া হয়। ফলে ফেনী ও কুমিল্লার মাঝে রাস্তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পরে।

রাজাকারসহ পাকসেনাদের একটি দল রামগঞ্জ থেকে লক্ষ্মীপুরের রাস্তায় ১০টি গাড়ীতে ১৯শে সেপ্টেম্বর অগ্রসর হচ্ছিল। এই সংবাদ পেয়ে আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা সুবেদার আলী আকবর পাটোয়ারীর নেতৃত্বে মীরগঞ্জ এবং ফজলচাদ হাটের নিকট পাকসেনাদের কনভয়টিকে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এই আকস্মিক আক্রমণের ফলে পাকসেনারা মারাত্মকভাবে ভিতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। পাকসেনারাও গাড়ী থেকে নিচে নেমে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে। উভয় পক্ষের মধ্যে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত প্রচণ্ড যুদ্ধ চলতে থাকে। এই প্রচণ্ড যুদ্ধের ফলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং স্থানীয় জনসাধারণের মনোবল আরও সুদৃঢ় হয়। ওপর পক্ষে পাক সেনাদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। আমাদের ৬০ সদস্যের একটি গেরিলা দল ১লা অক্টোবর রায়পুরে অবস্থিত রাজাকার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের উপর আক্রমণ চালিয়ে ৪০ জন রাজাকারকে নিহত করে। ১০ই অক্টোবর পাকিস্তানীদের একটি রেঞ্জার দলের লক্ষ্মীপুর থেকে রামগঞ্জ যাবার পথে আমাদের গেরিলারা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে রেঞ্জারদের একটি গাড়ী সম্পূর্ণ ধ্বংস করে। এতে একজন রেঞ্জার নিহত হয়। এর একদিন পর পাকিস্তানীদের একটি দল সনাইমুড়িতে তাদের গাড়ীতে আরোহণ করার সময় সুবেদার লুতফর রহমানের নেতৃত্বে আমাদের একটি গেরিলা দল তাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় দেড় ঘণ্টা গোলাগুলির পর ৬জন পাকসেনা নিহত হয় ও ৩ জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা সোনাইমুড়ি থেকে পালিয়ে যায়। ১২ই অক্টোবর আমাদের গেরিলারা ফেনী থানার অন্তর্গত লেমুয়ার একজন কুখ্যাত দালালকে হত্যা করে। এই সংবাদ পেয়ে পরদিন সকালে পাকিস্তানীদের একটি শক্তিশালী দল ঐ এলাকায় আসে। এবং স্থানীয় জনসাধারণের উপর নৃশংস অত্যাচার শুরু করে। আমাদেরও ঐ এলাকার গেরিলারা পাকসেনাদের এই অত্যাচার বন্ধ করার জন্য প্রায় ৫০ জন একত্রিত হয়ে পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। চারঘন্টা যুদ্ধের পর পাকসেনারা পলায়ন করে আত্মরক্ষা করে। প্রায় ৭ জন পাকসেনা ঐ যুদ্ধে গুরুতর আহত হয়। বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র আমাদের দখলে আসে।

জুলাই এবং আগস্ট মাস্যা আমাদের হেড কোয়ার্টার থেকে কয়েকশ গেরিলা ট্রেনিং প্রাপ্ত হয়ে অপারেশনের জন্য তৈরি হয়। এইসব গেরিলাদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে ফরিদপুর সদর এবং মাদারীপুর মহকুমার বিভিন্ন থানায় অপারেশনের দায়িত্ব অর্পন করা হয়। এইসব দলগুলোকে নবীনগর, দাউদকান্দি হয়ে নদীপথে তাদের নিজস্ব জায়গাতে পাঠানো হয়। ৩/৪ হাজার গেরিলা ছোট ছোট দলে গ্রাম্য পথে এবং নদীপথে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যে অনুপ্রবেশ করে তাদের নিজ নিজ গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হয়। শুধু একটি দল যাওয়ার পথে হোমনার নিকট পাকসেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। পাকসেনাদের গুলিতে একটি নৌকা ডুবে যায়। ফলে ৪ জন গেরিলা শহীদ হয় এবং ৪ জন আহত হয়। ৩টি স্টেনগান ও ৫টি রাইফেল পানিতে পড়ে ডুবে যায়। নিজ নিজ জায়গায় পৌঁছে গেরিলা দলগুলো তাদের তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। এই সময়ে পাকসেনারা ফরিদপুর হয়ে বরিশালের রাস্তায় যাতায়াত করত। সেপ্টেম্বরে মাদারীপুরের একটি গেরিলা দল ভুরঘাটার নিকট একটি সড়ক সেতুতে আক্রমণ চালিয়ে সেতুটি উড়িয়ে দেয়। ফলে পাকসেনাদের বরিশাল যাতায়াতের রাস্তায় অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এরপর গেরিলাদের আরেকটি দল নড়িয়া থানা আক্রমণ করে। সে সঙ্গে ডাকঘর ও রেজিস্ট্রি অফিস জ্বালিয়ে দেয়। ১,৫০০ মণ পাট ও তারা পুড়িয়ে দেয়। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে গেরিলারা ভেদরগঞ্জ থানা আক্রমণ করে সকল পশ্চিম পাক পুলিশকে নিহত করে। সেখানকার রেজিস্ট্রি অফিস, পোস্ট অফিস, কালেক্টর অফিস ইত্যাদি বন্ধ করে দেয়। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই গেরিলারা পালং থানার রাজগঞ্জ এবং কোটালিপাড়ায় আক্রমণ চালিয়ে সমস্ত সরকারী অফিস ধ্বংস করে দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে প্রায় চার হাজার মণ পাট জ্বালিয়ে দেয়। পরের সপ্তাহে গেরিলাদের একটি শক্তিশালী দল জাজিরা থানার রাজস্ব অফিস এবং রেজিস্ট্রি অফিস বন্ধ করে দেয় মাদারীপুরের অন্যন্য থানা আক্রমণ হওয়ার ফলে পাকসেনারা নড়িয়া থানাতে তাদের শক্তি বৃধি করে। এই থানার পাকসেনা ও পুলিশরা নিকটস্থ গ্রামে তাদের অকথ্য অত্যাচার চালায়। স্থানীয় গেরিলারা এই থানাটির শক্তি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ খবরাখবর সংগ্রহ করে। ৬ই সেপ্টেম্বর ৫০ জনের একটি গেরিলা দল রাত ৮টার সময় এই থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকসেনা ও পুলিশরা সব শক্তি দিয়ে থানাকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর আমাদের গেরিলারা থানাটি দখল করে নিতে সমর্থ হয়। প্রায় ১৭ জন পাকসেনা ও পিলিশ নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। থানার দারোগাও এতে নিহত হয়। থানা থেকে ৩০টি রাইফেল এবং একটি বেতার যন্ত্র গেরিলাদের হস্তগত হয়। গেরিলারা থানাটি ধ্বংস করে দেয়। গেরিলাদের আরেকটি দল ঝিকরগাছির নিকট বরিশাল-ফরিদপুর টেলিফোন লাইনের ৬শ’ গজ তাঁর নষ্ট করে দেয়। টেলিগ্রাফ বিভাগের টেকনিশিয়ানরা পাকসেনাদের পাহারায় টেলিফোন লাইনটি মেরামত করতে আসার পথে গেরিলাদের বসানো মাইন বিস্ফোরণে তাদের জিপটি ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনাদের আরেকটি টহলদার দল মাদারীপুরের হাওলাদার জুট মিলের নিকট গেরিলাদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ায় চারজন পাকসেনা নিহত হয়। গেরিলারা মাদারীপুরের নিকট ঘাট মাঝিতে প্রায় ৩০/৪০ গজ রাস্তা কেটে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মাদারীপুরের চড় মুগুরিয়ায় সরকারী পাট গুদামে আগুন লাগিয়ে প্রায় ৫০ হাজার মণ জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মাদারীপুর- ফরিদপুর রাস্তায় সমাদ্দার ফেরিঘাটে একটি ফেরী অগ্নি সংযোগে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। একটি মটর লঞ্চ ও ধ্বংস করা হয়। এই মটর লঞ্চটি পাকসেনারা টহল দেয়ার কাজে ব্যাবহার করত। আমাদের গেরিলাদের এই সব ব্যাপক তৎপরতায় পাকসেনারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। ৬ই সেপ্টেম্বর পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল লঞ্চে মাদারীপুরের দিকে তৎপরতা আরও জোরদার করার জন্য আগ্রসর হয়। এই খবর আমাদের গেরিলারা আগেই পেয়ে যায়। ২০ জনের একটি গেরিলা দল পলং থানার রাজগঞ্জের নিকট নদীর তীরে পাকসেনাদের জন্য এম্বুশ পেতে বসে থাকে। সকাল ১০টার সময় লঞ্চটি আমাদের গেরিলা দলের এম্বুশের আওতায় এলে তৎক্ষণাৎ গেরিলারা তাদের উপর আক্রমণ চালায়। ফলে ১০/১২ জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। উপায়ান্তর না দেখে পাকসেনাদের লঞ্চটি শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যায়। এর কয়েকদিন পড় পাকসেনারা আরও অধিক সৈন্য ফরিদপুর থেকে পালং থানায় মোতায়েন করে। ঐ এলাকার গেরিলারা পাকসেনাদের পালং থানার ঘাঁটির পুনর্দখলের পরিকল্পনা নেয়। গেরিলারা সঠিক সংবাদ নেয়ার পর জানতে পারে যে থানাতে প্রায় এক প্লাটুন পাকসেনা ও ৫০/৬০ জন পাক পুলিশ এবং রাজাকার রয়েছে। প্রায় ২/৩ শ’ গেরিলা একত্রিত হয়ে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২১শে সেপ্টেম্বর রাত ১১টায় পালং থানার উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা সম্মুখযুদ্ধের পর ঐ ঘাঁটি থেকে অনেক সংখ্যক পাকসেনা উপায়ান্তর না দেখে পালিয়ে যায়। গেরিলারা যুদ্ধে ৫০ জন পাকসেনা, রাজাকার ও পাকপুলিশকে নিহত করে। এর পর সম্পূর্ণ এলাকাটি আমাদের গেরিলাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।

কুমিল্লার উত্তরে ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে এবং ‘এ’ কোম্পানি মেজর সালেক ও মেজর আইনুদ্দিনের নেতৃত্বে মন্দভাগ ও শালদা নদী এলাকার পাকসেনাদের উপর তাদের চাপ অব্যাহত রাখে। ফলে পাক সেনারা মন্দভাগ বাজার, লক্ষ্মীপুর ও সাইতসালা প্রভৃতি জায়গা সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যাগ করে চান্দলা, পানছড়া ও সেনেরহাট ইত্যাদি জায়গায় তাদের ঘাঁটি পিছিয়ে নিতে বাধ্য হয়। পাকসেনারা পুনরায় তাদের পূর্বোক্ত অবস্থানগুলি দখল করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু আমাদের সৈনিকদের সুদূর প্রতিরক্ষার সামনে তাদের চেষ্টা সম্পূর্ণ ব্যার্থ হয়। তাদের সঙ্গে যখন আমাদের সৈনিকদের সম্মুখযুদ্ধ তীব্রভাবে চলছিল সেই সময়ে আমাদের গেরিলারাও পাকসেনাদের পশ্চাদে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিল। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিকট বিদ্যাকোটে আমাদের গেরিলাদের একটি দল পাকসেনাদের একটি টহলদার কোম্পানিকে এম্বুশ করে একজন অফিসারসহ ৫০ জন পাকসেনাকে নিহত করে। তাদের ৪টি নৌকাও ডুবিয়ে দেয়। গোসাইরহাট রেল স্টেশনের নিকট একটি রেল ইঞ্জিন মাইন দিয়ে উড়িয়ে দেয়। এসব সঙ্ঘর্ষে আমাদের গেরিলারা অনেক অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকসেনারা কসবার পশ্চিমে প্রায় দুই কোম্পানি সৈন্য সমাবেশ করে। পাক সমাবেশ আমরা বুঝতে পারি যে, কসবাকে পূর্ণ দখল করার জন্য তারা পরিকল্পনা নিয়েছে। আমরা তাদের সম্ভাব্য আক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুতি নেই। আমি আমদের কসবা অবস্থানের সাহায্যার্থে আমাদের প্রথম গোলন্দাজ ব্যাটারিকে অনুরূপভাবে মোতায়েন করি।

১৩ই অক্টোবর সন্ধ্যা ৫-৩০টায় পাকসেনারা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আমাদের অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানি বিপুল সাহস ও দৃঢ় আস্থার সঙ্গে এই আক্রমণের মোকাবিলা করে। প্রায় একঘণ্টা যুদ্ধের পর গলন্দাগ বাহিনীর সহায়তায় তীব্র পাল্টা আক্রমণের মুখে পাকসেনারা টিকতে না পেরে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। যুদ্ধে প্রায় ৪৫ জন পাকসেনা হতাহত হয়। ১৫টি জি ও রাইফেল, একটি ৩’’ মর্টার এবং ৩৫০০ টি ৭.৬২ গুলি ও ৮টি ৩’’ মর্টারের গোলা আমাদের হস্তগত হয়। এছাড়াও ন’টি বাঙ্কার ধ্বংস করা হয়। এই প্রচণ্ড সংঘর্ষে আমাদের দুজন শহীদ হয় এবং একজন আহত হয়। পরে যানা যায় যে, পাকসেনারা এই আক্রমণে পঞ্চম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্য নিয়োগ করেছিল। পরদিন পাকসেনারা যখন কসবার পশ্চিম দিক থেকে আরও পিছু হটে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময়ে আমাদের একটি প্লাটুন তাদের একটি দলকে অ্যামবুশ করে। এম্বুশে প্রায় ১৫ জন পাকসেনা এবং ১৫ জন রাজাকার নিহত হয়। আমাদের দু’জন সৈনিক শহীদ এবং একজন আহত হয়। আমাদের একটি হাল্কা মেশিনগান বিনষ্ট হয়।

এই সময়ে পাকসেনারা তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলিতে লঞ্চ ও নৌকার সাহায্যে রসদ সরবরাহ করত। নদীপথে জলযান বন্ধ করে দেয়ার জন্য আমি একটি গেরিলা দলকে বাঞ্জারাম থানার উজানচরের নিকট বিদ্যুৎ সরবরাহকারী পাইলনগুলো কেটে নদীতে ফেলে নদীপথে বাঁধা সৃষ্টি করার নির্দেশমত আমাদের গেরিলা দল একটু দূরে এম্বুশ পেতে অপেক্ষা করতে থাকে। পাইলন কাঁটার সংবাদ পেয়ে ৩/৪টি লঞ্চ ভর্তি পাকসেনা, মুজাহিদ ও রাজাকার নদীপথের এই বাঁধাগুলো পরিষ্কার করার জন্য আসে। পাকসেনারা যখন কাজে লেগে যায় ঠিক এমন অদূরেই এম্বুশ পেতে অবস্থানরত আমাদের গেরিলারা তাদের উপর অতর্কিতে আক্রমণ চালায়। ফলে প্রায় ৭০/৮০ জন পাকসেনা, মুজাহিদ এবং রাজাকার নিহত হয়। গেরিলাদের গোলার মুখে অবশিষ্ট পাকসেনা লঞ্চ নিয়ে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। এই বিপর্যয়ের কয়েকদিন পর পাকসেনারা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ৫/৬ টি লঞ্চে বিপুলসঙ্খ্যক সৈন্য বিমান বাহিনীর সহায়তায় আমাদের উজানচরের ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা শুধু হাল্কা মেশিনগান, রাইফেল ও এস এল আর নিয়ে পাকসেনাদের এই বিপুল শক্তির বিরুদ্ধে সহাসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ চালায়। কিন্তু বিমান হামলায় টিকতে না পেরে অবশেষে অবস্থানটি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। এর তিনদিন পর ১১ই অক্টোবর বিকাল চারটায় আমাদের এই দলটি জানতে পারে যে, পাকসেনাদের একটি প্লাটুন লঞ্চ যোগে বাঞ্চারাম থানার আসাদনগর এলাকা লুট করার জন্য অগ্রসর হচ্ছে। এই খবর পেয়ে আমাদের গেরিলা দলটি পাকসেনাদের লঞ্চটিকে আসাদনগরে অ্যামবুশ করে। আম্বশে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অন্যরা পলায়ন করে প্রাণ বাঁচায়। আমাদের গেরিলা দলটি হোমনা থানাতে পাকসেনারা পশ্চিম পাক পুলিশ মোতায়েন করে। আমাদের গেরিলা দলটি হোমনা থানাতে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৭জন পাক পুলিশকে নিহত করে এবং রাইফেল ও কয়েকশ রাউন্ড গুলি দখল করে নেয়।

পাকসেনারা কসবাতে বিপর্যস্ত হওয়ার পর কুমিল্লা থেকে চান্দলার নিকট সৈন্য সমাবেশ করে। পাকসেনাদের এই সমাবেশের মূল কারণ ছিল মন্দভাগকে পুনর্দখল করা। ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি এই সময় মন্দভাগের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। ১৮তারিখ রাত সাড়ে তিনটায় পাকসেনারা প্রায় এক কোম্পানী শক্তি নিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষার উপর আক্রমণ চালাতে শুরু করে। প্রায় তিনঘণ্টা যুদ্ধের পর সকাল সাড়ে ছ’টা পর্যন্ত আমাদের সৈনিকরা এই আক্রমণকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। পাকসেনারা প্রতিহত হয়ে আমাদের রক্ষাবুহ্যের সামনে থেকে গোলাগুলি চালাতে থাকে। বেলা দশটার সময় পাকসেনারা আরও দু কোম্পানি সৈন্য নিয়ে দুবার আক্রমণ চালায়। পাকসেনাদের এই শক্তিশালী দলগুলো গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় প্রবল বাঁধার মাঝেও সামনে অগ্রসর হতে থাকে। অগ্রসর হওয়ার সময় আমাদের সৈনিকদের গুলিতে তাদের অনেক হতাহত হয়। অবশেষে পাকসেনারা আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্য ভেদ করতে সক্ষম হয়। প্রায় দুঘণ্টা যাবত হাতাহাতি যুদ্ধে আমাদের দুর্ধর্ষ সৈনিকরা আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যে প্রবেশকারী পাকসেনাদের সাফল্যের সঙ্গে সম্পূর্ণরূপে পর্যদুস্ত করতে সক্ষম হয়। পাকসেনারা তাদের মৃতদেহ ফেলে রেখেই পলায়ন করতে বাধ্য হয়। আমাদের প্রতিরক্ষাবুহ্যের চতুর্দিকে কর্দমাক্ত নিম্ন জলাভূমি দিয়ে পালাবার পথে তারা আরো অধিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। আমাদের সৈন্যরা এই যুদ্ধে ৩৩ তম বেলুচ রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেঃ পারভেজ খান সহ ৮ জন পাকসেনাকে বন্দি করে। এছাড়া একজন অফিসারসহ ৫০ জন পাকসেনা নিহত হয়। ৬টি এম জি আই এ -৩, কুড়িটি ৭৩৬২ চায়না রাইফেল, চারটি জি-৩ রাইফেল, একটি মর্টার, একটি হাল্কা পিস্তল, পাঁচটি সাবমেশিনগান, ১৫ বাক্স মেশিনগানের গুলি , ৩১টি ৯৪ এলাগা গ্রেনেড, ২০টি ৩৬ এইচই গ্রেনেড, ১০টি এম এম বোমা, অনেকগুলো বেয়োনেট, বেশকিছু জি-৩ রাইফেল ম্যাগাজিন, ১৫টি বিভিন্ন দলিলপত্রসহ বেশকিছু ফাইল আমাদের সৈন্যরা দখল করে নেয়। এই প্রচণ্ড যুদ্ধে আমাদের পাঁচজন সৈনিক গুরুতরভাবে আহত হয়, কেউ শহীদ হয়নি। তাদের এই বিপুল বিপর্যয়ের ফলে পর্যুদস্ত দিশেহারা পাকবাহিনী এফ ৮৬ জঙ্গিবিমান দিয়ে আমাদের অবস্থানে প্রায় ৪৫ মিনিটকাল ধরে মারাত্মকভাবে হামলা চালায়। পাকসেনার গোলন্দাজ ইউনিটের ভারী কামানের সাহায্যে শত শত গোলাবর্ষণ করতে থাকে। আমাদের এই অবস্থানটি দখল করতে না পেরে পাকসেনারা কিছু পিছনে গিয়ে পুনরায় আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২০শে অক্টোবর পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল সকাল থেকে কামালপুরের নিকট আমাদের আরেকটি অবস্থানের উপর গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণেও তারা আমাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষাবুহ্যে ভেদ করতে না পেরে বিফল হয়। পাকিস্তানীদের একজন অফিসারসহ ৩০ জন সৈনিক নিহত হয়। বার বার ব্যার্থ হওয়ায় পাকবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। পাকসেনারা ৩/৪ দিন ধরে আমাদের অবস্থান গুলোর দুর্বলতা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালায়। ২৫ তারিখ অপরাহ্ণ ৩-৫ মিনিট থেকে মন্দভাগ , মঙ্গলপুর ও শ্রীপুরস্থ আমাদের অবস্থানগুলোর উপর বিকাল ৪-১০ পর্যন্ত এফ-৮৬ জঙ্গিবিমান প্রবল ভাবে হামলা চালায় এবং একই সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনারাও এইসব অবস্থাগুলোর উপর প্রবল আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত চলতে থাকে। আমাদের সৈনিকরাও মনোবল না হারিয়ে পাকসেনাদের এই সম্মিলিত আক্রমণকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিহত করে। সঙ্ঘর্ষে পাকসেনাদেরও প্রায় ৫৮ জন সৈনিক হতাহত হয়। ফলে তাদের আক্রমণ দুর্বল হয়ে পড়ে এবং বাধ্য হয়ে পিছু হটে যায়। যুদ্ধে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ এবং ৯ জন আহত হয়।

আমরা যখন মন্দভাগে পাকসেনাদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত এবং পাকসেনাদের প্রতিহত করার জন্য কসবার অবস্থান থেকে কিছুসংখ্যক সৈন্য নিয়ে মন্দভাগ অবস্থানকে শক্তিশালী করছিলাম ঠিক তখনি আমাদের কসবার অবস্থানের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে পাকসেনারা অগ্রসর হয়ে কসবার পুরনো বাজার পর্যন্ত পুনর্দখল করে নেয়।

সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে আমার সেক্টরের সৈনিকদের পুনর্গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশ আসে কে-ফোর্স গঠনের, আমি আগে থেকেই মনস্থ করেছিলাম যে পাকসেনাদের উপর পুনঃ আক্রমণের পুর্বে আমার অধীনস্থ সৈনিকদের পুনর্গঠনের দরকার। গত ৪/৫ মাস ধরে অবিরাম যুদ্ধে এবং জীবন ধারণের নিত্য প্রয়োজন আহার নিদ্রা থেকে বঞ্চিত ও যুদ্ধ সামগ্রীর অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি প্রবল প্রতিকূলতার দরুন তারা স্বাভাবিক কারণেই অত্যন্ত পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিল। সুতরাং পরবর্তী প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এছাড়া নতুন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈনিকদের নিয়ে এবং ৪র্থ বেঙ্গলের পুরনো ও অভিজ্ঞ সৈনিকদের নিয়ে আরও কয়েকটি ব্যাটালিয়ন গঠন করার ইচ্ছা ছিল। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি সাবসেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে হেডকোয়ার্টার মেলাঘরে একটি কনফারেন্স করি। সে কনফারেন্স নিম্নোক্ত সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করা হয় –

ক) চতুর্থ বেঙ্গল থেকে পুরনো ও অভিজ্ঞ সৈনিক নিয়ে আরও দুটি ব্যাটালিয়ন করা হবে।
খ) ৪র্থ বেঙ্গলের ‘সি’ কোম্পানি ও হেডকোয়ার্টারের কিছু সৈনিক ৪র্থ বেঙ্গলেই থাকবে এবং তাদেরকে নিয়ে ৪র্থ বেঙ্গলকে পুনর্গঠন করা হবে। এই ব্যাটালিয়নটি পরিচালনার জন্য ক্যাপ্টেন গাফফারকে নিযুক্ত করা হল এই ব্যাটালিয়নটি পুনর্গঠন এবং পুনর্বিন্যাসের জন্য কনাবন বেইস এ একত্রিত করা হবে।
গ) ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানি এবং ‘বি’ কোম্পানির কিছু সৈন্য নিয়ে নতুন করে ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হবে। মেজর আইনুদ্দিনকে এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হল। এই ব্যাটালিয়নটিকে কসবা বেইসু-এ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা হবে।
ঘ) ৪র্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি এবং বি কোম্পানির অবশিষ্ট সৈনিকদের নিয়ে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হবে। মেজর সালেক কে এই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক নিযুক্ত করা হল। মেজর সালেক এবং ৪র্থ বেঙ্গলের এই কোম্পানি শালদা নদীতে যুদ্ধে লিপ্ত থাকায় তাঁকে তাঁর সৈন্য সহ বেলিনিয়াতে যাবার নির্দেশ দেয়া হল। ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে বেলুনই-রাজনগর বেইসু -এ পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা হবে।
ঙ) ২নং সেক্টর অধিনস্ত সব যোদ্ধাদের তিন ভাগে বিভক্ত করা হবে। নবগঠিত ৪র্থ, ৯ম ও ১০ম রেজিমেন্টকে নিয়ে কে ফোর্স নামে ব্রিগেড গঠন করা হল।
চ) নবগঠিত কে ব্রিগেডির আলাদা হেডকোয়ার্টার স্থাপন করে সেখানে স্টাফ অফিসার হিসেবে মেজর মতিন এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ারুল আলমকে নিযুক্ত করা হল।
ছ) গেরিলা হেডকোয়ার্টার মেলঘরেই রাখা হবে। মেজর হায়দার আমার অধীনে গেরিলা স্টাফ অফিসার নিযুক্ত হল।
জ) ১৮টি সেক্টর কোম্পানি কোম্পানি হিসেবেই থাকবে এবং তারা কে ফোর্স হেডকোয়ার্টারের নির্দেশ মেনে চলবে। তাদেরকে সাধারণত কমান্ডো হিসেবে শত্রুপক্ষের পশ্চাতভাগে (গভিরাভ্যন্তরে) ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাবার কাজে নিয়োগ করা হবে।
ঝ) গেরিলারা তাদের নিজ নিজ এলাকায় পাকসেনাদের নির্মূল করে নিজ নিজ এলাকা শত্রুমুক্ত করবে। পাকসেনাদের ছোট ছোট দলে বিচ্ছিন্ন করে তাদের শক্ত ঘাঁটিগুলোকে অনুরোধ করে আত্তসমর্পন করাতে বাধ্য করবে।
ঞ) কে ফোর্স ব্রিগেড কে পাকসেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটিগুলিকে দখল করার কাজে নিয়োগ করা হবে এবং উদ্ধারকৃত মুক্ত এলাকার প্রতিরক্ষার কাজে নিয়োজিত থাকবে।
ট) অক্টোবর মাসের ১৪ তারিখের মধ্যেই কে ফোর্স পুনর্গঠনের কাজ শেষ করা হবে।
ঠ) কে-ফোর্স পুনর্গঠনকালে পাকসেনারা যাতে তাদের হৃত মনোবল পুনরুদ্ধার না করতে পারে এবং প্রাধান্য বিস্তার সক্ষম না হয় সেজন্য কোম্পানিগুলো এবং কমান্ডোপ্লাটুনগুলো গেরিলাদের সহায়তায় ৪র্থ বেঙ্গলের অপারেশন এলাকায় নিয়োজিত থেকে শূন্যতা পূরণ করবে তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখবে।
ড) অস্ত্র, গোলাবারুদ ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জাম যা কিছু আছে তা পুনরায় বিভিন্ন দলের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে বণ্টন কিরা হবে।
ত) গোলন্দাজ বাহিনীর প্রথম ফিল্ড রেজিমেন্ট কে-ফোর্স এর অধীনে নিযুক্ত করা হল।
ণ) কে-ফোর্স এবং ২ নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব যৌথভাবে আমার অধীনে থাকবে। আমার অবর্তমানে এই দুটি বাহিনী বিভক্ত হবে। কে-ফোর্সের অধিনায়কত্ব করবেন মেজর সালেক ও ২নং সেক্টরের অধিনায়কত্ব দায়িত্ব পালন করবেন।

কনফারেন্সের বর্নিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২নং সেক্টরের পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠনের কাজ শুরু করা হয়। নিয়মিত বাহিনীর কোর্স-ফোর্স ব্রিগেড গঠন করার কাজে আমাদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়। যেহেতু যুদ্ধসামগ্রীর যথেষ্ট অভাব ছিল বিশেষ করে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ ও পোশাকের; তবুও সংগঠনের কাজ মোটামুটি এগিয়ে চলে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট কসবাতে; ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট শালদা নদীতে এবং ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট বেলুনিয়াতে সঙ্ঘটিত হয়ে পুনরায় যুদ্ধের জন্য তৈরি হয়ে যায়। যুদ্ধে পুনঃনিয়োগের আগে এইসব ইউনিটগুলোকে তিন সপ্তাহের জন্য ব্যাপকভাবে সমন্বিত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অক্টোবর মাসের মাঝা মাঝিতে ৯ম বেঙ্গল ইউনিটকে পরিক্ষামূলকভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে পুননিয়োগের সিদ্ধান্ত নেই। এই সময়ে আমাদের সেক্টর ট্রুপ্স কসবা; মন্দভাগ প্রভৃতি এলাকায় ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি এই সুযোগের সদব্যাবহার করে তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে এই এলাকা থেকে বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত নেই। কসবার পূর্বাংশ ইতোমধ্যেই আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল। পাকসেনারা সেখান থেকে পিছু হটে পূর্বেই পশ্চিমাংশে পুরানা বাজারের নিকট তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছিল। পাকসেনাদের এই ঘাঁটিটিও ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে আক্রমণের নির্দেশ দেই। নির্দেশ অনুযায়ী মেজর আইনুদ্দিন তাঁর ব্যাটালিয়নকে লাট মুড়ার পিছনে সমবেত করে এবং ২০শে অক্টোবর পর্যন্ত শত্রু অবস্থানের সমস্ত সংবাদ সংগ্রহ করে। শত্রু অবস্থানের তথ্য জানার পড় বোঝা যায় যে পাকসেনারা তাদের অবস্থানটি পূর্ব এবং দক্ষিন্মূখি করে অধিক শক্তিশালী করে তুলেছে। আমি মেজর আইনুদ্দিনকে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের দুই কোম্পানি দিয়ে উত্তর ঠিক থেকে পাক অবস্থানের উপর আক্রমণ করার নির্দেশ দেই। শত্রুসেনারা মনোযোগ অন্যদিকে পরিবর্তন করার জন্য একটি কোম্পানি দিয়ে কসবার দিক থেকে অবস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি করার নির্দেশ দেই। শত্রুসেনারা মনোযোগ অন্যদিকে পরিবর্তন করার জন্য একটি কোম্পানি দিয়ে কসবার দিক থেকে অবস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি করার নির্দেশ দেই। আরেকটি কোম্পানি রিজার্ভে থাকার আদেশ করি। ১ম ফিল্ড ব্যাটারিকে এই আক্রমণে সহায়তার জন্য মেজর আইনুদ্দিনের অধীনে দেই।

২২শে অক্টোবর ভোর সাড়ে ৫টার সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী ৯ম রেজিমেন্ট পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালায়। প্রায় ১০ মিনিট তীব্র কামানের গোলার আক্রমণের পড় উত্তর দিক থেকে দুটি কোম্পানি লেঃ আজিজ ও সুবেদার মেজর শামসুল হকের নেতৃত্বে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই অতর্কিত আক্রমণের জন্য পাকসেনারা প্রস্তুত ছিলোনা। প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে তাদের অবস্থানগুলো ভেঙ্গে পড়ে। তারা দিশেহারা হয়ে অবস্থান পরিত্যাগ করে পেছনের দিকে পালিয়ে যায়। ৩ঘন্টা যুদ্ধের পড় ৯ম রেজিমেন্ট পাকসেনাদের অবস্থানটি দখল করে নেয়। যুদ্ধে ২৬ জন পাকসেনা নিহত ও ১৮ জন আহত হয়। ১১টি এল এম জি, ১ টি পিস্তল সিগনাল, ৪০টি এইচই৩৬ গ্রেনেড, ৩টি ৯৪ এনার্গা, ৪৪টি প্লাস্টিক মাইন, ১টি ম্যাপ, ২টি র্যাঙ্কের ব্যাজ আমাদের হস্তগত হয়। এই যুদ্ধে আমাদের লেঃ আজিজ ও ৩ জন সৈনিক শহীদ হয় এবং ১৫ জন আহত হয়। পাকসেনাদের একটি ছোট দল পিছনে হটে গিয়ে ছোট একটি নালার পশ্চিম তীরে পুনরায় দ্রুত অবস্থান গড়ে তোলার চেষ্টা করে। পরদিন ভোর ৪টায় সুবেদার মেজর সামসুল হকের কোম্পানি পাকসেনাদের এই অবস্থানের উপর পুনরায় আক্রমণ চালায়। প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে প্রায় ২অ জন পাকসেনা নিহত ও ২২ জন আহত হয়। বিপর্যস্ত হয়ে পাকসেনারা সম্পূর্ণরূপে পশ্চাতে হটে যায়। এই আক্রমণের ফলে সম্পূর্ণ কসবা আমাদের দখলে আসে। পাকসেনারা পিছু হটে গিয়ে মইনপুর, কাশেম্পুর, কামালপুর, গুড়গুইট প্রভৃতি জায়গায় তাদের নতুন অবস্থান তৈরি করে।

কসবা শত্রুমুক্ত করার পর ৯ম রেজিমেন্ট কৃশানপুর, বগাবাড়ি, ইয়াকুবপুর এলাকা জুড়ে তাদের নতুন বুহ্য তৈরি করে। এই অবস্থাগুলো থেকে পাট্রোল পার্টি ও শক্তিশালী রেইডিং পার্টি পাক অবস্থাগুলোর ওপর ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে যেতে থাকে। ফলে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানের সঙ্ঘর্ষে ২২জন পাকসেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়।

৪র্থ রেজিমেন্ট কোনাবনে তাদের বেইস-এ পুনর্গঠিত হওয়ার পড় অক্টোবর মাস্যা পুনরায় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়। আমি এই ব্যাটালিয়নকে শালদা নদী থেকে পাকসেনাএর বিতাড়িত করার নির্দেশ দেই। শালদা এলাকার কমপ্লেক্স ট্যাক্টিক্যাল একটি খারাপ এলাকা বলে তাদেরকে পুরো ব্যাটালিয়ন হিসেবে আক্রমণ করার নির্দেশ প্রদান করি। কোম্পানি এবং প্লাটুনে ভাগ হয়ে প্রথম তৎপরতা চালিয়ে এলাকার উপর পুরা আধিপত্য অর্জন করার নির্দেশ দেই। এই নির্দেশের পড় ক্যামতেন গাফফার তাঁর মন্দভাগ অবস্থান থেকে শালদা নদীর পশ্চিমে ও উত্তরে ৪র্থ রেজিমেন্টের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। অক্টোবর মাসের মাঝা মাঝি ৪র্থ রেজিমেন্টের একটি প্লাটুন কায়েমপুরের নিকট এম্বুশ পাতে। পাকসেনাদের প্রায় ৪০ জন সৈনিক এই এম্বুশে আক্রান্ত হয়। ফলে ১৫ জন পাকসেনা নিহত এবং অনেকে আহত হয়। এর ৩/৪ দিন পড় চতুর্থ বেঙ্গলের আরেকটি রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের চত্তরা অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে রকেট লাঞ্চার দ্বারা একটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয় এবং ১৫ জন পাকসেনাকে হতাহত করে। এর কিছুদিন পড় নায়েব সুবেদার শিকদার আফজাল হোসেনের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের একটি কোম্পানি পাকসেনাদের পিছনে অনুপ্রবেশ করে চাপিতলায় এম্বুশ পাতে। পরদিন ভোর ৪টার সময় পাকসেনাদের দুটি কোম্পানি তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলো শক্তিশালী করার জন্য অগ্রসর হচ্ছিল। পাকসেনাদের এই দলটি ভোর ৫টায় আমাদের এম্বুশে এসে যায়। প্রায় ৪ ঘণ্টা যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে ৫০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। এই আক্রমণের পরপরই পাকসেনারা আমাদের অবস্থানের উপর জঙ্গি বিমান দিয়ে ৯-৪৫ মিনিট পর্যন্ত প্রচণ্ড আক্রমণ করে। আমাদের পক্ষে কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট পাকসেনাদের কামালপুর, মইনপুর, লক্ষ্মীপুর অবস্থানগুলোর উপর তাদের চাপ আরও জোরদার করে তোলে। ১১ই নভেম্বর আমাদের একটি শক্তিশালী রেইডিং পার্টি পাকসেনাদের কামালপুরের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। হাড়ে ৯টা থেকে ১২টা পর্যন্ত এই আক্রমণে পাকসেনাদের ১৬ জন নিহত এবং ২২ জন আহত হয়। এর পরদিন সকাল সাড়ে ৫টায় ৪র্থ বেঙ্গলের আরেকটি কোম্পানি লক্ষ্মীপুর এবং শালদা নদী ফেরী এলাকা আক্রমণ করে দখল করে নেয়। যুদ্ধে প্রায় ১০০ জন পাকসেনা হতাহত হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। আমাদের একজন সৈনিক শহীদ ও ৭জন আহত হয়। শত্রুদের কাছ থেকে ১৫টি রাইফেল, ৩টি এল এম জি , ১২টি এল এম জি বাক্রু দুটি পিস্তল, একটি ৪০ এম এম রকেট লাঞ্চার, ৭২টি ৬০টি এম এম বোমা, ৩টি টেলিফোন সেট, ৫টি ওয়ারলেস সেট ব্যাটারি, ১টি মেশিন গানের ব্যারেল এবং ৪টি ম্যাপ সহ অনেক যুদ্ধ সরঞ্জাম দখল করে নেয়। শালদা নদী ফেরী এবং লক্ষ্মীপুর এলাকা আমাদের দখলে আসার পর ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে শালদা নদী কমপ্লেক্স দখল করার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।

শালদা নদীর যুদ্ধ

শালদা নদী এলাকায় শত্রুদের ঘাঁটিটি খুবই শক্তিশালী ছিল। এই ঘাঁটির উত্তর দিক দিয়ে শালদা নদী প্রবাহিত হওয়ায় শত্রুদের উত্তর দিক থেকে সম্পূর্ণরূপে নিরাপদ ছিল। পূর্ব দিকে রেলওয়ে ষ্টেশন উঁচু রেললাইন সম্মুখবর্তী এলাকায় শত্রুদের নিরাপত্তার প্রাধান্য বিস্তার করে। পশ্চিমের গুদামঘরের উঁচু ভূমি তাদের শক্তিশালী ঘাঁটির নিরাপত্তার বেশ সহায়ক ছিল। এই অবস্থানটিকে নিয়মিত প্রথায় আক্রমণ করে সফল হওয়া দুষ্কর ছিল। শত্রুঘাঁটির এই সকল বৈশিষ্ট্য তাদের পক্ষে সহায়ক হওয়ার আমরা এই ঘাঁটিটিতে নিয়মিত প্রথায় আক্রমণ না করে অনিয়মিত পদ্ধতিতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেই। শত্রুদের ঘাঁটিটি পর্যবেক্ষণের পর আমরা আরো জানতে পারি যে; শালদা নদীর তীর বরাবর আমাদের ঠিক সামনে তারা তারা চারটি বড় পরিখা খানন করেছিল। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ঘাঁটিটিকে তিনদিক থেকে সাঁড়াশী আক্রমণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্যাপ্টেন গাফফার ও নায়েব সুবেদার সিরাজের নেতৃত্ব একটি প্লাটুন শালদা নদী রেলস্টেশনের পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নেয়। সুবেদার বেলায়েতের নেতৃত্বে আরেকটি প্লাটুন শালদা নদীতে শত্রুর ঘাঁটির বিপরীত দিকে অবস্থান নেয়। পাকসেনা যাতে আক্রমণের সময় আমাদের পেছন থেকে আঘাত না হানতে পারে সেজন্য সুবেদার ওয়াহেবের নেতৃত্বে একটি কম্পানী মঙ্গল মিয়ার অবস্থানের পেছনে নিরাপত্তা মূলক অবস্থান গ্রহন করে। এছাড়া পাকসেনাদের মনোযোগ অন্যদিকে আকর্ষণ করার জন্য চারটি ছোট রেইডিং পার্টিকে বড় ধুশিয়া , চান্দলা , গোবিন্দপুর , কায়েমপুর প্রভৃতি শত্রুঘাঁটির দিকে পাঠানো হয়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এইসব রেইডিং পার্টিগুলো ১৫ই নভেম্বর রাতে পাকসেনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করার জন্য শত্রুঘাঁটির উপর আক্রমন চালায়। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা শালদা নদী থেকে রেইডিং পার্টির উপর কামান ও মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করে। এই গোলাবর্ষণ সমস্ত রাত ধরে চলে এবং ভোরের দিকে বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের আক্রমণ শেষ হয়ে গেছে ভেবে পাকসেনারা পরদিন সকালে কিছুটা অসতর্ক হয়ে পরে এবং বিশ্রামের সুযোগ নেয়। এই সময় তাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহগুলো রাজাকার এবং ইপকাফ এর প্রহরাধীন ছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যেঃ শত্রুরা সাধারণত রাতের বেলায় আমাদের সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য যতটা সতর্ক থাকত দিনের বেলায় ততটা প্রস্তুত থাকত না।

এমতাবস্থায় আমরা তাদের এই অসতর্কতার সুযোগ নিয়ে সকাল ৮ টার দিকে তাদের উপর পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ি প্রচন্ড আক্রমন চালাই।

সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি পশ্চিম দিক থেকে শালদা নদী গুদামঘরের পরিখায় অবস্থানরত শত্রুদের উপর এবং নায়েব সুবেদার রিয়াজ পূর্বদিকের পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান থেকে নদীর অপর দিকের পরিখাগুলোতে আর আর এর সাহায্যে শত্রুদের চারটি পরিখা ধ্বংস করে দেয়। এতে আমাদের যথেষ্ট সুবিধা হয় এবং পাকসেনারা সম্মুখবর্তী পরিখা ছেড়ে পিছু হটে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার বেলায়েত তাঁর সৈন্যদের নিয়ে নদীতে ঝাঁপিয়ে পরে এবং সাঁতরিয়ে অপর তীরে শত্রুদের সম্মুখবর্তী পরিত্যক্ত পরিখাগুলো দখল করে নেয় এবং কিছু সৈনিক সেইসব পরিখাতে রেখে সামনের দিকে আরো অগ্রসর হয়। অগ্রসর হওয়ার পথে সুবেদার বেলায়েত শত্রুসেনা কর্তৃক অতর্কিত আক্রান্ত হয়। নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে সুবেদার বেলায়েত বীরবিক্রমে সম্মুখভাগের শত্রু পরিখার ওপর গ্রেনেড চার্জ করে আরো কয়েকটি শত্রু বাঙ্কার ধ্বংস করে এবং শত্রু সৈন্য নিহত করে। সুবেদার বেলায়েত ও তার দলের প্রচন্ড আক্রমনে শালদা নদী তীরবর্তী এলাকা সম্পূর্ণ রূপে শত্রুমুক্ত হয়ে যায়। ফলে শালদা নদী রেলস্টেশনে অবস্থানরত পাকসেনাদের সঙ্গে শালদা নদী গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনাদের যোগাযগ সম্পূর্ণ রূপে বিছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পরে। পাকসেনারা আমাদের ওপর কামান কিংবা মর্টারের গোলা নিক্ষেপ করার সুযোগ পাচ্ছিল না। কেননা আমাদের সৈনিক তাদের দু দলের মধ্যবর্তী স্থানে পৌঁছে যাওয়ায় তাদের গোলাবর্ষণে নিজেদের ই ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনারা বুঝতে পারে যে, তারা দু দিক থেকে সাঁড়াশি আক্রনের স্বীকার হয়ে মূল ঘাঁটি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পরেছে এবং তাদের পক্ষে এই আক্রমনের মুখে বেশীক্ষন টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই সময় পাকসেনাদের একটি ওয়ারলেস মেসেজ আমাদের কাছে ধরা পরে। এতে তারা কর্তৃপক্ষকে জানায় যে মুক্তিবাহিনীর একটি ব্যাটেলিয়ন তাদের উপর প্রচন্ড আক্রমন চালাচ্ছ। তাদের পক্ষে এই ঘাঁটিতে বেশিক্ষন টিকে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। এই ম্যাসেজ পাওয়ার পর পাকসেনাদের দুর্বলতা সম্পূর্ণ ভাবে বুঝতে পারি। তাদের মনোবল যে একেবারেই ভেঙ্গে পরেছে তা বেশ বোঝা যায়। সঙ্গে সঙ্গে সুবেদার মঙ্গল মিয়াকে তার আক্রমণ আরো জোরদার করার নির্দেশ দেই। এই প্রচন্ড আক্রমনে টিকতে না পেরে গুদামঘরে অবস্থানরত পাকসেনারা নয়নপুর রেলস্টেশনের দিকে পালাতে থাকে। সুবেদার মঙ্গল মিয়ার দলটি গুদামঘর এলাকা দখল করে নেয়। আরো কিছুক্ষন যুদ্ধ চলার পর সুবেদার বেলায়েত এবং নায়েব সুবেদার সিরাজের প্রচন্ড আক্রমনে শালদা নদী রেলস্টেশনে অবস্থানকারী পাকসেনারাও রেললাইন ধরে নয়নপুরের দিকে পালাতে থাকে। আমাদের সৈনিকরা পলায়নপর পাকসেনাদের উপর গুলি চালিয়ে অনেককে হতাহত করে। দুপুর নাগাদ সমস্ত শালদা নদী এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং আমাদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রনাধিনে আসে। পাকসেনারা যাতে আবার এই এলাকাটি দখল করে নিতে না পারে সেজন্য আমাদের অবস্থানটিকে শক্তিশালী করে তোলা হয়। পাকসেনারা নয়াপুর রেলস্টেশনের ঘাঁটি থেকে বেশ কয়েকবার এই অবস্থানের ওপর মর্টার ও কামানের আক্রমণ চালায় এবং এই অবস্থান টি পুনর্দখলের জন্য শালদী নদী গুদামঘরের দক্ষিনে কিচুসংখ্যক সৈন্য সমাবেশ করে। এই খবর পেয়ে সুবেদার বেলায়েত একটি দল নিয়ে পাকসেনাদের আক্রমণ কে প্রতিহত করার জন্য গুদামঘর এলাকায় আক্রমন চালায়। পাকসেনাদের আক্রমন প্রতিহত হয় এবং তারা পালিয়ে যা। কিন্তু একজন পাকসেনা আড়াল থেকে সুবেদার বেলায়েত কে লক্ষ্য করে গুঁলি ছোঁড়ে। সুবেদার বেলায়েতের মাথায় গুলি বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে চিকিতসার জন্য ২ নং সেক্টরে মুক্তিবাহিনী হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই সে শাহাদাৎ বরণ করে। তার মত বীর সৈনিকের শহীদ হওয়াতে আমরা সবাই মর্মাহত হয়ে পরি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা বাংলাদেশ একজন মহান বীরকে হারালো। সুবেদার বেলায়েতের কীর্তি ও বিক্রমের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

শালদা নদী এলাকা দখল করা একটি দুঃসাহসী পরিকল্পনা ছিল। এই পরিকল্পনা অত্যন্ত অপ্রচলিত কৌশলের একটি বিরাট সাফল্য। এর ফলে কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মনবাড়িয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত হয়। বাংলাদেশ সরকার ক্যাপ্টেন গাফফার এবং শহীদ বেলায়েতকে কৃতিত্বপূর্ণ লড়াইয়ের জন্য বীরউত্তম উপাধিতে ভূষিত করেন। এই যুদ্ধে প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। এগুলার মধ্যে ২১ টা রাইফেল ৫ টা এল এম জি ৩ টা এম জি এই ৩ মেশিনগান ৩১ টা হাল্কা মেশিনগান ম্যাগাজিন ৪ টা রকেট লঞ্চার ১ টা এস এম জি ১ টা ওয়ারলেস সেট ২০২৫০ টি গুলি ২০০ টি ২” মর্টার বোমা ৩ টা টিলিফোন সেট ১ টা জেনারেল ২ টা এম জি ব্যারেল অনেক রেশন কাপড় চোপড় ম্যাপ ও বিভিন্ন ধরনের নথিপত্র আমাদের দখলে আসে। এই সব দলিলপত্র থেকে জানা যায় ৩০ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বি কোম্পানি ও ডি কোম্পানি পাকিস্তানীদের প্রতিরক্ষাব্যুহ নিয়োজিত ছিল। এই সংঘর্ষে প্রায় ৮০ / ৯০ জন পাকসেনা হতাহত হয় এবং ১২ জন পাকসেনা আমাদের হাতে জীবন্ত ধরা পরে। ভোর ৫ টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত ১৬ ঘন্টা যুদ্ধে আমাদের ২ জন শহীদ ও ৮ জন আহত হয়।

শালদা নদী কমপ্লেক্স আমাদের হস্তগত হওয়ার পর পাকসেনারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এই এলাকা পুনর্দখলের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। পাকসেনারা চান্দলার নিকটে অন্যান্য এলাকা থেকে প্রচুর সৈন্য এনে সমাবেশ ঘটায়। ১৬ ই নভেম্বর রাত ২-১৫ মিনিটে পাকসেনারা প্রায় ২ ব্যাটেলিয়ন সৈন্যশক্তি নিয়ে আমাদের শালদা নদী মন্দভাগ কামালপুর মঙ্গল প্রভৃতি উস্থানের ওপর গোলন্দাজ বাহিনী ও মর্টারের সহায়তায় প্রচন্ড আক্রমন চালা। এই আক্রমন প্রায় ৩ / ৪ ঘন্টা ধরে চলতে থাকে। চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকরা অসীম সাহসিকতার সঙ্গে পাকসেনাদের এই প্রচন্ড আক্রমন কে প্রতিহত করে। সকাল পর্যন্ত যুদ্ধে পাকসেনাদের বিপুলসংখ্যক সেনা হতাহত হয় এবং উপায়ন্তর না দেখে পাকসেনারা আক্রমন পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। এর একদিন পর আমাদের একটি ছোট দল মঙ্গলপুরের নিকট পাক সেনাদের ঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ১৭ জন পাকসেনাকে নিহত ও অনেককে আহত করে। আরেকটি রেইডিং পার্ট কাইয়ুমপুরে পাকসেনাদের অবস্থানের দুটি বাঙ্কার আর আর দিয়ে ধ্বংস করে দিয়ে ১৪ জন পাকসেনাকে নিহত করে। ২০ শে এবং ২১ শে নভেম্বর চতুর্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানী এবং বি কোম্পানী মঙ্গলপুর এবং কায়েমপুরের উপর তাদের চাপ বাড়িয়ে তোলে। ২১ তারিখ সকাল ৯ টার সময় এই দুই কোম্পানী পাক অবস্থানের ওপর অতর্কিত আক্রমন চালায়। এই আক্রমনে ১৬ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৯ জনকে আহত করে। ১০৬ আর আর এর সাহায্যে পাকসেনাদের বেশ কটি বাঙ্কার উড়িয়ে দেয়া হয়। আমাদের সৈনিকরা অনেক অস্ত্র শস্ত্রও দখল করে নেয়। ২৩ শে নভেম্বর পাকসেনারা আমাদের মন্দভাগ অবস্থানটি পুনর্দখলের জন্য আবার তাদের সৈন্য একত্রিত করতে থাকে। দুপুর দুটোর সময় আমাদের একটি কোম্পানী পাকসেনাদের সমাবেশের উপর আক্রমন চালায়। ফলে পাকসেনাদের শালদা নদির নিকটে মনোরা রেলসেতুর নিকটবর্তী আমাদের অবস্থানগুলোর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। মেশিনগান ১০৬ আর আর ও গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় পাকসেনারা অবস্থানের একটি বাঙ্কার ধ্বংস করতে সমর্থ হয়। আমাদের সৈনিকরা পাকসেনাদের আক্রমনকে প্রতিহত করতে সমর্থ হয় এবং তাদের বহু সৈনিক হতাহত হয়। আমাদের একজন সৈনিক শহীদ ও ৪ জন আহত হয়। একটি মেশিনগান গোলন্দাজ বাহিনির গুলিতে নষ্ট হয়ে যায়। ২৩শে নভেম্বর থেকে পাকসেনাদের সঙ্গে বেশ কটি খন্ডযুদ্ধে আমাদের সৈনিকরা শত্রুদের বিতাড়িত করতে সমর্থ হয়। এই এলাকায় শত্রুরা পর্যুদস্ত হয়ে বুড়িচং ও কুমিল্লার দিকে সরে যায়।

কয়েকদিন পর ৪র্থ বেঙ্গল কে শালদা নদী থেকে ফেনীর দিকে আক্রমণ চালানোর জন্য কে ফোরস এর অধীনে বেলুনিয়াতে স্থানান্তর করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কামালের অধীনে কয়েকটি সেক্টর কোম্পানি শালদা নদীতে রেখে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেত্রৃত্বে চতুর্থ বেঙ্গল বেলুনিয়াতে কে ফরস এ যোগাযগ করে। ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট রাজনগরে তাদের পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাসের পর তাদেরকে দু সপ্তাহের জন্য প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করা হয়। ব্যপক প্রশিক্ষনের পর বেলুনিয়াতে পুনরায় তাদেরকে পুরানো প্রতিরক্ষা ঘাঁটিগুলতে পাঠানো হয়। এবং এই সেক্টরে তৎপরতা বাড়ানর নির্দেশ দেয়া হয়। এই সময় ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট কে মেজর জাফর ইমাম নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পুনরায় রনক্ষেত্রে পৌছানোর পর ১০ ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট তাদের তৎপরতা বৃদ্ধি করে। ১৫ ই অক্টবর ১০ম বেঙ্গলের অনন্তপুর প্রতিরক্ষাব্যুহের সামনে পরশুরাম চিতলিয়া প্রভৃতি জায়গায় পাকসেনাদের ঘাঁটিগুলির ওপর ছোট ছোত আক্রমন চালিয়ে ২৪ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৩০ জন কে আহত করে। পাকসেনাদের ৩ টি বাঙ্কারো তারা ধ্বংস করে দেয় ১৮ ই অক্টোবর সকাল ৬ টার সময় পাকসেনাদের একটি প্লাটুন আমাদের ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হবার পথে বেলুনিয়া নদীর পূর্ব তীরে আমাদের সৈনিকদের এম্বুশে পরে। ফলে ১২ জন পাকসেনা নিহত এবং ১৪ জন আহত হয়। ফুলগাজীর নিকট ১০ ম বেঙ্গলের পাইওনিয়ার প্লাটুন ঐ দিন ই রাস্তায় মাইন পুঁতে সকাল ১০ টার সময় পাকসেনাদের একটি ট্রাক ধ্বংস করে দেয়। ৭ জন পাকসেনা নিহত এবং ৩ জন আহত হয়। ২০ শে অক্টোবর আমাদের মর্টার ডিপারমেন্ট সন্ধ্যা ৬ টায় পাকসেনাদের অবস্থানে অনুপ্রবেশ করে চিতলিয়া অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে ১২ জন পাকসেনাকে নিহত এবং ৭ জন কে আহত করে। ২৫ অক্টোবর আমাদের গোলন্দাজ বাহিনী পাকসেনাদের চিতলিয়া ঘাটির ওপর আক্রমন চালায়। ফলে ২ টি গাড়ি ধ্বংস হয়ে যায় এবং ৭ জন পাকসেনা নিহত হয়। ২৬ শে অক্টোবর ভোর ৫ টার সময় ফুলগাজীর নিকট আমাদের একটি প্লাটুন পাকসেনাদের টহলদারী দলকে এম্বুশ করে ৯ জন পাকসেনা নিহত ও ৬ জন কে আহত করে। এই যুদ্ধে আমাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা কুটি মিয়া শহিদ হয়। ঐদিন ই পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল আমাদের ঘাঁটির সামনে এসে মাইন পোঁতার চেষ্টা করে। কিন্তু পাকসেনাদের এই দলটির সঙ্গে আমাদের একটি দলের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে ১২ জন পাকসেনা নিহত ও ৩০ জন আহত হয়। অবশিষ্ট পাকসেনারা আহত ও নিহতদের ফেলে ও অস্ত্র শস্ত্র রেখেই পালিয়ে যায়। ১০ম বেঙ্গলের তৎপরতার কারনে এই এলাকায় পাকসেনাদের বিপুল সমাবেশ ঘটানো হয়। তারা ১০ ম বেঙ্গলকে ধ্বংস করার জন্য প্রস্তুতি নেয়। ২৭ শে অক্টোবর চিতলিয়ার নিকট এক ব্যাটেলিয়নের অধিক শক্তির সমাবেশ ঘটায়। সন্ধ্যা ৬ টার সময় গোলন্দাজ বাহিনীর সয়ায়তায় পাকসেনাদের দুটো কোম্পানী অগ্রসর হয়ে আমাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি নীলক্ষ্মীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা সাহসের সঙ্গে পাকসেনাদের আক্রমনে বাধা দেয়। কিন্তু প্রচন্ড আক্রমণের সামনে টিকতে না পেরে মূল ঘাঁটিতে ফিরে আসে। পাকসেনারা নিলক্ষ্মী অগ্রবর্তী ঘাটিটি দখল করে নেয়। পরদিন সকালে ১০ম বেঙ্গলের তিন কোম্পানী আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় নীলক্ষ্মীর ওপর পালটা আক্রমণ চালায়। সকাল ১০ টা পর্যন্ত তিন ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলে। প্রচন্ড চাপে পাকসেনারা টিকতে না পেরে নিলক্ষ্মী ঘাঁটি পরিত্যাগ করে পিছু হটে যায়। আমাদের সৈনিকরা নিলক্ষ্মী পুনর্দখলের পর প্রতিরক্ষাব্যুহ (মালিবিলদ) ও গাবতলী পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে। পরদিন সন্ধ্যা ৬ টায় আমাদের একটি প্লাটুন দুবলার চাঙ্গের নিকট একটি এম্বুশ পেতে বসে থাকে। পাকসেনাদের একটি দল বেলুনিয়া যাবার পথে সেই এম্বুশ এ পরে। আমাদের প্লাটুনটি পাকসেনাদের আক্রমন চালিয়ে ১৩ জন পাকসেনাকে নিহত করে এবং ২ জন পাকসেনাকে জীবিত বন্দী করে। এছাড়া অনেক অস্ত্র শস্ত্র দখল করে নেয়। নিলক্ষ্মীতে পাকসেনারা পর্যুদস্ত হয়ার পর পুনঃআক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। ২৯ শে অক্টোবর ভোর ৪ টার সময় পাকসেনারা শালদার নয়াপুর এবং ফুলগাজি থেকে আমাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটির উপর কামানের সাহায্যে প্রচন্ড গোলাবর্ষণ শুরু করে। আমাদের কামানগুলিও পাকসেনাদের গোলার প্রত্যুত্তর দেয়। সকালে পাকসেনারা তিন দিক থেকে আমাদের ঘাঁটির উপর আক্রমন চালায়। প্রায় ৫ ঘন্টা যুদ্ধের পর আমাদের পালটা আক্রমণের মুখে পাকসেনাদের আক্রমণ বিপর্যস্ত হয়ে পরে। প্রচন্ড বাধার সামনে টিকতে না পেরে পাকসেনারা পিছন দিকে পালিয়ে যায়। সংঘর্ষে ৪০ জন পাকসেনা হতাহত হয়। অনেক অস্ত্র শস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ হয়।

এই সময় পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা ঘাঁটি চিতলিয়া পরশুরাম ও বেলুনিয়া থানার নিকট ছিল। এসব ঘাঁটিগুলতে রেলওয়ে ত্রলির সাহায্যে পাকসেনারা ফেনী থেকে রসদ যোগাত। ৫ ই নভেম্বর রাতে আমাদের একটি রেইডিং পার্টি চিতলিয়ার দক্ষিনে রেলোয়ে লাইনের উপর এম্বুশ পাতে। ৬ ই নভেম্বর সকাল ৭ টায় পাকসেনাদের একটি ট্রলি আমাদের হেডিং পার্টির এম্বুশ এর আওতায় এসে যায়। ট্রলিটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দেয়া হয় এবং পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ চারজন সৈনিক নিহত হয়। আমাদের রেইডিং পার্টি একটি হালকা মেশিনগান একটি রাইফেল একটি স্টেনগান একটি ব্লেন্ডিসাইড ২০০০ রাউন্ড গুলি ও ১০ টি ব্লেনডিসাইড গোলা হস্তগত করে। ১০ম বেঙ্গল পাকসেনাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করার পর বেলুনিয়া থেকে পাকসেনাদের সম্পূর্ণ রূপে বিতাড়িত করার জন্য পালটা আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে পরশুরাম ও চিতলিয়ার মাঝে পাকসেনাদের সরবরাহ লাইনের সড়কটি বিচ্ছিন্ন করার প্রস্তুতি নেয়। ৬ ই নভেম্বর ১০ম বেঙ্গলের একটি কোম্পানী গোলন্দাজ বাহিনী ও মর্টারের সহায়তায় চিতলিয়ার উত্তরাংশে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। প্রায় ৪ ঘন্টা যুদ্ধের যুদ্ধের পর ১০ম বেঙ্গলের কোম্পানী টি চিতলিয়ার উত্তরাংশ দখল করে নিয়ে সালিয়া এবং ধানীকুন্ডার মাঝখানে রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে পরশুরাম ও ফেনীর মধ্যে যোগাযগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দিতে সমর্থ হয়। এর ফলে বেলুনিয়ার উত্তরাংশের পাকসেনারা অবরুদ্ধ হয়ে পরে। একজন অফিসার সহ ১২ জন পাকসেনা যুদ্ধে নিহত এবং ৫ জন বন্দী হয়। অফিসারের পকেট থেকে প্রাপ্ত এম ও ফর্ম থেকে জানা যায় ১৫ তম বেলুচ জজিমেন্তের ক্যাপ্তেন এবং বেলুনিয়াতে সে সময় ১৫ তম বেলুচ রেজিমেন্ত আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই সংঘর্ষে আমাদের মর্টার প্লাটুন কমান্ডার হাবিলদার ইয়ার আহমদ শহীদ হয় এবং আরো ৫ জন আহত হয়। পাকসেনাদের মনোবল সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পরে। পাকসেনারা চিতলিয়ার দক্ষিনে পশ্চাদপসরন করে। বিপুল অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। আমাদের চিতলিয়ার অবস্থানটি পুনর্দখলের জন্য পাকসেনারা ভোর ৫ টায় দু কোম্পানী সৈন্য নিয়ে প্রচন্ড আক্রমন চালায়। আমাদের কোম্পানীটি গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় অসীম সাহসের সঙ্গে এই আক্রমনের মোকাবিলা করে। আপ্রান চেষটাসত্বেও আমাদের সৈনিকদের গুলির সামনে এবং গোলন্দাজ বাহিনীর গোলার মুখে পাকসেনাদের এই আক্রমণ টি ব্যর্থ হয়ে যায়। ৩৫ জন পাকসেনা নিহত হয় এবং অনেক আহত হয়। কয়েকটি হালকা মেশিন গান সহ অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। পাকসেনারা ছত্রভংগ হয়ে পিছু হটে যায়।

১০ম বেঙ্গল উত্তর চিতলিয়া দখলের পর তাদের তৎপরতা অব্যাহত রাখে। ৯ ই নভেম্বর রাত সারে ১১ টার সময় আমাদের একটি পেট্রোল পার্টি ৫ জন পাকসেনাকে বন্দী করে এবং একটি মেশিনগান ও ৪ টি চায়না রাইফেল দখল করে দেয়। ১০ম বেঙ্গলের দুটি কোম্পানী ৯ ই নভেম্বর রাত সাড়ে ১১ টার সময় পরশুরাম ও বেলনিয়া শত্রুঘাঁটির উপর অতর্কিত আক্রমন চালায়। আক্রমনে অনেক পাকসৈন্য নিহত হয় এবং বহু অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। চার ঘন্টা যুদ্ধের পর এই দুই ঘাঁটি আমাদের সৈনিকরা দখল করে নেয়। পাকসেনারা পরদিন আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের উপর জঙ্গী বিমানের আক্রমণ চালায়। আমাদের সৈনিকরা ভারী মেশিনগানের সাহায্যে বিমান আক্রমনের পালটা জবাব দেয়। শত্রুদের একটি জঙ্গী বিমান আমাদের মেশিনগানের গুলিতে বিদ্ধ হয়ে শালিয়ার নিকট ভূপতিত হয়। বিমান আক্রমনে আমাদের দুজন সৈনিক শহীদ ও ৫ জন আহত হয়। এর পর দিন ১০ম বেঙ্গল আর দুটি কোম্পানী সকাল ১০ টায় চিতলিয়ার উপর গোলন্দাজ বাহিনির সহায়তায় আক্রমন চালায়। ৩ ঘন্টা যুদ্ধের পর আমাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলা এবং মর্টারের গুলিতে শত্রুপক্ষের ব্যপক ক্ষতি হয় এবং চিতলিয়া রেল স্টেশন ধ্বংস হয়ে যায়। এখানে পাকসেনাদের অনেকে হতাহত হয়। আমাদের ৫ জন শহীদ ও ১৩ জন আহত হয়। শেষ পর্যন্ত চিতলিয়া আমাদের দখলে আসে। আমাদের সৈনিকরা শত শত অস্ত্র শস্ত্র অয়ারলেস সেট পোশাক রেশন প্রভৃতি দখল করে নেয়। ৪ দিনের যুদ্ধে ৫৭ জন পাকসেনা ও ১৫ জন ই পি সি এ এফ আমাদের হাতে বন্দী হয় এবং আরো অনেক হতাহত হয়। পাকসেনারা চিতলিয়া থেকে পালিয়ে মুন্সিরহাটের দক্ষিনে এবং পাঠাননগরের কাছে তাদের রক্ষাব্যুহ পুনরায় স্থাপন করে। তাদের মূল ঘাঁটি ফেনিতে পিছিয়ে নেয়। এই সময় ক ফোরস হেডকোয়ার্টার থেকে পুনঃআক্রমনের নির্দেশ আসে। এই নির্দেশ অনুযায়ী কে ফোরস হেডকোয়ার্টার কোনাবন অবস্থান থেকে দক্ষিন বেলুনিয়াতে স্থানান্তরিত হয় এবং বেলুনিয়া সেক্টরে চতুর্থ বেঙ্গল কেও এই যুদ্ধে নিয়োজিত করা হয়। নতুন নির্দেশ অনুযায়ী কে ফোরস অতি সত্বর ফেনী মুক্ত করার আদেশ দেয়া হয়। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী চতুর্থ বেঙ্গল ফেনীর দিকে অগ্রসর হয়। চতুর্থ বেঙ্গল উত্তর দিক থেকে ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ফেনির দিকে অগ্রসর হয়। ১০ম বেঙ্গল লক্ষ্মীপুর হয়ে ছাগলনাইয়ার দিকে অগ্রসর হয়। কে ফোরস এর দুই ব্যটেলিয়নের প্রচন্ড চাপে পাকসেনারা টিকতে না পেরে তাদের অগ্রবর্তী ঘাঁটি পাঠাননগর ও দক্ষিন মুন্সিরহাট ছেড়ে পেছন দিকে পালিয়ে যায়। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকে কে ফোরস ছাগলনাইয়া ও ফেনীর উপকন্ঠে পাকসেনাদের উত্তর পশ্চিম দিকে সম্পূর্ণ ভাবে ঘিরে ফেলে এবং পাকসেনাদের অবস্থানগুলোর উপায় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্যে প্রচন্ড আক্রমন চালায় এই প্রচন্ড চাপে পাকসেনারা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। আমাদের আক্রমনের চাপ আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়। উপায়ন্তর না দেখে ৬ ই ডিসেম্বর পাকসেনারা তাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে শুভপুর সেতু হয়ে চট্টগ্রামের দিকে পালিয়ে যায়। ৬ ই ডিসেম্বর দুপুরে কে ফোরস ফেনীকে শত্রুমুক্ত করে। ফেনীতে পাকসেনাদের অজস্র গোলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয়। শত্রুরা পালাবার সময় ভুভপুর সড়ক ও রেলসেতু উড়িয়ে দেয়। যার ফলে পাকসেনাদের পিছু ধাওয়া করা কে ফোরসের পক্ষে অসুবিধা হয়ে পরে এবং তাদের অগ্রাভিযান বাধা প্রাপ্ত হয়। শুভপুর সেতু মেরামতের জন্য দুদিন সময় লেগে যায়। মিত্র বাহিনীর প্রকৌশলীরা একটি সেতু পুনঃনিরমান করে এবং এরপর সেতু ও নৌকার সাহায্যে চট্টগ্রামের দিকে কে ফোরস এর অগ্রাভিযান পুনরায় শুরু হয়। এই সময় আমি আহত হবার ফলে কে ফরস এর নেতৃত্ব মেজর সালেকের উপর ন্যাস্ত ছিল। কে ফোরস ফেনী থেকে করেরহাট পর্যন্ত পাকসেনাদের ছোটখাট রক্ষাব্যুহ দখল করে তাদের অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখে এবং করেরহাট পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকা শুরু করে। করেরহাট থেকে চট্টগ্রাম অগ্রসর হওয়ার জন্য নতুন একটি পরিকল্পনা নেয়া হয়। এই পরিকল্পনা অনুসারে চতুর্থ ও মুজিব ব্যাটারীকে (বাংলাদেশ প্রথম গোলন্দাজ বাহিনী) নিয়ে হিয়াকু ফটিকছড়ি নাজিরহাট হয়ে চট্টগ্রামের উত্তর পশ্চিম শত্রুবাহিনির উপর আক্রমন চালাবে এবং ১০ম বেঙ্গল ফেনী চট্টগ্রামের প্রধান সড়কে সীতাকুন্ড হয়ে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হবে। এই দ্বিমুখী অগ্রাভিযান চট্টগ্রামের উপকন্ঠে পৌছে চট্টগ্রাম শহরের উপর সাঁড়াশি আক্রমন চালাবে। পরিকল্পনা মত চতুর্থ বেঙ্গল মুজিব ব্যাটারি সহ হিয়াকুর দিকে ৭ ই ডিসেম্বর রাত ১২ টায় অগ্রসর হয়। পরদিন সকাল ৬ টায় হিয়াকু বাজারের নিকট পৌছার পর পাকসেনাদের একটি অগ্রবর্তী ঘাঁটির সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। পাকসেনাদের এই ঘাঁটিতে প্রায় ৪০ / ৫০ জন সৈনিক ছিল। তারা আমাদের বাধা দেয় কিন্তু আমাদের সৈনিক এবং গোলন্দাজ বাহিনীর আক্রমনে টিকতে না পেরে পাকসেনারা ফটিকছরির দিকে পালিয়ে যায়। ফলে হিয়াকু বাজার আমরা অতি সহজেই শত্রুমুক্ত করে নিজেদের দখলে আনি। হিয়াকু থেকে চট্টগ্রামের দিকে একটি কাঁচা রাস্তা গেছে। রাস্তাটি খুব ই খারাপ। সেই রাস্তা হয়ে পায়ে হেঁটে আমাদেরকে অগ্রসর হতেহয়। অগ্রসরের পথে নারায়ণহাটের নিকট পাকসেনাদের আরেকটি অবস্থানের সঙ্গে চতুর্থ বেঙ্গলের সংঘর্ষ হয়। পাকসেনাদের এ অবস্থানটিও আমাদের আক্রমনের চাপে টিকতে না পেরে ফটিকছড়ির দিকে পিছু হটে যায়। যাওয়ার সময় এটি কাঠের সেতু ধ্বংস করে দেয়। চতুর্থ বেঙ্গল ওই দিন রাতে নারায়নহাটে বিশ্রাম নেয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত সেতুটি মেরামত করার পর আমাদের অগ্রযাত্রা পুনরায় শুরু হয়। পথে কাজীরহাটে পাকসেনারা আমাদের অগ্রাভিযানে বাধা দেয়ার জন্য পথে অনেক মাইন পুঁতে রাখে। এই মাইন গুলোকে সরিয়ে রাস্তা পরিস্কার করে আমাদের অগ্রসর হতে হয়। ১০ ই ডিসেম্বর ফটিকছরির উপকন্ঠে চতুর্থ বেঙ্গলের অগ্রাভিযান কে পাকিস্তানের ২৪ তম ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্ট বাধা দেয়। ফটিকছড়িতে পাকিস্তানীদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। সেজন্য চতুর্থ বেঙ্গলের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন গাফফার পাকসেনাদের ঘাঁটিটি সম্বন্ধে পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর চতুর্থ বেঙ্গল কে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। একটি দল ফটিকছড়ির সন্নিকটে পাহারের দিকে রাস্তায় অগ্রসর হয় এবং প্রধান দলটি কাজীরহাট ফটিকছড়ি রাস্তার দিকে অগ্রসর হয়। ১১ ই ডিসেম্বর ৪ – ৩০ টায় এই দুটি দল সম্মিলিতভাবে দুদি্ক থেকে পাক অবস্থানের উপর আক্রমন চালায়। এই আক্রমনে তিকতে না পেরে রাত ১২ টার পর পাকসেনারা সমস্ত অস্ত্র শস্ত্র গোলাবারুদ বিছানাপত্র ফেলে পিছনের দিকে পালিয়ে যায় ফলে ফটিকছড়ি শ্ত্রুমুক্ত হয়। এই যুদ্ধে আমাদের দুজন শহীদ হয়। অপরদিকে শত্রুপক্ষের ৩০ / ৪০ জন হতাহত হয়। এই সময় খবর আসে যে পাকসেনাদের একটি শক্তিশালী দল তাদের রামগড় অবস্থান পরিত্যাগ করে মানিকছড়ির পথে ফটিকছড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এই সংবাদ পেয়ে চতুর্থ বেঙ্গল থেকে দুটি প্লাটুন এবং মর্টার প্লাটুন এই দলটিকে বাধা দেবার জন্য মানিকছড়ির রাস্তায় পাঠানো হয়। আমাদের প্লাটুনগুলো পাকসেনাদের মানিকছরির রাস্তায় সাফল্যের সঙ্গে এম্বুশ করতে সমর্থ হয়। পাকসেনারা অতর্কিত আক্রান্ত হয়ে নাজিরহাটের দিকে পালিয়ে যায়। ১২ ই ডিসেম্বর ভোরে ফটিকছড়ি থেকে চতুর্থ বেঙ্গল চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হয়। ২ / ৩ ঘন্টা পর প্রায় ৯ / ১০ তার সময় নাজিরহাট নদির পাড় থেকে পাকসেনারা আমাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে আমাদের অগ্রযাত্রায় বাধা দেয়। ক্যাপ্টেন গাফফার নদীর নিকটস্থ একটি দোতলা বাড়ি থেকে পাকসেনাদের অবস্থানের তথ্য সংগ্রহ করে। কবরাখবর নিয়ে বোঝা যায় যে পাকিস্তানের ২৪ তম ফ্রন্টিয়ার ফোরস তাদের প্রায় তিনটি কোম্পানী ও বেশ কিছু সংখ্যক ইপিসিএ এফ সহ নাজিরহাট নদীর তীর বরাবর একটি শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে আছি। ১৩ ই ডিসেম্বর পাকসেনাদের সম্বন্ধে আরো তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং তার পর ই পাক অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করা হয়। কিন্তু শত্রুদের অবস্থান এত শক্তিশালী ছিল যে চার ঘন্টা ধরে যুদ্ধ চালানোর পরো পাকসেনারা আমাদের আক্রমন কে প্রতিহত করে। সুতরাং এভাবে আক্রমন চালিয়ে কোন লাভ নেই মনে করে অন্য পন্থা অবলম্বনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এবং সেজন্য আমাদের সৈন্যদের কে কিছুটা পিছিয়ে নেয়া হয়। এই সময় একজন পাকসেনা আমাদের হাতে জীবিত ধরা পরে। জীবিত সেই পাকসেনার কাছ থেকে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ সম্বন্ধে আরো সঠিক খবর জানা যায়। সেখানে জানা যায় ২৪ তম ফ্রন্টিয়ার এর মেজর আশেক এই প্রতিরক্ষাব্যুহের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এই প্রতিরক্ষাব্যুহের সশক্তি প্রায় এক ব্যাটেলিয়নের মত। নদী বরাবর ব্যাটেলিয়ন টি অসংখ্য বাঙ্কার তৈরী করে তাদের প্রতিরক্ষাব্যুহ সুদৃঢ় করেছে। কিন্তু এদের নজ ফটিকছড়ির দিকে বেশি থাকাতে পশ্চিম ভাগ বেশী শক্তিশালি নয়। অতি অল্পসংক্যক সৈন্য দিয়ে পশ্চিমের চা বাগানের দিকে রক্ষাব্যুহ রচনা করা হয়েছে এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়ে পশ্চিমের চা বাগানের দিক থেকে পাকসেনাদের উপর আক্রমণের পইকল্পনা নেয়া হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী লেঃ শওকতের নেতৃত্বে গণবাহিনীর একটি কোম্পানী চারঘন্টা আগে নাজিরহাট ও চট্টগ্রামের রেলপথের মাঝে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমন চালায়। এ আক্রমনে তারা এত হতভম্ব হয়ে পরেছিল যে আমাদের আক্রমনে বাধা পর্যন্ত দিতে পারেনি এবং শত্রুরা ঘুম থেকে উঠেই দেখতে পায় আমরা তাদেরকে পিছন দিক থেকে আক্রমণ চালিয়েছি। উপায়ন্তর না দেখে সবকিছু ফেলে তারা চট্টগ্রামের দিকে পালাতে থাকে। পালাবার পথে আমাদের মর্টারের এওং মেশিনগানের গুলিতে অনেক পাকসেনা হতাহত হয়। প্রায় ৪০ জন হতাহত পাকসেনাকে আমরা যুদ্ধক্ষেত্রে পাই। ৮ জন পাকসেনা বন্দী হয় , ৪৯ জন ইপিসিএ এফ অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করে। প্রচুর গোলাবারুদ ও অন্যান্য জিনিসপত্র আমাদের হস্তগত হয়। রেশন বোঝাই কয়েকটি ট্রাকও আমাদের দখলে আসে। পালাবার সময় পূর্ব থেকে লেঃশওকতের গণ বাহিনির কোম্পানীও পাকসেনাদের উপর আক্রমন চালায় এবং অনেককে হতাহত করে। পাকসেনারা রাস্তা ছেড়ে গ্রামের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। ১৪ ডিসেম্বর নাজিরহাট সম্পূর্ণ রূপে শত্রুমুক্ত হয়। আমাদের একজন শহীদ ও এক জন সৈনিক আহত হয়। পাকসেনারা নাজিরহাট সড়ক সেতু আগে থেকেই ধ্বংস করে দিয়েছিল। সেজন্য নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রযাত্রা একদিন দেরী হয়ে যায়। নাজিরহাটের স্থানীয় জনগনের সাহায্যে আংশিক পুনঃ নির্মাণ করা সম্ভব হয় এবং ১৫ ডিসেম্বর নাজিরহাট থেকে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রাভিযান পুনরায় শুরু হয়। সকালে হাটহাজারি পৌছার পর ১০ম বেঙ্গলের সাথে যোগাযোগ হয়। ১০ম বেঙ্গল মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে সীতাকুন্ড হয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগিয়ে আসছিল। হাটহাজারিতে যোগাযগের পর কে ফরস এর ১০ম বেঙ্গল ও চতুর্থ বেঙ্গল সম্মিলিতভাবে অগ্রসর হয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শ্ত্রুমুক্ত করে। ১৬ ই ডিসেম্বর সকালে এই সম্মিলিত বাহিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অগ্রসর হয়ে চট্টগ্রাম শহর আক্রমণের প্রস্তুতি নেয়। এই সময় বাংলাদেশ ফোরসেস হেডকোয়ার্টার আক্রমন স্থগিত রাখার নির্দেশ পাঠায়। আরো খবর আসে যে পাকসেনারা ওই দিন আত্মসমর্পণ করবে। ১৬ ই ডিসেম্বর ৪- ৩০ মিনিটে পাকসেনাদের এক ডিভিশন সৈন্য কে ফোরস এর কিট অস্ত্রশস্ত্র সহ আত্মসমর্পণ করে। পাকসেনাদের কে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ চট্টগ্রাম সেনানিবাস নৌঘাঁটি ট্রানজিট ক্যাম্প প্রভৃতি জায়গায় বন্দী করে রাখা হয়। সমস্ত চট্টগ্রাম কে ফোরস এর নিয়ন্ত্রণে আসে। সতঃস্ফুরত জনগণ বিজয়মাল্যে ভূষিত করে আমাদের বিজয়ী বীর সৈনিকদের নিয়ে বিজয় উল্লাসে শহর প্রদক্ষিণ করে।

১১ ই এবং ১২ ই নভেম্বর ৯ম বেঙ্গলের “এ” কম্পানি ও “বি” কোম্পানী কৃষ্ণপুর ও বগাবাড়ি অবস্থান থেকে পাকসেনাদের অবস্থানের উপর আক্রমন চালিয়ে তাদেরকে কুমিল্লার দিকে আরো পিছু হটিয়ে দেয়। দুদিনের যুদ্ধে পাকসেনাদের ১৪ জন নিহত ও ৭ জন আহত হয়। আমাদের পক্ষে ২ জন শহিদ ও একজন আহত হয়। এই সময় চতুর্থ বেঙ্গল শালদা নদীর দিক থেকে পাকসেনাদের উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছিল। এই দুই ব্যাটেলিয়নের আক্রমণে পাকসেনারা পরাস্ত হয়ে শালদা নদী কসরা মন্দভাগ প্রভৃতি এলাকা সম্পূর্ণভাবে পরিত্যাগ করে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে কুমিল্লাতে আশ্রয় নেয়। ডিসেম্বর মাসের ১ লা তারিখ কুমিল্লার উত্তর এলাকা সম্পূর্ণ রূপে শত্রু মুক্ত হওয়ার পর চারটি সেক্টর কোম্পানীকে এই এলাকা মোতায়েন রেখে ৯ ম বেঙ্গল কে কুমিল্লার দক্ষিন পূর্বে মিয়ারবাজার এলাকায় সমাবেশ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। ডিসেম্বর মাসের ২ তারিখ ৯ ম বেঙ্গল মেজর আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে মিয়ারবাজারের দিকে অগ্রসর হয়। এই মিয়াবাজারে ক্যাপ্টেন মাহবুবের ছয়টি সেক্টর কোম্পানীও তাঁর সঙ্গে যোগ দেয়। ৩ রা ডিসেম্বর সকালে এই সম্মিলিত বাহিনী মিত্র বাহিনীর কামানের সহায়তায় মিয়াবাজারে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষাব্যুহের উপর প্রচন্ড আক্রমন চালায়। পাকসেনারা এ আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে কুমিল্লার দিকে পিছু হটে যায়। মিয়াবাজার শত্রুমুক্ত করার পর ৯ম বেঙ্গলের একটি দলকে লাকসামের দিকে অগ্রসর হবার নির্দেশ দিয়ে মেজর আইনউদ্দিন কুমিল্লা আক্রমনের জন্য অগ্রসর হতে থাকে। যাত্রাপথে শত্রুর প্রতিরক্ষাব্যুহ ধ্বংস করে অগ্রাভিযানের গতি অব্যাহত রেখে ৪ ঠা ডিসেম্বরের ভোরে মেজর আইনউদ্দিনের দল কুমিল্লার বিমানবন্দর এলাকা পর্যন্ত পৌঁছতে সমর্থ হয়। কুমিল্লা বিমানবন্দরের নিকট পাকসেনাদের একটি শক্তিশালি ঘাঁটি ছিল। ৯ ম বেঙ্গল মিত্রবাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় এই ঘাঁটিটির উপর প্রচন্ড আক্রমন চালায়। পাকসেনারা এই আক্রমন প্রতিহত করতে না পেরে কুমিল্লা শহরের দিকে পালিয়ে যায়। দুপুর পর্যন্ত সমস্ত কুমিল্লা বন্দর এলাকা শত্রুমুক্ত হয় এবং নবম বেঙ্গলের দুটি কম্পানী কুমিল্লার দক্ষিন ও পূর্ব দিক ( রাজগঞ্জ বাজার) থেকে কুমিল্লা শহরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। ৯ ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকসেনাদের আরো বিতাড়িত করে ময়নামতির পথে রেলওয়ে ক্রসিং এলাকা পর্যন্ত শত্রুমুক্ত করে। ৯ ম বেঙ্গলের আক্রমনের মুখে টিকতে না পেরে কুমিল্লা শহরে অবস্থানরত পাকসেনা ময়নামতি সেনানিবাসের দিকে পালিয়ে যায়। এই সময় হাজার হাজার জনতা আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে পাকসেনাদের পেছনে অগ্রসর হয়। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে , পাকবাহিনির সাথে সম্মুখযুদ্ধে এ জেলা শহর টি সর্বপ্রথম মুক্তি বাহিনী কর্তৃক শত্রুমুক্ত হয়। ১০ ই ডিসেম্বর নবম বেঙ্গল কুমিল্লা শহরের রেলওয়ে ক্রসিং থেকে ময়নামতি ছাওনীর দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই অগ্রাভিযানের সময় মিত্র বাহিনীর ৩ টি ট্যাঙ্ক ৯ ম বেঙ্গলের সহায়তার জন্য মেজর আইনউদ্দিনের কমান্ডের অধিনে দেয়া হয়। রেলওয়ে ক্রসিং থেকে দেড় মাইল পশ্চিমে অগ্রসর হওয়ার পর ৯ ম বেঙ্গলের অগ্রবর্তী দলগুলি টেক্সটাইল মিল এলাকার সামনে পাকসেনাদের গোলাগুলির সম্মুখীন হয়। ৯ম বেঙ্গলের আরেকটি কোম্পানি কোর্ট বাড়ির পথে ময়নামতির দক্ষিন দিক থেকে অগ্রসর হচ্ছিল। এই দলটি মিল এলাকায় পাকসেনাদের গোলাগুলির সম্মুখীন হলেও অগ্রবর্তী দলগুলো পাকসেনাদের অবস্থান গুলো দখল করার চেষ্টা করে। কিন্তু একঘন্টা রেকি করার পর বোঝা যায় পাকসেনাদের অবস্থান গুলো খুব ই শক্তিশালী। অবস্থানগুলোতে মেশিনগান এবং ১০৬ আর আর বাঙ্কারের ভিতর রেখে কুমিল্লা – ময়নামতির রাস্তাকে সুদৃঢ় ভাবে প্রতিরক্ষার প্রস্তুতি নিয়েছে। এই সংবাদ আমাদের অগ্রবর্তী দলগুলো মেজর আইনউদ্দিন কে অবগত করে। মেজর আইনউদ্দিন পাকসেনাদের অবস্থানগুলোর উপর চাপ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দিয়ে আরো সম্মুখবর্তী অবস্থানে পাকসেনাদের সম্বন্ধে বিস্তারিত সংবাদ সংগ্রহ করে। সংবাদ সংগ্রহের পর সম্পূর্ণ ব্যাটালিয়ন দিয়ে মিত্র বাহিনির ট্যাঙ্কের সহায়তায় আক্রমন করার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরদিন ভোরে মিত্র বাহিনীর ট্যাঙ্কগুলোকে সড়কের বা৬ দিক দিয়ে অগ্রসর হবার নির্দেশ দেয়। অপরদিকে ৯ম বেঙ্গল তাদের আক্রমণ আরো জোরদার করে। এ সাঁড়াশি আক্রমনের মুখে পাকসেনারা দারুন ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পরে। ১৫ ই ডিসেম্বর সকালে পাকসেনাদের সর্ব বাম দিকে সাদা পতাকা উড়তে দেখা যায় এবং কিছুক্ষন পর সেই জায়গা থেকে গোলাগুলিও বন্ধ হয়। মেজর আইনউদ্দিন সাদা পতাকা দেখে আক্রমণ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেয় এবং শত্রুসেনাদের উদ্দেশ্যে আত্মসমর্পণের আদেশ দেয়। প্রায় আধা ঘন্টা পর গোলাগুলি স্তিমিত হয়ে এলে উতর দিকের পুকুর পাড়ের উঁচু বাঁধের উপর প্রায় ২৫/ ৩০ জন পাকসেনাকে অস্ত্রশস্ত্র সহ সাদা পতাকা হাতে সামনের দিকে অগ্রসর হতে দেখা যায়। মেজর আইনউদ্দিন তৎক্ষণাৎ সেইসব পাকসেনাদের আরো সামনে আসতে নির্দেশ দেয়। পাকসেনারা নির্দেশ মত মেজর আইনউদ্দিনের কাছে তাদের অস্ত্র শস্ত্র সমর্পণ করে। এই সময় হাজার হাজার স্থানীয় জনসাধারণ পাকসেনাদের ঘেরাও করে তাদেরকে বেঁধে ফেলে। বাকি পাকসেনারা যারা তখনো বাঁধ থেকে সামনের দিকে আসছিল তারা ভয়ে সামনের দিকে না এসে পেছনের দিকে পালাতে থাকে। মেজর আইনউদ্দিন তাদেরকে পুনরায় আত্মসমর্পণ করার আদেশ দেয়া সত্বেও পাকসেনারা নিজেদের বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়। আত্মসমর্পণের আদেশ না মানায় মেজর আইনউদ্দিন ৯ম বেঙ্গল কে পুনরায় আক্রমনের নির্দেশ দেয়। প্রায় ৪০ ঘন্টা আক্রমনের পর শত্রু অবস্থানটি ৯ম বেঙ্গলের হস্তগত হয়। প্রায় ১৫০ জন পাকসেনা আত্মসমর্পণ করে। অবশিষ্ট পাকসেনা ময়নামতি ছাউনিতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। অনেক অস্ত্রশস্ত্র আমাদের হস্তগত হয়। পাকবাহিনীর ৩৯ তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট এই অবস্থান প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত ছিল। অবস্থানটি শত্রুমুক্ত করার পর ৯ম বেঙ্গল ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রসর হয় ময়নামতি সেনানিবাসের উপকন্ঠ পর্যন্ত শত্রুমুক্ত হয়। ৯ ম বেঙ্গল পাকসেনাদের শক্তিশালী প্রতিরক্ষাব্যুহের সম্মুখীন হয়। পাকসেনারা ময়নামতি সেনানিবাসের উচু ভূমির সহায়তায় এই ঘাঁটি টিকে একটি দুর্গে পরিনত করেছিল। চতুর্দিকে পরিখা খনন এবং বাঙ্কার তৈরি করে প্রতিরক্ষাকে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছিল।

৯ ম বেঙ্গল উত্তর ও দক্ষিন দিক থেকে ময়নামতি এলাকা সম্পূর্ণ রূপে ঘিরে ফেলে। কুমিল্লার হাজার হাজার গেরিলা ৯ ম বেঙ্গলের সঙ্গে যোগ দিয়ে পশ্চিম দিকে অবস্থান নিয়ে ময়নামতিকে ঢাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। ১৫ তারিখ বিকেলে অবরোধ সম্পন্ন হয়। এ সময় পাকসেনাদের কে আত্মসমর্পণের আদেশ দেয়া হয়। পাকসেনারা সেই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে তাদের প্রতিরক্ষার কাজে অটল থাকে। ময়নামতি ছাউনীতে চূড়ান্ত আক্রমনের জন্য ৯ম বেঙ্গল গেরিলা ও মিত্র বাহিনী প্রস্তুতি নেয়। ১৬ ই ডিসেম্বর ময়নামতি গ্যারিসন কমান্ডার আত্মসমর্পণের ইচ্ছা প্রকাশ করে সংবাদ পাঠায়। সেই দিন ই বিকেল ৪ টায় ময়নামতি গ্যারিসনে অবস্থানরত পাকসেনারা অন্যান্য জায়গার মত আনুষ্ঠানিকভাবে ৯ম বেঙ্গল এবং মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। আত্মসমর্পণের পর সমস্ত পাকসেনাকে বিভিন্ন জায়গাতে ৯ম বেঙ্গলের তত্বাবধানে স্থানান্তরিত করা হয় এবং তাদের অস্ত্র শস্ত্র বেঙ্গল লাইনে একত্র জমা করে। ৯ম বেঙ্গল আবার জয়ী হয়ে তাদের পুরান বেঙ্গল লাইনে ফিরে এসে বিজয় উল্লাসে ফেটে পরে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ন মাসের পূর্বে এখান থেকে যে চতুর্থ বেঙ্গলের সৈনিকরা স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহন করার জন্য দেশ মাতৃকার প্রতি প্রাণের টানে ঝাঁপিয়ে পরেছিল সেই চতুর্থ বেঙ্গলের ই অধিকাংশ সৈনিক ও নতুন রিক্রুট করা সৈনিকদের নিয়ে যুদ্ধকালীন বিপর্যস্ত সময়ে ৯ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গড়ে উঠেছিল।