আমার পরিচয় পেয়ে নিয়াজী তড়াক করে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো
১২ই ডিসেম্বর। গোরাই গিয়ে অবস্থান নিল ভারতীয় বাহিনী। কাদের সিদ্দিকী তার বাহিনীকে ১২ ও ১৩ই ডিসেম্বর বিশ্রামের নির্দেশ দিলেন। ১৪ ডিসেম্বর তিনি টাঙ্গাইলে জনসভা করলেন। সেই জনসভায় বললেন, এই বোধ হয় শেষ দেখা। আর দেখা নাও হতে পারে। এই যে আপনাদের সাথে মিলিত হতে পারলাম এটাই আমার শান্তি। কাদের সিদ্দিকী আমাকে এ প্রসঙ্গে বললেন, ঢাকা যে এত সকালে মুক্ত হবে তখনো তা ভাবিনি। আমি মনে করেছিলাম অন্তত আরো একমাস যুদ্ধ হবে। কাদের সিদ্দিকী ঢাকা অভিযানের জন্য নিজের বাহিনী থেকে আড়াই হাজার যোদ্ধা বাছাই করলেন। শুরু হলো ঢাকা অভিমুখে অভিযান। স্থির হপ্লো দুটি পথে সম্মিলিত বাহিনী ঢাকার দিকে এগিয়ে যাবে-
১। সাভার হয়ে এবং
২। টঙ্গী হয়ে।
১৫ই ডিসেম্বর সকালে পাক বাহিনী সম্মিলিত বাহিনীর অগ্রাভিযান রোধ করার জন্য কড্ডার সেতু ভেঙ্গে দেয়। এসব ঘটনার কথা বলছিলেন কাদের সিদ্দিকী, “সকালে ওরা ব্রিজ উড়িয়ে দিল। সম্মিলিত বাহিনীতে ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কেয়া সিদ্দিকী! কেয়া হো গেয়া! আমি বললাম, কি আর হবে। পাক বাহিনী ব্রিজ ভেঙ্গে দিল। পাকবাহিনীর কাণ্ড দেখে আমার তখন খুব হাসি পাচ্ছিল। ভাবছিলাম, পাক মিলিটারি তোদের রোধ করার জন্য ব্রিজ ভেঙ্গে ফেলি। মেজর জেনারেল নাগরাকে বললাম, আজ আভি অর নেহী যায়েগা। জেনারেল নাগরা বললেন, কিউ সিদ্দিকী কিউ? আমি বললাম, হাম প্লান বানায়েঙ্গে। রাতের বেলা পরিকল্পনা তৈরি করলাম। একদল ডানদিকে আর একদল বাম দিকে রাতের আবছায়ায় নদী পার হলো স্থানীয় লোকজনদের সহায়তায়। আমাদের ১০০ জন করে মুক্তিযোদ্ধা এবং ভারতীয় বাহিনীর একটি করে ব্যাটালিয়ান। পাক বাহিনী তখনো নিশ্চিন্তে রয়েছে। ভেবেছে, আমরা তো নদী পার হতে পারবোই না। আল্লাহর কি রহমত, সম্মিলিত বাহিনী নদী পার হয়েই শত্রুদের দুজনকে মেরে ফেলল। ব্রিজ ভেঙ্গে যারা খেতে বসেছিল তাদের পাকড়াও করলো।”
১৫ই ডিসেম্বর সকালে সম্মিলিত বাহিনীর আরেকটি দল এগিয়ে গিয়েছিল সভারের পথে। এখন যেখানে রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্প সেখানে যুদ্ধ হয়। তারপর আর কোন যুদ্ধ হয়নি। এই বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর সকালে মিরপুর থেকে সাভার অভিমুখী সড়ক সেখানে প্রস্থে দ্বিগুণ হয়ে অর্থাৎ ডবল রোড হিসেবে শুরু হয়েছে সেখানে এসে অবস্থান নিল। আর এদিকে টঙ্গী অভিমূখী বাহিনী ১৬ই ডিসেম্বর বোর্ড বাজারে এসে পৌঁছালো।
১৬ই ডিসেম্বর সকালে মেজর জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী একটি হেলিকপ্টারে এসে সাভারগামী সড়কে মিরপুর ব্রিজের পরবর্তী ব্রিজের কাছে নামলেন। সঙ্গে রয়েছেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। বলছিলেন কাদের সিদ্দিকীঃ ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার টঙ্গী অভিমুখে এগিয়ে যাওয়া বাহিনীর অধিনায়কত্ব করছিলেন। সাভারগামী বাহিনীর অধিনায়কত্ব করছিলেন ব্রিগেডিয়ার সানত সিং। হেলিকপ্টার থেকে নেমে মেজর জেনারেল নাগরা জেনারেল নিয়াজীর কাছে একটি চিঠি লিখলেন। তাতে তিনি নিয়াজীকে লিখলেন, আমি অমুক জায়গায় রয়েছি। তুমি আত্মসমর্পন করবে কিনা জানাও এবং উত্তর দাও। ভারতীয় বাহিনীর একজন মেজরকে বাহক করে চিঠি পাঠানো হলো। তার সাথে রয়েছে ভারতীয় বাহিনীর তিনজন জওয়ান ও পথ চেনাবার জন্য একজন মুক্তিযোদ্ধা। দু’টি জীপ তাদের নিয়ে চলে গেলো। জীপের সম্মুখে সাদা পতাকা। সঙ্গে কোন অস্ত্র নেই। নিয়াজী চিঠি পেয়ে জানাল যে, সে আত্মসমর্পন করতে প্রস্তুত। কিন্তু কোন লিখিত ভাষ্য সে দিল না। পাকবাহিনীর মেজর জেনারেল জামশেদকে পাঠিয়ে দিল। জামশেদ এসে মেজর জেনারেল নাগারাকে স্যালুট করলো। তখন নাগারা বললেন, ‘শুনো সিদ্দিকী, হামকো স্যালুট করেগা তো হাম লেগা আউর তুম লেগা। হামলোগ দো এক সাথ আয়া হ্যায়।’ জামশেদ এসে তার নিজের রিভলভার ও মাথার ফৌজি টুপি তুলে দিল সম্মিলিত বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পনের প্রতিক হিসাবে। রিভলভারটি গ্রহণ করলেন মেজর জেনারেল নাগরা এবং টুপি তুলে দিল আমার হাতে। জেনারেল নাগরা তখন আমাকে বললেন, আরে সিদ্দিকী, ক্যামেরাম্যান হ্যায়? ইয়েতো হিষ্ট্রি বন যায়েগা। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে সময়ে কোন ক্যামেরা ম্যান সেখানে ছিল না। মেজর জেনারেল জামশেদ যখন আত্মসমর্পন করলো, তখন সকাল দশটা।
কাদের সিদ্দিকী বললেন, ‘আমরা ঠিক করলাম যে, জেনারেল নিয়াজীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে হবে। মিরপুর ব্রিজের এপারে এলাম জেনারেল নাগরা, ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ব্রিগেডিয়ার সানত সিং ও আমি এলাম পাক বাহিনীর গাড়ীতে চেপে। রাস্তায় প্রহরারত পাক বাহিনী আমাদের স্যালুট ঠুকছে। আমাদের বাহিনী পড়ে রইলো পেছনে। এপারে এসে এক জায়গায় টেলিফোন করতে গিয়ে দেখি কোন শব্দ নেই। টেলিফোন ডেড। লাইন কাট আপ। এলাম মোহাম্মদপুর। নিয়াজীকে টেলিফোন করা হলো কিন্তু সাড়া নেই রিং হচ্ছে না। তখন জেনারেল নাগরা বললেন, উন লোক চালাকি কিয়া। যেধার যাতাহু ওধারই লাইন নেহী হ্যায়। তখন সকাল প্রায় সোয়া দশটা পেরিয়েছে। জেনারেল নাগরা তখন ভাবছেন যে আমরা ক্যান্টনমেন্টে যাবো কি যাবো না। যাওয়াটা কি ঠিক হবে। আমি বললাম, যখন এসেই পরেছি তখন যাবোই। তারপর দশটা চল্লিশ মিনিটে আমরা ক্যান্টনমেন্টে নিয়াজীর দফতরে পৌঁছলাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘর। নিয়াজী এসে স্যালুট করলো। নাগরা স্যালুটের জবাব দিলেন। নাগরা বসলেন। নিয়াজী বসলো। নাগরা তখন পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন, ইয়ে হ্যা ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার, ইয়ে হ্যায় ব্রিগেডিয়ার সানত সিং, আউর ইয়ে হ্যায় বাংলাদেশ বাহিনীর কাদের সিদ্দিকী। নিয়াজী তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে স্যালুট করলো এবং করমর্দনের জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। আমি তখনো বসে রয়েছি। ইতস্তত করছি, আর ভাবছি নিয়াজীর সাথে হ্যাণ্ডসেক করবো কিনা। নিয়াজী তখনো হাত বাড়িয়ে রয়েছে। জেনারেল নাগরা বললেন, কেয়া হুয়া সিদ্দিকী, হাত মিলাও। তুমকো নিয়াজীকে সাথে নেহী-এক ইনসানকে সাথ হাত মিলাতা হ্যায়। মিলাও।
—————————————————