You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.10.21 | বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর ষাট ব্যক্তির প্রতিবেদন | অক্সফোম রিপোর্ট - সংগ্রামের নোটবুক
       শিরোনাম                      সূত্র                 তারিখ
বাংলাদেশের পরিস্থিতির উপর ষাট ব্যক্তির প্রতিবেদন    অক্সফোম রিপোর্ট        ২১ অক্টোবর,১৯৭১

বাংলার সংকট নিয়ে ষাট ব্যক্তির সাক্ষ্য
(২১শে অক্টোবর, ১৯৭১ সালে, এইচ. লেজলী কির্কলে, ডিরেক্ট, সি. বি. ই. অক্সফোম, অক্সফোর্ড, কর্তৃক প্রণীত)
ষাট জন নারী এবং পুরুষ এমন এক পরিস্থিতি দেখেছে এবং এর মধ্য দিয়ে বসবাস করেছে যাকে বলা যায় “বর্ণনাতীত” । এটি হল তাদের তা ব্যখ্যা করার চেষ্ঠা। এটি হল একটি ট্র্যাজিডির তাদের রেকর্ড ,তাদের কন্ঠ, তাদের সাক্ষ্য ।
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এবং মাদার তেরেসা সম্পর্কে পুরো পৃথিবী জানে।অন্যরা যারা আন্তর্জাতিক সাংবাদিক বিশেষত এই ডকুমেন্টে সাক্ষ্য দিয়েছেন হলেন মাইকেল ব্রুনোসন (আইটিএন), ক্লারে হলিংওয়ার্থ (টরোন্টো টেলিগ্রাম), জন পিলগার (ডেইলি মিরর) ,নিকোলাস টমালিন (সানডে টাইমস)। সাথে অন্যরা হলেন ব্রিটিশ, ইউরোপীয়ান অভিজ্ঞ রিলিফ কর্মী। সকলেই অসংকোচে এবং বিনালাভে তাদের সময় এবং কর্মশক্তি দিয়েছেন ।
তারা হলেন প্রত্যক্ষদর্শী, এবং তারা যে গল্প বলেন তা ভয়ানক।এই গল্প হল লক্ষাধিক, ভীত, গৃহহীন, মৃত্যুগামীদের।এটি একই সাথে বিশ্ব সম্প্রদায় সাম্প্রদায়িক উটপাখির মতো আচরণে জোটবদ্ধ হবার গল্প।
হয়তবা এটি এমন যে পৃথিবীবাসী জানে না।তবে সত্যকে বলতে দেওয়া হোক।হয়তবা এটি এমন যে আমরা কোনভাবেই এই দুর্যোগের ব্যাপ্তিকে বুঝতে পারব না।ইতোমধ্যে একত্রে সুইডেন এবং নিউজিল্যান্ডের সমান জনসংখ্যা তাদের মাতৃভূমি হতে পালিয়েছে। আরো লক্ষাধিক যারা রয়ে গিইয়েছে এখন দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছে।এটি চিন্তা করতে বাধ্য করতে করে না।তবে আমাদের করতে হবে।যদি একটি ছোট মেয়ে অক্সফোমকে লিখতে পারে এবং বলতে পারে যে “আমরা সাহায্যের সিদ্বান্ত নিয়েছি।আমরা একত্রে ৫৬.১৫ ইউরো সংগ্রহ করেছি।আমরা সকলেই ৯’/২”, তবে ঈশ্বরের দোহাই এ বিশ্ব সরকারসমূহ এই বিষয়ে জরুরী চিন্তা করতে পারে।শত হাজার যারা অক্সফোমের মধ্য দিয়ে দিয়েছেন এবং দিয়ে যাবেন এবং সমসাময়িক পৃথিবীর অন্যান্য সংস্থার নামে আমি আমার সম্পূর্ণ হৃদয়ের সাথে নিম্নের আবেদনসমূহকে সামনে আনছিঃ
ব্রিটিশ সরকারের প্রতি – আমি অতিস্বত্বর নতুন করে ২৫ মিলিয়ন ইউরো শরনার্থী ত্রাণ চাইছি।ব্রিটেন দিয়েছে, তবে তা কোনোভাবেই পরিস্থিতির পর্যাপ্তের কাছাকাছি না।আরো ২৫ মিলিয়ন ইউরো এর মানে হল ব্রিটেন এক মাসের ত্রাণ খরচ মিটিয়ে দিয়েছে।অন্তত জাতি হিসেবে আমরা এইটুকু করতে পারি।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি- আমি চাইছি যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ এখন সভা ডেকে, সেক্রেটারি জেনারেলের ব্যক্তিগত চেয়ারম্যানশীপের অধীনে, কর্তৃত্বের সাথে অতিস্বত্বর পাঁচ জনের একটি কার্যবাহী দল নিয়োগ করা হোক যাতে ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের ত্রাণ কার্যক্রমের জরুরী তহবিল এবং বাস্তবায়ন নিশ্চিত করে।আমি আরো মিনতি করছি যে প্রত্যেক সরকার এই অত্যাবশ্যক মানবিক কার্যক্রমের অবদানে মুক্তভাবে সকল যথাযথ সম্পদ ব্যয় করি।
পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এবং মুক্তিবাহিনীর প্রতি – আমি চাইছি বিস্তীর্ণ ইউএন দুর্ভিক্ষ-ত্রাণ কার্যক্রমে তাদের পূর্ণ সমর্থ এবং উৎসাহ, এবং শরনার্থীদের তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে যেতে সাধারণ ভাবে সংগতিপূর্ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক।
মানুষ – সাধারণ মানুষের প্রতি – আমি চাই যে তারা তারা তাদের যত্ন এবং দেয়া অব্যাহৎ রাখে।আমি চাই যে তারা এমনকি একটি জীবনকেও পরিহার্য মানতে অস্বীকার করে।
এটি, আমার কাছে অকল্পনীয় যে, আমাদের কম করা উচিত।
সংকটের সংক্ষিপ্ত পটভূমি- ১৯৪৭ সালে, স্বাধীনতাকালে , “ব্রিটিশ ভারত” চার ভাগে বিভক্ত হয়েছিলঃ ভারত, বার্মা, এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান; পরবর্তীতে ইসলামবাদ এর ভিত্তিতে একটি দেশে মিলিত হয় কিন্তু হাজার মাইলে আলাদা থাকে, আলাদা ভাষা ও এমনকি আলাদা হাতে লেখা। এটি এমন যে খ্রিষ্টবাদের ভিত্তিতে, গ্রীস আর ব্রিটেন একদা একটি দেশ হিসেবে মিলিত হয়েছিল।
অনেক বছর ধরে, পাকিস্তানে পূর্বের বাঙালীদের ,পাঠানদের, পশ্চিমের বেলুচ্চিদের মধ্যে একটি শক্তিশালী সামরিক স্বৈরশাসনের মাধ্যমে আঞ্চলিক সংঘর্ষ সংঘটিত হয়ে আসছিল। ক্ষমতা কিছু মানুষের হাতে কুক্ষগিত করে রাখা হয়েছিল।বাইশটি পরিবার দেশের অর্ধেক শিল্প সম্পদের মালিক ছিল।
কয়েক বছর ধরে, পূর্বে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ যাচ্ছিল। ১৯৫৮ সালে ৫৫% রপ্তানী পূর্ব হতে এসেছিল; তারপরও ৭০% আমদানী গিয়েছে পশ্চিমে। পাট, যা দেশের রপ্তানীর ৪০% বহন করে, পুরোটা আসে পূর্ব হতে।তৃতীয় পঞ্চ বার্ষিকী পরিকল্পনায় (১৯৬৬-৭০), ৫২% রাজস্ব পূর্বে বরাদ্দ করা হয়েছিল ;শুধুমাত্র ৩৬% সেখানে ব্যয় করা হয়েছিল।
১৯৬৯ এর মার্চে আইয়ুব খান পদত্যাগ করে্ন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান কর্তৃক অনুসৃত হন, যিনি সিভিলিয়ান্দের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নির্ধারিত হয়েছিল।দুঃখজনক ভাবে ,এটি ছিল গণতন্ত্রের পথে প্রথম ধাপ – ১৯৭০ এর ডিসেম্বর এর সাধারণ নির্বাচন – যার কারণে সংকট শুরু হইয়।এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান ভিত্তিক আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবর রহমান পূর্ব পরিষদে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৫৭টি আসন অর্জন করে এবং একইসাথে জাতীয় পরিষদে ৩১৩টি আসনে নিয়ন্ত্রণ নেয়।তার কার্যক্রম বন্ধ হয় শুধুমাত্র পূর্বের অল্প বিচ্ছিন্নবাদের কারণে।
পূর্বে জে আ ভূট্টো জিতে সে সাধারণ পরিষদের ৩রা মার্চ ১৯৭১ এর প্রথম সভা বয়কট করে।ইয়াহিয়া খান অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিষদ স্থগিত করে।পূর্বের স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে সাথে হত্যা এবং লুন্ঠন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা শহরে।
২৫শে মার্চ ,পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য পূর্বে আনা হয় ঢাকা এবং চট্টগ্রাম এ তড়িত নিয়ন্ত্রণ আনতে।
একটি রক্তবন্যা বয়ে যায় ভয়ানক অনুপাতে।নারী এবং শিশুরা মেশিন গান বিদ্ব এবং ধর্ষিত হইয়।মে এর শুরুতে শরনার্থীর একটি বড় অংশ যাদের ৬৫% হিন্দু ,ভারতের সীমানায় ঢল পড়ে; তাদের পিছনে একটি গণহত্যা সাক্ষী রেখে।জুনের মাঝামাঝিতে পঞ্চাশ লক্ষাধিক জড় হয়েছিলঃ যেটি এসএস কর্তৃক ইউরোপে হামলার ধরুণ মানুষের প্রস্থান পরবর্তী সবচেয়ে বড়।ভারত সরকার খাদ্যের জন্য ক্যাম্প তৈরী করে,কিন্তু সেখানে পয়ঃনিষ্কাশনের, বিশুদ্ব পানির, ভীষণ অভাব ছিল।কলেরা ছড়িয়ে পড়ে।তখনি বর্ষা চলে আসেন।এবং সেখানে সব সময় আরো শরনার্থী আসতে থাকে যতক্ষণ না এর সংখ্যা বর্তমান অনুসারে নব্বই লক্ষে পোছায়, ১৫-৪০০০০ প্রতিদিন।
পোপ পল কর্তৃক পাকিস্তানের জন্য সাহায্যের আহবান-“লক্ষাধিক মানুষ, অমানুষিক অভাবের পরিস্থিতিতে আছে ।একের পর এক দুর্যোগ এই মানুষগুলোকে আঘাত হানছে যারা নিতান্তই গরীব।
এখানে ভয়ানক খবর এবং ঘটনার কমতি নেই, যাতে প্রকাশ পায় ভয়াবহ অসামঞ্জস্যতা যা সাহায্য প্রয়োজন আর যা আসলে লভ্য এর মধ্যে।অসংখ্য জীবন বাচাতে মানুষকে সাহায্যের ব্যপারে জেগে উঠতে হবে।সরকারি এবং বেসরকারি সাহায্য ,সাথে আমাদের নিজেদের সহযোগীতাও জড়িত কিন্তু এটি নিতান্তই অপর্যাপ্ত।এটি আশা করা অতিরিক্ত নয় যে পুরো পৃথিবী এই মানুষগুলো এই মানুষগুলোর অঙ্গীকার দ্বারা আবেগতাড়িত হবে এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ, ও অর্থ পাঠাবে।
এই শরনার্থী কার্যকরম এর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ এই শতাব্দীতে দেখা সবচেয়ে বড়।এই কার্যক্রম বর্তমানে ছয় মাস ধরে ৩৫০ মিলিয়ন ডলারে চলছে, প্রতিদিন ১ মিলিয়ন ডলারেরও উপরে।
যুক্তরাষ্ট্র হাই কমিশন ভারতের বোঝা মেটাতে শরনার্থীদের জন্য তহবিলের ডাক দিয়েছেঃ এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ১১৪ মিলিয়ন এসেছে একটি দেশ হতেঃ আমেরিকা
ভারতে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগীতা হল ৮ মিলিয়ন এবং পাকিস্তানের জন্য ১ মিলিয়ন।এর সাথে সাথে ব্রিটিশ দাতব্য তাদের কর্মসূচিতে ১ মিলিয়ন ব্যয় করে।
ব্রিটিশ সরকারের কাছে লেসলি কির্ক মোট অনুপাতের হিসেব পেতে চাইছে,যেখানে দুটো বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন।
১৯৫০ হতে ১৯৬৯ পর্যন্ত পাকিস্তানে আসা আন্তর্জাতিক সাহায্য হিসেব করা হয় ৬,০৩৩ মিলিয়ন এর উপর।বর্তমানে অবস্থার দরুণ পাকিস্তানে বড় দাতব্য দেশগুলো কর্তৃক নতুন সাহায্য স্থগিত করা হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের সাথে গ্রহণযোগ্য সঞ্চয়ের সাথে।(গত বছর ,পাকিস্তানে ব্রিটেনের সাহায্য ছিল ৯’/২ মিলিয়ন)
২ প্রেসিডেন্ট নিক্সন বর্তমানে কংগ্রেসের কাছে অতিরিক্ত ২৫০ মিলিয়ন চাইছে।
(অক্সফোম স্বীকারোক্তি তাদেরকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে যারা এই ষাট এর সাক্ষ্য সম্ভব করেছে; অবগশগ্রহণকারীদের তাদের সাক্ষ্য তৈরি করেছে নিজেদের মুখের, ছবিতে অথবা স্কেচে।তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অক্সফোমের সাথে এক হওয়া জরুরী নয়; তাদের বক্তব্য দ্বারা বাধ্যও অক্সফোমের নীতির কাছে।আমরা ধন্যবাদ জানাচ্ছি ক্লারে হোলিং ওয়ার্থ, নিকোলাস টমালিন এবং মার্টিন উলকটকে যারা মূল প্রবন্ধের জন্য সময় দিয়েছেন; দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ, দ্য সানডে টাইমস এবং দ্য গার্ডিয়ানকে যারা সেগুলো প্রচার করেছে; রোমানগো ক্যাগোগনি, এলান লিথার, এবং ডোনাল্ড ম্যাককুলিনকে তাদের ফটোগ্রাফের জন্য, দ্য অবসারভার এর ডেনিস ও’ডায়েরকে তার ডিজাইনের জন্য; সকল প্রতক্ষ্যদর্শীদের যারা বক্তব্য সময়মতো পাবলিকশনের জন্য দুর্ভোগ ও ব্যয় বহন করেছে; সর্বশেষ জেলার্ড স্কারফে যাকে আমরা প্রতক্ষ্যদর্শীর বক্তব্যের জন্য রিং করেছি , কিন্তু তিনি বলেছেন “আমি কথা বলার মানুষ নই” এবং আমাদের এই ছবিগুলো দিয়েছেন)

সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি
দুঃখের বিচিত্রতা
সম্পূর্ণ কৌশন এখন সারা বিশ্ব কর্তৃক বোঝা হয়নি। আমি আপনাদের এটি বলতে পারি যে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিজ চোখ দেখবেন না আমরা এর তীব্রতা বুঝতে পারবেন না।শুধুমাত্র এইখানে অবস্থান করে আপনি মানুষগুলোর অনুভূতি এবং অঙ্গীকার উপলব্ধি করতে পারবেন, এবং সহিংসতার তীব্রতা যা শরনার্থী তৈরিতে এবং বেসামরিকের হতাহতের সংখ্যা বাড়াতে বলবৎ রয়েছে।
ভারতে আমি শরনার্থী এলাকা পরিদর্শন করেছি কলকাতা হতে পূর্ব বাংলা সীমানা জুড়ে এবং পশ্চিমে পশ্চিম বাংলা থেকে জলপাইগুড়ি এবং দার্জিলিং শহরে উত্তর হতে পশ্চিমের ত্রিপুরা রাজ্যের আগারতলা পর্যন্ত।
ঢাকার দক্ষিণে অবস্থিত বরিশাল এবং খুলনা জেলার হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসে বীভৎস বর্বরচিত অত্যাচার।
আবালবৃদ্ধবনিতা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত অত্যাচারের হাত থেকে রেহাই পায়নি,তাদেরকে অনিশ্চিত ভাগ্যের বিড়ম্বনায় রাস্তার ধারে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে বিচরণ করতে দেখা গেছে।পাকিস্তানের সৈন্য ও তাদের দোসর বা সহযোগী দালালদের অবর্ণনীয় অত্যাচার যেমন অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ,লুটপাট,নিপীড়ন,হত্যা’র মতো বীভৎস ঘটনা এদের মুখে বলতে শোনা গেছে।রাস্তার ধারে অনেক শিশুকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে এবং তাদের পিতামাতাকে সাহায্যের জন্য রাস্তায় হাতবাড়াতে দেখা গেছে।মৌসুমী বৃষ্টিপাত ও প্রাকৃতিক আনুষঙ্গিক দুর্যোগ থেকেও তারা রেহাই পায়নি।যারা এ অবস্থা দেখেছে তারা ভেবেছে আরও কতদিন,আরও কত রাত বিশ্রামহীন,আশ্রয়হীন,খাদ্যহীন অবস্থায় এদের পাড়ি দিতে হবে।
একটি পঙ্গু শিশু যে নাকি জীবনে আর হাঁটতে পারবেনা তার অসহায় চাওনি এবং ছোট তাঁবুর নিচে মাদুরে শুয়ে থাকা ভীতসন্ত্রস্ত শিশুটি দেখছে তার মা বাবা ভাই বোনের করুণ মৃত্যু- এমন দৃশ্য কখনো মন থেকে মুছে ফেলা যাবেনা।আমরা পৌঁছার কয়েক মুহুর্ত পূর্বে কলেরায় মৃত ছোট শিশুটির গায়ে ঢাকবার মতো একখন্ড কাপড়েরও ব্যবস্থা করতে পাচ্ছেনা তার দশবছর বয়সী বোনটি।যখন আমি শরণার্থী শিবিরের একজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞেস করি তার সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন কিসের,তখন তিনি জবাব দিলেন তার প্রধান জরুরী প্রয়োজন হলো মৃতদেহ সৎকারের ব্যবস্থা করা।তিনি ছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ একটি শরণার্থী শিবিরের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এই স্থানটি মূলত নিম্ন এবং মধ্য আয়ের লোকদের আবাসস্থল হওয়ার কথা ছিলো।এখন তা এক লক্ষ সত্তর হাজার শরণার্থীদের আশ্রয়স্থল।
পূর্ববাংলার এই করুণচিত্র শুধুমাত্র পাকিস্তানের বা ভারতের ছিলোনা,এই করুণচিত্রটি ছিলো সারা বিশ্বের। এই সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন সমস্ত বিশ্বের মানবসম্প্রদায়ের যৌথ উদ্যোগ।
সাধারণ মানবতার দাবি আমেরিকা এবং সম্মিলিত জাতিসংঘের।এ সত্য মেনে নেওয়া উচিৎ যে এ সমস্যাটা শুধু ভারতের নয়,এটা সমগ্র মানবসম্প্রদায়ের একটি দায়িত্ব।
মাদার তেরেসা
( “দি মিশনারিজ অফ চ্যারিটি” এর প্রতিষ্ঠাতা মাদার তেরেসা।গত বছর তিনি পোপের পুরস্কার গ্রহণ করেন।তিনি ১৯৪৮ সাল থেকে কলকাতার মুমুর্ষ এবং দুস্থদের নিয়ে কাজ করেছেন।তাঁর আদেশ অতি অল্প সংখ্যক ক্যাথলিকদের মতোই ছিলো।তাঁর সাতশত পরিচারিকা ও সন্ন্যাসিনী ছিলো।তারা বস্তিতে বসবাস করতো এবং তারা দরিদ্রের মতো খাবার গ্রহণ করতো।)
ভারতীয়দের এই সমস্যাকে সারা বিশ্বের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
এই লক্ষ লক্ষ পাকিস্তানী শরণার্থীদের সার্বিক দায়িত্ব ভারত ইতোমধ্যে নিয়েছে এবং ভবিষ্যতে নেবে।তাদের এ সমস্যা বহির্বিশ্বে তুলে ধরার জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী চমৎকার একটি উদ্যোগ নিয়েছেন। চলো আমরা স্মরণ করি :
পাকিস্তানের জনগণ,ভারতীয় জনগণ, ভিয়েতনামের জনগণ এবং পৃথিবীর যে যেখানেই থাকুকনা কেনো সবাই ঈশ্বরের সন্তান।সবাই এক সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি।আজকে পাকিস্তানের জনগণ আমাদের নিকট আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হলেও তারাও কিন্তু এ বিশ্বে ঈশ্বরের পরিবারেরই সদস্য।

এটা শুধু ভারতের সমস্যা নয়।এটা সারাবিশ্বের সমস্যা।সমস্যাটা বিশ্বকে বহন করতে হবে এবং বিশ্বকেই এর সমাধান দিতে হবে।

আমাদের ভারতবাসীর জন্য এ সমস্যাটা ভাল কিছু নিয়ে এসেছে।কারণ আমাদের দেশের জনগন এটার জন্য যথেষ্ট ত্যাগ স্বীকার করেছে এবং করবে।
কিন্তু সারাবিশ্ব এ বিষয়ে আন্দোলিত হবে।আমরা যা হই না কেন,আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে,আমাদের লক্ষ লক্ষ শিশু ক্ষুধা,অপুষ্টি এবং আরও অন্যান্য সমস্যায় ভুগছে যার সমাধানে আমাদের জনগন প্রশংসা পাবার যোগ্য।যদি খাদ্য,আমিষ এবং আনুষাঙ্গিক জিনিসপত্র নিয়ে বিশ্ব এগিয়ে না আসে তবে এ শিশুরা অপুষ্টিতে ভুগবে এবং মারা যাবে।এ কারণে বিশ্বকে এর জবাবদিহি করতে হবে।
আমি শরণার্থীদের নিয়ে ৫/৬ মাস যাবৎ কাজ করছি।আমি শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের মারা যেতে দেখেছি।সেকারণে আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি যে,পরিস্থিতিটা কত নাজুক এবং এদের সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসা কত প্রয়োজন।
বিশ্বের কাছে এটা একটা আবেদন,এবং বিশ্বকে এর জবাবদিহি করতে হবে।
নিকোলাস টমালিন
(আমাদের মধ্যে যারা এটা দেখেছে তারা বুঝতে পেরেছে ব্যাপারটা একার পক্ষে সমাধান করা কতখানি অসম্ভব।’সানডে টাইমস’এর নিকোলাস টমালিন ইন্ডিয়ায় অবস্থানরত শরণার্থীদের সম্পর্কে এক অনবদ্য প্রবন্ধ লিখেছেন।)
বিগত ত্রিশ বছরের মধ্যে পাকিস্তানের এই ভয়াবহ দুর্যোগটি বিশ্বকে মোকাবেলা করতে হয়েছে।গত ২৫শে মার্চ-এ পাকিস্তানি জেনারেলরা সেনাবাহিনীকে নিজদেশের মানুষের উপর আক্রমণের জন্য লেলিয়ে দেওয়ার হুকুম হিটলারের যুদ্ধের পরিস্থিতির চেয়েও ভয়াবহ ছিল।
৯০ লক্ষ ভুক্তভোগী শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয় এবং সাড়ে ছয় কোটি নিষ্পাপ বাঙালি পূর্বপাকিস্তানে থেকে যায়,যাদের দুঃখ-দুর্দশা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না।যুদ্ধসহ,দুর্ভিক্ষ, মহামারী, ঘূর্ণিঝড়,অবিচারসহ বিভিন্ন ধরণের সরকারি অত্যাচার দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে যা বিগত ১৫ বছরের ভিয়েতনাম, বিয়াফ্রা এবং আফ্রিকার রক্তাক্ত সংঘাতের চেয়েও মারাত্মক ছিলো।
প্রতি সপ্তাহে যেখানে দুই থেকে তিন হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করছিল এবং আমরা যারা এগুলো দেখছিলাম তাদের সহায়তা করার মতো কোনো উপায় ছিলোনা।কারণ আমরা নিরুপায় ছিলাম।
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য এবং দুস্থদের সাহায্যের জন্য বিশ্বের দূর-দূরান্তের বিভিন্ন শহর-নগরের জননগন এবং বিভিন্ন সংস্থা আবেগ তাড়িত হয়ে কনসার্টের আয়োজন,সভা-সমাবেশের আয়োজন প্রভৃতির মাধ্যমে নগদ টাকা এবং তহবিল গঠন করতে উদ্যোগ নেয়।ওই সংস্থার কিছু সদস্য শরণার্থীদের সেবা করার মানসে ভারতে চলে আসে।
অক্সফামের মতো দাতব্য ত্রাণ বিতরণকারী সংস্থা যারা নাকি দুস্থ মানুষের দুর্দশা লাঘবে সক্ষম তারাও লোকবল,অর্থবল এবং অক্ষমতার কারণে প্রকৃত সমস্যা সমাধানে সক্ষম হয়নি।
তাদের অবশ্যই ইয়াহিয়া খান এবং তার পাকিস্তান সরকারকে বল প্রয়োগ করার জন্য একটি কঠিন এবং দক্ষ রাজনৈতিক প্রজ্ঞা দরকার যাতে তারা স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তাদের বর্তমান কর্মকাণ্ড বেআইনি এবং নির্বোধের এবং তা অচিরেই বন্ধ করা উচিত। এরপর তাকে এবং তার অনুসারীদের বাধ্য করতে হবে যাতে তারা পূর্ব পাকিস্তান হতে তাদের সৈন্য সরিয়ে নেয় এবং যেসব শরণার্থী ফিরে আসতে চায় যেন তাদের সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। এরপর তাদের ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারত সরকারকে রাজি করাতে হবে সেসব শরণার্থী গ্রহণ এবং সাহায্য করার জন্য যারা আর ফিরে আসতে চায় না। সর্বোপরি মানুষকে অনাহার, অসুস্থতা এবং অভাব থেকে বাঁচানোর জন্য তাদের কয়েক শত লক্ষ পাউন্ড পরিশোধ করতে হবে।

যদি এই সকল প্রক্রিয়া খুব দ্রুত সম্পন্ন করা যায় তবে বিপর্যয় এড়ানো সম্ভব। পূর্ব পাকিস্তান সাধারণভাবে বলতে গেলে বাংলা, এখনও একটি দুর্যোগ পূর্ণ এলাকা। কিন্তু তারপরও এখানে একটি সুখি অবস্থা বিরাজ করছে।

গত সপ্তাহে কলকাতায় কিছু শরণার্থী শিবির ঘুরে আসার পর থেকে এই বিপর্যয় নিয়ে লেখার কথা ভাবছিলাম। আমি শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত গ্রান্ড হোটেলের বড় সুইমিং পুলের পাশে একটি নরম গদিতে শুয়ে শুয়ে ঠান্ডা বিয়ার পান করছি, সাথে আছে চিনাবাদাম এবং মাঝে মাঝে কুঁচকানো কাগজে ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি (আই লাভ ইউ)’ নামের একটি কমিক পড়ছি যেখানে একটি ছেলে ও একটি মেয়ে পাহাড় থেকে স্কিইং করে নেমে আসছিল, তখন মেয়েটি বললো, “আমি স্টিভ কে ভালোবাসি, কিন্তু যখন সে আমার অতীত জানবে তখন সে কি করবে? সে কি আমার অতীত ভুলতে পারবে?”

আমি প্রচুর সাঁতার কাটি, অদ্ভুদ স্বাদের জুস খাই এবং চেষ্টা করি বাঙালি বেয়াড়া ছেলেটার উপর বিরক্ত না হতে যে আমাকে ভালো বখশিশের আশায় রাজা-মহারাজাদের মত খাতিরদারী করছে।

আমি এই সব কিছুই করেছি কেননা শরণার্থী শিবিরে যা ঘটছে তার আতঙ্ক কাটানোর জন্য আমার একটি লম্বা সময় দরকার। আমার সংবাদপত্রের সহকর্মীর অবস্থাও আমার মতই। আমি এসব উল্লেখ করছি কেননা অন্যান্য সকল পরিস্থিতিতে তারা এসব অতি আতঙ্কজনক ঘটনা এবং মানব দুর্বিপাকের অসহনীয় অভিজ্ঞতা দেখতে সক্ষম হয়েছিল এবং তা তাদের ভেতরে কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি।

আমি তাদেরকে বায়াফ্রা থেকে ভিয়েতনামে অথবা বাংলার ঘূর্ণিঝড় থেকে ফেরার পর দেখেছি। তারা উদ্বিগ্ন ছিল, সমব্যথী ছিল কিন্তু তারা আবেগের সাথে মানিয়ে নিয়ে জানত। কিন্তু এবার তারা মানতে পারছে না।

একজন সহকর্মী যার আগে একবার গলার ক্যান্সারের অপারেশন হয়েছিল সে আবার ইতিমধ্যে দিনে সত্তরটি সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে। একত্রিত হওয়া পত্রিকার লোকজন আত্মরক্ষার জন্য সশস্ত্র হয়ে যায়।

একজন জীর্ণশীর্ণ ছোট বাঙালি বালিকার আয়নার টুকরাতে নিজেকে দেখার ছবির দিকে তাকিয়ে কেউ একজন বললো, “অক্সফাম পোস্টারের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে” এবং তা শুনে সবাই হাসলো।

একজন আলোকচিত্রকর বললেন, “আমি আজ একটি অসাধারণ ছবি তুলেছি।” দুইটি শিশু একত্রে মাটিতে মৃত্যুবরণ করছে।”

“আমি এর চেয়েও ভালো কিছু পেয়েছি”, অন্য একজন বললো। “আমি তাদেরকে হাত ধরাধরি করা অবস্থায় পেয়েছি।”

কলকাতায় বাকিরাও সবাই সমান আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছে। একজন স্থানীয় কূটনৈতিক, যিনি এই দ্বিতীয় দফার পরেও স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছেন, এবং প্রচন্ড আবেগ নিয়ে যুদ্ধের ব্যাপারে কথা বলছেন। তার মতে হয়ত এই নভেম্বরে, অথবা পরবর্তী নভেম্বরের ভেতরেই ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে শুধুমাত্র যে কোন একটি দেশই টিকে থাকবে। তার মতে, ভারত সরকারের পক্ষে এই নব্বই লক্ষ কর্মহীন নতুন অভুক্ত বাসিন্দাদের অর্থনৈতিক ভার বহন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

ইতিমধ্যে আসামে বিদ্রোহ চলছে যেখানে পাহাড়ি লোকজন সমতলের বাঙালি যারা তাদের পাহাড় থেকে তাড়িয়ে দেয় তাদের অপছন্দ করে। এখনই তাদের ওখানে, এমনকি কলকাতার শিবিরগুলোর আশেপাশে লড়াই ও সংঘর্ষ চলছে। সর্বপ্রথমে ভারতীয় কৃষকেরাই তাদের দুঃখের সাথীদের স্বাগত জানায়। এখন যদি তারা কোন অপরিচিতকে অনাহারের কারণে তাদের কাজ ছিনিয়ে নিতে, তাদের জমি দখল করতে এবং তাদের মালামাল অথবা নারীদের হরণ করতে দেখে,তখনই তাদের লড়াই শুরু হয়।

সুতরাং, এই কূটনৈতিকের যুক্তি অনুসারে, ভারত (স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে নিয়ে) খুব দ্রুতই পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীকে এক সপ্তাহের মধ্যে নিষ্কাশনের জন্য তাদের উপর সেনা আক্রমণ চালাবে। এরপর তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে ভারতের প্রদেশ বানাবেন কি বানাবেন তার

বাংলায় কোন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থাকতো না, মোদ্দাকথা, এমন আজগুবি রকমে পাকিস্তানকে প্রদেশে ভাগ করতে হয় না, ভৌগলিক ভাবে এ অঞ্চল ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবার কথা ছিল যা অর্থনৈতিক দিক দিয়েও সামঞ্জস্যপূর্ণ।
সাম্প্রতিক ইতিহাস খুবই বেদনাদায়ক। দুর্ভাগ্য থেকে দারিদ্র্য, সেই দারিদ্র্য আরো বেশি দুর্ভাগ্য বয়ে নিয়ে এসেছে যা আরো প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শোষণ, অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, ধর্মান্ধতা আর রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় টিকে থাকতে পারে নি। এমন অসহায় এবং বিশৃঙ্খলাপূর্ণ জায়গায় কিভাবে পাকিস্তানের জন্মদাতা সুশৃঙ্খল পাঞ্জাবী শাসকরা নিয়ম এবং সমৃদ্ধি নিয়ে আসবে? তারা কিভাবে তাঁদের উৎসাহী ব্যবসায়ীদের এখান থেকে লুটপাট করা থেকে বিরত রাখবে? তারা কিভাবে ইসলামের নীতি বিরোধী হবে এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা কমাতে কেমন করে সুষ্ঠু জন্ম নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা গ্রহণ করবে?
এটা বোধগম্য হয়েছে যে পূর্ব পাকিস্তান এক রকম ভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের একটি উপনিবেশে পরিণত হয়েছে যেখানে লম্বা, বাদামি, আবেগহীন পশ্চিমা এবং খাট, কৃষ্ণকায়, উত্তেজিত, মেধাবি প্রাচ্যের মাঝে জাতিগত বিরোধ রয়েছে। পাঞ্জাবী এবং বিহারীরা বাঙ্গালীদেরকে অনিয়ন্ত্রণযোগ্য দুস্থ হাভাতে বানরের থেকে খুব বেশি কিছু মনে করত না। এবং তাঁদের দিক থেকে অবস্থাদৃষ্টে এই বিশ্বাসটিই আরো ভালভাবে প্রমাণিত হয়।
বাঙ্গালীরা পশ্চিমা ধাঁচের সামরিক শাসক, বণিক সম্প্রদায়, ইংরেজ পুঁজিপতি থেকে কোন অংশে কম না এমন মহাজন দেখে এসেছে। যারা ছিল আরো কম উদার, তাঁদের বিশেষ আবেগ অনুভূতির প্রতি কম সংবেদনশীল এবং আরো কম মত প্রকাশের সুযোগদানকারী। বৈরিতা এতটাই বেড়ে গেছে যে বিস্ফোরিত হওয়ার আগে বিগত মার্চ মাস থেকে বাঙ্গালীরা যেভাবে আগ্রাসী প্রদর্শন শুরু করেছে এবং তাঁদের মাটিতে সকল পশ্চিমা ‘বিদেশী’দের হত্যা করা শুরু করেছে তা মোটেও অবাক করার মতো নয়। কারণ, তারা এতই বেশি দিন ধ্বংসপ্রায় জীবন কাটিয়ে এসেছে যে এমন আক্রোশ (যা কিনা পুরো উপমহাদেশ জুড়েই সংঘাতপূর্ণ ঐতিহ্যের একটি অংশ) পুরোপুরিভাবেই বোধগম্য। এবং সবশেষে যখন লাখ লাখ পূর্ব পাকিস্তানী গত বছরের ঘূর্ণিঝড়ে ডুবে গেছে বা মারা গেছে তখন তারা কেন ইসলামাবাদের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে তাঁদের নিজেদের আওয়ামী লীগ কে ভোট দিয়েছে তাও অবাক করার মত নয়।
এ অবস্থায় যে কাজটা সবচেয়ে পাপের এবং মূর্খের মত হয়েছে তা হল জেনারেল ইয়াহিয়ার একমাত্র সামরিক সমাধানই একমাত্র সমাধান বলে ধরে নেয়ার সিদ্ধান্ত। তার এটা বুঝা উচিৎ ছিল যে এমন শত্রুভাবাপন্নতার সামনে কোন সামরিক সমাধানই ফলপ্রসূ হবে না। তার এই সিদ্ধান্ত শুধুমাত্র অনৈতিক এবং অবৈধই নয় বরং নিশ্চিতভাবে বিফল।
মার্চের আক্রমণগুলোর পরের মাসগুলোতে যা হয়েছে তা ইয়াহিয়ার আগে থেকেই বুঝা উচিৎ ছিল। দেশটি আগের চেয়ে কম নয় বরং আরো বেশি শত্রুভাবাপন্ন হয়েছে। বাংলার গেরিলারা সকল যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। এবং যেখানে তারা ব্যর্থ হয়েছে সেখানে সেনাবাহিনীর প্রতি আক্রমন সফল হয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে উর্বর এই অঞ্চলে খাদ্য মজুদ করা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বৈরিতা আর হত্যা আরো ধর্মীয় এবং জাতিগত হওয়া শুরু করেছে। পূর্ব পাকিস্তানে মুসলমানদের সাথে ১ কোটি হিন্দু বসবাস করছে। যখনই বুঝা গেল পাকিস্তানী সেনারা নির্বিচারে হিন্দু হত্যা করছে তারা প্রায় সবাই ভারতে পালিয়ে গেল। তাঁদের সাথে এল মুসলিম বাঙ্গালী জাতিয়তাবাদী। আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং জনগণ লড়াই করা থেকে পিছপা হল না। সংঘাত আর লড়াই যত বাড়তে থাকল ততই তা অপ্রতিরোধ্য হয়ে পড়ল। ভারতের সীমানার ওপাড় থেকে সেনাবাহিনী গেরিলা দ্বারা আক্রান্ত হল এবং এর প্রতিশোধ স্থানীয় জনগণের উপর নেয়া শুরু করল। এরপর বাঙ্গালীদের দমন করতে অনিয়মিতভাবে কিছু মুসলিম স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ দেয়া হল। এবং এই নিয়োগপ্রাপ্তরাই হল রাজাকার, যারা মুসলিম ধর্মান্ধ, দস্যু, কারাভোগ করা আসামী। এরাই এখন বেশির ভাগ হত্যা সংঘটিত করছে।
ওদের জন্যই এখন মৌসুমী বৃষ্টির সময়েও সীমান্তের ওপাড়ে শরণার্থীদের সংখ্যা বেড়ে চলছে।
বৃষ্টি থেমে গেলেই অবস্থার পরিবর্তন হয়ে যাবে। গ্রামাঞ্চল কিছুটা শান্ত হতে পারে কেননা সেনাবাহিনী মূলত রাস্তা এবং সীমানা ভাল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। যদি আরো বেশি মানুষ চলাচল শুরু করে এবং একে অপরকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয় তবে পরিস্থিতির অবনতি ঘটবে। কতিপয় ভারতীয় কর্তাব্যক্তি আরেকটি শরণার্থীদের জোয়ারের আশংকা করছেন, খুব সম্ভবত আরো ৪০ লাখ। অন্যদের ধারণামতে, বর্তমান শরণার্থীদের অর্ধেকের এক চতুর্থাংশ হয়তো ভারত থেকে পাকিস্তানের দিকে ধাবিত হবে।
তাছাড়া, এখন ভারতে অবস্থানকারী শরণার্থীরা গাদাগাদি করে বেঁচে আছে। সেখানে না আছে পর্যাপ্ত খাদ্য, না আছে সুষ্ঠু বাসস্থান আর না আছে কোন কাজ। পাকিস্তানী শরণার্থীদের দৈন্যদশা সাম্প্রতিক সময়ে এসে যে কারো কাছেই পরিচিত যদি সে পড়তে পারে অথবা এমনকি সে যদি চোখে দেখতে পারে। সকল সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং বিজ্ঞাপন বার্তা থেকে এসব আমাদের জোরপূর্বক দৃষ্টিগোচর করা হয়।
এমন বোমাবর্ষণের পর তাঁদের সত্যিকার মোটেও আশানুরূপ নয়। একজনের উৎসবের মনোভাব অন্য কারোর মহানুভবতার সাথে তাল নাও মিলাতে পারে। দীর্ঘদিন অপেক্ষা করে থাকার পর যেমন ক্যাথেড্রাল আর প্রাচীন গীর্জাগুলো প্রত্যাশিত ছবির মতো হয় না, ঠিক তেমনি কলকাতার নিকটবর্তী ক্যাম্পগুলোতে শরণার্থীদের আশ্চর্যজনকভাবে স্বাভাবিক লাগে।
তাঁদের কয়েকজন বেশ উৎফুল্ল। কয়েকজন তো আবার প্রায় মোটাই। কয়েকজনের আবার কিছু কাজ করার থাকে। কয়েকজন আবার পূর্ব পাকিস্তানে তাঁদের গ্রামের চেয়ে এখানে উন্নততর জীবন যাপন করছে। কয়েকজন শুধু এমন। বেশির ভাগই প্রায় লক্ষাধিকই এমন নয়। এবং যখন কেউ সীমানা ধরে রাস্তা দিয়ে অতিক্রম করে তখন চোখে পড়ে তাঁবুর পড়ে তাঁবু, শত শত তাঁবু রাস্তার ধারে গাছে টাঙানো অথবা ইটের স্তূপের উপর এই জনবহুল এলাকায় যেখানে সম্ভব সেখানেই শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। এখানে সবচেয়ে আশংকার বিষয় হল তাঁদের সংখ্যা।
কিছুকাল পরে, মানুষের এত দুঃখ দুর্দশা থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে তাঁদের অবস্থা এতটাই করুণ যে তা ধারণার অতীত। আমি মাত্র দুইদিন শরণার্থী শিবিরের পাশ দিয়ে গিয়েচি আর এক রাত মোটামুটি ভাল দশার এক শিবিরে থেকেছি। প্রথমে, আমি যেমনটা বলেছি, তাদেরকে দেখে সীমান্তবর্তী হাসনাবাদের রাস্তা থেকে খুব একটা দূরবর্তী মনে হয় না। কলকাতার এক শহরতলী সল্ট লেক সিটিতে আড়াই লাখ মানুষ মোটামুটি অবস্থাপন্ন বসবাস করে। সেখানে খাদ্য বেশ পর্যাপ্তই ছিল। বিদেশী ত্রাণ সংস্থা থেকে এখানে তিন-চারটা হাসপাতাল স্থাপিত হয়েছে। সেখানে বেশ কিছু আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও রয়েছে যার জন্য কলকাতার নিকটবর্তিতা ধন্যবাদ প্রাপ্য। কিন্তু এমনকি এখানেও শিশুদেরকেই সবচেয়ে বাজে অবস্থায় দেখা যায়।
তাঁদের দুরবস্থা বুঝতে গেলে পুষ্টি সম্পর্কিত কিছু জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। একটি শিশুর প্রচুর পরিমাণ আমিষ দরকার যখন সে মাইলের মাইল হেঁটে এসেছে। এবং এখন সে চিরস্থায়ীভাবে অসুস্থ কারণ এখন তার খাদ্যাভ্যাস আগে যেমন ছিল তেমনটা নেই। তার বিশেষত অনেক বেশি পরিমানে পুষ্টি দরকার। কিন্তু বর্তমানে ভারতে কর্তৃপক্ষ জনপ্রতি মাত্র ৪০০ গ্রাম চাল এবং সাথে কিছু শাকসবজি, রান্নার তৈল এবং শস্য রেশন হিসেবে দিচ্ছে। বরাদ্দ জনিত জটিলতার জন্য এ পরিমাণ অনেক ক্ষেত্রেই জনপ্রতি ২০০ গ্রাম চাল এবং শিশুদের জন্য তা অর্ধেক মানে প্রতিদিন ১০০ গ্রাম করে দেয়া হচ্ছে। এই পরিমাণ আসলে এক মুঠোর সমান।
ভারতীয় এবং বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মতে এই শিশুদের অনেকেই মারা যাবে যদি তাদেরকে অতিরিক্ত আমিষ দেয়া না হয়। নয় মাসের মধ্যে তাঁদের তিন চতুর্থাংশ মারা যাবে। প্রায় ১০ লাখ শিশু।
তাই, ধীরে ধীরে অনেক শ্রম দিয়ে শিশুদের খাবারের জন্য বিশেষ কেন্দ্র খোলা হয়েছে যেখানে তারা দুধ এবং বালাহার নামে উচ্চ আমিষযুক্ত খাবার পাবে। এখনও পর্যন্ত এসব খাদ্য কর্মসূচির অধিকাংশ

ক্ষেত্রেই যে খাবার শিশুদের হাতে দেয়া হয় তা তারা আদি প্রথামতে তাদের পরিবারকে দিয়ে দেয় এবং সবাই সেটা ভাগাভাগি করে খায়। তাই সেই শিশুটি এই অনুচ্ছেদটি প্রকাশিত হওয়ার আগেই মারা যাবে।
আবার লাখ লাখ শিশু মারা নাও যেতে পারে। তারা বেঁচে থাকবে, স্রেফ বাঁচার জন্য। আরও সাত কোটি প্রাপ্তবয়স্কদের সাথে তারাও বেঁচে থাকবে। আশাহীন, শিক্ষাহীন, কোন উদ্দেশ্যহীন। হিংস্র বাগাড়ম্বরে পরিপূর্ণ বাংলাদেশের বিদ্রোহীরা তাঁদের আয়ত্ব করে নিবে। আর তাঁদের মনে থাকবে পাকিস্তানী ট্যাংক গুলো হটিয়ে তাঁদের জন্মভূমি দখল করে নেয়ার মিছে আশা।
এটি একটি ভয়াবহ এবং বিপদজনক দৃশ্য। সবাই কোন সমাধান না করেই ভীতসন্ত্রস্ত এবং এমন উচ্ছন্ন কেন হয়েছে তা সহজেই অনুমেয়।
এর সাথে শিবিরের আশেপাশের মূর্ত স্মৃতি। বৃদ্ধা মহিলা বন্যার মাঝে দুই ঘড়া চাল নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পানি তার কাঁধ সমান। ঘড়াটা কাঁধের ঠিক উপরেই সে ধরে আছে। বেশির ভাগ সময়েই কিছু শিবিরের যে কয়টা তাঁবু অবশিষ্ট আছে ওখানে যেতে হলে বাঁশের তৈরি সরু সাঁকো পার হতে হয়। পুরো পরিবার কাদায় মাখা মাখি হয়ে যায় এবং তার চেয়েও বড় কথা স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত এ মানুষগুলোর মনের দাগও যায় না যখন বন্যার পানি ভেঙ্গে তারা খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রে পৌঁছাতে সংগ্রাম করে যায়।
একটা শিবির ছিল দিয়ারা, প্রায় ৩০০০০ শরনার্থী তাঁদের শুষ্ক তাঁবুতে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল। সবাই যথাযথভাবে তাঁদের মাথা গোঁজার ঠাই পেয়েছিল। কিন্তু সেই শিবিরও রাতারাতি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেল। তাঁদের যাবতীয় সহায় সম্পত্তি হারিয়ে যায় এবং পাশেরই এক উঁচু জায়গায় তারা আশ্রয় নেয়। তৃতীয় বা চতুর্থ বারের মতো তারা আবার তাঁদের জীবন সংগ্রামে নতুন করে লেগে পড়ে।
হাসনাবাদ রেল ষ্টেশন এ একটি অভ্যর্থনা কেন্দ্র ছিল। খাদ্যের রেশনের জন্য কাতর জনতার ভিড় সেখানে দুঃস্বপ্নের মত। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা এতই ক্লান্ত যে আর তারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তরুণ যুবারা ফোলা চোখে দাঁড়িয়ে আছে। তাঁদের প্রত্যেকের ত্বকে খুশকির আস্তরন পড়ে গেছে পুষ্টির অভাবে। মৃত বাচ্চাদের দাঁত অস্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে আছে তাঁদের শুকিয়ে যাওয়া মুখ থেকে। শক্তিসম্পন্ন লোকেরা তাঁবুতে বেকার বসে থাকা ছাড়া আর কিছু করার পায় না। অথবা স্থানীয় গৃহস্থালি হতে বিশেষ খাবার পাওয়ার আশায় দরাদরি করে তাঁদের রুপির মজুদটা শেষ করে দিচ্ছে।
এই দৃশ্য সবখানে; যে কেউ একের পর এক তালিকা দিয়ে যেতে পারবে। এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা হল বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর কি হবে সেটা চিন্তা করা। শরণার্থী এবং আবাসনচ্যুত ভারতীয় কৃষকদের মাঝে রাজনৈতিক গণ্ডগোল এসময়ে সবচেয়ে বাজে অবস্থা হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ তারাও বাংলায় শীতের কারণে খাদ্যাভাবে আছে। এদিকে একটু গরম থাকাতে এখানে এটা খুব বড় বিষয় নয়। কিন্তু সিলেটের দক্ষিণ দিয়ে আসামে এখনই ঠাণ্ডা বেশ পড়ে গেছে। দুই মাসের মধ্যে ওখানে বরফ জমে যাবে, তুষার পড়বে এবং টানা ঠাণ্ডা লেগেই থাকবে।
বাঙ্গালী শরণার্থীদের কোন কাপড় নেই, কম্বল নেই। তাঁবুও খুব বেশি নেই। ৩০ লাখ কম্বল, কাপড় আর সুষ্ঠু তাঁবু এসব মানুষদের জন্য এখনই দরকার।
তো এই ৯০ লাখ শরণার্থী ইতোমধ্যে রাজনৈতিক কুশাসন সয়ে এসেছে, এরপর ঘূর্ণিঝড় পারি দিয়ে এসেছে, এরপর একটি যুদ্ধ দেখেছে, এরপর গৃহহারা হয়েছে, ক্ষুধা, রোগ-শোক এবং শরনার্থী হবার আরো যা যা প্রাপ্য আছে তা সবই তাঁদের ধারন করতে অক্ষম এক দেশে তারা পেয়েছে। এরপর তারা বন্যাদুর্গত হয়েছে। আর এখন তাদেরকে এই তীব্র শীত সহ্য করতে হচ্ছে।
যেমনটা আমি বলেছিলাম, বিগত ৩০ বছরের ইতিহাসে পুরো পৃথিবীতে এমন দুর্যোগ আর কেউ দেখে নি। এবং আমি যেটা বুঝাতে চেষ্টা করেছি, এই দুর্যোগ এতই ভয়াবহ যে সুষ্ঠু কোন ব্যবস্থা

কোলকাতার সকল সাংবাদিকরা জানে সেই সাথে অক্সফাম ও অন্যান্য রিলিফ কর্মীরা যে আমরা অনেক বড় সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এখন শুধু দান কিংবা সমবেদনার মত অবস্থা নয়। সর্বোপরি, গোটা বিশ্ব দানশীলতার পরিচয় দিয়েছে। গত মে মাসে যখন কলেরা মহামারী আকারে দেখা দিয়েছিলো তখন আমরা আমার সব টাকা পয়সা ঢেলে দিয়েছিলাম, তাই গোটা বিশ্ব এখন বস্তুত পক্ষে কার্যকর দানের ব্যাপারে ক্লান্ত। তদুপরি, আসল দান দেখানো উচিৎ আমাদের নির্মম রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যেখানে স্পষ্টতই পাকিস্তানী সরকার এর জন্য বরাদ্দ, যেটা টিকে আছে বিদেশী অর্থ আর মিলিটারি সহযোগিতা নিয়ে, এটা আরও খারাপ পথে যাবে যদি না বর্তমান নীতি পরিবর্তন করা না হয়। রাজনৈতিক কর্মসূচি প্রবাহিত হচ্ছে সেনাবাহিনীর অফিসার দ্বারা যারা ইয়াহিয়া খান কে মদত দিচ্ছে।
যদি তাদেরকে ইয়াহিয়া খান কে পরিত্যাগ করতে পারা যায় আর তাকে তার পূর্বের ভুলের জন্য বলির পাঁঠা করা যায় তাহলে নতুন নীতির সমন্বয়সাধনের একটা সুযোগ পাওয়া যেতে পারে । এটাই প্রথম অপরিহার্য কাজ। তারপর কি হবে সেটা এখনো স্পষ্ট নয়। হয়তো স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হতে পারে কিন্তু সেটা অনেক গুলো সমস্যার ও তৈরি করবে। হয়তো পাকিস্তানের একটি নতুন সংবিধান হবে যেখানে পূর্ব অংশ কেন্দ্রীয় ভাবে পশ্চিমের সাথে যুক্ত হবে অথবা শেষমেশ একটি নতুন জাতিগত বাংলা রাষ্ট্র তৈরি হবে যাতে অর্ধেক মুসলিম, অর্ধেক হিন্দু আর ভারত ও পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে যাবে। সব সম্ভাবনাই এখন বিপদজনক। কিন্তু কোন কিছুই এতোটা বিপদজনক হবেনা এখনকার অবস্থা চলতে দেবার মত।
বড় শক্তিগুলোকে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক ভাবে বুঝাতে হবে যে পরিবর্তন দরকার আর সেটা খুব জলদি ই করতে হবে। তাদেরকে অর্থ, খাদ্য, সব কিছু দিয়ে ঐ সব পূর্ব পাকিস্তানী শরণার্থী যারা কিনা ভারতে অবস্থান করছে তাদের অনেক ব্যাপক পরিসরে সাহায্য করতে হবে।

যদি তারা থাকতে চায় তাহলে শত সহস্র পাউন্ড ও চ্যানেল বয়ে যাবে জাতিসংঘের এজেন্সি গুলোর মাধ্যমে। এটা নাহলে গ্র্যান্ড হোটেলের বিলাসবহুল সুইমিং পুল ভীতিগ্রস্ত, বাতুল, বিষণ্ণ হয়ে যাবে। স্থানীয় কূটনীতিকরা এভাবেই রহস্য করে কথা বলবে আর রাতে ঘুমাবেনা। সহস্র সহস্র বাচ্চারা মারা যাবে। সাথে হাজার হাজার বয়স্করাও। এর ফলশ্রুতিতে হাজার হাজার জীবিত মানুষের জীবন এই নির্মম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাবে।

ক্লারি হলিংঅরথ
ইন্ডিয়ার যাবার লম্বা রাস্তা
(ডেইলি টেলেগ্রাফ থেকে ক্লারি হলিংঅরথ। পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ। ৮০ লক্ষ মানুষ তাদের নিজেদের দেশেই শরণার্থী, অসহায় ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ভারতের দিকে চেয়ে আছে )

পূর্ব পাকিস্তানে আজ পর্যন্ত ৮০ লক্ষ মানুষ, স্ত্রী লোক, শিশুরা তাদের নিজেদের দেশে গৃহহীন , “শরণার্থী”।
গ্রামবাসীরা এদিক ওদিক অসহায়ের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে আর ভারতের পানে চেয়ে আছে, কখনো কখনো হতবম্ব হয়েই ভুল পথে পা বাড়াচ্ছে। কিন্তু এদের মধ্যে ক্ষীণ সন্দেহ হয় যে এই বিশাল ভুক্তভুগি জনগোষ্ঠী সীমানা পারি দিচ্ছে শরণার্থী শিবিরের খাবার আর থাকার আশায়।

একটা বড় অংশ ভয়ে তাদের ঘর বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে, যখন তারা গুলির শব্দ শুনছে অথবা দেখছে যে তাদের পাশের বাড়ি অথবা পাশের গ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা পুড়িয়ে দিচ্ছে মুক্তি বাহিনী – স্বাধীন বাংলার সৈন্য দের আগ্রাসনের প্রতিশোধ নেবার উদ্দেশ্যে

কিছুকিছু নারীরা স্বভাববসতই কিছু থালা বাসন আর কিছু চাল নিয়ে কোন জলাভূমির দিকে দৌড় দিচ্ছে। সৌভাগ্য বসত কিছু লোকের কাছে কিছু টাকা করি ছিল তাদের পকেটে, যা খুব তাড়াতাড়ি ই শেষ হয়ে যাবে। এই সব লোকদের চলার পথ গুলো খুব ভালো ভাবেই পাকিস্তানী আর্মি দের সচরাচর চলার পথ থেকে আলাদা। কোন আর্মি জীপের শব্দ শুনলেই সবাই কাছাকাছি কোন জঙ্গলায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে। কেউ কেউ বসতদিন গ্রাম গুলোতে আশ্রয় নিচ্ছে কিন্তু তারা স্থানীয় ভাবে কোন খাবার জোগাড় করতে পারছেনা। তারা এখন মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে কোথাও সাহায্যর জন্য বের হলে আর্মিরা তাদের যুবক ছেলে আর মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে।

খরা মৌসুমের দরুন, নৌকার কমতির কারণে, আর মুক্তি বাহিনীর রেলওয়ে, রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে ফেলার কারণে এই সব করুন লোকদের কোথাও যাবার ঠাই নেই, এমন কি সেই সব জায়গাও যেখানে খিস্টান মিশন আর ইয়উরপিয়ান রা সাহায্য করছে।

এটা বলা কঠিন যে এই সব লোকদের কতজন ভারতে যাবার পথেই মারা যাচ্ছে, ডাক্তার দের মতে পাঁচ ভাগের ১ ভাগ অন্তত। আমি এই লোকগুলোর মধ্যে খুব বড় ধরনের অপুষ্টির লক্ষণ দেখতে পারছি।

এই সব শরণার্থী আর ভবঘুরে লোকদের মধ্যে জরুরী ভিত্তিতে খাবার, পোশাক আর চিকিৎসা সেবা দেয়া দরকার কিন্তু এটাই সবচেয়ে কঠিন যে কিভাবে তাদের এই সেবা গুলো পৌঁছে দেয়া যাবে যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা ভারতের সীমানায় না আসে অথবা জাতিসংঘের উচিৎ পাকিস্থান সরকার কে চাপের মুখে রেখে কিছু সংখ্যক রিলিফ কর্মী বাড়াতে যারা কিনা এই সব খাবার বণ্টনে সহায়তা করবে। এখন পাকিস্তান সরকার পর্যবেক্ষক দল গুলোকে এটা দেখাতে রাজি হয়েছে যে তাদের উপহারক্রিত খাবার গুলো ঠিক ঠিক লোকের মুখে যাচ্ছে। খাবার একটি রাজনৈতিক অস্ত্র আর এটা খুবই দুর্লভ, “ভালো মানুষেরা” যারা কিনা পাকিস্তান আর্মি দ্বারা তৈরি শান্তি কমিটির সদস্য, তারা এগুলো রাজনৈতিক কর্মীদের খাওয়াচ্ছে।

আর “ খারাপ মানুষেরা” যারা পাকিস্তানের পক্ষে নয়, যাদের কিনা বাংলাদেশের প্রতি সহমর্মিতা আছে, তাদের প্রতি পাকিস্তানী আর্মি প্রশাসনের আচরণ খুবই খারাপ।

হাজার হাজার মানুষ না খেতে পেরে নাভিশ্বাস হয়ে উঠেছে তাদের নিজেদের বাসায় যদিও তাদের পার্শ্ববর্তী বাজারে প্রচুর চালের মজুদ আছে , কিন্তু তাদের সেটা কেনার মত ক্ষমতা নেই, অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙ্গে গেছে। এই যুদ্ধের কারণে চাষিরা ফসল ফলাচ্ছে না , লোকজনেরা তাদের কাজ থেকে “কর্ম বিরতি” নিয়েছে। আবারো, নিরপেক্ষ ভাবে এই রিলিফের খাবার বণ্টন হওয়া জরুরী কেননা এটা নাহলে হাজার হাজার মানুষ তাদের নিজেদের পরিচিত বসত ভিটে ছেড়ে ভারতের পথে পা বাড়াবে।

এই হাজার হাজার, হয়তো লাখ পেরিয়ে যাবে এই সব লোকদের বেঁচে থাকার জন্য একটাই মাত্র পথ খোলা আছে সেটা হচ্ছে, রিলিফ কার্যক্রম অতি শীঘ্রই চালু করা। এই দুর্ভিক্ষ এড়ানো যাবেনা কারণ শরতে যখন নতুন শস্য উঠবে তখন এখনকার চেয়ে আরও ২০ লক্ষ টন ধান প্রয়োজন হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বন্দর গুলো থেকে খাদ্য গুলো প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যেতে কোন ট্রেন, লরি অথবা খুব কম নৌকা আছে। যে জিনিসটা এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে কিছু স্পিড বোট আর ট্রাক যাতে করে কর্তিপক্ষ সেই শস্য গুলো পরিচিত জায়গা ছাড়াও অন্যান্য পথে রাজধানী থেকে নিয়ে যেতে পারে।

বার্নার্ড ব্রেইন, সংসদ সদস্য
বাংলার এই দূর্দশাজনক পরিস্থিতিতে যেটা ক্ষমার অযোগ্য তা হলো, মাসের পর মাস আমরা দেখছি এটি বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে কিন্তু এটি বন্ধের জন্য কেউ কিছুই করছে না। এটা প্রকাশ্য সুস্পস্ট যে, বৃহৎ ও ক্রমবর্ধমান শরণার্থীদের বোঝাক্রান্ত ভারত বা দূর্ভিক্ষের সম্ভবনার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা পাকিস্তান কেউই বাইরের সহায়ত ছাড়া নিজেদের সামলে উঠতে পারবে না। তবুও এখন পর্যন্ত উ থান্টের সাহায্যের আহ্বানের বিপরীতে সাড়ার পরিমান দুঃখজনকভাবে অপর্যাপ্ত। বিশ্ববাসীর এখনই কিছু করা উচিত, অথবা অকল্পনীয় মাত্রার মানবিক বিপর্যয়ের সাক্ষী হতে প্রস্তুতি নেওয়া উচিত।

মার্ক এডওয়ার্ডস, কিস্টোন প্রেস এজেন্সি
পরিণত বয়সী শরণার্থীদের মাঝে চূড়ান্তরকমের ক্লান্তি ছড়িয়ে গেছে। রাজনৈতিক আন্দোলনকারীরা কোনো আন্দোদোলনে নামার আগে, যা এমনকি সহিংস আন্দোলনও হতে পারে, তারা কতদিন টিকে থাকবে তা শুধু কেউ কেউ কল্পনাই করতে পারে।

টাইগার স্ট্যাক, অক্সফাম
শরনার্থী শিবিরে চূড়ান্ত মানবিক অবক্ষয় ও দূর্ভোগের মাঝে বেঁচে থাকার পরে দেশে ফিরলে জনগনের প্রত্যেকেরই একটি বিষয়ই মনে পড়বে… তাদের ঘর-গৃহস্থালি বিষয়ক দূর্ভাবনা।

আর্নেষ্ট হিলেন, উইকেন্ড ম্যাগাজিন
পূর্ব পাকিস্তানে চলমান বিপর্যয় বিষয়ে এখন পর্যন্ত সরকার ও কানাডার জনগনসহ অন্যদের মনোভাব মূলত নিস্পৃহ। এবং এটা বিশ্বাস করা শক্ত। পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তের শখানেক মানবেতর শরণার্থী শিবিরের একটিতে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে থেকে এটি বুঝতে পারা কঠিন। এতো সংখ্যাক মানুষ ভুগছে ও মারা যাচ্ছে যা নজিরবিহীন এবং এই সংখ্যা বাড়ছে। এখানে ব্যাপক দূর্ভিক্ষ চলছে এবং যুদ্ধের সমূহ আশঙ্কা আছে।
ডাঃ টিম লাস্টি, স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তার
কলকাতার ৭০০ মাইল উত্তরের কুচবিহারের এক শরণার্থী শিবিরে এক দুপুরে হেঁটে বেড়ানোর কথা আমি মনে করতে পারি। পথে চটের উপর পড়ে থাকা অসুস্থ ও মুমুর্ষু শিশুদের জন্য আমরা কয়েক দফা থমকে দাঁড়িয়েছিলাম। নরওয়েজিয়ান শিবির পরিচালককে আমি জিগ্যেস করেছিলাম অপুষ্টির কি উন্নতি হচ্ছে না কি আরও অবনতি হচ্ছে। তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘অবনতি হচ্ছে।’
দিনের মাঝেই অক্সফাম সে এলাকায় কার্যরত ভারতীয় চিকিৎসক দলকে নিয়ে আসে, কিন্তু ব্যক্তিগত দাতব্য কাজের কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। সৌভাগ্যবান মানুষদের উদ্বিগ্নতার মাত্রা দিয়ে এই সীমা নির্ধারিত হয়।

ডেভিড হার্ট, এসসিএফ স্বেচ্ছাসেবক
চা-উৎপাদনকারী হিশেবে আমি পূর্বস্থানীয় অঞ্চলে ১৪ বছর কাটিয়েছি তাই সেখানকার অবস্থা সম্পর্কে আমি জানি। গত নভেম্বরে সাইক্লোনের পরে আমি পূর্ব পাকিস্তানীদের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা এবং পরবর্তীতে তাদের দূর্ভোগ ও দূর্দশা দেখেছিলাম। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ভারতের শরণার্থী শিবিরে আমি যে দুঃখজনক পরিস্থিতি দেখেছি তার সাথে তুলনা চলে এমন কিছু আমি কখনও দেখিনি।