শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২৩১। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি এবং তার ওপর আলোচনা | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী | ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান সংক্রান্ত বিবৃতি
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ( মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, ইলেকট্রনিক্স মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ) — ভয়ানক বিরোধীতার মুখোমুখি সাহসী সংগ্রামের ফলে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে বীরত্বের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
পূর্বে, তারা নির্বাচনে বিশাল গণতান্ত্রিক জয় নিশ্চিত করে এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিও শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার ন্যায়সঙ্গত দাবী মেনে নেয়। আমরা কখনোই জানবো না যে যদি এই সদাশয় আচরণ এবং বাস্তব পদক্ষেপ সত্যি হয়ে থাকে তবে কিসের হস্তক্ষেপে তা বিশ্বাসঘাতকতা ও ঘৃণায় রূপান্তর হয়।
আমাদেরকে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার দল আওয়ামী লীগ পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিরোধ আন্দোলনের পরিকল্পনা করে। কিন্তু তাদেরকে অনবগত অবস্থায় পাশবিক সামরিক হামলার শিকার হতে হয়। স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া ছাড়া তাদের আর কোন বিকল্প ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট মিলে মুক্তি ফৌজ গঠন হয় যা পরবর্তীতে মুক্তি বাহিনী নাম দেয়া হয় এবং নিজেদের ভবিষ্যত রচনা এবং দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতে দৃঢ়বদ্ধ সহস্রাধিক পূর্ব বঙ্গের যুবক এই মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করেন। যেই একতা, দৃঢ়তা, এবং সাহসিকতার সাথে সমগ্র বাংলাদেশের জনগণ এই স্বাধীনতার সংগ্রাম করছে তা বিশ্ব সংবাদ মাধ্যমগুলোতে নথিভুক্ত করা হয়েছে।
আমাদের সামনে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনা এবং এর ফলশ্রুতিতে আমাদের সীমান্তে বাঁধ ভাঙ্গা শরণার্থীদের আগমন আমাদের দেশের ওপর এর চেয়ে বেশী সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলতে পারে না। এটা অবশ্যই স্বাভাবিক ব্যাপার যে বাংলাদেশের জনগণের সাম্প্রতিক সংগ্রামে আমাদের সহানুভূতি থাকবে। কিন্তু আমরা বাংলাদেশের স্বীকৃতির ব্যাপারে কোন হঠকারী পদক্ষেপ নেই নি। আমাদের সিদ্ধান্ত কোন আবেগ বশত ছিল না বরং প্রাদুর্ভূত ভবিষ্যৎ বাস্তবতার মূল্যায়ন থেকে নেয়া।
বাংলাদেশের সমগ্র জনগণের সর্বসম্মত বিদ্রোহ এবং সংগ্রামের সাফল্য থেকে এটা প্রকট হয়ে উঠেছে যে, তথাকথিত পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার বাংলাদেশের জনগণকে এর শাসনের অধীনে পুনরায় ফিরিয়ে আনতে অক্ষম। আর বাংলাদেশের সরকারের বৈধতা বিষয়ে এ মুহূর্তে সারা বিশ্বই অবগত যে এটা বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতের প্রতিফলন যা আগের কোন সরকারের সময়ে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন হিসেবে প্রকাশ পায়নি। এই মানদণ্ডে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা অনেক রাজ্যেই তাদের শোষণ চাপিয়ে দিতে উদ্বিগ্ন হলেও পশ্চিম পাকিস্তানে নিজেদের লোকদেরই প্রতিনিধিত্ব করার সমর্থন পায়নি।
এমতাবস্থায় যখন পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন আমাদের পক্ষ থেকে স্বাভাবিক সংশয় কাজ করছে যাতে আমরা এমন কিছু না করি যাতে শান্তিপূর্ণ অবস্থার ব্যতিক্রম ঘটায় অথবা, এমন কোন মধ্যবর্তী অবস্থার ব্যাখ্যা করে যা বর্তমান অবস্থায় তাৎপর্যহীন। বাংলাদেশের জনগণ তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে আর ভারতের জনগণ লড়াই করছে আগ্রাসনের পতন ঘটাতে, এবং উভয়ই বর্তমানে নিজেদের একই পথের সহযাত্রী হিসেবে খুঁজে পেয়েছে।
বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে এবং বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আমি এই সভায় এটা জানাতে পেরে অত্যন্ত আনন্দিত যে, কঠোর বিবেচনার পর ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এর স্বীকৃতি দানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আমরা আশা করি সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য জাতিও স্বীকৃতি প্রদান করবে এবং অচিরেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন জাতীয়তার একটি অংশ হয়ে উঠবে।
এই মুহূর্তে এই নতুন রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমবেদনা ও সমর্থন রয়েছে। আমি নিশ্চিত এই সভার সকলেই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের সকল সহকর্মীকে আমাদের তরফ থেকে শুভেচ্ছা ও উষ্ণ সংবর্ধনা জানাবে।
আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে পাওয়া যোগাযোগ পত্রের অনুলিপি এই সভার সামনে উপস্থাপন করছি। মাননীয় সংসদ সদস্যগণ জেনে খুশী হবেন যে, বাংলাদেশ সরকার তাদের রাষ্ট্রের মূল নীতি ঘোষণা করেছেন। এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং এমন একটি সমাজ ব্যবস্থা যেখানে ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সকলের সমান অধিকার থাকবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার উপনিবেশবাদ, স্বজাতিকতা এবং সাম্রাজ্যবাদের সাথে জোট নিরপেক্ষভাবে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের নীতি অনুসরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা ভারতও অনুসরণ করে।
বাংলাদেশ সরকার আমাদের দেশে অস্থায়ী শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের জমি এবং সম্পত্তির পুনর্বাসনের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। আমরা স্বাভাবিকভাবে এই ব্যাপারে সম্ভাব্য সকল উপায়ে তাদের সহায়তা করবো।
আমি বিশ্বাস করি ভবিষ্যতে ভারত ও বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ যারা একই আদর্শ ও উৎসর্গে বিশ্বাসী, এমন একটি পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরি করবে যার মূল ভিত্তি হবে পারস্পরিক সার্বভৌমত্ব ও প্রাদেশিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, সমতা ও পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষা করা। এইভাবে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্য একসাথে কাজ করে আমরা আদর্শ প্রতিবেশী রাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি যা এই অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও অগ্রগতি নিশ্চিত করবে। বাংলাদেশকে আমাদের শুভেচ্ছা।
ভারতীয় রাষ্ট্রপতি বরাবর ২৪.৪.১৯৭১ এ লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের চিঠি।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর
এপ্রিল ২৪, ১৯৭১
বরাবর
ভারতীয় রাষ্ট্রপতি
নয়া দিল্লী
মহামান্য,
২৬শে মার্চ, ১৯৭১ এ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা ঘোষণার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রধাণ করে সরকার গঠন করা হয়।
আপনার অবগতির জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র, আইনের ধারাবাহিকতা বলবতকরন এবং সংসদ সদস্যদের তালিকার একটি অনুলিপি “ক”, “খ” এবং “গ” অক্ষর দ্বারা চিহ্নিত করে এই পত্রের সাথে সংযুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার ২৬ শে মার্চ, ১৯৭১ এর আগ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত অঞ্চলে পূর্ণ সার্বভৌমত্ব ঘোষণা ও আইন প্রণয়ন করেছে এবং আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন অনুসারে রাষ্ট্রের সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে।
বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের মধ্যকার ঐতিহ্যগত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের প্রেক্ষিতে আমি আপনার মহামান্য সরকারের কাছে বিনীত আবেদন জানাচ্ছি যাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন ও রাষ্ট্রদূত বিনিময় করে কৃতজ্ঞ থাকবে যাতে করে আমাদের দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়।
মহামান্য, দয়া করে আমাদের প্রতিশ্রুতির সর্বোচ্চ বিবেচনা করবেন।
স্বাক্ষরিত/- (সৈয়দ নজরুল ইসলাম)
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি
স্বাক্ষরিত/- (খন্দকার মোশতাক আহমেদ)
(বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর) পররাষ্ট্র মন্ত্রী
(ক) স্বাধীনতার ঘোষণা
মুজিবনগর, বাংলাদেশ
তারিখ – ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১
যেহেতু, রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচনের লক্ষে ৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭০ থেকে ১৭ই জানুয়ারী, ১৯৭১ পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
এবং
যেহেতু, এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করে যারা আওয়ামী লীগের সদস্য।
এবং
যেহেতু, জেনারেল ইয়াহিয়া খান রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনের উদ্দেশে ৩রা মার্চ, ১৯৭১ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিমন্ত্রণ জানান।
এবং
যেহেতু, সংসদ অধিবেশন অন্যায় ও অবৈধভাবে অনিদৃস্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছ।
এবং
যেহেতু, বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া অবস্থায় প্রতিশ্রুতি পূর্ণ না করে পাকিস্তান কতৃপক্ষ অন্যায়ভাবে ও বিশ্বাসঘাতকতা করে যুদ্ধ ঘোষণা করে।
এবং
যেহেতু, পাকিস্তান কতৃপক্ষ এই নির্মম ও হিংস্র যুদ্ধ সংগঠিত করার পর এখনও বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের অসামরিক এবং নিরস্ত্র জনগণের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার ও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
এবং
যেহেতু, পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া এই অন্যায় যুদ্ধ এবং গণহত্যার এবং অন্যান্য দমনমূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের পক্ষে সরকার গঠন ও শাসন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
এবং
যেহেতু, বাংলাদেশের জনগণ তাদের বীরত্ব, সাহসিকতা এবং বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড দ্বারা নিজেদের অধিকারভুক্ত অঞ্চলের উপর কার্যকরীভাবে দখল নিয়েছে।
আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের জনগণের দেয়া এমন এক সম্মানে আবদ্ধ যাদের ইচ্ছায় মূলত আমরা নিজেদের সংগঠিত করেছি যাতে একটি গণপরিষদ গঠন করতে পারি,
এবং
বাংলাদেশের জনগণের জন্য সমতা, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা পারস্পরিক আলোচনা করেছি,
সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গঠন ও সেকারণে ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কতৃক দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা,
এবং
এই মর্মে প্রত্যায়ন এবং সংকল্প করা হচ্ছে যে, একটি পূরনাঙ্গ সংবিধান প্রণীত হবার সময় পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি থাকবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম সহকারী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন, এবং প্রজাতন্ত্রের সকল সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক থাকবেন রাষ্ট্রপতি, ক্ষমা মঞ্জুরের ক্ষমতা সহ প্রজাতন্ত্রের সকল নির্বাহী ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা রাখবেন, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন অনুসারে অন্যান্য মন্ত্রী নিয়োগের ক্ষমতা রাখবেন,
কর প্রয়োগ এবং রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যায় সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, গণপরিষদ সংগঠন ও স্থগিত করার ক্ষমতা,
এবং
বাংলাদেশের জনগণের জন্য আইনসম্মত ও সুশৃঙ্খল সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেয়া।
আমরা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ আরও নিশ্চিত করছি যে, এমন কোন সময়ে যদি রাষ্ট্রপতি না থাকেন বা রাষ্ট্রপতি তার দপ্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম না হন বা যেকোনো কারণে রাষ্ট্রপতি তার দায়িত্ব ও ক্ষমতার ব্যবহারে অক্ষম হন তবে, রাষ্ট্রপতির সকল দায়িত্ব ও ক্ষমতা সহকারী রাষ্ট্রপতির উপর বর্তাবে।
আমরা এই মর্মে আরও অঙ্গীকার করছি যে, জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী এর সদস্য দেশের উপর বর্তানো সকল দায়িত্ব ও কার্যাবলী সঠিকভাবে পালন করা হবে।
আমরা আরও সাব্যস্ত করছে যে, স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬শে মার্চ, ১৯৭১ থেকে কার্যকর হয়েছে।
আমরা আরও সাব্যস্ত করছি যে, এই দলিল কার্যকর করতে এবং রাষ্ট্রপতি ও সহকারী রাষ্ট্রপতির শপথ গ্রহণের জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইয়ুসুফ আলী কে আমাদের সাংবিধানিক আইন প্রণেতা হিসেবে নিয়োগ করছি।
স্বাক্ষরিতঃ
এম. ইয়ুসুফ আলী সাংবিধানিক আইন প্রণেতা
বাংলাদেশ সংবিধান ও গণপরিষদ
(খ) আইনের ধারাবাহিকতা বলবৎকরণ আদেশ
মুজিবনগর
তারিখ – ১০ই এপ্রিল, ১৯৭১
আমি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ১০ ই এপ্রিল, ১৯৭১ এ স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র অনুযায়ী সহকারী রাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বরত, এই মর্মে ঘোষণা করছি যে, ২৫শে মার্চ, ১৯৭১ এর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে কার্যত সকল আইন বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছায় গঠিত সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রয়োজন সাপেক্ষে পরিবর্তন করে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হবে। সকল সরকারী কর্মকর্তা তথা বেসামরিক, সামরিক, বিচারিক এবং কূটনৈতিক কর্মকর্তাগণ যারা বাংলাদেশের আনুগত্যের স্বপক্ষে শপথ গ্রহণ করবেন, তারা যতদিন নিজেদের দায়িত্ব উপভোগ করতে পারবেন ততদিন কর্মরত থাকবেন এই শর্তে নিজ নিজ কর্মস্থানে যোগদান করতে পারবেন। বাংলাদেশের সীমানার মধ্যে সকল জেলা বিচারক এবং জেলা প্রশাসকগণ এবং অন্যত্র সকল কূটনৈতিক প্রতিনিধিগণ নিজেদের আয়ত্তের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের এই শপথ গ্রহণের আয়োজন করবেন।
২৬শে মার্চ, ১৯৭১ থেকে এই আদেশ কার্যকর হবে।
স্বাক্ষরিতঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি
(গ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মন্ত্রী পরিষদ সদস্য —
রাষ্ট্রপতিঃ শেখ মুজিবুর রহমান
সহকারী রাষ্ট্রপতিঃ সৈয়দ নজরুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রীঃ জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ
পররাষ্ট্র এবং সংসদ বিষয়ক আইন মন্ত্রীঃ খন্দকার মোশতাক আহমেদ
অর্থ, বাণিজ্য এবং শিল্প বিষয়ক মন্ত্রীঃ জনাব এম. মনসুর আলী
অভ্যন্তরীণ, সরবরাহ, ত্রাণ এবং পুনর্বাসন বিষয়ক মন্ত্রীঃ জনাব এ.এইচ.এম. কামরুজ্জামান
———–
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর ১৫.১০.১৯৭১ এ লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চিঠি।
( বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর )
মুজিবনগর
১৫ ই অক্টোবর, ১৯৭১
মাননীয়া,
ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১ এ লেখা চিঠির ধারাবাহিকতায় এবং পরবর্তী যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা এই চিঠি লিখছি। মাননীয়া, আপনি অবগত আছেন যে, ১০ ই এপ্রিল সংসদীয় সভার সদ্য নির্বাচিত জাতীয় এবং আঞ্চলিক সদস্যগণ স্বাধীনতার ঘোষণা দেন যা কিনা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনতার ইচ্ছারই প্রতিফলন। একতরফা ও নিষ্ঠুর আচরণ ও জনগণের রায় কে অস্বীকার করে এবং ২৫ শে মার্চ, ১৯৭১ থেকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কতৃক বাংলার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার ও মৌলিক মানবাধিকার ক্ষুণ্ণ করার প্রেক্ষিতে এই ঘোষণার বাস্তবায়ন হয়।
এটা সর্বজনবিদিত যে, দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জনগণ নির্মম ঔপনিবেশিক আধিপত্য, অর্থনৈতিক শোষণ এবং ধারাবাহিকভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন বৃত্তের স্থূল রাজনৈতিক শোষণ ও সাংস্কৃতিক বৈষম্যের শিকার। ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১ এর চিঠির মাধ্যমে আপনাকে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অধীনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গঠনতন্ত্রের কথা জানানো হয়েছে।
বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের জনগণ মৌলিক অধিকার আদায়ের দাবীতে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলন চালিয়ে আসছে। এমনকি পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কতৃক জাতীয় সংসদ স্থগিত করে দেবার পরও আমরা সহিংসতার পথে না গিয়ে আমাদের অহিংস আন্দোলন জারি রেখেছিলাম। পাকিস্তানী সামরিক শাসক এই অবস্থার সুবিধা নিয়ে ২৪শে মার্চ, ১৯৭১ এর রাত পর্যন্ত তথাকথিত আলোচনার মিথ্যা বাহানা দিয়ে নিজেদের সৈন্য বহরের শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে।
২৫ শে মার্চের কালো রাতে তাদের পরিকল্পনা পুরো বিশ্বের সামনে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে যখন পূর্ব পরিকল্পিতভাবে তারা আমাদের দেশের নিরীহ ও অসহায় নারী, পুরুষ ও শিশুদের উপর তাদের সেনা বাহিনী লেলিয়ে দেয়। তারা আমাদের বুদ্ধিজীবী, জুবক ও শ্রমিক নেতা, কৃষক ও ছাত্রদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। এই পরিস্থিতি আমাদের অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য করে।
১০ই এপ্রিলের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণার পর আমাদের মুক্তির সংগ্রামে অনেক শক্তি ও গতি সঞ্চার হয়েছে। প্রাক্তন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এবং অন্যান্য আধা সামরিক বাহিনী থেকে প্রায় ৬০০০০ সদস্য বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনতার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে মাতৃভূমির মুক্তির লক্ষ্যে অস্ত্র হাতে নিয়েছে। এরকম আরও শত সহস্রাধিক যুবক তাদের কাছে প্রশিক্ষন গ্রহণ করে দেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে যোগ দান করে যাতে এই ঔপনিবেশিক আগ্রাসনের বন্ধন থেকে দেশকে মুক্ত করতে পারে।
বাংলা ভাষা ভাষী মানুষের সংখ্যাগরিষ্ঠতা হ্রাস ও নেতৃত্ব শুন্য করার লক্ষ্যে দমন নীতি ও বর্বরতা বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। এই গণহত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও লুণ্ঠন এর ফলশ্রুতিতে প্রায় নব্বই লক্ষ পুরুষ, মহিলা ও শিশু আপনাদের দেশে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে এবং আরও অনেকে দেশ ত্যাগ করছে।
আমাদের অবিসংবাদিত নেতা ও রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে গোপনে সামরিক বিচার পরিচালনা করে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। গত ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে এককভাবে জয়ী আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী নির্বাচিত ৭৯ জন জনপ্রতিনিধিকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে এবং তথাকথিত জনগণের সরকারের নাম দিয়ে পরাজিত ও দেশদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে সরকার গঠন করেছে যা পাকিস্তানের সামরিক জান্তার সমর্থন প্রাপ্ত। এই আচরণে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি জনতা প্রতারিত হয়নি বরং এর ফলে সামরিক শোষকদের কপটতা ও প্রতারণার মূল ছবি উদ্ভাসিত হয়েছে। আর এই সব থেকে আমরা বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য আরও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়েছি।
মাননীয়া, আমরা আপনাকে জানাতে পেরে আনন্দিত যে আমাদের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সফল হচ্ছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মুক্তি সেনার দল মুক্তি বাহিনী দেশের অর্ধেক অঞ্চলের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন নিয়েছে। আমরা আরও নিশ্চিত করছি যে, বাংলাদেশ সরকার এই অঞ্চলে অত্যন্ত কার্যকর বেসামরিক প্রশাসন স্থাপন করেছে যার কার্যক্রম অত্যন্ত সুন্দর ভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এই অগ্রগতি এখনও সকল জনগণের মাঝে পৌঁছায়নি কিন্তু সকলের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে আমাদের সরকারের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
অতএব, এই মর্মে গত ২৪শে এপ্রিল, ১৯৭১ এর ইতিবাচক বার্তার আলোকে স্বাধীন ও নব্য গঠিত বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতির আবেদন জানাচ্ছি। আপনার তরফ থেকে এমন একটি স্বীকৃতি বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে অসাধারণ গতি সঞ্চার করবে। এর ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ সম্ভব হবে যার ফলশ্রুতিতে এই অঞ্চলের স্বাধীনতা, শান্তি ও স্থিতিশীলতা বর্ধিত হবে। মাননীয়া এই কারণে আপনার কাছে এই বার্তার দ্রুত জবাব আশা করছি।
মহামান্য, দয়া করে আমাদের সর্বচ্চো সম্মানসূচক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবেন।
স্বাক্ষরিত/- স্বাক্ষরিত/-
(সৈয়দ নজরুল ইসলাম) (তাজউদ্দীন আহমেদ)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর ১৫ অক্টোবর, ১৯৭১
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী
মাননীয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী
নয়া দিল্লী
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর ২৩-১১-৭১ এ লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চিঠি।
(বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর)
মুজিবনগর
২৩শে নভেম্বর, ১৯৭১
মহামান্য,
গত ১৫ই অক্টোবর আপনার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গমনের প্রাক্কালে আমাদের তরফ থেকে লেখা চিঠির প্রতি আপনার সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। আমরা আশাবাদী ছিলাম, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ এবং এর সরকারকে স্বীকৃতি দানের সাধারণ অনুরোধ বিবেচনার সাথে সাথে আমাদের এই চিঠির মাধ্যমে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের ক্রমবর্ধমান অনুভূতি ও প্রেরণার কথা আপনি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে তুলে ধরবেন। নেতৃবৃন্দের সাথে আপনার আলোচনায় প্রাপ্ত এক প্রতিবেদনে আশার সৃষ্টি হয়েছে যে, তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে আমাদের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান কে আলোচনা করার জন্য প্ররোচিত করবে।
পনি বিদেশে অবস্থানকালীন সময়ে যখন সত্যিকার পরিস্থিতি চিত্র সকলের কাছে তুলে ধরছিলেন এবং বাংলাদেশের জনগণের ঘোষিত নির্বাচিত রাজনৈতিক সমাধানের অপরিহার্যতা সম্পর্কে জোর দান করছিলেন, সেসময়ে নিশ্চিত ইঙ্গিত পাই যে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠী আমাদের জনগণের উপর তাদের নিপীড়ন ও বর্বরতা নীতি চালিয়ে যাবার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। ১২ ই অক্টোবর এ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের বক্তব্য অনুসারে বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর অন্যায় কার্যক্রম বৃদ্ধি এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের আহবান প্রত্যাখ্যান করা ও তিরস্কার করার মাধ্যমে আমাদের উপরোক্ত মূল্যায়ন নিশ্চিত করা হয়েছে।
বিশেষ করে বিগত দুই সপ্তাহের ঘটনাচক্র থেকে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠী বাস্তব পরিস্থিতি অনুধাবন করে ন্যায় এর পথে ফিরে আসার পক্ষে কোন যুক্তি পরামর্শ নিতে অপারগ। এদিকে, আমাদের দেশের জনগণের দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেয়া অব্যাহত রয়েছে, যা আমাদের জনগণের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সেনা বাহিনীর অত্যাচার নিপীড়নের সরাসরি প্রভাবে ঘটছে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা আমাদের জনগণের উপর নির্যাতন অব্যাহত রাখার পাশাপাশি প্রতারণামূলক শাসন ব্যবস্থা জারি করেছে। সামরিক আইনের মাধ্যমে নির্বাচনে পরাজিত ও দেশদ্রোহী প্রার্থীদের নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়েছে যা বাংলাদেশের সকল মানুষের কাছে ঘৃণিত। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের জনগণকে জোরপূর্বক শাসন করার জন্য তাদের নৃশংসতা এক নতুন ও অকল্পনীয় মাত্রা নিয়েছে। আপনি অবশ্যই গত পাক্ষিক সময়ের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তান সেনা বাহিনীর কারফিউ, গ্রেফতার ও আগুনে পুড়িয়ে সব ধ্বংস করার বিষয়ে জানতে পেরেছেন। সম্পূর্ণ গ্রাম ধ্বংস করে জনমানব শুন্য করা হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান সেনা বাহিনী এমন নিয়মতান্ত্রিক ভাবে নির্যাতন চালিয়েছে যে লক্ষাধিক বাংলাদেশী বাস্তুহারা হয়েছে। আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পঞ্চাশ লক্ষাধিক বাংলাদেশী জনগণ এই করুন ও হৃদয় বিদারক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে যাদের কোন ত্রাণ সাহায্য নেই। এই সংখ্যা ভারতে আশ্রয় নেয়া ১০ লক্ষাধিক শরণার্থীদের সংখ্যার বাইরে এবং প্রতিনিয়ত ক্রম বর্ধমান। উপরোক্ত তথ্য থেকে নিশ্চিত উপসংহার টানা যায় যে, পাকিস্তান সামরিক শাসক গোষ্ঠী পূর্ব পরিকল্পিত ও পূর্ব নির্ধারিত ভাবে আমাদের সমগ্র বাঙালী জাতি ধ্বংস করার জন্য বদ্ধ পরিকর।
পাকিস্তান সামরিক শাসক দল এখনও শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে আলোচনার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করছে। এর ফলস্বরূপ পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান থেকে শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণ নয় পাকিস্তানের অন্যান্য অংশের জনগণকেও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের জনগণ এমনভাবে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে যে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি কে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয় যারা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক অঞ্চলের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছে।
এইসব থেকে আমাদের মূল মূল্যায়ন প্রতিবেদন নিশ্চিত করে যে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের সামরিক নির্যাতন ষড়যন্ত্রের স্বপক্ষে ছিল না বরং সমগ্র নির্যাতন কৌশলের পেছনে ছিল সামরিক জেনারেল দের দুরভিসন্ধি। রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের গত মাসের ঘোষণা ও কর্মকাণ্ড থেকে এটা নিশ্চিত ইঙ্গিত প্রদান করে যে, শুধুমাত্র বাংলাদেশের জনগণের গণতন্ত্রের চেতনা নয় সমগ্র পাকিস্তানের জনগণের গন্তান্ত্রিক অধিকার দমন করার জন্য তিনি বদ্ধ পরিকর।
গত ১৫ই অক্টোবর এর চিঠিতে আমরা আপনাকে মুক্তি বাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেছি, যাদের কার্যক্রমে এখন অনেক গতির সঞ্চার হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণের সার্বজনীন সমর্থন প্রাপ্ত মুক্তি বাহিনী অত্যন্ত সাফল্যের সাথে সামরিক শাসকদের থেকে দেশের বিশাল অঞ্চলের কার্যকরী প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রন নিতে সক্ষম হয়েছে। ১৫ই অক্টোবর এর চিঠিতে আমরা দেশের অর্ধেক অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন নেবার কথা জানিয়েছিলাম। অমরা অত্যন্ত আনন্দের সাথে জানাচ্ছি যে এই মুহূর্তে দেশের দুই তৃতীয়াংশ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রন এখন আমাদের দখলে। আমরা এই অঞ্চলগুলো শুধুমাত্র মুক্ত করিনি, এইসব এলাকা আমাদের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে বেসামরিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা কার্যকর করেছি। এমনকি বাকি অঞ্চল গুলোতে জন সমর্থিত মুক্তির সংগ্রাম এমন পর্যায় পৌঁছেছে যে, পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনী সীমিত কিছু স্থানে দেয়াল আবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। আমাদের সাফল্যের পাশাপাশি পশ্চিম পাকিস্তানের ঘটনা আমাদের বৈধতার কারণ। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠীর একগুঁয়েমি এবং আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে সংঘটিত হওয়া সকল কর্মকাণ্ড এই ইঙ্গিত বহন করে যে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান শুধুমাত্র তার দমন নীতির মাধ্যমেই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রন তার অধীনে নিতে ইচ্ছুক। এই পরিস্থিতি আমাদের মাতৃভুমি সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করার সঙ্কল্পকে আরও মজবুত করেছে এবং আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জনের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী। আমরা অনেক সংগঠিত হয়েছি এবং আমাদের সামরিক বাহিনী শৃঙ্খলা ও সংকল্পের সাথে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মুক্তিবাহিনিতে প্রতিনিয়ত হাজার হাজার দেশপ্রেমিক যুবক যোগদান করছে যারা সরবকালের জন্য বাংলাদেশের জনগণকে ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। গত দুদশক ধরে আমরা যে নিপীড়নের শিকার হয়ে আসছি, যার সর্বচ্চো পরিনাম ঘটে ২৫ শে মার্চের কালো রাতে এবং এর পরবর্তী ঘটনাবলী, এর মূল কারণ সম্পূর্ণরূপে মিটিয়ে দেয়াই আমাদের অপরিবর্তনীয় অভিপ্রায়। এটি দাসত্বের শিকার হওয়া মানুষের তাদের শোষকের বিরুদ্ধে সংগ্রাম।
আমরা আশা করি আমাদের এই সংগ্রাম আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী ভারতের আশু এবং বাস্তব সমর্থন পাবে। গত ৩১শে মার্চে, ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামের জন্য সহানুভূতি ও পারস্প্রিক নির্ভরতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উপায়ে জীবন যাপনের উপর অলঙ্কারপূর্ণ বক্তব্যগুলো আমাদের প্রত্যাশার ভিত্তি। ইতিমধ্যে আট মাস অতিক্রান্ত্র হয়েছে কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে পাকিস্তানী সামরিক শাসকদের বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে কোনরূপ আলোচনার জন্য জোর কিংবা পরামর্শ দেয়া হয় নাই। এমনকি, আপনার সহনশীলতা এবং সংযম, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নিপীড়নের ব্যাপারে পশ্চিমের শাসকদের উপর কোন কাঠামোগত প্রভাব ফেলেনি। পাকিস্তানী সামরিক শাসক দল এই ঘটনাকে ভারত -পাকিস্তান দ্বন্দ্ব হিসেবে তুলে ধরে বিশ্বের মনোযোগ অন্যত্র সরিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বাস্তব পরিস্থিতি ও সত্যিকারের ঘটনা তুলে ধরতে আপনার সরকারের সঙ্গতিপূর্ণ প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমরা সচেতন। শান্তিপূর্ণ বক্তব্যের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণ ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের মধ্যকার কলহ প্রতিরোধের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে, এবং ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও কর্মকাণ্ড থেকে রাজনৈতিক সমাধানের আশা প্রায় নেই। এই প্রেক্ষাপটে, আমরা অত্যন্ত বিস্মিত ও বিচলিত যে ভারত পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসক দলের বিরুদ্ধে সাবধানতা ও সংবরণ নীতি চালিয়ে যাচ্ছে।
আফ্রো – এশিয়া অঞ্চল থেকে অশুভ উপনিবেশবাদ তৈরির পেছনে ভারতের মূল ভুমিকার বিষয়ে বাংলাদেশের মানুষ সচেতন। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে সঙ্গতিপূর্ণ ভাবে সমর্থন দেবার মাধ্যমে ভারত বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে যা উপনিবেশবাদ নিশ্চিহ্ন করতে ত্বরান্বিত করছে। আপনার সরকার ও জনগণ সবসময় সেসব মানুষের পক্ষে কথা বলেছে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়েছে এবং মানুষের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমতা লুণ্ঠন করা হয়েছে। বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পক্ষে আপনার অটল সমর্থন সর্বজনিত। নির্যাতিত মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষা ও স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থনের জন্য ভারত এক নজির সৃষ্টি করেছে। আপনি গণতন্ত্রের মূলনীতি, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির উপর অটল সমর্থন দিয়েছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও আমাদের দেশের সরকারের অন্যান্য ঘোষণাগুলো স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয় যে আমরা একই আদর্শে বিশ্বাসী। এখানে পুনরাবৃত্তি করতে চাই যে, আমরা ইতিমধ্যে আমাদের রাষ্ট্রের মূল নীতি ঘোষণা করেছি। গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং একটি সমধিকারের সমাজ নিরমান যেখানে জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ নিয়ে কোন বৈষম্য করা যাবে না। আমাদের পররাষ্ট্র নীতিতে আমরা নিরপেক্ষতা, শান্তিপূর্ণ সহবস্থান, উপনিবেশ বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা করেছি। আমরা বুঝতে পারছিনা আদর্শ ও নীতির সম্প্রদায়ের এই পটভূমির বিরুদ্ধে ভারত সরকার কেন এখনও আমাদের স্বীকৃতি দানের আবেদনে সাড়া দিচ্ছে না।
আমাদের নিজেদের দেশে সন্ত্রাসের মুখোমুখি হওয়া অসংখ্য জনগণের আপনার দেশে আশ্রয় নেবার মাধ্যমে আপনার দেশের উপর অনাকাঙ্ক্ষিত চাপের ব্যাপারে আমরা সচেতন। আমাদের দেশ থেকে আগত লক্ষাধিক শরণার্থীর কারণে আপনার দেশের উদ্বেগের জন্য আমরা সমানভাবে উদ্বিগ্ন। এই বিশাল সংখ্যক শরণার্থীদের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক এবং সামাজিক – রাজনৈতিক উত্তেজনার ভার সমানভাবে ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের। আমাদের অঞ্চলের উপর কার্যকর নিয়ন্ত্রন এবং সংগঠিত বেসামরিক প্রশাসন গঠনের মাধ্যমে আমরা আশা করছি ২৫ শে মার্চের পর নিজেদের ঘর ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া অসংখ্য শরণার্থী আপনাদের মহানুভবতা ও অতিথেয়তা সত্ত্বেও দ্রুত দেশে ফেরত আসতে শুরু করবে। আমরা এই মুহূর্তে তাদের নিজ দেশে ফেরত এসে নিরাপত্তা ও সম্মানের সাথে পুনর্বাসনের নিশ্চয়তা দিতে সক্ষম। শীঘ্রই শীতকাল আসছে, সময় এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারী, বৃদ্ধ ও শিশুদের বাংলাদেশ প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করে তাদের স্বাস্থ্য ও অবস্থার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। শরণার্থীদের দ্রুত নিজ দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে আমাদের সরকারের সবরকম সহায়তার পূর্ণ নিশ্চয়তা দান করছি। আমরা চাইনা তাদের প্রয়োজনের সময়ে আমরা ব্যর্থ হই।
বিগত আট মাসে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের উপর বয়ে যাওয়া উত্তেজনা ও ধকল উপশমে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আপনার ক্রমবর্ধমান সমর্থন অপরিহার্য। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম দান করে আমাদের সাধারণ লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব। আমরা নিশ্চিত যে, আপনাদের স্বীকৃতি অনুযায়ী এবং এই স্বীকৃতিতে বাস্তব স্বতন্ত্রতা দানের মাধ্যমে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বাংলাদেশের সমস্যার দীর্ঘস্থায়ী সমাধান ত্বরান্বিত করবে।
আমাদের সংগ্রামে আপনার প্রচেষ্টার জন্য এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে আমাদের সংগ্রামের বিষয় তুলে ধরার প্রচেষ্টার জন্য আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা মনে করি আমাদের এখন আপনার আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক সমর্থন প্রয়োজন যাতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে আমাদের স্বীকৃতি ত্বরান্বিত হয়। আপনার স্বীকৃতি আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত পেতে উদ্দীপনা দিবে। আমাদের বিবেচিত মূল্যায়ন অনুসারে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ভারত সরকারের স্বীকৃতি উপমহাদেশের স্থিতিশীল পরিস্থিতির জন্যই প্রয়োজনীয় নয়, বরং দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার শান্তি, উন্নতি নিশ্চিত করার জন্যও জরুরী। সেকারণে, আমরা ১৫ই অক্টোবর এর চিঠির বিষয়ের পুনরাবৃত্তি করে দ্রুত সম্ভব সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের অনুরোধ জানাচ্ছি।
দয়া করে আমাদের সর্বচ্চো সম্মানসূচক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবেন।
স্বাক্ষরিত/- স্বাক্ষরিত/-
(সৈয়দ নজরুল ইসলাম) (তাজউদ্দীন আহমেদ)
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
নয়া দিল্লী
ভারত
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বরাবর ৪-১২-১৯৭১ এ লিখিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চিঠি।
(গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সীলমোহর)
প্রেরক
সৈয়দ নজরুল ইসলাম
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
এবং
তাজউদ্দীন আহমেদ
প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
বরাবর
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী
মাননীয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী,
গভীর বিস্ময়ের সাথে সবেমাত্র আমরা জানতে পারলাম যে ৩রা ডিসেম্বর বিকেলে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাহিনী আপনার দেশের বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণ পরিচালনা করেছে। ইয়াহিয়া খানের সর্বশেষ বেপরোয়া চুক্তিভঙ্গের এই প্রদর্শন প্রমাণ করলো যে উনি এই উপমহাদেশের রাষ্ট্র গুলোর উপর ধ্বংস, উত্তেজনা এবং আর্থ-সামাজিক নিপীড়ন বিস্তারের জন্য বদ্ধপরিকর; বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানী সরকারের এমুখ উদ্দেশ্যের ব্যাপারে অবগত ছিল এবং প্রায় নয় মাস আগে তারা স্বাধীনতার সংগ্রামের সূচনা করে। এই পরিস্থিতির বাস্তবতা এবং পাক বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে পরাজিত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ়তার কথা উল্লেখ করে গত ১৫ই অক্টোবর ও ২৩শে নভেম্বর আমরা আপনার নিকট বার্তা পাঠিয়েছিলাম। ইয়াহিয়া খান এবং তার সেনাপতিরা আপনার দেশের উপর যে আগ্রাসন চালিয়েছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দারাবার জন্য, ভারত ও বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা ও মূল্যবোধ রক্ষ্যার জন্য আমাদের দুদেশের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের মোকাবিলা করা আরও প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমরা গৌরবের সাথে আপনাকে অবগত করছি যে, ৩রা ডিসেম্বরে আপনার দেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সরাসরি আগ্রাসী হামলার সাপেক্ষে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী পাকিস্তানী সামরিক শক্তির সাথে বাংলাদেশের যেকোনো সেক্টরে অথবা যেকোনো সদরে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ অবস্থান আরও মজবুত হবে যদি আমরা একটি আনুষ্ঠানিক কূটনীতিক সম্পর্কে উপনিত হতে পারি। অতএব, আমরা আপনার নিকট পুনরায় অনুরোধ করছি যে ভারতীয় সরকার অবিলম্বে আমাদের দেশ ও সরকারকে অনতিবিলম্বে স্বীকৃতি দেয়। আমরা আপনাকে নিশ্চিত করতে চাই যে দুদেশের এমুখ শনিক ঘণ্টায় বাংলাদেশের সরকার ও মানুষ আপনাদের পাশে দৃঢ়তার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি যে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খানের পৈশাচিক উদ্দেশ্য ও পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আমাদের যৌথ প্রতিরোধ সফল পরিণতি নিয়ে আসবে।
আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে আপনাদের যথাযথ সংগ্রামে আমাদের সরকারের সম্পূর্ণ সহায়তার ব্যাপারে আমরা আস্থা দিচ্ছি।
দয়া করে আমাদের সর্বচ্চো সম্মানসূচক প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করবেন।
৪ ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১
শ্রী মল্লিকারজুন (মেডাক) — আমি এই পবিত্র দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। আমি তাকে আমাদের স্বর্গীয় ভারতের একজন অদ্বিতীয় অবতার হিসেবে দেখি। স্রস্টা এই দেশকে সকল নৈপূন্যে মহিমান্বিত করুন এবং আমরা সর্বদাই বিজয়ীর আস্নে থাকবো। জয় বাংলাদেশ।
শ্রী জিয়ত্রিময় বসু (ডায়মন্ড হারবার) — আমার দলের পক্ষ থেকে আমরা এই দিন কে অভিনন্দন জানাতে অত্যন্ত আনন্দিত। ১৯৪৭ এর পর আজকের দিন অন্যতম সেরা দিন।
শ্রী এইচ. এন. মুখারজী (কলকাতা উত্তর-পূর্ব) — এই মুহূর্তে আমরা বাক্যহারা। আমরা অনেকদিন ধরে প্রতীক্ষায় ছিলাম কবে আমাদের দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরনাঙ্গ সমর্থন জানাবে। আমি জানিনা এই পরিস্থিতিতে আমার বক্তব্য জরুরী কিনা। আমরা আনন্দিত। আমরা প্রধানমন্ত্রীকে জানাতে চাই, এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। আমরা বিশ্বের এই প্রান্ত থেকে সারা বিশ্বে আমাদের বার্তা পৌঁছে দিতে চাই। ইসলামাবাদের ক্ষমতা লোভী লোকদের বিরুদ্ধে, সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম অবশ্যই সফল হবে এবং স্বাধীনতা আমাদের এবং মানবতার পক্ষে থাকবে।
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী (গোয়ালিয়র) — স্পীকার মহাশয়, দেরিতেই হোক না কেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে একটি সঠিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। ইতিহাসের গতি পরিবর্তনের পক্রিয়া আমরা প্রত্যক্ষ করছি। নিয়তি এই সংসদ, এই দেশকে এমন গুরুত্বপূর্ণ কাল পর্যায়ে এসে উপস্থিত করেছে যখন আমরা মুক্তি সংগ্রামে আত্মাহুতি দানকারী লোকদের সমভিব্যাহারে যুদ্ধ করছি, আমরা কিন্তু ইতিহাসের গতির নতুন দিক নির্দেশের জন্যও সচেষ্ট রয়েছি। আজ বাংলাদেশে নিজেদের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত লোকদের এবং ভারতীয় সৈন্যদের শিকারে পরিণত হবে না। বাংলাদেশের মুক্তি এখন ঘনিয়ে আসছে। আমার মনে হচ্ছে, আমাদের সেনাবাহিনী এখন ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে যাচ্ছে। ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে শুধু মুক্তি সংগ্রামেরই সহায়তা করেনি, বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মর্যাদায় ভূষিত করেছে। এখন সে নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে যাবে, এজন্য এ সময় তাকে আমাদের স্বীকৃতি দান আরও অর্থপূর্ণ হল।
আমি মনে করি আমাদের প্রধানমন্ত্রী সত্যিই ধন্যবাদের পাত্রী। নিত্যদিন আমি এরুপ আরও খবরের প্রত্যাশা করতে থাকব।
শ্রী শেযহিয়ান (কুম্বাকোনাম) — এটা একটা ঐতিহাসিক দিন যখন স্বাধীন বাংলাদেশকে ভারত স্বীকৃতি দান করলো। বাংলাদেশ এবং এর বীরসুলভ জনগণকে আমাদের শুভেচ্ছা। আমি আমার দল ও এই সংসদের পক্ষ থেকে আপনাকে অনুরোধ জানাই বাংলাদেশ সরকার এবং এর জনগণকে শুভেচ্ছা ও শুভ কামনা জানাতে। স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয় অর্জন ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আমরা তাদের সাথে একীভূত। এখন যে লড়াই চলছে তা ইসলামাবাদ ও দিল্লী কিংবা ইসলামাবাদ ও বাংলাদেশের মধ্য না। এই লড়াই সামরিক শক্তি ও গণতান্ত্রিক অধিকারের মধ্যে। ইতিহাসের দেখানো পথ অনুসারে গণতান্ত্রিক অধিকার সবসময় জয়ী হবে। বাংলাদেশে নতুন ইতিহাস রচিত হরেছে।
শ্রী শ্যামনন্দন মিশ্র (বেগুসরায়) — স্পীকার মহোদয়, এই অবসরে আমরা প্রধানমন্ত্রী মহাশয়া এবং আমাদের সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী মহাশয়া এবং সেনাবাহিনী যেভাবে দেশের বিশ্বাস অটুট রেখেছেন সে বিশ্বাস ভবিষ্যতেও রাখবেন এবং বহু জটিলতা নিয়ে যেসব দিন আসছে সেগুলিতেও পূর্ণ আস্থা, প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে কাজ করবেন। আমি উপলব্ধি করছি, এ যাবত আমরা যতদূর সফল হয়েছি তাতে আমাদের সাহস বেড়েছে, আমাদের দেশের মর্যাদাও বৃদ্ধি এবং বিশ্বের অনেক স্থানে এ সম্পর্কে যেসব কথা হচ্ছে তাতেও অনেক কিছুর মূল্যায়ন অন্য দেশের লোকদের ধারণা পরিষ্কার হয়ে যাবে। ভারতের অবস্থা সম্পর্কে তারা অনেক বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল। ভারতের অবস্থান আজ সুস্পষ্ট হয়ে গেছে এবং যুদ্ধের তৃতীয় বা চতুর্থ দিনেই, আজ আমরা যখন একত্রিত হচ্ছি, আমি মনে করি, বিশ্বে যে নানারকম কথাবার্তা উঠছে, সে সব কথা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সুফলপ্রদ মোড় নেবে।
আমি বেশী সময় না নিয়ে শুধু এই বলবো, এখনই আমাদের দেশবাসী যেন একথা মনে না করে যে, আমাদের সফলতা শেষ পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, আমাদেরকে অনেক কোরবানি দিতে হবে, অনেক চিন্তা ভাবনা, আস্থা ও দূরদর্শিতার সঙ্গে চলতে হবে।
শ্রী পি. কে. দেও (কালাহান্ডি) — আমি প্রধানমন্ত্রীকে তার সাহসী সিদ্ধান্তের জন্য আমার অন্তরের অন্তস্থল থেকে অভিনন্দন জানাই। দেরীতে হলেও তিনি সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন।
সম্মানিত সংসদ সদস্য — সঠিক সময়ে।
শ্রী পি. কে. দেও — আমার দলের পূর্ণ সমর্থন তার প্রতি আছে। পাকিস্তান যে ভৌগলিক ভাবে একটা অর্থহীন দেশ আজকে তা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা আশা করি দেশ ভাগের ফলে যে ক্ষতি হয়েছিল তা পূরণ হবে, এবং আমরা সম্পূর্ণ আশা রাখি উপমহাদেশের ইতিহাসে এক সোনালী অধ্যায়ের সূচনা হবে। এই সাহসী সিদ্ধান্ত সত্যিই অনেক সাহসিকতাপূর্ণ এবং ভারতীয় জাতির মধ্যে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনার সঞ্চার করেছে এবং আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমাদের সেনা এবং শহীদদের সালাম জানাই যারা বাংলাদেশের জন্য তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছেন।
শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী (বেরহামপুর) — এটা প্রকৃতপক্ষেই ঐতিহাসিক মুহূর্ত, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত এবং এই নিয়ে লম্বা বক্তব্যের কোন প্রয়োজন নেই। তথাপি, আমাদের সেই দিন স্মরণ করিয়ে দেয় যখন রাভি নদীর তীরে পণ্ডিত জহরলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ভারতীয় জাতি একত্রিত হয়েছিল। আমরা স্বাধীনতার সঙ্কল্পে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম। একইভাবে এবছর ২৬শে মার্চে বুড়িগঙ্গার তীরে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়, এবং বাংলাদেশের জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার শপথ গ্রহণ করে বাংলাদেশকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রী এবং সরকার আজকের মত আর কখনোই জাতির সাথে এভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেনি। আমি প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
প্রফেসর মধু ডান্ডাভাট (রাজাপুর) — মাননীয়, প্রয়াত জওহরলাল নেহেরু একবার বলেছিলেন, শান্তির মতই স্বাধীনতা অদৃশ্য। এবং বিশ্বের এক প্রান্তের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি অন্য প্রান্তের স্বাধীনতার জন্যও হুমকিস্বরূপ। আমি আনন্দিত প্রধানমন্ত্রী তার পিতার কণ্ঠ শুনতে পেরেছেন এবং সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপক্ষ নিয়েছেন যা আমাদের দেশের ঐক্যের সাথে জড়িত। আজকে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ গণ অবশ্যই অনুভব করতে পারবেন তাদের আত্মত্যাগ বৃথা যায়নি। তারা অবশ্যই বুঝতে পেরেছিলেন কূটনৈতিক আলোচনার আসরে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আসবে না, বিপ্লব ও সংগ্রামের মাধ্যমেই তা উদ্ভূত হবে। এবং এই ভাবেই ভারত কতৃক বাংলাদেশের স্বীকৃতির উদ্ভব। এই জন্য আমি প্রধানমন্ত্রী এবং সমগ্র দেশকে অভিনন্দন জানাই।
আমি অধিক সময় নিতে চাই না। আজকে বাংলাদেশের মহান শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধারা অবশ্যই সেই কবিতার পঙক্তি স্মরণ করবে যেখানে কবি বলেছেন –
“ওহ স্বাধীনতা – মানবকূল পারবে কি তোমায় পরিত্যাগ করতে
একবার তোমার উদার শিখার আঁচ অনুভবের পর?
পারবে কি কোন অন্ধকুপ, খিল কিংবা গরাদ বা চাবুক তোমার আত্মাকে নিস্তেজ করতে? “
এই শব্দগুলো সারা বিশ্বের অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধাকে তাদের লক্ষ্যে উদ্দীপ্ত করেছে। এই শব্দগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন ও উৎসর্গকে উদ্দীপ্ত ও আলোকিত করবে। আমি আনন্দিত ভারত ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার শক্তি নিজেদের একত্রীভূত করতে পেরেছে। এমনটাই হবে সারা বিশ্বের চিত্র যা আমরা সবসময় আশা করেছি এবং ভারত সবসময় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে থাকবে। আমাদের সেনা বাহিনী কখনোই কোন দেশ দখল করতে যাবে না, আমাদের সেনা বাহিনী সবসময় স্বাধীনতা রক্ষার জন্য লড়াই করবে। এটা আমাদের মহান দেশের ঐতিহ্য।
শ্রী এস.এ.শামিম (শ্রীনগর) — সুতরাং, বিলম্বিত স্বীকৃতি- স্বীকৃতি দানের অস্বীকার নয়। আমি প্রধানমন্ত্রীকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। কিন্তু এই উত্তেজনাকর মুহূর্তে আমি এই সংসদকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, এই যুদ্ধের মূল তাৎপর্য আমাদের ভুলে যাওয়া উচিৎ নয়। মূল তাৎপর্য হচ্ছে, বাংলাদেশের সেনা বাহিনী এবং ভারতের হিন্দু ও মুসলিম গণ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে পরাজিত করার জন্য লড়াই করছে। এটাই এই যুদ্ধের সারমর্ম। ১৯৪৭ এ পাকিস্তান তৈরি হয়েছিল ধর্ম ভিন্নতার কারণে এবং ধর্ম সীমানা তৈরি করে দিয়েছিল। আজকে বাংলাদেশে একজন মুসলিম সেনাপতি জেনারেল ওসমানী ধর্মকে ভুলে শুধুমাত্র মানবতা এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে বৃহত্তর ধরে সেনা বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এটাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সারমর্ম। আমি নিশ্চিত জনাব বাজপেয়ী এবং অন্যান্য যারা বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছেন আমাদের দৈনন্দিন জীবনে এবং এদেশের আদর্শে এর প্রয়োগ করবেন।
শ্রীমতী এম. গডফ্রে ( নির্বাচিত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান) — মাননীয়, আমাদের প্রিয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি শ্রদ্ধার কথা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই তাকে আমাদের এই কঠিন সময়ে সঠিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। সৃষ্টিকর্তা তাকে আরও বিচারিক ন্যায় নিরদারনের ক্ষমতা দিয়েছেন যাতে তিনি আজকের দিনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছেন। আমি জানি অন্য কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার জন্য এখন কঠিন সময়। আমি মনে করি আজকের দিন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য সঠিক সময়। তাই আমরা সবাই সমস্বরে এই ঐতিহাসিক দিনে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানাই। এটা ইতিহাসের পাতায় সর্বদা লেখা থাকবে। আরও একবার, আমি তাকে অভিনন্দন জানাই এবং প্রার্থনা করি যাতে সৃষ্টিকর্তা তাকে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেবার দিক প্রদর্শন করেন, যা তিনি আমাদের দেশের এই কঠিন সময়ে সর্বদাই করে আসছেন।
শ্রী এস.বি.গিরি (ওয়ারাঙ্গাল) — মাননীয়, অবশেষে বাংলাদেশের এবং ভারতের জনগণের গণতান্ত্রিক ইচ্ছার বিজয় ঘটে এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করা হয়। তেলাঙ্গনা প্রজা সমিতির পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের জন্য অভিনন্দন জানাই। আমি আশা করি অন্যান্য দেশও আমাদের অনুসরণ করবে। আমি আশা করি আমেরিকা যারা জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলে এবং সর্ব বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ, শীঘ্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করবে।
শ্রী ইসহাক সম্ভলী (আমরোহা) — স্পীকার মহোদয়, আমাদের সবচাইতে বেশী অভিনন্দন জানাতে হবে বাংলাদেশের যোদ্ধাদের, যারা স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্র ও সেকুলারিজম এর জন্য লড়াই করছে। তারা নিজেদের সরকার গঠন করে নিয়েছে। আমি আনন্দিত এবং আমি ধন্যবাদ জানাই ভারতের জনগণ ও প্রধানমন্ত্রীকে যারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি একটি ঐতিহাসিক বিষয়। সেটি এক ধর্মমতাবলম্বী অর্থাৎ মুসলমানদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকের দেশ। কিন্তু তা সত্ত্বেও তারা সেকুলারিজম এর আদর্শ গ্রহণ করেছে। আমার বিশ্বাস, বিশ্বের কোটি কোটি লোকের স্বাধীনতার যুগ এই কাল থেকে আরম্ভ হয়েছে এবং তারা প্রতিটি পরাধীন অঞ্চল স্বাধীন করতে সক্ষম হবে।
এসব কথার দ্বারা আমি বাংলাদেশকে এবং এই সরকারকে অভিনন্দন জানাচ্ছি।
জনাব স্পীকার — আমি মনে করি এখন আরও বক্তব্য রাখা উচিৎ। আমিও প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। সকল দল বক্তব্য রেখেছে। তাদের সকলের পক্ষ থেকে যারা কোন দলের অন্তর্গত নয়, যারা কোনভাবে বিতর্কিত নন এবং যারা ট্রেজারি বেঞ্চ এবং বিরোধী দল উভয়ের সাথে সম্পৃক্ত, এদের সকলের এবং সংসদের পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাই। আজকে আমার স্পীকার হিসেবে কর্মজীবনে প্রথমবারের মত আমি টেবিল চাপড়ানোর ঐতিহ্যে যোগদান করে নিজের টেবিলে চাপড়েছি। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণা বাংলাদেশের সাদিনতা কামী জনতার সাথে আমাদের সহযোগিতা ও ঐক্যের ঘটনা হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে। এইসব সকল লোকের পক্ষ থেকে এবং আপনাদের সকলের পক্ষ থেকে আমি বাংলাদেশ সরকারকে এই গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণার জন্য অভিনন্দন জানাই যা তাদের দেশের গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, সামাজিকতা, বিশ্ব শান্তি এবং মানবাধিকারের ভিত্তি স্থাপন করেছে।