শিরোনামঃ | সূত্র | তারিখ |
২২৯। পাকিস্তান কতৃক ভারতের উপর আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি এবং তার উপর আলোচনা | ভারতের লোকসভার কার্যবিবরণী | ৪ নভেম্বর, ১৯৭১ |
বেলা ১১ টায় লোকসভার অধিবেশন শুরু হয়
(মাননীয় স্পীকারের উপস্থিতিতে)
পাকিস্তান কতৃক আক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে বিবৃতি
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ( মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, ইলেকট্রনিক্স মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী )– মাননীয় স্পীকার, আজকের সকালের সংবাদ অনুসারে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার আমাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। গতকাল বিকেলে, পশ্চিম পাকিস্তান বিমান বহর আমাদের আকাশ সীমা লঙ্ঘন করে এবং যথেচ্ছাপূর্বক বিপুল সংখ্যক বিমান ঘাটিতে আক্রমণ চালায়। একই সাথে তাদের স্থল বাহিনী সীমান্তের পশ্চিমাঞ্চলে আমাদের সেনা অবস্থানের উপর গোলা বর্ষণ করে। তাদের প্রচার মাধ্যম ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলেছে যে, ভারত আক্রমণ ও হামলা চালিয়েছে।
কলকাতা ত্যাগের প্রাক্কালে এই খবর আমার কাছে এসে পৌছায়। ফেরত আসার পর অনতিবিলম্বে আমি আমার সহকর্মী এবং বিরোধী দলীয় নেতাদের সাথে এ বিষয়ে পরামর্শ করি। জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা সর্বসম্মতভাবে একমত হয়েছি যে, আক্রমণকারীকে অবশ্যই প্রত্যাহত করা হবে। আমি নিশ্চিত আমাদের এই সংহতি ভবিষ্যতের কঠোর দিনগুলোতে আমাদের কাজে প্রভাব ফেলবে। দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হল।
আমি ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ প্রকাশিত ভারতীয় গেজেটেরে বিজ্ঞপ্তি নম্বর জি.এস.আর. ১৭৮৯ এর একটি অনুলিপি পেশ করছি, যাতে সংবিধানের ৩৫২ নম্বর অনুচ্ছেদের “২” নং ধারার উপ-ধারা “বি” অনুসারে ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ রাষ্ট্রপতি কতৃক জরুরী ধারা ঘোষণার কথা প্রকাশিত আছে, যা একই অনুচ্ছেদের “১” নং ধারায় উল্লেখ করা আছে।
আমরা সংসদে ভারতীয় সুরক্ষা বিধান পাশের প্রস্তাব রাখছি।
আমরা দুঃখ অনুভব করছি, যে সময়ে উপমহাদেশের উন্নতি সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন তখন পাকিস্তান তাদের চূড়ান্ত বোকামি আর ব্যর্থতার কারণে ভারত ও পাকিস্তানের জনগণকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ যাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কখনোই কোন বক্তব্য ছিল না, তাদের সাথে আমরা ভাল প্রতিবেশী হিসেবেই থাকতে পারতাম। এই অন্তিম মুহূর্তে আমাদের কতৃত্তপূর্ণ আবেগ অন্যতম আস্থা ও বিশ্বাস।
প্রায় নয় মাসেরও অধিক সময় ধরে পাকিস্তান সামরিক সরকার বর্বরতার সাথে বাংলাদেশের মানুষের সাধারণ মানবাধিকার এবং স্বাধীনতা পদদলিত করে আসছে। কর্মরত সেনা বাহিনী জঘন্যতম অপরাধ ঘটিয়েছে যার হিংস্রতার পরিমান কঠোর শাস্তিরও অপ্রতুল্য। কয়েক লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে এবং দশ লক্ষ লোক আমাদের দেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
আমাদের নিরাপত্তা ভীতি সত্ত্বেও, একটি পুরো জাতীর ধ্বংসের বিষয়ে ক্রমাগত সমগ্র বিশ্বের মনযোগ আকর্ষণ করেছি। সর্বত্রই জনগণ সহানুভূতি প্রকাশ করেছে এবং ভারতের অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য চাপ ও সংকটের বিষয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছে। কিন্তু সরকার নৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পক্ষঘাতগ্রস্তদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের জন্য ইসলামাবাদ সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নেবার বিলম্বিত প্ররোচনা ব্যর্থ হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তান সেনাদের ক্রোধের মাত্রা বেড়েছে কারণ বাংলাদেশের জনগণ তাদের মূল্যবোধ রক্ষার জন্য সংগ্রাম করছে এবং সেনাবাহিনীর কাছে এটা গ্রহণযোগ্য নয়, এবং পাকিস্তানের সব কটি প্রদেশে এটি দমন করা হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধির সাথে সাথে পশ্চিম পাকিস্তান সেনা বাহিনী মরিয়া হয়ে পড়েছে। অত্যাচারীর পক্ষ নেয়া নয় বরং নিপীড়িতদের সাথে থাকাই আমাদের ঐতিহ্য এবং এই কারনেই তাদের ক্রোধ এখন আমাদের উপর এসে পড়েছে।
বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ধাপে ধাপে বৃদ্ধি পাওয়া ও সম্প্রসারিত হওয়া পশ্চিম পাকিস্তানের আক্রমণ ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে পরিণত হয়েছে। শান্তির মত যুদ্ধেরও ধৈর্য ও সংযম এর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক সরকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা ও অভ্যন্তরীণ সমস্যা জারি রাখতে, সন্দেহ ও গুজব ছড়ানোর জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করবে। আমাদের তাদের পরিকল্পনার ফাঁদে পরা উচিৎ নয়। আমাদের অবশ্যই লক্ষ স্থির রেখে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
আমাদের দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। কৃষি এবং শিল্প ক্ষেত্রে উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছে মুল ভিত্তি যার উপর প্রতিরক্ষা নির্ভর করে। কৃষক, শ্রমিক, শিল্পবিদ ও ব্যবসায়ীদের আত্মোৎসর্গের সাহায্যে জওয়ানদের সাহসী ও যুদ্ধোপজোগী করে তুলতে হবে। ব্যবসায়িক সম্প্রদায়ের বিশেষ দায়িত্ব হচ্ছে দ্রব্যাদি মজুদ এ অধিক মুনাফার লোভ থেকে নিজেদের সংবরণ করা। শিল্পী, লেখক, শিক্ষক ও ছাত্রদের প্রতি জাতি আশা করে তারা আমাদের আদর্শকে রক্ষা করবে এবং নৈতিকতাকে উচ্চস্তরে রাখবে। আমাদের দেশের প্রতিটি নারীর প্রতি আমার বিশেষ আবেদন থাকবে যাতে তারা যতটা সম্ভব শস্য এবং রুপি সঞ্চয় করে এবং অপচয় রোধ করে। আমাদের সকলের আত্মত্যাগে গড়ে উঠবে জাতির শক্তি ও স্থায়ী ক্ষমতা।
আমরা শান্তির পক্ষে কিন্তু শান্তিরক্ষা করাটাও আবশ্যক। আজকে আমরা আমাদের প্রাদেশিক সংহতি ও জাতীয় সম্মান রক্ষার জন্য যুদ্ধ করছি। সর্বোপরি, আমরা যে আদর্শকে লালন করি তার জন্য এবং শান্তির জন্য যুদ্ধ করছি।
১১:০৬ ঘটিকা
জরুরী অবস্থা ঘোষণা বিষয়ক বিশ্লেষণ
শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ( মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আণবিক শক্তি মন্ত্রী, ইলেকট্রনিক্স মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী )– আমি জরুরী অবস্থা ঘোষণা বিষয়ক বিশ্লেষণ উত্থাপনের অনুরোধ জানাচ্ছি –
“রাষ্ট্রপতি কতৃক ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ স্বাক্ষরিত সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘোষণাকে সংসদে মঞ্জুর করা হোল।”
মাননীয় স্পীকারঃ- বিশ্লেষণ উত্থাপন করা হোল –
“রাষ্ট্রপতি কতৃক ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ স্বাক্ষরিত সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘোষণাকে সংসদে মঞ্জুর করা হোল। “
শ্রী এ. কে. গোপালান (পালাঘাট) — গতকাল বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণে বিমানযোগে আক্রমণ ও গোলা বর্ষণের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এদেশকে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধের মুখোমুখি করেছে। ভারত বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করার জন্য এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে, আমাদের দল সবসময়ই বলে এসেছে যে এই ধরণের পরিস্থিতিতে সমগ্র জাতি একীভূত হয়ে সামরিক জান্তার আক্রমণকে প্রতিহত করবে, কারণ উপমহাদেশে সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটিয়ে শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয় পশ্চিম পাকিস্তানেও গনতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া অত্যন্ত জরুরী। আমরা আমাদের দলের এই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করছি। আমরা ভারতীয় সরকারের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি যাতে সকল সংশয়ের অবসান ঘটিয়ে, সব ধরণের চাপ প্রতিহত করে শীঘ্রই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয় কারণ আমরা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করছি, এবং আজকে অবশ্যই আমাদের বাংলাদেশকে আনুস্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
আমরা আরও সতর্ক করতে চাই যে, দেশে প্রগতিবিমুখ শক্তি উগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি করতে পারে। এই ধরণের সকল প্রগতিবিমুখ শক্তি প্রতিহত করে আমাদের দেশের জনতাকে জানাতে হবে আমরা বাংলাদেশের জনগণের বিজয়ের জন্য এই যুদ্ধে অংশ নিচ্ছি। আমাদের আরও জানাতে হবে তারা যেন কোন প্রকার পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলনে জড়িত না হয়।
জরুরী অবস্থা ঘোষণা বিষয়ে আমাদের অভিমত এই যে, যেহেতু সমগ্র দেশ সরকারের পক্ষে রয়েছে তাই এই মুহূর্তে জরুরী অবস্থা ঘোষণার প্রয়োজনীয়তা নেই কিন্তু ইতোমধ্যে তা ঘোষিত হয়ে গেছে। এই বিষয়ে আমরা কোন মন্তব্য করবো না। আমরা নিশ্চিত করছি যে আমরা মনেপ্রাণে বাংলাদেশের সংগ্রামের পক্ষে এবং পাকিস্তানের বিপক্ষে আমাদের সমর্থন জানাবো।
শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত (আলিপুর ) — এই সংকটলগ্নে দেশের অখণ্ডতা রক্ষার এই গুরু দায়িত্বের প্রতি আমাদের দলের পক্ষ থেকে আমরা সম্পূর্ণ সমর্থন জানাই।
গতকাল রাত থেকে আমাদের সেনাবাহিনীর ওপর এক বিশাল ও ঐতিহাসিক দায়িত্ব এসে পড়েছে। শুধুমাত্র দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার মধ্যেই এই দায়িত্ব সীমাবদ্ধ না। বাংলাদেশের অত্যাচারিত ও দাসত্বের শিকার হওয়া অসহায় মানুষগুলো গত রাত থেকে আমাদের ভরসায় রয়েছে যাতে তাদের পক্ষে আমাদের ন্যায় বিচারের তলোয়ার শাণিত হয়। এই ন্যায়ের তলোয়ার সাহস ও স্থির সংকল্পের সাথে শাণিত হওয়া উচিৎ। একই সাথে আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাবো, সকল সন্দেহের উর্ধে থেকে এই বিষয়ে খোলাসা করতে যে, আমাদের পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা ক্ষুণ্ণ করার কোন দুরভিসন্ধি নেই। পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ যাদের সাথে আমাদের কোন কলহ নেই, আমরা সবসময় চেয়েছি এবং আশা করি একদিন অবশ্যই আমরা শান্তি ও সৌহার্দপূর্ণ প্রতিবেশী হিসেবে তাদের সাথে বসবাস করতে পারব।
আমাদের সংগ্রাম ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে, যাদের অবর্ণনীয় অত্যাচার ও ভোগান্তির শিকার বাংলাদেশের জনগণ। তাই, আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি যাতে সারা বিশ্বের কাছে এই যুদ্ধে আমাদের মূল লক্ষের বিষয়ে খোলাসা করা হয়, যাতে সম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তি এই পরিস্থিতির ফয়দা লুটতে না পারে। এবং এখন সময় এসেছে, বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের জনগণের সরকারকে আমাদের দৃঢ় স্বীকৃতি জানানোর।
খুব শীঘ্রই আমরা ভারতের প্রতিরক্ষা আইন পাশ করতে যাচ্ছি এবং এর নিয়ম কাঠামো এতে উল্লেখ করা থাকবে। এই আইন বাস্তবে সরকারকে অসীম ক্ষ্মতাসম্পন্ন করবে। প্রধানমন্ত্রী দেশ এবং প্রতিরক্ষার স্বার্থে উৎপাদন বৃদ্ধির কথা বলেছেন। আমরা তার সাথে একমত। কর্মজীবী শ্রেণী এই বিষয়ে ভুমিকা রাখবে। এখন আপনার অধীনে এই ক্ষমতা আসার পর আপনি অবশ্যই খেয়াল রাখবেন যাতে কারখানার মালিক ও কর্মজীবীরা নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য উৎপাদন বন্ধ এবং শ্রমিক ছাঁটাই না করে। আপনি আরও লক্ষ্য রাখবেন যেন এই মুহূর্তে বন্ধ থাকা ৩০০০ এরও অধিক কারখানা অবিলম্বে চালু করে উৎপাদন শুরু করা হয়, যাতে করে আমাদের সম্পদের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা যায়।
আমরা যেভাবে দেশকে প্রতিপক্ষের আক্রমণের হাত থেকে রক্ষায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, তেমনি সরকারের উচিৎ দেশের জনগণকে এই অস্বাভাবিক অবস্থার ফয়দা নিতে চেষ্টা করা অসাধু মুনাফাখোর, মজুতদার এবং গুপ্তচরের হাত থেকে রক্ষা করা।
আমি এই মুহূর্তে আর বেশী সময় নিতে চাই না। আজকে আমাদের প্রাথমিক ভাবনায় আমাদের বীর সেনা সদস্যগণ এবং আমার মতে বীর মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা যাদের আট মাস ব্যাপী প্রবল প্রতিরোধ ছাড়া বাংলাদেশের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব হত না। তারা নতি স্বীকার করলে, আত্মসমর্পণ করলে এবং হার মেনে নিলে আজকে আমাদের সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত। কিন্তু আশাই একমাত্র অবলম্বন এবং বাংলাদেশের জনগণ ও মুক্তিবাহিনীর আত্মত্যাগের ফলে তারা বিদ্রোহ চরমে রেখে স্বাধীনতা রক্ষা করতে পেরেছে। আজকে আমাদের গর্ব করা উচিৎ কারণ, যখন ইসলামাবাদের সামরিক জান্তা মরিয়া হয়ে রক্তের বিনিময়ে বাংলার জনগণকে দমন করতে চাচ্ছে তখন আমরা বাংলাদেশের জনগণের জাতীয় নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা রক্ষার ইতিহাসে অবিচ্ছেদ্যভাবে এই যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করছি। আমরা সাহস, সংকল্প ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ভাবে সামনে এগিয়ে যাব। কিন্তু আমাদের দেশীয় ঐতিহ্যকে মাথায় রেখে আমাদের ঘোষণা করতে হবে যে, আমরা সর্বদাই শান্তি প্রিয় রাষ্ট্র। আমরা শুধু তখনই যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে যখন আমাদের বাধ্য করা হয়েছে। আমরা অন্য কোন রাষ্ট্রকে জোরপূর্বক আমাদের অন্তর্ভুক্ত করতে চাই না। আমরা আমাদের মাতৃভুমির প্রতিরক্ষা করতে চাই, এবং বাংলাদেশের জনগণকে তাদের স্বাধীনতা রক্ষায় সাহায্য করতে চাই যাতে তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের ইচ্ছেমত এবং পছন্দের সরকারের অধীনে থাকতে পারে।
শ্রী শেঝহাইয়ু আন ( কুম্বাকোনাম ) — মাননীয় স্পীকার, আমি ডি.এম.কে. র পক্ষ থেকে জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমর্থন জানাচ্ছি এবং সরকারের প্রতি আমাদের সংহতি প্রকাশ করছি। আমরা যুদ্ধ চাই নি কিন্তু আমাদের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে এবং আমরা আমাদের গণতন্ত্র রক্ষায় এবং রাষ্ট্রীয় অধিকার সংরক্ষণে এই যুদ্ধ আহবান গ্রহণ করছি। যদি পাকিস্তানী সামরিক সরকার মনে করে অস্ত্র দেখিয়ে আমাদের সরকারকে অচল করা সম্ভব তবে এখানে আমরা এবং বাংলাদেশের জনগণ যারা তাদের সকল বিশ্বাস ও জীবন গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় নিয়োজিত করেছে, এই যুদ্ধের আহবান গ্রহণ করবে। একতাবদ্ধভাবে আমরা লড়াই করবো এবং একতাবদ্ধভাবে আমরা অবশ্যই জিতবো।
শ্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী — স্পীকার মহাশয়, একটি জাতীয় সংকটের মধ্যে আমরা একত্রিত হয়েছি। পাকিস্তান আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীর অব্যাহত সাফল্যে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরানোর জন্য এবং এই ভূখণ্ডে আন্তর্জাতিক চাপ ডেকে আনার জন্য পাকিস্তান আমাদের নিরাপত্তা, অখণ্ডতা এবং আমাদের স্বাধীনতার প্রতি চ্যালেঞ্জ প্রদান করেছে।
আজ আমি দলীয় প্লাটফর্ম থেকে বলতে আসিনি। এখন সমগ্র দেশই একটি দল। রাজনৈতিক মতানৈক্য বিস্মৃত হয়ে, ছোটখাটো ব্যাপারসমুহ শিকেয় তুলে রেখে, সমগ্র দেশকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, পায়ে পা মিলিয়ে বিজয়ের জন্য সামনে অগ্রসর হতে হবে। এই যুদ্ধ যত ত্যাগ চাইবে, তা প্রদান করা হবে। এরুপ পরিস্থিতিতে যে জাতীয় সংকল্প অপরিহার্য হয়ে ওঠে, এই সংকটকালে আমরা সেই সংকল্পের পরাকাষ্ঠা দেখাব না এমন ভাববার কোন কারণ নেই।
স্পীকার মহোদয়, মায়েরা যে দিনের জন্য সন্তান ভূমিষ্ঠ করে আজ সেদিন সমাগত। বোনেরা যেদিনের জন্য ভাইদের হাতে রাখী বেঁধে দেয় সেদিন এসে গেছে। পাকিস্তান যদি এই ভেবে থাকে যে সে প্রতারণা করে আক্রমণ চালিয়ে অসতর্কভাবে আমাদের কাবু করে ফেলবে তবে সেটি তার ভুল হবে। বিশ্ব দেখেছে আক্রমণকারী কে এবং আক্রমণকারীকে আমাদের সেনাবাহিনী দাঁতভাঙ্গা জবাব দিচ্ছে।
আমরা আশা করব, ইতিহাস পরিবর্তনের জন্য মুহূর্তের দায়িত্ব যাদের হাতে ন্যাস্ত, এবং প্রধানমন্ত্রী, যিনি এই সংকটকালে দেশের নেতৃত্ব দেবার জন্য এগিয়ে আসছে, আমাদের কামনা, এই দেশ জয়যুক্ত হোক এবং প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে আমরা একটি নতুন ইতিহাসের জন্ম দেই।
স্পীকার মহাশয়, আমি চাই এই আক্রমণের সময়ে এই সংসদকে ইয়াহিয়া খাঁর বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। পাকিস্তানে পার্লামেন্ট নেই। পাকিস্তান সরকারের জনসমর্থন নাই। এখানে জনপ্রতিনিধিরা উপবিষ্ট আছেন। বিশ্বরাষ্ট্রসমুহ দেখছে, এবং ভবিষ্যতেও দেখবে, সংকটের সময় এক হয়ে প্রত্যুত্তর দেবার সামর্থ্য এই দেশের আছে।
আমি এও প্রত্যাশা করব যে, যুদ্ধ তৎপরতায় সকলকে সহগামী করে তোলার জন্য পরিকল্পনা তৈরী করা হোক, পৃথকভাবে কাজ ভাগ করে দেয়া হোক, এবং দেশে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হোক যাতে এই যুদ্ধে আমরা বিজয়ী হতে পারব।
আজ জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, আমি এটা সমর্থন করি একথা বলাই বাহুল্য। এ ব্যাপারে আমি বন্ধু, গোপালনের সঙ্গে একমত নই যে, এর কোন প্রয়োজন ছিল না। পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, পাকিস্তান হঠাৎ আক্রমণ করেছে। এ সময়ে আমরা কোনরূপ শীথল নীতি দেখাব সে প্রশ্নই উঠতে পারে না। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, সংসদ তাকে পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে, এবং ভবিষ্যতেও দেশের নিরাপত্তার ব্যাপারে যে সব পদক্ষেপ নেয়া হবে, এই সংসদ তা সমর্থন করবে। সমগ্র দেশ এক ব্যক্তি রূপে এই চ্যালেঞ্জের জবাব দিতে সক্ষম হবে।
শ্রী শ্যামনন্দন মিশ্র ( বেগমসরাই ) — জনাব মাননীয় স্পীকার, আজকে আমি আমার দলের পক্ষ থেকে বলতে চাই, আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে আমরা জাতি হিসেবে দুর্বার ও একতাবদ্ধ। আজকে আমরা আমাদের মাঝে কোন পার্থক্য খুঁজে পাই না, পার্থক্য শুধুমাত্র আক্রমণকারী আর তাদের মিত্রদের সাথে। অতীতে আমাদের মধ্যে কিছু মতভেদ থেকে থাকতে পারে কিন্তু আজকে সেসব শুধু বিবর্ণই হয়নি, সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
আজকে আমার মতে জাতির সামনে শুধু একটাই কর্তব্য, সাফল্যের সাথে আক্রমণকারীকে প্রতিহত করা। এবং কেবলমাত্র দ্বিধাহীন ও পূর্ণ একতার সাথে একক নেতৃত্বে এই কাজ করা সম্ভব। আর সকল সংকীর্ণতা ঝেড়ে ফেলে দিয়ে এই পন্থা অর্জন ও বজায় রাখা সম্ভব।
জনাব, আক্রমণকারীর বিবেচনায় এই যুদ্ধ অত্যন্ত স্থির ও হিসেবী হবে। আক্রমণকারীরা আমাদেরকে দশ দিনের সময় দিয়েছিল। আমার মতে রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান তার কথা রেখেছেন।
তিনি তার দেশের জনতাকে জানিয়েছিলেন যে দশ দিনের মধ্যে তিনি যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। এখন আমি এই দেশের পক্ষ থেকে বলতে চাই আজকে সমগ্র জাতি আক্রমণকারীর বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
যদি রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান ভেবে থাকেন তিনি একজন জেনারেল ছিলেন এবং আমাদের প্রধানমন্ত্রী জেনারেল ছিলেন না, তবে আমি জানিয়ে দিতে চাই, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শুধুমাত্র এই জাতির কোমলতার প্রতীক নন, ইস্পাত ও গ্রানাইট পাথরের মত দৃঢ় ও মজবুত সত্তারও প্রতীক এবং আমাদের পক্ষ থেকে তিনি দুর্গা মায়ের মত ক্ষমতাবান।
আমরা মহাত্মা গান্ধীর উত্তরসূরি হিসেবে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বেড়ে উঠেছি। আমরা কখনোই নিজেদের আক্রমণকারী হিসেবে ভাবতে পারি না। আমরা কখনোই নিজেদের আক্রমণকারী রূপে মানাতে পারব না বরং আমরা চতুর্থ বারের মত পাকিস্তানের আক্রমণের শিকার হলাম। অতীতের সকল আক্রমণ ভারত প্রত্যাহত করেছে, আশা করি এবারের আক্রমণ এমন নিশ্চিতভাবে প্রত্যাহত করা হবে যাতে আক্রমণকারী ভবিষ্যতে পুনরায় আক্রমণের সাহস না পায়।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যাতে সব ধরণের পদক্ষেপের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত থাকে সেই বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিভিন্ন উন্নত দেশগুলো বিভিন্ন রকম কূটনৈতিক সাহায্যের জন্য প্রস্তুত থাকতে পারে। ৭এ০ই সকল বিষয়ের ধারণায় আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি, আমাদের দেশ সম্পূর্ণ একাগ্রতার সাথে যেকোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত আছে, এবং আমাদের সরকার বিশ্বাস, ভরসা এবং সহিষ্ণুতার সাথে এই কর্ম সম্পন্ন করতে পারবে, যেমনটা গত রাতে প্রধানমন্ত্রী তার সম্প্রচারে ব্যক্ত করেছেন।
আমি নিশ্চিত অন্য যেকোন কারনেই আমাদের সমাজের মধ্যে বিভেদ থেকে থাকুক না কেন, আজকে আমরা একটি জাতি হিসেবে উঠে দাঁড়াবো এবং যেকোন দায়িত্ব আমাদের উপর এসে বর্তাক আমরা তা পরিপূর্ণতার সাথে সম্পন্ন করতে পারবো। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের পরিপূর্ণতা ছাড়া সন্তুষ্ট হওয়া উচিৎ নয়।
জনাব স্পীকার, এই বক্তব্যের সাথে আমি আমার দলের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাতে চাই। এটা অত্যন্ত মামুলি শোনালেও আমরা গুরুত্বের সাথে জানাতে চাই যে, সম্ভাব্য সকল উপায়ে আমরা এই আক্রমণকারীদের বিপক্ষে দেশকে সচল রাখার চেষ্টা করবো।
শ্রী ফ্রাঙ্ক অ্যান্থনি ( নির্বাচিত অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ) — মাননীয় স্পীকার, আমার ইউনাইটেড ইন্ডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের সদস্যদের সাথে সেইরকম সহানুভূতি নিয়ে সহযোগিতা করার সুযোগ হয়েছিল যা অন্যান্য দলের মুখপাত্রের মধ্যেও ছিল।
এই তো সেদিন মদ্ধাহ্নভোজের সময় আমেরিকার সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চের সাথে আমি বলেছিলাম, আমি কিছুদিনের মধ্যে পাকিস্তান জান্তার তরফ থেকে আক্রমণ আশা করছি। উনি আমার কাছে এর কারণ জানতে চাইলে আমি ইসলামাবাদের অবর্ণনীয় নৃশংসতার কথা জানাই্, এবং এই সামরিক জান্তা বুঝতে পেরেছে যে তারা বেশীদিন বাংলাদেশকে দখলে রাখতে পারবে না তাই অন্যান্য স্বৈরাচারী শাষকের মত নিজেদের মুখ বাঁচাতে আমাদের উপর আক্রমণ করবে এবং তাই ঘটেছে।
সভায় উপস্থিত সকল দলের মুখপাত্র এবং প্রতিনিধিগণ এই জাতীয় সংকটলগ্নে অকুণ্ঠভাবে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারের প্রতি অটল সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু আমি মনে করি আমরা এই বিষয়েও একমত যাতে এই সময় আরেকটি তাশকেন্ট ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
নিরাপত্তা পরিষদ এবং অগ্রগামী দেশের সরকারগণ অত্যন্ত কঠোর ও অমানবিকভাবে নিশ্চুপ ছিল যখন ইসলামাবাদের কসাই ও তার ভাড়াটে সৈন্যরা লক্ষাধিক অসহায় পুরুষ, মহিলা ও শিশুর হত্যা করে এবং দশ লক্ষাধিক লোককে আমাদের সীমান্তে ঠেলে দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণ শুরু করে।
বাস্তবিকপক্ষে, কিছু সরকার আমাদের নিজেদের সীমান্ত রক্ষা না করার এবং আমাদের সৈন্য ফিরিয়ে নেবার মত হঠকারী উক্তিও করেছে, যখন তারা ইতিহাসের বৃহৎ এই গণহত্যা নিয়ে কথায় ও কাগজে ফুলঝুরি ফোটাচ্ছিলেন। আমি বিশ্বাস করি, এই গণহত্যায় উৎসাহের জন্য হলেও ইসলামাবাদের কসাইয়ের পূর্ণ মাত্রায় ভারত আক্রমণের সাহস হত না যেমনটা সে করেছে। সারা বিশ্ব জানে ভারত কিভাবে সংযমের পরিচয় দিয়েছে। বিশ্ব জানে ক্রমবর্ধমান আক্রমণ সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রীর শক্তি ও ক্ষমতা রয়েছে ভারতকে বিবেচনাযোগ্য সময়ের জন্য শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখার।
জাতির জন্য বিশেষত প্রত্যেকটি ভারতীয়র জন্য এই যুদ্ধ তাদের চারিত্রিক পরীক্ষা স্বরূপ। এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে, সব যুদ্ধের মত এখানেও বিসর্জন ও ভোগান্তি বৃহৎ আকারের। কিন্তু আমরা এটা জেনে উৎকর্ষ বোধ করতে পারি যে আমরা এমন এক অশুভ সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছি যার হাত অসহায় মানুষের রক্তে রাঙ্গা, সর্বোপরি আমরা এটা জেনে উৎকর্ষ বোধ করতে পারি যে, আমরা শুধু আমাদের দেশের জন্যই যুদ্ধ করছি না, আমরা যুদ্ধ করছি গণতন্ত্রের জন্য এবং যে যুদ্ধে বর্ণ, গোত্র, সম্প্রদায় নির্বিশেষে আমরা শুধুমাত্র ভারতীয় হিসেবে উল্লেখিত হব এবং একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ইসলামাবাদের রক্ত পিপাসু যুদ্ধবাদী উন্মাদকে পরাজিত করতে পারবো।
শ্রী পি.কে. দেও ( কালাহান্ডি ) — জনাব মাননীয় স্পীকার, ভারতের এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে বক্তব্য দেবার সুযোগ পেয়ে আমি গর্ব বোধ করছি। আমি জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমর্থন জানাচ্ছি এবং পাকিস্তান কতৃক ভারতীয় জনগণের উপর অনর্থক, স্থূল এবং উন্মুক্ত আক্রমণ ও বোমা বর্ষণের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
এটি শান্তিপ্রিয় লোকের বিরুদ্ধে ইতিহাসের সবচেয়ে জঘন্য আক্রমণ হিসেবে লিখিত থাকবে। পাকিস্তানের এহেন কর্ম পার্ল হারবারে জাপানীদের অপ্ররোচিত আক্রমণকেও তুচ্ছ প্রমাণ করেছে।
পাকিস্তানের সাধারণ জনগণের সাথে আমাদের কোন বিবাদ নেই। এটা ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বাধীন সামরিক দলের কর্ম, যারা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বোঝে না এবং নিজেদের লোকদের উপর গণহত্যা চালিয়ে ভারতের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
ভারত যদি কিছু করে থাকে তবে তা হল, মানবিক ও সহানুভূতির কারণে দশ লক্ষাধিক বাংলাদেশী শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।
এই উপলক্ষে সারা দেশ একতাবদ্ধভাবে প্রধানমন্ত্রীর স্বপক্ষে জেগে উঠবে। স্বতন্ত্র দল সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে এবং জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছে যাতে তাদের মনোবল ইস্পাতের মত মজবুত করে এবং দেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় সম্মান রক্ষায় রক্ত দিতে ও সর্বচ্চো বিসর্জনের জন্য প্রস্তুত থাকে।
আমি সরকারের কাছে আবেদন জানাই যাতে ১৯৪৯ এবং ১৯৬৫ সালের যুদ্ধবিরতির মত বোকামি না করে এবং সবধরণের চাপ প্রয়োগ করে এই দন্দের সমাপ্তি ঘটায় এবং জয়ই হতে পারে একমাত্র যৌক্তিক সমাপ্তি।
জনাব, সত্য ও ন্যায় আমাদের পক্ষে। সৃষ্টিকর্তা সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে। আমাদের উৎকৃষ্ট সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে যা নিয়ে যেকোনো দেশ গর্ব করতে পারবে। তাই জয় আমাদের হবেই।
শ্রী সমর গুহ ( কন্তাই ) — পাকিস্তানের উন্মাদ সামরিক একনায়ক আমাদের জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এই যুদ্ধ আমাদের জাতীয় সম্মান রক্ষার, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষার এবং সেসব সকল মূল্যবোধ রক্ষার যার ভিত্তিতে আজকে আমরা স্বাধীন।
জনাব, এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নাই যে সমগ্র জাতি আজকে এই যুদ্ধকে মেনে নিবে বরং তারা এই যুদ্ধকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সরবাধিক মূল্যবোধ রক্ষার জেহাদ হিসেবে গ্রহণ করবে যা থেকে পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ বঞ্চিত।
জনাব, আমি ভারতীয় সোশালিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আমার দল ও নিজেকে দেশের জাতীয় সম্মান ও নিরাপত্তা রক্ষার গুরু দায়িত্ব পালনে সমরপন করছি।
ইয়াহিয়া খানের এই বিশ্বাসঘাতি আক্রমণ ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে, যা একদিক থেকে ভারতীয় প্রেরণাকে এক উচ্চ মাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। এটা আমাদের ভারত, মহাত্মা গান্ধীর ভারত, পণ্ডিত জওহারলাল নেহেরুর ভারত, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের ভারত, যে ভারত সমগ্র জাতির জন্য ঝুকি নিতে পারে, বিশাল বিসর্জনের জন্য ঝুকি নিতে পারে, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য চরম ভোগান্তি ও ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে, যার ঐতিহাসিক বন্ধন ও ঐতিহ্য তিন হাজার বছরের পুরনো ভারতীয় সভ্যতা এবং আমাদের জাতির অংশ, আজ তা হুমকির সম্মুখীন। তাই যদি ঝুকি নিতে হয় আমরা আমাদের সর্বস্ব দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার ঝুকি নিতে প্রস্তুত। আজকে যখন বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী ও ঔপনিবেশিক শক্তি তাদের পুরাতন রাজনৈতিক শক্তি ও সংকীর্ণতায় নিমজ্জিত, তখন বিশ্বের ভবিষ্যৎ ইতিহাস এবং মানবতার ভবিষ্যৎ ইতিহাস স্বাক্ষী থাকবে যে একটি জাতি একটি অংশের জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেছিল, যেখানে সামরিক স্বৈরশাসক এমন হত্যা ও জঘন্য অপরাধ ঘটাতে চেয়েছে যা বিশ্ব আগে কখনও দেখেনি।
আজকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। আজকে আমাদের বাংলাদেশী বন্ধুদের জানাতে চাই, এই স্বাধীনতা সংগ্রাম শুধুমাত্র সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়, ৫৫ কোটি ভারতীয়রও সংগ্রাম। ইয়াহিয়া সরকারের জানা উচিৎ, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সর্বাধিক মূল্যবোধ রক্ষার এই সংগ্রাম ৬৩ কোটি জনতার যৌথ সংগ্রাম।
আমি প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে আরেকটি কথা বলতে চাই। আজকে তিনি কোন একক ব্যক্তিত্ব নন, নন কোন দলের প্রধাণ কিংবা ভারতের প্রধাণমন্ত্রী, আজকে তিনি আমাদের দেশের ব্যক্তিত্ব এবং জাতির জ্বলন্ত নিশান। সমগ্র জাতি মহাশক্তির এই জ্বলন্ত নিশান দেখতে সম্ভবপর সব কিছু করতে প্রস্তুত। ভারতীয় জনতার ধর্ম বিশ্বাসের এই মহাশক্তি শুধুমাত্র পাকিস্তানী আগ্রাসনকে উপড়েই ফেলবে না, শুধুমাত্র আমাদের জাতীয় সীমান্তই রক্ষা করবে না, চিরতরে পাকিস্তানের একনায়কতন্ত্রের সকল যুদ্ধ সরঞ্জামকে দুমড়ে মুচড়ে দিবে যা বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে চূর্ণ করতে চেয়েছিল।
আধ মরা সাপ অত্যন্ত ভয়ংকর। সাপকে মারতে হবে এবং চিরতরে শেষ করতে হবে, আমরা চাই ইয়াহিয়া খানের সাপকে চিরতরে শেষ করতে।
আমি এই পর্যবেক্ষণে আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই যে, এই গুরুতর মুহূর্তে আমাদের নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস এর স্বাধীনতা সংগ্রাম কালীন নেয়া অঙ্গীকার অনুসরণ করা উচিৎ। তিনি সেই সময়ে মুক্তি সেনাদের জন্য ৩ টি প্রাথমিক মন্ত্র বা ভিত্তি প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি একতা, ভরসা এবং বিসর্জন এই শব্দগুলো ব্যবহার করেছিলেন। জনগণের একতা, আমাদের সর্বোচ্চ মূল্যবোধের উপর ভরসা এবং এই দুটি লক্ষ্য পুরনের জন্য সর্বোচ্চ বিসর্জন।
ইতিমধ্যে বক্তব্য দেয়া আমার বাকি বন্ধুগণ প্রস্তাব রেখেছেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সারা বিশ্বকে অবশ্যই জানানো উচিৎ যে, আমরা ভারতীয় জনগণ স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য আমাদের সবকিছু ঝুকির মুখে রাখতেও প্রস্তুত।
শ্রী ইব্রাহীম সুলাইমান সাইত ( কোঝিকোডে )— মাননীয় স্পীকার, আমি এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আমাদের পবিত্র দেশের উপর পাকিস্তানের অপ্ররোচিত নগ্ন হামলার তীব্র নিন্দা জানাই। আমি আরও আমার মাতৃভূমির রাষ্ট্রপতির জরুরী ঘোষণার পক্ষে সমর্থন জানাই।
আজকে দেশ ইতিহাসের অন্যতম সংকটপূর্ণ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আজকের এই সংকট মুহূর্তে দেশ এবং দেশের বাইরের সবার বোঝার সুবিধার জন্য আমি পরিস্কার করে বলতে চাই, এই দেশের ৮ কোটি সক্ষম যোদ্ধা মাতৃভুমির নিরাপত্তা, সম্মান এবং অখণ্ডতা রক্ষার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ এবং প্রয়োজনে জীবন দিতেও প্রস্তুত আছে।
জনাব, অতীতে আমাদের দেশ বিভিন্ন সংগ্রামে রক্তের সাগর পার করেছে। আজকে একই পরিস্তিতিতে, সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে এই সংগ্রামও আমরা সফলতার সাথে পার করতে পারবো।
আমি এইসব কোন পক্ষের ভয়ে ভীত হয়ে বলছি না বা কারও পক্ষপাতিত্ব করতেও বলছি না। কিন্তু দেশপ্রেম, দেশের নিরাপত্তা এবং দেশের সাহসী সেনার উপর ভরসা থেকে বলছি। সেকারণে, সংসদে আমার সম্মানিত সহকর্মী জন সংঘ দলের নেতা শ্রী বাজপেয়ীর সাথে একমত হয়ে বলতে চাই, আজকে আমাদের কোন দলীয় পার্থক্য নেই। আজকে আমাদের একটাই দল, ভারতীয় দল এবং একজনই নেতা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।
আমার দল ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ এর পক্ষ থেকে আমি আমার দেশ, সরকার এবং জনতার উপর পূর্ণ সমর্থন জানাই। আমি আরও আমাদের যুদ্ধরত সেনাদের শুভ কামনা জানাই।
শ্রী এস.এ.শামীম ( শ্রীনগর ) — স্পীকার মহোদয়, এই সংসদ এবং এই দেশ গত ২৫ বছরে খুব নাজুক ও ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু আজকের মুহূর্ত সম্ভবত এ দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশী নাজুক এবং সবচেয়ে বড় ঐতিহাসিক মুহূর্ত। এর আগে আমরা যুদ্ধ করেছি নিজ দেশ রক্ষার জন্য, নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, কিন্তু আজকের যুদ্ধের তাৎপর্য ভিন্নতর। আজ আমরা শুধু নিজ দেশ রক্ষার জন্যই লড়াই করছি না, আমরা বাংলাদেশের জন্যও লড়ছি। আমরা শুধু নিজ দেশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াই করছি না, বরং পশ্চিম পাকিস্তানের পরাধীন জনগণের স্বাধীনতার লড়াইও লড়ছি। বিশ্বাস করুন এ যুদ্ধে শুধু ভারতের ৫৫ কোটি লোকই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বমানব এবং বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের উৎপীড়িত জনতাও আপনাদের সঙ্গে রয়েছে যারা বিগত ২৫ বছর ধরে ইয়াহিয়া খান ও আইয়ুব খানের মিলিটারী শোষণ যন্ত্রে নিষ্পেষিত হচ্ছে।
সুতরাং আমি মনে করি, আজকের যুদ্ধ শুধু সীমান্ত রক্ষার যুদ্ধ নয়। আজকের যুদ্ধ মহাত্মা গান্ধী, জওয়াহেরলাল নেহেরু এবং মারটিন লুথার কিং প্রমুখেরা যে স্বপ্ন দেখেছিলেন সেসব স্বপ্ন প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। এই যুদ্ধের সীমারেখা ফাজেলকায় শেষ হয় না, কাশ্মীরে শেষ হয় না এর সীমারেখা আপনি ভিয়েতনামের সঙ্গে মিলিত দেখতে পাবেন। রোডেশিয়ার জনগণের যুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের মধ্যে গভীর পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং আমি আশা করি, দেশের জনগণ এ যুদ্ধের গুরুত্ব বুঝবে।
সংসদের সামনে আমি এই বিশেষ দিক থেকে বলতে চাই যে, দেশের সেই রাজ্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক যার ওপর পাকিস্তানের লোলুপ দৃষ্টি বিগত ২৫ বছর ধরে লেগে আছে। আমি এই সংসদকে, এই দেশকে এবং সমগ্র বিশ্বের মানুষকে যারা, যেকোনো স্থান থেকেই হোক না কেন, অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে – প্রত্যায়িত করতে চাই যে, যেভাবে কাশ্মীরের জনগণ অতীতে পাকিস্তানী আক্রমণের এবং পাকিস্তানী হীন ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করেছে, এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক যুদ্ধে কাশ্মীরের বাহাদুর ও দুর্ধর্ষ জনগণ শুধু পাকিস্তান সামরিক জান্তাকেই নয় বরং পাকিস্তানের আদর্শকেও টলিয়ে দেবে।
মাননীয় স্পীকার — আরও অনেক সম্মানিত সংসদ সদস্যগণ তাদের বক্তব্য পেশ করতে আগ্রহী। আমি তাদেরকে ১ থেকে ২ মিনিতের মধ্যে তাদের বক্তব্য শেষ করার অনুরোধ করছি। এই বিষয়ে ইতিমধ্যে প্রচুর বক্তব্য রাখা হয়েছে।
শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী ( বেরহামপুর ) — মাননীয় স্পীকার, আজকে সভায় জরুরী অবস্থা ঘোষণার এই ঐতিহাসিক মুহূর্ত এবং আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ প্রতিহত করার সংকল্পের সর্বসম্মত সমর্থনের সাথে আমি একমত।
এই মুহূর্ত কথার নয় কাজের। তাই আমি এই সভায় লম্বা বক্তব্য রাখতে চাই না। কিন্তু আজকে আমি আমার কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হবো যদিনা, আমি সরকার এবং নেতৃবৃন্দের প্রতি কোন সতর্কবাণী না উচ্চারণ করি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, এই যুদ্ধ শুধু ভারতের নিরাপত্তা এবং অখণ্ডতা রক্ষার যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ অনেকটা সে কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। আমরা ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে। বিশ্ব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানে অস্বীকার করেছে। বিশ্ব বাংলাদেশের প্রাথমিক সমস্যা বিষয়ে কর্ণপাত করা থেকে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে, বিশ্ব বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া বিস্ফোরণের কারণে ভারত যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে তা সম্পর্কে দেখতে ও জানতে ব্যর্থ হয়েছে। এই জন্য শুধুমাত্র ভারতের দ্বারাই স্বীকৃতি নয়, একই সময়ে বিশ্বকে জানাতে হবে এটা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ নয়। তাদেরকে অবশ্যই পরিস্কারভাবে জানাতে হবে এটা অন্য যুদ্ধ, বাংলাদেশের জনগণের যুদ্ধ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত অবশ্যই ভারতের অধিকার আছে বাংলাদেশের জনগণকে যুদ্ধ জয়ে সাহায্য করার।
এরই সাথে আমি আবারও জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমর্থন জানাই।
ডঃ কারনি সিং ( বিকানের ) — পাকিস্তান আমাদের জাতির সামনে বিশাল হুমকি জাহির করেছে। এখন প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের সামনে সময় এসেছে কোমর বেঁধে শুধু পাকিস্তান ও শত্রুর সামনে নয়, সমগ্র বিশ্বের সামনে ঐক্যের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরার। পাকিস্তান এই যুদ্ধ ত্বরান্বিত করেছে, আমার এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই শীঘ্রই বাংলাদেশ স্বীকৃতি পাবে এবং পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে, এবং আমি আশা করি নিজস্ব এই আগ্রাসনের কারণে সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ থেকে পাকিস্তান এই অঞ্চলের দুর্বল গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে উদিত হবে যেখানে ভারত অগ্রগামী ভুমিকায় থাকতে পারবে।
আমি বলতে চাই, আমাদের অসংখ্য অল্পবয়সী সংসদ সদস্যগণ নিজেদের সামর্থ্যের শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও দেশের প্রতিরক্ষায় নিয়োজিত হতে চায়। আমার ৩০ বছর আগের বিশ্ব যুদ্ধে বিমান বাহিনীতে যোগদান করার স্বপ্ন ছিল, এবং আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যোগদান করে সেবা প্রদানের অঙ্গীকার করছি।
আমি লক্ষ্য করেছি সংসদের বিভিন্ন দলের সম্মানিত সদস্যরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। আমরা স্বতন্ত্র সদস্যরাও একই ভাবে সমর্থন জানাচ্ছি। এবং আমি আশা করছি জরুরী সময়ে প্রধানমন্ত্রী তার বিজ্ঞতার বিচারে জাতীয় সরকার কাঠামো গঠনের বিবেচনা করবেন।
আমাকে বক্তব্য দেবার সময়ের জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাই। আমি শুধুমাত্র এটুকু বলতে চাই যে, আমার সম্মানিত বন্ধু জনাব শামীম এবং অন্যান্য মুসলিম বন্ধুগণ বিশ্বকে নিশ্চিত করেছে যে ভারত ধর্ম নিরপেক্ষ দেশ, যা একসময় মহান মহাত্মা গান্ধী এবং জওয়াহেরলাল নেহেরু বলতেন। তারা প্রমাণ করেছেন ভারত প্রকৃতপক্ষেই ধর্ম নিরপেক্ষ জাতি।
শ্রী ভি.কে. কৃষ্ণ মেনন ( ত্রিভেন্দ্রুম ) — এই সভায় সর্ব সম্মতভাবে যে অনুভূতির প্রকাশ পেয়েছে তা শুধু পাকিস্তানের প্রতি ঘোষণাই নয়, পুরো বিশ্ব, বিশেষ করে বিশ্বের সেসব অংশের জন্য যাদের অস্ত্র সর্বদা আমাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহার করা হয়। এই অভিব্যক্তিগুলো জাতির অনুভূতি থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছে। যদি প্রধানমন্ত্রী কখনও এর প্রমাণ চাইতেন তবে আজ তা তিনি তাদের মুখ থেকেই পেয়েছেন যারা পেশাদারিত্ব থেকে নয় বরং তাদের কাজের অংশ হিসেবেই তার সমালোচনা করে থাকে।
বেলা ১২ ঘটিকা
এই মুহূর্তে ১ থেকে ২ টি ব্যাপারে আমি আলোচনা করতে চাই। আমি বলছি না এই বিষয়ে আমার কথাই শেষ কথা। কাশ্মীরে যুদ্ধ বিরতি এখন আর কার্যকর নয়। আগ্রাসনের ফলে এই যুদ্ধবিরতি অঙ্গীকার অকার্যকর হয়েছে। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণ দলের সদস্যদের বহির্গমন অনুমতিপত্র বিষয়ক সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হবে। কারণ যুদ্ধ বিরতি পর্যবেক্ষণ করা এখন তাদের উদ্দেশ্য নয় বরং পর্যবেক্ষণ করা আমাদেরকে প্রতিহত করা শক্তির মিত্রদের। উপরন্ত, এই পর্যবেক্ষকগণ জেকন সময় মারা যেতে পারেন। তাই আমাদের মহান দায়িত্ব থেকে আমরা তাদের কে ফেরত পাঠিয়ে দিতে পারি বা আমাদের অতিথিশালায় রাখতে পারি, কারণ এ ব্যপারে বিশাল আন্তর্জাতিক দায়িত্ব রয়েছে। একজন আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের জীবন এমন আবেগী পরিবর্তন আনতে পারে যে জাতিসংঘের কাছে অন্য কিছুর মূল্য থাকবে না।
দ্বিতীয়ত, আমার শ্রবণ শক্তি এখনও প্রখর এবং আমি শুনেছি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমি আমি তার বক্তব্যের সথিকতা যাচাইয়ের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছি। কারণ, যদি পাকিস্তান আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সেটা এক বিষয়। কিন্তু যদি পাকিস্তান বলে থাকে তারা যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা করেছে তবে তা ভিন্ন বিষয়। যুদ্ধাবস্থা ঘোষণা পাকিস্তান কেবল নিজ দেশে করতে পারে এবং তথাপি তা অঘোষিত যুদ্ধ। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা জড়িত, যুদ্ধ বিদ্যমান। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের রাষ্ট্র দূতকে বহির্গমনের অনুমতিপত্র দেয়া উচিৎ, যা বাংলাদেশের স্বীকৃতি দানের পথের সকল বাধা দূর করবে। এই প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমাদের কাছে পাকিস্তান আর এখন স্বীকৃত রাষ্ট্র নয়। অবশ্যই যদি তারা যুদ্ধ ঘোষণা করে তবে এর একটা শেষ আছে। এবং এই বিষয়ে আমাদের মাঝে কোন বাধা নাই। কিন্তু এই বিষয়টা পরিষ্কার করতে হবে, কারণ প্রধানমন্ত্রী তার বিশেষ অবস্থানে থেকে যদি সংসদে বলেন যে পাকিস্তান আমাদের বিপক্ষে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তবে আন্তর্জাতিক অভিমত অনুসারে এটাকে বাড়িয়ে বলা হয়েছে বলে উল্লেখ করা হবে। এটা অবশ্যই বাড়িয়ে বলা হয় নি কিন্তু এই ব্যাপারে আমাদের নিজেদেরকে কোন ঝামেলায় জড়ানো উচিৎ হবে না। এটা যদি ঘোষিত যুদ্ধ না হয় তবে অঘোষিত যুদ্ধ যা স্বতপ্রনোদিত যুদ্ধ নামে পরিচিত। স্বতপ্রনোদিত যুদ্ধ সবচেয়ে কলুষিত। এই পদ্ধতিতে কাকে আঘাত করা হবে এবং কোথায় আঘাত করা হবে তা অবশ্যই সরকারের সিদ্ধান্ত, জেনারেল এর না। যুদ্ধের মত গুরুতর বিষয় জেনারেলদের হাতেই ন্যস্ত থাকা উচিৎ। তাই এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রী যদি অন্য কোন কাজে নিয়োজিত না থেকে থাকে তবে, তিনি এ বিষয় নিশ্চিত করবেন যাতে যুদ্ধে কাকে এবং কোথায় আঘাত করা হবে তা যেন শুধু জেনারেল কতৃক নির্ধারিত হবে।
আমি আশা করি, আজ, কাল কিংবা যেকোনো সময় বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবেই এবং তা হবে পাকিস্তানের প্রতি যথার্থ জবাব। যা কিনা আমাদের প্রাণঘাতী আঘাতের মতই শক্তিশালী।
আমি এই বলে শেষ করতে চাই যে, এটি একটি শোচনীয় অধ্যায়। যুদ্ধ একটি ভয়ংকর ব্যাপার, বিশেষ করে আমাদের মত বিশাল জনসংখ্যার জন্য যাদের আশ্রয়ের এবং এ জাতীয় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাব রয়েছে, এবং সেই জাতির জন্য যারা নিজের মাটিতে ওয়ান্ডিওয়াশ লড়াইয়ের পর কোন যুদ্ধ দেখেনি। এই বিষয়ে বলতে হবে, আমাদের জনগণ এবং পেশাদার সেনাবাহিনী গৌরবের সাথে অনেক যুদ্ধক্ষেত্রে লড়েছে, কিন্তু নিজেদের মাটিতে আমরা যুদ্ধ দেখিনি। যুদ্ধ একটি ভয়ংকর ব্যাপার যেখানে অন্ধকারাচ্ছন্ন ও বোমা বর্ষণের ও বিভিন্ন বিষয়ের ভয় থাকে। এই ভয়ংকর সময়ে কে কত বেশী চরমপন্থি বক্তব্য দিতে পারে তার প্রতিযোগিতা হতে পারে। আমি প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করে বলতে পারি যে আমি একটি দলের প্রতিনিধিত্ব করি এটা ছাড়া আর কোন পার্থক্য আমাদের নেই, আমরা সকলে এক জাতি।
ষোড়শ শতাব্দীতে স্পেন এর ফিলিপ ব্রিটেন দখলের সময় ভেবেছিলেন স্কটল্যান্ড এর মেরী কুইন তাকে সাহায্য করবে, যেহেতু তিনি ক্যাথলিকদের নিষ্পন্ন করেছিলেন। কিন্তু এটা একই ব্যাপার যা আপনি মুসলিম লীগের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে শুনেছেন। আমরা একটি দেশ এবং একটি জাতি এবং আমার বলতে কোন দ্বিধা নেই আজকে আমরা ব্যক্তিগত আদর্শ নির্বিশেষে একক নেতৃত্তের অধীনে। আমি মনে করি না তিনি এদেশে সমাজতন্ত্রবাদ ফিরিয়ে আনবেন। আমি খুব অকপটে এই কথা বলতে চাই কারণ আপনি অবশ্যই একটি গর্তে ঝাঁপ দিয়ে তারপর লফ দিতে পারবেন না। কিন্তু এটা ভিন্ন ব্যাপার যা আমরা পরবর্তীতে বিবেচনা করবো। এই জাতি টিকে থাকলে সমাজতন্ত্র বা কোন তন্ত্রই কাজ করবে না। এই জাতির টিকে থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।
যুদ্ধের বিষয়ে আসা যাক, এই দেশ যুদ্ধকে প্রতিহত করতে চেয়েছিল। কিন্তু যুদ্ধবিরতির সময় দুর্ভাগ্যবশত অন্য দেশের কারণে যদি আমাদের সম্মুখ যুদ্ধের সেনাদের সংকটপূর্ণ আবস্থার মুখোমুখি হতে হয়, যখন সেই অন্য দেশ আমাদের সীমান্ত লঙ্ঘন সহ এই ধরণের অপরাধ ঘটায় তখন ভিন্ন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তাই যদিও আমরা শান্তিতে বিশ্বাস করি কিন্তু আমাদের পরিস্থিতি প্রাক্তন আমেরিকান রাষ্ট্রপতির মত, যিনি বলেছিলেন, ” আমি যেকোনো মূল্যে শান্তি কামনা করি এবং বর্তমানে শান্তির মূল্য যুদ্ধ। ” কিন্তু বর্তমানের এই বিষয়ে আমাদের কোন সিদ্ধান্ত নিতে হয় নি, শত্রুই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। তারা আমাদের বিমান ঘাটিতে বোমা বর্ষণ করে আমাদের সেনাদের অকেজো করে দিতে চেয়েছে। এবং আমার কোন সন্দেহ নেই এই ব্যাপারে যে এই যুদ্ধে পাকিস্তানের সাধারণ জনতার সাথে আমাদের কোন শত্রুতা নেই এবং আমরা নাজিদের মত তাদের সীমানা লঙ্ঘন করে তাদের নিরীহ লোকদের হত্যা করে তাদের দেশ দখলের চেষ্টা করবো না, যেমনটা শ্রী ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত তার বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন। শুধুমাত্র চরম পরিস্থিতিতে সামরিক বাহিনীর বোমা বর্ষণে সাধারণ জনগণের সমস্যা হতে পারে। কিন্তু আমরা নাপাম বোম নামের প্রাণঘাতী বোমার ব্যবহার করবো না যা অল্পবয়সীদের পঙ্গু করে দেয়। আমি জানি শত্রুকে কখনোই গুড়িয়ে দেয়া যাবে না, একবার গুড়িয়ে দিলে আমার পুনর্গঠিত হতে পারবে, কিন্তু আমাদের সেইসব বিষ দাঁত ভেঙে দিতে হবে যা আমাদের কামড়ে দিতে চেয়েছিল।
জরুরী অবস্থা ঘোষণা বিষয়ে আমি একটি কথা বলতে চাই। এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে বিভিন্ন আইনি কারণে জরুরী অবস্থা ঘোষণা আবশ্যক ছিল। অন্যথায়, সরকারকে অনেক বিলম্ব ও অসংলগ্ন পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হত। যদিও তারা কর্মকর্তাদের পরবর্তীতে ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত প্রধানমন্ত্রী সেই মহান সম্রাটের প্রবাদ তার বিবেচনায় আনবেন, যাতে বলা হয়েছে মহান সম্রাট ও ছোট বুদ্ধি এক সাথে যায় এবং উদারতা সর্বদাই নুন্যতম পুণ্য। আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। শুধুমাত্র বিরোধী দল না সংসদের সকল সদস্যকেই একসাথে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। আমি জাতীয় সরকারের কথা বলছি না কারণ সরকার জাতীয়ভাবে নির্বাচিত। যখন দীর্ঘ যুদ্ধের প্রস্তুতি চলছে তখন সরকারের খেয়াল রাখতে হবে যেন আমরা নিজেদের মধ্যে কোন ঝামেলায় না জড়িয়ে যাই।
সবশেষে, আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী সংসদ অধিবেশন বন্ধ করবেন না। অনেকেরই ধারণা সংসদ হচ্ছে একটি বিলাসিতা যা আমরা সহ্য করি। আসলে এটা তা নয়। সংসদ একটি অপরিহার্য স্থাপত্য। মাঝে মাঝে সংসদ নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে তাই সংসদ কার্যক্রম অবশ্যই চালু রাখতে হবে। যখন লন্ডনে বোমা বর্ষণ করা হচ্ছিল তখন বৃটিশ সংসদ অধিবেশন মাঝ রাতে অনুষ্ঠিত হত এবং বাস্তবিকপক্ষে, ২ টি বোমা সংসদে আঘাত করেছিল যখন তাদের অধবেশন চলছিল। এই বিষয়টা হিটলারকে ভাবিয়ে তুলেছিল যে বোমা বর্ষণের সময়ও তারা স্থান ত্যাগ করছে না। আমাদের জনগণও একই ধরণের। আমরা দেশ প্রতিরক্ষায় অত্যন্ত আবেগী। যখন আমরা মহান সম্রাটকে তার ভিত্তি থেকে নড়িয়ে দিতে পারি, তখন আমরা আক্রমণকারীর সমর্থক মহান সম্রাজ্যকেও নাড়িয়ে দিতে পারবো। আমাদের বিশ্বকে সতর্ক করে দেয়া উচিৎ যে, ভারতের বিরুদ্ধে আক্রমণকারীকে সাহায্য করা ভারতকে আক্রমণ করার শামিল।
শ্রী এম. সত্যনারায়ণ রাও ( করিমনগর )— মাননীয় স্পীকার, এই মুহূর্তে বক্তব্য দেয়া নয় কাজ করা প্রয়োজন। আমাদেরকে বিসর্জন দিতে হবে। তেলানাঙ্গা প্রজা সমিতির পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রীকে নিশ্চিত করতে চাই যে সমগ্র জাতি তার সাথে রয়েছে। আসুন আমরা আমাদের ক্ষুদ্র সমস্যাগুলো ভুলে যাই। এখন আমাদের সামনে একটাই সমস্যা, আগত আক্রমণকারীকে কিভাবে এ দেশ থেকে নির্গত করা যাবে তার উপায় বের করা।
আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করবো যাতে আমাদের কম বয়সী সংসদ সদস্যদের উপর কিছু দায়িত্ব অর্পণ করতে। আমরা জানি আমাদের সৈনিকরা শুধু যুদ্ধ করছে না, তারা প্রয়োজনে জীবন দিচ্ছে। আমাদের উচিৎ যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে কিছু করা। অন্ততপক্ষে আমাদের সৈনিকদের মাঝে আত্মবিশ্বাস বাড়াতে সাহায্য করা উচিৎ, যাতে তারা বুঝতে পারে সমগ্র দেশ তাদের সাথে আছে এবং আমরাও কিছু করার চেষ্টা করছি। আমি আশা করি প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যার সমাধান করবেন।
শ্রী বিরেন্দর সিং রাও ( মহেন্দ্রগড় ) — জনাব, বিশাল হারিয়ানা পার্টির পক্ষ থেকে আমি এই সভায় পেশ করা সকল ভাবানুভুতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করছি। আমি নিজে একজন সাবেক সৈন্য হিসেবে গর্ব বোধ করছি। এবং আমি একজন বৃদ্ধ সৈনিক নই, বরং আজকে আমি নিজেকে অনেক কম বয়সী হিসেবে উপলব্ধি করছি। আমি প্রধান্মন্ত্রিকে নিশ্চিত করতে চাই যে, আমাদের লক্ষাধিক সাবেক সৈন্য ও সেনা কর্মকর্তা তাকে সমর্থন জানাচ্ছে। আমরা সবাই আমাদের দেশ রক্ষায় কথিন্তর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত আছি। আমি নিশ্চিত ভারত অবশ্যই জয়ী হবে কারণ আমরা ন্যায়ের পক্ষে। আমি নিশ্চিত, এই বিংশ শতাব্দীর দ্বারপ্রান্তে যেসব রাষ্ট্র নিজেদের মানবতার রক্ষক হিসেবে দাবী করছে তারা সবাই মানবতাকে হার মানিয়েছে। স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র ও মানবতার যথার্থ রক্ষক হিসেবে বিশ্ব দুয়ারে ভারতের উত্থান ঘটবে।
জনাব, আপনি মাননীয় স্পীকারের আসনে আসীন থাকা অবস্থায় আপনার পক্ষ হয়ে আমি কিছু কথা বলতে চাই।
মাননীয় স্পীকার — আপনি ইতিমধ্যে সাবেক সৈন্য হিসেবে আমার পক্ষে বলে ফেলেছেন।
শ্রী বিরেন্দর সিং রাও — গত রাতে আপনার জেলায় বোমা বর্ষণ করা হয়েছে। আমাদের পাঞ্জাব ও রাজস্থানের সীমান্তবর্তী এলাকার জনতা পশ্চিম বঙ্গ এবং আসামের মতই সাহসের পরিচয় দিয়েছে। আজ সকালে অমৃতসারে কিছু বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হয় এবং তাদের সন্তানদের দিল্লী পাঠানোর অনুরোধ করি যাতে তারা নিরাপদ থাকে এবং আমরা পাকিস্তানকে দীর্ঘ মেয়াদী উচিৎ শিক্ষা দিতে পারি। কিন্তু তারা সবাই আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা বলেছেন, অমৃতসার জনশূন্য করা হবে না, তারা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সেখানে থাকতে চান। মাননীয় স্পীকার, আমি আপনাকে সাধুবাদ জানাই এমন জেলার প্রতিনিধিত্ব করার এবং পাঞ্জাব ও রাজস্থানের সীমান্ত এলাকার জনতা যারা অত্যন্ত সাহসী।
ডক্টর জি.এস.মেলকোটে ( হায়দ্রাবাদ ) — জনাব, আমি জরুরী অবস্থা ঘোষণার সমর্থন জানাই। আমি কি জানাতে পারি যে, আমরা আমাদের নেতৃর শাণিত কণ্ঠের আহবান শুনতে পেয়েছি? এই উপলক্ষে জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কর্মীরা এই সভায় তাদের পক্ষ থেকে এই কথা জানাতে অনুরোধ করেছে যে, বিগত ২ টি আক্রমণের সময় তারা ২৪ ঘণ্টা করে সবসময় কাজে লিপ্ত ছিল কিন্তু বিভিন্ন কল কারখানার পরিচালনা পরিষদ থেকে তাদের প্রতি পাক্ষিক দিবসের পর ১ দিনের ছুটি দেয়। তারা অভিযোগ করে এবং জানতে চায় কেন এই ছুটি দেয়া হোল। পরিচালকগণ জবাবে জানান, মানুষের ভুলের জন্য নয়, যন্ত্রপাতি ভেঙে যাওয়াতে এই ছুটির ব্যবস্থা করা হয়। এই সংকট মুহূর্তে আমি আমাদের নেতৃবৃন্দকে ভরসা দিতে চাই আমরা যুদ্ধক্ষেত্রের জওয়ানদের সাহায্যার্থে আগের চেয়েও সম্ভবপর অধিক কাজ করার জন্য প্রস্তুত রয়েছি।
এই কথার সাথে আমি জরুরী অবস্থার ঘোষণার সমর্থন জানাই।
শ্রী সুরেন্দ্র মোহান্তি ( কেন্দ্রাপারে ) — মাননীয় স্পীকার, আমি এই সংসদে উতকাল কংগ্রেস এবং ইউনাইটেড ইনডিপেন্ডেন্ট গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব করছি। আমি প্রধানমন্ত্রী কতৃক প্রস্তাবিত জরুরী অবস্থা ঘোষণার বিষয়ে আমাদের পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। এই অন্তিম সময়ে আমাদের সামনে প্রশ্ন হচ্ছে যুদ্ধে জড়িত হওয়া নাকি যুদ্ধ প্রতিহত করা। যখন লড়াইয়ের আহবান করা হয়েছে তখন আমাদের অবশ্যই যোগ দিতে হবে এবং মুক্তির সংগ্রামের পবিত্র শিখায় নিজেদের উৎসর্গ করতে হবে। তবে আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে আর্জি জানাচ্ছি যাতে উনি লক্ষ্য রাখেন জরুরী অবস্থার নামে মুক্ত সমাজের গুণাবলীগুলো হত্যা না করা হয়।
শেষ করার আগে আমি আমার বিজ্ঞ বন্ধু শ্রী কৃষ্ণ মেনন এর বক্তব্য র সমর্থন জানাই, উনি উল্লেখ করেছেন, সংসদ অধিবেশন যেন বন্ধ না হয়। এই অস্থির সময়ে সংসদ অধিবেশন চালু রাখা উচিৎ যাতে আমাদের দেশের আত্মবিশ্বাস ও সৎ সাহসের পরিচয় ফুটে উঠে।
শ্রী এস.এম.ব্যানারজী ( কানপুর ) — মাননীয় স্পীকার, সমগ্র ভারত প্রতিরক্ষা কর্মচারী সমিতির সভাপতি হিসেবে আমি প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে আমার পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছি। আমি আরও নিশ্চিত করছি যে ১৯৬২ এবং ১৯৬৫ সালের মত প্রতিরক্ষা কর্মচারীগণ এক সত্ত্বা হিসেবে কাজ করবে এবং পূর্বের তুলনায় অধিক বিসর্জন দিতে প্রস্তুত যাতে পাকিস্তানের এই নগ্ন আগ্রাসনকে সর্ব শক্তি দিয়ে নিরস্ত্র করা যায়। তারা সেনাবাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে এবং পেছন থেকে সব কিছুর প্রস্তুতিতে এবং এই কঠোর সময়ে সরকারকে সাহায্য করবে।
মাননীয় স্পীকার — প্রস্তাবিত বিষয় হচ্ছে,
“রাষ্ট্রপতি কতৃক ৩রা ডিসেম্বর, ১৯৭১ এ স্বাক্ষরিত সংবিধানের ৩৫২ নং ধারা অনুযায়ী জরুরী অবস্থা ঘোষণাকে সংসদে মঞ্জুর করা হোল। “
প্রস্তাব গ্রহণ করা হল
মাননীয় স্পীকার — বিশ্লেষণটি সর্বজন স্বীকৃত হয়েছে। এই অন্তিম মুহূর্তে এই সভা যেভাবে ঐক্যের পরিচয় দিয়েছে এবং কঠোর সংকল্পের প্রদর্শন করেছে, আমি এই সংসদের স্পীকার হিসেবে গর্ব বোধ করছি। আমরা সবাই প্রার্থনা করি যাতে জাতি একক নেতৃত্তে এক সংকল্পে একতাবদ্ধ থাকতে পারে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের সহায় হোন।