জীবনচিত্র নামঃ ডা. সুলেমান খান
Dr. Suleman Khan
ডাকনামঃ দুদু
পিতার নামঃ মো. ইউসুফ খান
পিতার পেশাঃ স্যানিটারি ইন্সপেক্টর
মাতার নামঃ নুরেন্নেসা খানম
ভাইবোনের সংখ্যাঃ সাত ভাই ও সাত বোন; নিজক্ৰম-পঞ্চম
ধৰ্মঃ ইসলাম
স্থায়ী ঠিকানাঃ গ্রাম-শেখদী, ডাকঘর-বাগড়া বাজার,
উপজেলা-ফরিদগঞ্জ, জেলা-চাঁদপুর
শহীদ ডা. সুলেমান খান
নিহত হওয়ার সময় ঠিকানাঃ ঐ
জন্মঃ ১৯৩৯
জন্মস্থানঃ গ্রাম-শেখদী, ডাকঘর-বাগড়া বাজার, উপজেলা-ফরিদগঞ্জ, জেলা-চাঁদপুর
শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ
ম্যাট্রিকঃ চাঁদপুর হাসান আলী হাই স্কুল, কুমিল্লা, ১৯৫৫
আইএসসিঃ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ, ১৯৫৮
এমবিবিএসঃ ঢাকা মেডিকেল কলেজ, ঢাকা, ১৯৬৭
শখঃ সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চাঃ উদীচীর সক্রিয় কর্মী, সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘পৃথিবী’ প্রকাশ, সামাজিক সংগঠন ‘তরঙ্গ’-এর সভাপতি
চাকরির বর্ণনাঃ
টঙ্গী জুট মিলঃ আবাসিক চিকিৎসক, ১৯৬৮-আমৃত্যু। প্রাইভেট প্র্যাকটিস-গোপীবাগ, ঢাকা
হত্যাকারীর পরিচয়ঃ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র
নিহত হওয়ার তারিখঃ ১৫ নভেম্বর, ১৯৭১
মরদেহঃ
প্রাপ্তি স্থানঃ গ্রামের বাড়িতেই
প্রাপ্তি তারিখঃ ২৫ এপ্রিল, ১৯৭১
কবরস্থানঃ গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক গোরস্তান
স্মৃতিফলক/স্মৃতিসৌধঃ বিএমএ কেন্দ্রীয় কার্যালয় ভবন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল, বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিফলকে নামাঙ্কিত আছে
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হিসেবে সাহায্য/দান/পুরস্কারঃ পাননি
স্ত্রীর নামঃ শামসুন্নাহার
তথ্য প্রদানকারী
হাশেম খান
শহীদ চিকিৎসকের ভাই
বাড়ি-৩, সড়ক-৩১,
সেক্টর-৭, উত্তরা মডেল
টাউন, ঢাকা-১২৩০
৩৭০ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
আমার ভাই
শহীদ ডা. সুলেমান খান
হাশেম খান
১৯৭১ সালের ২৫ এপ্রিল রাত। ২৫ মার্চের ঠিক একমাস পর। এই রাতেই আমি ভাইকে হারালাম। রাত তখন ২টা। শান্ত গ্রাম শেখদী। চাঁদপুর শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে। ডাকাতিয়া নদী ঘিরে আছে। গ্রাম তিনদিক থেকে বেষ্টনীর মতো। গভীর নিস্তব্ধতা ভেঙে হঠাৎ গর্জে উঠলো একরাশ স্টেনের গুলি আর রাইফেলের মুহুর্মুহু আওয়াজ।
প্রথমে অনেকেই ভাবলো, হানাদার পাকসেনা ঢুকে পড়েছে গ্রামে। কিন্তু গ্রামের এত ভেতরে তারা ঢুকলো কখন এবং কীভাবে? এসব ভাবতে ভাবতে অনেকেই কিছুটা উত্তেজনাবশত আমাদের বাড়ির কাছে এসে ভিড় করলো। বাড়িতে ঢুকতে সাহস পাচ্ছে না। ভেতর থেকে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে। কেউ এগুলেই গুলি করা হবে। আর চারদিকে গুলি করাও হচ্ছে।
বাড়িটি ইউসুফ খানের। নাম খাঁ-বাড়ি। ইউসুফ খানের তিন ভাইয়ের পরিবার-পরিজন নিয়ে এ বাড়ি। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার তারা। ইউসুফ খানের ছেলেমেয়ে ও বউ-ঝিরা এসেছে অনেকদিন পরে গ্রামের নিজের বাড়িতে বাধ্য হয়ে এবং আশ্রয় নিতে। ২৫ মার্চের কালরাত্রির পর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও অন্যান্য। শহর থেকে এমনি করে অনেকেই গ্রামে ছুটে এসেছে আশ্রয়ের জন্য।
প্রচণ্ড গোলার আওয়াজে ঘুম ভেঙে যায়। ধড়মড় করে ওঠে বসেছিলাম ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় গোপীবাগের বাসায়। কিন্তু গ্রামে এত ভেতরে প্রায় সেই রকম গোলাগুলি কিছুতেই মেলাতে পারছিলাম না।
পায়ের কাছেই ছয় মাসের মেয়েটি নড়ে উঠলো। সম্বিত ফিরে পেলাম। দেখি আমার স্ত্রীও বিছানায় বসে স্তব্ধ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হেঁচকা টানে কে যেন মশারিটা উল্টিয়ে ফেলে দিল।
দেখি মা। নিঃশব্দে হাত ধরে আমাদের টেনে বিছানা থেকে নামিয়ে দিয়ে তার ঘরে চলে যেতে বললেন।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ ৩৭১
শহীদ ডা. সুলেমান খান
ঘরের পশ্চিম পাশের বিছানা থেকে দাদা (আমার বড় ভাই) ও ভাবিকে মা নিজের কাছে নিয়ে এলেন। বড় ভাই ডা. সুলেমান খান। তিনি টঙ্গী জুট মিলে চিকিৎসক হিসেবে চাকরি করতেন এবং সন্ধ্যাবেলা গোপীবাগ রাশেদ মেডিকেল ফার্মেসিতে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতেন। রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির (মণি সিংহ) সদস্য ছিলেন।
দাদা আমাকে বললেন মনে হচ্ছে, এরা ডাকাত। কাকার ঘরে ঢুকেছে। পশ্চিম পাশের একটি আলাদা ঘরে থাকেন বাবা ও আমার আরেকটি ছোট ভাই। তাদের গলা শোনা যাচ্ছে। ডাকাতদের তারা সাবধান করছে, হুমকি দিচ্ছে। কিন্তু বের হওয়ার উপায় নেই। দাদা আমাকে ও অন্য দু’ভাইকে বললেন, ডাকাতরা টাকাপয়সা যা চায় দিয়ে দিস। খালি হাতে বাধা দিয়ে লাভ নেই। তবে যদি মেয়েদের গায়ে কেউ হাত দেয় তাহলে ছেড়ে দিবি না। যেমন করে পারিস বাধা দিবি।
ঘরে সেদিন অনেক মানুষ। ডাকাতরা কাকার ঘর থেকে বের হয়ে আমাদের ঘরের দরজায় এসে দরজা খুলতে হুকুম করলো। আমরা অনড়। খুলব না। পরে একটা কাটা খেজুর গাছের গুঁড়ি দিয়ে আঘাত করে দরজা ভেঙে ওরা ঘরে ঢুকলো। সামনেই পড়লো মনসুর ও হাসান। একজনের হাতে রাইফেল বাগিয়ে ধরা। তাঁর মুখে মুখোশ। সে ধমক দিয়ে মনসুরকে বললো, টাকা দে। টর্চ হাতে অন্য ডাকাত টৰ্চটা ঘুরিয়ে ডানদিকে বড় ভাইয়ের দিকে স্থির করে বললো, ‘এই দুগা না অন্য দুগা’। অর্থাৎ আমার কথা আর ডাক্তারের কথা বলা হচ্ছে। তারপরই ফিসফিসিয়ে রাইফেলধারীকে বলল, এ ডাক্তার, এটাই ডাক্তার। বড় ভাই ওঠে দাঁড়ালেন এবং বললেন, টাকা দিচ্ছি কিন্তু মেয়েদের…। তাঁর কথা শেষ হলো না। রাইফেল গর্জে উঠলো।
ওরা দাদাকে গুলি করেছে, আমাকেও। প্রচণ্ড আঘাতে হুমড়ি খেয়ে আমি পরে গেলাম বিছানায়। আমি খাটের ওপর, পেছনে কোনার দিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। গুলি লেগেছিল আমার পায়ে। কয়েক মুহূর্ত জ্ঞান ছিল না আমার। এরা ডাকাত ছিল না। এরা আমাদের মারতে এসেছে।
ঘাতকরা চলে যাওয়ার ও আমার জ্ঞান ফেরার পর ক্রল করে খানিকটা সামনের দিকে এগোবার চেষ্টা করছি। স্ত্রী এসে পাশে বসল। উদ্বিগ্ন স্বরে ও কান্না জড়িত কণ্ঠে জিগ্যেস করলো, তোমারও গুলি লেগেছে? কোথায় লেগেছে? বললাম পায়ে। ওরা দাদাকে একদম বুকে গুলি করেছে। বলেই ও কান্নায় ভেঙে পড়লো। আরো বলল, মা ও মুঞ্জু গুলিতে আহত।
বুক ভর করে এগিয়ে দাদার কাছে এলাম। দাদা বুকে দু’হাত চেপে মেঝেতে বসেছিলেন। কোথায় গুলি লেগেছে জানতে চাইলে মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল। তারপর হাত সরিয়ে রক্তাক্ত গেঞ্জিটা উঠিয়ে দেখালেন। প্রচুর রক্তক্ষরণে তাঁর শরীর ক্রমেই অবশ হয়ে যাচ্ছে। রক্তের ঢালের মধ্যে তিনি বসে আছেন। তাঁর অমন ক্ষোভ, অসহায় ও ঘৃণা জড়ানো দৃষ্টি এর আগে কোনোদিনই দেখিনি যেন দস্যুদের ছেড়ে দেয়া ভুল হয়ে গেছে।
কেন বুঝতে পারিনি আগে যে ওরা আমাদেরই মারতে এসেছে। ওদের ডাকাত বলা ঠিক হয়নি। ডাকাতরা প্রাণ নিতে আসে না।
মেদহীন বলিষ্ঠ ও সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন ডা. সুলেমান খান। এক সময় নিয়মিত ব্যায়াম করতেন। ভয়-ভীতিকে খুব একটা আমল দিতেন না।
কাজকর্মে সবাইকে উৎসাহ ও সাহস যোগাতেন। গুলি খেয়েও শেষবারের মতো চেষ্টা করে যেতে লাগলেন। সাংঘাতিক জখম হয়েছে তাঁর। নিজের রক্ত ও অন্যদের রক্তক্ষরণ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বন্ধ করতে বললেন। কীভাবে ব্যান্ডেজ করতে হবে, এটিএস দিতে হবে এবং দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে স্যালাইন দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে, তাও বললেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের। একে তো গভীর রাত। তারপর গ্রাম থেকে শহর অনেক দূর। যাতায়াতের ব্যবস্থা মোটেই সুবিধার নয়। নৌকা, রিকশা ও খেয়াই শুধু বাহন। তা সত্ত্বেও গ্রামের কিছু তরুণ ও আত্মীয়-স্বজন গুলিবিদ্ধ আমাদের চারজনকে নিয়ে নৌকায় উঠালো। ছোট ভাই মনসুর ও আর একজন তরুণ পায়ে হাঁটা পথে চাঁদপুরের দিকে চলে গেল। কারফিউর ভেতরে লুকিয়ে তারা চাঁদপুর শহরে ঢুকে শহরের নামকরা ডাক্তার নুরুর রহমানকে নিয়ে আসবে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য ও দ্রুত চিকিৎসার জন্য। কারণ সকাল ৫টার
৩৭২ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. সুলেমান খান
আগে শহরে ঢোকা যাবে না।
আমাদের নৌকা চললো ‘বাগড়া’ বাজারের দিকে মাইল দুয়েক নদী। তারপর রিকশা বা অন্য কোনো ব্যবস্থা। রাত তখন পৌঁনে তিনটা। গ্রাম ডাক্তার হাশিম ছুটে এলেন। ডাক্তারি পড়া না থাকলেও প্র্যাকটিস করে করে তিনি ডাক্তার। একজন সমাজসেবী। দাদার পরামর্শমতো সবাইকে তক্ষুনি তিনি এটিএস দিলেন। তাঁরই তখন প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যন্ত্রণায় তিনি সাংঘাতিক রকম ছটফট করছেন। পিপাসায় বুক ফেটে যাচ্ছে। বারবার বলছেন, যত তাড়াতাড়ি পারো স্যালাইনের ব্যবস্থা করো। কিন্তু সবাই অসহায়। নৌকাতেই দাদা জ্ঞান হারান, তখনো তিনি মারা যাননি।
বাগড়া বাজারে এসে আমাদের আহত তিনজনকে রিকশায় এবং দাদাকে একটি খাটিয়ায় তুলে চাঁদপুরে পাঠানোর ব্যবস্থা হলো। যেতে হবে প্রায় চার মাইল। সবার চিন্তা ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি বেঁচে থাকলে হয়।
ভাবি সবাইকে দ্রুত হাঁটার জন্য বলে নিজেও খাটিয়ার পাশে পাশে হাঁটছেন। ছাত্র আন্দোলন, মহিলা সমিতি। ষাটের দশকে দেশব্যাপী পাকিস্তান সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন চলছিল। মনে পড়ে উনসত্তরে কিশোর মতিউরের শহীদ হওয়ার দিনের কথা। মতিউর হত্যা নিয়ে সারা শহরে উত্তেজনা। সন্ধ্যায় ভাইয়ের খবর নিতে গিয়ে শুনি তিনি সারাদিন ফেরেননি। রাত দশটায় আবার গেলাম। না, দাদা ফেরেননি। আমরা তখন মুখোমুখি বাড়িতে থাকি গোপীবাগের তৃতীয় লেনে। কিন্তু ততটা ভীত নন। সম্ভবত সেদিন বিকেল থেকে কারফিউ ছিল।
ভাবিকে জিগ্যেস করি, দাদার খবর কি, কোথায় সারাদিন শহরের অবস্থা তো মোটেও ভালো নয়। তিনি জবাবে বললেন, গোপীবাগে একটু খোঁজখবর নাও, কবরস্থানটা কোথায়? তোমার ভাইয়ের এখন সেখানে থাকার কথা। খোঁজ নিতে কবরস্থানে গেলাম। ভাইকে সেখানে পেলাম। মতিউরের লাশ এইমাত্র দাফন করা হলো। মতিউরের লাশ অতি গোপনে ও সাবধানে এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। পুলিশ হন্যে হয়ে তার লাশ খুঁজছে। দাদা সারাদিন এ কাজেই ব্যস্ত ছিলেন।
সেই সগ্ৰামী স্বামী ডা. সুলেমানের গুলিবিদ্ধ দেহ নিয়ে মহিলা সমিতির কর্মী শামসুন্নাহার স্বপন গ্রামের রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছেন রাত পৌনে চারটায়। এতটুকুও মুষড়ে পড়েননি। সবাইকে নিয়ে চলেছেন হাসপাতালের দিকে। কিন্তু তখনো তিনি কেন, কেউই জানে না মাত্র কিছুক্ষণ আগে দাদা সবাইকে ছেড়ে চলে গেছেন। শুধু তার দেহটা নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি।
প্রায় মাইল দুয়েক হাঁটার পর দাদার প্রাণবায়ু যে বেরিয়ে গেছে তা আমি লক্ষ্য করেছি। এর আগে আমি কোনো লোককে চোখের সামনে মরে যেতে দেখিনি। আমি রিকশা থেকে সবসময়ই চোখ রেখেছিলাম তাঁর পা দুটির দিকে। অনেক আগে জ্ঞান হারালেও তিনি অনেকক্ষণ জীবিত ছিলেন। যন্ত্রণায় মাঝে মধ্যে পায়ের পাতা দুটি কেঁপে কেঁপে উঠছিল। এক সময় দেখলাম কিছুক্ষণ স্থির থেকে হঠাৎ দুটি পায়ের পাতা দু’দিকে অবশ হয়ে পড়ে গেল।
বুঝতে কষ্ট হলো না কী সাংঘাতিক ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়ে থাকলাম। কাউকে কিছুই বলতে না পেরে অক্ষম আমি ক্ষোভে-দুঃখে শুধু নীরবে নিজের ঠোঁট কামড়েছি।
আর কিছুক্ষণ চলার পর ‘ইছালী’ খেয়াঘাটের কাছে এসে আমাদের শব-মিছিল থামালাম। গ্রাম ও বাজার থেকে অনেকেই আমাদের সঙ্গে আসছিল। প্ৰায় ছোটখাটো মিছিল একটা। তারপর কোনো দ্বিধা, কোনো সঙ্কোচ না করে ভাবিকে বললাম, আর এগিয়ে কাজ নেই। খাটিয়া নামাও। দাদা নেই।
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রথমেই আমার দাদার চরিত্রের দৃঢ়তার কথা মনে হয়। আদর্শের প্রশ্নে অনমনীয় ছিলেন বলে দাদা দীর্ঘদিন বাড়ি ফেরেননি। ছাত্র আন্দোলন, পিতার অমতে বিয়ে, বামপন্থি রাজনীতি ইত্যাদির কারণে আমার সঙ্গে মনোমালিন্য ছিল। বাপ-মা-ভাইবোন থেকে বিচ্ছিন্ন থেকে ৭-৮ বছর পর, ২৬ মার্চের পরেই দাদা সবার মাঝে ফিরে আসে। বাবা-মা সবাই খুব খুশি। মাত্র সেদিন রাতেই অর্থাৎ মৃত্যর একঘণ্টা আগে আব্বা তার বড় ছেলে সম্পর্কে যেসব ভুল ধারণা করেছিলেন সবকিছুর অবসান ঘটে। পিতা-পুত্রের সত্যিকারের মিলন হয় সেই রাতে। ছেলের উদারতা, দেশ ও জনসাধারণের প্রতি গভীর ভালোবাসা, রাজনৈতিক চিন্তা, আদর্শ ও মেধার চেতনার সত্য পরিচয় সেদিনই তিনি পান। প্রায় চার-পাঁচ ঘন্টা ধরে আব্বা
৩৭৩ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. সুলেমান খান
ও দাদা সেদিন অত্যন্ত অন্তরঙ্গভাবে দেশ-জাতি, জাতির ভবিষৎ ও নিজেদের পরিবার ইত্যাদি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন। আব্বা সেদিন জ্যেষ্ঠ পুত্রের হাতে তাঁর সম্পত্তি ও টাকা-পয়সার হিসাব এবং ভাগ-বাটোয়ারার উইল পত্র তুলে দেন। দাদা স্বেচ্ছায় নিজের ভাগের সম্পত্তি ছোট ভাইদের, বোন ও মাকে বিলিয়ে দিয়ে বাবাকে বললেনঃ আমাদের পরিবারের সবার দায়িত্ব ও সম্পত্তি, টাকা-পয়সার দায়িত্বই যখন আমাকে দিলেন, তখন নিজে একটা ভাগ নিয়ে যদি আমি স্বার্থপর হয়ে যাই। সবার সুবিচার যাতে করতে পারি তাই সম্পত্তির ভাগ আমার প্রয়োজন নেই। সেদিন দাদার উদারতা দেখে আব্বা যেমন চমৎকৃত হন, তেমনি গর্ববোধ করেন। কিন্তু দাদার এ আকস্মিক মৃত্যুতে আব্বা শোক ও অনুশোচনায় বিহ্বল হয়ে পড়েন।
২৬ মার্চের পর দাদা ও ভাবিকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদীচীর দু’জন সদস্য এসেছিল। তারা বলেছিল, পার্টির সদস্য ভারতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আপনাদের এবং সত্যেন সেনকে নিতে এসেছি। দাদা সত্যেন সেনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। ‘উদীচী’ সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর প্রতিষ্ঠানের সাথে তিনি ও ভাবি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। উদীচীর গণসঙ্গীতের প্রথম দিকের ক্লাসগুলো আমাদের গোপীবাগের বাড়িতে হতো। দাদা গোপীবাগে তরুণদের নিয়ে গড়ে তুলেছিল ‘তরঙ্গ’ নামে শিল্পী ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী। ঊনসত্তরের আন্দোলন থেকে শুরু করে সবকটি প্রগতিবাদী আন্দোলনের সাথে তরঙ্গের তরুণরা ঝাপিয়ে পড়তো। স্বাধীনতা যুদ্ধেও এরা অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। তরঙ্গের সদস্যরাও এলো ঢাকা ছেড়ে পালানোর অনুরোধ নিয়ে। তিনি তাদের সবাইকে বলেছিলেন, আমি আগে আমার গ্রামে যাই, তারপর ভারতে গিয়ে পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করবো। নিজের গ্রামে এসেও ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চাঁদপুরে পাকসেনাদের গুলিগোলায় আহত মানুষের চিকিৎসা করার জন্য এ গাঁয়ে, পাশের গাঁয়ে যাচ্ছেন। এ অঞ্চলের ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীদের দু’চারজনের সঙ্গে দেখা হলো। তাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চললো দেশের এহেন পরিস্থিতিতে কী করা যায়। সশস্ত্র সংগ্রাম ছাড়া দেশকে স্বাধীন করা সম্ভব নয়। মুক্তিবাহিনী গঠন করার জন্য তরুণদের সংগঠিত করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা, সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি নেয়া ইত্যাদি ব্যাপারে গ্রামের সুধীজনের সঙ্গে আলাপ চালাতে লাগলেন। এ সময়েই গ্রামে আওয়ামী লীগের রসদ ও অস্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটা নৌকা লুট হলো। লুট করেছে মুসলিম লীগের কিছু ভাড়াটে গুণ্ডা ও লোক। লুট করা নৌকা নিয়ে বিচার ও মীমাংসার জন্য আয়োজিত সভায় মুসলিম লীগের পাণ্ডাদের সাথে চরম বিরোধ দেখা দিল। তারা আওয়ামী লীগের সব রসদ ফেরত দিতে নারাজ। ফলে বিচার সভা পণ্ড এবং তাকে ও অন্যান্য বিচারকের জীবননাশের হুমকি দেয়া হলো। মাত্র আট-নয়দিন আগে মুজিবনগরে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়েছে। তাঁর প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও দেখা দিলো। ২৫ এপ্রিল রাতে আমাদের বাড়ি প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম লীগের ভাড়াটে গুন্ডাদের আক্রমণের আগের দিন দাদা আমাকে বলেছিলেন, ছাত্র ইউনিয়নের কয়েকটি ছেলে ও পার্টির কয়েকজন আসবে আমাদের বাড়ি। দু’একদিনের ভেতরে বাড়ির একটি গোপন কামরা ঠিক করে আমরা কিছু হাতবোমা তৈরি করবো। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র জোগাড় করারও চেষ্টা করতে হবে। তুই তৈরি থাকিস। বিশেষ করে খুব গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। যে কোনোদিন আমাদের বাড়ি আক্রান্ত হতে পারে। কিন্তু সে সময় আর পাওয়া গেল না। তার আগেই প্রতিক্রিয়াশীলরা স্বাধীনতার এক যোদ্ধাকে ছিনিয়ে নিলো।
(*সাপ্তাহিক বিচিত্রা থেকে সঙ্কলিত)
৩৭৪ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
শহীদ ডা. সুলেমান খান
প্রাসঙ্গিক উল্লেখযোগ্য তথ্যসূত্রঃ
ক. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী তালিকা; তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রকাশকালঃ ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭২।
খ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক তালিকা বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যালয় বিএমএ ভবনে (তোপখানা রোড, ঢাকা) শোভিত স্মৃতিফলকে উকীর্ণ। (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)।
গ. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র; সম্পাদনাঃ হাসান হাফিজুর রহমান; প্রকাশনাঃ তথ্য মন্ত্রণালয়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রকাশকালঃ আষাঢ় ১৩৯১, জুন ১৯৮৪; ৮ম খণ্ড; পূ. ৭০৭।
ঘ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারক ডাকটিকিট; প্রকাশনাঃ বাংলাদেশ ডাক বিভাগ; ৫ম পর্যায়; ১৯৯৬ । (পরিশিষ্ট দ্রষ্টব্য)
ঙ. স্মৃতি ১৯৭১; সম্পাদনাঃ রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; প্রথম খণ্ড; ২য় পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকাল অগ্রহায়ণ ১৪০৬, ডিসেম্বর ১৯৯৯; পৃ. ৮৫ ।
চ. মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক স্মৃতিকথা; সম্পাদনাঃ প্রকৌশলী ইতিখার কাজল; প্রকাশনা রক্তঋণ; প্রকাশকালঃ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২; পৃষ্ঠা নং. ৩৬ ।
ছ. মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেগুনবাগিচা, ঢাকায় সংরক্ষিত শহীদ চিকিৎসকের স্মারক সামগ্রী।
জ. চরিতাভিধান সম্পাদনাঃ সেলিনা হোসেন ও নুরুল ইসলাম প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; ২য় সংস্করণ; প্রকাশকালঃ মাঘ ১৪০৩, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭; পূ. ৪১৪৷
ঝ. শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মারকগ্রন্থ; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; প্রথম পুনর্মুদ্রণ, প্রকাশকালঃ পৌষ ১৪০০, জানুয়ারি ১৯৯৪; পৃ. ৫৬ ।
ঞ. শহীদ বুদ্ধিজীবী কোষগ্রন্থ; সম্পাদনা ; রশীদ হায়দার; প্রকাশনাঃ বাংলা একাডেমী; প্রকাশকালঃ অগ্রহায়ণ ১৩৯২, ১৪ ডিসেম্বর ১৯৮৫; পৃ. ১০৩ ।
ট. দৈনিক সংবাদ বিশেষ সংগ্ৰাহক সংখ্যা-৩, যেসব হত্যার বিচার হয়নি; পরিকল্পনায়ঃ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনঃ প্রকাশকালঃ সোমবার ১৪ ডিসেম্বর ১৯৯৮; পৃ. ৯, ১৭, ২৭, ৩৫ ।
ঠ. মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পাদনাঃ আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন; প্রকাশনাঃ সাহিত্য প্রকাশ।
ড. *সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ৩১ অক্টোবর, ২০০৩।
৩৭৫ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ
Reference: মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চিকিৎসক জীবনকোষ – বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজ