শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
২০৯। পাকিস্তান কর্তৃক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিবৃতি | রাজ্যসভার কার্যবিবরণী | ০৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ |
রাজ্য সভা
শনিবার ৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১/ ১২ ই অগ্রহায়ন, ১৯৮৩
সকাল ১১ টায় কার্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়
(সভাপতি চেয়ারে বসে আছেন)
দেশের বর্তমান পরিস্থতি নিয়ে মন্ত্রীর বক্তব্য
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী (শ্রী জগজীবন রাম)-সংবাদ অনুসারে আজ সকালে পশ্চিম পাকিস্তান সরকার আমাদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে।
গতকাল সন্ধ্যায় পশ্চিম পাকিস্তানি বিমান বাহিনী উদ্দেশ্যমুলকভাবে আমাদের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে এবং আমাদের বেশ কিছু বিমান ঘাঁটি আক্রমণ করে। একইসাথে পশ্চিম সীমান্তে তাদের স্থল বাহিনী আমাদের পজিশনে গোলাবর্ষন করে। তাদের প্রোপাগান্ডা মিডিয়া সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন অভিযোগ এনেছে যে ভারত তাদের হামলা করেছে।
সংবাদটি আমার কাছে এবং প্রধানমন্ত্রীর নিকট পৌঁছেছে এবং প্রধানমন্ত্রী কোলকাতা থেকে ফিরে আসা মাত্র আমরা আমাদের সতীর্থ এবং বিরোধীদলীয় নেতাদের নিয়ে পরামর্শ সভা করেছি। আমরা সবাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে একমত হয়েছি যে, জাতির স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি এবং সর্বসম্মত হয়েছি যে- আক্রমণকারীকে প্রত্যাঘাত করা হবে। আমি নিশ্চিত সামনের কঠিন দিনে আমাদের মধ্যে একই ধরনের সংহতির অনুভূতি ক্রিয়াশীল থাকবে। দেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। আমরা হাউসে সমবেত হয়েছি ভারত প্রতিরক্ষা বিল গ্রহনের জন্য। আফসোস এবং দুঃখ এইজন্য যে, পাকিস্তান চুড়ান্ত মুর্খতা থেকে বিরত হতে পারেনি; যখন এই উপমহাদেশের জন্য সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো উন্নয়ন তখন ভারত ও পাকিস্তানের জনগণকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দেয়া হলো। আমরা ভালো প্রতিবেশী হয়ে কাটাতে পারতাম কিন্তু পাকিস্তানের জনগনের হাতে কখনো তাদের ভাগ্য বদলানোর চাবি ছিলো না। এখন এই উত্তেজনার মুহুর্তে আমাদের সম্মিলিত আস্থা ও বিশ্বাস আমাদের প্রভাবশালী করে তুলবে।
আমরা যুদ্ধকালীন সংসদে সমবেত হয়েছি। যে যুদ্ধ আমরা চাইনি এবং যা এড়ানোর জন্য আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি- সেই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যা এড়ানো সম্ভব ছিল তা আজ বাস্তবতা। পশ্চিম পাকিস্তান বেপরোয়া বেঈমানের মতো আঘাত করেছে।
ন’মাস ধরে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নৃশংসভাবে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা এবং মৌলিক অধিকার পদদলিত করে চলেছে। দখলদার সৈন্যবাহিনী তাদের তুলনাহীন প্রতিহিংসাপরায়ণ হিংস্রতা দিয়ে ঘৃণ্য জঘন্য অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। লাখ লাখ মানুষকে ভিটে-মাটি ছাড়া করা হয়েছে; ১০ মিলিয়ন মানুষকে আমাদের দেশের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়েছে।
আমরা বারংবার বিশ্বের দরবারে মনোযোগ আকর্ষন করেছি এবং বলেছি যে এইসব মানুষের বিপর্যয় আমাদের নিরাপত্তার উপর হুমকি স্বরূপ। ভারতের অর্থনৈতিক চাপ এবং অন্যান্য বোঝা এবং বিপদসমূহের ব্যাপারে সর্বত্র সাধারণ মানুষ সমবেদনা জানিয়েছে কিন্তু সরকারকে মনে হয়েছে নৈতিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। দেরিতে হলেও (সমস্যার) স্থায়ী সমাধানের জন্য যেসব পদক্ষেপ নিতে ইসলামাবাদের শাসকগোষ্ঠীকে বলা হয়েছিল, সেসবও বৃথা গেল।
পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের রাগ বৃদ্ধির কারণ বাংলাদেশের আমজনতা মান রক্ষার্থে প্রতিবাদ করেছে এবং সংগ্রাম করেছে এবং সেটা পাকি সৈন্যরা বুঝতে অক্ষম এবং এটার কারণে পাকিস্তানের প্রতিটি প্রদেশে দমন নিপীড়ন চলছে।
যত মুক্তিবাহিনীর কার্যকারিতা বৃদ্ধি পেয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ততো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। আমাদের ঐতিহ্য অত্যাচারীর পাশে নয় বরং নিপীড়িতের পাশে দাঁড়ানো। তাই তাদের রাগ আমাদের উপরেও পতিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আগ্রাসন প্রবল বৃদ্ধি করেছে ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণ যুদ্ধ করার উদ্দ্যেশ্যে।
যুদ্ধের সময় ধৈর্য এবং আত্মসংবরণ প্রয়োজন হয় ঠিক ততখানিক যতটা শান্তির সময়েও এটা প্রয়োজন হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি শাসকেরা যতখানিক সম্ভব সন্দেহ ও গুজবের বীজ ছড়াবে যাতে করে এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং অভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলো প্রকট হয়। আসুন আমরা যেন তাদের ফাঁদে পা না দেই। আমরা অবশ্যই আমাদের যেনো একতা ও উঁচু আদর্শের লক্ষ্য বজায় রাখতে পারি।
আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। উচ্চ উত্পাদনশীল কৃষি ও শিল্প হচ্ছে এর ভিত্তি যার উপর বাকী প্রতিরক্ষা নির্ভর করে। কৃষক, শ্রমিক, যন্ত্রবিদের এই উৎসর্গের দ্বারা জোয়ানদের সাহস এবং লড়াইয়ের যোগ্যতা কে উৎসাহিত করতে হবে এবং ব্যাবসায়িক সম্প্রদায়ের ব্যাবসায়ীদের সামাজিক দায়িত্ব হবে সম্পদের প্রতি অথবা উচ্চ মুনাফার নির্ধারন এর লোভ থেকে বিরত থাকা। আমাদের আদর্শ রক্ষার জন্য অথবা সুউচ্চ মনোবল বজায় রাখতে, দেশের শিল্পী, লেখক এবং ছাত্ররা তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমাদের দেশের নারীদের প্রতি আমার বিশেষ আবেদন, অপচয় রোধে সম্ভাব্য প্রতিটি শষ্যদানা এবং রূপি সঞ্চয় করুন। আমাদের প্রত্যেকটি আত্নত্যাগ জাতিকে করে তুলবে শক্তিশালী এবং সহিষ্ণু ক্ষমতার। সাহসী জাপানি বৈমানিক, নাবিক এবং তাদের কঠিন ও করিত্কর্মা কর্মকর্তা তাঁরা তাদের কর্তব্য পালন করবে। এবার আমরা আমদের কাজ করি।
আমরা শান্তির পক্ষে দাঁড়িয়েছি কিন্তু এই শান্তিকে রক্ষা করতে হবে। আজ আমরা লড়ছি আমাদের আঞ্চলিক অখন্ডতা ও জাতীয় সম্মান রক্ষা করার জন্য। সর্বোপরি আমরা লড়ছি সেই আদর্শের জন্য যেটা আমরা লালন করি এবং স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে।
সভাপতিঃ আমি বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দ কে আহ্বান করব এবং বক্তব্য সংক্ষিপ্ত করার জন্য অনুরোধ করছি। জনাব গুরুপদস্বামীকে বক্তব্য দেবার জন্য আহ্বান করছি।
বিরোধিদলীয় নেতা শ্রী এম এস গুরুপদস্বামীঃ জনাব সভাপতি, দেশের এই পরিস্থিতিতে এখন আমাদের বা তাদের বলে দ্বিধান্বিত, ইতস্তত বা আমতা আমতা করার সময় এটি নয়। পাল্টা অভিযোগ বা বিভেদ করার সময় ও এখন নয়, কিংবা আমরা দেশকে জিজ্ঞেস করার বা দেশ আমাদের কি দিয়েছে সেসব বলার সময় ও এখন নয়। নিঃসন্দেহে এটা সেই সময়, যখন আমরা আমাদের নিজেদের জিজ্ঞেস করবো দেশকে এখন আমরা কি দিতে পারি এবং এই দৃষ্টিকোণ থেকে এবং এই মানসিকতা থেকেই আমি, বর্তমান মারাত্নক পরিস্থিতির দিকেই তাকিয়ে আছি যা আমাদের মুখোমুখী করেছে।
এখন আমরা একটা ভয়ানক মুহুর্তের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি এবং অবশ্যই আমি মনে করি আমাদের দেশের এ এক ঐতিহাসিক মুহুর্ত। ২৫ বছরের ছোট্ট ইতিহাসে পাকিস্তান আমাদের তৃতীয়বারের মতো আক্রমণ করেছে এবং আমি আশা করি অন্যান্য সদস্যও আমার সাথে এক আশা পোষন করবেন যে- এটাই যেন শেষ যুদ্ধ হয়।
যদি এটা যুদ্ধ হয়, তবে এই যুদ্ধই হবে ভবিষ্যতে পাকিস্তানের সাথে সব যুদ্ধের শেষ। আমি মনে করি, এই দ্বন্দ, এই মুকাবেলা, এই যুদ্ধ আমাদের নিয়তি কে রুপদান করতে, ভাগ্য সাজাতে এবং উপমহাদেশের সকলের ভবিষ্যত একবারেই সকল সমস্যার সমাধান করবে। স্যার, এই মুহুর্তে আমি আমার ও আমার দলের পক্ষ থেকে আনুগত্য প্রকাশ করছি; পাকিস্তানের যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার ক্ষেত্রে আমাদের বন্ধুভাবাপন্নতা, আমাদের সহযোগিতা সরকারের প্রতি নিবেদিত থাকবো। স্যার এই সংসদে এই সময়ে আমরা ঠিক করতে যাচ্ছি ভবিষ্যৎ-এ উপমহাদেশে পারস্পারিক সম্পর্ক কি দাড়াবে। এই অনন্য উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে এই দেশের প্রত্যেক নর-নারী, প্রত্যেক দিনমজুর, মালিক, কর্মচারি-কর্মকর্তা সবাই আত্মত্যাগ করার জন্য প্রস্তুত। আমি নিশ্চিত আমাদের দেশ শক্তিশালী এবং এদেশের মানুষ সাহসী; সেই সাথে আমি বিশ্বাস করি আমাদের মধ্যে অটুট ঐক্য বিদ্যমান। আমি নিশ্চিত এই সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সব দলের প্রতিনিধিরা আজ এই ভয়াবহ সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারকে সবরকম সহায়তা করার জন্য সর্বসম্মত। আমি শুধুমাত্র একটি সতর্ক করতে চাই- আমরা কোনো আপোষ বা সন্ধি চাই না, আমি চাই আমার দেশ আরেকটা তাসখন্দে পরিনত হোক। আমরা কোনো বহিঃ শক্তির আদেশ, উপদেশ, নির্দেশ, চাপ, প্ররোচনা শুনতে চাই না। আমরা এক জাতি হিসাবে এই যুদ্ধ টেনে নিয়ে যাব এবং লক্ষ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত চালিয়ে যাব।
স্যার, পরিশেষে সংসদ সম্পর্কে একটা কথা বলতে চাই। শেষ মহাযুদ্ধের সময় চার্চিলের সেই বিখ্যাত উক্তি……
শ্রী অর্জুন অরোরা (উত্তর প্রদেশ); চার্চিল নয়, এটা চেম্বারলেইনের উক্তি।
শ্রী এম এস গুরুপদস্বামীঃ উনি বলেছিলেন যুদ্ধের সর্বোচ্চ উপকরণ হতে যাচ্ছে সংসদ। যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সব সময় বসত। তাঁরা দিনে কিংবা রাত যেকোন সময় সংসদ আহবান করত। সংসদ ছিলো ফ্যাসিস্টদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সরকারের শক্তিশালী আত্মরক্ষার উপায়। ঠিক একইভাবে আমি সরকারের নিকট এবং এই সংসদের প্রত্যেক সহকর্মীর নিকট আবেদন করছি দিনে দিনে সংসদ যেনো আহবান করা হয় এবং সংসদকে সরকারের মিত্র হিসাবে ভূমিকা রাখে। সংসদ এবং সরকারের ভিতর কোনো তফাৎ নেই, এই দুয়ের ভেতর শুধুমাত্র ঐক্যমত্য এবং সৌহার্দ্য বিদ্যমান। চেয়্যারম্যান আপনার মাধ্যমে আমি বলতে পারি কি- প্রতিদিন কয়েক ঘন্টার জন্য হলেও আমরা কি সংসদে বসতে পারি না? সরকারকে সমালোচনা করার জন্য নয় বরং সরকারের এই অসাধারণ কাজ এবং উদ্দেশ্য- এর সাথে আরো এবং আরো সংহতির জন্য। শেষে আমি আবার বলছি পাকিস্তানের বিরূদ্ধে এই যুদ্ধের ব্যাপারে আমার দল মনপ্রাণ দিয়ে এই সরকারের সমস্ত কর্মকান্ডের সাথে সংহতি প্রকাশ করছে। আমরা আশা করি এবং বিশ্বাস করি খুব দ্রুত, এমন কি আগামী বড়দিনের আগে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ- এর অভ্যুদয় দেখব। আমরা আরো আশা করি এবং বিশ্বাস করি আমরা এই উপমহাদেশে একটা স্থায়ী স্থিতি এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা করব।
শ্রী পীতাম্বর দাস (উত্তর প্রদেশ); মাননীয় সভাপতি মহাশয়, ভারত বর্ষের শান্তিপ্রিয়তা ও সহনশীলতা বিশ্ববিখ্যাত, এবার আমাদের সহনশীলতায় পরাকাষ্ঠা হয়ে গেছে: আমাদের দুর্ভাগ্য পাকিস্তান সব সময় উল্টা বুঝেছে।
আমাদের সৌজন্যতা তারা কাপুরুষতা ভেবেছে। আমাদের সম্পর্কে এও বলা হয়েছে “তারা পাল্টা আঘাত করতে অনেক সময় নেয় কিন্তু যখন সেটা করে তখন তারা সেটা ভীষন ক্ষিপ্রতার সাথে করে। “ এবং আমি আনন্দিত সেই সময় সমাগত।
মহোদয়, বিজয়ের প্রশ্নে আমাদের সন্দেহের কোন কারন নেই কেননা, প্রথমতঃ যে জন্য আমরা সর্বদা সংগ্রামরত ও বিবদমান তার নিজস্ব একটা দৃঢ়তা ও সাত্ত্বিকতা আছে। উপরন্ত পাকিস্তান আজ যে শক্তিসমূহের সেবা করছে তাদের অস্ত্র ১৯৬৫ এর যুদ্ধেও তার পক্ষে কাজ করতো। সে সময় পাকিস্তানের দুই বড় ভাই মিলে মিশে কাজ করত আজ পশ্চিম পাকিস্তানের এক পা বাংলাদেশে বাধা পড়েছে, আর সে যে মিত্রদের সেবা করে তাদের মধ্যে একজন রাশিয়ার সংগে জড়িয়ে পড়েছে, অন্যজন আপন রক্ষার জন্য তার প্রতিপক্ষ রাশিয়ার সাথে সমঝোতা করে চলছে। অতএব বিজয়ের ব্যাপারে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমরা অবশ্যই হৃদয় দিয়ে এগিয়ে যাবো এবং উপরে ঈশ্বর আছেন।
এর সংগে সংগে আমরা অবশ্যই আমাদের ইতিহাস দেখব, প্রাচীন ও পরবর্তীকালের ইতিহাস আমরা দেখব, সংঘর্ষে ভারত কখনো হার মানেনি। সংঘর্ষে আমরা সবসময় বিজয়ী হয়েছি। আমরা হেরে থাকলে আপোষের মধ্যে হেরেছি। সুতরাং বর্তমান ইস্যুতে বৈঠকে বসে আজ আপোষের কোন অবকাশ নেই, প্রধানমন্ত্রীও এ কথাই বলেছে, “সত্যারূঢ় দলের অন্যান্য লোকেরাও একই কথা বলেছেন। আমরা আরেকটা তাসখন্দ মেনে নেবো না। আমি একে স্বাগত জানাই। এরূপ দৃঢ়তা ও সংকল্প নিয়ে আমাদের উপর আরোপিত যুদ্ধের মোকাবিলা করতে আমরা সামনে চলব।
শ্রী দয়াভাই ভি প্যাটেল (গুজরাট)ঃ মিঃ চেয়ারম্যান স্যার, আমার পুর্বের বক্তা এবং বিরোধীদলীয় নেতার মুখ নিঃসৃত বক্তব্যের সাথে একাত্ম হবার জন্য আমি কৃতজ্ঞবোধ করছি। আমরা যে আগ্রাসন মোকাবেলা করছি তার সাথে পুরো সংসদ এবং পুরো জাতি সরকারের সাথে আছে। এই যুদ্ধ আমাদের কারণে সংগঠিত হয়নি। আমাদের প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন এটা এড়াতে এবং এমন এক সময়ে যখন দেশে তাঁর উপস্থিতি খুবই জরুরি ছিল কিন্তু তিনি বিদেশে যাবার বিপদজ্জনক পদক্ষেপ নিয়েছেন সারা বিশ্বকে বোঝাতে যে এখানে আসলে কি ঘটছে। আমাদের মতপার্থক্য থাকতে পারে। আমরা প্রায়ই এই ব্যাপারে এই সংসদে যুক্তি পাল্টা-যুক্তিসহ বিতর্ক করেছি কিন্তু এখন আর সেটা করার সময় নয়। আজ একাত্ম হবার জন্য কথা বলার সময় যাতে আমরা এই আগ্রাসনকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারি। এবং আমার পুর্ব বক্তা সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন, আসুন আমরা এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে বিজয়ী হই এবং একটা স্থায়ী শান্তি নিয়ে আসি। এবং আমরা যে পুর্বের কোনো ভুল, দুর্ঘটনা বা দুর্ভাগ্যের পুনরাবৃত্তি না করি। আসুন আমরা আমাদের কার্ডটা সঠিকভাবে খেলি। আসুন আমরা বিজ্ঞের মতো আচরণ করি এবং আমি অনেকবছর ধরে এই উপমহাদেশে শান্তি দেখতে চাই।
শ্রী ভুপেশ গুপ্ত (পশ্চিম বাংলা)ঃ আমরা আরো একবার পাকিস্তানি শাসকের নিষ্ঠুর চ্যালেঞ্জ এবং আগ্রাসনের মুখে। আমরা একটা শান্তিপ্রিয় জাতি এবং এতগুলো বছর ধরে পাকিস্তানের কাছে শান্তি ছাড়া কিছু চাইনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী দ্বারা সমর্থিত পাকিস্তানি শাসকরা দুই দেশের জনগণের বন্ধুত্বের মধ্যে কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছে। এমন কি এই সংকটপূর্ণ সময়ে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ যারা নিজেরাই তাদের শাসকদের অত্যাচার এবং বিশ্বাসঘাতকতায় অতিষ্ট তাদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ পোষণ করি না। এই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র আমরা বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করার কারণে, শুধুমাত্র আমাদের নীতি ও মুল্যবোধ পশ্চিম পাকিস্তানি শাসক ও তাদের সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্টপোষকদের নিকট নতি স্বীকার না করার কারণে। এই যুদ্ধ আমাদের উপর ঠেলে দেয়া হয়েছে কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা বাংলাদেশ এর যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পশ্চাদপসরণ করছে। যত দিন যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান বদল করছে এবং শক্তিশালী বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীরা দুর্বিনীতভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। এই কারণে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকরা ক্ষিপ্ত হয়ে পাগলের মতো জুয়া খেলছে, অধিক বেপরোয়া হয়ে উঠছে কিন্তু আমরা জানি তারা যখন মরিয়া হয়ে উঠে তারা আইন কিংবা মানুষের প্রতি শিষ্টতা থোরাই পরোয়া করে। তাদের সব ধরনের আক্রমণ ও বিশ্বাসঘাতকতার সম্মুখীন হবার জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকা জরুরি। আমাদের দেশ আক্রমণ করার মতো দুঃসাহস পাকিস্তানি সামরিক শাসকরা দেখাতে পেরেছে কারণ পিছন দিক দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা তাদের অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা প্রদান করছে। এই সহায়তা না পেলে তারা হয়ত এরকম বিপদজ্জনক যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ত না, যা ভালো কোনো কিছু বয়ে আনে না। আমরা ও পাকিস্তানের জনগণ যে মুল্যবোধ লালন করি তা এর ফলে অত্যন্ত ক্ষতি হবে। আমাদের লক্ষ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। এই যে যুদ্ধ যেটা আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে সেখানে আমাদের অখন্ডতা রক্ষা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্য নেই। এবং আমাদের সকল একতা, শক্তি এবং সামর্থ্য দিয়ে আমরা আমাদের অখন্ডতা রক্ষা করব। যদি পাকিস্তানি শাসক এবং তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভু যদি এমন চিন্তা করে যে, এভাবে তারা বাংলাদেশ-কে দেওয়া আমাদের সহায়তাসমুহ নিরস্ত করতে পারবে তাহলে তারা মস্ত ভুল করছে। পাকিস্তানি শাসকদের এধরনের আগ্রাসন বাংলা দেশ- কে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য দেয়া সহায়তাসমুহ আরো জোরদার করার আমাদের সংকল্প- কে বরং আরো শক্তিশালী করবে। আমরা সম্পূর্ণ পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই- বাংলা দেশ এর স্বাধীনতাকে দুনিয়ার কোনো শক্তি রুখতে পারবে না। এই প্রসঙ্গে আমি উল্লেখ করতে চাই – আমাদের দায়িত্ব প্রকাশ্যে এবং সম্পুর্ণভাবে গ্রহন করে বাংলা দেশ কে স্বীকৃতিদানে আমাদের আর আদৌ দেরী করা উচিৎ না। আমেরিকান ও অন্যরা আমাদেরকে প্রতারণা করেছে। তারা বাংলা দেশ ইস্যুকে আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত করার অপচেষ্টা করছে এবং এটাকে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার বিরোধ নাম দিয়ে পার পেতে চাইছে। সেটা কক্ষনো ভারতের মাটিতে হবে না, আমরা নিশ্চয় আমাদের মাটি রক্ষা করব এবং বাংলা দেশের ব্যাপারে আমারা আমাদের সার্বিক সহায়তা প্রদান করব যাতে তারা বাংলা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম জ্বলজ্বলে বাস্তবতায় পরিণত হয়। সেটাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ।
এই মুহুর্তে আমার বেশি কিছু বলার দরকার নেই। এটা দুঃখের এবং লজ্জাজনক যে চিনা সরকার পাকিস্তান এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পিছনে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আরো সমাজতান্ত্রিক দেশ আছে। আমাদের বন্ধু সোভিয়েত ইউনিয়ন রয়েছে যারা সবসময় আমাদের সমস্যা ও অসুবিধায় পাশে আছে। অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশসমুহ আছে যারা নিঃসন্দেহে পরিস্থিতি বুঝবে এবং আমাদের প্রশংসা করবে। আমরা ন্যায়যুদ্ধের সম্মুখীন। আমরা মানবিক মর্যাদা রক্ষায় যুদ্ধ করছি যা আমরা জোয়ান ও জনগণের রক্তের বিনিময়ে সমুন্নত রাখছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং সর্বোপরি স্বাধীনতা ও শান্তিকামী মানুষের কাছ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদা আশা করছি।
সবশেষে স্যার আমি বসার আগে আমি আমার পার্টির তরফ থেকে প্রতিরক্ষা ইস্যুতে সরকারের প্রতি সব রকম সমর্থন নিশ্চিত করছি কারণ এটা কোনো দলীয় ইস্যু নয়। এটা একটা জাতীয় ইস্যু এবং এই চ্যালেঞ্জ এবং হুমকি পুরো জাতি অভুতপূর্ব একতাবদ্ধভাবে মোকাবেলা করবে। সাম্প্রদায়িক শান্তি ও সম্প্রীতি এই মুহুর্তে আগের যে কোনো সময়ের চাইতেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের সমস্ত নৈতিক শক্তি, আমাদের সমস্ত প্রচেষ্টা দিয়ে এই বিষয়টি সমুন্নত রাখবো। এটাই আমাদের আদর্শ, এটাই আমাদের বর্ম। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একতাই আমাদের সুরক্ষার ঢাল। সাম্প্রদায়িক সন্দেহ ও অবিশ্বাস ছড়িয়ে কেও যেনো পরিস্থিতির সুযোগ না নিতে পারে সেদিকে কঠোর লক্ষ্য রাখতে হবে। এই সাধারণ সংগ্রাম এবং যুদ্ধে আমরা সবাই ভাই। সব ধর্ম, সম্প্রদায়ের সদস্য; বিভিন্ন রাজনৈতিক ও অন্যান্য সমিতির সদস্যের শক্তির উৎস এই কঠিন ঐক্য। আমি মনে করি সরকার এই ঐক্যের উপর নির্ভর করতে পারে। স্যার, আমি আশা করি একই সময়ে সরকার প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বার্থান্বেষী গোষ্টীকে এই পরিস্থিতির কোনোরূপ সুযোগ দেবে না। এই চ্যালেঞ্জিং পরিস্থিতি মোকাবেলায়- গণতান্ত্রিক অধিকার এবং জনগণের স্বাধীনতাকে সম্মান করা আবশ্যক এবং তাদের পূর্ণ ন্যায়সঙ্গত ভূমিকা পালন করতে দেয়া উচিৎ যাতে করে আমাদের মহান জাতি তাঁর সাহস প্রমাণ করতে পারে এমনকি এই সংকটের সময় যখন একটা যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা জাতীয় প্রতিরক্ষার ব্যাপারে কাজ করছেন তাদের প্রতি আবার আমরা আমাদের অঙ্গীকার এবং সংহতি প্রকাশ করছি। বাংলাদেশের বীর স্বাধীনতা যোদ্ধা এবং জনগণের প্রতি আমরা আমাদের উষ্ণ ভালোবাসা জানাচ্ছি। আমাদের হৃদয় তাদের প্রতি নিবেদিত। যতক্ষণ না পর্যন্ত শেষ পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্য বাংলাদেশ ছেড়ে না যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের দুর্গ গুড়িয়ে দেয়া হবে। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো বিরতি বা তীব্রতা কমবে না। আবার আমার শুধু এই-ই বলার আছে- আসুন আমরা এই চ্যালেঞ্জ সাহসের সাথে, একতা’র সাথে এবং বিশ্বাসের সাথে মোকাবেলা করি যে আমরা জিতব এবং সেই সাথে বাংলদেশ এর জনগণ জয়লাভ করবে।
শ্রী এন জি গারাই (মহারাষ্ট্র)ঃ যদিও আমার পার্টির সহকর্মীদের সাথে এই ব্যাপারে পরামর্শ করার মতো তেমন সময় পাইনি, তবুও আমি সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছি যে- আমাদের মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব ও অখন্ডতা রক্ষার প্রশ্নে সব ধরণের উদ্যোগ সাথে আমার পার্টি দৃঢ়ভাবে সংহতি প্রকাশ করছে। এই মুহুর্তটা আমি ভারতের ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে দেখছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই আগুন থেকে এক নতুন ভারতের জন্মলাভ হবে। শুধুমাত্র আমাদের মুল্যবোধ ও স্বাধীনতা রক্ষা নয় বরং আমাদের প্রতিবেশী বীর বাংগালীদের স্বাধীনতা ও মুল্যবোধ রক্ষার্থে আমাদের একই আগ্রাসী শক্তিকে প্রতিহত করা অধিকার রয়েছে।
আমি আমাদের দেশের সর্বক্ষেত্রের মানুষ এর প্রতি আবেদন করতে চাই- বিশেষ করে ছাত্র, যুবা, কৃষাণ, মজদুর এবং অতি অবশ্যই ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি তাঁরা যেন তাদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেন।
শ্রী কে পি সুব্রামানিয়া মেনন (কেরালা) ঃ সভাপতি সাহেব, স্যার, পাকিস্তানি মিলিটারি চক্র নির্বোধ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের বিমানঘাঁটি গুলোর উপর হামলা চালিয়েছে এবং আমাদের সীমায় বোমাবর্ষণ করেছে যেটা একটা যুদ্ধ ডেকে নিয়ে এসেছে যেটা সর্বোতভাবে আমরা চাইনি। কিন্তু স্যার, নির্মম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার জন্য যেভাবে লড়ে যাচ্ছে তাদের প্রতি আমাদের জনগণের সাহায্য, সমর্থন এবং অংশগ্রহণ এর পরিণাম হিসাবে এই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।
আমাদের পার্টি সবসময় বলে এসেছে এবং আমি খুশি যে এই-ই সংসদেই গতকাল আমি পূনরাবৃত্তি করেছিলাম যে- যদি আমাদের জনগণের সর্বসম্মত ইচ্ছা যে তাঁরা বাংলাদেশের জনগন-কে তাদের স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করবে তাহলে আমাদেরকে পাকিস্তানী সেনা চক্রের যুদ্ধ মোকাবেলা করতে হবে, এবং তখন সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখন্ডতা রক্ষা করার জন্য সারাদেশের মানুষ একটি একক মানুষ হিসাবে ফুঁসে উঠবে। আমি আমাদের পার্টির সেই অবস্থান এই মহান সংসদে আবার পূনরাবৃত্তি করতে চাই।
একই সময়ে আমি এই সুযোগে এই পরিস্থিতির অন্তর্নিহিত কিছু নির্দিষ্ট বিপদ সম্পর্কে বলতে চাই; সবার প্রথমে আমরা স্পষ্ট করতে চাই আমরা এই যুদ্ধটা লড়ছি বাংলাদেশের জনগণের জন্য; এবং এটাই সঠিক সময় আমাদের যুদ্ধটা বাস্তবসম্মত করতে, বোধগম্য করতে, এক্ষুনি এখানে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করতে হবে। এই ব্যাপারে বিন্দুমাত্র দেরী করা ঠিক হবে না। সর্বোপরি আমরা কি কারণে যুদ্ধ করছি যদি না আমরা বাংলাদেশের জনগণের জন্য যুদ্ধ করি? এবং আমাদেরকে উগ্র দেশপ্রেমের বিপদ থেকে সতর্ক থাকতে হবে যেনো সেটা পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরিণত না হয় কারণ সেটা গোটা ব্যাপারটা ব্যর্থতায় পর্যবাসিত করে দেবে। বস্তুতঃ আমরা যে কর্মকান্ড চালাচ্ছি অর্থাৎ আমরা বাংলাদেশের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষায় সংগ্রাম করছি সেটা যেনো এটাও দেখায় যে আমরা গোটা পাকিস্তানের জনগণের গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করছি যারা মুলত জনগণকে অত্যাচার করছে। অতএব আমাদের উগ্র দেশপ্রেমের ফাঁদে পড়লে চলবে না বরং আমাদেরকে স্পষ্ট থাকতে হবে কে আমাদের শত্রু এবং কাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ।
তৃতীয়তঃ আরো একটা বিপদ আছে; নির্দিষ্ট কিছু অংশ আছে, নির্দিষ্ট কিছু প্রতিক্রিয়াশীল চক্র আছে যারা দেশের এই পরিস্থিতিতে সাম্প্রদায়িক বিবাদ উসকে দেবার চেষ্টা করবে; সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ঘৃণার বিষ উসকে দেবার চেষ্টা করবে। স্যার, আমাদের যুদ্ধ বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে, তাদের প্রতি আমাদের সমর্থনের সারমর্ম হলো- গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য সংগ্রাম এবং সার্বজনীন ভারতীয় জনগণের জন্য সংগ্রাম। অতএব, স্যার, বাংলাদেশ এর প্রতি সমর্থন দানে আমরা যদি এহেন সাম্প্রদায়িক মনোভাবে জড়িয়ে পড়ি তাহলে আমাদের সংগ্রামের উদ্দেশ্য এবং উৎসর্গ বিফল হবে। তাই, আমাদের আরো সতর্ক হওয়া জরুরি যে আমরা যেনো দেশের সংখ্যালঘুদের সাথে কোনোরূপ সাম্প্রদায়িক সংঘাত এবং বিরোধে যেনো জরিয়ে না পড়ি। এবং আমি নিশ্চিত যে এই সময় সারাদেশ একতাবদ্ধ থাকবে এবং আমাদের উৎসর্গ- কে সাফল্যে রূপদান করবে।
ধন্যবাদ।
শ্রী কাঞ্চি কল্যানসুন্দারাম ( তামিল নাড়ু)ঃ সভাপতি সাহেব, এই ক্রান্তিলগ্নে, আমরা এক গুরুতর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। ভারতীয় উপমহাদেশের উপর পাকিস্তানের আক্রমন প্রথম বারের মতো নয়। এর আগেও আরো ২ বার তারা আক্রমন করেছিলো। একইভাবে, আবারো যুদ্ধবাজ পাকিস্তানীরা এখন আমাদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন শুরু করেছে। আমরা শান্তিপূর্ন ভাবেই বাস করছিলাম। আমাদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের এ আগ্রাসন নিন্দার যোগ্য। এখন আমাদের পাকিস্তান কে উচিত শিক্ষা দেয়া যেনো তারা আবার ও আক্রমন করার সাহস না হয়। যে যুদ্ধ আমরা এখন করছি, তা শুধুমাত্র আমাদের স্বাধিনতাকে কে রক্ষার জন্য নয়, একটি মহৎ উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানের জনগনের গনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার উদ্দেশ্যে আমরা এই যুদ্ধ করছি। আমরা শুধু আমাদের দেশের গনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য এ যুদ্ধ করছি না, পাকিস্তানের জনগনের গনতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় আমরা যুদ্ধ করছি। যুদ্ধংদেহী এই পাকিস্তানী শাষকদেরকে শিক্ষা দিতে হবে। পাকিস্তানীদের সাথে এটাই আমাদের শেষ যুদ্ধ হওয়া উচিত। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে, আবার পাকিস্তান আমাদের আক্রমন করার সাহস না পায় এবং আবারো তাদের লেজ কেটে দেয়া হবে। যতদিন আন্তর্জাতিক মানচিত্রে পাকিস্তান আছে, আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে যে আমাদের সাথে শান্তিমতো থাকতে হবে, এবং এই মুহুর্তেই পাকিস্তান কে এই বিষয়টি বোঝাতে হবে। আমার মনে হয় এই যুদ্ধ অবধারিত এবং এখন এই যুদ্ধ চলছে; আমরা চাই না এই যুদ্ধ আরেক “তাসখন্দ” এ পরিনত হোক। ইতিমধ্যে আমরা জানি যে, তাসখন্দ চুক্তিতে আমাদের জন্য কি করা হয়েছে। ইংরেজীতে একটি প্রবাদ আছে, “চরম শত্রুকেও তার প্রাপ্য পাওনা বুঝিয়ে দাও। এই সংকটকালে, পাকিস্তান শুধু একটাই ভাষা বুঝবে তা হলো আঘাতের জবাব আঘাত দিয়েই করতে হবে।
এই ক্রান্তিলগ্নে, D.M.K পার্টির পক্ষ হতে, আমি, ভারতের অখন্ডতা ও স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য আমাদের আন্তরিক ও অকুন্ঠ সহযোগিতা দিতে এবং ত্যাগ স্বীকার করতে ভারতবাসীর সাথে আছি।
ধন্যবাদ
শ্রী বি. ভি আবদুল্লা কয়া (কেরালা)ঃ জনাব সভাপতি, স্যার, যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই – আমাদের ভারতীয় সাম্রাজ্যের উপর পাকিস্তানের আগ্রাসন খুবই পরিকল্পিত ভাবে শুরু করেছে। প্রত্যেক ভারতীয় নাগরিক সে হিন্দু অথবা মুসলিম, শিখ অথবা খ্রীষ্টান তাদের পবিত্র কর্তব্য হলো, যার যা কিছু আছে সবকিছুকে উৎসর্গ করা এবং নিজের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও প্রান প্রিয় ভারত মাতা কে রক্ষার করা। যুদ্ধ ততদিন চলবে যতদিন পর্যন্ত শত্রু একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং ভবিষ্যতে ভারত সীমানা যেনো চিরতরে এ ধরনের আগ্রাসন থেকে নিরাপদে থাকতে পারে। আমি আমার পক্ষ থেকে এবং আমার পার্টি – ভারতীয় ইউনিয়ন মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে, সরকারকে আমাদের পুরো উদাত্ত হৃদয়ের সমর্থনের অঙ্গীকার করছি, এবং এই সময়ে অবিবেচক পাকিস্তানের আগ্রাসন থেকে দেশকে সুরক্ষার জন্য আমরা আমাদের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত।
শ্রী কুম্ভ্রাম আর্য ( রাজস্থান)ঃ সভাপতি মহাদয়… এ পর্যায়ে আমাদের এই প্রতিজ্ঞা ও নিষ্ঠার সাথে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে যে বাংলাদেশেও গনতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হোক এবং ভারত তার অখন্ডতা নিয়ে পাকিস্তান কে এমন একটি শিক্ষা দিক যে, জীবনে সে যেন আর মাথা উঠানোর ধৃষ্ঠতা না দেখায়। এজন্য এ দেশের প্রতিটি মানুষ বিশেষ করে যাদের রক্তে তেজ আছে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাক। তারা ক্ষেতেও কাজ করে এবং যুদ্ধের ময়দানে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেবার জন্য ও কাজ করে এবং এর সাথে তারা এও চায় যে একবার তাদের সম্মখে বিক্ষেপিত পা কারো কথায়, কারো চাপে, কোন সমঝতায় আর পেছন ফিরবে না। এ ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমাদের দেশ সবসময় শান্তি বজায় রেখে চলেছে সামনেও শান্তি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানকে শিক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুত তার অন্য কোন ইচ্ছা নেই।
এক্ষেত্রে আমি শুধু বলবো দল, আমি এবং আমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনসাধারন সকলে এ দেশের জন্য শুধু সহযোগীতা নয় রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত কিন্তু এই রক্তের বিনিময়ে পরিষদের কাছে শুধু একটি প্রত্যাশা যে স্থানে আমাদের রক্ত বইবে ঐ মাটিতে আমাদের অধিকার যাতে স্থায়ী হয়…
*সরদার নরেন্দর সিংহ বার ( পাঞ্জাব)ঃ সভাপতি মহোদয়, আমাকে বলার সুযোগ দেয়ায় আমি আনন্দিত। দেশে সামান্য উদ্বিগ্নতা আছে কিন্তু এর মাঝে আমি কিছু প্রসন্নতাও বোধ করছি এই মনে করে যে, জাতি এবার তার শৌর্য দেখাবার এবং শত্রুর দাঁত ভেঙ্গে দেবার একটি সুযোগ পেয়েছে।
যুদ্ধ করার ব্যাপারে, মৃত্যুকে আলিংগন করার ব্যাপারে আমার জাতি আপনার সঙ্গে রয়েছে এবং সর্ব ক্ষেত্রে আপনার সহযোগিতা করবে। ( মূল ভাষন উর্দুতে)
শ্রী আই সি চাগলা (মহারাষ্ট্র)ঃ জনাব সভপতি, ১৯৪৭ সালে যখন আমরা স্বাধীন হই, পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু এর সেই সময় একটি বিখ্যাত অভিব্যাক্তি ছিলো, যে তিনি নিয়তিতে বিশ্বাস করতেন। ভাগ্যের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। আমার কাছে মনে হয়, এটা আমদের নিয়তির সংযোগ স্থল। ১৯৪৭ সালের সেই সময়ে, আমরা নতুন ভারত গড়ার প্রচেষ্টার মাধ্যমে ভাগ্যের সাথে মোকাবেলা করেছিলাম। আমার বক্তব্য এই, এবারো আমরা ভাগ্যের সাথে সাড়া দেবো সাহস, একতা, সংহতির মাধ্যমে।
স্যার এই যুদ্ধ শুধু আমাদের দেশের ভবিষ্যতের উপরই প্রভাব ফেলবে না, পুরো দক্ষিন এশিয়ার উপর প্রভাব ফেলবে। কথায় আছে, ইশ্বর যদি কাউকে ধ্বংস করতে চায়, তো প্রথমে তাদেরকে পাগল বানিয়ে দেয়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান হচ্ছে একজন উন্মাদ। এটা আমরা সবাই জানি। সে তার ধ্বংসের পথেই যাচ্ছে। কিন্তু আমি এই বিষয়ে আরো গুরুত্ব আরোপ করতে চাই। পাকিস্তানের সাথে এটাই আমাদের শেষ যুদ্ধ হোক। যখন আমি পাকিস্তানের ধ্বংসের কথা বলছি, আমি বলতে চাই, আমি পাকিস্তানের ধ্বংস দেখতে চাই। যখন আমি পাকিস্তান ধ্বংসের কথা বলি, তখন যে কারনগুলো আসে, তা হলো সামরিক একনায়ক্তন্ত্র, সামরিক স্বৈরশাষন, ভারতীয় দ্ব-জাতিতত্ত্ব, গনতান্ত্রিক অধিকার দমন, এবং জাতিসংঘের সনদে সন্নিবেশিত প্রতিটি মুলনীতি।
আবার অন্যদিকে, আমরা গনতন্ত্রের জন্য, স্বাধীনতার জন্য, প্রতিবেশী সুলভ মনোভাবের কারনে সোচ্চার হয়েছি কারণ এসকল বৈশিষ্ট্যগুলোকে আমরা দাম দেই। তাই, স্যার, এই যুদ্ধ শুধু সীমান্তবর্তী দুই দেশ পাকিস্তান ভারতের মধ্যে যুদ্ধ নয়, এটি দুই মতবাদের মধ্যে যুদ্ধ এবং আমি বলতে চাই যতদিন না আমরা পাকিস্তানের এই অন্যায় কে ধ্বংস করে দিতে পারবো আমরা পৃথিবীর এই অংশে কখনোই শান্তি আনতে পারবো না।
স্যার এবার আর আত্নরক্ষামূলক যুদ্ধ নিয়ে আর কোন কথা নয়। যথেষ্ট হয়েছে, পাকিস্তানের সাথে এটি এখন আক্রমনাত্নক যুদ্ধ। আমরা সব সময়ই চেয়েছি যুদ্ধ কে এড়াতে যতটুকু করা সম্ভব। কিন্তু, স্যার এখন বিবাদের সূত্রপাত হয়ে গেছে যা- বেরিয়ে আসার সব বেরিয়ে আসুক এবং এই ঝামেলা চিরতরে শেষ করে দিতে হবে।
স্যার আমি এর সাথে আরো বলতে চাই, পাকিস্তান পাপকে ধারন করে এবং এর শেষ হচ্ছে সহিংসতার মধ্য দিয়ে। পাকিস্তানের একটি অংশ ইতিমধ্যে ধ্বংস হয়ে গেছে। বাংলাদেশ যা পাকিস্তানের একটি অংশ যা গঠিত হয়েছিলো পাকিস্তানের অধিকাংশ অংশ নিয়েই। কিন্তু যা ছিলো তার সবই ধ্বংস হয়ে গেছে ইয়াহিয়া খানের কীর্তিকলাপে। কিন্তু আমি আমার বন্ধু গুপ্তার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করবো যে, আজ প্রথমে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর ইশ্বরের দোহাই এটাই হবে আমাদের প্রথম উত্তর। আমি জানি আন্তর্জাতিক চাপ আমাদের উপর আছে। এক বিজ্ঞ ব্যাক্তি নিউইয়র্কে বসে থাকবেন এবং তার অন্যান্য মন্ত্রীসভাসদরা আমাদের বলবেন আমাদের কেমন ব্যাবহার করা উচিত, আমাদের কি করা করা উচিত? কিন্তু আমরা জানি আমাদের কাছে জাতীয় স্বার্থই মূখ্য। ঈশ্বর জানেন আমরা অনেক অপেক্ষা করেছি, আমরা অপমানিত হয়েছি, পাকিস্তানের আগ্রাসন দেখেছি। সে সময় চলে এসেছে যখন আমরা শপথ নিয়েছি যে, এই আগ্রাসন দূর করতে আমরা দৃঢ় সংকল্প বদ্ধ। এবং সাথে এটাও দেখতে চাই না যে ভবিষ্যতে বিশ্বের কোথাও কোন ধরনের আগ্রাসন চলুক।
স্যার, একটা বিষয়ে আমি সরকার ও প্রধানমন্ত্রী কে আশ্বস্ত করতে চাই, আমার মনে এই সময়ে আমাদের সকল ভেদাভেদ ভুলে যাওয়া উচিত। আমাদের এখন শুধু একটা জিনিসই ভাবা উচিত এবং তা হলো আমাদের দেশকে প্রতিরক্ষা করা এবং পাকিস্তানকে পরাজীত করা। স্যার, আমি প্রধানমন্ত্রী কে আশ্বস্ত করতে চাই যে, আমাদের প্রত্যেক নেতাই তার পিছনে দাঁড়াবে এবং তিনি আমাদের বিজয়োৎসবের দিকে নিয়ে যাবেন।
শ্রী গংগা শরণ সিংহ( নাম- নির্দেশিত)ঃ প্রিয় সভাপতি মহোদয়, পরস্পরাগত ভাবে আমাদের নীতি এই ছিলো যে, একবার আমরা আর পেছনে ফিরে আসি না। আমরা আক্রমন করিনি, অন্যের ভূ-খন্ড দখল করিনি কিন্তু স্বদেশের নিরাপত্তার জন্য আমরা সবসময় সংশ্লিষ্ট ছিলাম। আর আমি যখন দেশের কথা বলি তখন একটি ভূ-ভাগের ধারনা আমার অন্তরে থাকে না, কিছু ব্যাক্তির সমষ্টির মধ্যে সেটি সীমিত থাকে না। আমি আমার দেশকে মানবের উচ্চতম চিন্তাধারা, উচ্চতম দর্শন এবং উচ্চতম নীতির প্রতীক মনে করি। এ প্রতীক আমাদের আদিকাল থেকেই ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। এজন্য আমরা আজ নীতিমালার জন্য ও আমরা অস্ত্র ধারন করি যেগুলোর প্রতীক হচ্ছে আমাদের দেশ।
সভাপতিঃ মি। চিত্ত বসু।
শ্রী চিত্ত বসু ( পশ্চিম বাংলা)ঃ স্যার, এটি ইতিহাসের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন মুহুর্ত এবং জাতির জন্য এক পরীক্ষা। এবং এটি হয়েছে কারন, আমরা যুদ্ধের মধ্যে অবস্থান করছি। এবং এই যুদ্ধ আমাদের ইচ্ছায় হয় নি, এটি আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। স্যার, জাতির জন্য ডাক এসেছে, সুতরাং সীমান্ত বর্তী এলাকা জুড়ে যে আগ্রাসনের এই প্রতিযোগিতা কে মুখোমুখি করতে হবে। এই যুদ্ধ শুধু আমাদের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য না এবং আমাদের দেশের একত্রীকরনের জন্যও না, কিন্তু এই যুদ্ধ আমাদের জীবনের আদর্শ রক্ষার, যার জন্য আমরা বেচে আছি তার প্রতিরক্ষায় এবং আমরা আমদের নিজেদের ভুমিতে বেচে আছি, এটাই হলো গনতন্ত্র, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতার জীবনাদর্শন।
সুতরাং এই যুদ্ধ আমাদের লালিত আদর্শ রক্ষার যুদ্ধ। এবং এই যুদ্ধের জন্য পূর্ন সংহতির প্রয়োজন কারন এটি একটি পূর্ন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শুধু সীমান্তের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সাহসী জোয়ানরাই লড়াই করছে না, বরং লাংগল চালানো মানুষ থেকে শুরু করে কল কারখানার মানুষ এবং সর্বস্তরের জনগন এখানে অংশগ্রহণ করেছে। এটি একটি পূর্নাংগ যুদ্ধ এবং এর জন্য পূর্নাংগ সংহতির প্রয়োজন। আমাদের মনে রাখতে হবে, এই যুদ্ধ সরাসরি পাকিস্তানের জনগনের বিরুদ্ধে নয়। কারন, এটি সম্পর্কে বহির্বিশ্ব অবহিত এবং এটি বার বার পূনরাবৃত্তি করা উচিত যে আমাদের আদর্শ রক্ষার জন্য এই যুদ্ধে অংশ নিতে আমরা বাধ্য হয়েছি। এবং আমার কোন সন্দেহ নেই যে এই সাফল্য এবং জয় নিয়ে এবং ইয়াহিয়া ও ভূট্টোর দাসত্ব থেকে পাকিস্তানের জনগনকে মুক্ত করে এবং স্বাধীনতা নিয়ে আসবো এবং অবাধ স্বাধীনতায় তাদের নিয়তিকে রুপ দিবো।
দুপুর ১২ টা
এমতাবস্থায় আমি অঙ্গীকার করতে চাই, সমস্ত কার্যকলাপে, সরকারের সকল প্রচেষ্টাতে আমার ঐকান্তিক সমর্থন থাকবে। এই ব্যাপারে, আমি মনে করি দেশের সকল রাজনৈতিক দল গুলো নিজেদের মধ্যের ভেদাভেদ ভুলে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থাকে আরো শক্তিশালী ও নতুন করে রুপদান করবে।
বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় ও স্বাধীনতা কামী মানুষের কাছে আমি যুদ্ধবাজ পাকিস্তানকে আর প্রতিপালন না করার ব্যাপারে আবেদন করতে চাই। এবং অনুরোধ করছি তারা তাদের নিজেদের নিজ নিজ সরকারকে সামলাতে অবদান রাখবেন যাতে তারা পাকিস্তানকে কোন প্রকার সাহায্য না করে – যাতে করে এই অঞ্চলে স্থায়ীত্ব ও শান্তি ফিরে আসে।
আমি আরো একবার সরকারকে আহবান করতে যাই যে, বাংলাদেশের মানুষগুলো তাদের দেশের স্বাধীনতার জন্য বীরের মত লড়াই করছে এবং গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগনের সরকারকেও অনতিবলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক। কারন, বাংলাদেশের জন্য আমরা বাধ্য হয়েছি এ অবস্থান নিতে। এই পাকিস্তানী যুদ্ধবাজদের অনতিবিলম্বে উপযুক্ত জবাব হবে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারে স্বীকৃতি প্রদান করা।
স্যার, আরো একবার বলে আমি শেষ করতে চাই যে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা হোক।
শ্রী বি ডি KHOBRAGADE ( মহারাষ্ট্র)ঃ স্যার, যেহেতু আমি এই মহান সংসদের ডেপুটি চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি। গত ২ বছর ধরে, এই সংসদে আলোচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন বিষয়গুলোতে মতামত প্রকাশে আমি আমার নিজেকে বিরত রেখেছি, কিন্তু পাকিস্তান কর্তৃক ছড়িয়ে দেয়া এই আগ্রাসনের এই দৃশ্যে, আমি আমার মতামত প্রকাশ করতে বাধ্য হচ্ছি। আমি ভারতের রিপাব্লিকান দলের পক্ষ হতে দেশের সরকার ও মানুষের সাথে সংহতি প্রকাশ করছি।
স্যার, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মুখপাত্ররা তাদের নিজ নিজ মতামত প্রকাশ করেছে এই জাকজমকপূর্ন অনুষ্ঠানে। এই মহান জাতির রাজনৈতিক নেতাদের প্রদেয় মতামতের সাথে আমি আমার একাত্নতা প্রকাশ করছি।
কিছু সদস্য গন তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন এভাবে যে, আমাদের এই সুযোগের সদ্বব্যাভার করা উচিত এবং পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেবার প্রচেষ্টা করা উচিত। আমি মনে করিয়ে দিতে চাই এই সংসদে, যে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান আমাদের দেশের বিরুদ্ধে যে বিবাদের সূত্রপাত করেছিলো, আমরা পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিয়েছি। সম্ভবতঃ পাকিস্তা সে শিক্ষা ভূলে গেছে, পাকিস্তান পুনরায় আমাদের দেশের বিরুদ্ধে আবারো বিবাদ শুরু করেছে, এবং আমার মনে কোন সন্দেহ নেই যে আমাদের যে জোয়ানরা সামনে থেকে লড়াই করবে, তারা অবশ্যই এমন শিক্ষা দেবে পাকিস্তানকে যা কখনোই পাকিস্তান ভুলতে পারবে না।
স্যার, বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের দেশ চেষ্টা করেছে সাহায্য করতে এবং কাজেই পাকিস্তানী সামরিক জান্তার ক্রোধ ও উন্মত্ততা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দেশের বিরুদ্ধে এই আগ্রাসন কে আমরা অবশ্যই বীরত্বের সাথে মোকাবেলা করবো এবং আমার কোন সন্দেহ নাই যে আমাদের জোয়ানেরা যারা সম্মুখ যুদ্ধ করবে, তারা তাদের সমস্ত শক্তি ও বল দিয়ে পাকিস্তানের এই আগ্রাসী মনোভাবকে গুড়িয়ে দিবে।
আমি সংসদের আর বেশি সময় নিবো না। আমি আমার একটি মাত্র মত দিতে চাই এবং তা হলো, বাংলাদেশের জন্য আমাদেরকে এই বিবাদের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানে অনেক বিলম্ব হয়েছে, যদি বাংলাদেশের জন্যই আমাদের এই বিবাদের সম্মুখীন হতে হয়, আমি মনে করি সেই সময় চলে এসেছে যখন বাংলাদেশের স্বীকৃতি প্রদানে আর দেরী করা উচিত নয়।
এই অনুষ্ঠানে ভারতীয় রিপাব্লিকান দলের পক্ষ থেকে আমি অকুণ্ঠ ও নিঃশর্ত সমর্থন জানাচ্ছি এবং এই দেশের দূর্বল এবং পদদলিত মানুষ আমাদের দলের প্রতিনিধি। আমি সেই শ্রেনীকেই নির্দেশ করছি যাদেরকে আমরা দরিদ্র বলি, হয়তো তারা এমন অবস্থানে নেই যে তারা সোনা বা অর্থ অনুদান করতে পারবে, কিন্তু আপনাকে, এই সংসদ কে, এবং প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকারের মাদ্ধ্যমে আমি নিশ্চিত করছি যে, এই গরীব লোকেরা তাদের শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও দেশের একতা রক্ষা করতে, স্বাধীনতা, অখন্ডতা রক্ষা করতে তাদের জীবন উতসর্গ করবে।
আমি ১৯৬২ এবং ১৯৬৫ এর আগ্রাসনের অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে চাই না, যখন নিপীড়িত জনগনের সাহস ও বীরত্ব বিকশিত হয়েছিলো এবং তারা তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলো এই দেশের অখন্ডতা এবং স্বাধীনতা রক্ষায়। ১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সালের আগ্রাসনের অভিজ্ঞতা এক পাশে রেখে, আপনি এই দেশের ইতিহাস এর পাতায় দেখেন, শিবাজির সময় থেকে শুরু করে যখনই আমাদের দেশকে স্বাধীনতা রক্ষায় এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, এই গরীব জনগনেরাই সর্বদা নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় এবং স্বাধীনতা অর্জনে। তাই, এই সমারোহপূর্ন অনুষ্ঠানে, আমি আমার পক্ষ থেকে এবং সেনাদলের পক্ষ থেকে সরকারের প্রতি সংহতি প্রকাশ করছি এবং নিশ্চিত করছি যে আমরা দেশের স্বাধীনতা ও অখন্ডতা বজা রাখতেযে কোন প্রকারের ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত।
জনাব সভাপতিঃ সম্মানিত সদস্যগন, এই বিচারাধীন মুহুর্তে আমি আরো একটি কথা যোগ করতে চাই। পুরো সংসদ এবং প্রকৃতপক্ষে পুরো জাতি দৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ। এই যুদ্ধ; যা আমাদের উপর ঠেলে দেয়া হয়েছে, এতে কোন সন্দেহ নেই যে, বিজয় আমাদের হবে। প্রতিটি ব্যাক্তি, প্রতিটি দল, আমি নিশ্চিত তারা আপ্রান চেষ্টা করবে। এই বিজয়ের লক্ষ্য অর্জনে তারা অবদান রাখবে। আমাদের কারন এটাই আমরা লড়াই করছি নির্দিষ্ট আদর্শ এবং নির্দিষ্ট নীতির জন্য। সামরিক বাহিনী একটি মহান জাতির সামরিক শক্তি। পুরো জাতি তাদের পেছনে আছে এবং এতে কোন সন্দেহ নেই যে পরিনামে আমরা আমাদের আদর্শ ও নীতি সংরক্ষনে সফল হবো।
সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের অধীনে পুনরায় জরূরী অবস্থার ঘোষনা
প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ( শ্রী জগজীবন রাম) ঃ স্যার আমি নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত অপসারনের জন্য আবেদন করছি,
“সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের দফা (১) অনুযায়ী, ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ এ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি কৃত জরুরী অবস্থার ঘোষনা সংসদে অনুমোদন”
প্রশ্নটি প্রস্তাবিত হল।
বিরোধী দলীয় নেতা ( শ্রী এম এস গুরুপদস্বামী) ঃ আমি খুব সংক্ষেপে বলছি, সময় এসেছে সিদ্ধান্ত নেয়ার, আমাদের কি মহান দেশ হিসেবে কাজ করে যাওয়া উচিত নাকি ছোটই থেকে যাবো। আমাদের সামনে গুরুত্বপুর্ন প্রশ্ন হচ্ছে, এই দেশ কি সুবিশাল দেশ হবে নাকি এটি বামনের দেশে পরিনত হবে। জাতির ইতিহাসের সেই মুহুর্তে, যখন জাতি তার রক্ত ও শক্তির বিনিময়ে সুনাম অর্জন করেছে। বহু জাতিই দূর্ভোগ সহ্য করেছে এবং কঠোর পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছে এবং তারা সফল হয়েছে। দেশ এখন সংকটময় এবং আমাদের এর মধ্য দিয়েই যেতে হবে এবং সাফল্য অর্জন করতে হবে। স্যার, আমি পুনরাবৃতি করতে চাই না যা আগেই বলেছি। এই আয়োজনে, আমি শুধু এটাই বলতে চাই, বিভিন্ন দল ও উপদলগুলোর মধ্যে যে ছোটখাট দ্বন্দ গুলো আছে সেগুলোকে মিটিয়ে ফেলতে হবে। এই কথাটি আমি আমার সকল বন্ধুদের কাছে বলতে চাই। অতীতে এবং বর্তমানে আমাদের মধ্যে যে প্রধান বিভেদগুলো ছিল বা আছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে এবং জাতির লক্ষ্য অর্জনে আমাদের একটি সার্বজনীন ইচ্ছাশক্তি তৈরি করতে হবে। এই দ্বন্দ কোন সাধারন দ্বন্দ নয় যা জনাব চাগলা ইতমধ্যে নির্দেশ করেছেন। এটিই গনতন্ত্র ও এক নায়কতন্ত্রের মধ্যে পার্থক্য। এটি সামরিক ও গনতান্ত্রিক মূল্যবোধের মধ্যে দ্বন্দ এবং এটি এমন এক দ্বন্দ যেখানে জাতির স্বার্থে আমাদের প্রত্যেককেই জড়িত হতে হয়েছে যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী। এই আয়োজনে, সরকারের প্রত্যেকটি অংগ, প্রত্যেকটি অর্থনৈতিক হাতিয়ার, প্রত্যেকটি সামাজিক মাধ্যমকে কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। যন্ত্রপাতি চালাতে হয়েছে, ক্ষেত গুলোতে চাষ করাতে হয়েছে, অফিসের কাজ করতে হয়েছে এবং সদা জাগ্রত থেকে তা অর্জিত হয়েছে। আমি নিশ্চিত পাকিস্তান কর্তৃক সৃষ্ট এই জরুরী অবস্থা অবলম্বে শেষ হবে। আমাদের কিছু বন্ধু আছে যারা এই ঘোষনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে, “এই জরুরী অবস্থার কোন নির্দিষ্ট সময় সীমা নেই”- তারা এই অংশটিকে নির্দেশ করেছে। আমার খেয়াল আছে, অতীতে যখন জরূরী অবস্থা জারি হয়েছিলো, সেই জরুরী অবস্থা টানা কয়েক বছর ধরে চলেছিলো। এবং আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি এই জরুরী অবস্থা বেশিদিন চলবে না কারন এখন পরিস্থিতি ভিন্ন, এবং আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার, এবং পুরো জাতি এখন এক। এরই সাথে, শুধু মাত্র ভারতই না, যারা গনতন্ত্রে বিশ্বাস করে এবং গনতন্ত্রকে ও ন্যায় বিচারকে মূল্য দেয় তারা আমাদের সাথেই থাকবে এবং আমি খুবই নিশ্চিত যে এই জরুরী অবস্থা খুব শীঘ্রই শেষ হয়ে যাবে এবং অল্প কয়েক মাসের মধ্যে আমরা একটি নতুন উদীয়মান বাংলাদেশকে পাবো এবং এশিয়ার সামনে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে ভারত প্রকাশ পাবে। এত বছর ধরে আমরা এমন ভাবে কাজ করেছি, যা আমাদের দেশকে একটি মাধ্যমিক অবস্থানে নিয়ে এসেছে এবং, এই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে আমরা সুযোগ পেয়েছি যখন আমরা সত্যি পরিনত করতে পারবো এ দেশকে মহান করতে। এই আগুনের মধ্য দিয়েই আমাদের যেঁতে হবে, এ ছাড়া আমদের আর কোন বিকল্প নেই। এই নির্মম কষ্টের মধ্য দিয়েই যেঁতে হবে এছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প নেই। শুধুমাত্র এই পন্থায় বহু দেশ এভাবেই মহত্ব অর্জন করেছে। যারা ইতমধ্যে বলে গেছেন যে পাকিস্তানের জন্য সঠিক এবং কার্যকরী উত্তর হচ্ছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করা আমি তাদের সাথে একাত্নতা প্রকাশ করছি।
বাংলাদেশ, গতকাল আমি এই বিষয়টি তুলেছি এবং আমি ডেপুটি চেয়ারম্যান এর সাথে সহমত প্রকাশ করছি যিনি বলেছেন, বাংলাদেশের কারনে সেখানে দ্বন্দের সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য সেখানে যুদ্ধ হয়েছে এবং আমরা কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের এই তাড়নাকে বাধা দিবো। এই নিয়ন্ত্রনের পেছনে যুক্তি কি, আমি তা বুঝি না। আমি আশা করি এবং বিশ্বাস করি সরকার এই বিষয়ে পদক্ষেপ নিবে। আমি সরকারকে আশ্বস্ত করতে চাই যে পুরো জাতি তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে এবং সংসদ ও তাদের সাথে থাকবে যদি তারা আজ ঘোষনা দেয় যে তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করবে। এটিই হবে সঠিক এবং কার্যকরী জবাব যা আমরা পাকিস্তানকে দিতে যাচ্ছি।
প্রতিরক্ষা নিয়ে একটি কথা, আমি আমার সম্মানিত বন্ধু জনাব ছাগলার সাথে একমত যখন তিনি বললেন এক্ষেত্রে প্রতিরক্ষামুলক যুদ্ধে কোন বিকল্প নেই। এই যুদ্ধে কোন প্রকারের বাধা থাকতে পারে না, এই দ্বন্দের কোন বাধা থাকতে পারে না। এই হিংস্রতার পুরষ্কার খুব ভালোভাবেই পেতে হয়েছে, যাতে আমরা খুব দ্রুত বিজয় অর্জন করতে পারি। অন্যভাবে, আমার ভয় হচ্ছে সেখানে হয়তো টানাটানি হবে, হয়তো দেরী হবে, হয়তো লক্ষ্য অর্জনে স্থগিত হতে পারে। যাইহোক, চলুন সবাই মিলে এটিকে সংক্ষিপ্ত আর ছোট করি। ইহা এই জন্যে আমি বলি যে, সরকার এবং সংসদ কে এক হয়ে কাজ করতে হবে। এবং আমাদের অবশ্যই থাকতে হবে, যাকে আমি বলি ইচ্ছাশক্তি, জাতীয় ইচ্ছা শক্তি –বাংলাদেশকে স্বাধীন করার। এবং এই কাজে যে কোন ধরনের ত্যাগ, যে কোন ক্লেশ, যে কোন দূর্ভোগ যে কোন পরিমাপের কষ্ট এবং জ্বালা জাতি হিসেবে আমাদের সহ্য করতে হবে। আমি নিশ্চিত জাতি হিসেবে আমাদের সেই শক্তি, ইচ্ছা শক্তি আছে এবং ঐক্য এবং দৃঢ়ভাবে আমরা নিশ্চিত যে এর সমাধান, ক্রিসমাসের আগেই করতে পারব এবং স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করবো এবং পাকিস্তানের সামরিক শাষনের পতন – সেটাও ক্রিসমাসের আগেই।
এরই সাথে আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি।
ডঃ ভাই মহাবীর (দিল্লী)… মহোদয়, আমার শুধু এই বলার আছে, যে সংকটই আসুন না কেন আমার মনে পড়ছে, যখন ব্রিটেনের উপর এরুপ একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি এসেছিলো তখন বলা হয়েছিল, বৃটেনের জন্য সেটি ছিল সংকটকাল, কিন্তু বাস্তবে দেখা গেলো, বৃটেনের সবচেয়ে অন্ধকার সময়ই ছিলো বৃটেনের সুন্দর সময়। এরুপ কোন পরিস্থিতি এসে থাকলে আজ সেটি আমাদের ইতিহাসের সবচেয়ে বীরত্বপূর্ন অধ্যায়রুপে গন্য হবে, ১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট যে ভুল হয়েছিলো তা ধুয়ে মুছে সমগ্র দেশে আমরা একটি নতুন যুগের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করব।
…… মহোদয়, আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ঐক্যের যে প্রয়াস চলছে নিজেদের মধ্যে অনৈক্যের মনোভাব কখনো কখনো তাতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় কিন্তু কোন শত্রু যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে দেয় যে, আমরা নিজেদের ঐক্যের কথা ভাবি, ঐক্যের মন্ত্র উচ্চারন করি, তাহলে তাদের প্ররোচনা আমাদের শোনা উচিত। ভারত আবার এক হয়ে দাঁড়িয়ে নতুন যুগ নির্মাণ করবে। আমাদেরও মতভেদ রয়েছে সত্যারূঢ় দল, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে অভিনন্দন জানাবো এবং তাদের বলব যে তারা এই দেশকে, ভারত মাতার শিরকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন, এজন্য তারা ধন্যাবাদার্হ। এর সঙ্গে আমি অবশ্যই চাইবো, অন্যসব দল যেভাবে বিনাশর্তে সমর্থনের আশ্বাস দিচ্ছে সেভাবে সরকার ও সবকিছুর উর্ধ্বে একদলীয় সরকারের মত না ভেবে নিজেকে যেন সারা দেশের সরকার মনে করেন।
মহোদয়, আমি আরেকটি মাত্র কথা বলতে চাই, আমি মনে করি এই জরুরী অবস্থা ঘষনার সংগে সঙ্গে এই ঘোষনা আসবে যে ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। এতে আর বিল্মব করা উচিত হবে না। পরিষদের এই ব্যাক্ত ইচ্ছার সঙ্গে আমি সরকারের সঙ্গে কণ্ঠ মিলাতে চাই। ধন্যবাদ।
শ্রী এম, কে মোহতা (রাজস্থান)ঃ জনাব সভাপতি, স্যার, শুরুতেই আমি পুনরাবৃতি করতে চাই, যা আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান ইতোমধ্যে বিবৃতি দিয়েছেন, যথা, জাতীয় দূর্যোগের এই সময়ে জাতীয় প্রতিরক্ষা প্রচেষ্টায় আমাদের দল অঙ্গীকার করছে যে, আমরা পরিপূর্ন ও অকুন্ঠ সমর্থন দিবো। জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে এবং সারা পৃথিবীর দৃষ্টি এখন ভারতের জনগণের দিকে। আমরাই নির্ধারন করবো এই পরিস্থিতিতে আমরা কতটুকু উচ্চতায় উঠবো যাতে আমাদের সাহস ও সহিষ্ণুতা ও অভিপ্রায়ের সাথে একত্রে কাজ করতে পারি এবং এই সঙ্কট পুরোপুরি সফলতার সাথে মোকাবেলা করতে পারি। আমি বিশ্বাস করি একটি জরুরী অবস্থায় দলীয় মতভেদ, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ – বাদ দিতে হবে এবং একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে হবে। এটাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে, সকল রাজনৈতিক দলেরই এবং সকল রাজনৈতিক দলের সম্মেলনে গঠিত জাতীয় সরকারই এই যুদ্ধে এই দেশকে জয়ের দিকে এগিয়ে নেবে।
সংসদের ভুমিকার ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই। যদিও সেখানে গভীর সঙ্কট বিরাজমান, তবে এটা জরুরী যে সংসদ বসবে, সরকারের কাছ থেকে সীমান্তের বিষয়ে বুঝে নেবে, কি পরিস্থিতি চলছে এবং সরকারের জন্য কি ভুমিকা কোন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে কি ব্যাবস্থা নেওয়া উচিত সে ব্যাপারে সংসদের পরামর্শ নেওয়া হবে।
শেষ করার আগে, আমি এটা বলতে চাইঃ আধুনিক যুগের যুদ্ধে একটি জাতির শক্তিমত্তার পরিমাপ শুধু সম্মুখসমরে কি পরিমাণ অস্ত্র প্রয়োগিত হচ্ছে অথবা কি পরিমাণ লোকের হাতে অস্ত্র আছে তা দিয়ে না, বরং জাতির অর্থনৈতিক শক্তির উপরও নির্ভর করে। যেকোন অর্থনৈতিক সংঘাতের ফলাফল নির্ভর করে আমরা অর্থনৈতিকভাবে কতোটা শক্তিশালী তার উপর। সেজন্য, এটা সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ যে সকল ভাবাদর্শ ভুলে যেতে হবে, সকল খুঁটিনাটি দ্বন্দ্ব ভুলে যেতে হবে। এই দেশের সামনে একমাত্র লক্ষ্য হতে হবে কিভাবে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে আরও শক্তিশালী করা যায়, সেটা মাঠে হোক, বা কারখানাগুলোতে, অধিক উৎপাদন এবং আয় করতে হবে। এটা কোন বিষয় না যে কে পণ্য উৎপাদন করছে এবং কিভাবে করছে। যেটা বিষয় সেটা হলো পণ্য অবশ্যই উৎপাদিত হতে হবে; অধিকতর পণ্য এবং সেবা উৎপাদিত হতে হবে সেটা মাঠে হোক বা কারখানায়। এবং সেজন্য আমি আপনার মাধ্যমে, জনাব, সরকারের কাছে আবেদন করবো সেসব ছোটখাটো বিষয় ভুলে যেতে যা অতীতে সরকারের চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো, বরং সরকারের ও জনগণের সকল কর্মক্ষমতা সব রকমের উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিয়োগ করতে যাতে অর্থনৈতিকভাবে আমরা শক্তিশালী হতে পারি, যাতে একটি মজবুত অর্থনীতি আমাদের সামরিক বাহিনিগুলোকে প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত সমর্থন দিতে পারে এবং এটা আমাদের বিজয়ের দিকে নিয়ে যাবে।
শেষ যে বিষয়টা আমি বলতে চাই তা হলো সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষেরা খুবই ন্যায্যত ও যথাযথভাবে আশা করছে যে সরকার অতি শীঘ্রই জরুরী ঝুঁকি বীমা ঘোষণা করবে যাতে শত্রুর যেকোনো কাযে বা নাশকতায় সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি সমগ্র ভারতের জনগণ বহন করবে এবং এর ধকল শুধুমাত্র সীমান্তবর্তী অঞ্চলে যারা বসবাস করে তারাই যাতে শুধু বহন না করে। এটা সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের বেশ কিছুকাল ধরেই চলে আসা সনির্বন্ধ দাবি এবং যেহেতু এখন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে, আমি আশা করবো সরকার জরুরী ঝুঁকি বীমা ঘোষণা করতে দেরি করবে না যেমনটা কিছুকাল আগেও যখন দেশে এরকম জরুরী পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলো।
সভাপতি সাহেব ঃ শ্রী দেশাই
শ্রী দেবদত্ত পুরি (হরিয়ানা)ঃ জনাব, এই বিষয়ে ইতোমধ্যে ভোটাভুটি হয়েছে এবং একটা বা দুইটা বক্তৃতাও ……
(ব্যাঘাত)
জনাব সভাপতি ঃ দলগুলোর কয়েকজন সদস্য ইতোমধ্যে বলে ফেলেছেন।
শ্রী কে চন্দ্রশেখর(কেরালা) ঃ জনাব, যখন আপনি কয়েকজনকে আলোচনায় অংশ নেতে দেবেন, তখন আপনাকে বাকিদেরও বলার বলতে দিতে হবে। নতুবা আপনার উচিত কাউকেই অনুমতি না দেওয়া।
জনাব সভাপতি ঃ আমি এটা বলিনি, আমি ‘অনুমতি’ দিচ্ছি না। আমি আপনাকে আবেদনটি বিবেচনা করার অনুরোধ করছি; আমি বাকি সদস্যদেরকেও এই অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনাকে অন্য সদস্যদের ইচ্ছাও বিবেচনা করতে হবে। আমি কখনোই বলিনি, ” আমি মঞ্জুর করবো না “।
শ্রী দেব দত্ত পুরি ঃ এই দিক হতে আমি সদস্যদের কাছে আবেদন করবো যে এটা একটা অনেক পবিত্র উৎসব।
শ্রী কে চন্দ্রশেখরন ঃ আমি অবশ্য আপনার উদ্দেশ্যে বলছিলাম না জনাব, বরং তার উদ্দেশ্যে
বলছিলাম। সংসদীয় বিষয়াবলী বিভাগের এবং নৌ-পরিবহন ও যাতায়াত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী (শ্রীওম মেহতা)ঃ আমি শুধু এটাই বলবো যে এটা যেন সংক্ষিপ্ত হয়।
জনাব সভাপতি ঃ জনাব সারদেশাই, আপনি কি বলতে চান? আমি আপনাকে ডেকেছিলাম।
শ্রী এস জি শ্রীদেশাই(মহারাষ্ট্র) ঃ আমি শুনিনি। জনাব সভাপতি এই আইনসভা ইতোমধ্যে সর্বসম্মতিক্রমে সরকারকে সম্মতি জানিয়েছে যুদ্ধে লড়ার ব্যাপারে যা আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। যদিও আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তবু আমরা চাই আমাদের উদ্দেশ্য হাসিল না হওয়া পর্যন্ত আমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবো। লক্ষ্যের প্রতি অবশ্যই আমাদের সম্পূর্ণ পরিষ্কার থাকতে হবে। সেই লক্ষ্যের একটা অবশ্যই বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং দ্বিতীয়টা হলো আমাদের আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং নিরাপত্তার পুর্ণাঙ্গ প্রতিরক্ষা। এগুলোই মুল লক্ষ্য। আমি এগুলো বলছি কারণ যখন আমরা আমাদের লক্ষ্যের ব্যাপারে সাম্নের দিনগুলোতে সম্পূর্ণরূপে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকবো, কিছু ধারনা সামনে প্রকট হতে পারে এবং আজ আমাদের সম্পূর্ণরূপে সতর্ক থাকতে হবে আমাদের লক্ষ্যের বিষয়ে কারণ যুদ্ধ খুবই কঠিন হবে। আমরা নিশ্চিত যে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সরকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও আজাদি মেনে নিতে বাধ্য হবার আগ পর্যন্ত আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে, আমি সতর্কতার সাথে আরেকটা কথা বলতে চাই। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের কোনও অংশ সম্পূর্ণরূপে দখলের জন্য যুদ্ধ করছি না।
এই বিষয়ে পরিষ্কার থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ, জনাব, এখানে উপস্থিত সবাই এটা বলেছেন এবং আমি সম্পূর্ণরূপে সম্মত যে আমাদেরকে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে। আমাদেরএমন কোনও ধারণা পোষণ করা উচিত নয় যাতে আমাদের সম্প্রীতি বজায় রাখতে অসুবিধা সৃষ্টি হয়। এই দফাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমি এখনি এই বিষয় বিশদ ব্যাখ্যায় যাচ্ছি না কারণ এই সংগ্রাম আমরা মাত্র শুরু করলাম। তথাপি শুরুর দিকে হলেও কয়েকটা বিষয় পরিষ্কার থাকা উচিত। কোন দয়া প্রদর্শন করা হবে না। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করবো যতক্ষণ পর্যন্ত না সামরিক জান্তা হার মানতে বাধ্য হয়। আমার আমাদের ক্ষমতা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহও নেই।
আমি আরও দুই-একটা কথা বলতে চাই কারণ এই বিষয়ে কিছুই বলা হয় নাই। আমরা এই জরুরী অবস্থাকে সবাই সমর্থন করছি। যখন আমরা বলছি যে জনগণের সম্পূর্ণ ক্ষমতাই একটা মহৎউদ্দেশ্যে প্রয়োগ করা হচ্ছে, তখন এটার সঙ্গে অর্থনীতির প্রশ্ন, উৎপাদন অব্যাহত রাখার প্রশ্ন, নিত্য-ব্যবহার্য জিনিসপত্রের বণ্টনের প্রশ্নও জড়িত থাকে। তাই এটা একটা লালনপালনেরও প্রশ্ন যা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই এবং একথা বলতেও আমার কোনও দ্বিধা নেই যে ভারতীয় শ্রমিক শ্রেণীর একটা ভূমিকা আছে এবং তারা সেটা পালন করবে। এই বিষয়ে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। কিন্তু অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে যখনি আমাদের জাতি বিপদের সম্মুখীন, যখনি আমরা সঙ্কটাপন্ন, শ্রমিক শ্রেণি কখনোই বেঈমানি করে না। দুঃখজনকভাবে, আমরা সবাই জানি যে এখানে মুনাফাভোগীরা আছে, সেইসব গুপ্তচরেরা যারা দেশের অর্থনীতিকে মুক্তিপণ বানিয়ে তার সুবিধা নেয়। এখন অবশ্যই আমি আবেদন করবো সরকারের দৃষ্টির প্রতি যাতে তারা কঠোরহস্তে শক্তভাবে সমস্ত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পারে যারা এই জাতীয় সমস্যাকে শোষণ করে নিজেদের সুবিধার্থে কাজে লাগাতে চায় তাদের বিরুদ্ধে।
আমি এই বিষয়ে আরও এক ধাপ এগোতে চাই, এবং সেটা হচ্ছে জনগণের নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন। অনেক সময় দেখা যায় একটা সার্বজনিন পদক্ষেপ নেওয়া হয় যারা একত্রে সংগ্রহ করে বা বৈঠক ডাকে তাদের বিরুদ্ধে, কারণ জাতি বিপদের সম্মুখীন। এরকম যেন অবশ্যই না হয়। আমি এটা একদম পরিষ্কার করে বলতে চাই যে সকল প্রহসন যা আমাদের নিরাপত্তার জন্য প্রকৃতপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ এবং যারা দেশের ভেতরে সৈন্য সমাবেশ করে যেতে চায়; আমাদের দেশের নিরাপত্তাকে জোরদার করতে চায় তাদের তা করার অনুমতি দেওয়া হোক কারণ ব্যাপক পরিমানে গণশিক্ষা দরকার। এটা একটা নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন। যদি সেখানে বিন্দুমাত্র ভয় থাকে যে কেউ বাধার সৃষ্টি করছে জনগণের ঐক্য, সাম্প্রদায়িক সম্প্রিতি ইত্যাদিতে, এগুলা যেন দমন করা হয়। কিন্তু বাকিদের জন্য, জনগণের গনতান্ত্রিক অধিকারকে সংহত করা এবং যুদ্ধের পক্ষে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ অবশ্যই সহায়ক হবে, এবং আমি আশা করবো ও আবেদন করবো সরকারের কাছে এবং আমি তাদেরকে দৃঢ়ভাবেজিজ্ঞাসা করবো যে অর্থনীতিকে চালু রাখার যে সম্পূর্ণ প্রশ্ন, নাগরিক অধিকারের যে সম্পূর্ণ প্রশ্ন তার প্রতি এমনভাবে অগ্রসর হতে হবে যেন আমাদের প্রতিরক্ষা দৃঢ়তর হয়। যারা আমাদের প্রতিরক্ষাকে দুর্বল করে, তাদের বিরুদ্ধে যেন ব্যবস্থা নেওয়া হয়। আমাদের এই দুইটি বিষয়ে পরিষ্কার থাকতে হবে। আমি আশা করবো যে এটা খেয়ালে থাকবে।
শ্রী থিল্লাই ভিল্লালান (তামিল নাড়ু) ঃ জনাব, আমরা ইতোমধ্যে আমাদের দলের পক্ষ হতে এই সরকারের প্রতি ঐকান্তিক সমর্থন জানিয়েছি। এটা কাজের সময়, কথার সময় নয়। এটা সেই সময় যখন একতা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
আমরা কখনোই যুদ্ধে প্রবিষ্ট হই না। কিন্তু আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হলে আমরা ছেড়ে দিবো না। আমরা যদি সবাই মিলে ভ্রুকুটি দিয়ে তাকাই সেটা পুরো পাকিস্তানকে জ্বালিয়ে দিবে। আমরা একসাথে শ্বাস নিলে সেটা একটা ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি করবে এবং সেটা পাকিস্তানকে কোন অজানা সাগরে নিক্ষেপ করবে। আমরা সবাই পাকিস্তানের বিপক্ষে একসাথে থুথু ফেললে তা অবশ্যই পাকিস্তানে এক বন্যার সৃষ্টি করবে এবং বিশ্বের মানচিত্রে পাকিস্তান বলে কিছু থাকবে না। তাই এই মুহূর্তে আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন কেবল একতা। তাই, আমি সকলের কাছে নিবেদন করবো যে একত্র হোন এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করুন। এই কথাগুলোর সাথে জরুরী অবস্থা ঘোষণাকে স্বাগত জানাই।
শ্রী কে চন্দ্রশেখরন ঃ জনাব সভাপতি, জনাব, এটা উদ্বেগের সময় নয়, যদিও আমরা অনেক বিপদের মাঝে আছি। স্বাধীনতার পরে এটা চতুর্থ ঘটনা – তিনবার পাকিস্তান দ্বারা ও একবার চীন দ্বারা -আমাদের দেশের স্বার্থ বিপন্ন হয়েছে। এবং পূর্বের মতই, আমার কোন সন্দেহ নেই যে এই দেশ অবশ্যই দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ হবে এবং পদক্ষেপ নেবে যাতে আমরা স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এই পরিস্থিতিমোকাবেলা করতে পারি।
স্যার এই জরুরী অবস্থার মধ্যেও সংসদ একটি চূরান্ত ভূমিকা পেয়েছে। সরকারের অবশ্যই দেখাঁ উচিত, সংসদ যে কোন পরামর্শ প্রদানে তার করনীয় দায়িত্ব পালনে সক্ষম আছে কিনা, এবং সরকার কর্তৃক প্রদত্ত দায়িত্ব পালনে অস্বীকার করছে কিনা। একজন সম্মানিত সংসদ সদস্যের কাছ থেকে আমি শুনেছি যে, জাতীয় সরকার গঠনের সম্ভবত একটি চাহিদা আছে। আমি একমত নই। স্যার আমি মনে করি না যে প্রকৃতপক্ষে জাতীয় সরকার গঠন করার কোন প্রয়োজনীয়তা আছে, স্বাধীনতার পর আজ আমাদের কাছে সবচেয়ে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার আছে, এবং সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী আছে। অতএব, সব শেষে, এখানে জাতীয় সরকার গঠন করার আসলেই কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
স্যার বিরোধী দলের নিশ্চতভাবেই দায়িত্ব ও কর্তব্য থাকবে। কয়েক মিনিট আগে আমরা কক্ষের প্রতিটি অংশে দেখেছি, সকল প্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলের নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন এবং আমাদের সামনের কঠিন সময়ে সরকারের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে তাদের সমর্থন ও অকুন্ঠ সহযোগিতা দিয়েছেন। কিন্তু স্যার বিরোধী দলকে অবশ্যি একটি গঠনগতভাবে জটিল পদ্ধতিতে এর দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। আমি তাই সরকারকে সতর্ক করতে চাই যে, যদি কোন ভুল হয় তাহলে এই দেশের বিরোধী দল অকপটে সেই ভুল সরকারকে দেখিয়ে দেবে এবং সরকারকে এই ভুল স্বীকার করতে হবে ও সেগুলো সুধরাতে হবে। এমন না যে সরকার কোন ভুল বা অসাবধানতা ছাড়া কাজ করতে পারে। সংসদ এবং সংসদের বাইরে গঠনমুলক বিরোধী দল হিসেবে বিরোধী দল গুলো ভবিষ্যতে তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারবে এবং যদি সরকার কোন ভুল করে তাহলে খেয়াল রাখবে যাতে সরকার সেটা সুধরায়। আমার মনে হয় সংসদে আগের চেয়ে আরো ঘন ঘন বসা উচিত। আমি আরো সুপারিশ করব যাতে বিশেষ করে প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা কমিটিকে একটি বিশিষ্ট ভুমিকা দেওয়া হয়। আমি এটাও সুপারিশ করব যে প্রতিরক্ষার সাংসদীয় উপদেষ্টা কমিটিকে উভয় সংসদীয় কক্ষের সকল দলের রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে অতিদ্রুত পুনর্গঠন করা উচিত।
মাননীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্যে যথার্থ ভাবে নির্দেশ করা হয়েছে যেটা তিনি আজ সকালেই বলেছেন, আমরা উৎপাদন দেখতে গিয়েছিলাম এবং এর ফলাফল বৃদ্ধি পেয়েছে এই জরুরী অবস্থার সময়ে। এই জরুরী অবস্থা চলাকালীন সময়ে আমাদের দেখতে হয়েছে, মূল্য বৃদ্ধির বদলে মূল্য স্থিতিশীলতা। এই সবের জন্য, দেশের শিল্পপতি ও ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে আন্তরিক সহযোগিতা প্রয়োজন। এবং সরকারের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং জরুরী ব্যাবস্থা নিয়ে দেখতে হবে যাতে দাম বৃদ্ধি না পায় এবং দেশে অবিরাম উৎপাদন অক্ষুন্ন থাকে। এমনকি, যদি আমরা পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জয়ী হই, আমরা দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে হারতে পারবো না যা আমাদের দেশের ভেতরে অনবরত চলছে। পরিকল্পনা কমিশন, পরিকল্পনা মন্ত্রনালয় এবং পরিকল্পনা মন্ত্রীকে আরো ভালো করায় মনোযোগী এবং কথায় আরো বেশি আন্তরিক হতে হবে ভবিষ্যতে এই দেশের উন্নয়নে পরিকল্পনার সামগ্রিক গঠনে এবং পরিকল্পনার সাফল্যের জন্য। এর সাথে, এই জরূরী অবস্থা চলাকালীন সময়ে আমি সরকারের কাজে আমার সহযোগিতার হাত আরো প্রসারিত করবো।
জনাব চেয়ারম্যানঃ জনাব শ্যাম লাল ইয়াদেভ- আমার তালিকার সর্ব শেষ বক্তা।
শ্রী শ্যামলাল যাদব( উত্তর প্রদেশ)ঃ সভাপতি মহোদয়, আজকের সংকট কালে সকল দল সরকারের সংগে রয়েছে, আমাদের দলের সভাপতি, চৌধুরী চরন সিংহ এর আগে পরিষদের বাইরেও একথা সুষ্পষ্ট ভাবে বলেছেন যে, এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলে আমাদের দেশের সৈন্যদের এরূপ প্রস্তুতি রয়েছে যে আমরা পাকিস্তানী আক্রমনের মোকাবেলা করতে পারব এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সুরক্ষিত করতে পারব। সকল দলের মাননীয় নেতৃবৃন্দ যেমণ বলেছেন, আমিও বলতে চাই, সরকারের আর একটি মুহুর্ত মাত্র বিলম্ব না করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া উচিত। এর ফলে যে অবস্থা বিরাজ করবে তাতে আমরা আমাদের সীমান্ত রক্ষ আকরতে পারব। আজ সকল বিরোধী দল সরকারের সহযোগীতা করতে প্রস্তুত, আমরা আশা করি, দেশের এই সংকট কালে সরকার ও সকল দলের সহযোগীতা গ্রহন করবেন।
সভাপতিঃ জনাব জগজীবন রাম, আপনি কি কিছু বলতে চান?
শ্রী জগজীবন রামঃ আমার বেশি কিছু বলার নেই। সংসদ ভালো মতই জানে কোন পরিস্থিতিতে এই জরুরী অবস্থা জারি করা হয়েছিলো। সংসদ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসমূহ, এবং তাদের নেতারা, এবং জাতি সমূহ জাতীয় নিরাপত্তা দিয়ে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে। আমি শুধু এটাই বলতে পারি, যে সমগ্র জাতি আজ সামরিক বাহিনীর পেছনে আছে তাদেরকে নতুন আস্থা দিয়ে, তাদের নতুন কর্মদক্ষতা দিয়ে, নতুন কার্যকরীতা দিয়ে। আমার কোন সন্দেহ নেই যে সামরিক বাহিনী জাতির প্রত্যাশা পূরন করবে এবং পাকিস্তানকে এমন শিক্ষা দিবে যা তারা সারা জীবন মনে রাখবে। সুতরাং আমি পরিষ্কার করে বলতে চাই পাকিস্তানের সীমানা বৃদ্ধিতে আমাদের কোন ইচ্ছা নেই..
শ্রী এ ডি মানী (মধ্য প্রদেশ)ঃ পাকিস্তানের জনগনের সাথে কোন প্রকার ঝগড়া নয়।
শ্রী জগজীবন রামঃ অবশ্যই আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন। এটাই সংকল্প এবং বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছা যা তারা নির্ভূল ভাবে নির্দেশ করে দিয়েছে শেষ নির্বাচনে। এবং আমি আবারো পরিষ্কার করে বলতে চাই যে পাকিস্তানের সীমানা বৃদ্ধিতে আমাদের কোন ইচ্ছা নেই…
ডঃ ভৈমহাবীরঃ কাশ্মির যুদ্ধ।
শ্রী জগজীবন রামঃ আমরা যা চাই তা হলো, পাকিস্তানের উচিত বন্ধু পূর্ন প্রতিবেশি হিসেবে থাকা এবং মূল্যবোধের লালন করা, যা বর্তমান সময়ে ভালো মানবিক মূল্যবোধ বলে মনে করা হয়, সেই মূল্যবোধ গুলো জাতিসংঘের সনদে উল্লেখ্য আছে, যা আমরা আমাদের নিজেদের সংবিধানে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, গনতন্ত্রের মূল্যবোধ, ধর্ম নিরপেক্ষতার মূল্যবোধ। এটাই আমরা চাই। এই যুদ্ধের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাদের সংবিধানে সন্নিবেশিত লালিত মূল্যবোধ রক্ষার জন্য হবে। এবং এই সংহতি আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে আরো সাহসী করবে, যা সংসদ ইতমধ্যে নির্দেশ করেছে যেমন টা আমি বলেছি, সংসদে তাই নির্দেশিত হয়েছে যে, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীকে সাহসী করা হবে, এবং তাদের উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য দক্ষতা বারাতে হবে।
সভাপতিঃ প্রশ্ন হচ্ছে…
“সংবিধানের ৩৫২ অনুচ্ছেদের দফা (১) অনুযায়ী, ৩রা ডিসেম্বর ১৯৭১ এ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক জারি কৃত জরুরী অবস্থার ঘোষনা সংসদে অনুমোদন”
প্রস্তাব গ্রহন করা হয়েছে
জনাব সভাপতিঃ সর্বসম্মতিক্রমে সমাধান গৃহীত হয়েছে।