You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.08.28 | বাংলাদেশের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গের জমিয়তে উলামার বক্তব্য | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১৭০। বাংলাদেশের সমর্থনে পশ্চিমবঙ্গের জমিয়তে উলামার বক্তব্য কম্পাস ২৮ আগস্ট ১৯৭১

বাংলাদেশ ও জমিয়ত উলামা

খিস্ত আওউয়াল চুম নেহাদ মেহ্মার কাঘ তা সুবাইয়া মীর রুয়াদ দিওঘারকাঘ, অর্থাৎ ভিত যার বাঁকা তার চুড়া আকাশচুম্বী হলেও বাঁকা থাকবেই – বলেছেন শেখ সাদি। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত পশ্চিম বঙ্গ জমিয়তে উলামার, কনভেনশনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি মওলানা মোহাম্মদ তাহের সাহেব বলেছেন ঃ গোঁড়ায় যার গলদ রহিয়াছে, তাহার শেষ শোধরানো সহজ নয়, সমাপ্তি তার সুন্দর হতে পারেনা। একথা মওলানা বলেছেন পাকিস্তানের জন্ম ও ইতিহাস মনে করে এবং তারই ভাষায়ঃ ‘একদা যে স্বার্থান্ধতা ও ক্ষমতা লিপ্সা সাম্প্রদায়িকতার নামে দেশ বিভাগ এবং পাকিস্তানের জন্ম দিয়েছিল, আজ সুদীর্ঘ ২৩ বৎসর যাবত পাকিস্তানের ইতিহাসে তাহা বারে বারে নগ্নভাবে আত্মপ্রকাশ করিয়াছে। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সেই উগ্র খমতালিপ্সা এবং স্বার্থপরতারই ক্রমপরিনতি’

সোনার বাংলা শ্মশান কেন?

… ‘ধর্মের নামে, ইসলামের নামে, দেশের ঐক্য সমৃদ্ধি এবং নিরাপত্তার নামেই এই শোষণ এবং অবিচার চলিয়াছে। অথচ যে পবিত্র ইসলাম এবং ধর্মেন্র নাম নিয়ে এই শোষণ সেই পবিত্র ইসলাম ধর্মে কিন্তু ইহার অবকাশ মাত্র নাই। ….প্রিয় নবী (দঃ) স্পষ্ট ভাষায় ঘোষনা করিয়াছেনঃ যে রাষ্ট্রনায়ক কিংবা সরকার তাহার প্রজা সাধারণের কল্যাণ প্রচেষ্টা করেন না, তাহাদের সঙ্গে বিষাসঘাতকতা করেন। নরকের আগুনেই তাহার নিশ্চিত ঠাই।

তাই প্রতিবাদ

রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ
অন্যায় যে করে, আর অন্যয় যে সহে
তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসমদহে।

তাহের সাহেব তাই হাদিস শরিফ উল্লেখ করে বলেনঃ অত্যাচার, অবিচার চুপ করিয়া সহ্য করিতে নাই, অত্যাচার অবিচারের ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় এবং নীরব দর্শকের ভূমিকা গ্রহণ করিতে নাই, ইহাতে সমগ্র সমাজের সর্বনাশ অবশ্যাম্ভাবি।

অত্যাচার অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষ কাপুরুষতা প্রদর্শন না করিয়া যাহাতে সৎ সাহসে আগাইয়া আসে তজ্জন্য উৎসাহ দান হুজুর (দঃ) ঘোষণা করিয়াছিলেনঃ ‘জালিম রাষ্ট্রনায়কের সম্মুখে সত্য কথা ঘোঘোনা শ্রেষ্ঠতম জেহাদ”।

তাই দেখা যায়, ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি হতে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নানাভাবে এবং জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রতিবাদের ঝড় এবং ঘোষিত বা অঘোষিত জেহাদ। আর শেষতঃ ২৩ বছর পড় সাধারণ নির্বাচনে বাংলাদেশের মানুষ রায় দিয়েছিল ছয় দফার পড়। শেখ মুজিব নেতৃত্ব হল এই দির্ঘ সংগ্রামের প্রতীক।

ইসলামাবাদ চক্র প্রতিনিধি জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশের ভাষাকে এবং রায়কে পদদলিত করবার প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে ‘সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের দলনায়কদের সঙ্গে পরামর্শমাত্র না করিয়া’ জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করে দিলেন। তাছাড়া ইয়াহিয়া শেষ মুজিবুরকে প্রধানমন্ত্রীত্বের টোপ দিয়া ছয় দফা দাবী হতে বিচ্যুত করিতে চেষ্টা করিলেন কিন্তু, ‘জাতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা না করিয়া তিনি স্পষ্ট জবাব দিলেনঃ জাতী আমাকে এবং আওয়ামীলীগকে প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য ভোট দেয় নাই, তাহারা ছয় দফা দাবীতেই ভোট দিয়াছে; আমি তাহা বিসর্জন দিয়া জাতির সঙ্গে বিশ্বাস ঘাতকতা করিতে পারিব না। ’

তাহের সাহেব তাই বললেনঃ ইহাতেই শোষকের আতে ঘা পড়ে; তাহারা ভাবে ব্রিটিশ সরকারকেও একদা যে অসহযোগ আন্দোলনের অস্ত্র শেষ পর্সন্ত ঘায়েল করিয়াছে, ভারতছাড়া করিয়াছে, শোষিত বাঙ্গালীরা যদি সেই অস্ত্র ব্যাবহার করে তবে আর রক্ষা নাই, ইহাতেও জোকের মুখে চুন পড়িবে…। অতএব সূচনাতেই সামাল দাও; এই শোষিত অবাধ্য বাঙ্গাল জাতিকে ডাণ্ডা মারিয়া ঠাণ্ডা করিয়া দাও। তাহাদের মেরুদণ্ড ভাঙ্গিয়া দাও। এবং বাঙ্গালী নিধনের নির্দেশ দিয়া ইয়াহিয়া ঢাকা হইতে করাচী যাত্রা করিলেন। ’

সবই চলে ধর্মের বাদে

ইসলাম ধর্ম —- রক্ষা নামেই ইয়াহিয়া সব কিছু করিতেছে। শিশু হত্যা, ধর্ষন, নিরপরাধ জনতা নিধন, বাঙ্গালী নিধনের নামেই সব চলিতেছে। ‘তাহারা মজলুমকে ঠাণ্ডা এবং জগতকে ধোঁকা দিবার জন্য একই সঙ্গে বন্দুকের গুলি এবং ধর্মের বুলি ব্যাবহার করতঃ মজলুমের শোণিত রক্তের হোলি খেলিতেছে। বাংলাদেশের সর্বত্র চলছে তাহাদের এই পৈশাচিক নৃত্য।

জেহাদ ও মুক্তিবাহিনী

প্রায় ২৩ বছর ধরে যে অব্যাক্ত জেহাদ চলে আসছিল তাই ২৫ মার্চের রাতে রূপ নিল ভিন্নভাবে।

ইয়াহিয়া খানের বিশ্বাসঘাতকতার ও বুলেটের গুলিতে পরিবেশে জন্ম নিল মুক্তিবাহিনী। বাধ্য হল মানুষ জবাব দিতে। তাহারা যে যেখানে পারল শোষক সরকারের জালেম সেনাদের প্রতিরোধে প্রয়াস পাইল — তাই তাহাদের প্রত্যুত্তরে সুসঙ্ঘবদ্ধ ছিল না। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ ছিলোনা; ক্রমে মাস দুই পড়ে তাহারা সুপরিকল্পিতভাবে তাহাদের অভিযান চালাইতে থাকে। ’

এই মুক্তিবাহিনীর উদ্যেশ্যে তাহের সাহেব হাদিস শরিফ হতে উল্লেখ করে বলেনঃ ‘নিজেদের প্রাণ, ধন-মান রক্ষায় যে নিহত হয় তাহার মৃত্যু শহীদের মৃত্যু। ’

এই কনভেনশনে সভাপতি হিসেবে আজাদ হিন্দ বাহিনীর জেনারেল শাহ নেওয়াজ খান, সাড়া ভারত জমিয়তে উলামার সাধারণ সম্পাদক সদস্য মাওলানা আসাদ মাদানি প্রভৃতিও একটি অইস্লামিক রাষ্ট্রের স্বরূপ নিয়ে যেমন বলেছেন, ঠিক তেমনি বাংলাদেশের সংগ্রামী জনসাধারণকেও অভিনন্দন জানান। আর সকলেই তাদের সাহেবের ‘অ্যামেরিকা, চিন প্রভৃতির নিজ স্বার্থে জালিম ইয়াহিয়া খান ও তার সরকারকে সাহায্য যদি দোষের না হয়, তবে নির্যাতিত মজলুম বাংলাদেশবাসির সাহায্য সহায়তায় হিন্দুস্তানের অপরাধ কি? উক্তির সমর্থনে নিজেদের কথাও বলেন।

শেষতঃ এই কনভেনশন প্রস্তাব গ্রহণ করে

১) নিশর্ত সমর্থন জানান বাংলাদেশের সংগ্রামকে; ২) ঘৃণা প্রকাশ করে ইসলামাবাদ চক্রের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিকে ৩) দাবী করে মুজিবের মুক্তি এবং ঐ সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন করে ইসলামাবাদ সামরিক চক্রের বিচার, এবং আশা প্রকাশ করে যে ভারত সরকার সময় মত স্বীকৃতি দেবে প্রজাতন্ত্রিক বাংলাদেশকে।