শিরোনাম | সুত্র | তারিখ |
১৬১। বিহার রাজ্যে বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতির জয়প্রকাশ নারায়ণের দাবীঃ অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হোক | ‘কম্পাস’ | ১৭ জুলাই, ১৯৭১ |
বাংলাদেশের স্বীকৃতি সম্পর্কে জয়প্রকাশ নারায়ণ
সম্প্রতি ৬ই জুলাই পাটনায় বিহার রাজ্যে বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতি কতৃক আয়োজিত এক জনসভায় দেশের সব রাজনৈতিক দল, শ্রমিক সংস্থা এবং স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান সমূহের উদ্দেশ্য সর্বোদয় নেতা শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ এই মর্মে আবেদন করেন যে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ সরকারের ওপর বিশেষ চাপ দেবার ব্যবস্থা করেন। বাংলাদেশ স্বীকৃতি পেলেই ঐ দেশের মুক্তিযোদ্ধের পক্ষে উপযুক্ত পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে ইয়াহিয়া খানের হানাদারী বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করা সহজ হয়ে উঠবে।
শ্রী নারায়ণ এই অভিমত প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া খানের সেনারা যে যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে তার ফলে ভারতকে এক ভীষন সংকটের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এই সংকটের মধ্যে দিয়েই ভারতকে প্রকৃত পরীক্ষা দিতে হবে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে। এই সংকটের মাঝেই ভারত সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ হবে অথবা তাকে ভাঙ্গনের মুখে দাঁড়াতে হবে। আজ বাংলাদেশ যে যুদ্ধ চলছে তার বোঝা ভারতকে বহন করতেই হবে। বাংলাদেশ পরাজিত হলে, পরিণামে ভারতকেও পরাজয় বরণ করতে হবে। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে, বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনগণের সঙ্গে ভারত সামিল হয়ে গেছে।
শ্রী নারায়ণ বলেন যে, পাকিস্তানের ওপর অন্যান্য রাষ্ট্রদের রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য ভারত অপেক্ষা করতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ যে রায় দিয়েছেন তার মর্যাদা ভারতকে দিতে হবে। পাকিস্তান বাংলাদেশে যে নিপীড়ন ও অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে তা থেকে সরে দাঁড়াবে না। আর তার নীতিরও পরিবর্তন ঘটাবে না। এমতাবস্থায় এক্ষুনিই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে হবে। আর অস্ত্রশস্ত্রের যোগান দিতে হবে। ভারতের স্বার্থেই এ কাজটা করতে হবে। কারণ বাংলাদেশ থেকে যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে, তাঁদের আগমনের ফলে এদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নানা রকমের জটিল সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে বাংলাদেশে সামরিক অভিযান চালাতে গিয়ে পাকিস্তানের সামরিক চক্র যে টাকা খরচ করছেন, তার চাইতে তিন চারগুণ বেশী টাকা খরচ করতে হচ্ছে ভারতকে বিনা যুদ্ধেই। যদি কেউ মনে করেন যে যুদ্ধ চলতে থাকলে পাকিস্তানের কাঠামো ভেঙ্গে পড়বে, তাহলে তিনি ভুল করবেন। পাকিস্তানের অর্থনীতি বানচাল হয়ে যাওয়ার জন্য আরো দু’ডিভিসন সৈন্য সংগ্রহ করছে।
তিনি আরো বলেন যে, বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে, তাকে বাইরে থেকে মনে হবে গৃহযুদ্ধ। কিন্তু বাস্তবে এ যুদ্ধ গৃহযুদ্ধ নত। এ যুদ্ধকে সাম্রজ্যবাদী একটা জাতীয় সঙ্গে একটি মুক্তিকামী ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রের জনগণের যুদ্ধ হিসেবে গণ্য করা উচিত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বার্তা বহন করে তিনি এটা উপলব্ধি করেছেন যে, বাংলাদেশের ব্যাপারে বিদেশে পাকিস্তানী সামরিক চক্রের ভারত বিরোধী প্রচারকার্য ব্যর্থ হয়েছে। পাকিস্তান বিদেশে এরকম একটা সৃষ্টি করতে চেয়েছিলো যে পাকিস্তানে বাংলাদেশকে নিয়ে যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে, তার মূলে আছে ভারত। অবশ্য পাকিস্তানের এরকম ধারণা সৃষ্টির চেষ্টা সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছে। তবে বাংলাদেশের সমস্যাবলী নিয়ে বিশ্বের দুটি রাষ্ট্র অর্থাৎ আমেরিকা ও ফ্রান্স অদ্ভুত দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তাঁকে এই মর্মে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলো যে পাকিস্তানকে আরো অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করা হবে না। কিন্তু পরবর্তী দেখা গেলো, যুক্তরাষ্ট্র সরকার পাকিস্তানে আরো ছ’সাত জাহাজ বোঝাই অস্ত্রশস্ত্র পাঠিয়েছে। ফ্রান্স সরাসরি পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র না পাঠালেও, সেখানে খোলাবাজারে পাকিস্তানের জনগণের কাছে অস্ত্রশস্ত্র বিক্রি করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক (এইড টু পাকিস্তান) কমিটি সাহায্য দেওয়া বন্ধ রাখলেও, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি বলে পাকিস্তান সাহায্য পেতে থাকবেই।
এখন ভারতের প্রায় ৭০ লক্ষ শরণার্থী এসেছে বাংলাদেশ থেকে। অদূর ভবিষ্যতে এই সংখ্যা এক কোটিতে দাঁড়াবে। পাকিস্তান এমন একটা কৌশল অবলম্বন করতে চাইছে যার ফলে এদেশে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্য্যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। এ ব্যাপারে ভারতকে সতর্ক থাকতে হবে। যদি ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যায়, তাহলে পাকিস্তানের হাত বাংলাদেশে আরও শক্ত হবে এবং পরিণামে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রাম বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে। কিছুকাল আগে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন সময় এলেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হবে। এখন প্রশ্ন হলো, সে সময় আসবে কবে? বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি করা হলে, ভারতের সমস্যাবলী আরও জটিল হয়ে পড়বে। অথচ, এটা ঠিক যে একদিন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতেই হবে। বাংলাদেশকে এক্ষুনি স্বীকৃতি না দিলে আমাদের জাতীয় স্বার্থের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে। আর সারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় শান্তি বিঘ্নিত ও বিপন্ন হবে। এ জন্য যদি যুদ্ধ আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, আমাদের অবশ্যই যুদ্ধ করতে হবে।
বিহার রাজ্য বাংলাদেশ সম্মেলন সমিতির ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন রাজ্যপাল শ্রী দেবকান্ত বড়ুয়া। শ্রী বড়ুয়া বলেন যে, ভারত পাকিস্তানের একনায়কতন্ত্রের বিরোধী। আজ বাংলাদেশে যে কায়দায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হচ্ছে, ঠিক সে কায়দায় একদিন হিটলার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিলেন। কিন্তু ইতিহাস এই সাক্ষ্য বহন করেছে যে, পাশবিক কার্যাবলী কখনোই পরিণামে টিকে থাকে না। এর অন্যথা হলে, হিটলার অবশ্যই চুড়ান্ত পর্যায়ে সফলকাম হতেন।
তিনি আরও বলেন যে, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামীদের ও দুর্গত শরণার্থীদের সাহায্য দেওয়ার জন্য এ পর্যন্ত বিহারের জনগণ ২৭ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করেছে। এ দেখেই বুঝা যায় বিহারের আপামর জনসাধারণ বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রাম সম্পর্কে কী সহানুভূতিশীল মনোভাব গ্রহণ করেছেন। বিহারের আধিবাসীগণ বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা সংগ্রহ করার এক কর্মসূচী নিয়েছে।
সারা ভারত এস.এস.পি দলের সভাপতি শ্রী কর্পুরী ঠাকুরও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে ভাষণ দেন।
বাংলাদেশের চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ডঃ এ. কে. মল্লিক বলেন, বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে বিহারের জনগণ যে ভূমিকা করেছেন তা কোনোদিনই বাংলাদেশের মানুষ ভুলবে না। তিনি আরও বলেন যে বাংলাদেশের মানুষ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার চেয়েছিলেন পাকিস্তান থেকে বিছিন্ন পাকিস্তান হয়ে যেতে চায়নি। স্বায়ত্তশাসনের যে দাবী বাংলাদেশের মানুষরা করেছিলেন, সেই অপরাধে ২৫শে মার্চের মধ্য রাত্র থেকে পাকিস্তানি সামরিক চক্র নিরস্ত্র ও নিরীহ জনসাধারণের ওপর হত্যার অভিযান শুরু করে দেয় এবং এই হত্যাকাণ্ডই শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ নামে এক নতুন রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। বাংলাদেশে বাংগালী হিন্দুদের মধ্যে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে পাকিস্তানী কতৃপক্ষ যে কৌশল অবলম্বন করেছেন, তার মূল লক্ষ্য হলো ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করে দেওয়া। এ সম্পর্কে ভারতের জনগণকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে।
ডঃ মল্লিক আরও বলেন যে, বাংলাদেশে বাঙ্গালি হিন্দু ও বাঙ্গালি মধ্যে কোনো শক্তিই ফাটল ধরাতে পারবে না। শেষ পর্যন্ত বাংলার মুক্তিকামী মানুষ জয়ী হবেই। এটা মনে রাখা প্রয়োজন যে বাংলাদেশে এখন যে যুদ্ধ চলছে তা হলো গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার যুদ্ধ। এমতাবস্থায় গণতান্ত্রিক ভারতের জনগণ যদি বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তাহলে বাংলাদেশের মুক্তি আরও ত্বরান্বিত হবে।