চরম অর্থনেতিক সংকট সেনাবাহিনীতে অন্তর্দ্বন্দ-মুক্তিবাহিনীর দুর্বার সাফল্যে সুনিশ্চিত পরাজয়ের মুখে বর্বর খুনী পাক হানাদারবাহিনী
(ভাষ্যকার)। সুদীর্ঘ সাত মাস ধরে বাঙলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। যতই দিন যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ তত বেশী জোরদার হচ্ছে অন্যদিকে জঙ্গীশাহীর পতনের দিনও ঘনিয়ে আসছে। রাজাকার বাহিনী বিপুল সংখ্যায় অস্ত্রশস্ত্র সমেত মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে। বিশ্বের দরবারে ইয়াহিয়া খাঁর মিথ্যার বেসতি আর চলছে না। এমতাবস্থায় বাঙালী জাতির বিজয় রুখতে পারে এমন সাধ্য শুধু ইয়াহিয়াশাহী কেন বিশ্বের কোন শক্তিরই নেই। জঙ্গীশাহীর পতন যে অবশ্যম্ভাবী সে ব্যাপারে কারুরই আজ সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। | জঙ্গীশাহীর পতনের কারণগুলাে পর্যালােচনা করলে প্রথমেই অর্থনৈতিক অবস্থাটা সম্পর্কে কিছুটা | বলা দরকার। চরম অর্থনৈতিক সংকট। পাকিস্তানের অর্থনীতিতে এখন চরম সংকট দেখা দিয়েছে। এর প্রধান কারণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রয়েছে। পাকিস্তানের প্রধান অর্থকারী ফসল হচ্ছে পাট। এই পাটচাষ এখন কোনভাবেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হবার সাথে সাথেই কৃষক সমাজকে অনুরােধ জানিয়ে বলেছিলেন যে তারা যেন পাট চাষ বন্ধ রাখেন। অন্যদিকে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করার অনুরােধ জানালে বাংলার কৃষক সমাজ পাটের জমিতে মই চরিয়ে সেখানে ধান চাষ শুরু করেন। ফলে পাট চাষ এ মরশুমে একেবারেই হয়নি। জঙ্গীশাহী ২৫শে মার্চ নিরস্ত্র জনতার ঝাপিয়ে পড়ার পর গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার। করে দেয়। এই জ্বালানাে পােড়ানাের সময় মগজবিহীন মিলিটারীগুলাে বেশীরভাগ চা বাগানও পুড়িয়ে দেয়। ফলে চা থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসতাে সেটাও আর জঙ্গীশাহীর পক্ষে অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে ।
এসব ছাড়াও বাংলাদেশে সবগুলাে কলকারখানায়ই এখন বড় বড় তালা ঝুলছে। নান কায়দায় তােষামােদ চালিয়েও কোন শ্রমিককেই কাজে যােগদান করানাে জঙ্গীশাহীর পক্ষে আজ কোনভাবেই সম্ভব হচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বন্ধ হওয়ায় জঙ্গীশাহী ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বার বার বিভিন্ন রাষ্ট্রের দুয়ারে ধর্না দিচ্ছে। কিন্তু সবগুলাে রাষ্ট্রই এখন পাকিস্তানকে সাহায্য দেয়া স্থগিত রেখেছেন। ফ্রান্সের কতিপয় নামজাদা লেখক যারা এবার নভেল পুরস্কারও পেয়েছেন তারা সম্প্রতি তাদের সরকারকেও সাহায্যদান বন্ধ রাখার জন্য আবেদন জানান। মার্কিন সিনেটেও সাহায্যদান সম্পর্কে অনেক বাক বিতণ্ডা হওয়ায় মার্কিন সাহায্য সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। ফলে জঙ্গীশাহী এখন মহাফাপরে পড়েছে। সেনাবাহিনীতে অন্তর্দ্বন্দ্ব জঙ্গীশাহীর যখন এই না ঘরকা না ঘাটকা অবস্থা ঠিক সেই সময়ে মুক্তি বাহিনী দুর্বার বেগে একের পর এক মুক্তাঞ্চল তৈরী করে এগিয়ে চলেছেন। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে বহু খানসেনা খতম ও জখম হয়ে চলেছে। এ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা প্রায় কুড়ি হাজারের মত খানসেনাকে খতম করেছেন। রাজাকার বাহিনীও বিপুল সংখ্যায় অস্ত্রশস্ত্র সমেত আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। ফলে বাংলাদেশে জঙ্গীশাহীর পরের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। এই পরাজয়ে পাকসেনাবাহিনীর মধ্যেও ভাঙন শুরু হয়েছে। সম্প্রতি খানশাহীর এক গােপন দলিল বাংলাদেশ সরকারের হস্তগত হয়েছে। ঐ দলিলে লেফট্যানেন্ট নিয়াজীর একটি উক্তি থেকেও তাদের নিজেদের অবস্থার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়। নিয়াজী বলেছে যে তারা নাকি ইজ্জত রক্ষার জন্যে যুদ্ধ করছে। এদিকে রাও ফরমান আলীও বলেছে *We are fighting for a lost battle” জেনারেলদের মধ্যেও পুরােপুরি দুটো দল হয়ে গেছে।
একটি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছে জেনারেল হামিদ এবং অপরটি টিক্কাও নিয়াজীর নেতৃত্বে। ইয়াহিয়া ভুট্টোর কামড়াকামড়ি এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানেও জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ আস্তে আস্তে ঘনীভূত হচ্ছে। ইয়াহিয়া খা ভূট্টোর। কাধে ভর দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের উপর ঝাপিয়ে পড়লেও এখন তাদের নিজেদের মধ্যেই ক্ষমতা। নিয়ে কামড়াকামড়ি শুরু হয়েছে। ইয়াহিয়ার ইচ্ছা বিভিন্ন দলের সমন্বয়ে একটা সরকার গঠিত হউক। কিন্তু ভূট্টো নিজেই সরকার গঠন করার পক্ষপাতী। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন নিয়ে বহুবার ইয়াহিয়া সবগুলাে দলকে নিয়ে আলােচনায় বসেছে। কিন্তু আলােচনা এক ধাপ এগিয়ে আবার পরমুহুর্তেই তিন ধাপ পিছিয়ে গেছে। ফলে শাসনতন্ত্র প্রনয়নে এখন সাংঘাতিক অচল অবস্থা বিরাজ করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণও গণতন্ত্র পুনঃ প্রতিষ্ঠিা না হওয়ায় নতুন করে আন্দোলনে নামবার কথাও চিন্তা করছেন। ইয়াহিয়া ভূট্টোর ভাওতাবাজিও জনগণের কাছে ধরা পড়ে যাচ্ছে। যার ফলশ্রুতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যতম নেতা ওয়ালি খানের নেতৃত্বে শুরু হয়েছে পাখতুনিস্তান আন্দোলন। বেলুচিস্তান সীমান্তে নতুন করে আন্দোলন শুরু হওয়ায় ইয়াহিয়ার খাঁ এখন আরাে মরিয়া হয়ে উঠেছে। পাকশাহী মরিয়া তাই সে ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু করার জন্যে ভারত সীমান্তে প্রচুর পরিমাণে সৈন্য সমাবেশ করেছে। প্রত্যহই সে ভারতের ভুখণ্ডে গুলিগােলা ছুড়ছে। ভারত অবশ্য স্পষ্টই বলে দিয়েছেন যে এবার পাকিস্তানকে দাতভাঙা জবাব দেয়া হবে এবং যেসব এলাকা দখল করা হবে সেসব আর ছেড়ে দেয়া হবে না।
ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধলে বাংলাদেশ তাে স্বাধীন হবেই উপরন্তু পশ্চিম পাকিস্তানও ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে হয়ে যাবে। এই অবস্থা আশংকা করে ইয়াহিয়া খা রাষ্ট্রসংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথান্টের কাছে এক আরজি পেশ করেছে। উথান্টের কাছে আরজিতে বলেছে যে ভারত পাক সীমান্তে যেন রাষ্ট্র সংঘ। পর্যবেক্ষক পাঠানাে হয়। অথচ এই কিছুদিন আগেও ইয়াহিয়া খা রাষ্ট্রসংঘের কথায় কোন কর্ণপাতই করেনি। মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েই ইয়াহিয়া খা সব কাজগুলাে করছে। এখানে একটা কথা বলা দরকার যে সবাই হয়ত লক্ষ্য করে থাকবেন যে খুনী ইয়াহিয়া খাঁর হুংকার বেশ কদিন ধরেই বড় একটা শােনা যাচ্ছে না। তার গলায় সুরও কিছুটা নরম হয়ে এসেছে। নিশ্চিন্ত পরাজয়ের কথা চিন্তা করেই সম্ভবতঃ তার নরম সুর। ঘটনাপ্রবাহ থেকে একটি কথাই স্পষ্ট যে জঙ্গীশাহীর পরাজয় ঠেকাতে পারে এমন সাধ্য পৃথিবীর আজ কোন শক্তিরই নেই। ইয়াহিয়ার পরাজয় যেমন সত্য-বাংগালি জাতির বিজয়ও অনুরূপ ভাবেই সত্য। বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠা পাবেই পাবে।
দাবানল।১: ৪।
৩১ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৯