You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.30 | সীমান্তের চারদিক থেকে | আনন্দবাজার পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

সীমান্তের চারদিক থেকে

আমাদের স্টাফ রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি, নিজস্ব সংবাদদাতা স্বাধীন বাংলাদেশের নানা সীমান্ত থেকে অজস্র সংবাদ পাঠাচ্ছেন ওখানকার মুক্তিযুদ্ধের। সব মিলিয়ে একসঙ্গে তা প্রকাশিত হল সংক্ষেপে। সব সংবাদেরই বক্তব্য, পাক ফৌজ ভেঙ্গে পড়ছে, মুক্তিফৌজ দখল করে চলেছে একের পর এক এলাকা।

গেদে থেকেঃ কুষ্টিয়ার লড়াই-এ মুক্তিফৌজকে সাহায্যে জন্য হাজারে হাজারে অসামরিক নাগরিক পদ্মা পার হয়ে কুষ্টিয়ার দিক থেকে ছুটে যান। হারডিঞ্জ সেতু পার হবার সময় শক্র বাহিনী বোমারু বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করে। বোমায় সেতুর একাংশ বিধ্বস্ত হয় এবং শতখানেক স্বাধীনতা সংগ্রামী প্রাণ হারান।

পাবনায় শক্রবাহিনী ওই একই নারকীয় দৃশ্য তৈরী করেছে। তবে রক্ত দিয়ে তাদের মূল্য দিতে হয়েছে। শেষ শক্রুসৈন্যও জনতার রোষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

মুক্তিফৌজের কমান্ডার ভারতের জনগণকে তাঁর অভিনন্দন জানিয়েছেন। তিনি বলেন, রংপুর আমাদের মুক্তিফোজের দখলে এসেছে।

খুলনায় নারী ও শিশুদের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যে বর্বর, অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে- মুক্তি ফৌজের নেতা বার বার তার উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন, রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে, আমরা তা জানি। কিন্তু আমাদের মা-বোন, ছেলেমেয়েদের উপর নৃশংস অত্যাচার চলতে-তা আমরা ভাবতে পারিনি।

মেখলিগঞ্জ থেকেঃ বাংলাদেশের রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ এবং বগুড়া শহরে দখলদার পাকিস্তানী ফৌজ ও বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর মধ্যে প্রতি মহল্লায় তুমুল লড়াই চলছে।

দখলদার বাহিনী রংপুর শহরে ট্যাঙ্ক নামিয়েছে। দিনাজপুর ও রংপুর জেলা শাসক ও পুলিশ সুপারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অপরদিকে মুক্তি ফৌজ পচাগড়ে অবরুদ্ধ কোম্পানী পাকিস্তানী ফৌজকে পর্যুদস্ত করে অস্ত্রশস্ত্র কেড়ে নিয়েছে এবং এই লড়াইয়ে অধিকাংশ পাকিস্তানী ফৌজ নিহত হয়েছে। রংপুর ও দিনাজপুর জেলার সীমান্ত ফাঁড়ি এখনও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ন্ত্রণে। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানী ফৌজকে পরাজিত করে রাজশাহী শহরকে মুক্ত করেছে।

ইতিমধ্যে এপার বাংলার কাছে ওপার বাংলার তরুন ছাত্রদের আর্ত আবেদনঃ আমাদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করুন। হলদিবাড়ি সীমান্তে গতকাল চারজন চাথ্রপ্রতিনিধি আসেন অস্ত্র সংগ্রহেনর জন্য।

দিনাজপুর শহরে মুক্তিফৌজের শক্তিবৃদ্ধির জন্য সীমান্ত বাঙালি ইপিআর সীমান্ত চৌকি ছেড়ে চলে গিয়েছে। দিনাজপুরের পথে পথে পশ্চিম ফৌজ প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন। ঘোড়াঘাট ও হিলির পশ্চিমী ফৌজের একটি ট্রাক রাস্তার উপর একটি গর্তে পড়ে উলটে যায়। প্রচুর ফৌজ আহত হয়। হিলি এলাকায় ভারত-পাক সীমান্তের কাছে দুটি অবাঙালি পশ্চিত ফৌজের মৃতদেহ দেখা গিয়েছে। দুজন পশ্চিমী ফৌজ প্রাণভয়ে ভারতের এলাকায় ঢুকে পড়ে। তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

সোমবার মুক্তিফৌজের তাড়া খেয়ে প্রায় ২০ জন পশ্চিম পাকিস্তানী সপরিবারে হিলি সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পড়ে। এরা ভারতীয় রক্ষী বাহিনীর নিকট আত্নসমর্পন করেছে।

অন্যদিকে পশ্চিম দিনাজপুরের দিক থেকে আওয়ামী লীগের দুজন বিশিষ্ট নেতাও এপার আসেন। জলপাইগুড়ি শহরে এরা পৌঁছালে তাদের বিপুল সম্বর্ধনা জানানো হয়।

পাকিস্তানী জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা মুহম্মদ আবিদ আলী বাংলাদেশে অবিলম্বে সাহায্যের জন্য আর্ত আবেদন জানিয়েছেন।

হাসনাবাদ থেকেঃ সোমবার দুপুরে সাতক্ষীরা সীমান্তে খবর সাতক্ষীরা আদালত ভবন থেকে ক্রুদ্ধ জনতা পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। সাতক্ষীরা পাঞ্জাবী মহকুমা শাসককে জনতা স্বগৃহে অন্তরীণ করে রেখেছে।

সীমান্ত আজ মুছে একাকার হয়ে গেছে। এপার বাংলা থেকে দলে দলে মানুষ এসে সীমানার এপারে দাঁড়াচ্ছে। ওপারের মানুষ এসে দাঁড়াচ্ছে মুখোমুখি। আজ আর কেউ কারও কাছে অপরিচিত নয়।

সোমবার সীমান্ত পার হয়ে অনেকখানি ঢুকে গিয়েছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। কথা হল বহু মানুষের সঙ্গে। সকলের মুখে এক কথা, শত্রুর মোকাবিলা করার জন্য আমাদের অস্ত্র দিন।

অস্ত্র আর অস্ত্র। ওপার বাংলার মানুষ এপার বাংলার মানুষের কাছে আজ শুধু একটি জিনিসই চান। শুধু নৈতিক সমর্থন নয়, অস্ত্র না পেলে আমরা লড়ব কি করে। এই তাদের বক্তব্য।

খুলনা থেকে দুদিন হেঁটে আজই ফিরেছেন এমন একজনের সঙ্গে দেখা হল। সমস্ত রাস্তা বন্ধ। খুলনায় এখনও চলছে জোর লড়াই। সেখানে মুক্তিফৌজ ৪০০ পাঞ্জাবী সৈন্যকে নিহত করেছে। একটি তিনতলা বাড়ীতে কিছু পাঞ্জাবী সৈন্য আশ্রয় নিয়েছি। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেলস তাদের ঘেরাও করে। সাদা পতাকা উড়িয়ে পাঞ্জাবী সৈন্য আত্নসমর্পন করে।

যশোর থেকে সদ্য প্রত্যাগত একটি যুবকের কথাঃ যশোরের পথে বেশীদূর এগুতে পারলাম না। পথে পথে মৃতদেহ। দূরে গুলির শব্দ ধোঁয়া আর ধোঁয়া।

আগরতলা থেকেঃ গতকাল চট্রগাম দখলদার সৈন্য অবতরণে অসামরিক জনগণ বাধা দিলে তাদের ওপর জাহাজের কামান থেকে গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে বহু লোক মারা যায়।

ইপিআর-এর ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকে দখলদার ফৌজরা গ্রেফতার করেছে। ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের যেসব বাঙালি ফৌজ ওই বাহিনী থেকে সরে আসতে পারেননি তাদের হয় গ্রেফতার করা হয়েছে অথবা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।

স্বাধীন বেতারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিমবঙ্গের জনগনের সমর্থনের সংবাদ ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়েছে।

পাক বিমানবহর হেলিকপ্টারে করে সন্দ্বীপে ফৌজ নামাবার চেষ্টা করছে; নৌকা করে যশোরেও সেনা পাঠাবার। স্বাধীন বেতার কেন্দ্র আজ দুপুরে ওই খবর দেন। সঙ্গে সঙ্গে জানান, মুক্তিফৌজ তীব্র প্রতিরোধ করছে। এযাবৎ দুজায়গায় পাক বিমানবহরের চেষ্টা প্রতিহত হয়েছে।

-আনন্দবাজার পত্রিকা, ৩০মার্চ, ১৯৭১