ফরিদপুরের প্রতিরোধ
(সাপ্তাহিক ‘চিত্রবাংলা’ ৩ জুন ১৯৮৩ সালে প্রকাশিত শরীফ আফজাল হোসেন রচিত প্রতিবেদন থেকে সংকলিত)
আকস্মিকভাবে ২৫শে মার্চ গভীর রাতে রাজধানীতে পাক হানাদার বাহিনীর হামলার খবর, রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যদের প্রতিরোধ ও আত্মত্যাগের কথা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণা ২৬শে মার্চ সকাল বেলাতেই পেয়ে গেলাম। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফরিদপুরের পুলিশ ব্যারাক এবং বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ফরিদপুরের প্রাথমিক প্রবেশদ্বার গোয়ালন্দ ঘাটে ছাত্র জনতা, পুলিশ ও আনসার সমন্বয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে উঠলো এবং ঢাকা ফেরত কিছু ইপিআর এসে এতে যোগদান করলেন। সর্বস্তরের জনগণের সমর্থনে আমরা উৎসাহিত বোধ করলাম। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে গোয়ালন্দ ঘাটে ছাত্রজনতার এই প্রতিরোধ শুধুমাত্র রাইফেল, বন্দুক এবং মনোবলকে সম্বল করে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসেবে গ্রহণ করা হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য এবং আজো ভাবতে অবাক লাগে যে, সুসজ্জিত পাক বাহিনীর সামনে আমাদের অবস্থান ছিলো বাঘের সামনে অবোধ বালকের নুড়ি হাতে খেলা করার মতো। এসকল আয়োজনের ভিত্তি ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত জনতার দেশপ্রেম ও মুক্তির আকাঙ্খা। ফরিদপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় এভাবে জনতার প্রতিরোধের সাড়া পড়ে গেলো। তখন প্রয়োজন দেখা দিলো সুসমন্বয় ও প্রশাসনিক নির্দেশ প্রদানের। খুব সম্ভবত ২৯শে মার্চ তদানীন্তন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য কেএম ওবায়দুর রহমানকে আহবায়ক করে এ্যাডভোকেট আদেলউদ্দিন, ইমামউদ্দিন আহমেদ, শামছুদ্দিন মোল্লা, সৈয়দ হায়দার হোসেন, মোশারফ হোসেন, নূরুন্নবী, কাজী খলিলুর রহমান, মুজিবুর রহমান খান, গৌরচন্দ্র বালা, ফিরোজা রহমান, আমিনউদ্দিন, মোখলেসুর রহমান প্রমুখ স্থানীয় জননেতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নাসিরুদ্দিন মুসা, শাহ আবু জাফর, কবিরুল আলম, সালাউদ্দিন আহমদ, আবু সাঈদ, আতিয়ার প্রমুখ ছাত্র ও জনপ্রতিনিধি ও কর্মীদের নিয়ে জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সার্বিকভাবে ফরিদপুরের প্রশাসন ও তদারকির কাজ পরিচালনা করতে থাকে। তখন ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন এএনএম ইউসুফ এবং পুলিশ সুপার ছিলেন নূরুল মোমেন খান। পরবর্তীকালে ফরিদপুরে পাক হানাদার বাহিনী প্রবেশের পরেই তারা ধৃত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দীর্ঘ নয় মাস কারাবাসের পর মুক্তিলাভ করেন। ফরিদপুরের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবি, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকের মধ্যে বিশেষ করে লিয়াকত আলী হোসেন, আব্দুস সালাম মিয়া, আজম আমীর আলী, আনম আবদুস সোবহান, মিছির কর্মকার, আতাহার হোসেন, শামসুল হক, তারাপদ ঘোষ এবং আরো অনেকের কথা স্মরণ করা যায়। এছাড়াও ফরিদপুরের গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরের প্রত্যেক মহকুমায় স্থানীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। রাজবাড়ীতে মরহুম কাজী হেদায়েত হোসেন, মোসলেম আলী মৃধাসহ জননেতা ডাঃ এসএ মালেক, ওয়াজেদ চৌধুরী, নুরুল ইসলাম, মরহুম আবদুল জলিল, আবদুল হাই, চিত্তবাবু, আলী আক্কাস এবং স্থানীয় ছাত্রনেতা আবদুল জব্বার, নাজিবর, ফজলু, রেজা, তাপস প্রমুখ।
ফরিদপুর জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটির মূল ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের ডাক বাংলো ঝিলটুলীতে এবং সেখান থেকে প্রত্যেকটি মহকুমায় যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত এ দিনগুলো ছিলো ফরিদপুরের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় সময়কাল। ফরিদপুরের প্রতিরোধের সেই সাতাশটি দিন মনে হতো আমরা সম্পূর্ণ স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক ভূখন্ডে বসবাস করছি। কোথাও কোনো স্বাভাবিক আইন শৃঙ্খলার অবনতি পরিলক্ষিত হয়নি। এ যেন জনতার স্বতঃস্ফূর্ত নতুন জীবনের পথে স্বাভাবিক পথ চলা। ঢাকা থেকে বহু প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট পাক হানাদার বাহিনীর অনেক কুকীর্তি শুনতে পেলাম এবং ফরিদপুরে আমরা আতংকিত হলাম। সম্ভবত পহেলা এপ্রিলে প্রয়াত নেতা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীর পথে ফরিদপুরে পৌঁছালেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে পরের দিন চলে গেলেন। ১৭ই এপ্রিল বাংলার মাটিতে মেহেরপুরের মুজিবনগরে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক ঘোষণার কথা জানতে পারলাম এবং ফরিদপুরকেও আমরা তখন মুক্ত এলাকার একটা অংশ হিসেবে গর্ব অনুভব করলাম। আমরা তখন ফরিদপুরে স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতাম। সে সময় ফরিদপুরবাসীদের সার্বিক সুখ দুঃখের এক উচ্ছাসময় শিহরণের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। কখন হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে সেটাই ছিলো সার্বক্ষণিক চিন্তা। দেশের অন্যান্য জায়গায় পাক বাহিনীর নারকিয় অমানবিক দস্যুতার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের বেশি ভয় ছিলো প্যারাট্রুপ হানাদার বাহিনী নামলে প্রতিরোধ করার কোনো অস্ত্র আমাদের হাতে ছিলো না। নদীপথে গোয়ালন্দঘাট, গোপালগঞ্জ এবং মাদারীপুর ছাড়াও স্থলপথে পাংশা ও কামারখালীতে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয় যাতে করে কুষ্টিয়া কিংবা যশোর হয়ে আক্রমণের সম্ভবনা প্রতিহত করা যায়। দিবারাত্র চব্বিশ ঘন্টা ডিস্ট্রিক কাউন্সিলে কন্ট্রোল রুম কর্মব্যস্ত থাকতো এবং সেখান থেকে তাৎক্ষণিক তদারকি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা প্রদানের নির্দেশ প্রদান করা হতো। ফরিদপুর ছিলো ভারত অভিমুখে শরণার্থীদের অনেকেরই মাঝপথ। অনেক নেতা ও কর্মী ঢাকা থেকে ভারত যাওয়ার পথে ফরিদপুরে বিশ্রাম নিয়ে যশোর হয়ে চলে যেতেন। এভাবে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অনেক নেতৃবর্গই ফরিদপুরে অবস্থান নিলেন। এপ্রিলের মাঝামাঝি ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, রাজবাড়ী, মাদারীপুর শহর থেকে লোকজন পরিবার পরিজন সহ গ্রাম এলাকায় চলে যেতে লাগলেন। একটা সংঘাতের মুখোমুখি আমরা প্রশাসন কর্মকর্তা ও প্রতিরোধে নিয়োজিত নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা শহরে রয়ে গেলাম। আমরা শহরে প্রবেসের বিভিন্ন রাস্তার উপর ব্যারিকেড তৈরি করলাম। ২১শে এপ্রিল ভোর রাতে হানাদার বাহিনী সুসজ্জিত গানবোট দিয়ে প্রথম গোয়ালন্দঘাট আক্রমণ করলো। আমাদের প্রতিরোধ কর্মীরা প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে কিন্তু দূর থেকে অবিরাম মর্টারের শেল বর্ষণের মধ্যে সকাল নয়টায় হানাদার বাহিনী গোয়ালন্দঘাট দখল করলো এবং একই সঙ্গে হেলিকপ্টারে করে ফরিদপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ছত্রীবাহিনী অবতরণ করতে লাগলো। নেতৃবৃন্দ ও কর্মীরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ফরিদপুর শহর ত্যাগ করতে লাগলাম।
আমি সকাল দশটার দিকে ইপিআর’এর একজন প্রতিরক্ষা কর্মী সদস্য কবিরুল আলমকে সঙ্গে নিয়ে নড়বড়ে একটা জীপে করে কামারখালীর দিকে রওয়ানা হলাম এবং কেএম ওবায়দুর রহমান নগরকান্দা হয়ে গোপালগঞ্জের দিকে রওয়ানা হলেন। অন্য নেতৃবৃন্দও বিচ্ছিন্নভাবে শহর ত্যাগ করলেন।
——————————————————–