শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১২৩। বাংলাদেশের প্রশ্নে আচার্য বিনোবার সাক্ষাতকারঃ ডেমোক্র্যাসি এন্ড মিলিটারিজম আর ইঙ্কম্পিটেবল | পিপলস একশন | মে ১৯৭১ |
বিনোবা বলেন-
গণতন্ত্র ও সমরবাদ হচ্ছে পরস্পরবিরোধী
৪ঠা এপ্রিল শ্রী দেবেন্দ্র কুমার গুপ্তের নেতৃত্বে সর্বদয়া – এর এক দল কর্মী আচার্য বিনোবার সাথে তাঁর পাওনারস্থ আশ্রমে দেখা করেন এবং বাংলা দেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। উক্ত আলোচনার প্রভাস যোশীর করা ভাবানুবাদ নিম্নে দেয়া হলোঃ
বিনোবাঃ আজ সকালে অলইন্ডিয়া রেডিও সোভিয়েত প্রেসিডেন্টের একটি সমবেদনার বাণী প্রচার করেছে। আমি এতে খুশি হয়েছি। শেখ আব্দুল্লাহ এবং খান আব্দুল গাফফার খান কি করছে? তারা কি কিছু বলেছে?
দে.কু.গুপ্তঃ না।
বিনোবাঃ ওরা চুপ করে আছে কেন? শুধুমাত্র মানবতার খাতিরেই ওদের উচিত বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদ করা। গাফফার খান কোথায়?
দে.কু.গুপ্তঃ তিনি হয়তো পাকিস্তানের বিভাজন পছন্দ করেন না।
বিনোবাঃ বাংলা দেশের নেতা ছিল মুজিব। তারা (সামরিক বাহিনী) তাঁর সাথে আলোচনার প্রহসন চালিয়ে গেছে এবং এরপর চালিয়েছে সর্বাত্মক আক্রমন। ওরা বোমাও ব্যবহার করছে। আর যখন বোমা হামলা হয়, তখন মৃত্যুও হয়। বোমার তো আর হিন্দু – মুসলিম ভেদাভেদ নাই, বয়োবৃদ্ধ সকলেই আক্রান্ত। বাংলা দেশে যা চলছে তাকে সর্বাত্মক ধ্বংসলীলা ছাড়া আর কিই বা বলা যায়। ওরা যদি পণ করেই থাকে যে বাংলা দেশের মানুষের মনে আতংক সৃষ্টি করে তাদের ওপর ওদের স্বেচ্ছাচারিতা চাপিয়ে দেবেই, তবে গনতন্ত্রের নামে এই প্রহসন কেন?
দে.কু.গুপ্তঃ লোকে বলে পশ্চিমবঙ্গে ভারতও তো সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে।
বিনোবাঃ তাতে কি হয়েছে? ভারতীয় সেনাবাহিনী কি গণহত্যায় মেতে উঠেছে? পশ্চিমবঙ্গে সীমান্ত প্রতিরক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। আমি একে ‘বোতলের গলা’ বলি, যদি ভারতের সেনাবাহিনী থাকে তাহলে সেটিকে সীমান্তে মোতায়েনের প্রয়োজন রয়েছে।
পাকিস্তানও পূর্ব বঙ্গে সেনা মোতায়েন করেছে। কিন্তু ওরা চায় জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলতে। তাই ওরা সর্বাত্মক যুদ্ধের জন্য নিয়ে এসেছে সাঁজোয়া যান (ট্যাঙ্ক), বোমারু বিমান এবং অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র।
দে.কু.গুপ্তঃ কিন্তু বিয়াফ্রা-তে (নাইজেরিয়া) এধরণের গণহত্যা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে এবং কেউ তা থামাতে পারেনি।
বিনোবাঃ ব্রিটিশরা এর প্রতিবাদ করেছে। এমনকি এখানেও সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট শুধুমাত্র মানবিক কারনে এক বাণী দিয়েছেন। কিন্তু আমেরিকা একে বলছে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যপার। আমেরিকার বিদ্যার দৌড় এটুকুই।
পশ্চিম পাকিস্তানীরা সুচারুরূপে পূর্ব বঙ্গের মানুষদের শাসন ও শোষণ করে এসেছে। বেশিরভাগ মানুষ পূর্ব বঙ্গে বসবাস করতো কিন্তু সেনাবাহিনীতে এবং প্রশাসনে তাদের সঠিক মাত্রায় প্রতিনিধিত্ব ছিলোনা। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনে পশ্চিম পাকিস্তানীদেরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। উন্নয়নের সুফল মূলতঃ পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছেই যেত। পূর্ব বঙ্গ দরিদ্রই থেকে যায় এবং এমনকি আজও তারা এই পুরো উপমহাদেশের সবচে দরিদ্র জনগোষ্ঠী। নির্বাচনে, মুজিবের আওয়ামী লীগ ৯৮ শতাংশ ভোট পায় এবং পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু তাদেরকে ধোঁকা দেয়া হয় এবং গণতান্ত্রিক শাসন থেকে বঞ্চিত করা হয়।
গাফফার খান যখন এখানে এসেছিল, তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলামঃ পাখতুনিস্তান সামরিক জান্তার হাতে নিগৃহীত হচ্ছে। তুমি কি চাও ভারত এই ব্যপারটা জাতিসংঘে তুলুক? সে জবাব দিয়েছে, “এটা সময়োপোযোগী হবে না। পাকিস্তানে গনতন্ত্র আসছে এবং আমাদের দেখতে হবে যে আমরা নিজেরা কি করতে পারি”। গনতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠায় তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। এখন যখন পূর্ব বঙ্গে গনতন্ত্রের সমাধি রচিত হয়েছে, তখন সে নিশ্চুপ কেন?
দে.কু.গুপ্তঃ কিন্তু আমরা তাহলে কিভাবে একজন আক্রমনকারীকে আলোচনার টেবিলে বসতে বাধ্য করতে পারি একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের খোঁজে?
বিনোবাঃ নৈতিক চাপেই কাজ হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার উপর চাপ সৃষ্টি করতে বিশ্বমত তৈরিতে তোমাদের একত্রে কাজ করতে হবে।
দে.কু.গুপ্তঃ পাকিস্তানের দুই অংশ কি তবে একত্রে থাকতে পারবে?
বিনোবাঃ এটা তখনই সম্ভব হবে যখন এবিসি ত্রিভুজ বাস্তবে রূপান্তরিত হবে (এবিসি ত্রিভুজ হচ্ছে আচার্য বিনোবার কল্পনায় পাক-ভারত উপমহাদেশের সাথে আফগানিস্তান, বার্মা ও শ্রীলংকার একীভূত হওয়ার ধারণা)। কিন্তু আজকের দিনে এমনকি পাক-ভারত একীভূত হওয়াও সম্ভব নয়। ৪৮ এবং ৬৫ সালের যুদ্ধের পর জনগন এই লাইনে চিন্তা করতেও ভুলে গেছে।
সামরিক জান্তার হাতে যেভাবে তারা নির্যাতিত হয়েছে এরপরে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে কোনদিনই থাকতে চাইবেনা, যদি বাংলা দেশের সামান্যতম জ্ঞানও অবশিষ্ট থাকে। এছাড়াও, দুই অংশের মধ্যে কোনো বিষয়েই কোনো মিল নেই। ইসলাম ধর্ম তাদেরকে একত্রে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। পুরো ইউরোপ মহাদেশই খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী, কিন্তু খ্রিস্টধর্ম তাদেরকে একটি জাতিতে একীভূত করেনি। ধর্ম এখন সেকেলে। ক্ষুধাই এখন মূল বিষয়বস্তু। কে ক্ষুধার্ত? অবশ্যই বাংলা দেশ, এবং ক্ষুধার্ত মানুষের কোনো ধর্ম নেই।
দে.কু.গুপ্তঃ তাহলে কি বিশ্বমত তৈরিতে আমাদের উচিত একটি এশীয় সম্মেলন ডাকা?
বিনোবাঃ হ্যাঁ, এটা করা যেতে পারে। এবং এর বন্দোবস্ত করাও বেশ সহজ হবে।
পায়ে হেঁটে দেশ ভ্রমণের সময়, আমি ১৮ দিন পূর্ব বঙ্গে ছিলাম। সেইসময় আমি দেখেছি যে বাংলা দেশের মানুষ তাদের ভাষা নিয়ে খুবই গর্বিত। তারা বলতো যে কোলকাতায় যে বাংলা বলা হয় সেটা শুদ্ধ বাংলা নয়। তাদের বাংলা ভাষা হচ্ছে খাঁটি ‘সোনা’। এবং তাদের বাংলা ভাষায় ভারতের যেকোনো ভাষার চেয়ে বেশি সংস্কৃত শব্দ রয়েছে। ভারতীয় ভাষার মধ্যে ‘মালায়ালাম’ ভাষায় সবচে বেশি সংস্কৃত শব্দ আছে কিন্তু পূর্ব বঙ্গের বাংলা ভাষায় তারচেয়েও বেশি সংস্কৃত শব্দ রয়েছে।
আমি তাদেরকে জিজ্ঞেস করতামঃ “বাংলার মনন তৈরিতে কাদের ভূমিকা সবচে বেশি? ” এবং তারা সবসময়ই চারটি নাম বলতোঃ বুদ্ধ, মোহাম্মেদ, চৈতন্য এবং ঠাকুর (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)। এঁরা হচ্ছেন চারজন বিশেষ ব্যক্তিত্ব যারা বাংলা মননের রুপায়ক। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান আমার সোনার বাংলা দেশ কে জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নিয়েছে। তারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা এতটাই পছন্দ করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকেরা তাদের বেতারে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা পাঠ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
দে.কু.গুপ্তঃ মানুষের মনে এই শঙ্কাও আছে যে পূর্ব বঙ্গ হয়তো আলাদা হয়ে যাবে এবং স্বাধীনতা অর্জন করবে।
বিনোবাঃ আমাদের সেই দুশ্চিন্তার কোন প্রয়োজন নেই। মুজিব কখনই স্বাধীন বাংলাদেশ চায়নি। সে সবসময়ই স্বায়ত্তশাসন চেয়ে এসেছে। কিন্তু সামরিক বাহিনী গণতন্ত্রের নামে প্রহসন করে তাকে বঞ্চিত করেছে এবং তাদের বুটের নিচে সেই গণতন্ত্রকে কবর দিয়েছে। সে কারনেই মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছে।
দে.কু.গুপ্তঃ আমরা কি তবে ভারত সরকারের কাছে আবেদন করতে পারি তারা যাতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়?
বিনোবাঃ (হাসতে হাসতে) আমরা অবাস্তব প্রস্তাব দেয়ার ব্যপারে বিশেষ পারদর্শী। তবে আমারও একটা প্রস্তাব আছে। ভারতের উচিত তার সৈন্য বাহিনী ভেঙে দেয়া। যে গণতন্ত্র সেনাবাহিনীর উপর নির্ভরশীল সেটি সত্যিকার গণতন্ত্র নয়। বাংলাদেশে এটা প্রমানিত হয়েছে। বিশ্বের সামনে এই উদাহরণ সৃষ্টি করে, ভারতের ঘোষণা দেয়া উচিত যে গণতন্ত্র রক্ষা করতে গিয়ে আমরা আমাদের সেনাবাহিনী ভেঙে দিচ্ছি। এতে শুধু পাকিস্তানই নয় বরং বিশ্বের সকল দেশের উপরই মারাত্মক এক নৈতিক চাপের সৃষ্টি হবে। কেউ যদি তার সেনাবাহিনী ভেঙে দেয় তাহলে অন্য কেউ তাকে আক্রমন করার সাহসই পাবে না। এবং এরপরেও যদি কেউ তাকে আক্রমন করে, বিশ্বের পরাশক্তিগুলো তা ঘটতে দেবে না।
দে.কু.গুপ্তঃ তাহলে আমরা কিভাবে আমাদের জনগণকে রক্ষা করবো?
বিনোবাঃ (হাসতে হাসতে) জনগণ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সুরক্ষিত আছে কেননা কেউই সেনাবাহিনীর উপর খুব একটা নির্ভর করছেনা। সেনাবাহিনী ভেঙে দেয়ার প্রস্তাবটা যতটা অবাস্তব মনে হচ্ছে আসলে ততটা নয়। স্বাভাবিক সময়ে যা করা সম্ভব নয় কিন্তু ক্রান্তিলগ্নে তা করা সম্ভব। এই মুহূর্তে তোমার সরকারের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে এবং তারা এটা করার মতো অবস্থানেও রয়েছে। তারা যদি এটা করতে পারে, তাহলে বিশ্বব্যাপী এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে।
দে.কু.গুপ্তঃ তাৎক্ষনিকভাবে আমরা কি করতে পারি?
বিনোবাঃ তোমাদের উচিত শুধু ভারতেই নয় বরং অন্যান্য দেশেও জনমত তৈরিতে কাজ করা। তোমরা আমেরিকার জনগণকে বলতে পারো যে তাদের সরকারের দেয়া অস্ত্রই পূর্ব বঙ্গের গণহত্যায় ব্যবহৃত হচ্ছে। তারা তাদের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে এবং তাদের সরকার তখন অন্যান্য দেশগুলোকে, বিশেষ করে আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোকে, প্ররোচিত করবে যাতে তারা বাংলা দেশে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানকে সমর্থন না করে। তোমরা তোমাদের নিজের সরকারকেই বলতে পারো বিষয়টা জাতিসঙ্ঘে তুলতে।
ভারতে, জনমত তৈরি করতে তোমরা সর্বদলীয় সভার আয়োজন করতে পারো। তোমরা ত্রাণকাজের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারো। তোমরা সীমান্তে চিকিৎসক দল পাঠাতে পারো।
দে.কু.গুপ্তঃ বাংলা দেশের মানুষ কিভাবে অহিংসভাবে সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করবে?
বিনোবাঃ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলা দেশের মানুষ সম্পূর্ণ অসহযোগিতার এক চমৎকার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু তারা এখনো অহিংস আন্দোলনের শক্তি দেখাতে পারেনি। সত্যি বলতে, কোনো দেশই তা করতে পারেনি। বিশ্বে অনেক অসহযোগ আন্দোলনের উদাহরণ রয়েছে। এবং এমনকি ভারতেও অহিংস আন্দোলনের শক্তি ব্যবহৃত হয়নি। আমি আশা করেছিলাম যে মুজিব হয়তো এটা সৃষ্টি করতে পারবে। কিন্তু তাকে ধোঁকা দেয়া হয়েছে এবং সর্বাত্মক আক্রমণের মাধ্যমে এর শেষ আশাটুকুও সেনাবাহিনী নিঃশেষ করে দিয়েছে।