You dont have javascript enabled! Please enable it! দিনাজপুর জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধের বিবরণ | বাংলা একাডেমীর দলিলপত্র - সংগ্রামের নোটবুক

দিনাজপুর জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধের আরও বিবরণ
সাক্ষাতকারঃ সুবেদার মেজর এ, রব (ডি-এ-ডি)
২৪-২-১৯৭৯
(অনুবাদ)

৯-৩-৭১ থেকে ৮ উইং কমান্ডার মেজর আমীন তারিক বাঙ্গালী গার্ড কমান্ডার, কোট এবং ম্যাগাজিন এনসিওএস পরিবর্তন করলো এবং তাদের স্থলে পাঞ্জাবীদেরকে দায়িত্ব দিল। সে তিনজন বাঙ্গালী আর্মি অফিসার, বাঙ্গালী জেসিও, এনসিও এবং আমার (এসএম) বিরুদ্ধে নিরাপত্তা হিসেবে অল্প কয়জন ইপিআর বিহারী নিযুক্ত করলো যা কিনা আমাদের মাঝে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিল। ঐ সময়টাতে ক্যাপ্টেন নাজির আহমেদ এবং ক্যাপ্টেন নজরুল হক ছিল এমকিউ এবং এডজুটেন্ট কারণ তারা দুজনেই ছিল বাঙ্গালী। আমি সব ঘটনা তাদের কাছে রিপোর্ট করতাম।

যখন ৮ উইং কোট, ম্যাগাজিন এনসিও এবং গার্ড কমান্ডার পরিবর্তন করা হল, আমি সহ আতাউল হক শহীদ, এন/সাব লুতফুর রহমান, এন/সাব মোয়াজ্জেম হোসেন, সেক্টর কিউএম/হ্যাভ খোন্দকার আবু সায়ীদ, ৮নং উইং এর কিউএম/হ্যাভ ভুলুমিয়া, সেক্টর এন্টি ট্যাংক প্লাটুনের হ্যাভ নাজিম এবং আরো এনসিও সহ অন্যান্যরা পরিকল্পনা করলাম যে যদি কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে সেক্টর এসএম (এরব) অস্ত্র এবং গোলাবারুদের জন্য অস্ত্রাগারের চাবি সরবরাহ করবে। আমাদের এই পরিকল্পনা খুব অল্প কিছু লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।
.
১৭-৩-৭১ তারিখে সেক্টর কমান্ডার কিউএম ক্যাপ্টেন নাজির আহমেদকে যাবতীয় গ্রেনেড এবং চাইনীজ অস্ত্র গুলো দিনাজপুরের ২৬ এফএফ রেজিমেন্ট জওয়ানদের কাছে হস্তান্তর করার নির্দেশ দিল। পালাক্রমে কিউএম ক্যাপ্টেন সেক্টর কমান্ডার, কিউএম/হ্যাভ আবু সায়ীদ কে নির্দেশ দিল কিন্তু সে হস্তান্তর করল না।
.
৭১ সালের মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে কিছু অবাঙ্গালী জেসিও/এনসিও এবং ওআর সেক্টর হেডকোয়াটারে এনে অবাঙালি শক্তি কিছুটা বাড়ানো হল এবং সবসময় তাদের অস্ত্র সরবরাহ করা হল। ১৮-৩-৭১ তারিখে আবু সায়ীদকে অস্ত্রাগারের চাবি এন/সাব-কিউএম মোঃ ইব্রাহীম (অবাঙ্গালী) এর কাছে হস্তান্তর করার নির্দেশ দেয়া হল কিন্তু সে তা না করে সব চাইনীজ অস্ত্রগুলো বাঙ্গালী পরিবারের লোকদের কে দিল যেটার দায়ে তাকে ২৪-৩-৭১ তারিখে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। দিনদিন পরিস্থিতির অবনতি দেখে শত্রুর মোকাবেলা করার পরিকল্পনা করলাম।

.
অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ আমাদের ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে কর্নেলের সাথে এক আলোচনায় আমি কৌশলে বললাম যে অবাঙ্গালী নিরাপত্তা-কর্মীরা শহর থেকে রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঠিক তথ্য জানাতে পারছেনা কারণ তারা স্থানীয় লোক দের সাথে মিশতে অপারগ। সে ক্ষেত্রে আমি কিছু বিশ্বস্ত বাঙ্গালী নিয়োগ দেয়ার পরামর্শ দিলাম যাতে তার সঠিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সেক্টর কমান্ডার আমার পরামর্শ গ্রহণ করলেন এবং দুই-তিন জন বাঙ্গালী ছেলে এই কাজের জন্যে নিয়োগ দিতে বললেন। নির্দেশ অনুযায়ী আমি এল/এনকে আবুল মান্নান, এল/এনকে মোতাহার এবং সিপাহী মুস্তাফিজুর রাহমানকে নিয়োগ দিলাম এই বলে যে তারা যেন সরাসরি সেক্টর কমান্ডারের কাছে রিপোর্ট করে। আমি তাদেরকে এও বললাম যে রিপোর্ট করার সময় তারা যেন বলে যে রাজবাড়ি আমবাগানে এবং শহরের বাইরে বিভিন্ন জংগলে ভারতীয় প্রতিনিধিরা আওয়ামীলীগ স্বেচ্ছাকর্মী, ছাত্র এবং ন্যাপ কর্মীদের গভীর রাতে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে এবং অস্ত্র সরবরাহ করছে। তারা যেকোনো সময় ইপিআর সেক্টর হেডকোয়ার্টারে, অফিসার দের ক্লাব ও বাংলোতে হামলা চালাতে পারে। তাদেরকে এই কথা বলার পিছনে আমার উদ্দেশ্য ছিল যে তা শুনে সিও আমাকে এবং অন্য অফিসারদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্যে ডাকবে। ঐ মুহূর্তে আমার উপদেশ হবে যেন হেডকোয়ার্টার, অফিসার্স ক্লাব এবং তাদের বাংলোর চারিদিকে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া হয় কারণ তাহলে সব অস্ত্রশস্ত্র পাঞ্জাবীদের পরিবর্তে আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সেক্টর কমান্ডার আমার কথা মানলেন এবং তদনুযায়ী কাজ করার নির্দেশ দিলেন। আমিও পরিকল্পনা অনুযায়ী সব কিছু করলাম। মহান আল্লাহর রহমতে যুদ্ধ ছাড়া একজন বাঙালি ইপিআরও প্রাণ হারায়নি। এর সাথে এমএনএ/এমপিএ এবং ছাত্র নেতাদের রক্ষা করা সম্ভব হয়।
.
১৮-২-৭১ তারিখে সেক্টর কমান্ডার, দিনাজপুরের ডিসি মিঃ ফাইজুদ্দিন আহমদের উপর জোরপূর্বক দিনাজপুরে কারফিউ জারি করতে বললেন কিন্তু ডিসি তা প্রত্যাখ্যান করলেন। বিষয়টি প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর অবাঙ্গালী ইপিআরেরা (যাদের অধিকাংশই ছিল বিহারী) ডিসিকে অপসারণের উদ্দেশ্যে দাঙ্গা শুরু করলো যেন কারফিউ জারি করা হয়। তারপর আমি মিঃ জামানের বাড়িতে গিয়ে অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে ব্যাপারটি জানালাম। পাশাপাশি আওয়ামীলীগ এমএনএ এবং অন্যান্য নেতাদের বিভিন্ন সূত্রের মাধ্যমে অবগত করলাম।
.
১৯/২০মার্চ ৭১’এ ক্যাপ্টেন এডজুটেন্ট নজরুল ইসলামকে অপসারিত করে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন জাভেদ ফিরোজকে এডজুটেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হল। অন্যদিকে বাঙ্গালী কমান্ডার এন/সাব মোয়াজ্জেম হোসেনের পরিবর্তে একজন বিহারী কমান্ডার নিয়োগ করা হল। যার ফলে বাঙ্গালী ইপিআর সৈন্যরা একটা পর্যায়ে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়ল। এটা লক্ষ্য করে আমি তাদের হতাশ না হয়ে বরং সুসংগঠিত ও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিলাম।
.
২৩-৩-৭১ তারিখ বেলা সাড়ে নয়টার দিকে সেক্টর কমান্ডার আমাকে ফোনে সৈন্যদের জন্যে ‘বড়খানা’ এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে বললেন। দুপুরে সেক্টর কমান্ডার আমাকে ২৬ এফএফ রেজিমেন্টের সৈন্যদের বড়খানায় নিমন্ত্রণের নির্দেশ দিলেন। বেলা চারটার দিকে আমি গোপন সূত্রে খবর পেলাম যে বড়খানায় এফএফ রেজিমেন্টের অর্ধেক লোক উপস্থিত থাকবে এবং বাকিরা সশস্ত্র এসে আমাদের কোট ম্যাগাজিন দখল করবে। সাথে সাথে আমি আমার বাঙ্গালী সৈন্যদের সতর্ক করে দিলাম। আল্লাহর রহমতে ঐ রাতে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি।
.
২৪-৩-৭১ তারিখে শহরে উদ্বেগ সৃষ্টি করতে পাক বাহিনীর ফাকা গুলিবর্ষণ আমাদের মধ্যে একটু মানসিক অস্থিরতা তৈরি করল। ২৩শে মার্চ থেকে পাকিস্তানী আর্মিদের উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্যে আমি আমার রাত্রিকালীন প্রহরীর সংখ্যা বৃদ্ধি করলাম।
.
২৪শে মার্চ পাক আর্মি আমাদের সীমারেখার দিকে তাক করে দিনাজপুর সার্কিট হাউজ কম্পাউন্ডে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র বসাল।
.
২৫শে মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিটে ঘুম থেকে উঠে আমি তাহাজ্জুদ নামাজে দাড়াতেই এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন জাভেদ ফিরোজের কাছ থেকে ফোন আসল এবং তিনি আমাকে তৎক্ষণাৎ ইউনিফরম পড়ে সাক্ষাৎ করতে বললেন যা আমাকে কিছুটা হতভম্ব করল। যাই হোক আমি গুলিভর্তি একটি রিভলভার সহ ইউনিফর্ম পড়ে বের হতেই একটা জীপ এসে হাজির হল। গাড়িতে দুজন অবাঙ্গালী যাত্রাসঙ্গি বসে ছিল। গাড়িতে করে আমি যখন দিনাজপুর ডিসি এর বাসস্থান অতিক্রম করে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম তার বাংলো পাক আর্মিরা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে ঘেরাও করে রেখেছে। সেক্টর কমান্ডারের বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম আমাদের অফিসারেরা আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। সেখানে বাঙ্গালী অফিসারদের দেখে আমার মানসিক অস্থিরতা কিছুটা কমল। সেক্টর কমান্ডার আমাকে জানালেন যে ঢাকা, চিটাগাং, রাজশাহী, খুলনা এবং অন্যান্য জেলায় প্রশাসনের ব্যর্থতার কারণে অগ্নিকান্ড, লুটপাট, নারী ধর্ষণসহ অসংখ্য অসামাজিক ঘটনা ঘটেছে। রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থে পাক আর্মি এবং ইপিআর পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসনের ক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। সেক্টর কমান্ডার আমাকে লাইনে থাকা সৈন্যদের বিনোদন কক্ষে একত্রিত করার নির্দেশ দিলেন। তদনুযায়ী আমরা ইপিআর পৌঁছলাম এবং সেক্টর কমান্ডার সবাইকে শহরের মূল পয়েন্টগুলো পিকেট দিয়ে বন্ধ করে দিতে বললেন (শ্রোতাদের অধিকাংশই ছিল অবাঙ্গালী)। আমি যখন বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন সার্কিট হাউজে অবস্থিত আর্মি হেডকোয়ার্টার থেকে আমাকে ফোনে ডেকে পাঠানো হল।সেখানে যাওয়ার পর সেক্টর কমান্ডার, নিরাপত্তা অফিসার মেজর রাজা সিদ্দিক এবং মেজর দুররানী হাসিখুশি মুখে স্বাগত জানিয়ে দিনাজপুর জেলায় কারফিউ জারির একটি নির্দেশনামা বাঙ্গালায় লিখে দিতে বললেন। আমি আদেশ অনুযায়ী কাজটি করলাম। আমাকে বাংলায় কারফিউ জারির ঘোষণা দিতে বললেন। কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়ার সময় আমার সাথে উপরোক্ত অফিসারেরা ছিল এবং এফএফ রেজিমেন্টের একজন গার্ড আমার পিছনে ছিল। রাত তিনটায় ঘোষণা আরম্ভ হল শেষ হল বেলা সাড়ে নয়টায়। তারপর আমাকে সারাদিন বিশ্রাম দেয়া হল।
.
২৬-৩-৭১ তারিখে সারা দিন ধরে আর্মি এবং ইপিআর শহর এবং চারপাশের এলাকা সমূহে পাহারারত ছিল। কিছুকিছু এলাকায় সারাদিন ধরে পিকেট বসিয়ে রাখা হল এবং কিছু এলাকায় জনগণ রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছিল বলে আর্মিরা কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করেছে। রাতে আর্মিরা এবং ইপিআরের অবাঙ্গালী অফিসারেরা গুরুদাস তালুকদার, বড়দা চক্রবর্তীসহ অন্যান্য নেতাকর্মী ও কয়েকজন হিন্দু বণিকদের গ্রেপ্তার করে।
.
২৭-৩-৭১ তারিখে ৮ উইং কমান্ডার এবং এডজুটেন্ট আমাকে বললেন প্রচার অফিসারকে শহরে কারফিউ ঘোষণা করার সময় সাহায্য করতে। আমি কাজ শেষ করে সাড়ে ১১টায় ফিরলাম। তারপর সেক্টর কমান্ডার আমাকে লাইনে থাকা সৈন্যদের জড়ো করার নির্দেশ দিলেন এবং তিনি আওয়ামীলীগ ও বঙ্গবন্ধুকে অভিযুক্ত করে বলা ইয়াহিয়া খানের কথা গুলোকে সবার সামনে পুনরায় বললেন।
.
তারপর কিউএম ক্যাপ্টেন নাজির আহমেদ এবং সাব আতাউল হককে এক প্লাটুন সৈন্যসহ ঠাকুরগাঁও পাঠানো হল। আমি আতাউল হকের অভাব অনুভব করছিলাম যেহেতু সে ছিল দিনাজপুর যুদ্ধে আমার ডানহাত। পিকেট কমান্ডার এন/সাব লুতফর রহমান আমাদের ২১/সি এর আবাসস্থলে আক্রমণ করার জন্যে জনগণকে ফুসলিয়েছে এই অজুহাতে সেক্টর কমান্ডার অযথা তাকে হুমকি দিল। এটা ছিল তাকে সরিয়ে একজন অবাঙ্গালী নিয়োগ দেয়ার ফন্দি মাত্র। দিনের মধ্যভাগে কিছু বিহারী এসে সেক্টর কমান্ডারকে জানাল যে কাঞ্চন নদীর নিকটে এবং অন্যান্য দূরবর্তী এলাকা গুলোতে বিহারীদেরকে আক্রমণ করার উদ্দেশ্যে বাঙ্গালীরা একত্রিত হচ্ছে। আমি খোজ নিয়ে সেক্টর কমান্ডারকে অবগত করলাম যে ব্যাপারটি মিথ্যা। সারাদিন আর্মি এবং ইপিআররা শহরে প্যাট্রল দিল। ১২ বছরের এক শিশু রাস্তা পারাপারের সময় আর্মিরা তাকে গুলি করে হত্যা করে।
.
২৭-৩-৭১: সন্ধ্যায় সেক্টর কমান্ডার তার অবাঙ্গালী অফিসারদের কুমন্ত্রণায় রংপুর ব্রিগেড থেকে আরো কিছু সৈন্য আনার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পাহারারত সৈন্য দিয়ে বন্ধ রাস্তার আশেপাশে ১৪জনকে গুলি করে হত্যা করে।
.
২৭/২৮ মার্চ রাতে পাক আর্মিরা ছেহেল গাজী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের ভাই হাবিব সহ তাদের তালিকাভুক্ত আরো কয়েকজনকে ধরে নিয়ে হত্যা করে। তাদের মৃতদেহ রাজবাড়ি জঙ্গল, ফুলহাট ব্রিজ এবং ওয়াপদার খাদ থেকে উদ্ধার করা হয়। সকালে এ সকল লাশ দেখে মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে।
.
ইতোমধ্যে আমি গোপনসূত্র খবর পেলাম যে, সকল এমএনএ ও এমপিএ এবং শহরের মান্যগণ্য নেতাকর্মীদের আর্মি হেডকোয়ার্টারে ডেকে হত্যা করা হবে। এর পর ১৭টার সময় আক্রমণ চালিয়ে সকল বাঙালী ইপিআর হত্যা করা হবে। কিন্তু আমি তাদেরকে গোপনে এ খবর পৌঁছে দিলাম। তারা হেডকোয়ার্টারে আসেনি।
.
২৮-৩-৭১ (রবিবার): প্রায় সাড়ে ১০টায় হ্যাভ নাজিম আমার কাছে এসে জানাল যে তার আগের দিন পাক আর্মিরা ২০০ বাঙ্গালীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। বলতে গিয়ে সে কেঁদে ফেলল। পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে সেটা জানার জন্যে ৮ উইং কমান্ডার হ্যাভ মুসলিম আলী তাকে আমার কাছে পাঠিয়েছে। আমি নাজিমকে ইশারায় অপেক্ষা করতে বললাম এবং বললাম যে তারা যেন আমাদের গোপন পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যায়। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বিহারী সুবেদার বাদশা আহমাদকে তার বর্ডার কয় থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে। মার্চের ২৮ তারিখ যদিও রবিবার ছিল, তবুও সেক্টর কমান্ডার এবং অন্যান্য অবাঙ্গালী অফিসারেরা বেলা ২টা পর্যন্ত মিটিং করলো। মিটিং শেষ করার পর বাদশা আহমাদকে বাইরে ব্যবহারের জন্যে একটি পিআই সরবরাহ করাহল। দিনাজপুরে আর্মি আসার পর থেকেই ইপিআরে আর্মি সংকেত দেয়া ছিল। দায়িত্ব প্রাপ্ত এনসিও কে সার্কিট হাউজে ডাকা হল এবং তিনি এসে বাঙালি সৈন্যদের সেট বন্ধ করে দিতে বললেন। বাদশা আহমেদ ওয়্যারলেস সেট বন্ধ করাসহ ৩” মর্টার, এমএমজি, এলএমজি এবং একটি পিআই দাবী করার কারণে আমরা ‘H’ ঘণ্টা, এক ঘণ্টা ১৫ মিনিট আগেই স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হলাম। অফিসারেরা অফিস ত্যাগ করা মাত্রই পরিকল্পনা অনুযায়ী বাদশা আহমাদের সৈন্যদের দেয়া অস্ত্র আমরা আমাদের সৈন্য দিলাম। আমাদের সৈন্যরা তাদের অবস্থান নেয়া মাত্রই সার্কিট হাউজ থেকে গুলি শুরু হল। আমাদের একদল সৈন্যকে অবাঙ্গালী ইপিআর দের দমন করার জন্যে পাঠিয়ে দিয়ে আমরাও পাল্টা গুলি শুরু করলাম। গোলাগুলি এতটাই তীব্র ছিল যে আমি আমার আরভি-তে পৌছাতে পারলামনা কারণ আমার কোয়ার্টার ছিল সার্কিট হাউজ এবং ইপিআরের মাঝে। গোলাগুলি একটু থামার পর আমি আরভি- তে পৌঁছেই অপারেশন শুরু করার নির্দেশ দিলাম। ফেরিঘাট ও রেলওয়ে ব্রিজ দিয়ে শত্রুর আক্রমণ ঠেকানোর জন্যে কাঞ্চন ব্রিজে একটি এমএমজি ৩” মর্টার বসানো হল। প্রত্যেক বিওপি’তে দুজন করে লোক রেখে বাকিদের আমাদের সাথে যোগ দিতে বললাম।
.
২৯-৩-৭১ তারিখে দিনাজপুরে যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের সবাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল এমন কি দিনাজপুরের যুবক শ্রেণী ও আমাদের যথেষ্ট সাহায্য করেছিল।
.
৩০-৩-৭১: সারাদিন যুদ্ধ চললো। বাঙ্গালী ইপিআর ৬ পাউন্ডর এন্টি-ট্যাংক গান ব্যবহারসহ সর্বচ্চ শক্তি দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেল। আমরা এন্টি-ট্যাংক গান ব্যবহারের ফলে পাক জান্তা ধারনা করে নিলো যে ভারতীয় আর্মি ট্যাঙ্ক দিনাজপুরে ঢুকে পড়েছে। ইতোমধ্যে শহর ও পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে অসংখ্য পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে।
.
৩০শে মার্চ সন্ধ্যা নাগাদ আমরা আমাদের যাবতীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদ কাঞ্চন ব্রিজের বিপরীত পাশে সরিয়ে নিলাম। আমরা সেখানে রিয়ার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করলাম সেখানে শত্রুরা আমাদের উভয় দিক থেকেই আক্রমণ করে ব্যর্থ হল। ৩০শে মার্চ পর্যন্ত অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে আমরা যুদ্ধ চালিয়ে গেলাম।
.
৩১শে মার্চ ভোরে সাব এমজি, এন/সাব আমির আলী এসকে, এন/সাব মোয়াজ্জেম হোসাইন, এন/সাব মীর মোকাদ্দাস, এন/সাব মমিনুল হক তাদের সৈন্যসহ আমাদের সাথে যোগ দিল। প্রায় ৪০০/৫০০ সৈন্য নিয়ে আমরা শত্রুকে কোণ ঠাসা করে ফেললাম। অন্যদিকে Coy কমান্ডার sub সুকুর পার্বতীপুরের দিকে এগিয়ে গেল।
.
২৯/৩০ মার্চ রাতে সৈয়দপুর থেকে পাক সৈন্যদের জন্যে ফিল্ডগান পাঠানো হলেও রাস্তাঘাট বন্ধ থাকার কারণে সেগুলি তাদের কাছে পৌঁছেনি। ৩১শে মার্চ দুপুরে শত্রুপক্ষ ভয়াবহ আক্রমণের স্বীকার হল। সৈয়দপুর থেকে পাকবাহিনীর জন্যে আসছে জেনে পাক সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কোরায়েশী অসংখ্য সৈন্য নিয়ে ফুলবাড়ি রোড দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু সেখানে তারা সাব সুকুরের কয়দের দ্বারা বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে শত্রুরা রাস্তা পরিবর্তন করে মোহনপুর ব্রিজের কাছাকাছি যাওয়ার পর সেখানে আমাদের আরেক দল সৈন্য তাদের আক্রমণ করে। সেখানে বাধাগ্রস্ত হয়ে পাকবাহিনী রাজবাড়ি-রানীনগর সড়ক দিয়ে সৈয়দপুরের দিকে গেল। ভুষির বন্দর এরিয়ায় শত্রুরা আমাদের উপর গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে ফলে আমরা আর বেশি দুর তাদের ধাওয়া করতে পারিনি।
.
৩০/৩১ মার্চ পুরো রাত বাঙ্গালী ইপিআর গুলি চালালো কিন্তু পাক সৈন্যদের কোন পালটা জবাব না পেয়ে আমাদের সৈন্যরা আরো ১০ কি.মি. সামনে এগিয়ে গেল। শত্রুর মোকাবেলা করার জন্যে রাজবাড়ি দিঘীর ডানপাশে রানীনগর ভুষি এলাকায় এন/সাব লুতফর রহমানের নেতৃত্বে একটি পি.আই রাখা হল এবং আমরা দিনাজপুর শহরে শত্রুর সব প্রবেশপথ দখল করে ফেললাম। ৩১ তারিখ দুপুরের মধ্যে আমরা পুরো দিনাজপুর শহর শত্রু মুক্ত করলাম।
.
৩১-৩-৭১ তারিখে সবই পিআর সৈন্য এবং প্রায় ১৫০/২০০ পুলিশ, আনসার ও জিহাদি প্রতিরক্ষা বুহ্য গড়ে তুলল। বেলা নয়টার দিকে দিনাজপুর জেল খুলে দেয়া হলে মি. গুরুদাস তালুকদার, বড়ুদা ভূষণ চক্রবর্তী, ছাত্রসহ সব রাজনৈতিক নেতারা মুক্তি পেল। সকল সরকারী এবং বেসরকারি ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানো হল এবং এসডিও, পুলিশ এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের যার যার দায়িত্ব পালন পুনরায় শুরু করার নির্দেশ দেয়া হল।
.
৩০/৩১ মার্চ সন্ধ্যায় হ্যাভ ইদ্রিসের প্যাট্রোল পার্টি মেজর এম এইচ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন নজরুল হক, মি. ফাইজুদ্দিন আহমেদ, জেলা জজ মি. শাহাদাত হোসেন সহ আরো কয়েক জনকে সপরিবারে উদ্ধার করলো যদিও আমরা খবর পেয়েছিলাম যে ২৮/২৯ তারিখে পাক আর্মিরা তাদের সবাইকে হত্যা করে ফেলেছে।
.
ঠাকুরগাঁও অপারেশনে পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেন নাভীদ আলম ও তার স্ত্রীকে বাচাতে গিয়ে আমাদের বাঙ্গালী কিউ এম ক্যাপ্টেন নাজির আহমেদ জনগণের হাতে খুন হয়। সে দায়ী করেছিল যে নাভিদের স্ত্রী তার বোন হয়। সাব আতাউল হক, এল/এন কে জয়নাল আবেদীনও একই ভাবে খুন হয়।
.
১-৪ এপ্রিল পর্যন্ত দিনাজপুরে আমরা পুলিশের সহায়তা নিয়ে শহর ও আশেপাশের এলাকাগুলোতে চিরুনি অভিযান চালালাম এবং সবাই নিজ নিজ কাজ নিরাপদে শুরু করল। পরিবহন পুনরায় চালু করা হল।
.
১লা এপ্রিল আমি রিয়ার হেডকোয়ার্টারে ক্যাপ্টেন নজরুল হককে রেখে আমার শহরের হেডকোয়ার্টারে গেলাম। সেখানে প্রতিরক্ষা বুহ্য আরো প্রসারিত করলাম। ভুষির বন্দর থেকে সৈন্যদের আরো ১০ মাইল এগিয়ে নিলাম। পার্বতীপুর ও সৈয়দপুর দিয়ে শত্রুর আগমন দমাতে প্রতিরক্ষা রাজবাড়ি থেকে শিবপুর নালা পর্যন্ত প্রসারিত করলাম। ফুলবাড়ি রুট এবং ট্রেন দিয়ে আসা শত্রুর আগমন ঠেকাতে প্রতিরক্ষা আনন্দনগর থেকে ছিরির বন্দর পর্যন্ত বিস্তৃত করা হল।আরও দিকে সাব শুকুর পার্বতীপুর আক্রমণ করলো।
.
৩/৪ এপ্রিল ক্যাপ্টেন আশরাফের একটি পি.আই এবং শিবগঞ্জ এয়ারপোর্ট সম্পর্কে তথ্য নেয়ার জন্যে ৩য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট অনেক প্ররোচনার পর আমাদের সাথে যোগ দিল। এয়ারপোর্ট সম্পর্কে তথ্য নিয়ে সৈয়দপুর ফিরে যাওয়ার পথে সমস্যা শুরু হল। ফলে তারা ঠাকুরগাঁওয়ে আটকে গেল।
.
২/৩ থেকে ৪/৫ এপ্রিল পর্যন্ত, যখন আমাদের সীমান্তবর্তী সব লোকজন দিনাজপুর পৌঁছল, আমরা আমাদের পিআই/কপি দের চিনতে পেরে তাদেরকে দিনাজপুর জেলার বিভিন্ন ফ্রন্টে নিয়োজিত করলাম। এই কাজে এমএনএ/এমপিএ, সাধারণ জনগণ এবং ছাত্র সমাজ যথাসম্ভব আমাদের সাহায্য করেছিল।
.
৩/৪ এপ্রিল আমি সাব মেজর কাজিমুদ্দিন, ক্যাপ্টেন নজরুল হক, ক্যাপ্টেন আশরাফ, মেজর এমএইচ চৌধুরী এবং মেজর এমটি হোসাইন (অবঃ)ভাটগাও ব্রিজে আমাদের পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা নিয়ে বৈঠক করলাম।
.
মেজর এমটি হোসাইন এর মত বিখ্যাত এবং অভিজ্ঞ অফিসার পেয়ে আমরা ব্যাপক আকারে অপারেশন চালিয়ে শত্রুদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার পরিকল্পনা হাতে নিলাম। পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা মূল পয়েন্টে আমাদের সৈন্য মোতায়েন করলাম এবং শক্তিশালী বুহ্য গড়ে তুললাম।
.
হানাদার বাহিনী যাতে জংগল দিয়ে দিনাজপুর শহরে ঢুকতে না পারে সেজন্য এন/সাব লুতফর এবং হ্যাভ কিবরিয়ার নেতৃত্বে আমরা রাজবাড়ি ও রানীনগর রোডে সৈন্য মোতায়েন করলাম। ক্যাপ্টেন নজরুল হককে ইপিআর সৈন্যদের অপারেশন কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ করা হল। হেডকোয়ার্টারে প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে রাখা হল মেজর ওসমান গনিকে। আমি তখন দিনাজপুর শহর ও তার আশেপাশের এলাকা এবং রানীনগর এলাকার কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করছিলাম। ২/৩ এপ্রিল থেকে ৭৭/৭৮ বিএসপি অফিসারেরা আমাদের সাথে নিয়মিত দেখা করে গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিত। আমরা তাদের কাছে ভারি অস্ত্র সাহায্য চেয়েছিলাম কিন্তু তারা আমাদের কোন এক কারণে ছোট ছোট অস্ত্র সরবরাহ করলো। আমরা ঘোরাঘাট এবং ভাটাগাও ব্রিজ এলাকায় সৈন্য মোতায়েন করলাম।
.
নীলফামারী সংঘর্ষঃ ৬ এবং ৭ এপ্রিল ৮ উইং এর সাব এমজি দের ৭১ কয় এর সাথে শত্রুপক্ষের বিভীষিকাময় যুদ্ধে একজন ইপিআর জওয়ান এবং দুজন আনসার নিহত হল এবং কয়েকজন আহত হল। যুদ্ধে আমাদের আইএমজি [ভিকার] ও একটি ৩” মর্টার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমাদের সৈন্যরা সেখান থেকে দেবীগঞ্জের দিকে গেল। হানাদারেরা নীলফামারীতে ঢুকে সাধারণ মানুষের উপর পাশবিক তান্ডব চালালো।
.
বদরঞ্জযুদ্ধঃ ৮ এপ্রিল, হানাদার বাহিনীর সাথে বদরগঞ্জে তুমুল সংঘর্ষ বাঁধল। আমাদের অবস্থান সম্পর্কে রাজাকাররা তাদের আগেই জানিয়ে দিয়েছিল। ফলে আমাদের সৈন্যরা আকস্মিক আক্রমণের শিকার হয়েছিল রংপুরে। যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ক্যাপ্টেন নিহত হল এবং এসপি’কে আটক করা হল। আমাদের দুজন সিপাহী এবং একজন গাড়িচালক নিহত হল এবং ক্যাপ্টেন আনোয়ার পায়ে আঘাত পেয়েছিল। পাক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি ছিল বর্ণনাতীত। পরে সৈন্যদের বদরগঞ্জ থেকে ফুলবাড়ি ডিফেন্সে নিয়ে যাওয়া হল। ফুলবাড়ি থেকে গিয়ে এন/সাব কাউছারের ইপিআর সৈন্যরা মোহনপুর ব্রিজে প্রতিরক্ষা ঘাটি তৈরি করল। একইসাথে এন/সাব মমিনুল হক তার পি.আই নিয়ে নওগাঁ এলাকায় স্থানান্তরিত হল।
.
ভুষির বন্দরঃ ৭ এবং ৮ তারিখে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে আমরা মেজর আশরাফকে হারালাম। ভুষির বন্দর থেকে আমরা আমদের সৈন্যদের দশমাইল-এ (টি জাংকশন) মোতায়েন করলাম। সেখান থেকে একটি সড়ক দিনাজপুরের দিকে গেছে আরেকটি গেছে ঠাকুরগাঁও উপ-বিভাগে।
.
আমি ৮ এপ্রিল সেখানে কমান্ডারে দায়িত্ব নিলাম। ঐদিন সন্ধ্যা থেকেই পাক বাহিনী আমাদের উপর ফিল্ডগান দিয়ে বোমা বর্ষণ শুরু করে। ৭/৮ এপ্রিল বিবিসির একটি টিম আমাদের এলাকা পরিদর্শনে আসে।
.
দশমাইলঃ ভুষির বন্দরের পর আমাদের সৈন্যরা আরো শক্তি বাড়িয়ে দশ মাইল এলাকায় নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলে। ক্যাপ্টেন নজরুল ইসলামের অনুপস্থিতিতে আমি ৮ এপ্রিল সেখানে কমান্ডারের দায়িত্ব নিলাম। বিখ্যাত কান্তনগর মন্দির এলাকা থেকে নাশিপুর পাট গবেষণা এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রানীনগর রাজবাড়ি সড়কে প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল এন/সাব এল রহমান এবং কিবরিয়া। হানাদারদের সাথে যুদ্ধে আমাদের অস্ত্রের পরিমাণ অপর্যাপ্ত হয়ে গেল। তবুও আমি দশমাইল থেকে দুই মাইল সামনে শত্রুদের আগমন ব্যাহত করতে কিছু সৈন্য পাঠালাম।
.
৯ তারিখ সকাল থেকে ১০ তারিখ বিকেল পর্যন্ত পাক আর্মিরা তিনটি অক্ষ থেকে আর্টিলারি গান দিয়ে আমাদের উপর লাগাতার গোলাবর্ষণ করলো। আমাদের দশজন সৈন্য নিহত হল এবং তুললাম ফলে শত্রুরা আর এগোতে পারল না। আমরা দশমাইল এলাকায় যুদ্ধ করার সময় মি. রহিম এমপিএ ব্যতীত অধিকাংশ এমএনএ/এমপিএ এবং জেলা কর্মকর্তা ভারত চলে যায় যেটা সৈন্যদের মনোবলে একটা কুপ্রভাব ফেলেছিল। দুঃখজনক ব্যাপার হল ভারি অস্ত্রের অভাবে আমরা যুদ্ধে বারবার পরাজিত হতে লাগলাম।
.
ভাটাগাও ব্রিজ ছিল পাক আর্মিদের সৈয়দপুর থেকে দিনাজপুরে ঢুকার সম্ভাব্য প্রবেশ পথ। সেখানে আমরা শত্রুকে প্রতিহত করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ১০ এপ্রিল দশমাইল এবং ভাটাগাও এলাকায় পরাজিত হয়ে ৯ উইং কন্টিনজেন্ট ঠাকুরগাঁয়ে অবস্থান নিলো। তারা কিছুক্ষণের জন্যে পাক বাহিনীকে তারা খানসামা ও দেবীগঞ্জ এলাকায় প্রতিহত করতে পেরেছিল। দশমাইল এলাকার পরাজিত হওয়ার পর দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও ফোরসের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
.
দিনাজপুর শহরের পতনঃ ১৪-০৪-৭১ তারিখে ৭/৮ ঘণ্টা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বেলা তিনটার দিকে পাক বাহিনী উভয় দিক থেকে ট্যাংক ও আর্টিলারি নিয়ে দিনাজপুর শহরে প্রবেশ করলো এবং মানুষের উপর পাশবিক তান্ডব চালাল। এই যুদ্ধে আমাদের ৫ জন সৈন্য নিহত হল। বাঁ প্রান্তে থাকা আমাদের সৈন্যরা বিরাল সীমান্তের দিকে গেল আর আমরা বড়গ্রাম সীমান্তের দিকে পিছিয়ে গেলাম। প্রায় রাত তিনটায় আমিসহ কয়েকজন বড়গ্রাম পৌছলে গ্রামবাসী আমাদের আশ্রয় দিল। বড়গ্রামের বিপরীত পাশে আম্লিয়া নামে বিএসএফের একটি ক্যাম্প ছিল। আমাদের সৈন্যরা সীমান্তবর্তী বিওপিতে অবস্থান নিলো। বাকিরা ১৪ তারিখ সন্ধ্যার মধ্যে বিভিন্ন রুট দিয়ে বড়গ্রাম পৌঁছল।
.
বিরাল যুদ্ধঃ পাক বাহিনী দিনাজপুর দখল করে নেয়ার পর আমরা দুই অক্ষে বিভক্ত হয়ে গেলাম। একটা অংশ বড়গ্রাম, খানপুর, মোহনপুর এবং আম্লিয়ার বর্ডারের দিকে গেল। আরেক অংশ গেল বিরাল বর্ডারের দিকে যেখানে নজরুল হক এবং ওসমান গনির তত্বাবধানে আমাদের রিয়ার হেড কোয়ার্টার ছিল। বিরাল ছিল কাঞ্চন নদীর পশ্চিম পাশে সেখানে স্থানীয়রা আমাদের সার্বিক সহায়তা করেছে। ১৬/১৭ তারিখে বিকেল ৪ টায় পাক বাহিনী বিরালে আক্রমণ চালিয়ে বিরাল দখল করে নেয়। প্রাক্তন ইপিআরের Hav নাসির আলী যুদ্ধে শহীদ হয়।
.
বিরাল থেকে আমরা বাংলাদেশের শেষ সীমান্ত পাঁচপাড়া গ্রামে পিছিয়ে গেলাম। ক্লান্ত-অবিশ্রান্ত সৈন্যরা সব ব্যাপারে হতাশ হয়ে গেল। বিএসএফ আমাদের অস্ত্র ও খাদ্য দিয়ে সহায়তা করল ফলে আমরা আবার পাক আর্মিদের বিরুদ্ধে আক্রমণের প্রস্তুতি নিলাম। ইতোমধ্যে বিরাল দখলের পর হানাদাররা কিশোরগঞ্জ দখল করে নিয়েছে। আমাদের পরিকল্পনা ছিল কিশোরগঞ্জ ও পাঁচপাড়া এলাকা শত্রু মুক্ত করা। তদনুযায়ী আমরা ২রা মে কিশোরগঞ্জ বিওপি এলাকায় আক্রমণ করলাম তিন অক্ষ থেকে। দিনাজপুরের ছাত্ররাও আমাদের সাথে যোগ দিল। ১০/১৫ কি. মি. দুর থেকে হানাদারেরা রাধিকাপুরে ভারতীয় সরকারের প্রতিষ্ঠিত উদ্বাস্তু ক্যাম্পে দুর পাল্লার গোলা বর্ষণ করল ফলে একজন নিহত ও কয়েকজন আহত হল। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুক্তি বাহিনীকে যুদ্ধ বন্ধ করার চাপ দিল। যাইহোক বহু চেষ্টার পর বাঙ্গালী ইপিআর, আনসার, মুজাহিদ এবং ছাত্ররা দখল করলো।
.
৩রা মে বিএসএফ মেজর বেদি রাধিকাপুর এসে মেজর ওসমান গনিকে সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে পাক বাহিনীর উপর হামলা চালাতে নিষেধ করলেন। কিছুদিন গেরিলা যুদ্ধ চলল। এতে আমাদের সিপাহী তোতা মিয়া শহীদ হল।
.
পরদিন পাক আর্মি বিএসএফকে বাঙ্গালী ইপিআরদের তাদের কাছে হস্তান্তর করার জন্য পতাকা বৈঠকে আহবান জানাল। তারা দাবি করলো যে তার আগের দিনের যুদ্ধে বাঙালি ইপিআর তাদের ৫০ জন সৈন্যকে হত্যা করেছে। বিএসএফ সেখানে কোন বাঙ্গালী সৈন্য অবস্থানের কথা সরাসরি অস্বীকার করল। তারপর থেকে আমরা জুন পর্যন্ত পাক সৈন্যদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে গেলাম।
.
মেজর রবের অধীনে যে সৈন্যরা বড়গ্রাম, খানপুর এবং আম্লিয়া সীমান্তে অবস্থান নিয়েছিল তাদেরকে ঐ এলাকায় শত্রু আক্রমণ ঠেকাতে পাহারায় রাখা হল। মেজর নিজাম ও ক্যাপ্টেন আনোয়ারের অধীনে ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি শক্তিশালী দল ফুলবাড়ি এবং পাহাড়ি এলাকায় ইপিআরের সাথে যোগ দিল। পাহাড়ি এলাকায় পরাজয়ের পর তারা ভারতের পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান নিলো।
.
ভারতীয় হিলি এলাকায় আমাদের সৈন্যরা কুরমাইল টেকনিক্যাল স্কুল এবং সুব্রা এলাকায় সমবেত হল। উল্লেখ্য যে আমার সাথে দশ মাইল এলাকায় যুদ্ধ করা এন/সাব নাসির মিয়ার অধীনে থাকা ৩য় ইপিআর সৈন্যদল ও আমার সাথে ছিল এবং তারা বর্ষগ্রাম এলাকায় সক্রিয় ছিল।
.
আমরা নওগাঁ ইপিআর ফোরসের সাথে কুরমাইল এবং সুব্রা এলাকা থেকে মোহনপুর ব্রিজ, ফুলবাড়ি, পাঁচবিবি, জয়পুরহাট, ধামুরহাট পড়শিপাড়া এলাকা ও হিলির আশপাশের এলায় পাক আর্মিদের উপর অতর্কিত হামলা চালাতে লাগলাম। মি. এম এ জলিল, মি. বায়তুল্লাহ এমএনএ, জাহাঙ্গীর এমএনএ এবং আমজাদ হোসেন এই এলাকায় এসে ২/৩টা যুব ক্যাম্প খুলল এবং সৈয়দ হায়দার আলী এমএনএ এবং সিরাজগঞ্জের অধ্যাপক আবু সায়ীদ এমএনএ গেরিলাদের প্রশিক্ষণ দিতে দুইটা যুব ক্যাম্প খুলল। ৭ উইং ইপিআর ওয়ান এর লে. (অপসারিত) ইদ্রিস বি ইউ স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো। সে ছিল একজন বীর যোদ্ধা।

————————————————-