দিনাজপুর জেলায় সশস্ত্র প্রতিরোধ
সাক্ষাৎকারঃ সুবেদার আরব আলী
…১৯৭২
২৫ শে মার্চের পাকবাহিনীর পৈচাশিক ঘটনার কথা আমরা ২৬ শে মার্চ সকালবেলা জানতে পারি এবং সঙ্গে সঙ্গে আমরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়ে যাই।এই দিন থেকে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনগন খানসেনা আসার সম্ভাব্য সকল রাস্তায় বেরিকেড রচনা করে।এই সময় জনগন ক্রুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং জনসাধারণের মনে প্রতিহিংসার আগুন জ্বলতে দেখা যায়।চারদিকে একটা মার-মার,কাট-কাট অবস্থার সৃষ্টি হয়।
২৭ শে মার্চ পাঞ্জাবী বাহিনী দিনাজপুর কুটিবাড়ী ইপিআর হেডকোয়ার্টার আক্রমন করে এবং সমস্ত ইপিআরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করে।এই সময় ইপিআররা পাঞ্জাবীদের প্রতি পাল্টা আক্রমন চালায়।উভয় পক্ষ মর্টার ও কামান মারতে থাকে।আমরা বর্ডার থেকে মুহুর্মুহু কামানের গর্জন শুনতে পাচ্ছিলাম।এই সময় দেখতে পাই হাজার হাজার নিরিহ শহরবাসী ভারতের দিকে রওনা দিচ্ছে। এই সময় আমি আমার উপরস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে পাক হিলি বর্ডারে যোগাযোগ করি।
২৯ শে মার্চ ভোরে ভাইগর বিওপিতে অবস্থানরত একজন পাঞ্জাবী ইপিআর হাবিলদার ও একজন নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হয়।এই দুইজনকে খতম করে আমি রুধরানী বিওপিতে চলে যাই।সেখানে অবস্থানরত একজন পাঞ্জাবী হাবিলদার ও একজন সিপাইকে জিন্দা বন্দী করি।এরপর আমি রানীনগর প্লাটুন হেডকোয়ার্টারে চলে আসি।এখানে একজন পাঞ্জাবী ল্যান্স নায়েককে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং একজন সিপাইকে জিন্দা বন্দী করে তাকে পাবলিকের হাতে তুলে দিই।পরে জনসাধারণ তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলে।
ফুলবাড়ী সংঘর্ষঃ ২৯ শে মার্চ উপরোক্ত ঘটনার পর আমি আমার সমস্ত জাওয়ানদেরকে একত্রিত করি।ফুলবাড়ী আসার দুই মাইল দূরে থাকতে খবর পাই যে পাঞ্জাবী সৈন্যরা দিনাজপুর থেকে ইপিআর-এর হাতে মার খেয়ে পার্বতীপুর যাবার জন্য ফুলবাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।এই কথা শোনার পরপরই ভীষণ গোলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাই।খবর নিয়ে জানতে পারি যে ফুলবাড়ি থেকে ইপিআররা পাকবাহিনীর গতিরোধ করেছে।এই খবর পাবার পর খুব তাড়াতাড়ি আমি আমার জওয়ানদেরকে নিয়ে ফুলবাড়ি যাবার পথে হাসপাতালের কাছে রোড ব্লক করলাম।আমরা পজিশন নেবার পরপরই পাঞ্জাবীরা অবস্থা বেগতিক দেখে পিছু হটতে আরম্ভ করে এবং কিছু সৈন্য গাড়ী ফেলে কোনাকুনি মাঠের মধ্য দিয়ে পার্বতীপুরের দিকে অগ্রসর হয়।আমরা তাদের পিছু নেই এবং আক্রমন চালাই।এই যুদ্ধে ফুলবাড়ি বাজারের মোড়ে ৭ জন খান সেনার লাশ পাওয়া যায়। একজন সিগন্যাল ম্যানকে আহত অবস্থায় পাওয়া যায় এবং সঙ্গে ২ টা চাইনিজ মেশিনগান ও ৫ টা রাইফেল আমরা হস্তগত করি।এই সময় ১ টা জীপ ও ২ টা ডজ গাড়ী আমাদের হাতে আসে।
পার্বতীপুরে বিহারীদের লুটপাট ও সংঘর্ষঃ অতঃপর এপ্রিল মাসের ৭ তারিখে আমরা জানতে পারি যে পার্বতীপুরের বিহারীরা নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে ব্যাপক হারে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করছে।তারা নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করছে।এই খবর পাবার পর আমি আমার প্লাটুন নিয়ে পার্বতীপুরের নিকটে গ্রামগুলির নিরাপত্তা বিধানের জন্য যাই।আমরা যাবার পর প্রায়ই বিহারীরা আমাদের উপর গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে এবং সুযোগ বুঝে লুটপাট চালাতে থাকে।
১০ ই এপ্রিল স্থানীয় হাজার হাজার লোক এসে আমাকে জানায় যে বিহারীরা অত্যাচারের চরম সীমায় পৌঁছেছে।কাজেই তাদের যে কোন প্রকারে শায়েস্তা করতে হবে।তখন আমি হাজার হাজার জনতার সঙ্গে একত্রিত হয়ে আমার বাহিনী নিয়ে পার্বতীপুরের বিহারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি প্রথমদিকে বিহারীরা আমাদের প্রতি গোলাগুলি নিক্ষেপ করতে থাকে,কিন্তু কিছুক্ষণ পর তারা আমাদের গোলার মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটতে থাকে।বিহারীরা এই সময় লাইন ধরে সৈয়দপুরের দিকে যেতে থাকে।হিংস্র জনতা পলায়নরত বিহারীদের উপর চড়াও হয় এবং যাকে যাকে পায় পিটিয়ে মেরে ফেলে।ঐদিন আনুমানিক প্রায় ৪০০/৫০০ লোক মারা যায়।এই সময় পার্বতীপুর পুরাপুরি আমাদের আয়ত্তে এসে যায়।
১১ ই এপ্রিল সৈয়দপুর থেকে ৩ টনী ৩টা গাড়ী, ২টা জীপ বোঝাই খানসেনা পার্বতীপুর আসে এবং আমাদের উপর প্রবলভাবে গোলা বর্ষণ করতে থাকে ঐদিন সন্ধ্যার পর উভয় পক্ষ থেকে গোলাগুলি বন্ধ করা হয়।এই সময় আমাদের কাছে গোলাবারুদ প্রায় শেষ হয়ে আসে।সারা রাত্রি আমরা বহু জায়গায় যোগাযোগ করেও কোন গোলাবারুদ জোগাড় করতে পারিনি।
১২ ই এপ্রিল সকাল ৮ টার সময় সেনারা পুনরায় আমাদের অবস্থানের উপর গোলাবর্ষণ করতে থাকে।এই সময় তারা মর্টার থেকে আমাদের উপর গোলাবর্ষণ করে।কিছুক্ষন যুদ্ধ চলার পর আমরা আর টিকতে পারি না,বাধ্য হয়ে পিছু হটতে থাকি।এখানে আমার একজন সিপাই মারা পড়ে এবং খোলাহাটিতে ৩ নং বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আনোয়ার সাহেবের কাছে যাই এবং তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করি।কিন্তু সে জানায় যে,তার কাছে তেমন কোন অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নাই।তখন বাধ্য হয়ে আমরা ফুলবাড়ি হেডকোয়ার্টারে চলে যাই।অতঃপর আমি ফুলবাড়ি ক্যাম্প থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ওখান থেকে আরও জওয়ান ও আনসার নিয়ে ১৫ই এপ্রিল পুনরায় পার্বতীপুরের দিকে যাত্রা করি।এবং আমরা পার্বতীপুরের আগের রেলস্টেশন ভাবানীপুরের হাওয়া গ্রামে ডিফেন্স করি।
১৬ ই এপ্রিল খান সেনারা পার্বতীপুর থেকে ১টা ট্যাঙ্কসহ ভারী ভারী অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত হয়ে সকাল ১১ টার দিকে আমাদের উপর আক্রমন চালায়।প্রায় ১ ঘন্টা যুদ্ধ চলার পর খান বাহিনীর ট্যাঙ্কের গোলার মুখে পরপর আমার ৩ জন আনসারসহ ৫ জন সিপাই মারা যায়।এই সময় আমার সিপাই মোঃ হোসেনের মাথার উপর ১ টা মর্টারের গুলি এসে পরে এবং সঙ্গে সঙ্গে সে ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।বাধ্য হয়ে আমরা পিছু হটে ফুলবাড়ির দিকে যাত্রা করি এবং এই সময় আমাদের পিছু পিছু খানসেনারা ফুলবাড়ির দিকে যাত্রা করে।
ঐদিনই বিকাল প্রায় ৫টার দিকে খানসেনারা ফুলবাড়িতে আমাদের হেডকোয়ার্টারের উপর প্রবল আক্রমন চালায়।এই সময় তারা ট্যাঙ্ক,মর্টার,কামান,মেশিনগান ব্যবহার করে।রাত ৮টা পর্যন্ত খানসেনাদের সঙ্গে চলে যাই।এই সময়ও আমাদের মনোবল অটুট থাকে।
১৮ই এপ্রিল খান সেনারা হিলি আক্রমণ করে। এখানে ভীষন যুদ্ধের পর আমরা ভারতের দিকে চলে যাই।
—————————————