You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.03 | স্বীকৃতিদানের আহবান জানিয়ে প্রকাশিত, সম্পাদকীয়ঃ অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন | “দৈনিক আনন্দবাজার” - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
১০৬। স্বীকৃতিদানের আহবান জানিয়ে প্রকাশিত, সম্পাদকীয়ঃ অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন “দৈনিক আনন্দবাজার” (সম্পাদকীয়) ৩ এপ্রিল, ১৯৭১

অবিলম্বে স্বীকৃতি দিন

এই চ্যালেঞ্জ কাহার প্রতি? পূর্ব বংগ বা “বাংলাদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের? সে তো নিশ্চয়ই। মরণপণ এক সংগ্রামে তাঁহারা জড়াইয়া পড়িয়াছেন। সভ্যতার ইতিহাসে চরম এক সংকটের, ভয়ংকর এক দুর্যোগের সাত-সাতটা দিন পার হইয়া গেল, তাঁহাদের অগ্নি পরীক্ষার এখনও শেষ নাই। সেই আগুনে কত জনপথ পুড়িয়া ছাই হইল, ওই বাংলার নদী-জপমাল দৃত প্রান্তর ছারেখারে গেল, বীরের রক্তস্রোত, অশ্রু ধারার সংগে মিশিয়া লবণাক্ত মোহনার পর মোহনার দিকে বহিয়া গেল, কিন্তু কী আশ্চর্য বাহির বিশ্বের কাহারো যেন তন্দ্রা আজও ছুটিল না।

অথচ আবহমান কালের ইতিহাসে এমন দৃশ্য কোথাও দেখা গিয়াছে কিনা সন্দেহ। একটা জোড়াতালি রাষ্ট্রের মাইনরিটি মেজরটিকে পায়ের তলা থে’তলাইয়া দিতে চায় শুধু তাই নয়, দরকার হইলে গোটা একটা মানবগোষ্ঠীকে তাহারা উৎসাধন করিবে, এই তাহাদের আস্ফালন। নতুবা পশ্চিম পাক, ফৌজ কীসের আশায় ওখানে চড়াও হইয়াছে, তাহার অন্য কোনও ব্যাখ্যা হয় না। একটা জাতিকে বিলকূল ফৌৎ করিয়া নূতন পত্তনি স্থাপন না করিলে তো তাদের মতলব হাসিল হয় না। পারিবে কি পারিবে না সেটা স্বতন্ত্র প্রশ্ন। তবে ইহা ঠিক, তুড়ি মারিয়া সব ঠাণ্ডা করার-কেল্লাফতে করার-লড়াই ইহা নয়।

সবচেয়ে লজ্জার কথা এই-বাহিরের দুনিয়ায় যেন ঠাণ্ডা রক্ত, অপ্রকোপিত পিত্তে চুপ করিয়া সব দেখিতেছি। হতমান, হতবল ব্রিটেনের কথা না বলাই ভাল-তথাকথিত কমন ওয়েলথের একটি দেশের দুই ভাগে যুদ্ধ। ব্রিটেন এতএব পড়িয়াছে উভয় সংকটে। আর এক মুরুব্বী আমেরিকা এখনও সুযোগ সন্ধানী বেড়ার উপর বসিয়া; হিতোপদেশের বাঁশি বাজাইতেছে। নীরো ইহার চেয়ে বড় অপরাধ করেন নাই। রুশ আচরণের সংগে ওই দেশের ঐতিহ্যের মিল আছে। কী করিয়াছিলেন স্টার্লিন, ত্রিশের দশকে স্পেনের প্রজাতন্ত্রী বাহিনী যখন জবরদস্ত হুকুমতের সংগে লড়াই করে? পিকিংয়ের কথা না তোলাই ভাল। পিণ্ডিচক্রের সংগে তার দোস্তি সুবিদিত। আর রাষ্ট্রপুঞ্জের নায়ক প্রগতিবাদী শ্রীযুক্ত উথাণ্ট? হস্তক্ষেপ দূরে থাক, তিনি মানবতার তাগিদে আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে নিজে এত্ত লা দিতে চান না-বরাত দিয়েছেন ভারতকে কি গণতন্ত্রের, কি সমাজতন্ত্রের ধ্বজাদারী-সব পুরোহিতই নির্বাক।

আর চমকপ্রদ ছোটখাটো প্রতিবেশী বা কাছাকাছি দেশগুলির ভূমিকা। ভারতের উপর দিয়া বন্ধ আকাশপথটি ঘুরপথে খোলা রাখার সব রকম সুবন্দোবস্ত করিয়া দিয়াছে বামপন্থী রাষ্ট্র সিংহল। সেখানকার অধিনেত্রী শ্রীমতি বন্দরনায়েককে “মা” বলিয়া ঢাকা, নৈতিক ও কূটনৈতিক চাপ, কিছুতেই সিংহলের মন টলে নাই। শতাধিক বিমান এযাবৎ পূর্ব বংগ হইতে পশ্চিমে ফেরার পথে সিংহলে নামিয়েছে। কিন্তু পশ্চিম হইতে রোজ কত জেট গিয়াছে পূর্বে তাহার নাকি কোন সরকারী হিসাব নাই। আর বর্মার নে উইন-সরকার পাক জাহাজকে তেল দিতেছেন। তেল দেওয়াটা আক্ষরিক ও রূপক উভয় অর্থে। এবং শ্রী নে উইনও নাকি সমাজমন্ত্রী। “বাংলাদেশ” সরকার করুণ আবেদন জানাইয়াছেন বিশ্বকে “পশ্চিম পাকিস্তানকে আর মারণাস্ত্র জোগাইবেন না। আপনাদের নিকট হইতে পাওয়া আয়ুধে উহারা আমাদেরই মারিতেছে। ”

বৃথা এ ক্রন্দন। সব কর্ণ বধির কেহ শুনিবে না। সব চতুর মন জানে, রুটির কোন দিকটায় মাখন-মাখানো। অতএব বিশেষ দায় আসিয়া পড়িতেছে ভারতেরই উপর। এ দায় নৈতিক এ দায় মানবিক। এদেশে হৃদয়াবেগের বান ডাকিয়াছে রক্তের। অতীতে এই ভারতই আফ্রো-এশিয়ার হইয়া পিসীমার ভূমিকা অনেক লইয়াছে, কিন্তু বিনিময়ে পাইয়াছে গলাধাক্কা-অনন্তঃ কোনায়। আরবদের হইয়া গলা ফাটাইয়া ইজরাইলকে আসামী বানাইয়াছে, অথচ কাশ্মীরের ব্যাপারে এ ছটাক আরব নেক নজরও কুড়াইতে পারে নাই। এবার যাহা ঘটিতেছে, তাহা কিন্তু ভারতেরই দ্বারপ্রান্তে। ঝাপটা ঝটকা সব এই দেশের গায়েই লাগিবে। যদি-যদির কথা বলিতেছি- ‘বাংলাদেশের প্রজ্বলিত প্রাণাগ্নি নিবু-নিবু হয় তবে দলে দলে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বিপন্ন বিতাড়িত মানুষের জোয়ার এ দেশের তটে আছড়াইয়া পড়ে ঠেকাইবে কে? প্রশ্নটা তাই ভারতের পক্ষে শুধু মানবতার নয়-আত্মরক্ষার। ওখানকার সংগ্রাম আমাদেরও সংগ্রাম।

ওই দেশের অগণিত মানুষ আজ বড় আশায় এ দেশের দিকে চাহিয়া আছে। আমরা কী দিব তাহাদের কি দিতে পারি? শুধু মামুলী রিলিফ নয়। সেটা এই পরিস্থিতিতে যাহারা রুটি চায় তাহাদের পাথর মারিয়া ফিরাইয়া দেওয়ার মন। এমনকি শুধু হালকা হাতিয়ারে কুলাইবে না। রণাংগনের শেষের দিকটার রিপোর্টে ক্রমশঃ স্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে যে, ‘বাংলাদেশের’ মুক্তিফৌজের সব আছে-বীরত্ব সাহস ইত্যাদি সবকিছু-কিন্তু শুধু সাহস, এমন কি শুধু শত-সহস্র-লক্ষ শির ডালি দিয়াও এ যুগের যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত হয়তো জেতা যায় না। ভারী অস্ত্র এবং মাথার উপর ‘বিমানছত্র’ চাই। ওই একটি বিষয় বাংলার মুক্তিফৌজ আজও অসহায় হইয়া আছে, বিপক্ষ তাহার পূর্ণ সুযোগ লইতেছে। ‘জেনারেল মনসুন কবে দেখা দিবেন কে জানে, তাহার আগে বাংলাকে বাঁচানো চাই-বাঁচানোর উপকরণ সরবরাহ একান্ত জরুরী। যতটা তাহাদের স্বার্থে ততটা আমাদেরও যদি কূটনৈতিক কলংকের ভয়টাই বাধা হইয়া থাকে তবে সেটাকেও দূর করার সোজা রাস্তা আছে-সে রাস্তা লওয়ার বিস্তর ঐতিহাসিক নজিরও বর্তমান ও বিদ্যমান-অস্থায়ী ‘বাংলাদেশ’ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি।