শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
১০৫। বাংলাদেশের সমর্থনে সারা পশ্চিম বংগেহরতাল পালিত | দৈনিক ‘যুগান্তর’ | ১ এপ্রিল, ১৯৭১ |
ওপারে লড়াই এপারের সমর্থন
সারা পশ্চিমবঙ্গ হরতালে সামিল
(স্টাফ রিপোর্টার)
কলকাতা ৩১ মার্চ-বাংলাদেশের মানুষের বীরত্বব্যাঞ্জক আন্দোলনের প্রতি সমর্থন, সহানুভূতি এবং একাত্মতা জানিয়ে পশ্চিম বাংলার মানুষ আজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাধারণ ধর্মঘট ও হরতাল পালন করেছেন। জীবন-মরণ যুদ্ধে লিপ্ত ও বাংলার আট কোটি মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন এ বাংলার পাঁচ কোটি বাঙ্গালী। তাঁদের ব্যথায় ব্যথিত, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার ভাগীদার।
বাংলা বিভক্ত হবার পর এই প্রথম এ-বাংলার বাঙ্গালীর প্রতি প্রকাশ্যে এবং সোচ্চারে সহানুভূতি ও সমর্থন জানালেন।
দোকান-পাট, বাজার-হাট, কল-কারখানা বন্ধ রেখে, যানবাহন তুলে রেখে, সমস্ত আনন্দানুষ্ঠান বাতিল করে দিয়ে এ বাংলার বাঙ্গালী তাঁর একান্ত আপনজন ও বাংলার বাঙ্গালী বীর শহীদের প্রতি অন্তরের শ্রদ্ধার নিদর্শনরূপে আজ ‘শোকদিবস’ পালন করে বর্বরতার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও ঘৃণা প্রকাশ করেছেন।
পরম আত্মীয়ের বিয়োগ ব্যথায় মহানগরীর সর্বত্র আজ কালো পতাকা। পথের মোড়ে মোড়ে শহীদ বেদী। শ্বেতশুভ্র শহীদ বেদীগুলি ধূপধূনা আর ফুলে ফুলে সাজান।
শহীদ বেদীর পাশে অর্ধনমিত জাতীয় পতাকা। আর কালো পতাকা। নাগরিকদের বুকে কালো ব্যাজ। এই ‘কালিমা’ একাধারে প্রতিবাদ অন্যদিকে ধিক্কার। স্বাধিকার আন্দোলনে নিহত সৈনিকদের জন্য শোকের ছায়া সর্বত্র পরিব্যপ্ত।
বাঙ্গালীর বাঁচার দাবীর সমর্থনে এই শহরে সকালে এবং বিকালে অনেকগুলি প্রতিবাদ মিছিলও বের হয়। মিছিলের আওয়াজ বাঙ্গালীর জয়ধ্বনি। উদ্যোক্তা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। কতকগুলি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে শহরের নানান এলাকায় অর্থ সংগ্রহ অভিযানও শুরু হয়েছে। অর্থ সংগ্রহ অভিযানে মহিলারাও এগিয়ে আসেন।
বিনা হাঙ্গামায় এমন সর্বাত্মক ধর্মঘট কলকাতা ইতিপূর্বে খুব কমই প্রত্যক্ষ করেছে। দোকান-পাট বন্ধের জন্য এদিন কাউকে শাসাতে হয়নি। কিম্বা মিছিল নিয়ে গিয়ে বোমাও নিক্ষেপ করতে হয়নি। রেল লাইন অবরোধ করার আগেই ট্রেন বন্ধ। লোক্যাল ট্রেন ’ত চলেইনি, দূর পাল্লার ট্রেনগুলি পর্যন্ত আজ এ রাজ্যে ঢোকেনি। হাওড়া-শিয়ালদা খাঁ খাঁ করছে। স্ট্যাণ্ডে রিকশা আছে-কিন্তু চালক নেই।
বন্দরেও একই দৃশ্য। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো যে কর্মবহুল বন্দর বাঁচিয়ে রাখছে সেই কোলাহলমুখর কলকাতা বন্দরেও আজ কোন সাড়াশব্দ নেই। সারি সারি জাহাজ দাঁড়িয়ে আছে, কোন কাজ হয়নি। শ্রমিকরা কাজ করেনি।
বিমান বন্দরে
দু’দিন আগে বিমান ধর্মঘট মিটেছে। কিন্তু বাংলাদেশে নিরস্ত্র মানুষের উপর জঙ্গীশাহীর বর্বরতার প্রতিবাদে বৈমানিকরা আজ বিমান চালায়নি। আনন্দানুষ্ঠান-সিনেমা, থিয়েটারগুলিও আজ পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
বাংলাদেশের সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্রকে অবিলম্বে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেবার দাবীতে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের উপর জঙ্গীশাহীর বর্বর আক্রমণের প্রতিবাদে আজ পশ্চিম বাংলায় এই ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন রাজ্যের রাজনৈতিক দলগুলি, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এবং ছাত্র সংগঠনগুলি।
এদিন সকাল থেকেই দফায় দফায় যুবকরা-ছাত্ররা শেখ মুজিবরের জয়ধ্বনি দিতে দিতে পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন অফিসে এসে জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে বিক্ষোভে জানান। একদল যুবক এবং ছাত্র বার ঘণ্টার জন্য অনশন ধর্মঘট শুরু করেছেন এই অফিসের সামনে।
উত্তর থেকে দক্ষিণে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে সর্বত্র ঘুরেছি আজকের ধর্মঘট নিয়ে কোথাও কোন হামলার খবর পাইনি। বেলেঘাটা, শোভাবাজার, দমদম, জোড়াবাগান, বরানগর ইত্যাদি অশান্ত এলাকাগুলিও বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা আন্দোলনের সমর্থনে এদিন শান্ত ছিল। পথের মোড়ে যুবকদের জটলা এ দৃশ্য মহানগরীর সর্বত্র।
রাজপথগুলি খালি পেয়ে ফুটবল হকি এমনকি ডাঙ্গুলী খেলোয়াড়েরা তা দখল করে নেয়।
দক্ষিণের কয়েকটি স্থানে দেখলাম শহীদ বেদীর সামনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। হাত দিয়ে তিনি নির্দেশ দিচ্ছেন-তার নীচে লেখা ‘এত তাজা প্রাণ বলি হচ্ছে, তবু দুর্গম যাত্রাপথে কোন বাধা মানব না। ’ কোথাও কোথাও বাড়ীর শীর্ষেও অর্ধনমিত জাতীয় পতাকার সঙ্গে কালো পতাকা উড়তে দেখা যায়। সরকারী, আধা-সরকারী বেসরকারী অফিসে, কল-কারখানায় সর্বত্র তালাবদ্ধ।
যুব কংগ্রেসের অনশন
স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাক সেনাবাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদে এন্টালী যুব কংগ্রেসের উদ্যোগে মিডল রোড ও সি আই টি মোড়ে এবং এনটালী মার্কেটের কাছে ১২ ঘণ্টার জন্য অনশন পালন করা হয়।
হাওড়ায় হরতাল
হাওড়া শহর ও গ্রামাঞ্চলে আজ স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল পালিত হয়। ট্রাম, বাস, ট্রেন ও অন্য যানবাহন বন্ধ ছিল। বিনা পিকেটিং-এ হরতালের দিন হাওড়ায় কল-কারখানা বন্ধ হওয়ার ঘটনা এই প্রথম।
পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর অত্যাচারের প্রতিবাদে শহরে ২৩টি বড় বড় মিছিল এবং উত্তর হাওড়া ও শিবপুরে শাসক কংগ্রেসের উদ্যোগে দুটি বড় জনসভা বাংলাদেশের মুক্তিফৌজকে অভিনন্দন জানায়।
সারা পশ্চিম বঙ্গে হরতাল
আবেগ মথিত হ্নদয়ে ও বাংলার মানুষের সঙ্গে এ-বাংলার মানুষ ধ্বনি তুলেছেন ‘শহীদের রক্ত তারা বৃথা যেতে দেবে না’।
উত্তরে দার্জিলিং থেকে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত গোটা পশ্চিম বাংলায় আজ সফল ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হওয়ায় রাজ্যের রাজনৈতিক দল, ট্রেড ইউনিয়ন সংস্থা, ছাত্র-শিক্ষক-যুব এবং মহিলা সংগঠনগুলিও বুদ্ধিজীবী সংস্থাগুলির পক্ষ থেকে আলাদা বিবৃতিতে এ বাংলার সংগ্রামী মানুষকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
যাঁরা বিবৃতি পাঠিয়েছেনঃ সি-পি-এম, সি-পি-আই, ছয় পার্টির আহবায়ক, বিদ্রোহী পি-এস-পি, ভারতীয় বলশেভিক পার্টি, সারা বাংলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতি, দুই ছাত্র ফেডারেশন, পি-এস-ইউ, ডি-এস-ও, এস-ইউ-সি, আর-এস-পি, সি, ক্যালকাটা প্রেস ওয়ার্কস ইউনিয়ন, নিখিল-বঙ্গ মহিলা সংঘ, পশ্চিম বঙ্গ নার্সেস ক্যাডার্স এসোসিয়েশন, ইউ-টি-ইউ-সি, সারা বাংলা মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি, বিপ্লবী যুব সংস্থা, ইউনাইটেড কিষাণ সভা, হাইকোর্টের বার এসোসিয়েশন-ইত্যাদি।
মহিলাদের সভা
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে ১লা এপ্রিল বিকাল ৫টায় ইণ্ডিয়ান এ্যাসোসিয়েশন হলে ভারতীয় মহিলা ফেডারেশনের উদ্যোগে মহিলাদের এক সভা হবে।
আরো যাঁরা বিবৃতি দিয়েছেন-ফরোয়ার্ড ব্লক, এস-এস-পি, ছাত্র পরিষদ, মানিকতলা গভঃ হাউসিং এস্টেট, টেনেণ্টস এসোসিয়েশন, লেখক, শিল্পী-শিক্ষাব্রতী ও সমাজকর্মী সংঘ যুব কংগ্রেস।