You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.08 | প্যারিসে রাষ্ট্রী ভোজ সভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণ | ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় - সংগ্রামের নোটবুক
শিরোনাম সূত্র তারিখ
৬৫। প্যারিসে রাষ্ট্রী ভোজ সভায় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধির ভাষণ ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় ৮ নভেম্বর, ১৯৭১

৮ নভেম্বর ১৯৭১ প্যারিসে রাষ্ট্রীয় মধ্যাহ্ন ভোজনে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ভাষন

আমার মন ছুয়ে গেছে আপনার কথায়, এবং আমি আপনাকে এবং আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাতে চাই ফ্রান্সের এই আতিথেয়তা ও বন্ধুত্বপূর্নতার জন্য। এক বছর আগে, জেনারেল দ্যা গল এর স্মরন সভায় শোক পালনে তাড়াহুড়ো করে এসেছিলাম। তিনি একজন বিশাল মর্যাদাবান ব্যাক্তি ছিলেন। দূর্দশার দিনে তিনি ছিলেন ফ্রান্সের গৌরবমূর্তী। আমরা ভারতীয়রা তাকে শ্রদ্ধা জানাই, জানাই তাকে সালাম।

ফ্রান্সের প্রতি আমাদের গভীর টান আছে। ফ্রান্স, ভারতের মতই এটি শুধু একটি দেশ নয়, এটি একটা বিশ্বাস। ইতিহাস জুড়ে আপনাদের এবং আমাদের পরিচয় আছে বিজয় এবং বিয়োগান্তের সাথে, তবুও আমরা চেষ্টা করেছি সামাজিক মূল্যবোধ গুলো বজায় রাখতে। বিগত কয়েক শতাব্দীতে, শিল্প এবং বিজ্ঞান, দর্শন এবং সাহিত্য এবং রাজনীতিতে, বিশ্ব ঋনী থাকবে ফ্রান্সের মত সৃজনশীল মননের জাতির কাছে। ফ্রান্স আমাদের শিখিয়েছে, উদ্দেশ্য এবং মানব জীবনে পরিস্থিতি, এবং আইন ও যুক্তির অগ্রগতি হচ্ছে স্বাধীনতা। আপনাদের দেশের মতো আর কোথাও জনগনের ভাগ্য নিয়ে এত তীব্র ও আন্তরিক ভাবে আলোচনা করা হয় না। ফ্রান্স কখনোই তার মহীমা ফিরে পেতে তার জনগনকে পন্য করেনি। গত ত্রিশ শতাব্দী ধরে, ভারতীয় সভ্যতার অর্জন হচ্ছে এর অবিচলতা। এই টিকে থাকা সম্ভব হয়েছে, সহনশীলতা আর আয়ত্তকরনের ক্ষমতা এবং বিশ্বাস যে, ক্ষমতা আর অবস্থানের চাইতে মানুষের জীবনের মুল্য অনেক বেশি।

অনেক উত্থান-পতনের পরে, আমরা আবারো ইতিহাসের মুলস্রোতধারায়। আমাদের ব্যাস্ত রাখা হয়েছিলো বছরের পর বছর সামন্ত তন্ত্র ও ঔপনিবেশিক শাষনের চিরস্থায়ী প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে। তখন আমরা শিল্প, প্রযুক্তি এবং সামাজিক পরিবর্তন থেকে বঞ্চিত হচ্ছিলাম। ভিন্ন মত ও অসন্তোষ কথার এবং অসংগঠিত প্রচারনার অভাবে একটি গনতান্ত্রিক সমাজের অর্জনের ফলাফল, একটি নিয়ন্ত্রিত সমাজের তুলনায় কম চিত্তাকর্ষক মনে হতে পারে। যদিও আমরা বিশ্বাস করি, গনতন্ত্র একটি নিশ্চিত এবং কার্যকর পদ্ধতি যা মানুষকে শক্তি দেয়।

স্বাধীনতা প্রত্যাশা কে জাগায় এবং গনতন্ত্র প্রতিযোগিতাকে উৎসাহিত করে। উন্নয়নের প্রথম অর্জন আরো নতুন দুঃশ্চিন্তার উদ্রেক করে। অপেক্ষাকৃত কম বিশ্বস্ত অঞ্চলের ও ধর্মের লোকেরা এখান থেকে কিছু সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে, যা আমাদের মত বিশাল বৈচিত্র পূর্ন দেশে একটু বেশি হয়ে থাকে। আমরা চেষ্টা করছি বিভিবন্ন বিভাগ গুলির মধ্যে বৈষম্য হ্রাস করা এবং খুদ্র ব্যক্তি পর্যায়েও বেশি করে সুযোগ প্রদান করা। আমাদের অনেক সংখা লঘু আছে। তারা সংখালঘু এবং জাতি হিসেবে সমস্ত অধিকার ভোগ করে থাকে।

আমরা অবশ্যই চাইবো আমাদের সমাজ প্রযুক্তির দ্বারা উপকৃত হোক, কিন্তু কখনোই প্রযুক্তির কাঠামো দ্বারা বন্দী হতে চাই না। আমাদের কোন ইচ্ছা নেই পশ্চিমের অভিজ্ঞতা কে পুনরাবৃত্তি করার, আমাদের জাতিগত ব্যাক্তিত্বকে নিজস্ব উপায়ে বিকশিত করতে দেয়া উচিত। উপাদানগত সমৃদ্ধির প্রবৃদ্ধি মানুষের একান্ত আয়কে সন্তোষজনক করে না। সমাজের উচিত সেই সব মূল্যবোধ কে অনুপ্রানিত করা যা মানুষকে পরিপূর্নতা খুজে পেতে সক্ষমতা দেয় এবং তার জগৎ কে উপভোগ্য করে তোলে।

এই নীতি আমাদের সকল প্রচেষ্টার পথনির্দেশক হয়েছে। বিপ্লব ছাড়া পুরোনো রীতিকে পরিবর্তন করা অথবা আশ্রয়ের জন্য জোড়জবরদস্তি ছাড়া, বিচিত্র মানুষগুলোকে যুক্তিযুক্ত ভাবে একটি আধুনিক জাতির ছাচে ফেলা অতো সহজ না। যেমন তেমন ঐক্যের প্রচেষ্টা হিসেবে কাজটি ছিলো সুবিশাল, একধরনের ধর্মান্ধ আবেদন আসে যা ধর্মীয় বা ধর্মীয় মতবাদ থেকে। এই শতাব্দীর পাদপ্রান্তে এসে, একটি যৌক্তিক গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায়, ভারতের সমস্যাকে বৃহত্তর দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা সবসময় দেখে এসেছি। আমরা মনে করি স্নায়ুযুদ্ধ পৃথিবীর বড় বড় সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করায়। এবং পারস্পরিক সহযোগীতার বদলে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। একথা অনস্বীকার্য যে কোল্ড ওয়ার এর ফল ভালো হয়নি। ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বৈরিতার অবসান কে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা আনন্দিত যে, অবশেষে চীন জাতিসংঘের সাথে যুক্ত হয়েছে, এবং মার্কিন যুক্ররাষ্ট্র এবং চীন সংলাপ শুরু করেছে। এই সময়ের মধ্যে, ফ্রান্স দূরদর্শিতা এবং সর্বোচ্চ শৃংখলার রাষ্ট্রনায়োকচিত ভাব প্রদর্শন করেছে।

সুতরাং, সেখানে একটি শান্তুপূর্ন বিশ্বের দিকে বিবর্তনের আশা করার অনেক কারনই ছিলো এবং স্বাভাবিক ভাবে ভারতেরও সেই আশা ছিলো। আমাদের গত সাধারণ নির্বাচন রাজনৈতিক স্থিতিশিলতার সৃষ্টি করেছে। যা অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আরো ত্বরান্বীত করেছে।

নতুন সরকার গঠনের এক সপ্তাহের মধ্যে, কোন সতর্কবাণী ছাড়াই এবং আমাদের পক্ষ থেকে কোন অন্যায় আচরণ না থাকা সত্ত্বেও একটি বিশালাকার নতুন বোঝা আমাদের ওপর এসে পড়ল। পূর্ব বাংলা থেকে প্রায় কম-বেশি ৯ মিলিয়ন – যে সংখ্যাটা বেলজিয়াম বা অস্ট্রিয়ার জনসংখ্যার সমান – এই পরিমাণ উদ্বাস্তু যাদেরকে পাকিস্তানের সামরিক শাসক তাড়িয়ে আমাদের দেশের ভেতরে জোর করে পুশ করেছে। এতে আমাদের আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে এবং আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনার জন্য হুমকি স্বরূপ। বিশ্বের কি এই আগ্রাসী ঘটনায় সজাগ হওয়া উচিৎ নয়? স্বাভাবিক অর্থে এটি গৃহযুদ্ধ নয়। এটা গণতান্ত্রিকভাবে ভোট দেয়ার অপরাধে বেসামরিক নাগরিকদের উপর নাজিল হওয়া গণহত্যা। এটা একটি প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে অসহায় মানুষকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করার সামিল। মানুষের আকাঙ্ক্ষা, স্বাধীনতার কামনা এবং মর্যাদার দাবীকে নির্বাপিত করা যায় না।

আমরা ভারত সর্বাধিক সংযম দেখিয়েছি। কিন্তু কোন সন্দেহ নেই যে, আমাদের স্থিতিশীলতা ও নিরাপত্তা হুমকির সম্মুখীন। এই সঙ্কটের মূল কারণ দূর করা উচিত। একটি রাজনৈতিক সমাধান বের করতে হবে। যা বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য হবে।