শিরোনাম | সূত্র | তারিখ |
৪৭। প্রেসিডেন্ট টিটোর ভারত সফর শেষে প্রকাশিত ভারত- যুগোস্লাভ যুক্ত ইশতেহার | ভারত সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ২০ অক্টোবর ১৯৭১ |
প্রেসিডেন্ট টিটোর ভারত সফর শেষে প্রকাশিত ভারত- যুগোস্লাভ যুক্ত ইশতেহার
২০ অক্টোবর, ১৯৭১
ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরির বন্ধুত্বপূর্ণ আমন্ত্রণে, ১৬ অক্টোবর থেকে ২০ অক্টোবর ১৯৭১ যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল জসিপ ব্রজ টিটো রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে আসেন। ভারত-যুগোস্লাভ এর অব্যাহত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং শান্তি, স্বাধীনতা, স্বাধীনতা ও আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধির জন্য এই সফর খুব গুরুত্ববহ।
যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট, ভারতের রাষ্ট্রপতি ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী গুরুত্বপূর্ণ বর্তমান আন্তর্জাতিক বিষয় এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উপর আলোচনা করেন।
যুগোস্লাভ দিকে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী ছিলেন:
জনাব রাটো ডুগ্নোজিজ, যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র প্রেসিডেন্সি সদস্য;
জনাব ইলিয়া রায়াচিচ, ভয়ভোডিনা স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ পরিষদের চেয়ারম্যান, ও যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র প্রেসিডেন্সি সদস্য; জনাব আন্তন ভ্রাতুসা, যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র ফেডারেল নির্বাহী পরিষদের সদস্য;
জনাব মার্কো ভ্রুনচে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিপরিষদ ভারপ্রাপ্ত প্রধান;
জনাব মিলোস মেলোভস্কি, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভায় পররাষ্ট্র কাউন্সেলর;
জনাব এডুয়ার্ড কিউন, পররাষ্ট্র ফেডারেল সচিবালয়ের এশিয়া বিভাগের প্রধান; এবং
জনাব আনডেল্কো ব্লাজেভিচ, দূতাবাসের নয়া দিল্লি যুগোস্লাভিয়া সমাজতান্ত্রিক ফেডারেল প্রজাতন্ত্র এর চার্জ দ্যা এফেয়ার্স.
ভারতীয় দিকে ছিল:
সরদার শরণ সিং, এক্সটার্নাল অ্যাফেয়ার মন্ত্রী;
ডঃ করণ সিং, বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রী; শ্রী সুরেন্দ্র পাল সিং, পররাষ্ট্র উপমন্ত্রী;
শ্রী টি এন কাউল, পররাষ্ট্র সচিব; শ্রী এস কে বন্দ্যোপাধ্যায়, সচিব (পূর্ব); শ্রী পি এন মেনন, সম্পাদক (পশ্চিম); শ্রী এইচ লাল, সচিব, বৈদেশিক বানিজ্য মন্ত্রী; শ্রী আর জয়পাল, ভারত যুগোস্লাভিয়া থেকে রাষ্ট্রদূত; শ্রী কে পি মেনন, যুগ্ম-সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; শ্রী আর ডি সাথী থেকে, যুগ্ম-সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; শ্রী উ পি ভেঙ্কাটেশরন, যুগ্ম-সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিবর্তন, বিশ্ব শান্তি, জাতীয় স্বাধীনতা এবং স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে তাদের প্রচেষ্টা সহ কিছু বিষয়ে একমত প্রকাশ করেন।
আইডেন্টিটি বা মতামতের ঘনিষ্ঠতা দু ‘দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
উভয় পক্ষই দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা আরও জোরদার করবে এবং বছরের পর বছর ধরে সংহত সম্পর্কের সাথে তারা এঁকে ওপরের কাছে সুপরিচিত। তারা স্বীকার করেন একটি দীর্ঘমেয়াদী ভিত্তিতে এটি আরও সম্প্রসারণ করা এবং সর্বক্ষেত্রে পারস্পরিক সহযোগিতার জন্য তাগিদ দেন। তারা নিয়মিত দ্বিপাক্ষিক আলোচনা চর্চা চালানোর সিদ্ধান্ত নেন।
দুই পক্ষের যৌথ কমিটির মাধ্যমে দুই দেশের অর্থনৈতিক উনয়নের প্রয়োজনীয়তা আলোচনা করেন এবং অন্যান্য সংস্থা উভয় দেশে বা তৃতীয় দেশের মধ্যে যৌথ প্রকল্প নিয়েও আলোচনা করেন। একটি পারস্পরিক সুবিধাজনক ভিত্তিতে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত দক্ষতার শেয়ারিং নিয়েও আলোচনা হয়।
পূর্ববাংলায় সাম্প্রতিক ঘটনার ফলে সৃষ্ট মারাত্মক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর ফলে ভারতের সৃষ্ট গুরুতর সামাজিক ও রাজনৈতিক উত্তেজনা ও অর্থনীতির উপর চাপ যুগোস্লাভিয়ার কাছে অনুভূত হয়েছে। শরনার্থিদের প্রবেশ – যার সংখ্যা প্রতিদিন হাজার হাজার বাড়ছে – এটি নিয়ে যুগোস্লাভ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। উভয় পক্ষ একমত হয় যে এই সমস্যা শুধুমাত্র নির্বাচিত প্রতিনিধিদের – যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছিল – তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা সমাধান করা যেতে পারে। পূর্ববাংলায় অবস্থা স্বাভাবিক হলে শরণার্থীরা জাতী-ধর্ম নির্বিশেষে নিরাপত্তা ও সম্মানজনকভাবে তাদের মাতৃভূমিতে ফিরে যেতে সক্ষম হবে।
উভয় পক্ষই অধিকার এবং পূর্ববাংলার জনগণের বৈধ স্বার্থ অনুযায়ী এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। জনগণের সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে গেলে সমস্যা আরও তীব্রতর হবে বলে তারা একমত হন।
উভয় পক্ষ একমত হয়েছে যে এই অস্থিরতা ও উত্তেজনার একটি সমাধান তাড়াতাড়ি না বের করলে অবস্থার গুরুতর অবনতি হতে পারে।
যুগোস্লাভ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যের ব্যাপারে শঙ্কিত কারণ তাঁর সাথে যা কিছু অন্যায় করা হচ্ছে তার পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে বলে তারা মনে করেন।
প্রেসিডেন্ট টিটো, দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করেন যে শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান এর স্বার্থে এবং শান্তি ও উপ-মহাদেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাপারে কোণ হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো হবেনা। তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জনাব ইয়াহিয়া খান এর প্রতি এই আবেদন করে যান ১৪ আগস্ট, ১৯৭১। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পূর্ববাংলার নির্বাচিত নেতা, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিশর্তে মুক্তিদানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য এটি অপরিহার্য।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেন ভারত সরকার চায় যে শরণার্থীরা তাদের মাতৃভূমিতে অবিলম্বে ফিরে যাক এবং এর জন্য যেসব ব্যাবস্থা করা দরকার তা করা উচিৎ। যুগোস্লাভ এর সঙ্গে একমত হয়। উভয় পক্ষ আরও একমত হয়েছে যে এই লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের সাহায্য করা সমগ্র বিশ্ব সম্প্রদায়ের উপর পরে।
দুই পক্ষই লক্ষ্য করে যে ইউরোপ যদিও এখনও বিভক্ত এবং তবুও শেষ যুদ্ধের বোঝা তাদের টানতে হচ্ছে। তবুও তাদের অবস্থার উন্নতি অনেক হয়েছে। সমতার ভিত্তিতে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা এবং শান্তি ও গঠনমূলক সহযোগিতার জোরদারের একটি পরিবেশ তৈরি হয়েছে।
উভয় পক্ষই মনে করে যে, তাদের মধ্যকার জোট নিরপেক্ষ নীতি তাদের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। যুগোস্লাভিয়া ও ভারতের নীতি বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ দেশগুলোর আন্তর্জাতিক কার্যক্রমে সহায়ক।
উভয় পক্ষই অশান্তিকর আন্তর্জাতিক আর্থিক সংকট ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে আলোচনা করেন। তারা উল্লেখ করেন যে, উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে দূরত্ব কমানোর জন্য কোন ব্যাবস্থা গৃহীত হয়নি। এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রভাবিত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
তারা পুনর্ব্যক্ত করে উন্নয়নশীল দেশগুলো যাদের অধিকাংশ বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক সংকটের দ্বারা প্রভাবিত তাদের আরও জোরাল পদক্ষেপ সম্মিলিতভাবে নিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি করতে হবে।
উভয় পক্ষই একমত যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে আন্ত-আঞ্চলিক, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক পর্যায়ে একসাথে কাজ করতে ইচ্ছুক। এই প্রসঙ্গে তারা তারা ব্যাংককে অনুষ্ঠিত এশিয়ান ফরেন ট্রেড মন্ত্রীবর্গের এবং গ্রুপ ৭৭ এর মিনিস্টিরিয়াল কনফারেন্স এর প্রতি গুরুত্বারোপ করেন।
তারা একমত হন যে U.N.C.T.A.D. -III তে গৃহীত পদক্ষেপ ও জাতিসঙ্ঘের দ্বিতীয় দশ বছর মেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনার গৃহীত পদক্ষেপগুলির বাস্তবায়নের ব্যাপারে উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি ঐক্যমত্য নিশ্চিত করতে হবে।
উভয় পক্ষই আন্তর্জাতিকভাবে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে সাধারণ ও সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণ এর প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
দুই পক্ষ জাতিসংঘের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেন এবং জাতিসংঘের সব সদস্যের বিধানাবলী পালন প্রয়োজনীয়তার গুরুত্বের সাথে নেন। তারা সদস্যপদের সার্বজনীনতা নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে একমত হন। তারা জাতিসঙ্ঘে ভুটান, বাহরাইন ও কাতারের যোগদানে স্বাগত জানান। তারা জাতিসংঘে চীনের বৈধ অধিকার অবিলম্বে পুনবিবেচনার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন। তারা মনে করে ইউ.এন এর বাইরে অন্যান্য দেশেরও ইউ.এন. এবং তার সংস্থার কার্যক্রমে অংশ নেয়া উচিৎ।
উভয় পক্ষই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং ঔপনিবেশিক আধিপত্য এর বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য তাদের সমর্থন ঘোষণা করেন এবং ঔপনিবেশিক দেশকে স্বাধীনতা প্রদানের ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের ঘোষণা অনুযায়ী উপনিবেশবাদ সম্পূর্ণ বর্জনের দাবি করেন। তারা মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা বিরোধী হিসেবে বর্ণবাদী নীতি ও চর্চার নিন্দা জ্ঞ্যাপন করেন।
দুই পক্ষের ইন্দো-চীন বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপের ধারাবাহিকতা ধরে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেন। শান্তি ও নিরাপত্তার স্বার্থে বাইরে থেকে কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই ইন্দো-চীন থেকে সব বিদেশি সেনা দ্রুত প্রত্যাহারের দাবী পেশ করেন। এ প্রসঙ্গে লক্ষনীয় যে দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের সাত দফা প্রস্তাব একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি গঠন করে। তারা আশা করেন ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়ার প্রশ্নে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান জেনেভা চুক্তিতে থাকবে।
দুই পক্ষই পশ্চিম এশিয়ায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতি এবং সংকট সমাধানের জন্য তাদের গুরুতর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা একমত যে ২২ নভেম্বর, ১৯৬৭ -এর নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি শান্তিপূর্ণ চুক্তি আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য দেয়া হয়েছিল। তারা ইস্রায়েল ও ফিলিস্তিনের জনগণের ন্যায়সঙ্গত অধিকারের প্রতি সম্মানসহ রেজোলিউশন তৈরি ও তার প্রয়োগের জন্য আবেদন করেন। তারা দীর্ঘস্থায়ী, স্থিতিশীল এবং স্থায়ী শান্তি অর্জনের প্রয়োজনীয়তার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ জানান। তার আমন্ত্রণ অত্যন্ত আনন্দের সাথে গৃহীত হয়।